সমরেশ মজুমদার
সারাটা রাত নির্ঘুমে কাটাল দীপাবলী। মনোরমার জ্বর কমার কোনও লক্ষণই নেই। বাড়তে বাড়তে সেটা চারে পৌঁছেছিল। মাথায় জল দিয়ে, গলা মুখ ভেজা তোয়ালেতে মুছিয়ে দিচ্ছিল সে বারংবার; এবং একসময় তার খুব ভয় লাগল। সেই কখন নিজে নির্বাচন করা ওষুধ খেয়েছিলেন মনোরমা কিন্তু তার কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। এখন নিশুতি রাত। কলকাতা ঘুমোচ্ছে। দীপাবলীর খুব মনে হচ্ছিল একজন ডাক্তারের কথা। কিন্তু কোথায় ডাক্তার পাওয়া যায়? এই কারণেই টেলিফোন দরকার। নাম্বার জানা থাকলে মাঝরাত্রেও পৌঁছানো যায়।
মনোরমা পড়ে আছেন নিথর হয়ে। তাঁর শিরা-জড়ানো বাঁ হাত মাঝে মাঝে কাঁপছিল। তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দেবার সময় ওঁর বুক পেট কোমরে পৌঁছেছিল দীপাবলী। এবং তখনই তার নতুন একটা বোধ জন্মাল। যৌবনে মনোরমার শরীর কেমন ছিল তা সে জানে না। তবে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছাবার পর সেই শরীরের স্পর্শ পেয়েছিল সে প্রতি রাত্রে। যা থেকে ওঁর যৌবনকে এখন অনুমান করা যেতে পারে। এখনকার মনোরমা সেইসব স্মৃতি অথবা স্মৃতিনির্ভর ভাবনার বাইরে ছিটকে এসেছেন। তাঁর শরীর কয়েকটা হাড় এবং তাদের কোনওমতে ঢেকে রাখা কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় সীমাবদ্ধ। জীবনের প্রতিটি বছর প্রতিটি মাস যেন কুঁকড়ে গিয়ে শরীরে একটার পর একটা ভঁজ ফেলেছে। শৈশব এবং বার্ধক্যের মধ্যে যাঁরা মিল দেখতে পান তারা ভুল করেন। শুরুর কোনও স্মৃতি থাকে না তাই দুঃখও বাজে না। শেষের শুধু স্মৃতিই সম্বল। আর কে না জানে সুখের স্মৃতি থেকেও একধরনের দুঃখের রস ক্ষরিত হয়। এই মনোরমাকে দেখে তার মনে হল ভদ্রমহিলার জীবনের কাছে আর নতুন কিছু পাওয়ার নেই। প্রতিটি মানুষ এতদিন বেঁচে থাকলে একদিন ওই বোধে উপনীত হবে। এই বেঁচে থাকাটা মোটেই আনন্দের নয়। দীপাবলী নিজের সঙ্গেই যেন কথা বলছিল। তার নিজের শরীরে যখনই অক্ষমতা এসে বাসা বাঁধবে তখনই যেন তার মৃত্যু ঘটে।
কিন্তু এসব ভাবনা নিজের। একটি মানুষের অসুস্থতা বাড়ছে এবং সেটা চুপচাপ চেয়ে দেখা যায় না। একটা কিছু বিহিত করা প্রয়োজন। হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্সটা বের করল সে। এই অবস্থায় কোন ওষুধ দেওয়া যায় যদি সে জানত! যে-শিশি থেকে মনোরমা তখন ওষুধ খেয়েছিলেন তার কয়েকটি দানা সে ইতিমধ্যে ওঁর মুখে ঢেলে দিয়েছে। কোনও লাভ হয়নি। হোমিওপ্যাথিতে যার অভ্যাস—! দীপাবলী উঠল। পাড়ায় কি কোনও মানুষ জেগে নেই? একজন জাগ্রত মানুষকে খুঁজে পেলে তার কাছ থেকে ডাক্তারের হদিশ মিলতে পারে। অভ্যস্ত হন বা না-হন ডাক্তারের নির্দেশে ওষুধ খেতে হবে মনোরমাকে। কিন্তু এত রাত্রে একা বেরোতে অস্বস্তি হচ্ছিল। খোকনকে ডাকল সে। প্রথম দু’বারে সাড়া পাওয়া গেল না। ক্লান্তি এবং মদ্যপান তাকে যেন ঘুমের অতলে ডুবিয়ে রেখেছিল। তৃতীয়বারের ডাকের সময় ঘরের আলো জ্বালল দীপাবলী। এবার চোখ খুলল খোকন। সংবিৎ ফিরল একটু পরে। উঠে বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’
‘ঠাকুমার জ্বর বাড়ছে। আমার খুব ভয় করছে। একজন ডাক্তার ডাকা দরকার।’
‘ডাক্তার কোথায় থাকে?’
‘জানি না।’
‘ক’টা বাজে এখন?’
‘আড়াইটে।’
‘খোকন বিছানা ছাড়ল। সে নিজেও কোনও পথ খুঁজে পেল না। একটু বিরক্ত গলায় বলল, ‘যেখানে থাকিস সেখানে কাছেপিঠে ডাক্তার আছে কিনা খোজ করবি না?’
‘আমার তো এতদিন প্রয়োজন হয়নি।’
‘চল নীচে যাই।’
‘আমি কী করে ঠাকুমাকে একা ফেলে যাই? আই অ্যাম সরি খোকন, তোকে এমন করে খাটাচ্ছি…।’ কথা শেষ করতে পারল না দীপাবলী। ভদ্রস্থ হয়ে হাত নেড়ে তাকে থামতে বলে দরজা খুলে ততক্ষণে নেমে যাচ্ছে খোকন। দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে ফিরে এল সে। মনোরমা একই ভঙ্গিতে স্থির। জীবিত কি মৃত বোঝা যাচ্ছে না। কখনও কখনও মানুষের এই দুই পর্যায়ের ছবি একরকম হয়ে যায়।
দারোয়ানকে ঘুম থেকে তুলে খোকন যখন একজন ডাক্তারকে নিয়ে এল তখন রাত সাড়ে তিনটে। সে কীভাবে অচেনা জায়গায় এমন সফল হল এই আলোচনার অবকাশ হয়নি। ভদ্রলোক নাড়ি দেখলেন। স্টেথো চাপলেন বুকে পাঁজরে পিঠে। জ্বর দেখলেন। পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিলেন। শেষে গম্ভীর মুখে প্রেসক্রিপশন লিখতে বসলেন। সেটা শেষ করে নাম জিজ্ঞাসা করলেন। দীপাবলী মনোরমার পুরো নাম বলে জানতে চাইল, ‘ভয়ের কিছু নেই তো ডাক্তারবাবু?’
ডাক্তার বললেন, ‘এখনও বলা যাচ্ছে না। কাল সকাল দশটায় যদি অবস্থার উন্নতি না হয় তা হলে হসপিটালাইজ করবেন।’
খোকন পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞাসা করল, ‘ওষুধের দোকান ভোলা পাওয়া যাবে?’
ডাক্তার উঠলেন, ‘এ-পাড়ায় পাবেন না। ধর্মতলায় একটা-দুটো দোকান সারারাত খোলা থাকে। পিজির সামনেও পেতে পারেন।’
‘অত দূরে এত রাত্রে যাব কী করে? ট্যাক্সি যদি না পাওয়া যায়।’
ডাক্তার ঘড়ি দেখলেন, ‘আর তো ঘণ্টা দেড়েক বাদেই বাস চলবে। ততক্ষণ এক কাজ করুন, বাড়িতে জ্বরজারির কোনও ট্যাবলেট আছে?’
দীপাবলীর সঞ্চয়ে কিছু ছিল। এগুলো এখন প্রায় সব বাড়িতেই রাখা থাকে। মাথাধরা, সামান্য জ্বরজ্বারি, অথবা একদিনের পেট খারাপের জন্যে কে আর ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়! ডাক্তার তা থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে বললেন, ‘গিলে খেতে পারবে বলে মনে হয় না। গুঁড়ো করে জল মিশিয়ে দিন। মাথা ধোয়ানোটা বন্ধ করবেন না।’
পঞ্চাশ টাকা দক্ষিণা নিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন। খোকন তাঁকে নীচ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এল। তখন আকাশ একটু একটু করে রং বদলাতে শুরু করেছে। ফিরে এসে খোকন দেখল চামচে করে গোলা ওষুধ মনোরমাকে খাইয়ে দিচ্ছে দীপাবলী। সমস্তটা খাওয়ানোর পর বালতিতে জল নিয়ে এসে মাথা ধোওয়ানো হল। খোকন বারান্দায় চলে গেল চেয়ার নিয়ে। শরীরের কোথাও এক ফোঁটা ঘুম নেই। কিন্তু আলস্য আছে। দীপাবলী রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের জল বসাল। মনোরমাকে যদি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় তা হলে পি জি-ই ভাল। কিন্তু হাসপাতাল শুনতেই ভয় লাগে। নার্সিংহোমে কেমন খরচ হয়? ডাক্তার ঠিকই বলেছেন। বাড়াবাড়ি হলে তার একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। খোকন নিশ্চয়ই আজ চলে যাবে। ও যা করেছে তা অনেক। আর বেশি কিছু চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু ডাক্তার পরিষ্কার করে কিছু বললেন না। যদি তার কাছে আসার পরে মনোরমার কিছু হয় তা হলে! অসম্ভব! নিজের মনে মাথা নাড়ল সে। না, হতে দেবে না।
চায়ের কাপ দুটো নিয়ে বারান্দায় এল দীপাবলী। সেটা হাতে নিয়ে খোকন খুব খুশি, ‘ফার্স্টক্লাস।’ মনের কথা কী করে বুঝতে পারলি।’
দীপাবলী হাসল। অন্ধকার অনেকটা সরে গেছে। এখন পৃথিবী গভীর ছায়ায় জড়ানো। সে মনোরমার বিষয়ে কথা বলতে যাচ্ছিল এইসময় খোকন বলল, ‘তোর মনে আছে দীপা, ঠিক এইরকম ভোরে আমরা ফুল তুলতে যেতাম। ঘাসের ওপর পড়ে থাকা শিউলি কুড়োতিস তুই। আহা, ছোটবেলাটা কী সুন্দর ছিল। কোনও ধান্দাবাজি ছিল না সেইসময়।’
আচমকা সবকিছু থেকে মুক্তি নিয়ে দীপাবলী ছিটকে গেল ছেলেবেলায়। সে ফুল কুড়োত এইরকম বাত-না-যাওয়া ভোরে। খোকনরা অবশ্য লক্ষ্মীপুজোর আগে আসত। সাজি ভরে যেত শিউলি ফুলে। নধর হলুদ বোঁটার সাদা ফুল। সেইসময় একদিন সেই মালবাবুর বাড়িতে বেড়াতে আসা ছেলেটি তাকে সচিত্রা সেনের সঙ্গে তুলনা করেছিল। হেসে ফেলল সে। দৃশ্যটা চোখের সামনে সেঁটে আছে।
খোকন জানতে চাইল, ‘কী রে, হাসছিস কেন?’
ভাবনা ঘোরাল দীপাবলী, ‘তোর সেসব কথা এখনও মনে পড়ে খোকন?’
খোকন মাথা নাড়ল, ‘এমনিতে পড়ে না। তুই পাশে আছিস আর রাতটা ভোর হচ্ছে দেখে হঠাৎ মনে পড়ে গেল। যাক, ঠাকুমার ব্যাপারে কী করবি?’
‘দেখি। দশটা পর্যন্ত দেখে ঠিক করা যাবে।’
‘আজ তোর অফিস চোট।’
‘দেখি! ফোন করে অন্তত জানাতে হবে।’
‘বুড়ি তোকে কী ঝামেলায় ফেলল বল তো!’
‘ঝামেলা বলছিস কেন? ওঁকে অনেক আগে আমার নিয়ে আসা উচিত ছিল।’
‘তা হলে তুই বল মায়ের বিরুদ্ধে না গিয়ে আমিও ঠিক করছি?’
‘তুই যদ্দিন বউকে ভালবাসবি তদ্দিন ঠিক করছিস।’
‘আরে সেটাই তো গোলমাল। মা চাইছে না আমি বউকে ভালবাসি। বউ চাইছে না আমি মাকে সাপোর্ট করি। তুই বুঝতে পারছিস না।’
‘পারছি। তুই যদি সত্যি তোর বউকে ভালবাসিস তা হলে সেটা ও বুঝতে পারবে। তখন তোকে দুঃখ দেবে না বলেই মায়ের সঙ্গে মানিয়ে নেবে।’
‘সেটা নেয়। আসার সময় বলেছে মাকে নিয়ে চিন্তা না করতে। কিন্তু মাকে ম্যানেজ করা মুশকিল। বাবা পারেনি, ঠাকুমা পারেনি।’
দীপাবলী হেসে ফেলল। খোকন জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল?’
‘ছেলেবেলায় একটা গল্প খুব বিশ্বাস করতাম। তোদের বাড়িতে যে-বাতাবি লেবুর গাছ ছিল তার প্রথম পাকা বাতাবির রস তোর ঠাকুমা নাকি আকাশ থেকে নেমে এসে ডালে বসে চুষে খেতেন। দৃশ্যটা তুই ভাব।’ দীপাবলী আবার হেসে উঠতেই গলা মেলাল খোকন। তারপর বলল, ‘মা কিন্তু সেইসময় ঠাকুমাকে খুব ভয় করত। বাড়ি বাড়ি বিলিয়ে দিত বাতাবি, আমাদের খেতে দিত না। বাবা খুব রাগ করত তাই।
ঘণ্টা দুয়েক বাদে কপালে হাত দিয়ে অবাক হল দীপাবলী। তাড়াতাড়ি থার্মোমিটার দিল মনোরমার বগলে। আর তাতে চোখ মেললেন মনোরমা। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন লাগছে এখন?’ মনোরমা মাথা নাড়লেন, ভাল। জ্বর একশো। কমেছে অনেক। মনোরমা বাথরুমে যেতে চাইলেন। দীপাবলী তাকে সাহায্য করল। কাল রাত্রে মুখের যে-চেহারা হয়েছিল তার অনেকটা দূর হয়েছে। জল চেয়ে মুখ ধুয়ে আবার বিছানায় ফিরে গেলেন তিনি। খোকন হাসছিল, ‘ঘরে যে-ওষুধ ছিল তাই দিতেই জ্বর কমল অথচ তুই মাঝরাত্রে ডাক্তার এনে সারারাত জেগে কী কাণ্ডটাই না করলি। সন্ধেবেলায় ওষুধটা খাইয়ে দিলে এসব ঝামেলাই হত না।’
দীপাবলীর ভাল লাগছিল। যদি আবার জ্বর না আসে তা হলে তো আনন্দের সীমা নেই। মুখে বলল, ‘তখন ঠাকুমাকে ওই ট্যাবলেট খাওয়ানো যেত না। হুঁশ ছিল না বলে খেয়েছেন।’
কথাগুলো মনোরমার কানে যাচ্ছিল। প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতেই ভাল লাগছিল। খোকন বলল, ‘তাঁ হলে হাসপাতালের কী করবি?’
দীপাবলী সেটাই ভাবছিল। চোখে পড়ল মনোরমার ডান হাত নিষেধের ভঙ্গিতে নড়ছে। ওরা দু’জনেই একসঙ্গে হেসে ফেলল। খোকন বলল, ‘না বললে হবে না ঠাকুমা। আপনি কাল রাত্রে যে খেল দেখিয়েছেন তাতে হাসপাতালই আপনার ঠিক জায়গা।’
মনোরমার মাথা এবার দু’পাশে নড়তে লাগল। দীপাবলী হাসল, ‘ঠিক আছে, জ্বর তো এখন কমেছে। যদি আবার না আসে তা হলে কোথাও যেতে হবে না। আর একবার ট্যাবলেট খাওয়াব বলে ভাবছি। কিন্তু তার আগে তোমাকে কিছু খেতে হবে। চা খাবে না। বিস্কুট খেতে পারবে? না বললে শুনছি না।’ দীপাবলী উঠল। খোকন বলল, বাজারের ব্যাগটা দে। আমার সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছে। একসঙ্গে সব কিনে আনি।’
না, মনোরমার সেই জ্বর আর ফিরে আসেনি। তবু খোকনকে একবার সেই ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছিল। তিনিও অবাক হয়েছেন। বলেছেন, হোমিওপ্যাথিতে যাঁরা অভ্যস্ত তাঁদের শরীরে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ, যার ক্ষমতা খুব সামান্য, তা অনেক বেশি কার্যকর হয় কখনও কখনও। জ্বর কমে গেলে তার ট্যাবলেট খাওয়ানোর দরকার নেই। তিনি একটা মিক্সচার করে দিয়েছেন যেটা আগামীকাল পর্যন্ত খাওয়াতে হবে। সেইসঙ্গে কিছু ভিটামিন লিকুইড নিয়ে এল খোকন, ডাক্তারের পরামর্শমতো।
সারাটা সকাল নিশ্চিন্তে ঘুমালেন মনোরমা! জ্বর এখন নিরানব্বুই। মাছের ঝোল ভাত আর একটা তরকারি বানিয়ে ফেলেছিল দীপাবলী। ওষুধের সঙ্গে বুদ্ধি করে শিঙাড়া জিলিপি কিনে এনেছিল খোকন। তাতে জলখাবারের সমস্যা গেল। রান্নার সময়ে সে এগুলোই ভাবছিল। খোকনকে বাজার ওষুধ এবং জলখাবারের টাকা দিয়ে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু এই পরিশ্রমগুলো তাকে করতে হল না। একটি মেয়ে ইচ্ছে করলেই বাজার যেতে পারত, ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে ওষুধ আনতে পারত, ফেরার পথে মনে রেখে জলখাবার কেনাও তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আজ তাকে এসবের কিছু করতে হয়নি। কেউ করণীয় কাজ আন্তরিকতার সঙ্গে করে দিলে এক ধরনের আরাম হয়। এই আরামটা ঠিক চাকরবাকরকে দিয়ে করিয়ে পাওয়া যায় না। সেখানে শুধু স্বস্তিটুকু থাকে। খোকন চলে গেলে আবার তাকে এ সবই করতে হবে। অলোকের কথা মনে পড়ে গেল তার। ইচ্ছে করলেও মানুষটাকে ভুলে থাকতে পারে না সে। যতই মতবিরোধ হোক, সম্পর্ক নিয়ে ভেঁড়াঘেঁড়ি চলুক, ওই যে মাসের পর মাস একসঙ্গে থাকা, এক ধরনের সাহচর্যের আরাম— এ সবই একজীবনের জন্যে মনের গায়ে গাঁথা হয়ে আছে। অলোক আর কিছু না হোক, খোকনের মতো ভাল বন্ধুও তো হতে পারত!
এই ফ্ল্যাটে দুটো টয়লেট। একটা দিশি মতে। সেটি বাইরের দিকে। শোওয়ার ঘরের সঙ্গে যেটি, সেটায় কমোড রয়েছে। মনোরমার পক্ষে কোনওমতে সেখানে যাওয়াই সম্ভব। অথচ তিনি কখনওই কমোড ব্যবহার করেননি। বাড়িতে বেডপ্যানও নেই। চট করে গিয়ে কিনে আনবে এ-পাড়া থেকে তেমন কোনও দোকান নেই। মানুষটি এত দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে একা ছাড়াও যায় না। দীপাবলীর অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। বালিকা অথবা শিশু বয়সে অঞ্জলি অসুস্থ থাকলে মনোরমা তাকে পরিচর্যা করতেন। কী করে নিজেকে পরিষ্কার করতে হয় তাই বোঝাতেন বারংবার। আজ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি অসুস্থতার কারণেই সেই শৈশবে ফিরে গিয়েছেন আর দীপাবলীকে মা-ঠাকুমার ভূমিকা নিতে হল। অসুস্থতা সত্ত্বেও মনোরমার সংকোচ হচ্ছিল। প্রায় ধমক দিয়েই সেটা দূর করল দীপাবলী। অত কষ্টের মধ্যেও বুড়ি রসিকতা করলেন, ‘তোর ছেলেমেয়ে হল না কিন্তু আমি যে তোর মেয়ে হয়ে গেলাম।’ দীপাবলী হেসেছিল। কাজ শেষ করার পর তৃপ্তি হল। সে লক্ষ করছিল মনোরমার সেই শুচিবায়ুগ্রস্ততার কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। নিজেকে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছেন ওর ওপরে। হয়তো সেটা শক্তিহীনতার কারণে; পরে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
স্নান সেরে বৃদ্ধাকে পাউরুটি আর তরকারি খাইয়ে দিল সে। বলল, ‘নিরামিষ তরকারি। আগে রেঁধেছি আলাদা কড়াইতে। তোমার কোনও চিন্তা নেই।’ মনোরমা কিছুই বললেন না। খাওয়ার পর মিক্সচার খেয়ে আবার বিছানায় কাত হলেন।
এবার খোকনকে খেতে ডাকল দীপাবলী। টেবিলে পরিবেশন করতে গিয়ে সে শক্ত হল। তারপর হেসে ফেলল। খোকন জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসলি কেন?’
‘তোর হয়তো খাওয়া হবে না।’
‘কেন?’
‘আমার রান্না খুব খারাপ। খাওয়া যায় না।’
খোকন বেশ অবাক হল। হাত নেড়ে বলল, ‘শালা বিনি পয়সায় পাচ্ছি তার ভাল আর মন্দ। আমার অনেক খারাপ রান্না খাওয়ার অভ্যেস আছে। সরি, শালা বলে ফেললাম। তুই বসে যা।’ ভাত তরকারি মেখে মুখে দিয়ে সে বলল, ‘তুই আঙসাঙ বলিস জানতাম না তো!’ খেতে শুরু করেছিল দীপাবলী, বলল, ‘আজ কী করে যেন উতরে গিয়েছে।’
আচমকা খোকন জিজ্ঞাসা করল, ‘তোকে কেউ বলেছে তুই খারাপ রাঁধিস?’
‘বলতে হবে কেন? আমি নিজেই জানি।’
‘যত ফালতু কথা।’
খাওয়াদাওয়ার পর দীপাবলীকে একটু বেরোতে হয়েছিল। পোস্টঅফিস থেকে অফিসে টেলিফোন করে জানিয়ে দিল সে যেতে পারেনি অসুস্থতার কারণে। প্রয়োজন হলে দিন চারেক ছুটি নেবে। একটা চিঠি সঙ্গে সঙ্গে লিখে ডাকবাক্সে ফেলে দিল। দিয়ে নিশ্চিন্ত হল।
সারাটা দুপুর তিনটি মানুষ ঘুমিয়ে কাটাল। সন্ধের মুখে খোকনের হাঁকডাকে ঘুম ভাঙল। খোকনের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে চা বানাল দীপাবলী। টেলিফোন করে ফেরার সময় এক বোতল হরলিক্স কিনে এনেছিল। সেটা তৈরি করে মনোরমাকে দিল। মনোরমার জ্বর মাছির নীচে নেমে গেছে।
বাইরের ঘরে নিজের চায়ের কাপ নিয়ে সে যখন এল তখন খোকনের চা খাওয়া হয়ে গেছে। ব্যাগ নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘চলি!’
হঠাৎ খুব কষ্ট হল দীপাবলীর। খোকন যদি আরও কয়েকটা দিন থাকত! একটি মানুষ নিজের রোজগার পরিবার ছেড়ে এভাবে পড়ে থাকতে পারে না তা সে জানে। তবু কষ্টটা এল। খোকন বলল, ‘চলি রে! ঠাকুমা কি এখনও ঘুমোচ্ছে?’
দীপাবলী মাথা নাড়ল, না। খোকন তার পাশ দিয়ে ভেতরের ঘরে চলে এল, ‘বাঃ, এই তো। একেবারে ফিট! এখন নাতনিকে পেয়ে গেছেন আর চিন্তা কী! আমি ফিরে যাচ্ছি। কাউকে কিছু বলতে হবে?’
মনোরমা এক মুহূর্ত স্থির রইলেন। তারপর বললেন, ‘কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবি আমি এখানেই বাকি ক’টা দিন থাকব। কারও দরকার নেই আমার খোঁজ করার।’
‘কে খোঁজ করবে? সবাই তো বেঁচে গিয়েছে। চলি আমি।’
‘খোকন।’
‘বলুন।’
‘তুই আমার ছেলের কাজ করলি বাবা!’
‘যাচ্চলে। নাতি হয়ে কী করে ছেলের কাজ করব? চলি।’ বাইরে বেরিয়ে এসে সে দীপাবলীর মুখোমুখি হল। দীপাবলী ডাইনিং স্পেসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। হেসে বলল, দীপা, তোর কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে, আমি বুঝতে পারছি না।’
সঙ্গে সঙ্গে সহজ হয়ে গেল দীপাবলী, ‘পাকামি করিস না। গিয়ে চিঠি দিবি। বউকে আমার কথা বলবি। আর সুযোগ পেলেই ওদের নিয়ে আমার এখানে চলে আসবি। বুঝতে পেরেছিস?’
খোকন মাথা নেড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। সিড়ি থেকে যতক্ষণ দেখা গেল দেখে দীপাবলী ব্যালকনিতে চলে এল। একটু বাদেই খোকনকে রাস্তায় দেখা গেল। দীপাবলী আশা করছিল খোকন একবার মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাবে। কিন্তু সেটা ওর মাথায় নেই বোঝা গেল। পৃথিবীতে আর কোনও সমবয়সি পুরুষের কথা এই মুহুর্তে মনে পড়ল না যে তাকে তুই বলে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারে। খোকনের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয় না। কে জানে খোকন হয়তো তার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তা অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে করে না। সেই মেয়ের কাছে খোকন আর পাঁচটা পুরুষের মতো। হয়তো অলোককে অন্য কোনও নারী স্বচ্ছন্দ ব্যবহারের জন্যে প্রশংসা করে। অলোক যদি তার সঙ্গে খোকনের মতো ব্যবহার করত! দীপাবলী চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছিল। এইসময় ভেতর থেকে মনোরমা দুর্বল গলায় ডাকলেন, ‘দীপা, ও দীপা, আলোটা জ্বাল!’
দীপাবলী চোখ খুলল। পৃথিবী এখন ঝাপসা। অন্ধকার নামা সত্ত্বেও আলোর সম্পূর্ণ মুছে যাওয়ার সময় হয়নি। তবু সে জলের আড়াল সরাতে পারছে না। ঘরে ঢুকল সে। চার দেওয়ালের ভেতরে এখন আঁধার। তার মধ্যে খাটের মাঝখানে মনোরম বাবু হয়ে বসে আছেন। দীপাবলী জানে না কেন কোন কারণে সে দূরত্বটুকু অতিক্রম করে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে মনোরমার কোলে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। বুকের ভেতর যে দমবন্ধ কষ্টটা গুমরে মরছিল তাই বাঁধভাঙা জলের মতো কান্না হয়ে বেরিয়ে এল। মনোরমা অবশ্যই অবাক হয়েছিলেন। তারপর নিজেকে সামলে ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। চুলের ফাঁক গলে সেই স্পর্শ শরীরে প্রবেশ করামাত্র দীপাবলী আরও আবেগে আক্রান্ত হল। ঘরের আলো জ্বলল না। তরল অন্ধকারে দুই নারী পরস্পরকে জড়িয়ে রইল শব্দহীন হয়ে।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর তার ঘুম নেই। পাশাপাশি শুয়ে মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর ব্যাপার কী বল। বিয়ে করলি কিন্তু দু’জনে আলাদা কেন?’
‘বাঃ, ও দিল্লিতে চাকরি করছে আমি এখানে বদলি হয়ে এসেছি, তাই।’
‘তা হলে কাদলি কেন?’
দীপাবলী ঠোঁটে শব্দ করল, ‘আঃ, আমার কথা থাক। কাল রাত্রে কী বলতে চাইছিলে সেটাই বলো। কী হয়েছে তোমার?’
মনোরমা নিশ্বাস ফেললেন, ‘কী আবার হবে। কপালে যা লেখা ছিল তাই হয়েছে।’ ‘তুমি খুব কপাল বিশ্বাস করো বুঝি?’
‘নিশ্চয়ই। ভাগ্যে যা লেখা আছে মানুষ তার বাইরে এক পা যেতে পারে না।’
‘তাই? আমি যখন ওই বয়সে বিধবা হয়েছিলাম তখন ভাগ্যে কী লেখা ছিল? আর পাঁচটা বাঙালি বিধবার মতো বাবা বা ভাইয়ের সংসারে কাজ করে জীবনটা কাটিয়ে দেব। তাই না?
‘তোর ভাগ্যে সেটা লেখা ছিল না। যা ছিল তুই তাই হয়েছিস।’
‘আশ্চর্য! আমি যদি তখন চেষ্টা না করতাম, উদ্যোগ না নিতাম, তা হলে কি হত?’
‘তুই যে চেষ্টা করবি তাও লেখা ছিল নিশ্চয়ই।’
‘উফ। তোমার সঙ্গে তর্কে পারা যাবে না। তারপর বলল, কী হয়েছিল?’
‘তুই তো দেখে এলি আমরা কীভাবে ছিলাম। ছোটছেলের সঙ্গে নিত্য ঝামেলা হত অঞ্জলির। সে ব্যাবসা করবে, বাড়ি বাঁধা রেখে টাকা পেতে চায়। অঞ্জলি কিছুতেই তাতে রাজি হবে না। এক রাত্রে ওইরকম ঝগড়ার সময়ে অঞ্জলির বুকে ব্যথা করতে লাগল। আমাকেও কিছু বলেনি। নিজের ঘরে শুয়েছিল। পরদিন বুঝলাম হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ডাক্তার এল। আমিই ডাকিয়ে আনলাম। খবর পেয়ে বড়ছেলে এল বিকেলে। সেটা সামলালেও বিছানা থেকে উঠতে পারল না। তার পরেরবার আবার যখন হল তখন সব শেষ। শেষদিকে আমার হাত জড়িয়ে বলত, তোমার কী হবে? মেয়েটাকে লেখো।’
‘আমি তোমাকে চিঠি দিতাম।’
‘আমি পাইনি। পরে বুঝলাম সেসব চিঠি পোেস্টঅফিস থেকে ওই হারামজাদা ছেলে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলত। তোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখি ও চাইত না। গত সপ্তাহে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাকে বলতেই আমাকে মারতে তেড়ে এল। মুখের ওপর বলল, বেশ, করেছি। অতই যখন টান তখন চলে যাও না দিদির কাছে। গেলে দূর করে তাড়িয়ে দেবে। এটা শুনেও মুখ বুজে ছিলাম। পয়সাকড়ি দিত না অঞ্জলি মরে যাওয়ার পর থেকে। কীভাবে যে বেঁচে ছিলাম তা আমিই জানি। এমন সময় নাতজামাইয়ের চিঠি পেলাম।’
‘নাতজামাই? মানে অলোক?’ দীপাবলী অবাক।
‘তোরা কী সহজে স্বামীর নাম ধরিস, না?’
‘কেন? এতে অন্যায় কী আছে? ওরা যদি আমাদের নাম ধরে ডাকতে পারে তা হলে আমরা পারব না কেন? এ তো খুব অদ্ভুত ব্যাপার।’
‘আমরা পারতাম না। আমাদের শেখানো হয়েছিল তাই।’
‘ভুল শেখানো হয়েছিল।’
‘হয়তো ঠিক। কী জানি।’
‘কী লিখেছিল অলোক?’
‘ভাল চিঠি। আমি পোস্টঅফিসে গিয়ে বলে এসেছিলাম বলে আমার হাতে দিয়ে গিয়েছিল। খুব বিনয় করে লিখেছিল আমার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি বলে সে ক্ষমা চাইছে। চাকরির প্রয়োজনে তুই এখন কলকাতায় আছিস। তোকে আমি দিল্লির ঠিকানায় যে-চিঠি লিখেছি তা কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। কলকাতার ঠিকানাটা জানিয়েছে। ও লিখেছে যে তোর এবং ওর নাকি খুব ইচ্ছে আমার অসুবিধে না হলে আমি যেন কলকাতায় এসে থাকি। এইসব।’
‘তুমি উত্তর দিয়েছ?’
‘না। তার সুযোগ পেলাম কোথায়?’
‘কেন?’
‘তার পরদিনই দুই ভাই আমার কাছে এসে হাজির। ওরা দু’জনে ঠিক করেছে ওই বাড়িটা রাখার কোনও মানে হয় না। ওরা কেউ সেখানে থাকবে না। ভাল দাম পেয়েছে তাই বিক্রি করতে চায়। এতে ছোটভাইয়ের ব্যাবসা করতে সাহায্য হবে। আমাকে নিয়েই তাদের দুশ্চিন্তা। আমি বড়ভাইয়ের কাছে বাগানের কোয়ার্টার্সে গিয়ে থাকতে পারি কিন্তু সেটা তোর ভাইবউ পছন্দ করছে না। এক্ষেত্রে যদি কাশীতে গিয়ে থাকি তা হলে ওরা প্রতি মাসে আমাকে কিছু খরচ দেবে। আমি এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম যে কথা বলতে পারছিলাম না। ওরা আমাকে জানিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি কী বলি বা না বলি তা ধর্তব্যের মধ্যে নিল না। তরশু বিকেলে দুটো লোক এল বাড়িতে। ওরা নাকি বাড়ি কিনবে তাই দেখতে চায়। আমি দেখতে দিইনি। রাত্রে তোর ছোটভাই এসে আমাকে যারপরনাই গালাগাল করল। বলল কাল দুপুরে ওরা আবার আসবে। আমি সেটা সহ্য করতে পারছিলাম না। ঠিক করলাম একাই তোর কাছে চলে আসব। শরীর রাত থেকেই খারাপ হয়েছিল। যদি খোকন আমার অবস্থা দেখে সঙ্গে না আসত তা হলে পথেই কোথাও মরে পড়ে থাকতাম। একটানা কথাগুলো বলে বৃদ্ধা হাঁপাতে লাগলেন। দীপাবলী ওঁর হাত জড়িয়ে ধরল। একটু বাদে মনোরমা নিচু স্বরে বললেন, স্বামী জলে ডুবেছিল না সন্ন্যাসী হয়েছিল জানি না। কিন্তু ওই বয়সে তো ছেলেকে পেটে নিয়ে বিধবা হয়েছিলাম। বাপ ভাইয়ের হাত ঘুরে ছেলের হাতে এসেছিলাম। কষ্ট হত তবু ভাল ছিলাম। বউমা যাই করুক আমাকে অসম্মান করেনি কখনও। ছেলে মরতে সর্বনাশ হল। তবু এই হেনস্থা হবে ভাবিনি। এখন আমি তোর কাছে। কপালে ভগবান আর কী লিখেছে কে জানে। স্বামী গেল, বাপ গেল, ছেলে গেল, বউমা গেল, কিন্তু আমাকে যমেও ছুঁয়ে দেখল না।’ বড় নিশ্বাস পড়ল একটা।
দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘স্বামী গেল বলছ কেন? পরে কিছু খবর পেয়েছ?’
‘মানে?’ মনোরমা যেন চমকে উঠলেন।
দীপাবলী পাশ ফিরল। মনোরমার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ঠাকুরদাকে তুমি অস্বীকার করেছিলে, না? সত্যি কথা বলো আমাকে?’
মনোরমা সময় নিলেন, ‘তোর মনে আছে?’
‘হ্যাঁ। আমার মনে হত বাবাও সেটা জানতেন।’
হঠাৎ মনোরমা গলা তুললেন, ‘কেন করব না? একটা স্বার্থপর মানুষ আমাকে বঞ্চিত করে অত বছর খোঁজ না নিয়ে হঠাৎ পুণ্য অর্জন করতে ফিরে এল আর তাকে আমি সাহায্য করব? কী ভেবেছ সে আমাকে? তুই হলে চেনা দিতিস?
জড়িয়ে ধরে দীপাবলী বলল, ‘না। কখ্খনও না। এইজন্যে তোমাকে আমি শ্রদ্ধা করি।’
মনোরমা হাসলেন, ‘না। শ্রদ্ধায় আমার দরকার নেই। তোর মনে এই মায়া থাক, তাতেই হবে।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন