সমরেশ মজুমদার
এই ভাল। সেই পুরনো কথাটাতেই ফিরে আসা, সুখের চেয়ে স্বস্তি ঢের ভাল। কারও সঙ্গে কোনও সংঘাত নেই, মেনে নেওয়া এবং মানিয়ে নেওয়ার টানাপোড়েন নেই। এই একা একা থাকার বাইরের কোনও উটকো ঝামেলা নেই। এখন যা কষ্ট নিজের তৈরি, তার জন্য কারও কাছে কৈফিয়ত দেবার দায়ও নেই। অনেক তো হল। একসময় নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হত। সেই নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে একটি মানুষের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়েছিল আন্তরিকভাবে। হওয়া গেল কোথায়? জীবন কোনও অঙ্কের হিসেবে চলে না। তার কোনও নিয়মও নেই। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের তাই নিত্যদিন সংঘাত। তাই কোনও পুরুষের সঙ্গে এক ছাদের তলায় বাস করেও যদি একা থাকতে হয়, মনের কথা মনে পুষে রেখে অন্য কথা বলতে হয়, তা হলে তার চেয়ে এই একা থাকা ঢের ভাল। অন্তত সকালে উঠেই রান্নাঘরে ছুটতে হয় না কারও মুখে চা তুলে দেবার জন্যে। নিজের মর্জিমতো চা বানাও, ইচ্ছেমতো রান্না করো। কিছু না করতে ইচ্ছে করলে টোস্ট এবং ওমলেট খেয়ে অফিসে যাওয়া যায়। দিনে দু’বার চা খেলে খিদেটা থাকে না। বাসের ভিড় ঠেলে বাড়ি ফিরে প্রথমে চা খাওয়া তারপর স্নান। এরপর যদি সেদ্ধভাত এবং সেইসঙ্গে তরকারি একটা বানিয়ে ফেলা যায় তা হলে সেটা খাওয়ার জন্যে রাত এগারোটা পর্যন্ত এটা-ওটা করতে বেশ জেগে থাকা যায়।
সমস্যা হল ওই রাতটাকে নিয়ে। অফিসে যাওয়া আসা এবং সেখানে কাজ করার যে ক্লান্তি, সারাদিনের স্বল্পাহারের ফলে পেটে যখন ভাত পড়ে তখন যে-আলস্য, তা নিঃসন্দেহে ঘুম এনে দিতে সক্ষম। কিন্তু দশটায় শুলে একটা নাগাদ জেগে বসতে হয়। তখন অনেক চেষ্টা করেও নিদ্রাদেবীর কৃপা পায় না দীপাবলী। ঘাড়ে মুখে জল দিয়েও স্বস্তি নেই। শরীরটা যেন কিছুতেই তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমোতে চায় না। সমস্ত পৃথিবী যখন গভীর ঘুমে ডুবে আছে তখন হয় অন্ধকারে ভূতের মতো বসে থাকো, না হয় আলো জ্বালিয়ে বই পড়ো। সেইসময় কোনও সিরিয়াস লেখা মোটেই ভাল লাগে না। হ্যাডলি চেজ কিংবা রবিন্সের লেখা স্বচ্ছন্দে পড়া যায়। বই পড়তে পড়তে কখন সকাল হয়ে যায় তা টের পায় না সে। অথচ দিল্লিতে থাকার সময় এমনটা কখনই হয়নি। অলোকের সঙ্গে হাজার ঝামেলা হলে শরীরে কষ্ট হয়েছে কিন্তু নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়নি। তাই দেরিতে রাত্রের খাওয়া শেষ করে আরও পরে বিছানায় যায় সে। ঘুম আসে। বারোটার ঘুম তিন-সাড়ে তিনটেতে ভেঙে যায়। সেইসময় বই পড়তেও ইচ্ছে করে না। অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকা। এই কষ্ট মারাত্মক। মাঝে মাঝে ঘুমের ওষুধ খেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ইচ্ছেটাকে এখনও দমন করতে পারছে দীপাবলী। একবার শুরু করলে ওর দাসত্ব করতে হবে চিরকাল।
এই রাতটুকু ছাড়া দীপাবলীর আর তেমন সমস্যা নেই। একা থাকতে হলে কিছু কিছু ব্যাপার সহ্য করতেই হয়। সেটাও তো একরকমের মজা। বাড়িতে বাজার নেই, আলু পর্যন্ত নেই। কিন্তু বাজারে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুধু চিঁড়ে খেয়ে একটা গোটা দিন দিব্যি কাটিয়ে দেয় সে। দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকলে এটা পারত না। ভাত খাওয়া হল না বলে মনে কোনও কষ্ট এল না। ইতিমধ্যে তার সংসারে দুটো জিনিস এসে গিয়েছে। মাসিক কিস্তিতে দাম শোধ করতে হচ্ছে। গ্যাস এবং ফ্রিজ। গ্যাসের টাকা একসঙ্গে দিতে হয়েছে। এ দুটোই তাকে যেন বাঁচিয়ে দিয়েছে। রান্নার ঝামেলা নেই আর সন্ধের রান্না পরের সকালেও গরম করে খাওয়া যায়। রবিবার সকালে একটু বেশি করে বাজার এনে ফ্রিজে রেখে দিলে পুরো হপ্তা তাই দিয়ে চলে যায়। প্রথম প্রথম খেতে বসার সময় খারাপ লাগত। বিশেষ করে ছুটির দিনে। সেদিন কারও সঙ্গে কথা বলা যায় না। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকো। অফিসে গেলে কাজের প্রয়োজনে কথা বলা যায়। কিন্তু ছুটির দিনে সময় যেন কাটতেই চায় না। তখন মনে হয় কেন ছুটি হল। মাসের তিরিশ দিনেই যদি কাজ করা যেত তা হলে যেন সে রক্ষা পেত। আর সেইসব দুপুরবেলায় একা খেতে বসে মাঝে মাঝে কান্না পেত দীপাবলীর। মুখে ভাত তুলতে পারত না। খাওয়াটা নিজের প্রয়োজনে, নিজের রুচিমতো। কিন্তু সেই খাওয়ার সময়ে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি যে আলাদা পরিবেশ তৈরি করে তা এর আগে এমন করে বোঝেনি। কিন্তু একসময় তো তাকেও একা থাকতে হয়েছিল যাদবপুরে। তখন তো এরকম মনে হয়নি। সেইসময় তার কোনও আকাঙ্ক্ষা বা প্রাপ্তি ছিল না। অলোকের সঙ্গে বাস করে যে অভ্যাস তৈরি হয়েছিল সেটাই বোধহয় এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হ্যাঁ, এটাও একা থাকার সমস্যা। জেনেশুনেই সে ব্যবস্থাটা নিয়েছে। তা নিয়ে আক্ষেপ করে লাভ নেই। প্রথম প্রথম দরজা কিংবা জানলায় শব্দ হলে ভয় করত। চমকে উঠত। কোনও বদমায়েশ লোক শব্দ করে, যদি দেখা করতে আসে এই আশঙ্কা অবশ্যই ছিল। ধীরে ধীরে সেটাও কাটিয়ে উঠেছে সে। এখন আর বাইরের কোনও পুরুষকে তার ভয় হয় না। অনেকদিনই তো পার্ক স্ট্রিটে কেউ না কেউ তাকে অনুসরণ করে। ভুলেও সে ফিরে তাকায় না। লোকগুলো যতক্ষণ প্রশ্রয় না পায় ততক্ষণ ওদের মতো ভীরু খুব কমই আছে। এই পাড়াটাও উত্তর কলকাতার মতো নয়। কেউ কারও ব্যাপারে নাক গলায় না। কে কী করছে তা নিয়ে কোনও কৌতুহল নেই। এটা স্বস্তিকর। দীপাবলী কার সঙ্গে থাকছে বা একা কেন, এমন প্রশ্ন কেউ করেনি এখনও। একা থাকতে গেলে শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবে।অসুস্থ হলেই বিপদ। বড় কিছু হলে না হয় নার্সিংহোমে গিয়ে থাকা যায় কিন্তু অল্প স্বল্প অসুস্থতায় কেউ এক গ্লাস জল গড়িয়ে দেবার নেই। ইদানীং একটা টেলিফোনের অভাব খুব বোধ করছে সে। টেলিফোন থাকলে কোনওমতে ডাক্তারকে ফোন করা যায়। খুব একা থাকার সময়ে কারও সঙ্গে কথা বললে একটু হালকা হয় চাপ। কিন্তু কথা বলার লোকও এই শহরে যে তেমন নেই।
রবিবার সকালে বাজারে যাচ্ছিল দীপাবলী। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখল ঠিক নীচের ফ্ল্যাটে দরজায় এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। স্বাস্থ্যবতী মধ্যবয়সিনী। এই সকালেই ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছেন কিন্তু বাইরে যাওয়ার ইঙ্গিত পোশাকে নেই। চোখাচোখি হতে হাসলেন মহিলা, ‘আমি আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘আমার জন্যে?’ দীপাবলী একটু অবাক।
‘আপনি তো প্রতি রবিবারে এইসময় বাজারে যান তাই ভাবলাম এখানেই ধরব। একবার ভাবলাম আপনার ফ্ল্যাটে যাই। কিন্তু ও বলল আপনি নাকি অফিসার, ঠিক না হলে রাগ করতে পারেন।’
‘কী ব্যাপারে বলছেন বুঝতে পারছি না।’
‘আপনার নাম কি দীপাবলী মুখার্জি?’
‘হ্যাঁ।’
‘তা হলে ঠিক। দাঁড়ান একটু।’ ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলেন। রহস্যটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বোঝা গেল। ভদ্রমহিলা ফিরে এসে একটা ইনল্যান্ড লেটার এগিয়ে ধরলেন, ‘কাল আমাদের লেটার বক্সে আপনার চিঠি ভুল করে ফেলে গিয়েছিল পিয়ন।’
চিঠি নিয়ে দীপাবলী হাসল, ‘আমি অফিসার তা জানেন নামটা জানেন না?’
‘আপনার ফ্ল্যাটের দরজায় তো লেখা নেই। এমনকী লেটার বক্সের গায়েও নয়। দেখুন, চিঠিতে ফ্ল্যাট নম্বর লেখা হয়নি। আর দারোয়ান আপনার পুরো নাম বলতে পারল না।’
‘তা হলে আমারই দোষ। ওগুলো লিখে রাখতে হবে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘না না। এ তো সামান্য ব্যাপার। আসুন না একদিন আমার ফ্ল্যাটে।’
‘আসব সময় পেলে।’
‘খুব ভাল লাগবে। তবে এলে দুপুর বেলাটা বাদ দিয়ে আসবেন। মানে বেলা বারোটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে নয়।’ ভদ্রমহিলা হাসলেন।
ঘাড় নেড়ে নেমে এল দীপাবলী। সে ভেবে পাচ্ছিল না হঠাৎ ভদ্রমহিলা কেন সময় বেঁধে দিলেন? ওইটে কোনও ভদ্রলোকের বাড়িতে যাওয়ার সময় নয়। ভদ্রমহিলাকে কেমন অস্বাভাবিক বলে মনে হতে লাগল ওর। সে ঠিক করল যাবে না। যত ঘনিষ্ঠতা হবে তত মানুষের কৌতূহলের সামনে পড়বে। আর তা থেকে তিক্ততায় পৌঁছে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কী দরকার গায়ে পড়ে ঝামেলা ডেকে আনার। হাতের চিঠিটা দেখল সে। অলোকের চিঠি। এখন বাজারে যাওয়ার পথে চিঠি খুলে পড়া সম্ভব নয়। বিশ্রী দেখাবে সেটা। দীপাবলী চিঠিটা রেখে দিল। অলোক যে এভাবে চিঠি লিখবে তা সে আশা করেনি। এমনটা ঠিক নয়। এই যে অলোক গায়ে পড়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে সেটা এক ধরনের ডিসিভিং ব্যাপার। ও নিজের সঙ্গে যতদিন প্রতারণা করবে ততদিন এমন ধারায় চলবে। যা সত্যি তার উলটোটা করার একটা মেকি চেষ্টা কি নিজের সঙ্গে প্রতারণা নয়?
বাজার সেরে বাড়ি ফিরে এল যখন তখনও মেজাজ ঠিক হয়নি। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইল বিছানায়। তারপর হাত বাড়িয়ে চিঠিটা তুলে নির্দয়ভাবে ছিঁড়ল। পরিষ্কার হাতে ইংরেজিতে লেখা গোটা সাতেক লাইন। বাংলা করলে এমন দাঁড়ায়, ‘দীপা, নিশ্চয়ই ভাল আছ। তোমার একটি চিঠি আমার ঠিকানায় এসেছিল। সেটি তোমার ঠিকানায় কি ইতিমধ্যে পৌঁছেছে? যাঁরা তোমায় চিঠিপত্র দিতে পারেন তাঁদের এবার নতুন ঠিকানা জানিয়ে দেওয়া ভাল। ফ্ল্যাট এখনও ছাড়িনি। ভাল থেকো। অলোক।’
ইংরেজি ভাষার সুবিধে নেবার জন্যেই বাংলায় লেখেনি চিঠিটা। এর আগে কখনও এমন হয়নি। হঠাৎ একটা তিক্ত অনুভূতি তৈরি হল। এই চিঠিটা না লিখলে অলোকের কী ক্ষতি ছিল? ঠাকুমার চিঠিটা দেখেই তো সে বুঝেছে ওটা রি-ডাইরেক্টেড হয়ে এসেছে। নতুন ঠিকানা যে জানিয়ে দেবে সে এটা বলার প্রয়োজন হয় না। অলোক ফ্ল্যাট রেখেছে কি রাখেনি সেটা ওর ব্যাপার, দীপাবলী নিশ্চয়ই খবরটার জন্যে উদগ্রীব নয়।
চুপচাপ শুয়ে রইল সে কিছুক্ষণ। নাকি তার মনে অন্য রকমের চিন্তা ছিল। সে কি ভেবেছিল অলোক ইনিয়ে বিনিয়ে তার একাকিত্বের কথা লিখবে? ঠিক যে-ভাষায় বিবাহ-পূর্ব পত্রাবলি লিখেছে সেই ভাষায়? এবং সেটা না দেখতে পেয়ে নিজস্ব অপমানবোধ তৈরি হল বলেই মনটা এমন বিশ্রী হয়ে গেল? তার রাগ, তার নির্লিপ্তি কি কোনও প্রত্যাশাকে কেন্দ্র করে?
আচমকা হেসে ফেলল দীপাবলী। প্রত্যাশা। যার কাছ থেকে পাওয়ার কিছু নেই, তার কাছে কেউ আশা করে? হঠাৎই মনে হল, তার কি দেওয়ার কিছু ছিল? না, আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মতো ভাল রান্না সে করতে পারে না। ইনিয়ে বিনিয়ে মিষ্টি কথা বলার অভ্যেস তৈরি হয়নি। মেয়েদের যেসব ন্যাকামি অনেক ছেলের ভাল লাগে তা এ-জীবনে রপ্ত করা হবে না। যা সত্যি তা বলতে কোনও দ্বিধা আসত না। এবং—! দীপাবলী স্থির চোখে ছাঁদের দিকে তাকাল। সেইসব রাতগুলো নিশ্চয়ই অন্যরকম ছিল। কিন্তু আলো জ্বেলে রেখে অলোকের ইচ্ছাপূরণ করতে সে কখনই পারেনি। অলোক ঠাট্টা করত! ‘এসব কি অন্ধকারের জিনিস বলে মনে করো? এটাও এক ধরনের শিল্প।’
হয়তো। সপক্ষে অনেক উদাহরণ আছে। ভারতবর্ষের মন্দিরগুলোর গায়ে মূর্তিদের আবরণ যা এককালের শিল্পীরা রেখে গেছেন অমর হাতে তা দেখে শিল্প না বলে উপায় নেই। আমাদের পৌরাণিক কাহিনিগুলোয় যে শারীরিক মিলনের বিবরণ তাও শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে অনেক জায়গায়। সারাপৃথিবী জুড়ে যৌনতাবিষয়ক বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা এখন হচ্ছে প্রকাশ্যে। শরীরের ওই খেলা এখন সাদা চোখে দেখা হচ্ছে। নরনারীর মানসিক এবং শারীরিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যাপারটা টনিকের মতো কাজ করে বলে অনেক বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। সবই ঠিক। কিন্তু আবাল্য যে-সংস্কার রক্তের কোষে কোষে ছড়িয়ে আছে তা এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলতে পারেনি দীপাবলী। তার মা ঠাকুমা বলে যাঁদের জেনেছিল তাঁরা কখনই নিম্নাঙ্গে অন্তর্বাসের সংখ্যা দুইয়ে নিয়ে যাননি। শাড়ি পরার বয়সে পৌঁছানোমাত্র দীপাবলী তাঁদের অনুসরণ করেছিল। বিদেশি মেয়েরা সেটা আমৃত্যু পরেন কারণ তাঁদের স্কার্ট বা প্যান্ট ব্যবহার করতে হয়। দিল্লিতে এসে যখন বুঝল মেয়েরা শাড়ির সঙ্গে প্যান্টি ব্যবহার করেও স্বচ্ছন্দ তখন অলোকের কথা ফেলতে পারেনি। এবং তা করে ব্যাপারটি বাস্তবসম্মত মনে হয়েছিল। পোশাক মানুষ পরবে প্রয়োজনের জন্যে। এককালে, বেশি কাল আগে নয়, এদেশীয় মেয়েরা সেমিজ ব্যবহার করতেন। কাঁধ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত সেই পোশাক যে কাজের ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকর নয় তা বুঝেই সায়া এবং ব্লাউজের চল এল। ঠিক একই ভাবে যদি শাড়ির নীচে দ্বিতীয় অন্তর্বাসের ব্যবহার স্বাচ্ছন্দ্য দেয় তবে তা ব্যবহার করতে আপত্তি কোথায়? কিন্তু এই পরিবর্তনে অলোকের অন্য বাসনা তৃপ্ত করতে পারেনি সে। হোক তাদের ফ্ল্যাটে তৃতীয় ব্যক্তি নেই, কিন্তু নিজের কাছেই লজ্জা করত। অলোক বলত বিদেশে সমুদ্রের ধারে ওই পোশাকে অবলীলায় শুয়ে থাকে মেয়েরা। আর বন্ধ দরজার এপাশে একটি বাঙালি মেয়ে শুধু তার স্বামীর সামনে সংক্ষিপ্ত দুটো অন্তর্বাস পরে বিচরণ করতে পারবে না কেন? পারেনি দীপাবলী। আলোক রেগে গেছে, অভিমান করেছে, আর কষ্ট পেয়েছে সে ওই কারণে।
হ্যাঁ, এ সবই তো না-দিতে পাবার তালিকায় যোগ হবে। দীপাবলী জানে না, বাংলাদেশের আর পাঁচটা বউ একই আচরণ করে কিনা। অলোক বলেছিল ‘শীতল স্ত্রী-যে কোনও পুরুষকেই উন্মাদ করে দিতে পারে যদি সে অপ্রকৃতিস্থ না হয়। সেক্সকে তুমি মাঝে মাঝে মাসান্তের অসুস্থতার মতো মনে করো।’ দীপাবলী অনেক কথা বলতে পারত না হয়তো। তবু কোনও কোনও ছুটির দুপুরের কথা ওকে মনে করিয়ে দিতে পারত। সেইসব মুহুর্তে অলোকের একটিবারের জন্যেও মনে হয়নি সে বরফের চাঁই জড়িয়ে শুয়ে আছে? নিশ্চয়ই তার খামতি ছিল। শারীরিক সম্পর্কহীন প্রেমপর্বে কখনই এই বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করা যায় না, রুচিতে লাগে। করতে পারলে হয়তো পরবর্তীকালের ঘটনার শিকার হত না দু’জনেই।
‘আমি অস্বাভাবিক।’ দীপাবলী ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল। মনে মনে কথা বলতে লাগল তার পরেই। আমি যা যা করেছি তা যেন কোনও বাঙালি মেয়ে না করে। করলে তাকে খুব কষ্টে থাকতে হবে। আর না-করলে যে–মেয়ের কষ্ট হবে তার পরিত্রাণের কোনও রাস্তা নেই। তবে কোন কষ্টটা বেশি কষ্টদায়ক সেটা তাকেই বুঝে নিতে হবে। অলোক যা যা চাইত তা সে করতে পারলে নিশ্চয়ই ছবিটা অন্যরকম হত। এখন এই সময়েও বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে স্বামীর সঙ্গে জীবন কাটাচ্ছে। তার সংখ্যা আর একটি বাড়েনি এই যা।
উঠে বসে চিঠিটা লিখে ফেলল দীপাবলী, ‘অলোক। অপ্রয়োজনীয় চিঠিটা লিখতে তোমারও নিশ্চয়ই ভাল লাগেনি। আমাদের দু’জনেরই বয়স হয়েছে। নিজের সঙ্গে প্রতারণা করে কেউ কি সামান্য আনন্দও পাব? পাব না। তাই না? দীপাবলী।’
ইনল্যান্ড ভাঁজ করতে করতে মাথা নাড়ল সে। রুচি রুচি। রুচি নিয়ে আমি মরলাম। কেন আমি একটু অন্যরকম হলাম না? হ্যাডলি চেজের উপন্যাসের সেইসব নায়িকার মতো যারা শুধুই জীবন দেখেছে তাৎক্ষণিকতায়। তা হলে হয়তো সবকিছুর সঙ্গে সেজেগুজে বেশ থাকা যেত। যার দশে হয় না তার একশোতেও হবে না।
জলপাইগুড়িতে যাওয়া দরকার। মনোরমাকে দেওয়া কথা রাখতে হলে সশরীরে সেখানে উপস্থিত হওয়া প্রয়োজন। দীপাবলী নিশ্চিত নয় মনোরমা তার সঙ্গে আসতে রাজি হবেন কিনা। কিন্তু তবু চেষ্টা করতে হবে। হঠাৎ তার মনে হল মনোরমা সঙ্গে থাকলে বেঁচে যাবে। একাকিত্ব যে চাপ তৈরি করে সেটা দূর হবে। কিন্তু মনোরমা বাঁচবেন আর কতদিন? জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন ভদ্রমহিলা। তারপর? তা ছাড়া ওঁর সংস্কার, ওঁর শুচিবায়ুগ্রস্ততা এসব তো খুবই মুশকিলে ফেলবে তাকে। এসব ভাবনা সত্ত্বেও ভেতরে ভেতরে টান বোধ করতে লাগল দীপাবলী।
কাজ না করতে করতে কাজ সম্পর্কে যাদের নিস্পৃহ ভাব তৈরি হয়, চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত নিয়মে ফিরতে হয় তাদের। দীপাবলীর সেকশনের মহিলারা মুখে যা-ই বলে যান এখন তাঁদের কাজটুকু করতে হচ্ছে। নইলে প্রতিদিন গোটা দশেক কেসের শুনানি হতে পারত না। এঁরা প্রথমে দীপাবলীকে আর একজন মহিলা বলেই ভেবেছিলেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা অন্যরকম হতে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের দোহাইগুলো কমে গিয়েছে। তবে দীপাবলী তাঁদের কিছু স্বাধীনতা দিয়েছে। যে-মহিলাটিকে রোজ সাড়ে তিনটের সময় ছেলেকে নিতে স্কুলে যেতে হত তাঁকে তিন দিন আগে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। সেই তিন দিন ঠিক দশটার সময় এসে তাঁকে কাজ শুরু করতে হবে। যিনি দেরিতে আসতেন তাঁকে যেমনভাবেই হোক দিনের কাজ দিনেই শেষ করতে হচ্ছে। অসন্তোষ থাকবেই কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি সে। ছেলেকে আনতে যাওয়া মহিলাটিকে বলেছিল, ‘আপনি আপনার স্বামীর সঙ্গে এই কাজটা ভাগ করে নিন। ছেলে তো তাঁরও। উনি ছুটি পান না বললে যদি রেহাই পান তা হলে তার দায় আপনার ওপর বর্তাবে কেন?’ ভদ্রমহিলা কোনও জবাব দিতে পারেননি। মাথা নিচু করে বসেছিলেন। দীপাবলী নিচু গলায় বলেছিল, ‘সংসার আপনার একার নয়।’ হঠাৎই ভদ্রমহিলা চোখের কোণে রুমাল চেপে ধরেছিলেন। ভেজা গলায় বলেছিলেন, ‘এগুলো যে ওকে আজও মুখ ফুটে বলতে পারলাম না।’
দীপাবলী মহিলাটির মুখের দিকে তাকাল অবাক হয়ে। বয়স বেশি নয়। কিন্তু চেহারায় লাবণ্য অথবা রূপের ছায়া আছে মাত্র। সে বলল, ‘এবার বলুন।’
মাথা নাড়লেন মহিলা, ‘আপনাকে কী করে বলি। আপনি অসন্তুষ্ট হবেন।’
‘আপনার সমস্যাটি কী?’
‘যা চলছে তা না চালালে ও অসন্তুষ্ট হবে। খুব রাগারাগি করবে। সেই অশান্তি আমি সহ্য করতে পারি না।’ মহিলা মুখ নামালেন।
‘আপনি কি বিয়ের আগে থেকেই চাকরি করছেন?’
‘হ্যাঁ। সেইজন্যেই তো বিয়েটা হল। সারাজীবন ধরে যৌতুক পেয়ে যাবে।’
‘আপনি এত জানেন, বোঝেন, তা হলে প্রতিবাদ করতে চান না কেন?’
‘এখন প্রতিবাদ করে কী হবে?’
‘কেন?’
‘প্রতিবাদ করলে আমি সংসার হারাব। স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা মেয়েদের আমাদের সমাজ এখনও পছন্দ করে না। সবাই সন্দেহ করবে। আর আলাদা হয়ে আমি কোথায় বা যাব? ভাইয়ের সংসারে গিয়ে থাকা মুশকিল। সে তা চাইবে না। এই মাইনেতে একা থাকতে গেলে বস্তিতে গিয়ে উঠতে হয়। ছেলেকে নিয়ে তা আমি পারব না। তাই ওঁর সঙ্গে আমাকে থাকতেই হবে। এইভাবেই, সারাজীবন।’
‘আপনাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই?’
‘সম্পর্ক? শুধু ছেলে এবং সংসারকে কেন্দ্র করে যতটুকু, ততটুকু।’
‘কেন এমন হল?’
‘আমি জানি না। হয়তো দেখতে ভাল নই, খুব রোগা, ওর এরকম মেয়ে পছন্দ হয় না। আবার আমি সাজলে গুজলে খুব রেগে যায়। বলে দাঁড়কাক ময়ূর হয় না।’
‘এই মানুষটিকে আপনি ভালবাসেন?’
মহিলা চোখ তুললেন, ‘আপনি এসব কথা কাউকে বলবেন না। প্লিজ। অফিসের সবাই জানে আমাদের খুব সুখের সংসার। তাই জানুক।’
দীপাবলী বুঝল ওই প্রশ্নটির উত্তর মহিলা দেবেন না। অথবা দিতে পারবেন না। তখনই কথা হল তাঁকে সে সপ্তাহে তিন দিন ছাড়বে। বাকি তিন দিন তাঁর স্বামীকে যেতে হবে স্কুলে, ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। এই ব্যাপারটা আজই ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে বলবেন। এবং কী হল তা জানাবেন তাকে।
ফল হয়েছিল। মহিলা এক ফাঁকে এসে জানিয়ে গিয়েছেন একটু রাগারাগি করলেও স্বামী ভদ্রলোক ব্যবস্থাটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। যেহেতু মহিলা বলেছেন রোজ সাড়ে তিনটেয় বেরিয়ে এলে মাইনে কাটা যাবে।
দীপাবলী জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি খুশি?’
মাথা নেড়েছিলেন মহিলা, ‘না। জানেন, আমার ভয় হচ্ছে ছেলেটাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ও ঠিকমতো খাবার দিতে পারবে না। হয়তো চারটের বদলে সাড়ে চারটের সময় স্কুলে যাবে ছেলেকে আনতে। আর ততক্ষণ বেচারা কান্নাকাটি করবে।’
দীপাবলী এখানেই কথা শেষ করেছিল। ভদ্রমহিলার গল্প আর শুনতে ইচ্ছে করেনি। পশ্চিমবাংলার ঘরে ঘরে স্বামী স্ত্রীর যে মানসিক বিরোধ তার সমাধানের কোনও রাস্তা তার জানা নেই। স্বামী যতই অন্যায় করুন, তাঁর সঙ্গে থাকা মানে একটা নিরাপদ জায়গায় থাকা এই বোধ নব্বুইভাগ মহিলার মনে পাকা হয়ে আছে। আর বিকল্পই বা কী? তা হলে তো বাসস্থানের সমস্যা আরও প্রবল হবে। এত থাকার জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে বিচ্ছিন্ন স্ত্রী পুরুষদের জন্যে? অতএব কিছু করার নেই।
অষ্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট টিম কলকাতায় টেস্ট খেলবে। দু’দিন পরে তাদের খেলা। হঠাৎ সকালবেলায় ডাক পড়ল আই এ সি-র ঘরে। ভদ্রলোক বেশ ভদ্রতা করলেন। বললেন, ‘আপনাকে আমরা এতদিন মিসেস ব্যানার্জি বলে জেনে এসেছিলাম কিন্তু আপনি মিসেস মুখার্জি?’
‘হ্যাঁ। বিয়ের আগে আমি চাকরিটা পেয়েছিলাম ব্যানার্জি হিসেবে।’ দীপাবলী বলল, ‘বিয়ের ডিক্লারেশন দিয়েছিলাম। কিন্তু ওটাই কেউ কেউ বলে যাচ্ছেন।’
‘কেউ কেউ মানে?’
‘যাঁরা জানেন তারা মুখার্জি বলেন।’
‘হ্যাঁ। কাল আপনার রেকর্ডস দেখলাম। অবশ্য অনেকেই তো প্রথম স্বামীর পদবি ক্যারি করে যাচ্ছেন। ফিল্মে তো এরকম চল আছে। যা হোক, সি আই টি আমাকে রিকোয়েস্ট করেছেন টেস্টম্যাচের কয়েকটা টিকিটের জন্যে। আমি অন্যান্য আই টি ও-দের বলেছি। কিন্তু ক্লাব হাউসের টিকিট দিতে পারেন এমন অ্যাসেসি আপনার ওয়ার্ডে আছে।’
‘আমায় কী করতে হবে?’
‘দুটো ক্লাব হাউসের টিকিট পাঠিয়ে দেবেন। আমি পৌঁছে দেব।’ ভদ্রলোক হাসলেন, ‘সিনহা অবশ্য এক ডজন দিয়ে গেল। কিন্তু ক্লাব হাউসের টিকিট মাত্র দুটো। আর আমাদের সি আই টি-র দরকার ছ’টা।’
‘কার কাছে পাওয়া যাবে জানি না কিন্তু তিনি তো পয়সা নিতে চাইবেন না। স্যার, এভাবে টিকিট নিলে পরে ভদ্রলোক সুবিধে আদায় করতে চাইবেন।’
ভদ্রলোক হাত তুললেন, ‘আমি এ-ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না। সি আই টি টিকিট চেয়েছেন, আমি জানিয়ে দিলাম। দ্যাটস অল।’
অফিসটা যেন হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সর্বত্র টিকিট টিকিট রব। এর মধ্যে অন্তত চারজন উকিলকে ফিরিয়ে দিয়েছে দীপাবলী। সে খেলা সম্পর্কে আগ্রহী নয় অতএব টিকিটের দরকার নেই। নমিতাদি এসে মিনমিন করে টিকিট চাইলেন তাঁর আত্মীয়ের জন্যে। জানালেন প্রতিটি সেকশনের স্টাফরা দুটো করে সিজন টিকিটের সেট পেয়েছে। আই টি ও-রা ডেকে ডেকে সবাইকে টিকিট দিচ্ছে। দীপাবলীর মনে হল চারপাশের স্রোত যখন সাগরমুখী তখন সে এদের যেন পাহাড়ে ফিরতে বলছে। ক্রমশ সে সবার চোখে অপরাধী হয়ে যাবে। এদের সবাইকে বিনা পয়সায় টিকিট দেওয়া যেন অফিসার হিসেবে তার কর্তব্য— ব্যাপারটা এই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। এইসময় সেই ভদ্রলোক এলেন। অমিয়কুমার সাহা। সি এ বি-র মেম্বার, অনেকগুলো মদের দোকানের মালিক। বিনীত গলায় বললেন, ‘প্রত্যেকবার টেস্ট ম্যাচের সময় আমি টিকিট দিয়ে থাকি। ক’টা দেব?’
দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘সিজন টিকিটের দাম কত?’
‘দাম? না না, দাম দিতে হবে না।’
‘আপনি নিশ্চয়ই বিনামূল্যে পাননি।’
অমিয়বাবু তাজ্জব, ‘এই প্রথম এমন কথা কোনও ইনকামট্যাক্স অফিসারের মুখে শুনলাম। দেখুন ম্যাডাম, ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের কাছে আমি কখনও কোনও ফেবার চাই না। যা রোজগার করি তা অডিট করিয়ে পাইপয়সা ট্যাক্স মিটিয়ে দিই। হ্যাঁ, কিছু ইনকাম আমি দেখাই না কিন্তু তা ধরার কোনও ক্ষমতা আপনাদের নেই। আমার খাতাপত্তর, হিসেব এবং ব্যাবসার সবকিছু খতিয়ে দেখে আপনারা কোনও খুঁত পাবেন না। তাই ভয় পেয়ে ঘুষ দেবার কোনও প্রশ্ন নেই। তবু আমি টিকিট দিতাম। দিতে হত।’
‘আপনি আমাকে চারটে সিজন টিকিট দিতে পারবেন? আমি টাকা দেব।’
‘বেশ। একশো পঁচিশ করে পাঁচশো টাকা দেবেন। ভদ্রলোক চারটে টিকিট সামনে রাখলেন, ‘ক্লাব হাউসের টিকিটগুলো কিন্তু টাকা দিয়ে কিনিনি।’ দীপাবলী এক মুহূর্ত ভাবল, ‘ওগুলোয় আমার প্রয়োজন নেই। তবে আই এ সি-র আছে।’
‘হ্যাঁ। উনিই চান। আপনার পূর্বসূরি টিকিট নিয়ে ওঁকে দিতেন।’
‘তা হলে ওই টিকিট দুটোর ব্যাপারে আমার কোনও করণীয় নেই।’
‘ম্যাডাম, আমি কি ওঁকে পৌঁছে দিতে পারি?’
‘সেটা আপনার ইচ্ছে।’
‘বুঝতে পেরেছি।’ অমিয়বাবু উঠতে যাচ্ছিলেন। দীপাবলী তাঁকে একটু অপেক্ষা করতে বলে নমিতাদিদের ডেকে পাঠাল। তাঁরা এলে সে চারখানা টিকিটের বই দেখিয়ে বলল, ‘অমিয়বাবুর কাছ থেকে চারখানা টিকিট পাওয়া গিয়েছে। এর বেশি কেনার সামর্থ্য আমার নেই। আপনারা নিজেরা ভাগ করে নিন।’
ব্যাগ খুলে সে পাঁচশো টাকা বের করল। গতকাল থেকেই টাকাটা সে ব্যাগে রেখে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। এইসময় ইন্সপেকট্রেস মহিলা বলে উঠলেন, ‘আপনি টাকা দিয়ে টিকিট কাটছেন?’
‘হ্যাঁ। বিনা পয়সায় নিলে অমিয়বাবুর ওপর অবিচার করা হবে কারণ বিনিময়ে কোনও সুবিধে তো আমি ওঁকে দিতে পারব না শুধু ভদ্রতা ছাড়া।’
‘তা হলে আমার টিকিটের দরকার নেই।’
‘মানে?’
‘আপনি কেন কিনে দেবেন। রোজগার তো আমরাও করি।’
‘আপনারা?’ অন্যান্যদের দিকে তাকাল দীপাবলী।
মহিলারা নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন কিছুক্ষণ। তারপর নমিতাদি মাথা নাড়লেন, ‘না। থাক। দরকার নেই।’
‘আপনার প্রয়োজন ছিল বলেছিলেন।’
‘নাঃ। আসলে ডিপার্টমেন্টে কেউ পার্টির কাছে টিকিট কেনে না বলেই চেয়েছিলাম, এখন লজ্জা করছে। না না, দরকার নেই। তবে, আমরা যদি চাঁদা করে কিনে নিই?’
বেশ তো। সেটা আরও ভাল কথা।’
‘চারটের দাম পাঁচশো টাকা, না? এত টাকা তো সঙ্গে নেই।’
‘ঠিক আছে। আমি এখন দিয়ে দিচ্ছি। পরে আপনারা আমায় দিয়ে দেবেন।’
পিয়ন মেয়েটি চুপ করে ছিল। এবার বলল, ‘আমি তো চাঁদা দিতে পারব না। আমার ভাই খুব ধরেছিল দেখবে বলে। কোথাও টিকিট পাচ্ছে না।’
দীপাবলী নিস্পৃহ মুখে বলল, ‘তোমার সম্পর্কে কিছু কথা আমি শুনেছি। ওগুলো যদি না করতে তা হলে আমি ভেবে দেখতাম। ঠিক আছে, ওকে একদিনের স্লিপ আপনারা দিয়ে দেবেন। আমাকে পঁচিশ টাকা কম দিলেই হবে। সমস্যার সমাধান হল?’
নমিতা একগাল হাসলেন, হ্যাঁ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘কিন্তু আপনারা পাঁচদিনই কামাই করবেন নাকি?’
সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘না।’ জানা গেল মহিলারা টিকিট নিচ্ছেন তাঁদের ছেলে ভাই বা স্বামীর জন্যে। পাঁচশো টাকা নিয়ে অমিয়বাবু উঠে দাঁড়ালেন, ‘এটা আমার কাছে একটা অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। আমি মদ বেচি, কিন্তু খাই না শুনে কেউ কেউ অবাক হয়। এই অভিজ্ঞতা তার লক্ষগুণ বেশি চমকপ্রদ। নমস্কার।’
দশ মিনিট পরে আই এ সির ফোন এল। তিনি ক্লাব হাউসের টিকিটের জন্যে ধন্যবাদ জানালেন। দীপাবলী বলল, ‘আমাকে ধন্যবাদ দেবেন না স্যার। ওটা মিস্টার সাহা আপনাকে দিয়েছেন।’
‘আরে কে দিল সেটা বড় কথা নয়, পেয়েছি সেটাই সত্যি।’ আই এ সি লাইন কেটে দিলেন। সেদিন বাড়ি ফিরে দীপাবলী তাজ্জব। তাদের ফ্ল্যাটবাড়ির একতলায় মনোরমা বসে আছেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন