১৩. ন্যাড়া গাছটা

সমরেশ মজুমদার

ন্যাড়া গাছটাকে আর চেনার উপায় নেই। কচি সবুজ পাতায় তার চেহারা এখন বড় আদুরে। শুধ গাছ নয়, মাটি ফুঁড়েও কিছু উদ্ভিদ মুখ তুলেছে। এগুলোকে ঠিক ঘাস বলতে আপত্তি আছে দীপাবলীর। চা-বাগানের মাঠে যে চাপড়া বাঁধা ঘাস ছড়িয়ে থাকে তা এখানে কোনওকালেই হবে না। কিন্তু যা হল তা কম কী! সতীশবাবুরা বলেন দেখতে দেখতে এসব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। গাছটা পাতা খসিয়ে দিতে বাধ্য হবে। সত্যি কথা। কিন্তু দীপাবলীর ইচ্ছে ওগুলো তিন মাসের নোটিশ শেষ হওয়া পর্যন্ত টিকে থাক। অন্তত যাওয়ার সময় একটু সবুজ দেখে যেন যেতে পারে।

টেলিগ্রাম পাওয়ার পর ক’দিন বেশ টেনশনে ছিল সে। কিন্তু অমলকুমার আসেনি, তার বদলে চিঠি এল। দীপাবলী, টেলিগ্রামটার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আসলে অনেক কিছুর মতো শেষ মুহুর্তে আমাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়েছিল। এই চিঠি আমি লিখছি কলকাতা থেকে। জলপাইগুড়ি ছেড়ে আসার আগে মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল রামপুরহাটে নেমে তোমাকে দর্শন করে আসবেন। লোকে রামপুরহাটে নামে তারাপীঠ দর্শনের জন্যে। মায়ের সেই ইচ্ছে ছিল না যা সম্ভবত দেবীকে ঈর্ষান্বিত করেছিল। তিনি বোধহয় কোনও প্রতিযোগীকে সহ্য করতে পারেন না। ফলে আসার দিন সকালে মা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন যাত্রার দিন পিছোতে হল। মায়ের সুস্থ হওয়া এবং আমার নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার মধ্যে সময় এত অল্প ছিল যে বাধ্য হয়েছি সরাসরি চলে আসতে।

একটু অবাক হয়েছ নিশ্চয়ই। জলপাইগুড়িতে বসে বাড়ির ভাত খেয়ে শৌখিন ব্যাবসা করে যার বেশ দিন চলে যাচ্ছিল সে কী করে হঠাৎ চাকরি করতে কলকাতায় এল! বছর দেড়েক আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে একটা আবেদন করেছিলাম। পরীক্ষা ইত্যাদি চুকে যাওয়ার পর বিস্মরিত হয়েছিলাম ব্যাপারটা। হঠাৎ ইন্টারভিউয়ের ডাক এল। কাউকে না জানিয়ে কলকাতায় গিয়ে দিয়েও এসেছিলাম সেটা। দেখা গেল কোনও মামা পেছনে না থাকা সত্ত্বেও কখনও কখনও এ-দেশে চাকরি পেয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে যায়। মাইনেপত্র এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা যা তাতে মনে হয়েছে ব্যাবসা করার শৌখিনতা আমার ত্যাগ করা উচিত। সত্যি বলতে কী ব্যবসায়ীর কোনও গুণ আমি এ জন্মে রপ্ত করত পারতাম না।

অতএব এখন কলকাতায়। বাসা নিয়েছি একজন পরিচিতের সূত্র ধরে কর্নফিল্ড রোডে। মা এর মধ্যে বেশ গুছিয়ে বসেছেন। টেলিগ্রামটার জন্যে তিনিও লজ্জিত। তুমি ছুটিছাটা পাও না? সরকারি অফিসারদের কি কলকাতায় আসার প্রয়োজন হয় না? যদিও এখানে তোমার চেনা হস্টেল নিশ্চয়ই আছে তবু এই ভাড়া বাড়িতে একটি অতিরিক্ত ঘর পাওয়া গেছে, খবরটা তোমাকে জানিয়ে রাখলাম। ভাল থেকো। অমলকুমার।’

চিঠি পড়ে মন বেশ ভাল হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে উত্তর লিখতে বসল। অমলকুমারের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হোক এই কামনা জানিয়ে নিজের কথা খানিকটা আড়াল রেখে শেষ করল, ‘ছুটির কথা বলছিলে না? এক জায়গা থেকে ছুটি চাইলেই চট করে পাওয়া যায়! নিয়ম মানতে ধৈর্য ধরতেই হয়। আমারও এ ছাড়া কোনও উপায় নেই!’

দীপাবলী একটা ব্যাপারে বেশ অবাক হচ্ছিল। পদত্যাগপত্র সে পাঠিয়েছে প্রপার চ্যানেলে। অথাৎ এস ডি ও বা ডি এম-এর হাত ঘুরে তা যাবে কলকাতায়। কিন্তু এই দুই ওপরওয়ালা কোনওরকম বিস্ময় প্রকাশ করেননি। নিত্য সরকারি সার্কুলার বা চিঠিপত্র অফিসে আসছে। পদত্যাগপত্র দেখে কারণ জানতেও কেউ চাইল না! মানুষ এত নির্লিপ্ত কখন হয়। সে কি এই দুই ভদ্রলোকের গলগ্রহ হয়ে যাচ্ছিল!

ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হল পরের সপ্তাহে ডি এমে সঙ্গে মিটিং-এ। নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বললেন তিনি। কী করতে হবে তার নির্দেশ দিলেন। দু’বছর আগের করা ভোটার লিস্টটাকে অনুসরণ করতে হবে সবাইকে। মিটিং-এর পরে তিনি দীপাবলীর সঙ্গে আলাদা কথা বললেন, ‘আপনার ওখানে তো দিবাকরবাবু দাঁড়িয়েছেন। শুনেছি খুব সজ্জন লোক। কমিউনিস্ট পার্টির ক্যান্ডিডেটের চান্স কেমন?’

‘আমি দিন কয়েক আগে ওঁর নাম শুনেছি।’

‘হুম। দিবাকরবাবুকে হারানো খুব মুশকিল।’

হঠাৎ দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি দিবাকরকে দেখেছেন?’

চমকে উঠলেন ডি এম, ‘মানে?’

‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছিল আপনি ওঁকে খুব ভাল চেনেন।’

‘শুনেছি। একেবারে যাকে বলে মাটি থেকে উঠে আসা মানুষ। কোনওরকম মতবাদে অন্ধ নন। এইটেই তো চাই।’

‘আপনি আমাকে কী জন্যে ডেকেছেন?’

‘নির্বাচনের আগেই ওখানে বিখ্যাত পরিচালক সুবিনয় সেন শুটিং করবেন? আপনি কি মনে করেন কোনও গোলমাল হবার আশঙ্কা আছে?’

‘বিন্দুমাত্র না। অবশ্য যতক্ষণ অর্জুন নায়েক ওঁকে সাহায্য করবেন।’

‘না না। অর্জুনবাবু তো সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছেন।’

‘তা হলে কোনও সমস্যা নেই। উনি যতদিন পাশে থাকবেন ততদিন আপনাদের কোনও দুশ্চিন্তা থাকছে না।’

‘হুম। আপনি আবার এর মধ্যে ছুটি নিয়ে চলে যাবেন না তো?’

‘না। তেমন ইচ্ছে নেই।’

‘কোথাও বড় চাকরি পেয়েছেন নিশ্চয়ই। কে যেন বলছিল কলেজে পড়াতে যাবেন। অবশ্য মেয়েদের সেটা খুব সেফ এলাকা।’

‘মাপ করবেন। আমি এম এ পরীক্ষার দরজা পর্যন্ত কখনও পৌঁছাইনি। এ-দেশের কলেজে পড়াতে গেলে অন্তত এই ডিগ্রিটা দরকার হয়। আর এসব আমার একদম ব্যক্তিগত ব্যাপার।’ উঠে দাঁড়িয়েছিল দীপাবলী।

সুবিনয় সেন এখন এখানে শুটিং করছেন। এমন এলাহি ব্যাপার এ-তল্লাটের মানুষ আগে কখনও দ্যাখেনি। যাতায়াতের সময় বাঁচানোর জন্যে স্কুলটাকে তিন সপ্তাহের জন্যে বন্ধ রাখা হয়েছে অর্জুন নায়েকের হুকুমে। স্কুলবাড়ির মাঠে তিনদিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি খড়ের ঘর তৈরি করে পুরো ইউনিটের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। নায়ক এবং সুবিনয় সেন স্কুল বাড়িতে আছেন। ওঁদের জন্যে বেশ কয়েকটা সাময়িক বাথরুম পায়খানা তৈরি হয়েছে মাঠেই। কলকাতার ঠাকুর দু’বেলা রান্না করছে। নায়িকার কাজ শুরু হতে দেরি আছে বলে তিনি দলের সঙ্গে আসেননি। একটা কথা ঠিক শুটিং-পার্টি আসায় সমস্ত তল্লাটটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বৃষ্টির পরে রোদ উঠছে নিয়মিত, পাতাগুলো বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ার মুখে, কিন্তু মানুষের উৎসাহ বেড়ে গেছে অনেকগুণ।

হাটতলার ট্যাক্সিগুলো দিনরাত ভাড়া খাটছে শুটিং-এ। আগামী নির্বাচনে যারা দিবাকরের হয়ে খাটবে তারা কাজ পেয়েছে রোজের ভিত্তিতে। ভিড় সরাতে. যে-বাহিনী তৈরি হয়েছে তারা দু’বেলা খাওয়া নিয়ে কুড়ি টাকা করে পাচ্ছে। দীপাবলীর নির্দেশে স্থানীয় নতুন দারোগা প্রথমদিন গিয়ে সব বুঝেসুঝে রিপোর্ট করে গিয়েছেন, পুলিশের কোনও প্রয়োজন হবে না। অর্জুনবাবু সবকিছু যাতে শান্তিতে শেষ হয় তার ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

শুটিং-এর আগের দিন বিকেলে সুবিনয় সেন দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁকে চা খাইয়েছিল দীপাবলী। রোদ মরে যাওয়ার বাইরে চেয়ার পেতে বসেছিল ওরা। সুবিনয় সেন বলেছিলেন, ‘তোমায় কাল স্পটে চাই।’

‘কেন?’ হেসেছিল দীপাবলী।

‘শুটিং শুরু করছি, তুমি এখানকার কর্ত্রী, তুমি থাকবে না?’

‘তা হলে তো আমার যাওয়া হল না।’

‘কেন?’

‘কারণ আমি এখানকার কর্ত্রী নই।’

‘কিন্তু খাতায় কলমে তো এখনও আছ।’

‘আপনি জানেন বলে মনে হচ্ছে।’

‘হ্যাঁ। অর্জুন আমাকে বলেছে তুমি পদত্যাগ করছ। কেন জিজ্ঞাসা করব না। আচ্ছা, তোমার সঙ্গে আমার যদি কোনও ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে থাকে তার সুবাদেই না হয় এসো৷’

‘ক্ল্যাপস্টিক দিতে হবে?’ আবার হেসেছিল দীপাবলী।

‘নাঃ। সে দায় মিস্টার শ্রীবাস্তবের। তিনি আগামীকাল সকালেই এখানে পৌঁছে যাবেন। আলাপ হলে বুঝবে আলাদা ধরনের মানুষ।’

দীপাবলী গিয়েছিল। ঠিক সকাল সাতটায় গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। মাইল দুয়েক দূরে টিলামতো জায়গায় শুটিং হবে। প্রচণ্ড ভিড় হয়েছে এই সাতসকালে। দিবাকরের বাহিনী তাদের সামাল দিচ্ছে। দীপাবলী গাড়ি থেকে নেমে দেখল অর্জুন নায়েক এস ডি ও সুবিনয়বাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। তাকে দেখতে পেয়ে অর্জুন কয়েক পা এগিয়ে এল, ‘আসুন আসুন। মিস্টার সেনকে বলছিলাম একমাত্র পুজোর মেলা না হলে এত মানুষকে এক জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় না।’

অর্জুন এমন সরল গলায় কথা বলল যেন তাদের সম্পর্ক খুব ভাল। দীপাবলী তাকে জটিল না করে উত্তর দিল, ‘ভালই তো, আর একটা মেলা পাওয়া গেল।’

এস ডি ও ঘড়ি দেখছিলেন, ‘দশটার পর তো কাজ করতে পারবেন না। ডি এম-এর যে কেন দেরি হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’

সুবিনয় সেন বললেন, ‘প্রথমে দিনের দৃশ্যগুলো তুলব কয়েকদিন ধরে। সকাল ছ’টা থেকে দশটা আবার বিকেল তিনটে থেকে যতক্ষণ আলো পাওয়া যায়।’

অর্জুন ঠাট্টা করল, ‘তা হলে মেমসাহেবকে ধরুন। উনি প্রার্থনা করলে আকাশে মেঘ জমতে পারে। আপনার কাজের সময় বাড়বে।’

‘না না। মেঘ চাই না। তা হলে কন্টিনিউটির গোলমাল হয়ে যাবে।’ সুবিনয় সেন হাত নাড়লেন। তারপর সহকারীকে বললেন, ‘স্বপনকে ডাকো তো।’

সহকারী ছুটল। একপাশে চাঁদোয়া খাটিয়ে চেয়ার টেবিল পাতা হয়েছে। সেখান থেকে এক সুদর্শন ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে এল। সুবিনয়বাবু বললেন, ‘স্বপন, এঁদের সঙ্গে তোমার আগেই পরিচয় হয়েছে। এঁর নাম দীপাবলী। একজন সরকারি অফিসার। এককালে গ্রুপ থিয়েটারে দারুণ অভিনয় করত। আর এ হল স্বপন, নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। এই ছবির নায়ক।’

মাথা দুলিয়ে যেন নমস্কার সেরে নিল স্বপন। দীপাবলী হাত জোড় করেছিল। তার মেজাজ খারাপ হল। স্বপন বলল, ‘সুবিনয়দা যখন অভিনয়ের প্রশংসা করলেন তখন নিশ্চয়ই ভাল করতেন। তা হলে ছাড়লেন কেন?’

‘উনি স্নেহ করেন বলে অতিরঞ্জিত করেছেন।’

এইসময় ডি এম-এর জিপের পেছন পেছন একটি সাদা গাড়িকে আসতে দেখা গেল। ডি এম-এর জিপ থেকে তাঁর স্ত্রী নামলেন। এস ডি ও ছুটে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে জানালেন মন্ত্রী আসবেন বলে ডি এম শহর ছাড়তে পারেননি। তাই স্ত্রীকে পাঠিয়ে সুবিনয়বাবুকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সাদা গাড়ি থেকে একটি সুদর্শন প্রবীণ ভদ্রলোককে নামিয়ে নিয়ে এলেন সুবিনয়বাবু। নায়ক বিগলিত হয়ে তাঁকে নমস্কার করল। তিনি হাসলেন। বছর ষাটের ওপর বয়স। পরনে সাদা শার্ট প্যান্ট। সুবিনয়বাবু ওঁর সঙ্গে সবার আলাপ করিয়ে দিলেন। শ্রীযুক্ত দীননাথ শ্রীবাস্তব। বর্তমান ছবির প্রযোজক। তিনিই ক্ল্যাপস্টিক দিলেন। ছবির প্রথম দৃশ্যগ্রহণ করা হল। না, নায়ক স্বপনকে নিয়ে নয়। দু’জন অভিনেতা একটি ঘোড়ার ওপর মালপত্র চাপিয়ে গ্রাম্যবেশে আসছে— শুধু এই দৃশ্যটি। যতক্ষণ না সুবিনয়বাবুর পছন্দ হল ততক্ষণ অভিনেতা এবং কলাকুশলীদের বারংবার একই কাজ করতে হচ্ছিল। দ্বিতীয়বার দেখার পর বিরক্তি এসে গেল। স্থানীয় দর্শকরা একবার হেসে উঠল মজা পেয়ে। অর্জন তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘কারও যদি বেশি হাসি পেয়ে থাকে তা হলে পরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো।’ সঙ্গে সঙ্গে জনতা একদম চুপচাপ। দীপাবলী লক্ষ করল ওরা আর আগের মতো সহজ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নেই।

দৃশ্যটি গৃহীত হওয়ামাত্র চা এল। এই টিলার পাশেই শুটিং কোম্পানি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। সুবিনয়বাবু একপাশে দাঁড়িয়ে শ্রীবাস্তব সাহেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন। হঠাৎ হাত তুলে দীপাবলাকে ডাকলেন। দীপাবলী যেন বেঁচে গেল। ঠিক তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডি এম-এর স্ত্রী। কিন্তু তিনি এমন ভঙ্গি করছিলেন যেন এখানে মহিলা বলতে একমাত্র তিনিই আছেন। দীপাবলীর দিকে ভুলেও তাকাচ্ছিলেন না। পদমর্যাদায় যে তিনি অনেক ওপরের তলায় তা বুঝিয়ে দিতে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। অস্বস্তি হচ্ছিল দীপাবলীর। এখনও অনেক মহিলা স্বামীর চাকরিকে নিজের চাকরি বলে মনে করেন। স্বামীর বোনাস পাওয়া মানে তাঁরই পাওয়া। এক্ষেত্রে পদমর্যাদার অহংকার সেই কারণেই। সুবিনয়বাবু ডাকতে দীপাবলী এগিয়ে গেল।

সুবিনয়বাবু বললেন, ‘শ্রীবাস্তব সাহেবকে তোমার কথা বলছিলাম।’

অপ্রস্তুত দীপাবলী, ‘আমার কথা মানে?’

এবার দীননাথ শ্রীবাস্তব পরিষ্কার বাংলায় কথা বললেন, ‘শুনলাম আপনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন। এরকম খবর খুব কম পাই।’

‘ও। আসলে আমি কাজ করতে চেয়েছিলাম। ছেলেবেলা থেকে আমার অ্যাম্বিশন ছিল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কাজ করব। ডবলু বি সি এস দিয়েছিলাম। ওপরের দিকে কিছু পাইনি খারাপ ফল হওয়ায়। কিন্তু এই চাকরিতে কিছু করার পাচ্ছি না। করতে দেওয়া হচ্ছে না।’

দীননাথ চোখ বন্ধ করে শুনলেন, ‘শেষ কথাটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট।’

‘হ্যাঁ। তাই।’

‘তা হলে আপনি লড়াই করতে চান?’

‘চাই কিন্তু লড়াই করার জায়গা খুঁজতে হবে।’

এইসময় সুবিনয় সেন বললেন, ‘তুমি ফিল্‌মে এসো। আমি তোমার ভাল ব্রেকের ব্যবস্থা করব।’ তারপর শ্রীবাস্তব সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি ওর অভিনয় দেখেছি। শি ইজ এ ভেরি গুড অ্যাকট্রেস।’

‘আই ডোন্ট থিঙ্ক সো’ মাথা নাড়ল দীপাবলী, ‘আমি কোনও কনস্ট্রাক্টিভ কাজ করতে চাই।’

‘আপনার, কিছু মনে করবেন না, বয়স কত?’ শ্রীবাস্তব জানতে চাইলেন।

দীপাবলী জানাল। ওইরকম একজন প্রবীণ মানুষ তাকে তখন থেকে আপনি বলে যাচ্ছেন, একবার ইচ্ছে হয়েছিল আপত্তি করতে, কিন্তু ভদ্রলোক যে দূরত্ব রেখে কথা বলছিলেন তাতে মেনে নেওয়াই ঠিক বলে ভাবল।

দীননাথ শ্রীবাস্তব এবার চারপাশে তাকালেন, ‘মিস্টার সেন, আমি এবার যাচ্ছি। আশা করি আপনার কাজ ভালভাবে শেষ হবে।’

‘আপনি কি কলকাতায় থাকবেন?’

‘না। কালই বম্বে যেতে হবে। ফিরব দিন পাঁচেক বাদে। আপনার কোনও অসুবিধে হলে চৌধুরীকে কনট্যাক্ট করবেন। ওকে সমস্ত ইনস্ট্রাকশন দেওয়া আছে।’ শ্রীবাস্তব দু’পা এগিয়েই থেমে গেলেন। দীপাবলীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চাকরি ছেড়ে দেবার পর আপনি কি কলকাতায় যাবেন?’

‘হয়তো। কিছু ঠিক করিনি।’

‘ও। কলকাতায় গেলে আপনার ইচ্ছে হলে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। কারও ভেতরে ফাইটিং স্পিরিট থাকলে তার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগে।’ কথা শেষ করে উপস্থিত অতিথিদের হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন দীননাথ শ্রীবাস্তব। গাড়ি বেরিয়ে গেল।

আবার যখন কাজ শুরু হতে যাচ্ছে তখন এস ডি ও সামনে এলেন, ‘তা হলে আমাদের মায়া ত্যাগ করলেন?’

‘মায়া তো তৈরিই হল না, ত্যাগ তো পরের কথা।’

‘ও। আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি। আপনার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে আমাকে চার্জ বুঝিয়ে দেবেন। অবশ্য যদি আপনার জায়গায় কোনও অফিসার এসে যায় তা হলে আলাদা কথা।’

দীপাবলী হাসল, ‘আমাকে কিন্তু কেউ বুঝিয়ে দেয়নি। আমি এসেছি এবং কাজ শুরু করেছি।’

ভদ্রলোক থতমত হয়ে বললেন, ‘আরে না না। আমি সেরকম কিছু বলছি না। এটা একটা চলতি কথামাত্র।’ বলেই চলে গেলেন তিনি ডি এম-এর স্ত্রীর কাছে। বিগলিত হয়ে কথা বলতে লাগলেন। ভদ্রমহিলা যে স্বস্তি পেলেন কথা বলতে পেরে তা না বুঝিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে শালিখের মতো হাঁটতে লাগলেন।

দীপাবলী সুবিনয়বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিল। তিনি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন তার ফিরে যাওয়ার জন্যে। দীপাবলী বুঝল অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে আছে।

নতুন দারোগা শঙ্কর ঘোষের বয়স বেশি নয়। কথাবার্তায় ভদ্র। জয়েন করে দেখা করে গিয়েছিলেন। ভদ্র কিন্তু একটু বেশি কথা বলেন। শুটিং-এর প্রথম দিন বিকেলে তিনি এলেন। দীপাবলী অফিসেই ছিল। ভেতরে ঢুকে নমস্কার করে বসলেন, ‘ম্যাডাম, শুনলাম আজ সকালে আপনি শুটিং স্পটে গিয়েছিলেন।’

‘হ্যাঁ। ওঁরা নেমন্তন্ন করেছিলেন। কিন্তু তখন আপনাকে দেখলাম না তো!’

‘অর্জুন নায়েক নিষেধ করেছিলেন।’

‘কী আশ্চর্য! অর্জুনের কথায় আপনি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন? যদি কিছু গোলমাল হত তা হলে কী কৈফিয়ত দিতেন? আমাকে ছাড়ত ওপরওয়ালা। আমি তো আপনাকে নোট পাঠিয়েছিলাম।’ দীপাবলী রেগে গেল।

‘সব ঠিক ম্যাডাম।’ শঙ্কর ঘোষ তাঁর টাক চুলকালেন, ‘আমার হয়েছে বিপদ, কর্তব্য করব না ওপরওয়ালার কথা শুনব। অর্জুনবাবু থানায় এসে বলে গেলেন তাঁর সঙ্গে ডি এম-এর কথা হয়েছে যে তিনিই ম্যানেজ করবেন। পুলিশ নাকি কোনও কাজে আসবে না। ডি এম বলেছেন যখন—।’

‘তা হলে আর কী! আমার কাছে এসেছেন কেন?’

শঙ্কর ঘোষ নিচু গলায় বললেন, ‘কিন্তু আমি খবর পেয়েছি এই শুটিং নিয়ে গোলমাল বাধতে পারে।’

‘কীরকম?’

‘দিবাকরবাবুর বিরোধী পক্ষ, কমিউনিস্টরা প্রচার করছে যে শুটিং-এর চমক দিয়ে অর্জুনবাবু ইলেকশন জিততে চান। গরিব মানুষের এই দেশে বড়লোকের শুটিং পার্টি শুধু ফয়দা লুটতে এসেছে, গরিব গরিবই থেকে যাবে। ব্যাপারটা যদি ভালভাবে প্রচার হয় তা হলে খুব মুশকিল।’

‘খবরটা পেলেন কী করে?’

‘আমরা যে শুটিং-এ যাইনি তা সবাই জেনে গিয়েছে। আজ ওদের অ্যান্টি পার্টির কয়েকজন এসে শাসিয়ে গেল, আপনারা যখন একবার যাননি তখন কখনও যাবেন না। গরিবের অভাব দেখিয়ে ফিল্‌মপার্টি লাখ লাখ রোজগার করবে এ হতে দেব না। যদিও ওদের অর্গানাইজেশন নেই তেমন তবু আমার ভাল লাগছে না।’

‘অদ্ভুত লাগছে। অর্জুন নায়েকের বিরুদ্ধাচারণ করার মানুষ এখানে আছে?’

‘এখানকার লোক নয় ওরা। সাবডিভিশন টাউন থেকে এসেছে।’

‘বাইরের লোক এখানে এসে কী করতে পারে?’

‘অর্জুনবাবুর বিরুদ্ধে কিছু করা মুশকিল। লোকটার ক্ষমতা আছে ম্যাডাম। ডি এম-এর স্ত্রী আজ ওঁর বাড়িতে লাঞ্চ খেয়ে ফিরে গিয়েছেন। এস ডি ও ছিলেন।’

‘আপনি এস পি-কে ব্যাপারটা রিপোর্ট করুন। আমিও ডি এম-কে জানাচ্ছি।’

‘কিন্তু যদি কিছু না হয় পরে তা হলে বেইজ্জত হয়ে যাব না?’

‘কিছু লোক এসে শাসিয়েছিল এটা তো ঘটনা। তাই জানান।’

‘অর্জুনবাবুকে কি জানাব?’

‘তিনি কি আপনার বস?’

‘না—মানে—।’

‘প্লিজ, নিজের কর্তব্য করুন।’

শঙ্কর ঘোষ চলে গেলেন বটে কিন্তু হঠাৎ কয়েক দিনের মধ্যে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পোস্টার পড়তে দেখা গেল। শঙ্কর ঘোষের বলা কথাগুলোই লেখা হতে লাগল সেইসব পোস্টারে। অর্জুন নায়েকের লোক প্রকাশ্যে তা ছিঁড়ে ফেললেও পরদিন আবার দেখা গেল রাতের অন্ধকারে কারা পোস্টার সেঁটে গিয়েছে। এবার অর্জুনের লোকজন রাতের পাহারায় নামলে পোস্টার মারা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে মুখে মুখে ব্যাপারটা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুটিং কিন্তু বন্ধ হয়নি। কেউ হামলা করেনি সেখানে। দিবাকর প্রত্যহ শুটিং-এর বিভিন্ন স্পটে লোক নিয়ে গিয়ে নাটক দেখানোর মতো শুটিং দেখিয়ে আসছে। এইসময় নায়িকা এলেন। তিনি গোটা চারেক ছবি করেছেন এবং এর মধ্যে বেশ নাম হয়েছে তাঁর, বিশেষ করে অতি আধুনিকার চরিত্র চিত্রণে। অর্জুন নায়েক প্রোডাকশন ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে শহর থেকে জিপে চড়িয়ে তাঁকে নিয়ে এল শুটিং স্পটে। সাধারণ মানুষ অবাক চোখে দেখল একটি মোমের মতো মেয়ে সবার সামনে স্বচ্ছন্দে সিগারেট খাচ্ছে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল স্কুলের টেন্টে। তিনি সেখানে গিয়ে নাক কোঁচকালেন। তাঁর দাবি শহর থেকে রোজ শুটিং স্পটে আসবেন। দূরত্ব ও সময়ের কথা ভেবে সকলের যখন মাথায় হাত তখন অর্জুন প্রস্তাব দিল তার গরিবের কুটিরে যদি ম্যাডাম থাকতে পারেন তবে সে ধন্য হবে। নায়িকা গেলেন সেই কুটির দেখতে। দেখে এত পছন্দ করে ফেললেন যে সব রাগ জল হয়ে গেল।

এখন অর্জুনের জিপে নায়িকাকে দেখা যাচ্ছে। নায়িকার আঙুলে সিগারেট। মানুষজন জুলজুল করে দেখছে তাদের। তাদের চেনা মানুষ অর্জুনকে নায়িকা যেরকম খাতির করছে তাতে তাদের গর্ব বাড়তে লাগল, সেইসঙ্গে ঈর্ষাও। আর সেইসময় গোটা দশেক লোক নায়িকাকে নিয়ে শুটিং-এ যাওয়ার সময় হঠাৎ পথ আগলে বিক্ষোভ দেখাতে লাগল। অর্জুন জিপ থামাতে বাধ্য হল। সে চিৎকার করে বিক্ষোভকারীদের সরে যেতে বলল। কিন্তু এই মানুষগুলো তার অচেনা। ব্যাপারটা দেখে মজা পেতেই স্থানীয় কিছু মানুষ সেখানে জুটে গেল। অর্জুন জিপ ঘুরিয়ে নায়িকাকে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু তার আধঘণ্টার মধ্যেই ওই জনা দশেক মানুষকে প্রচণ্ড আহত করে বড় রাস্তায় ফেলে দেওয়া হল। নায়িকা শুটিং-এ পৌঁছে গেলেন। দারোগা শঙ্কর ঘোষ ঘটনাস্থলে ছুটে যেতে বাধ্য হলেন। খবর এল দীপাবলীর কাছেও। বড় রাস্তায় পৌঁছে সে দেখতে পেল দারোগা আহতদের সাবডিভিশন হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। একটি লরিকে আনা হয়েছে। দীপাবলী শঙ্কর ঘোষকে বলল, ‘এদের মধ্যে যে-লোকটি কম আহত তার এজাহার নিন। দেখুন ও কোনও স্পেসিফিক অভিযোগ করে কিনা!’

‘নিয়েছি ম্যাডাম।’

‘কী বলছে?’

‘বলছে অর্জুন নায়েক লোক দিয়ে ওদের প্রচণ্ড আহত করেছে। লোহার শিক দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়েছে। ওরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছিল, এই হল অপরাধ।’

‘এরা কোত্থেকে এসেছে এখানে?’

‘সাবডিভিশনাল টাউন থেকে। কমিউনিস্ট পার্টি করে এরা।’

‘প্রয়োজনে সাক্ষী দিতে পাওয়া যাবে এদের?’

‘মনে হয়। আমি লক্ষ করেছি কমিউনিস্টরা সহজে হার স্বীকার করে না।’

‘বেশ। আপনি আরও তদন্ত করুন। ঘটনাস্থলের কিছু মানুষকে জোগাড় করুন যারা সাক্ষী দিতে পারবে। আর এসব কথা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলবেন না।’

‘কী সব কথা?’

‘এরা যে এজাহার দিয়েছে তা কাউকে বলার দরকার নেই।’

‘ঠিক আছে ম্যাডাম।’

আহতদের হাসপাতালে পাঠিয়ে একটা রিপোর্ট লিখল দীপাবলী। এখন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্জুনকে অ্যারেস্ট করা যায়। ক্রিমিন্যাল অফেন্স। কিন্তু ব্যাপারটা এস ডি ও বা ডি এম-কে জানালেই অর্জুন জানতে পেরে পেরে যাবে সঙ্গে সঙ্গে। সে ইচ্ছে করেই রিপোর্টে অর্জুনের নাম লিখল না। নায়িকার সঙ্গে যাওয়ার কথা যতটা সম্ভব সে এড়িয়ে গেল। কিছু বিক্ষোভকারীকে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীরা মারাত্মক জখম করে ফেলে গিয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করল।

বিকেলে শঙ্কর ঘোষ এলেন। তিনি কিছু স্থানীয় সাক্ষী জোগাড় করে ফেলেছেন এর মধ্যে। তারা বলেছে কারা কারা আক্রমণে অংশ নিয়েছিল। এরা সবাই অর্জুন নায়েকের নিজস্ব মানুষ। আলোচনা করে দীপাবলী নির্দেশ দিল ঠিক রাত ন’টায় শঙ্কর ঘোষ ওদের চারজন পান্ডাকে তুলে থানায় নিয়ে যাবেন। সাড়ে ন’টায় মধ্যে লোকগুলোর কাছ থেকে খবর বের করে বাহিনী নিয়ে চলে আসবেন দীপাবলীর কাছে।

সারাটা সন্ধে খুব উত্তেজিত হয়ে রইল দীপাবলী। তার একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছিল। এইসব গোলমালের খবর নিশ্চয়ই শুটিং পার্টির লোকেরা পেয়েছে। সুবিনয় সেনের চিন্তিত হওয়া উচিত। তিনি যে কেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন না তাই সে বুঝতে পারছিল না।

ঠিক রাত সাড়ে ন’টায় শঙ্কর ঘোষ এলেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তৈরি হয়ে বসে ছিল দীপাবলী। শঙ্করবাবু বললেন, ‘ব্যাপারটা খুব সহজ নয় ম্যাডাম। আজ সন্ধের সময় অর্জুনবাবু নায়িকাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় এসেছিলেন।’

‘তাই নাকি?’

শঙ্কর ঘোষ মাথা নাড়লেন, ‘অর্জুনবাবু নায়িকাকে দিয়ে ডায়েরি করালেন। কিছু সমাজবিরোধী তাঁর কাজে যাওয়া-আসার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি জানিয়েছেন এর পরিণাম খারাপ হতে পারে।’

‘ডায়েরিতে শুধু দিন লেখেননি তো?’

‘না না, ডায়েরি সবসময় সময় দিয়ে লেখা হয়। অর্জুনবাবু তখন কিছু বলেননি কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন ডি এম জানতে চেয়েছেন আমি কেমন কাজকর্ম করছি? হেসেই বললেন। সাপের মতো হাসি।’

‘লোকগুলোকে তুলেছেন?’

‘হ্যাঁ। ওরা স্বীকার করেছে, অর্জুন নায়েকের নির্দেশে এই কাজ করেছে।’

‘স্বীকারোক্তিতে সই করিয়েছেন?’

‘এটা আর আমাকে মনে করিয়ে দেবেন না। কিন্তু একটা কথা ভাবুন, অর্জুনবাবুর পাশে সমস্ত প্রশাসন আছে। তিনি আমাদের গুঁড়িয়ে দিতে পারেন।’

‘ঠিকই। আমি সতীশবাবুকে রিপোর্ট জমা দিতে পাঠিয়েছিলাম। তিনি আমার নির্দেশমতো শহরের সবকটা বড় কাগজের প্রতিনিধিকে আজ মধ্যরাত্রে আমাদের থানায় আসতে বলে এসেছেন। কোনও ইঙ্গিত দেননি। শুধু বলেছেন একটা বিরাট ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। মনে হয় রাত বারোটায় শহর থেকে সাংবাদিকদের গাড়ি আপনার থানায় পৌঁছে যাবে। তাঁরা যদি খবরটা ছেপে দেন তা হলে আপনার আর ভয়ের কিছু থাকবে না।’

‘ঠিক আছে। লোক আমি খুব সৎ নই। তবে এবার একটু সাহস দেখাই। চলুন, আমার বাহিনী প্রস্তুত।’

এইসময় বাইরে একটা গাড়ির আওয়াজ হল। দরজা খোলাই ছিল। দীপাবলী এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল একটা বড় ভ্যান থেকে কয়েকজন নামছেন। তাঁদের একজন প্রশ্ন করলেন, ‘শুনলাম ও সি নাকি এখানে এসেছেন। তাঁর দেখা পেতে পারি?’

‘আপনারা?’ দীপাবলী প্রশ্ন করল।

‘আমরা সাংবাদিক। আজ বিকেলে খবর পেয়েছি—।’

‘কিন্তু আপনারা আগেই এসে গিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপারটা কী?’

এইসময় শঙ্কর ঘোষ বেরিয়ে এলেন, ‘ঠিক আছে। আপনারা আমাদের অনুসরণ করতে পারেন। আজ এখানে একটি গণধোলাই হয়েছে। কয়েকজনের জীবনহানির আশঙ্কা আছে তা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। আমরা একজন খুব ক্ষমতাবান মানুষ, যিনি এই কাণ্ডের নায়ক, তাঁকে গ্রেপ্তার করতে যাচ্ছি। আপনাদের আমি আমন্ত্রণ করছি না। কিন্তু পেছনে এলে বাধা দেব না। তবে আমার কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন না।’

অন্ধকার হেডলাইটে সরিয়ে কয়েকটা গাড়ি দ্রুতবেগে ছোটা শুরু করল।

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন