৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস

সমরেশ মজুমদার

মুঠোয় ধরা সিগারেটে ঘনঘন টান দিতে দিতে ভদ্রলোক দীপাবলীর দিকে তাকালেন। মানুষটির বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে অনেকদিন, ফরসা সৌম্য চেহারাটি দেখলেই মনে হয় ভাল পড়াশুনা আছে। ইনি দীপাবলীর কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস। তাকে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে-এলাকার, সেখানে তার ওপরে থাকবেন একজন আই এ সি। ইনি তারও বস।

ভদ্রলোক বললেন, ‘কাজ করার ইচ্ছে থাকলে কাজ করা যায়। অন্তত দিল্লির মত প্রতি মুহূর্তে লাল চোখ দেখতে হয় না। ইফ ইউ আর অনেস্ট, ইফ ইউ আর ইন ট্রাবল, আমার কাছে চলে আইসেন। এটা দিল্লি না, কলকাতা। এখানকার ট্রাবলটা আবার একটু অন্যরকম। আন্ডারস্ট্যান্ড?’

মাথা নেড়েছিল দীপাবলী, ‘না স্যার।’

‘নিজেই সেটা ফিল করুন। কাজকর্ম ভালভাবে করবেন যাতে আমাকে প্রশ্ন করতে না হয়। আই অ্যাম ওয়ার্কিং উইদ বাঞ্চ অফ পিপল হু হ্যাভ চেঞ্জড দি ডেফিনিশন অফ অনেস্টি অ্যান্ড আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ টু ইনক্রিজ দেয়ার নাম্বার। আন্ডারস্ট্যান্ড।’

এবার যেন অস্পষ্ট হলেও কিছুটা বুঝেছে বলেই মনে হল দীপাবলীর।

পার্ক স্ট্রিট এলাকার ইনকামট্যাক্স অফিসটিতে যাওয়া আসা করতে দীপাবলীর অসুবিধে হবার কথা নয়। টানা বাস যাচ্ছে বাড়ির কাছাকাছি। ন’টা পনেরোতে স্টপেজে পৌঁছে দ্যাখে বসা না গেলেও দাঁড়াতে অসুবিধে হচ্ছে না। বাসটা যখন ভবানীপুরে পৌঁছোয় তখনও পাদানি ফাঁকা। দশটা বাজতে পাঁচ নাগাদ পার্ক স্ট্রিটে পৌঁছে রাস্তাটুকু স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে এসে সে হতভম্ব। তার অফিস যে-তলায় সেখানে সে একা। দিল্লিতে দশটা দশের মধ্যে অধিকাংশই এসে যেত। এখানে অফিস চালু হয় এগারোটা থেকে। নিজের সেকশনের স্টাফদের জিজ্ঞাসা করে জেনেছে তাদের অ্যাটেন্ড্যান্স রেজিস্টারে সই করতে বাধা দেওয়া হয় না এগারোটা পর্যন্ত। তারপরে খাতা চলে যায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের কাছে। তিনি দাগ মেরে খাতা পাঠিয়ে দেন অফিসে। কেউ যদি দুটোয় এসে সই করে সেই দাগের ওপরে তা হলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কলকাতা শহরে বাস ট্রামে অফিস আওয়ার্স কথাটা চালু থাকে প্রায় সাড়ে বারোটা পর্যন্ত, সকালের দিকে। দশটা পাঁচটা চাকরির সময়টা নেহাতই খাতায় কলমে। এ-ব্যাপারে মাথা ঘামাবার দায়িত্ব যখন তাকে দেওয়া হয়নি তখন চুপ করে থাকাই ভাল। এই ডিস্ট্রিক্টের অন্যান্য অফিসারদের সঙ্গে ইতিমধ্যে আলাপ হয়েছে। তিনজন আই আর এস আছেন এখানে, বাকিরা প্রমোটি। একই কাজ করতে হয় সবাইকে কিন্তু পার্থক্যটা স্পষ্ট। প্রমোশনের ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ অনেক আগে। কিছুদিনের মধ্যেই কেউ কেউ প্রমোটি অফিসারদের বস হয়ে যাবেন। এস কে সিনহা নামের প্রমোটি অফিসারটির নিজস্ব গাড়ি আছে। তাঁর সাদা পোশাকে কোথাও এক ফোঁটা ময়লা নেই। হাবেভাবে বোঝান কাউকে পরোয়া করেন না। বিদেশি সিগারেট খান। রোজ সামনের বার কাম রেস্তোরাঁ থেকে তাঁর লাঞ্চ আসে। এই মাইনেতে সেটা কীভাবে সম্ভব তা তিনিই জানেন। চতুর্থ দিনে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘মিসেস মুখার্জি, আপনি তো আমাদের বিপদে ফেলবেন। আই এ সি বলছিলেন আপনি নাকি দশটায় অফিসে আসেন?’

‘হ্যাঁ। অন্যায় করছি নাকি?’

‘নিশ্চয়ই। ওটাকে প্লিজ এগারোটা করুন। নইলে আপনার উদাহরণ আমাদের দেখাতে হবে।’

কথা হচ্ছিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের ঘরে বসে। সিনহা বলমাত্র সবাই হেসে উঠল। দীপাবলী একটু সিরিয়াস হয়েই জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? এই রিল্যাক্সেশন কেন?’

এ ও বললেন, ‘ট্র্যান্সপোর্টের জন্যে। অনেকেই উঠতে পারে না।’

‘মিথ্যে কথা। ন’টার সময় বাস ট্রাম ফাঁকা থাকে।’

‘ন’টায় তো কেউ বেরোয় না। তা ছাড়া যারা মফস্‌সল থেকে আসে তাদের ট্রেনে প্রায়ই গোলমাল। তাই একটু সময় দিতেই হয়।’

এবার সিনহা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি দিল্লিতেই বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ?’

‘কেন বলুন তো?’ দীপাবলী ব্যক্তিগত প্রশ্ন পছন্দ করছিল না।

সিনহা হাসলেন, ‘এটাই কলকাতার সিস্টেম। এটা চেঞ্জ করা সম্ভব না। এগারো থেকে বারোটার মধ্যে অফিসে আসা, একটা থেকে দুটো ইউনিয়নের মিটিং করা, আর চারটে বাজলেই কেটে পড়া। টোটাল তিন ঘণ্টা কাজ করেই বছরের পর বছর ঠিক ওয়ার্কলোড সামলে যাচ্ছে বাঙালি।’

সিনহার কথায় দত্তসামন্ত উদ্বুদ্ধ হলেন যেন, ‘হ্যাঁ, কোনও কাজ আটকে থাকছে না কিন্তু। টাইম বার্ড হচ্ছে না কোনও কেস।’

নিজের সেকশনের সবাইকে ডাকল দীপাবলী। মোটামুটি দিল্লির ছবি। যিনি সিনিয়ার তাঁর বয়স হয়েছে। জানা গেল পিয়ন হয়ে ঢুকেছিলেন। পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে আপার ডিভিশনে পৌঁছেছেন। দ্বিতীয়জন ডাইরেক্ট রিক্রুটেড ইন্সপেক্টার পরীক্ষায় পাশ করে অপেক্ষা করছে প্রমোশনের জন্যে। তৃতীয়জন পাটনা থেকে এসেছে। একটু ভিতু স্বভাবের। স্টেনো ছেলেটি বেশ স্মার্ট। পিয়নটিকে প্রথম দেখায় ঘোড়েল বলে মনে হয়েছিল। এদের সঙ্গে আছেন একজন ইন্সপেক্টার। আর প্রমোশনের আকাঙক্ষা নেই ভদ্রলোকের।

দীপাবলী প্রথম প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কখন অফিসে আসেন?’

একমাত্র স্টেনোগ্রাফার জানাল সে দশটা পনেরোতে অফিসে পা দেয়। সিনিয়ার এগারোটায় এবং তার সঙ্গীরাও সেই সময়ে। ইন্সপেক্টর জানালেন যেহেতু তাঁকে এনকুয়ারির কাজে বাইরে ঘুরতে হয় তাই আসতে দেরি হয়। দ্বিতীয়জন বলল, ‘আমাদের পাড়ায় এত বোমাবাজি হয় যে ইচ্ছে করলেও বেরুতে পারি না ঠিক সময়ে।’ পিয়নটি জানাল সে আসে সোদপুর থেকে আর প্রতিদিনই ট্রেনে গোলমাল। এই যেমন আজ। পকেট থেকে শেয়ালদা স্টেশন থেকে সংগ্রহ করা ট্রেন লেটের সার্টিফিকেট বের করে দেখাল।

দীপাবলী বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি আপনাদের সমস্যাগুলো খুব জেনুইন। তবে যখন চাকরি নিয়েছিলেন তখনও এই সমস্যা ছিল। দশটায় আসতে পারলে ভাল, কিন্তু সাড়ে দশটার পরে কেউ এলে সেদিন সই করবেন না, কাজও করতে হবে না। অন্যরা কে কী করছে জানি না, আপনারা আমার সঙ্গে যেহেতু কাজ করছেন তাই আমার কথা মানতে হবে।’

ইন্সপেক্টর বললেন, ‘কিন্তু ম্যাডাম, এনকুয়ারি থাকলে?’

‘সেটা তো আমিই করতে দেব। তাই না?’

সিনিয়ার বললেন, ‘সরকারি নিয়ম হল বারোটা পর্যন্ত সই করা যায়। তিন দিন লেট হলে একটা ক্যাজুয়েল লিভ কাটা হয়।’

‘বেশ। এখন থেকে আমার সেকশনে এই নিয়মটাই প্রয়োগ করা হবে। খাতায় কলমে ওটা রেখে লাভ কী! এরপরে যে কথাটা বলছি সেটা আমার বিশ্বাস থেকে। কোনও অ্যাসেসিকে অযথা হ্যারাস করবেন না। তখনই কাজ করে দিতে না পারলে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।’

দ্বিতীয়জন বলল, ‘ম্যাডাম, কথাটা আপনি না জেনে বললেন। আমি ইউনিয়ন করি, দায়িত্ব নিয়েই বলছি, অ্যাসেসিদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক আমাদের। হ্যারাস করেন অফিসাররা।’

‘আপনি ইউনিয়ন করেন?’

সিনিয়ার বললেন, ‘উনি অফিস রিপ্রেজেন্টেটিভ।’

‘কখন করেন?’

‘টিফিন আওয়ার্সে। ছুটির পরেও ইউনিয়ন অফিসে যেতে হয়। তবে জরুরি কিছু ঘটলে অন্য সময়ে সেটা করতে পারি, এ-ব্যাপারে সি আই টি-র মৌখিক অনুমতি আছে।’

‘তা হলে তো খুবই ভাল হল। আমি যে-পরিবেশ চাইছি তা নিশ্চয়ই আপনি সমর্থন করবেন। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করা হয় কাজের পরিবেশে সুস্থতা আনার জন্যে। তাই না?’

দ্বিতীয়জন একটু হকচকিয়ে গেল। মাথা নাড়ল কি নাড়ল না বোঝা গেল না।

বিকেল বেলায় ছেলেটি আবার ফিরে এল। তার হাতে কয়েকটা কাগজ। বসে বলল, ‘ম্যাডাম, আমাদের রিক্রিয়েশন ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠান সামনের মাসে মহাজাতি সদনে হবে। আপনি নতুন এসেছেন, পার্টিদের জানেন না, কিন্তু অসিতবাবু আপনাকে বলে দেবেন। চারখানা বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে আপনাকে। সিনহা সাহেবও রাজি হয়েছেন। সবাইকে অবশ্য বলছি না।’

‘বিজ্ঞাপন কেন?’

‘সুভেনিরের জন্যে। তিনদিনের অনুষ্ঠান তো। খরচ অনেক।’

‘পার্টিরা বিজ্ঞাপন কেন দেবেন?’

‘আপনি বললে কেউ না বলতে পারবে না।’

ফর্মগুলো দেখল দীপাবলী। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘পাঁচশো টাকা পকেট থেকে দিয়ে লোকগুলো পরে কোনও সুবিধে যদি চায় তখন কী হবে?’

‘মানে?’

‘আপনি কি অযথা পাঁচশো টাকা খরচ করেন?’

‘না, মানে, এটাই তো হয়ে আসছে।’

‘যার কাছে বিজ্ঞাপনের জন্যে টাকা নেব তাকে আমি পরে কী বলে ঠেকাব?’

‘একটু আধটু তো সবাই দেন।’ ছেলেটি হাসল, ‘সিনহা সাহেব—।’

‘কে কী করছেন আমার জানার দরকার নেই। এটা এক ধরনের ঘুষ নেওয়া। নিজের জন্যে নয় রিক্রিয়েশন ক্লাবের জন্যে বললে ব্যাপারটার গুরুত্ব যে দিচ্ছে তার কাছে কমে না। আপনি ইউনিয়ন করেন, এইভাবে চাপ দিয়ে পার্টির কাছে বিজ্ঞাপন চাওয়ার আগে একবার ভাবা উচিত ছিল।’

ছেলেটির মুখ দেখে মনে হল এমন অপমানিত সে কখনও হয়নি। বিনা বাক্যব্যয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দীপাবলী বুঝল এই নিয়ে অফিসে আলোচনা হবে এবং সবটাই তার বিরুদ্ধে যাবে।

পৌনে পাঁচটার সময় দীপাবলী দেখল পিয়নটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এক কোণে। চোখাচোখি হতেই সে হাতজোড় করল, আপনি যদি অভয় দেন তা হলে একটা কথা বলব!’

‘এভাবে কথা বলছেন কেন?’

‘আপনি আমাকে আপনি বলবেন না স্যার, আমার শুনতে খারাপ লাগে।’

‘আমি স্যার নই। যা হোক কী বলবেন?’

‘আগে বলুন আপনি অন্যায় নেবেন না। অফিসে সবাই বলছে আপনি খুব রাগী, খুব কড়া। এখন থেকে নো ফাউন্ডেশন ক্রিয়েট, নো টরচারিং, নো অ্যামালগামেশন!’

বিস্মিত দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘এসব কথার মানে কী?’

‘ও। দিল্লিতে এসব শোনেননি?’

‘না তো।’ কৌতূহল বাড়ছিল দীপাবলীর।

পিয়নটির নাম সুধীর। সে বাঁ হাতে ঘাড় চুলকাল, ‘না থাক তা হলে।’

‘কী বলতে এসেছিলেন সেটা বলুন।’

‘আজ্ঞে, আমার কয়েকটা কেস আছে—!’

‘কেস? কী কেস?’

‘মানে অ্যাসেসমেন্ট। আমিই রিটার্ন ভরে দিই। ফুটপাতের পার্টি সব। আমার ওপর খুব নির্ভর করে। বারো-তেরো হাজার টোটাল ইনকাম। আগের অফিসাররা সবাই জানেন। তাঁরা দয়া করে কেস করে দিতেন। দু’-দশটা টাকা ট্যাক্স হয়, ওরা দিয়েও দেয়।’

‘এর জন্যে আপনি ওদের কাছ থেকে টাকা নেন?’

‘আজ্ঞে, ভালবেসে যে যা দেয়—!’

দীপাবলী গম্ভীর হল। সুধীর সেটা ধরতে পারল না। সে বলে উঠল, ‘বেশি না। এই বিশ-পঞ্চাশ। পেশকারবাবুরা এক একটা কেস করে হাজার-দু’হাজার নিয়ে থাকেন। আমি অল্পেই সন্তষ্ট। উকিলবাবুরা কেস করে যাওয়ার সময় দু’-পাঁচটা টাকা বকশিশ দেন আর পুজোর আগে পার্টিদের কাছে কিছু পেয়ে থাকি। তখন সেকশন থেকেও দেয়।’

‘সেকশন থেকে দেয় মানে?’

‘হেড পেশকারবাবুর কাছে সব জমা হয়, তিনি ভাগ করে দেন। এসব না করলে আজকালকার বাজারে এই মাইনেতে সংসার চালানো কি যায়? বলুন আপনি?’

‘এইসব ব্যাপার আমার আগে যিনি অফিসার ছিলেন তিনি জানতেন?’

‘বিলক্ষণ! দেবতুল্য মানুষ ছিলেন তিনি। একশো টাকার নীচে হলে বলতেন সেকশনে দিয়ে দিন। ওঁর আমলে এই আমাকেই কত পার্টি পঞ্চাশ টাকা বকশিশ দিয়ে গেছে।’ গদগদ মুখে বলল সে।

‘সেকশনের সবাই এই দলে?’

‘ওই যে বললাম, হেড পেশকারবাবু ভাগ করে দেন রোজ। একশো টাকা রোজগার হলে চল্লিশ নিজে রাখেন, পঁচিশ সেকেন্ডবাবু, পনেরো থার্ড আর স্টেনো, পাঁচ আমার। ইন্সপেক্টরবাবু নিজে আলাদা ইনকাম করেন। তিনি এই দলে নেই।’

‘যিনি ইউনিয়ন করেন, তিনি?’

সুধীর গলা নামাল, ‘এই নিয়েই তো ঝামেলা। উনি অফিস আসেন সাড়ে এগারোটায়। এসেই খবরের কাগজ নিয়ে বসেন। একটা বাজতে-না-বাজতেই মিটিং কিংবা অন্য কাজে চলে যান। ঠিক চারটের সময় এসে অসিতদাকে বলেন ভাগটা দিয়ে দিতে। এইটে স্টেনোগ্রাফারবাবু মেনে নিতে পারছে না। বলছে, যে কোনও কাজ করে না সে ভাগ পাবে কেন?’

অসীম ধৈর্য দেখাবে বলে ঠিক করেছিল দীপাবলী। কিন্তু সুধীরের এই কথাগুলো সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। যে-মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ করে সে কখনও ঘুষ নিতে পারে না। আর এটা তো ঠিক ঘুষ নয়, বকশিশ! ট্রেড ইউনিয়নের কোনও কর্মী যদি এমন কাজ করে চলেন তা হলে নেতারা নিশ্চয়ই তাঁকে তিরস্কার করবেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবেন না। সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘সুধীরবাবু, আপনি এবার কাজে যান।’

‘আচ্ছা স্যার! আমি এসব বলতাম না। কিন্তু দুঃখের কথা কী জানেন, আমার ব্যাপারটা কেউ ভাবে না। বেশি লেখাপড়া শিখিনি বলে এখনও পিয়নের চাকরি করছি কিন্তু কোন ফাইলে কী আছে আমার চেয়ে বেশি পেশকারবাবুবা জানে না। আমি তো টবচারিং করতে পারি না।’

‘টরচারিং ব্যাপারটা কী?’

সুধীর হাসল, ‘স্যার, প্রথমে ফাউন্ডেশন ক্রিয়েট। পার্টি এল। সাত বছরের অ্যাপিল এফেক্ট দিয়ে ফাইল আপ টু ডেট করতে হবে। বাবুরা বললেন, পরে আসুন, এখন সময় নেই। পার্টি চাইছে এখনই। দু’পক্ষই মিষ্টি কথা বলে রাজি হলেন। বাবুরা কাজ শুরু করলেন। দু’দিন বাদে পার্টি এসে শুনল চালান ঠিক সময়ে দেওয়া হয়নি, পেমেন্ট বাকি আছে, এইসব কারণে ইন্টারেস্ট দিতে হবে অনেক। এটা হল টরচারিং। টরচার করে পার্টিকে কাবু করে দর বাড়ানো। তারপর সব কাজ শেষ হয়ে গেলে টাকা নেওয়া মানে অ্যামালগামেশন।’

দীপাবলী বলল, ‘ঠিক আছে এবার যেতে পারেন।’

‘আর একটা কথা স্যার।’ সুধীর ঘাড় চুলকাল।

দীপাবলী ঠোঁট কামড়ে তাকাল।

সুধীর বলল, ‘আপনি দয়া করে মিসেস ভার্মার মতো অর্ডার দেবেন না।’

‘মিসেস ভার্মা কে?’

‘চার বছর আগে আই টি ও ছিলেন। জয়েন করেই বললেন, আই ওয়ান্ট ডিসিপ্লিন। নো ঘুষ নো বকশিশ। আমি তো বিপদে পড়লাম। এই করে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি আরও তিনটি বাকি। একেবারে মরে যাব। সোজা বাড়িতে গিয়ে ওঁর পায়ে পড়ে গেলাম। শেষে দয়া করে বললেন, পার্টির কাছে হাত পেতে নিতে হবে না। উনি ওঁর ঘরের কোনায় একটা বড় ডিব্বা রেখে দেবেন। পার্টিরা তাদের ইচ্ছেমতো যা দেবার ওখানেই ফেলে যাবে। মাসের শেষে ডিব্বা ভেঙে আমি সব নিয়ে নেব। এটা করলে পাঁচজনে দেখতে পাবে না। সেইমতো কাজ শুরু হল। যারা আমাকে দু’টাকা দিত তারা আই টি ও-র সামনে পাঁচ ফেলতে বাধ্য হল। ঘর থেকে ওরা যখন বেরুতেন আমি জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতাম কে কত ফেলল। খাতায় লিখে রাখতাম। মাসের শেষে যোগ করে দেখলাম চারশো আশি। ডিব্বা ভাঙলে দেখি নব্বই টাকা।’

কাজের চাপ প্রচণ্ড। দীপাবলী ঠিক করেছিল, তার চোখের আড়ালে কী হচ্ছে তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাবে না। পেশকারবাবুরা যদি ঠিকঠাক কাজ করে দেন তা হলে কিছুই বলার নেই। অসিত লোকটা কাজের ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস। কাজ জানেনও ভাল। ব্যবহারে ঔদ্ধত্য নেই। তার কথা রেখে সাড়ে দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে কাজের ব্যাপারে তাঁকে ঘরে ডেকে পাঠায় দীপাবলী। একদিন হঠাৎ বলল, ‘অসিতবাবু। আপনাকে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।’

‘বলুন ম্যাডাম।’

‘পার্টিদের কাছ থেকে টাকাপয়সা না নিয়ে আপনি একটা নজির তৈরি করতে পারেন না?’

ভদ্রলোক মাথা নিচু করলেন।

‘আপনি খোলাখুলি কথা বলুন।’

‘ম্যাডাম, ওটা না নিলে খুব বিপদে পড়ে যাব।’

‘কেন?’

‘সংসারের খরচ যে-জায়গায় পৌঁছেছে, মানে, পেতে পেতে ওটাও বাজেটের মধ্যে এসে গিয়েছে।’

‘কিন্তু এটা অপরাধ, তাই না?’

‘জানি। কিন্তু উপায় নেই।’

‘আপনি বন্ধ করলে সেকশনের বাকিরাও নিতে সাহস পাবে না।’

‘না ম্যাডাম। ওরা আমার ওপর খেপে যাবে। এখন পর্যন্ত আমি গভর্নমেন্টের ক্ষতি না করে পার্টিদের কাজ করে পয়সা নিচ্ছি। বন্ধ হলে ফাইল থেকে কাগজপত্র হাওয়া হয়ে যাবে। আপনি সময়ের বিরুদ্ধে একা যেতে পারবেন না।’

‘মানে?’

‘আমরা যখন ডিপার্টমেন্টে ঢুকেছিলাম তখন কাজ করে পয়সা নিতে শিখেছিলাম। এখন ডিম্যান্ড নোটিশ চালানের জন্যেও এরা পয়সা চায়। যে-ছেলে সাত দিন আগে ডিপার্টমেন্টে ঢুকে রিসিভিং সেকশনে পোস্টেড হয়েছে, তার কাছে যদি আমি কোনও পার্টির জমা দেওয়া কাগজ চাইতে যাই তো আমার কাছেই পয়সা চায়। ভাবে আমার নিশ্চয়ই কোনও ইন্টারেস্ট আছে। সবাই সেকশনে পোস্টিং চায় কারণ এখানে পার্টিদের সঙ্গে ডাইরেক্ট যোগাযোগ হয়। আগে একটা গোপনীয়তা ছিল, এখন কেউ পরোয়া করে না।’

‘আমার পক্ষে এসব মেনে নেওয়া অসম্ভব।’

‘আমি জানি। একজন উকিল দিল্লিতে কেস করতে গিয়ে শুনে এসেছেন আপনার সম্পর্কে।’ অসিতবাবু মাথা নাড়লেন, কিন্তু এটা বন্ধ করা যাবে না। যেখানে দশ জন আই টি ওর ন’জনই চাপ দিয়ে পার্টির কাছ থেকে টাকা নেন, এবং সেটা দশ-বিশ হাজার থেকে এখন একশো পর্যন্ত নেমেছে সেখানে দু’-দশ টাকায় জন্যে ক্লার্কদের থামানো যাবে না।’

‘দশজনের মধ্যে ন’জন অফিসার নেয় এই তথ্য কোথায় পেলেন?’

‘চোখ খুলে দেখলেই টের পাবেন। হ্যাঁ, সবাই সিনহা সাহেবের মতো দুঃসাহসী নন। আমাদের ইন্সপেক্টর ওঁর লেকের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল একটা দরকারে। বাইশশো স্কোয়ারফুটের ফ্ল্যাট। ভেতরে কাচের দেওয়াল। জোড়া কাচ নয়। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। ইন্সপেক্টরের টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। উনি ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কোন টয়লেটে যাবেন? পিঙ্ক না হোয়াইট? উনি পিঙ্কে ঢুকে দেখেছিলেন দেওয়াল মেঝে থেকে তোয়ালে পারফিউম সবকিছুর রং পিঙ্ক। এসব সিনেমাতেও দেখা যায় না। আপনি বলুন, একজন অফিসার যে-মাইনে পান তাতে এমন বৈভবের মধ্যে থাকা সম্ভব? উনি কেয়ার করেন না। আমরা যা পাই তাতে অভাব মেটে না, উনি নেন স্ট্যাটাস বাড়াতে, আরও বেশি আরামে থাকতে। বলুন কে বেশি অপরাধী?’

দীপাবলী হতভম্ব। সে না জিজ্ঞাসা করে পারল না, ‘আপনারা যখন জানেন তখন তো এটা গোপন নেই। ডিপার্টমেন্ট থেকে স্টেপ নিচ্ছে না কেন?’

‘কারণ যাঁরা নিতে পারেন তাদের মন জুগিয়ে চলেন উনি।’

‘ঠিক আছে। কিন্তু কে কী করছে আমার দেখার দরকার নেই অসিতবাবু।’

‘বেশ। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, সরকারকে ডিপ্রাইভ করব না আমরা।’

দীপা হাসল, ‘আমি কি এতেও মত দিতে পারি।’

স্রোতের বিরুদ্ধে কোনও মানুষ একা চলতে পারে না। যেখানে মানুষের সবক্ষেত্রে অবক্ষয় এসে গিয়েছে সেখানে তো অসম্ভব। এই কলকাতা শহরে চোখ কান খোলা রেখে চললে একটি শিশুও যা শিখবে, তাতে তাকে ভবিষ্যতে যে-জাতির নায়ক করে তুলতে পারে তা রীতিমতো ভয়ানক। হয়তো এখনও যাকে ভয়ানক বলে মনে হচ্ছে সেসময় তাই স্বাভাবিক বলে মনে হবে। এখানে পুলিশ কনস্টেবল প্রকাশ্যে হাত বাড়িয়ে ড্রাইভারদের কাছে পয়সা নিতে লজ্জা পায় না। দোকানিদের ব্ল্যাকে জিনিস বিক্রি করতে যেমন দ্বিধা নেই তেমনি প্রয়োজনের চাপে বাড়তি দাম দিয়ে তা কিনতে হামলে পড়ে সবাই। পিতামাতাকে সারাদিন এত দু’নম্বরি ব্যাপারে জড়িয়ে থাকতে হয় বাঁচার প্রতিযোগিতায় জেতার জন্যে, যে শিশু তার বইয়ে লেখা উপদেশাবলি পড়েই ভুলে যেতে পারে অক্লেশে। দিন আসবে যখন এসব আর বইয়ে ছাপা হবে না।

যে-রাজনৈতিক পটপরিবর্তন একটা সুস্থ সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখাচ্ছিল তাও মুখ থুবড়ে পড়ল। সিরিয়াস নকশাল আন্দোলন ভারতবর্ষের আন্দোলন হতে পারল না। সেই আন্দোলনে ভেজাল মিশিয়ে জনসাধারণের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে শেষপর্যন্ত গলা টিপে থামিয়ে দেওয়া হল। হাজার হাজার ছেলে মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ত্রিশঙ্কু হয়ে রইল। বাজারদর হুহু করে বেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে তছনছ। মানুষ আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে না পেরে চোরাপথে অর্থ রোজগারের ধান্দায় নামল। ধীরে ধীরে মূল্যবোধের ওপর খোলস চাপল। একই মানুষ একসঙ্গে দুইরকম জীবনযাপন করতে শিখল। বাইরের জীবনে যে ঘুষ নিচ্ছে, নির্দ্বিধায় ঘরে ফিরে সে সন্তানকে আদর্শের কথা শেখাতে লাগল। তবু এখনও, লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকারকে হা হুতাশ করতে দেখেও, সন্তানকে শিক্ষিত করার জন্যে মানুষ মরিয়া! হয়তো এরা যেদিন বাস্তবমুখী হবে, সেদিন শিশুকে কে জি স্কুলে ভরতি করার জন্যে রাত না জেগে পকেট মারা, গুন্ডামি, প্রতারণা করার বিদ্যা আয়ত্ত করাতে সচেষ্ট হবে।

অসিতবাবু বোধহয় কথা রেখেছেন। এর প্রমাণ পাওয়া গেল যেদিন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ওর ঘরে এলেন, ‘মিসেস মুখার্জি, আপনি কল্যাণকে ছাড়তে রাজি আছেন?’

‘কী ব্যাপার? বলুন।’

‘আপনি নিয়মকানুন বেশি মানেন বলেই বোধহয় ও আপনার সেকশনে থাকতে চাইছে না।’

‘উনি থাকায় একজন কাজের লোক কম হয়ে গেছে সেকশনে। দিল্লিতে আমার সেকশনে একটি পাগলকে দেওয়া হয়েছিল। কাজের ব্যাপারে আমি একই ফর্ম পাচ্ছি।’

‘ঠিক আছে, আমি পালটে দিচ্ছি।’ ভদ্রলোক হাসলেন, ‘আমি একটা প্রস্তাব দেব বলে ভাবছিলাম। আমাদের অফিসে বেশ কয়েকজন মহিলা কর্মী আছেন। তাঁদের যদি জড়ো করে আপনার সেকশনে দিয়ে দিই তা হলে কেমন হয়?’

হঠাৎ দীপাবলীর মনে হল এতে সে বেঁচে যাবে। অন্তত পয়সাকড়ির ব্যাপারে মনের বিরুদ্ধে রোজ যে লড়াই করতে হচ্ছে তা থেকে রক্ষা পাবে। তবু সে জিজ্ঞাসা করল, ‘যাঁদের দেবেন তাঁরা কাজ জানেন তো?’

‘নিশ্চয়ই। ইন্সপেকট্রেস ভদ্রমহিলা তো খুবই ভাল। পেশকার দু’জন পরীক্ষায় পাশ করে বসে আছেন। আমার মনে হয় আপনার অসুবিধে হবে না।’

সেই ব্যবস্থাই হল। অর্ডার বেরোনোমাত্র অফিসে গুঞ্জন। অসিতবাব থেকে সুধীর পর্যন্ত অন্য সেকশনে চলে গেল। প্রমীলা সেকশন বলে ঠাট্টা চালু হল। পাঁচজন মহিলাকে নিয়ে আলোচনায় বসল দীপাবলী। সে দেখল দু’জন মধ্য চল্লিশে। বেশ গিন্নিবানি। দ’জন বছর পাঁচেক ঢুকেছে। পিয়ন মহিলাটি স্বামীর মৃত্যুর পরে চাকরি পেয়েছে।

সম্ভবত ইতিমধ্যেই দীপাবলী সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে সমস্ত অফিসে। তাই মহিলারা কেউ মুখ খুলছিলেন না প্রথমে। কাজকর্মের ব্যাপারগুলো ভাগ করে দিয়ে দীপাবলী বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনারা অফিসে আসবেন। আমরা মেয়েরা যে ছেলেদের চেয়ে কোনও অংশে কম নই তা কাজে প্রমাণ করে দেখাবার সুযোগ এটা।’

যাঁকে সেকশনের চার্জ দেওয়া হয়েছিল তিনি মাথা নাড়লেন, ‘আমার পক্ষে তো এগারোটার আগে আসাই সম্ভব নয়। মরে গেলেও পারব না।’

‘সেকী?’

সকাল থেকে কম কাজ? স্কুলের ভাত করে যখন বাস স্টপে আসি তখন পাদানিতে পা রাখা যায় না। কীভাবে যে অফিসে আসি তা বোঝাতে পারব না!’ মহিলা পুতুলের মতো মাথা নাড়লেন। দ্বিতীয়া মহিলা তাঁকে বললেন, ‘নমিতাদি, আমার ব্যাপারটা বলে দাও!’

দীপাবলী তাঁকে বলল, ‘আপনিই বলুন।’

‘মানে, আমার মেয়ে যে-স্কুলে পড়ে তার ছুটি হয় চারটেয়। বাড়িতে তো কেউ নেই। ওঁর অফিস। তাই মেয়েকে নিতে যেতে হয় ওইসময়।’ দ্বিতীয়া হাসিমুখে জানালেন।

ইন্সপেকট্রেস মহিলা বললেন, ‘আমার কোনও প্রবলেম নেই।’

নমিতা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘তোমার তো থাকবে না ভাই। বিয়ে থা করোনি, মা ভাত বেঁধে দেয়। ঝক্কি থাকলে বুঝতে পারতে সংসার সামলে আমরা চাকরি করি কী করে!’

দীপাবলী নমিতাকে বলল, ‘আপনি বললেন মরে গেলেও পারবেন না, তা হলে চাকরি করেন কী করে? চাকরি করতে গেলে নিয়মকানুন মানতে হবে তো?’

‘দূর! কুড়ি বছর পার করে দিলাম, এখন আর কী হবে। চুরি না করলে তো চাকরি যাবে না। আমার আগের সেকশনে ডিম্যান্ড নোটিশ লিখতে দিত, এক ফাঁকে করে দিতাম।’

দীপাবলীর মাথার ভেতরে দপদপানি শুরু হল। মহিলারা নিজেদের মধ্যে একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন। কী কষ্টে যে তাঁরা অফিস করছেন এটা ছেলেরা বোঝে না। আজকেই বাসে উঠতে চাইলে ছেলেরা বলে উঠেছিল পরের বাসে আসবেন। যেন ছেলেরাই অফিস করে তাঁরা করেন না। দীপাবলী স্পষ্ট জানিয়ে দিল, সাড়ে দশটার পরে কেউ যেন না আসেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া পাঁচটার আগে বেরোনো চলবে না। কোনও ফাইল একবার শুরু করলে কাজ শেষ না করে ছাড়া যাবে না। এসব না মানলে সে সোজা কমিশনারের কাছে লিখিত কমপ্লেন করবে। মেয়েরা চাকরি করছে মানে তারা দয়া করে কাজ করতে আসছে না। সবাইকে বিদায় করে সে ইন্সপেকট্রেসকে বসতে বলল।

একা হওয়ামাত্র ইন্সপেকট্রেস বললেন, ‘এঁদের দিয়ে কাজ করাতে আপনি অসুবিধেয় পড়বেন। কাজ না করে করে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন ওঁরা। নমিতাদির বদলে স্ট্যাটিসটিক্স থেকে সোনাদিকে নিলে খুব ভাল হত। উনি যা সিরিয়াসলি কাজ করেন তা যে-কোনও ছেলের চেয়ে ভাল।’

‘আগে এঁদের নিয়েই চেষ্টা করি। আপনার সাহায্য চাই।’

‘নিশ্চয়ই। অবশ্য সেটা করতে গেলে নমিতাদির কথা শুনতে হবে।’

‘কেন?’

‘ওঁর স্বভাবই ওইরকম। দেখলেন না, আমায় খোঁটা দিলেন সংসার করি না বলে। যেন বিয়ে না করলে সংসার করা হয় না। এক নম্বরের সুবিধেবাদী মহিলা। শুধু চেয়ে বেড়াবেন। সেকশনে সেকশনে ঘুরে ক্যালেন্ডার ডায়েরি থেকে শুরু করে টেস্টম্যাচের টিকিট পর্যন্ত।’

তবু কাজ শুরু হল। দিন পাঁচেকের মধ্যে কোনও গোলমাল হল না। শুধু নমিতা দেবী যেসব অর্ডার ড্রাফট করতেন তার প্রতিটি লাইন নতুন করে লিখতে হত দীপাবলীকে। প্রতিটি কাজ খুঁটিয়ে দেখতে হত। ফলে চাপ বেড়ে গেল দীপাবলীর। নিশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যাচ্ছিল না। ওপরওয়ালাকে স্ট্যাটিসটিক্যাল রিপোর্ট দিতে হয় অবিরত। এ-কাজটাও করতে হচ্ছিল তাকেই। মুশকিল হল এঁদের বিরুদ্ধে কাজ না করতে পারার নালিশ করলে সে নিজেই অপ্রিয় হবে। কিন্তু এর মধ্যেই তৃতীয় পেশকার মহিলাটি এবং ইন্সপেকট্রেস খুব দ্রুত নিজেদের যোগ্য করে তুলছেন এটাই যা একটু আশার কথা।

অফিস ছুটির পরে দু’জন অফিসার তার ঘরে এলেন। এঁদের পেছনে সিনহাও আছেন। সিনহা বললেন, ‘কী ব্যাপার মিসেস মুখার্জি, এখনও খেটে যাচ্ছেন? হাতে কোনও কাজ আছে?’

‘এই উঠব।’

‘যাবেন কোথায়?’

‘বাড়িতে।’

‘তা হলে আমার ওখানে চলুন। এঁরাও যাচ্ছেন। একটু চা খাওয়া যাবে একসঙ্গে।’

‘নাঃ, আজ থাক। আমি খুব ক্লান্ত।’

সিনহা হাসল, ‘আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার গরিবখানায় পায়ের ধুলো দিলে খুব আনন্দ পেতাম। ঘণ্টা দুয়েকের ব্যাপার। আমার ড্রাইভার আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’

দীপাবলী তাকাল। তার জিভে খুব কঠোর শব্দাবলি এসে যাচ্ছিল। কোনওমতে নিজেকে সামলে বলল, ‘না মিস্টার সিনহা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’

‘আরে ম্যাডাম চলুন। দু’জন সি আই টি আসছেন আমার ওখানে। আলাপ হয়ে গেলে আখেরে কাজ দেবে। আপনার মতো সুন্দরী মহিলাদের ওঁরা কৃপা করতে পেলে বেঁচে যান।’

‘একটু ভুল হল। আমি কারও কৃপার ওপরে বেঁচে নেই। ওঁদের কৃপা আপনার প্রয়োজন, কারণ যে-পথে আপনি আপনার গরিবখানা সাজিয়েছেন তাতে বাঁচার কোনও পথ খোলা থাকে না তা না হলে। আপনি তো বুঝতেই পারছেন আমরা এক পথের মানুষ নই।’

গলা চড়ল সিনহার, ‘মিসেস মুখার্জি, আপনি আমাকে অপমান করছেন!’

অন্য দুই অফিসার হস্তক্ষেপ না করলে ব্যাপারটা আরও খারাপ দিকে গড়াত।

পরের দিনই ঘটে গেল ঘটনাটা। নিজের ঘরে বসেই দীপাবলী চিৎকারটা শুনছিল। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কেউ চেঁচাচ্ছে। কাজে অসুবিধে হচ্ছিল। চেয়ার ছেড়ে ঘরের বাইরে আসতেই দেখল ভিড় জমে গেছে। প্রায় পঁচাত্তর-আশি বছরের ফরসা এক বৃদ্ধ চিৎকার করছেন, ‘ঘরের বউ না হয় নষ্টামি করেছে, তাই বলে তার বিচার করবে বেশ্যারা? অ্যাঁ?’

দীপাবলী এগিয়ে গেল, ‘আপনি এসব কী বলছেন?’

‘ঠিক বলেছি।’ থরথর করে কাঁপছিলেন ভদ্রলোক।

‘এভাবে কথা বলা অন্যায়। এটা বুঝতে পারছেন না?’

‘অন্যায়। আমাকে ন্যায় অন্যায় শেখাতে এসেছেন? হ্যাঁ, আমার তিনটে বাড়ি থেকে যে ইনকাম তা ঠিকমতো দেখাই না। যা রসিদ দিই তা থেকে ভাড়া নিই অনেক বেশি। আমার অর্নামেন্টসের ভ্যালুয়েশনে গোলমাল রয়েছে। তুমি আমাকে ধরো আমি তোমার সঙ্গে আইনের লড়াই করব। তা না, ডেকে এনে প্রথমেই বলে কিনা, বিশ হাজার টাকা দিন নইলে আপনাকে ফাঁসিয়ে দেব! আমি ওর বাবার বয়সি, একটুও বাধল না বলতে? আবার ন্যায় অন্যায় বলা হচ্ছে?’

‘কে আপনার কাছে বিশ হাজার টাকা চাইল?’

‘ওই যে নেমপ্লেটটা দেখছেন, মিস্টার সিনহা। ডাকাত, গবর্নমেন্ট ডাকাত পুষছে।’ বৃদ্ধের উত্তেজনা তখনও কমছিল না। যারা শুনছিল তারা হাসাহাসি করছে। অফিসারদের ঘুষ নেওয়ার যে-গল্প চালু ছিল তা আজ প্রকাশ্যে এসে গেল। একবার আড় ভাঙলে দেখতে হবে না। দীপাবলী ভদ্রলোককে বলল, ‘আসুন আপনি আমার সঙ্গে।’

সোজা আই এ সি-র ঘরে ঢুকে দীপাবলী সমস্ত ঘটনাটা বর্ণনা করে বলল। ‘একজন অফিসার হিসেবে আমি খুব অপমানিত বোধ করছি!’

আই এ সি বৃদ্ধের পরিচয় জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘আমার নাম হীরেন্দ্রনারায়ণ রায়। আমার বড় ছেলে আমেরিকায়, মেজ ছেলে দিল্লিতে ইন্ডিয়া গবর্নমেন্টের সেক্রেটারি।’

সেক্রেটারির নাম জানামাত্র আই এ সি নড়েচড়ে বসলেন। তিনি বৃদ্ধকে লিখিত অভিযোগ করতে বললেন। নিজের ঘরে বৃদ্ধ খসখস করে লিখে দিতেই আই এ সি সিনহাকে ডেকে পাঠিয়ে দীপাবলীকে যেতে বললেন। নিজের ঘরে ফিরে এসে দীপাবলীর মনে হল, তার সম্পর্কে কেউ যদি এভাবে অভিযোগ করত তা হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনও উপায় থাকত না।

একটু বাদেই টেলিফোন বাজল। সিনহার গলা। ‘মিসেস মুখার্জি, রায়কে আপনি আই এ সি-র ঘরে নিয়ে গিয়ে ভাল কাজ করেননি। ওরকম কমপ্লেন লেটার হাজার হাজার লেখা হয়েছে আমার নামে। কিন্তু সিনহার চুল ছোঁবে এমন কেউ পয়দা হয়নি এখন পর্যন্ত। আই এ সি বৃদ্ধকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই কেসটা বিনি পয়সায় আমাকে করে দিতে হবে, এই না। প্লিজ নিজের চরকায় তেল দিন।’

অফিস থেকে বেরিয়ে বাসে উঠতে প্রচুর সময় লাগে। সব ভরতি হয়ে আসছে ধর্মতলা থেকে। দীপাবলী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বাস স্টপে। হঠাৎ দেখল সুধীর তাকে নমস্কার করছে। সে বলল, ‘কী ব্যাপার সুধীরবাবু!’

‘আর ব্যাপার! আপনি তো আমাকে তাড়িয়ে দিলেন। এদিকে আপনার নতুন পিয়ন হেমাঙ্গিনী তো লাল হয়ে গেল।’

‘মানে?’

‘দু’হাতে বকশিশ নিচ্ছে।’

‘কী বলছেন আপনি? একজন বিধবা মহিলার নামে!’

‘লঙ্কার রাজা হলে রাবণ হতেই হয়। আমার বেলায় শুধু দোষ হল। সিনহাসাহেব বিশ হাজার নেবেন তাতে দোষ নেই, হেমাঙ্গিনী দিনে পঞ্চাশ পাচ্ছে তাতেও দোষ নেই। অফিসার আর মেয়েছেলেদের সাতখুন মাপ।’

সুধীর চলে গেলে অনেকক্ষণ অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দীপাবলী। হেমাঙ্গিনীকে সে বেশ সহানুভূতির চোখে দেখত। ঘরের বউ আচমকা বাধ্য হয়ে কাজ করতে এসেছে। কিন্তু সেও পার্টিদের কাছে হাত পেতে পয়সা নিচ্ছে। হঠাৎ সুধীরের কথাটা খেয়াল হল। অফিসার এবং মেয়েছেলে যাদের বলা হয় সেই দু’দলকেই তো সে একাই প্রতিনিধিত্ব করছে। লোকটা কি তাকেই ইঙ্গিত করল।

খুব খারাপ লাগছিল। চারধারে অসাধুতার প্রতিযোগিতা চলছে। জীবনের কাছে এখন এটাই স্বাভাবিক। সে একা শুধু প্রতিবাদের কথা ভাবছে। এমন একটা চাকরি সে বেছে নিল যেখানে নীচতা পাকা জায়গা গেড়ে বসেছে।

বাড়িতে ঢোকার সময় বক্সে উঁকি মারল সে। চিঠি এসেছে। এই প্রথম চিঠি। তালা খুলে মনোরমার হাতের লেখা চিনতে পারল। দিল্লি থেকে রিডাইরেক্ট হয়ে এসেছে খামটা। মুখটা ছিঁড়ে চিঠি বের করে চোখ বোলাতে গিয়ে অসাড় হয়ে গেল দীপাবলী। মনোরমা লিখেছেন, ‘কল্যাণীয়াসু, অতীব দুঃখের সহিত জানাইতেছি যে গত পরশু সন্ধ্যায় অঞ্জলি অকস্মাৎ দেবলোকে যাত্রা করিয়াছে। সে যে শয্যাশায়ী ছিল তাহা তুমি নিশ্চয়ই জানো। মৃত্যুর আগে তোমার নাম সে করিয়াছিল। অভাগিনী নিজের স্বার্থ দেখিল। আমি এই পোড়া চোখে আর কত দেখিব…।’

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন