৭. অবস্থা খুব গোলমেলে

সমরেশ মজুমদার

দুপুর নাগাদ দীপাবলী বুঝতে পারল অবস্থা খুব গোলমেলে।

সকালের ডাক্তারের ওষুধে কোনও কাজ হচ্ছে না, দ্বিতীয় ট্যাবলেট খাইয়ে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোনও মানে হয় না। এখন চেষ্টাচরিত্র করলে শমিতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হতে পারে। শেকড়বাকড়, তিরি যেসব কথা বলছে, মাথায় ঢোকাতেই চাইল না সে। এর মধ্যে অন্তত চারবার শমিতের মাথা ধোয়ানো হয়েছে। দশটার পর অফিস বন্ধ করে ভেতরে এসে দীপাবলী দেখেছিল শমিতের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে তিরি ভেজা গামছা ওর বুকে গলায় বুলিয়ে তাপ কমাবার চেষ্টা করছে।

দৃশ্যটি একদম পছন্দ হয়নি দীপাবলীর। এ-কথা ঠিক, শমিতের চোখ বন্ধ, চেতনা স্পষ্ট নয়, তার শরীরের পাশে কে বসে কী করছে তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু কাউকে সেবা করতে হলে শরীরের অত কাছে যেতে হবে কেন? এমনকী তাকে দেখেও সরে বসার চেষ্টা করল না তিরি। কাতর গলায় বলল, ‘কী হবে দিদি! শরীর তো একটুও ঠান্ডা হচ্ছে না। কাল সারাদিন বোধহয় সূর্য শরীরে ঢুকেছে।’

‘আমি দেখছি, তুই রান্নাঘরে যা।’ একটু কড়া গলায় বলল দীপাবলী।

‘তুমি বুক আর পেট ভাল করে মুছিয়ে দিতে পারবে?’ তিরি যেন উঠতে চাইছে না।

‘আঃ, কী করতে হবে আমি বুঝব। দুপুরে খেতে হবে না?’ দীপাবলীর গলা অতটা না উঠলে বোধহয় তিরি ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে আসত না। এমনিতে তিরি তার বিছানায় কখনওই উঠে বসেনি এর আগে। যতই তোক কিছু দূরত্ব রাখতেই হয়, রাখা উচিত মনে করে দীপাবলী। শমিতকে এই বিছানায় নিয়ে আসার পর তিরিকে বেশ কয়েকবার বিছানায় উঠতে হয়েছিল, তখন চোখ সেটা ঠাওর করে দ্যাখেনি, এখন দেখল।

শমিতের পাশে বসে ভেজা গামছা তুলে নিতেই সে বুঝতে পারল সেটাও গরম হয়ে গিয়েছে। খাটের নীচে বালতিতে রাখা জলে সেটা ডুবিয়ে নেওয়া হয়েছে এতক্ষণ। তাই অনুসরণ করল সে। গামছাটা শমিতের বুকে গলায় বুলিয়ে দিতে দিতে উত্তাপ টের পেল। একটা কিছু ব্যবস্থা করা এখনই দরকার। এখানে হাটতলা বলে একটা জায়গা আছে। বাস রাস্তার ধারে। মাঝে মাঝে কিছু ভাড়ার গাড়ি যাতায়াতের পথে সেখানে দাঁড়ায়। তার একটাকে ডেকে আনলে হয়। কিন্তু অত দূরে তিরিকে পাঠানো চলবে না। দীপাবলী শমিতের মুখের দিকে তাকাল। মাঝে মাঝে এক একটা নার্ভ দপদপ করছে। সে ডাকল, ‘শমিত, এই শমিত, শুনতে পাচ্ছ?’

যেন শব্দের প্রতিক্রিয়াতেই শমিতের চোখ ঈষৎ খুলেই আবার বন্ধ হয়ে গেল। তার ফাঁকে বোঝা গেল সে দুটো টকটকে লাল। এই মুহূর্তে নিজের শরীরের ওপর তার কোনও বশ নেই। অসুস্থতার এই পর্যায় এবং মৃত্যুর পর মানুষ সমস্ত সংস্কারমুক্ত হয়ে যায় শরীর সম্পর্কে। শমিত যদি সুস্থ থাকত অথবা তার চেতনা যদি লুপ্ত না হত তা হলে সে কিছুতেই এইভাবে বুকে গলায় হাত বুলিয়ে দিতে পারত না। হঠাৎ নিজের ভাবনার জন্যে লজ্জাবোধ করল সে। একজন রুগি আর সুস্থ শমিতের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলাই নিচু মনের প্রকাশ। তিরিকে শমিতের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে দেখে তার ভাবনা অত্যন্ত নিচুতার লক্ষণ। কারণ শমিত নয়, তিরি একজন অসুস্থকে সেবা করছিল। বিছানা থেকে নেমে তিরিকে ডাকল দীপাবলী। ভেতরের দরজায় সে এসে দাঁড়ানোমাত্র বলল, ‘তুই এই ঘরে থাক, আমি আসছি।’

কোথায় যাচ্ছ?’

‘হাটতলায় যাচ্ছি গাড়ি ডেকে আনতে।’

‘কেন?’

‘ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার।’

‘না।’ দ্রুত মাথা নাড়ল তিরি।

‘না মানে?’ দীপাবলীর মনে হল, না শব্দটির উচ্চারণ এবং ঘাড় নাড়ার মধ্যে তিরি যেন বিদ্রোহ করতে চাইছে।

‘হাসপাতালে গেলে বাবু বাঁচবে না।’ তিরি কেঁদে ফেলল।

দীপাবলী ধমকে উঠল, ‘কী হচ্ছে কী?’

‘ওই তো, বড়বাবু বউকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল, বাঁচাতে পারল? তুমি বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে যেয়ো না।’ কাতর গলায় বলল মেয়েটা।

‘তুই বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দে।’ টেবিলের ওপর রাখা ছাতাটা তুলে হনহন করে বেরিয়ে এল দীপাবলী। ছাতা খুলতেই বুঝল লক্ষ নাগিনীর নিশ্বাস বোধহয় এর চেয়ে ঠান্ডা। আজ লু বইছে। ছাতা আড়াল করলেও বাঁচা মুশকিল। যতটা সম্ভব জোরে সে ছুটতে লাগল।

হাটতলায় একটা লরি দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভার নিশ্চয়ই আশেপাশে ঝাঁপ নামিয়ে রাখা কোনও দোকানে বসে আছে। দীপাবলী আর পারছিল না। সমস্ত শরীর জ্বলছে। এইসময় বাস চলাচল অনিয়মিত। ফলে লোকজনও দেখা যাচ্ছে না। লরির ওপর একটা কিছু টাঙিয়ে ছাউনি করে তার তলায় শমিতকে শুইয়ে নিতে যেতে হবে। সে সামনের চায়ের দোকান, যার ঝাঁপ নামানো, এগিয়ে যেতেই পেছনে গাড়ির শব্দ শুনতে পেল। একটা জিপ ছুটে আসছে। দূর থেকে কড়া রোদে যেন তাকে ঘিরে ঠিকরে ওঠা আলো কাঁপছে বিদ্যুতের মতো। জিপ যদি খালি আসে তা হলে পদাধিকারবলে সে একটা অনুরোধ করতে পারে। ভাবনাটা অফিস বন্ধ হবার আগে মাথায় এলে ওদের দিয়েই গাড়ি ডাকানো যেত।

বেশ শব্দ তুলে ব্রেক কষল জিপটা দীপাবলী হাত তুলতেই। আর ঝপ করে যে-লোকটা ড্রাইভিং সিট থেকে নামল তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, আরব বেদুইনদের মতো মাথা মুখ ঢাকা। দীপাবলী হকচকিয়ে গেল।

‘কী ব্যাপার ম্যাডাম? আপনি এইসময় এখানে দাঁড়িয়ে?’ কথাগুলো যে অর্জুন বলছে তা বুঝতে দীপাবলীর যেটুকু সময় লাগল তাতেই দ্বিতীয়বার প্রশ্ন শুনল, ‘আপনি আমাকে বোধহয় চিনতে পারছেন না, না?’

ছাতার আড়ালে দীপাবলীর মুখ রোদের তাপ এবং আকস্মিকতার ঘোরেই আরও লাল হয়ে উঠেছিল। সে কোনওরকমে বলতে পারল, ‘বুঝতে পারিনি।’

‘খুব স্বাভাবিক। এখানকার লোক অবশ্য জিপ দেখলেই বুঝতে পারে। এই গরমে মুখের চামড়া নরম রাখতে ঢেকেঢুকে রাখতে হয় ম্যাডাম। শক্ত চামড়া তো কেউ পছন্দ করে না।’ অদ্ভুত শব্দ করে হাসল অর্জুন।

ঠোঁট কামড়াল দীপাবলী। খুবই অশ্লীল ঠেকল কথাগুলো। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অর্জুন আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু আপনি এখানে?’

গম্ভীর হতে চেয়েও পারল না দীপাবলী। বলল, ‘আমার একটা গাড়ির দরকার ছিল। এই লরির ড্রাইভারটাকে খুঁজছিলাম।’

‘ও তাই বলুন।’ অর্জুন মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাল। তারপর গলা তুলে চোস্ত হিন্দিতে কাউকে ধমকাল। বন্ধ দোকানগুলোয় সেই আওয়াজ পৌঁছাতেই একটি ঝাঁপ নড়ে উঠল। তারপর রোগামতন একটি মানুষ মাথা মুখ গামছায় মুড়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় বেরিয়ে এল বাইরে। অর্জুন তাকে একগাদা কথা শোনাল। ‘ম্যাডাম বাইরে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ছেন আর তুমি ছায়ায় সুখ করছ? ম্যাডামকে তুমি চেনো? এই এলাকায় ওঁর কথাই শেষ কথা। কোনও গড়বড় করবে না, উনি যা বলবেন তাই শুনবে।’

বাধ্য হয়ে দীপাবলী বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’ তারপর ড্রাইভারটির দিকে ঘুরে দাঁড়াল, ‘আপনাকে একটু লরি নিয়ে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’

‘এখন, এই রোদে?’ ড্রাইভার সরু গলায় জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ, উপায় নেই।’

‘কোথায় যাবেন?’

‘শহরে।’ জবাবটা দিয়েই দীপাবলী অর্জুনের দিকে ফিরে বলল, ‘আচ্ছা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, নমস্কার!’

‘নমস্কার, নমস্কার। কিন্তু শহরে যাচ্ছেন লরিতে চেপে? অবশ্য এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমার কথা বলা সাজে না। ও হ্যাঁ, কাল সতীশবাবুর জন্যে জিপ পাঠিয়েছিলাম, ওরা এখনও ফিরে আসেনি, না?’

‘না।’

‘ভেরি স্যাড ব্যাপার। এই বয়সে ভদ্রলোকের বউ মারা গেল।’

‘অর্জুনবাবু, এই রোদে দাঁড়িয়ে আর কথা বলা যাচ্ছে না।’

‘ওহো, তাই তো। চলি।’ অর্জুন নিজের জিপে গিয়ে বসল। শব্দ করে জিপটা বেরিয়ে গেল শহরের দিকে। দীপাবলী এবার অবাক হল। সে ভেবেছিল শহরে যাওয়ার কথা এবং সে লরি খুঁজছে জানামাত্র অর্জুন তাকে নিজের জিপ অফার করবে। কিন্তু সে ওসব দিকে গেলই না। অথচ এই লোক তাকে হাতে রাখতে ওই তোষামোদটুকু করবে এটাই স্বাভাবিক। লরির ড্রাইভারের পাশে বসে বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে দীপাবলী আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিল গরম হলকার থেকে বাঁচার জন্যে। আঁচলে মুখ মুড়ে তার হঠাৎ মনে হল অর্জুন যেন তাকে আজ অবহেলা করল। আবার এটাও তো ঠিক, লরি পাওয়া না গেলে সে কী করত তা জানা নেই, পেলে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করত অর্জুন তার জিপ দিতে চাইলে। এই গরমে জিপ না লরি, কোনটিতে শহরে যাওয়া বেশি আরামপ্রদ তাই সে বুঝতে পারল না।

বাড়িতে পৌঁছে দীপাবলী লরিওয়ালাকে শহরে যাওয়ার কারণটা বলল। শুনে লোকটা যেন আঁতকে উঠল, ‘না মেমসাহেব, ওরকম করবেন না। ওইভাবে লরির ওপর শুইয়ে রুগি নিয়ে গেলে শহর পর্যন্ত আর বাঁচবে না।’

দীপাবলী বিরক্ত হল, ‘আশ্চর্য, মাথার ওপর একটা ছাউনি দিতে বলছি না?’

‘ছাউনি? তিন পাশ কী করবেন? তিন পাশ দিয়ে গরম হাওয়ার ঝাপট আসবে যখন তখন কী করবেন? আপনি বাবুর জিপ নিলেন না কেন?’

দীপাবলী একটু অসহায় বোধ করছিল। ড্রাইভার একটু গুঁইগাঁই করে বলল, ‘আপনি যদি ওঁকে সামনের সিটে বসিয়ে নিয়ে যেতে পারেন তা হলে হতে পারে।’

দীপাবলী মাথা নাড়ল, ‘না, বসিয়ে নেওয়া অসম্ভব।’

তখন ড্রাইভার বলল, ‘তা হলে আমাকে আধ ঘণ্টা সময় দিন। পেছনটা ভাল করে ঢেকেঢুকে নিয়ে আসি। তবে যদি কোনও ট্যাক্সি পেয়ে যাই পাঠিয়ে দেব।’

রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। লোকটি লরি নিয়ে ফিরে গেল। দীপাবলী দরজা বন্ধ করে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে তিরিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছে রে?’

‘একই রকম। মাকে খুঁজছিল।’ তিরি দরজায় দাঁড়িয়ে জবাব দিল।

ভুল শুনল দীপাবলী, ‘আমাকে?’

‘তোমাকে কে বলল? ওর মাকে!’

ঢোঁক গিলল দীপাবলী, ‘খুঁজছিল মানে? জ্ঞান ফিরেছে?’

‘না। শুধু কয়েকবার মা মা বলেছে। তুমি কিছু খাবে?’

‘না।’ দীপাবলী চোখ বন্ধ করল। এর মধ্যে যে-রোদ এবং হলকা লেগেছে তাতেই শরীর কাহিল লাগছিল। মনে হচ্ছিল সব রক্ত যেন শুষে নিয়েছে। ঝিমুনি আসছিল। জন্মলগ্নে ঈশ্বর যার কপালে—! এই অবস্থাতেই হেসে ফেলল সে। চিরদিন, জ্ঞান হবার পর থেকে ভেবে এসেছে নিজের কাজ দিয়ে ভাগ্যকে জয় করবেই। অথচ দুর্ভাগ্য তাকে কোনও-না-কোনও ভাবে একের পর এক জড়াবেই। আর কতদিন এই লড়াই চালাতে হবে জানা নেই। হয়তো আমৃত্যু। নইলে শমিতের এখানে আসার কথা ছিল না। যার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার মুহূর্তেই সম্পর্কের ছেদ ঘটিয়ে চলে এসেছে, সে কেন খামোকা তার কাজের জায়গায় এসে ইচ্ছে করে অসুখ বাধিয়ে বসবে? জেনেশুনে তাকে বিপাকে ফেলা। এ-ব্যাপারে সে অঞ্জলির কাছে কৃতজ্ঞ। কয়েক বছর আগে মনোরমার পা ভেঙে যাওয়ার খবর দিয়ে টাকা চাওয়া ছাড়া আর কোনওভাবেই তাকে বিরক্ত কবেনি মহিলা। যাকে জন্মানোর পর থেকেই মা বলে জেনেছে, তার পড়াশুনার পেছনে যে-মহিলার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি পরবর্তীকালে যতই দুর্ব্যবহার করুন না কেন, হাত বাড়িয়ে কিছু চাইলে তার পক্ষে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হত না। কিন্তু মহিলা চাননি। নীরবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। চাকরি পাওয়ার পর নিজের প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখে দীপাবলী প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠায়। প্রতুলবাবুর কাছ থেকে হাত পেতে অমরনাথ যে-টাকা তার পড়াশুনার জন্যে নিয়েছিলেন, এবং সেই টাকার যে-অংশ অমরনাথের অনুরোধে তাকে নিতে হয়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে শোধ করে সে মুক্ত হতে চায়। টাকাটা অঞ্জলির কাছে পৌঁছানো মানে অমরনাথের কাছে পৌঁছানো। প্রতি মাসে মানিঅর্ডারের কুপনে কার সই থাকে সে কখনও যাচাই করতে যায়নি। অঞ্জলির নামের মানিঅর্ডার নিশ্চয়ই অন্য কেউ নেবে না। কিন্তু কুপনে পুরো সই থাকে না। তবু মনের দিক থেকে প্রতি মাসে পরিষ্কার হয়ে যায় সে।

হঠাৎ অমরনাথের মুখ মনে পড়ল। একটা রক্তমাংসের মানুষ এই পৃথিবীতে সমস্তরকম সুখ দুঃখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সে স্পষ্ট দেখতে পেল চা-বাগানে রবিবারের সকালে অমরনাথ সেজেগুজে হাটে যাচ্ছেন, অমরনাথ তাস খেলছেন, জলপাইগুড়ি হস্টেলে অমরনাথ এসেছেন, চা-বাগানের কোয়ার্টার্সের বাইরে অমরনাথ তার সঙ্গে গল্প করছেন। এইসব ছবি মাটি জল পাথরের মতো সত্যি। এখন সবই আছে, শুধু সেই মানুষটি নেই। এটাও সত্যি এবং নির্মমভাবে সত্যি।

ঠিক এইসময় জিপের আওয়াজ পাওয়া গেল। তিরি ছুটে এল বাইরের ঘরে। দরজা ফাঁক করে বাইরেটা দেখে চাপা গলায় বলল, ‘অর্জুনবাবু!’ বলে দ্রুত ভেতরে চলে গেল। দীপাবলী সোজা হয়ে বসল। খানিক বাদেই দরজায় শব্দ হল, খোলা দরজা তবু ঠেলে খুলছে না অর্জুন।

দীপাবলী ডাকল, ‘আসুন।’

সাদা কাপড়ে মুখ ঢাকা, ঘরে ঢুকে সেটি ঈষৎ শিথিল করে অর্জুন বলল, ‘আবার আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম।’

‘এসেছেন যখন তখন বসুন।’

‘আমি সেটা জানি। কিন্তু বসার জন্যে আমি আসিনি। লরিওয়ালার কাছে শুনলাম আপনার বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এ-কথাটা তখন আমাকে বলেননি? আমি খুব খারাপ টাইপের মানুষ হতে পারি কিন্তু একটু-আধটু ভাল কাজও তো করি!’

দীপাবলীর অস্বস্তি হচ্ছিল। সে উঠে দাঁড়াল, ‘আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি। তা ছাড়া হাটতলায় গিয়ে আপনার দেখা পাব বুঝতে পারিনি।’

‘কাউকে আমার বাড়িতে খোঁজ করতে পাঠাতে পারতেন।’

‘আপনার বাড়ি কোথায় আমি জানি না।’

‘তা অবশ্য। কিন্তু এরা তো জানে। কাল রাত্রে ওদের প্রয়োজনে গিয়েছিল।’

‘গাড়ি পেয়ে গেলে তো কাজ চলে যেত’

‘না ম্যাডাম।’ এটা তো মাল,বয়ে নিয়ে যাওয়া নয়। অসুস্থ মানুষকে আরাম দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। আর দেরি করবেন না, ভাগ্যিস একটা দরকার মনে পড়ে গিয়ে ফিরে এসেছিলাম—! চলুন!’ ব্যস্ত ভঙ্গি করল অর্জুন।

মুহূর্তে মনস্থির করে নিল দীপাবলী। শমিতের প্রয়োজন এত জরুরি যে অর্জুনের সাহায্য নেবার ব্যাপারে কুণ্ঠা করে কোনও লাভ নেই। সে নিজে যেচে উপকার নিতে যাচ্ছে না, কেউ যদি গায়ে পড়ে উপকার করতে চায় তা হলে পরবর্তীকালে সে পালটা কিছু আশা করতে পারে না। দীপাবলী বলল, ‘উনি হেঁটে গাড়িতে উঠতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।’

‘কোথায় উনি? ভেতরে যেতে পারি?’

শমিতকে বহন করে জিপে তোলা তার এবং তিরির পক্ষে কতটা সম্ভব এ-ব্যাপারে দ্বিধা ছিল। অতএব অর্জুনকে নিয়ে ভেতরে এল দীপাবলী। খাটে শুয়ে থাকা অতবড় একটা মানুষকে দেখে অবাক হয়েছে কিনা বোঝা গেল না কারণ অর্জুনের মুখ কাপড়ে মোড়া, কিন্তু তার মাথা ঘুরে গেল ভেতরের দরজা ধরে দাঁড়ানো তিরির দিকে। সেটা লক্ষ করল দীপাবলী। কয়েক সেকেন্ড পরে মুখ ঘুরিয়ে অর্জুন বলল, ‘ঠিক আছে, ওঁর শরীরের ওপর চাদর দিয়ে দিন যাতে বাইরে গেলে রোদের তাপ না লাগে।’

‘কিন্তু গাড়িতে তোলা হবে কী করে?’

‘এমন কঠিন জায়গায় যখন আছি তখন খুব নরম ভাবছেন কেন ম্যাডাম। দেখি চেষ্টা করে, নিয়ে যেতে পারি কিনা।’ অর্জুনের হাসির শব্দ শোনা গেল।

দীপাবলী দেখল তিরির শরীর এখন আর ঘর থেকে দেখাই যাচ্ছে না। অর্জুন তাকে দেখার পর থেকেই সে যেন আরও আড়ালে যেতে চাইছে। অথচ ও যে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।

একটা চাদর দিয়ে শমিতকে ভাল করে ঢেকে দিল দীপাবলী। এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে যেভাবে শমিতের বিশাল শরীরটাকে তুলে নিয়ে অর্জুন দরজার দিকে এগিয়ে গেল তাতে চমকে উঠল দীপাবলী। মানুষটার শরীরে এতখানি শক্তি আছে বোঝা অসম্ভব ছিল। সে দ্রুত দরজার পাল্লা খুলে ওদের যাওয়ার পথ সহজ করে দিল। জিপের পেছনে শমিতকে পা মুড়ে শুইয়ে মাথার নীচে বালিশ গুঁজে দিল দীপাবলী। তারপর তিরিকে কিছু নির্দেশ দিয়ে শমিতের ঝোলা নিয়ে জিপের কাছে ফিরে আসতেই অর্জুন বলল, ‘ম্যাডাম, আপনাকে ফ্রন্ট সিটে বসতে বলতে পারছি না, কারণ ওঁকে ধরে না থাকলে জিপ চললে পড়ে যেতে পারেন।’

দীপাবলী ঠোঁট কামড়ে পেছনে উঠে বসল। যেন সে শমিতকে এইভাবে একা শুইয়ে আরাম করে ফ্রন্ট সিটে বসতে চেয়েছে? সে মুখে কিছু বলল না। শমিতের কাঁধ শক্ত করে ধরে রাখতে হচ্ছে। জিপ চালু হওয়ামাত্র ঝাঁকুনি শুরু হয়েছে। বিছানা থেকে যে জিপে তুলে আনা হয়েছে তা অবশ্যই টের পায়নি শমিত। পেছন দিকের ত্রিপলের পরদাটা ভাল করে আটকে দিয়েছে অর্জুন তবু গরম হলকা ঢুকছে কোন ফাঁক পেয়ে। জিপের ছাদ এখন আগুন। অর্জুন স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে শিস দিচ্ছে। ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদ, হেমন্তকুমারের হিন্দি গান। এই ভরদুপুরে উনুনের মতো গরমে চাঁদিনি রাতের গান কেউ ভাবতে পারে? দীপাবলী মুখ ফিরিয়ে শমিতের দিকে তাকাল। চাদরে-মোড়া শরীরটাকে দেখতে স্বস্তি হচ্ছে না। তার এসব দেখার কথা ছিল না। অসুস্থ শমিতকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল মায়ার, অথচ সে সেই কাজ করছে। একসময়ের একটু ভাল লাগা, আপনি থেকে তুমিতে নেমে যাওয়ার দাম এখন কড়ায় গন্ডায় শোধ করতে হচ্ছে।

শিস থামিয়ে হঠাৎ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসপাতালের কাউকে চেনেন ম্যাডাম?’

‘না, এর আগে কখনও প্রয়োজন হয়নি।’

‘আপনি ওঁর কীরকম ট্রিটমেন্ট চান?’

‘মানে?’

‘এই ছোট্ট শহরে তো ভাল চিকিৎসা হবার কথা নয়।’

‘যদি ওরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে যেতে হবে।’

কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’

‘বলুন?’ অবশ্যম্ভাবী ছিল যে-প্রশ্ন তার জন্যে তৈরি হল দীপাবলী।

কিন্তু সে-দিকে গেলই না অর্জুন, ‘রিস্ক না নিয়ে একেবারে সদর হাসপাতালে যেতে আপনার আপত্তি আছে?’

‘সময় লাগবে তো!’ নিশ্বাস ফেলল দীপাবলী।

‘লরির জন্যে অপেক্ষা করলেও তো সময় নষ্ট হত।’

‘কিন্তু আপনি অতদূরে যাবেন কেন?’

‘নিজের জন্যেই যাব।’

‘মানে?’

‘ম্যাডাম, রোজ যত পাপ করছি যে মাঝে মাঝে একটু আধটু পুণ্য না করলে যমরাজের সঙ্গে আর্গুমেন্ট করাই যাবে না।’

‘আপনার যদি অসুবিধে না হয় তা হলে চলুন!’

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। শিস শুরু করল অর্জুন। জিপের গর্জনের সঙ্গে শিসের শব্দে মিশে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। শিস থামিয়ে আচমকা অর্জুন বলল, ‘নেখালির লোকগুলোর যা সহ্য হয় তা বাইরের মানুষ পারবে কেন?’

চোয়াল শক্ত হল দীপাবলীর। অর্থাৎ অর্জুনের কিছুই জানতে বাকি নেই? লোকটাকে এই অঞ্চলের মুকুটহীন রাজা বলা হয়ে থাকে। ক্ষমতার চুড়ান্ত অপব্যবহার এবং ব্যবহার করে মেজাজে আছে। অবশ্য এই ক্ষমতা নিশ্চয়ই সে অর্জন করেছে। তা সত্ত্বেও কোথায় কী ঘটছে তার খবর চটপট পায় কী করে লোকটা। খবর দেবার লোকগুলোকে কি অর্জুন কিনে রেখেছে? দীপাবলী জবাব দিল না। অর্জুন আর কথা বাড়াল না। জিভে শিস বাজাতে বাজাতে জিপ চালাতে লাগল দ্রুতগতিতে। যেন না বোঝাবার বুঝিয়ে দিয়ে খুশি হল।

সদর হাসপাতালে শমিতকে ভরতি করে দেওয়া হলে ডাক্তার বললেন লু লেগে শরীর অসুস্থ হয়েছে। সেইসঙ্গে শরীরের ওপর দীর্ঘদিনের অত্যাচাব ছিল। হাসপাতালের খাতায় নামধাম লেখানোর সময় অর্জুন পাশে ছিল। ঠিকানার জায়গায় এসে একটুও দ্বিধা না করে দীপাবলী নিজের ঠিকানা দিল। যে ভরতি করছে তার সঙ্গে রুগির সম্পর্কের জায়গায় লিখল আত্মীয়। অর্জুন একটু চুপচাপ দেখল। শহরে আসার পরও অর্জুন তার মুখের আবরণ খোলেনি। যদিও এখানে গরম কম নয় কিন্তু কাউকেই এই বেশে দেখা যাচ্ছে না। অর্জুনের এই নিয়ে কোনও ভাবনাই নেই।

বিকেলের আগে কোনও খবর পাওয়া যাবে না শমিতের ব্যাপারে, এই অবস্থায় ওরা হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এল। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘ম্যাডাম, এবার তো আমার চলে যাওয়া উচিত কিন্তু তবু একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি।’

দীপাবলী তাকাল। খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে।

‘বিকেলে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে ফিরবেন কী করে?’

‘ফিরে যাব।’ অদ্ভুত গলায় জবাব দিল দীপাবলী। অর্জুন বুঝল অবহেলা প্রকট না হলে এমন গলায় কথা বলা যায় না।

‘আপনি এখন কোথায় যাবেন?’

‘দেখি!’

‘আচ্ছা চলি, নমস্কার।’ অর্জুন হঠাৎ যেন ঝাঁকুনি দিয়ে শরীরটাকে চালু করল। সে যখন বেশ কয়েক পা এগিয়ে যাচ্ছে তখন দীপাবলী তাকে ডাকল, ‘শুনুন, একটু দাঁড়িয়ে যাবেন?’

পেছন ফিরল অর্জুন। ওর মুখ যেহেতু দেখার উপায় নেই তাই অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপাবলী কাছে গেল, ‘আপনি অনেক উপকার করেছেন। কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না।’

‘ধন্যবাদের দরকার নেই এখন। ঠিক সময়ে ওটা আদায় করে নেব।’

‘মানে?’

‘অর্জুন নায়েক সম্পর্কে কিছু তো জেনেছেন। বিনা স্বার্থে আমি কোনও কাজ করি না। এই যে এসব করলাম তার পেছনে কিছু কারণ আছে।’

‘কী কারণ?’

‘আপনার হাতে কিছু সরকারি ক্ষমতা আছে। সামান্য হলেও আছে। সেটুকু কাজে না লাগালে আমার অসুবিধে হতে পারে। অবাক হবেন না, আমার চরিত্র এটাই।’

‘আপনি এভাবে বলবেন জানলে আপনার উপকার নিতাম না।’

‘না নিলে আপনার আত্মীয়কে বাঁচানো মুশকিল হত ম্যাডাম।’

‘সেটা আমার সমস্যা ছিল।’

‘নিশ্চয়ই। তবে মানুষের জীবনের চেয়ে দামি আর কী হতে পারে!’

‘সেটাও আমি বুঝতাম।’

‘যাক, এখন তো ভেবে লাভ নেই। আপনি আমার কাছ থেকে উপকার নিয়েছেন এটাই সত্যি। আমি উপকার চাইলে কি আর না বলতে পারবেন?’

‘কী চান আপনি?’ দীপাবলীর মুখে রক্ত জমল।

‘খেতে।’ হেসে উঠল অর্জুন।

‘মানে?’

সকালে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট খেয়েছিলাম। এখন দুপুর শেষ হতে চলেছে। পেটে কিছু নেই। খাওয়াবেন?’

‘আমি আপনাকে বুঝতে পারছি না!’

‘আমিও নিজেকে বুঝতে পারি না বেশিরভাগ সময়। সেই চেষ্টাও আর করি না। কিন্তু খিদে বা শরীরে ব্যথা পেলে বেশ টের পাই। আপনিও তো সকাল থেকে কিছু খাননি। না খেয়ে থাকলে ওই ভদ্রলোকের অসুখ যদি সেরে যায় তা হলে অবশ্য অন্য কথা।’ অর্জুন সেই হাসিটা হাসল।

ঠোঁট কামড়াল দীপাবলী। লোকটাকে খাইয়ে দিলে যদি দায়মুক্ত হওয়া যায় তা হলে সেটা এখনই করা উচিত। সে বলল, ‘আমি এখানকার কিছু জানি না, কোথায় ভাল খাবার পাওয়া যায় বলুন।’

অর্জুন বলল, ‘আসুন।’

জিপে ওঠার সময় একটু ইতস্তত করছিল দীপাবলী। অর্জুন বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তা হলে পেছনে বসুন।’

‘কেন?’ চমকে উঠল দীপাবলী। তার মনের কথা লোকটা টের পেল?

‘আমার পাশে আপনাকে জিপে দেখলে চেনা পাবলিক গল্প তৈরি করবে। পচা আলুর পাশে থাকলে ভাল আলুও নষ্ট হয়ে যায়।’

দীপাবলী ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসল। বসে বলল, ‘আমি যতক্ষণ অন্যায় না করছি ততক্ষণ বদনামের ভয় করি না।’

অর্জুন কথা না বলে ইঞ্জিন চালু করল। শহরের ঠিক মাঝখানে একটা সিনেমা হলের পাশে জিপ দাঁড় করিয়ে বলল, ‘আপনি একটু বসুন আমি আগে দেখে আসছি।’ সে নেমে গেল।

রাস্তাঘাট এখনও শূন্য। সম্ভবত ছায়া না-ঘনালে কেউ ঘর থেকে বের হয় না। দীপাবলীর হঠাৎ মনে হল ডি এম এই শহরে আছেন। নেখালির ব্যাপার নিয়ে যে-পরিকল্পনা সে গতকাল এস ডি ও-র অফিসে রেখে এসেছিল তা কি তিনি আজ ডি এম-এর অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছেন? মন্তব্যসহ পাঠানোটাই নিয়ম। একবার খোঁজ নিলে ভাল হয়। ডি এম জানলে ওগুলো রাইটার্স বিল্ডিং-এ তাড়াতাড়ি পৌঁছাবে।

অর্জুন বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। জিপের পাশে এসে বললে, ‘ম্যাডাম, কপাল মন্দ বলে মনে হচ্ছে। এদের লাঞ্চ শেষ। মিষ্টিটিষ্টি খেয়ে ম্যানেজ করা যেতে পারে।’

‘আপনি খাবেন?’

‘না ম্যাডাম, স্বভাবে ব্রত-উদযাপন নেই।’

‘ব্রত উদযাপন?’

‘ওই বিধবা মহিলারা যা করে থাকেন।’

‘তা হলে তো আপনাকে খাওয়াতে পারছি না আমি। যা করছেন তার জন্যে আবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি নামছি।’ দীপাবলী জিপ থেকে নেমেই দেখতে পেল একটা রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে সিনেমাহলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে আমিই হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারতাম!’

‘আমি হাসপাতালে নয়, ডি এম-এর অফিসে যাচ্ছি।’ দীপাবলী এগিয়ে গেল।

ডি এম-এর অফিসে পৌঁছেতে বড়বাবু তাকে সসম্ভ্রমে বসতে বলে জানালেন, ‘স্যার মিটিং করছেন। খবর দিচ্ছি। কিন্তু আপনার কী হয়েছে?

‘আমার? কেন?’

‘খুব রুক্ষ লাগছে। মনে হচ্ছে ঝামেলার মধ্যে আছেন।’

‘তা আছি। কীসের মিটিং?’

‘শান্তি শৃঙ্খলা নিয়ে। কমিউনাল দাঙ্গা বাধার চান্স আছে। আমাকে হুকুম দিয়েছেন কেউ যেন বিরক্ত না করে। আপনার নেখালির কাগজপত্র আমরা পেয়েছি।’

‘বাঃ। কুইক কাজ করছে সবাই।’

‘কিন্তু কোনও লাভ হবে না।’ বড়বাবু কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। অর্জুন নায়েক ঢুকছে পান চিবোতে চিবোতে। দীপাবলীকেই চেনেই না এমন ভঙ্গিতে বড়বাবুকে জিজ্ঞাসা করল সে, ‘সাহেব কোথায়? ভেতরে?’ বড়বাবু মাথা নাড়তেই সে হেলতে দুলতে ডি এম-এর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল সাবলীল ভঙ্গিতে।

দীপাবলী তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। একজন সরকারি অফিসার যেখানে তার বসের সঙ্গে দেখা করতে বসে থাকে সেখানে একজন সাধারণ ব্যবসায়ীকে এই প্রশ্রয় দেওয়া হয় কী করে? সে বড়বাবুর দিকে রাগত চোখে তাকাল। তিনি মাথা নেড়ে বসতে বললেন, ‘এই লোকটির জন্যে আপনার নেখালির পরিকল্পনা কার্যকর হবে না। বুঝলেন?’

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন