১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে

সমরেশ মজুমদার

কাকডোর বলে কিছু নেই এখানে। রাতটাকে একটানে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দিন এসেই জাঁকিয়ে বসে। সেই যে সূর্যের উনুন জ্বলল, সারাদিন ধরে চরাচর পুড়িয়ে খাক করে দিলেও শান্ত হয় না, দিন নিবে গেলেও তেতে থাকে চারপাশ অনেকক্ষণ। ঘড়িতে যখন প্রায় পাঁচটা, ছায়া সরতে শুরু করেছে পৃথিবীতে, দীপাবলী স্নান সেরে অফিসঘরে চলে এসেছিল। এই একটু সময় প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারা যায়। তার আবাস,এবং অফিস একই বাড়িতে। পেছনের তিনটে ঘরে সংসার, সামনের তিনটে ঘরে অফিস। ভেতরের উঠোনে একটি গভীর কুয়া আছে। যার জল নামতে নামতে এখন আর চোখে দেখা যায় না। দড়ি নামিয়ে বালতিতে ভরে তুললেও ছেঁকে নিতে হচ্ছে। জষ্ঠি মাসেই যদি এই অবস্থা, আষাঢ়ে কী হবে।

এখন অফিসে কারও আসার কথা নয়। তবে এসে পড়বে। এইসময় অফিস বসে ছ’টায়, দশটায় যে- যার বাড়িতে। আবার সাড়ে তিনটেয় এসে সাড়ে ছটায় ফিরে যাওয়া। ওই সাড়ে তিনটের সময় আসাটায় কষ্টের, শরীর পুড়ে যায়। জানলা খুলে দিয়ে চেয়ারে বসল দীপাবলী। বড়জোর ন’টা পর্যন্ত এটাকে খুলে রাখা যাবে। ততক্ষণ হাওয়া না আসুক, আকাশ তো দেখা যাবে। চাবি ঘুরিয়ে ড্রয়ার খুলতেই চিঠিটা নজরে এল। গতকালের ডাকে এসেছে। একটা জবাব লেখা দরকার। কাগজ টেনে নিল সে।

‘অমল। আপনার চিঠি পেয়ে আরাম লাগল। মাসিমার শরীর ঠিক নেই জেনে অবশ্য ভাল লাগেনি। কী করছেন মশাই? ভাল ডাক্তার দেখাচ্ছেন তো? এইটে লিখেই অবশ্য মনে হল আমি অবান্তর ভাবছি। মাসিমার ব্যাপারে আপনি অবহেলা করার মানুষ নন।

আমার কথা আপনি জানতে চেয়েছেন। আমি এখন যেখানে আছি সেখানে প্রকৃতির সঙ্গে সবুজের কোনও সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানগুলো এখানে বসে স্বপ্ন বলেই মনে হয়। শ্রাবণে পথ ভুলে দুই তিন টুকরো মেঘ যদি আকাশে আসে তা হলে স্থানীয় মানুষ মুগ্ধ চোখে তাকায় বলে শুনেছি। সারাবছরে সবসমেত চব্বিশ ঘণ্টা বৃষ্টি হয়েছে এমন কথা কেউ বলতে পারেননি। মাটি ফেটে চৌচির। হাতে নিলে ঝুরুঝুরু ধুলো হয়ে ঝরে পড়ে। মাটিকে বেঁধে রাখে যে-রস তার অস্তিত্ব নেই এখানে। নাই রস নাই, দারুণ দহনবেলা— লাইনটা এইখানে এসে বড় সত্যি বলে বুঝেছি। সবুজ নেই কারণ গাছে পাতা নেই, অথচ নিষ্পত্র গাছেরা দাড়িয়ে আছে। এই প্রকৃতিতে যেসব মানুষেরা বেঁচে আছে তারা জানে না কেন বেঁচে আছে! মেদ দূরের কথা, মাংস খুঁজে পাওয়া যাবে না কারও শরীরে। আমার কাজ এদের নিয়ে। ঢাল নেই তলোয়ার নেই তবুযুদ্ধ করতে হবে। এব্যাপারে আমার কাজের লোক একটা চমৎকার শিক্ষা দিল। সকালে বেরিয়েছিলাম। ফিরতে দুপুর। রোদে পুড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে অফিসে ফিরে মনে পড়ল আজ সকালে ওকে বাজারের টাকা দিতে ভুলে গিয়েছি। ঘরে এক ফোঁটা তরিতরকারি নেই। খিদে পেয়েছিল খুব এবং সেইসঙ্গে আলস্য। তা থেকেই স্থির করলাম আজ উপোস দেব। বিকেল না হলে দোকানপাট খুলবে না। তখন রাত্রের ব্যবস্থা করা যাবে। ভেতরের ঘরে ঢুকে শুনলাম কাজের মেয়েটি আমাকে খেতে ডাকছে। জানেন, যা আমরা ফেলে দিই, গত দু-তিন দিন তরকারি কুটে ফেলে দেওয়া খোসা বা গোড়া সে সরিয়ে রেখেছিল। তাই দিয়েই রেঁধেছিল। খেতে গিয়ে অমৃত মনে হল। পরে বুঝেছি সে ওই দিয়েই রাঁধতে অভ্যস্ত। আলু যার জোটে না অথচ খোসা পেয়ে যায় চেয়েচিন্তে সে তো খোসার রান্নাতেই সিদ্ধহস্ত হবে। এইটে আমাকে উৎসাহিত করল। আমি ঢাল তলোয়ার ছাড়াই যুদ্ধ করতে নেমেছি। এদের, এই এলাকার মানুষের জন্যে জল চাই, অমৃত নয়। অমৃতে তৃষ্ণা মেটে না।

চিঠি বড় হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাল আছি। রজনী নিদ্রাহীন (গরমে), দীর্ঘ দগ্ধ দিন, আরাম নাহি যে জানে রে। আপনি যে কী করছেন। এবার ঘরে তাকে নিয়ে আসুন। মাসিমার পাশে যিনি সবসময় থাকবেন। একটু আগেভাগে জানালে ছুটি নিয়ে হাজির হবই। শুভেচ্ছা সহ, দীপাবলী।’

চিঠিটা ভাঁজ করতে করতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। এখনই রোদে ঝলমল করছে চরাচর। এখানে বসলেই একটা ন্যাড়া গাছ নজরে পড়ে। গাছটার প্রতিটি ডাল বেঁকেচুরে আকাশের দিকে প্রতিবাদের ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। সতীশবাবুর মুখে শুনেছে ওই গাছে নাকি প্রথমবার জল পড়লেই পাতা গজায়। অবশ্য বেশিদিন সেই পাতা হাওয়া খাওয়ার সুযোগ পায় না। দীপাবলী অনেক দুরে দৃষ্টি বোলাল। ফাটা মাটি আর শূন্য আকাশে রোদের রং পালটানো শুরু হয়ে গিয়েছে। বেশিক্ষণ তাকালে বুকের ভেতরটায় থম ধরে। নিজেকে নীরক্ত মনে হয়। শূন্যতা গলা টিপে ধরে।

‘ম্যাডাম!’

দীপাবলী মুখ ফেরাল৷ চিঠি খামে ঢুকিয়ে বলল, ‘বলুন সতীশবাবু।’

‘ম্যাডাম, আপনি কি নিশ্চিত যে আজ এস. ডি. ও. সাহেব আসবেন!’

‘নিশ্চয়ই, আমার সঙ্গে কথা হয়েছে ওঁর।’

‘ও।’ ঘুরে দাড়ালেন প্রৌঢ়।

‘কেন জিজ্ঞাসা করলেন বলুন তো?’ দীপাবলী জানতে চাইল।

‘আমি এখানে আট বছর চাকরি করছি। আজ অবধি এস. ডি. ও. সাহেব মাত্র দু’বার এসেছেন। তাও বৃষ্টি পড়লে। চারজন এস. ডি. ও. সাহেব এইসময় বদলি হয়ে গিয়েছেন। তাই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আর হ্যাঁ, স্টাফদের তা হলে দুপুরে থাকতে বলি। উনি এসে না দেখতে পেলে—!’

‘না না। এখানকার নিয়মমতো যেমন সবাই কাজ করেন তেমন করবেন। উনি যদি দুপুরে এসে যান আমিই কথা বলব।’দীপাবলী এক মুহূর্ত ভাবল, ‘আপনি শুধু নেখালির ফাইলটা আমাকে দিয়ে যান।’

সতীশবাবু মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলে খামে আঠা সেঁটে ঠিকানা লিখল সে। সতীশবাবু ফাইলটা নিয়ে ফিরে এলেন, ‘একটু বসতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই। বসুন।’

‘সতীশবাবু বসলেন। রোগা বেঁটেখাটো মানুষ, মাথায় চুল আশিভাগ পেকে গিয়েছে। দুটো হাত কচলালেন, ‘ম্যাডাম, আপনার আগে যাঁদের দেখেছি তারা মানুষ খারাপ ছিলেন না। তবে সবাই পুরুষমানুষ বলে এসেই বদলির চেষ্টা করতেন। এই হতচ্ছাড়া জায়গায় কে থাকতে চায় বলুন। আর যাঁরা বদলির চেষ্টা করেন তাদের কাজে মন বসতেই পারে না। কিন্তু আপনি কাজ করতে চাইছেন। এখানকার মানুষের জন্যে কেউ কাজ করে না।’

‘আমাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে কাজ করার জন্যে, নয় কি?’

কিন্তু আপনি কোনও কাজ করতে পারবেন না, এইটে আমার অভিজ্ঞতা।’

‘সতীশবাবু, চেষ্টা করতে দোষ কী?’

‘এখানকার সাধারণ মানুষগুলোকে দেখেছেন? বুক পিঠ আলাদা চেনা যায় না। কারও পেটে ভাত দূরের কথা সেদ্ধ পর্যন্ত রোজ পড়ে না। অথচ কোনও প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই, কেড়ে খাওয়ার সাহস নেই। এদের কোন উপকার করবেন আপনি?’

দীপাবলী অবাক হয়ে তাকাল, ‘সতীশবাবু, আপনি কি কমিউনিস্ট?’

চমকে উঠলেন প্রৌঢ়, ‘না না। আমি কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই।’

সমর্থক নন কথাটা সত্যি নয়।’

‘কেন?’

‘আপনি তো ভোট দেন। ব্যালট পেপারে ছাপ দেওয়ার সময় সমর্থন জানানো হয়ে যায়।’

মাথা নাড়লেন সতীশবাবু, ‘আমি ভোট দিই না ম্যাডাম।’

‘সেকী? কেন? আপনি সরকারি কর্মচারী, স্বাধীন ভারতের নাগরিক।’

‘জানি, ভোট দেওয়া আমার উচিত, কিন্তু কাকে ভোট দেব বুঝতে পারি না। যে জিনিসটা নিজ বুঝতে পারি না সেইটে কখনও করি না। ব্রিটিশ আমলের অভ্যেস।’

‘কোন আমল ভাল সতীশবাবু?’

‘শুনতে খারাপ লাগবে, কাজের কথা যদি বলেন ব্রিটিশ আমলে ভাল কাজ হত।’

ফাইলটা তুলে নিল দীপাবলী, ‘আচ্ছা, এই নেখালির মানে কী? শব্দটা শুনলে মনে হয় খালি নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। অথচ ওই জায়গা থেকে নেওয়ার কিছু নেই।’

‘না।ম্যাডাম। লোকে বলে বটে নেখালি, আসলে জায়গাটার নাম নেইখালি। নেই, খালি হয়ে গেছে। বলার সময় উচ্চারণের দোষে অমন শোনায়।’

‘তাই বলুন।’

সতীশবাবু উঠে গেলেন। ফাইলে চোখ রাখল দীপাবলী। মোট বাহান্ন ঘর পরিবার আছে নেখালিতে। এরা বেশিরভাগ জনমজুরি করে। পাঁচ মাইল দূরে অর্জুন নায়েকের জমি চাষ করতে যায় কেউ কেউ। সরকারি প্রকল্পে শ্রম দিয়ে টাকা পায় অনেকেই। কিন্তু সেই টাকার পরিমাণ এত কম এবং ধার শোধ করতে যা বেরিয়ে যায় তারপর দিনের অন্ন জোটানোই দায় হয়ে ওঠে।

নেখালি গ্রামে সতীশবাবুকে নিয়ে সে যখন প্রথম যায় তখন বিকেল। রোদ মরেছে, ছায়া ঘন হয়নি। সে এসেছে জানতে পেরেই পিলপিল করে কঙ্কালসার মানুষগুলো বেরিয়ে এসেছিল কুঁড়েঘরগুলো থেকে। হাঁউমাউ করে চিৎকার কান্নায় মিশিয়ে যা বলতে চেয়েছিল তা প্রথম বোধগম্য হয়নি দীপাবলীর। সে আতঙ্কিত হয়েছিল। এমন মানুষ একসঙ্গে দেখা আতঙ্ক। সতীশবাবু ধমকে রাগারাগি করে ওদের দূরে সরিয়ে রাখছিলেন। একটু একটু করে অভিযোগ বুঝতে পেরেছিল সে। এদের পেটে খাবার নেই, জল নেই, তিন ক্রোশ দূরে যে কুয়ো আছে জল তার তলায় চলে যাওয়ায় কাল এই গ্রামে কারও তৃষ্ণা মেটেনি। দু’জন বুড়ো আর বাচ্চা গত সাত দিনে মরে গিয়েছে। ভগবান দেবীকে পাঠিয়েছে তাদের কাছে। এখন দেবী যদি তাদের না বাঁচায় তা হলে আর কোনও পথ নেই।

মন্বন্তর দ্যাখেনি দীপাবলী, উপন্যাসে পড়েছে। আজ শিউরে ওঠার পর সে থমকে গেল। অভাবী মানুষেরা শ্রোতা পেলে শুধু নালিশের পর নালিশ জানিয়ে যায়। অর্জুন নায়েক তাদের যে-পয়সায় কাজ করতে ডাকে দেবার সময় তার অর্ধেক দেয়। জিজ্ঞাসা করলে বলে ওই পয়সা জমিয়ে গ্রামে কুয়ো করে দেব। গ্রামের দুটি ছেলে এখন চুরি করতে শুরু করেছে। বয়স্করা তাদের নিষেধ করেছিল কিন্তু তারা বিদ্রোহী হয়েছে। চুপচাপ সমস্ত কথা শুনে গেল দীপাবলী। সে আবিষ্কার করল একটি শব্দ উচ্চারণ করলে তা কাপা শোনাবে নিজের কাছেই। সমস্ত গ্রাম ঘুরে সে হতশ্রী আর হতাশা প্রত্যক্ষ করল। এই মানুষগুলো কেন এখানে পড়ে আছে তাই তার মাথায় ঢুকছিল না। স্বাধীন ভারতবর্ষের একটি গ্রামের এমন বীভৎস চেহারা ক’জন শহুরে মানুষ জানে সন্দেহ আছে। মন্ত্রীরা যে জানেন না এটা সত্যি।

সতীশবাবু ওদের বোঝাচ্ছিলেন। আজ পর্যন্ত কোনও অফিসার এই গ্রামে পা দেয়নি। এবার যখন একজন দিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। দীপা সতীশবাবুকে বলল, ‘জনা চারেক মানুষকে বলুন আমার বাড়ির কুয়ো থেকে জল নিয়ে আসতে। তিরি বলে ঘণ্টা দুয়েক বাদে বাদে কুয়োতে জল জমে।’

সতীশবাবু গলা নামালেন, ‘এমন কাণ্ড করবেন না ম্যাডাম।’

‘কেন?’

‘ছাগলকে বেড়ার ফাঁক দেখালে কি আর বাগান বাঁচাতে পারবেন?’

‘তা হোক, আজ তো প্রত্যেকে একটু জল খেয়ে বাঁচুক।’

অগত্যা সতীশবাবু ওদের প্রস্তাবটা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হইচই পড়ে গেল। সবাই একসঙ্গে ছুটে যেতে চায় জল আনতে। সতীশবাবু বাধা দিয়ে জানিয়ে দিলেন চার জনের বেশি ওখানে গেলে ম্যাডাম রাগ করবেন। আর তিনি রেগে গেলে যে-সমস্ত উপকার করবেন বলে ভাবছেন তা আর করবেন না। দীপাবলী দেখল, এতে কাজ হল।

নির্বাচিত চার জন রওনা হল পাত্র নিয়ে জল আনতে।

ফেরার পথে অন্ধকার নামল। দীপাবলী সতীশবাবুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘লোকগুলো এমন অবস্থায় বেঁচে আছে, রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে সদরে?’

‘না ম্যাডাম।’

‘কেন?’

‘এ-প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না।’

দীপাবলী মানুষটির আবছা মুখ দেখল। সতীশবাবু এখন টর্চ জ্বেলেছেন।

সে বলল, ‘ফাইলে দেখছিলাম, খরার সময় শীতের সময় এই ব্লকে কিছু টাকা এসেছিল, কোন খাঁতে খরচ হয়েছে তা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন।’

‘হ্যাঁ পারব। খরার টাকা যখন হাতে এল তখন দু’-এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তাই খরচ করা যায়নি। শীতের কম্বল যখন এল তখন শীত চলে গিয়েছে।’

‘ওগুলো গেল কোথায়?’

‘টাকাগুলোর একটা হিসেব পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কম্বল কিনে নিয়েছে গঞ্জের হরিরামবাবু। ওর একটা কাপড়ের দোকান আছে।’

‘বাঃ, চমৎকার। আপনার বিবেকে লাগেনি একটু।’

‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম ম্যাডাম। আপনি যদি কোনও আদেশ করেন তা হলে আমি অমান্য করতে পারি?’

‘একা রাজা ভোগ করেন না, মন্ত্রীরাও অংশ পান নিশ্চয়ই?’

‘অস্বীকার করব না। তবে না নিলে চাকরি থাকত না।’

দীপাবলী অবাক হয়ে গেল। এমন অকপট স্বীকারোক্তি সে কখনও শোনেনি। লোকটার ওপর রাগ হল না, বরং সে খুশি হল। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন বলুন তো কী কী কাজ করলে এদের ভাল হয়।’

‘প্রথমে এই গ্রামে দুটো কুয়ো দরকার। ডিপটিউবওয়েল হলে খুব ভাল।’

‘কে যেন ওদের কুয়ো করে দেবে শুনলাম।’

‘অর্জুন নায়েক।’

‘তিনি কে?’

‘ওঁর বাবা ছিলেন জমিদার। উনি ম্যাট্রিক পাশ করে ব্যাবসা শুরু করেছিলেন। বাপের সম্পত্তি বাড়িয়ে চলেছেন। এস. ডি. ও. সাহেব পুলিশ সুপার সাহেব ওঁর খুব কাছের মানুষ। তাই আমাদের পাত্তা দেন না, দারোগাবাবুকেও ডেকে পাঠান।’

‘সেটা আমাদের দেখার কথা নয়। কিন্তু মজুরির টাকা অর্ধেক কেটে নিয়ে কুয়ো বানিয়ে দেবেন, এটাও ঠিক নয়।’ দীপাবলী বলল, ‘ওঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার।’

‘ম্যাডাম। অর্জুন নায়েকের সঙ্গে আপনি যত কম কথা বলবেন তত ভাল।’

‘কেন?’

‘লোকটা চরিত্রহীন।’

দীপাবলী জবাব দিল না। চুপচাপ বাকি পথ হেঁটে এল সতীশবাবুর টর্চের আলোয়। অফিসের সামনে সেই চারটে লোক বিব্রত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। দীপা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার? তোমরা জল নাওনি?’

ওরা একই সঙ্গে বলে উঠল, ওদের জল নিতে দেওয়া হচ্ছে না। সতীশবাবু বললেন, ‘আপনি যান ম্যাডাম, আমি দেখছি।’

বাড়িতে ঢোকার দুটি পথ। পেছনের দরজা দিয়ে উঠোনে, আর অফিসের পাশ দিয়ে মূল দরজা খুলে তিরি সেখানে দাড়িয়ে ছিল। ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। এই ঘর দিয়েই অফিসে ঢোকা যায়।

সতীশবাবু তিরিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে, ওদের জল নিতে দিসনি কেন? মেমসাহেব তো ওদের পাঠিয়েছেন।’

‘না। আমি দেব না জল নিতে।’ অদ্ভুত গলায় বলল তিরি। ওকে এই গলায় কথা বলতে কোনওদিন শোনেনি দীপাবলী। সে বিরক্ত হল, ‘দিবি না কেন?’

‘ওরা যখন আমাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তখন মনে ছিল না?’

‘তুই নেখালির মেয়ে?’

‘হুঁ। আর আমি এখন এখানে চাকরি করি, দু’বেলা খেতে পাই বলে ওরা আমাকে রাস্তায় দেখলেই টিটকিরি দেয়। ওরা তবে কেন এসেছে জল নিতে এখানে?’ শেষের দিকে গলায় কান্না মিশল যেন।

সতীশবাবু বললেন, ‘আহা, ওরা নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে। কিন্তু ম্যাডাম ওদের কথা দিয়েছেন যখন তখন একটা দিন জল নিয়ে যেতে দে।’

‘গ্রামসুদ্ধ লোক জল নিতে এলে আমরা কি বালি খেয়ে থাকব।’

‘আর কেউ আসবে না। ওরাই শুধু নিয়ে যাবে। যা পেছনের দরজা খুলে দে।’

সতীশবাবুর কথা শেষ হওয়ামাত্র নিতান্ত অনিচ্ছায় তিরি চলে গেল দরজা খুলতে। ব্যাপারটা খুব অপছন্দ করল দীপাবলী। সতীশবাবু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। যে-গ্রাম সে দেখে এল তার ভাবনার সঙ্গে তিরির এমন আচরণ থেকে তৈরি বিরক্তি মিশে এক বিশ্রী মেজাজ তৈরি হয়ে গেল।

মিনিট পনেরো বাদে চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকে সামনের টেবিলে রেখে তিরি ফিরে যাচ্ছিল, দীপাবলী ডাকল, ‘অ্যাই শোন!’

মেয়েটা দাঁড়াল। এখন ওর পরনে দীপাবলীর অল্প রং ওঠা নীল শাড়ি। সেদিকে তাকিয়ে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘এই বাড়িটায় আমি থাকি, তুই এখানে চাকরি করিস। কথাটা কখনও ভুলে যাস না।’

মেয়েটা জবাব দিল না। দরজার সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইল। কথাগুলো বলেই দীপাবলীর মনে হল একটু রূঢ় হয়ে গেল যেন। চায়ের কাপ হাত বাড়িয়ে নিয়ে আবার প্রশ্ন করল, ‘তোকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল কেন?’

উত্তর এল না। দীপাবলী দেখল তিরি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

‘আমি তোকে একটা প্রশ্ন করেছি।’

‘আমি এখানে চাকরি করছি বলে ওরা তাড়িয়ে দিল।

‘এখানে? তুই তো এখানে চার বছর চাকরি করছিস। আমার আগে যাঁরা ছিলেন তাঁদের কাছেও তুই চাকরি করেছিস। তাতে অন্যায় কী হয়েছিল?’

‘আপনার আগে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সব ছেলে।’

দীপাবলীর কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘তুই কি রাত্রে এখানে থাকতিস?’

‘প্রথম সাহেবের সময় থাকতাম না। পরের সাহেব থাকতে বলেছিলেন।’

‘তুই থাকতিস কেন?’

‘না হলে আমার চাকরি চলে যেত।’

চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল দীপাবলী, ‘আগের সাহেবের সঙ্গে তো কোনও মহিলা ছিলেন না। তবু তুই কোন সাহসে থেকে যেতিস রাত্রে?’

‘আমি আর গ্রামে ফিরে যেতে চাইনি, তাই।’

‘তুই, তুই কী বলছিস তা জানিস?’

মাথা নেড়ে নীরবে হ্যাঁ বলল তিরি।।

সমস্ত শরীরে জ্বলুনি শুরু হল, প্রবল ঘেন্না এল মনে। মেয়েটাকে নির্লজ্জ চরিত্রহীনা বলে মনে হল। এই মেয়ের সঙ্গে সে ক’দিন আছে, অথচ সতীশবাবু কিছু বলেননি বলে ওঁর ওপরও খেপে গেল। এখানে চাকরিতে জয়েন করার সঙ্গে সঙ্গে সতীশবাবু বলেছিলেন, ম্যাডাম, আপনার কপাল ভাল, আগের অফিসারের কাছে যে-মেয়েটি কাজ করত সে এখানেই আছে। সব কাজকর্ম জানে, আপনার অসুবিধে হবে না। অসুবিধে হয়নি। বরং মেয়েটির কাজকর্ম এবং ব্যবহার দেখে সে নিশ্চিন্ত হয়েছিল। আজ সন্ধের আগে পর্যন্ত কোনও খুঁত খুঁজে পায়নি।

‘তোকে ওরা গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ঠিকই করেছে। ‘দাঁতে দাঁতে চেপে বলল সে, ‘আমার আর তোকে দরকার নেই।’

‘তুমিও আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?’ আর্তনাদ করে উঠল তিরি।

‘হ্যাঁ’। আমি আর তোকে রাখব না।’

‘কেন? আমি কী করেছি?’

কী করেছিস জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা করছে না?’

‘না। আমি তোমার কোনও কাজে ফাঁকি দিই না, দিই?’

‘আমি সেকথা বলিনি।’

‘তা হলে?’

‘একটা পরপুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়েছিস এখানে, ছিঃ!’

‘ও। যে-লোকটা আমাকে এখানে থাকতে বাধ্য করেছিল তার কোনও দোষ নেই?’

‘হ্যাঁ। যে তোকে এখানে থাকতে বাধ্য করেছিল সে লম্পট। কিন্তু তাকে ছেড়ে যেতে দিলি কেন তুই? আর কেউ বাধ্য করেছিল বললে দোষ মাপ হয়ে যায় না।’ দীপাবলী মাথা নাড়ল, ‘না। তুই চলে যা।’

‘আমি কোথায় যাব দিদি?’

‘আমি জানি না!’

হাউহাউ করে কেঁদে উঠল তিরি। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি আমাকে মেরে ফেলো না দিদি। এখান থেকে চলে গেলে হয় আমাকে বাজারে নাম লেখাতে হবে নয় বিষ—!’ কান্না থামছিল না।

চোখ বন্ধ করল দীপাবলী। নেখালি গ্রামের মানুষের চেহারার স্বাস্থ্যের সঙ্গে তিরির কোনও মিল নেই। তার পূর্বসূরিরা মেয়েটিকে ব্যবহার করেছেন, প্রতিবাদ করলে ওর কী হতে পারত? নেখালি গ্রামে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে জীবন্বত হয়ে বেঁচে থাকতে চায়নি তিরি। একটি কঙ্কালসার মানুষ হিসেবে তিরিকে ভাবতে সেও পারছে না কেন? আজ কথা না উঠলে সে কখনওই জানতে পারত না। নিজের অতীতের কথা যে স্বীকার করে তাকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া কি উচিত কাজ। অতীতে কী করেছিল সেইটে বড়, না তিরি তার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করছে তাই বিচার্য? ওর তো ওইটেই নেশা নয়, তা হলে তার সঙ্গে এমন আন্তরিকভাবে থাকতে পারত না। দীপা বলেছিল, ‘আমাকে আর এক কাপ চা করে দে, এটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।’

নেখালি গ্রামে দুটো গভীর কুয়ো আর টিউবওয়েল অবিলম্বে তৈরি করে দেওয়া দরকার। আগামী এক বছরের মধ্যে চাষের খেতগুলোয় যেখানে বছরে একবারই লাঙল পড়ে, যেখানে শস্য আসে কি আসে না সেখানে সেচের ব্যবস্থা করা দরকার। এই জল গভীর কুয়ো থেকে তোলা যেতে পারে। মাটির যে গভীরত্বে জল বৈশাখ মাস পর্যন্ত টিকে থাকে তার অনেক নীচে পেঁৗছোতে হবে। চাষ যদি সম্ভব না হয় এই অঞ্চলে এখনই কুটির শিল্প স্থাপন করা উচিত। অন্তত মুরগি চাষের জন্য বেশি জল দরকার হয় না। অনেকগুলো পরিকল্পনা নিয়ে দীপাবলী এস ডি ও-র সঙ্গে দেখা করেছিল। ভদ্রলোকো আই এ এস করে সবে কাজে যোগ দিয়েছেন। এখনও এলাকাটা চিনে ওঠেননি। নেখালি গ্রামের বর্ণনা শুনে আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনাদের মতো মহিলা ওখানে আছেন কী করে?’

‘আমার মতো মহিলা মানে?’

‘সরি, কথাটা অন্যভাবে বলা উচিত ছিল। আমি বলতে চেয়েছি সাধারণ মহিলাদের থেকে আপনাকে আলাদা মনে হয়।’

‘ঠিকই। কিন্তু আমি চাকরি করতে এসেছি। আমার কাজ উন্নয়ন দেখা।’

এস ডি ও বলেছিলেন, ‘বাজেট পারমিট করবে কিনা জানি না, তবু আমি একবার নিজের চোখে দেখতে চাই। নইলে ডি এম বলুন আর মন্ত্রী কাউকে কনভিন্স করাতে পারব না।’

ভদ্রলোকের কথাবার্তা খুব আশাজনক না হলেও খারাপ লাগেনি দীপাবলীর। অথচ সতীশবাবু বলে গেলেন তিনি আশাবাদী নন। এরকম ঘটনা নাকি সচরাচর এখানে ঘটে না। দীপাবলী ঠিক করল সে অপেক্ষা করবে। যদি ভদ্রলোক আজ না আসেন তা হলে আগামীকাল সে সদরে গিয়ে দেখা করবে। ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত না করে সে ছাড়বে না। যদি তাতেও ভদ্রলোকের সময় না হয় তা হলে ওপরতলায় সমস্ত ব্যাপারটা জানিয়ে চিঠি লিখবে।

বেলা দশটায় যখন চারজন কর্মচারী বাড়ি চলে গেলেন তখন সতীশবাবু এলেন ওর ঘরে, ‘আমি কি থাকব?’

‘না, আপনি বাড়িতে যান, বিশ্রাম নিন। উনি কখন আসবেন বুঝতে পারছি না।’

‘যদি এসে পড়েন তা হলে তিরিকে পাঠাবেন, সঙ্গে সঙ্গে চলে আসব। আপনি একা ওঁকে নিয়ে নেখালিতে যাবেন না।’

‘কেন?’

‘গতকাল একটা কিছু ঘটেছে ওখানে যার জন্যে সবাই খেপে আছে।’

‘কী ঘটেছে?’

‘আমি ডিটেল্স পাইনি। একটু আগে বংশীচরণ বলল কাল নাকি ওখানে খুব চেঁচামেচি হয়েছে। আচ্ছা চলি এখন।’ সতীশবাবু চলে গেলেন।

আরও দুটো ফাইল শেষ করে যখন দীপাবলী উঠতে যাবে ঠিক তখনই বাইরে গাড়ির আওয়াজ হল। জানলাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল তাপের কারণে, গাড়ি অফিসের সামনে এসে থামতেই দীপাবলী ব্যস্ত হয়ে উঠে বাইরের ঘরের দিকে এগোতে যাবে, এইসময় দৌড়ে ভেতরে ঘরের দরজায় এল তিরি।

সে হাঁপাচ্ছে, উত্তেজনা চোখে মুখে, ‘দিদি, তুমি বাইরে যেয়ো না।’

অবাক হল দীপাবলী, ‘মানে? কেন যাব না?’

‘ওই বদমাশটা এসেছে। ওকে দেখলে আমরা লুকিয়ে পড়ি।’

‘কে এসেছে?’

এইসময় বাইরের ঘরে কেউ বেশ মেজাজ নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী ব্যাপার? অফিস বন্ধ হয়ে গেল নাকি? লোকজন গেল কোথায়?’

দীপাবলী এগিয়ে গিয়ে পরদা সরিয়ে দিতেই দেখতে পেল ধবধবে চোস্ত পাজামা আর আদ্দির কাজ করা পাঞ্জাবি পরা একটি লোক তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। বছর তিরিশ বয়স, একটুও মেদ নেই শরীরে, চোখ দুটো খুব ধারালো, চুলের কায়দা চোখে পড়ার মতো। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কে?’

‘আমি?’ লোকটির যেন চমক ভাঙল। সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত জড়ো করে ঈষৎ ঝুঁকে নমস্কার করতে করতে বলল, ‘আমি অর্জুন নায়েক। এই তল্লাটেই বাস করি। আপনি এখানে পোস্টেড হয়ে এসেছেন শুনেছিলাম কিন্তু বড় দেরি করে ফেললাম দর্শন করতে, তবে ইংরেজরা একটা ভাল কথা বলে, বেটার লেট দেন নেভার।’ লোকটার কথা বলার সময় একটা প্যাচপ্যাচে হাসি ঠোঁটে জড়ানো ছিল।

দীপাবলীর কয়েক মুহূর্ত লাগল। এই সেই অর্জুন নায়েক? সে বলল, ‘এখন তো অফিস ছুটি। আপনার কোনও দরকার থাকলে বিকেলে আসবেন। সন্ধের পরেও ওঁরা থাকেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল ঠোঁট টিপে। তারপর বলল, ‘মেমসাহেব কি আমাকে বসতে বললে খুব অসুবিধে বোধ করবেন?’

মুখে হ্যাঁ চলে এসেছিল কিন্তু দ্রুত মন পরিবর্তন করল দীপাবলী, সতীশবাবুর টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে উলটো দিকটা দেখিয়ে বলল, ‘বসুন, কী বলার আছে বলুন।’ সে নিজে সতীশবাবুর চেয়ারে গিয়ে বসল। অর্জুন নড়ল না, সেখানে দাঁড়িয়েই বলল, ‘এটা কি ঠিক হল মেমসাহেব? কেরানিদের চেয়ারে আপনাকে মানাচ্ছে না।’

‘আপনি বসতে চেয়েছিলেন, আমি আপত্তি করিনি।’

‘ও। ঠিক আছে।’ বেশ সমীহ করার ভঙ্গি নিয়ে অর্জুন এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বেশ শব্দ করেই বসে পড়ল। পকেট থেকে একটা রুপোর কৌটো বের করে দুই আঙুলে জরদা তুলে নিয়ে মুখে পুরল, ‘আমি ভেবেছিলাম কোনও বয়স্কা মহিলা বোধহয় বুড়ো বয়সে প্রমোশন পেয়ে এই পোস্টে এসেছেন। খুব ভাল খুব ভাল। হ্যাঁ, নাম তো বলেছি, একেবারে মহাভারতের নাম, ব্যাবসা করি, জমিজমা আছে কিন্তু তার হাল তো দেখছেন, শালা নেচার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে জমির। তবু আপনাদের শুভেচ্ছায়

ভাত কাপড়ের অভাব নেই।’

‘আপনার নাম আমি শুনেছি।’

‘আই বাপ! আপনার কানে এর মধ্যেই কেউ মন্ত্র পড়ে দিয়েছে?’

‘মন্ত্র পড়া মানে?’

‘আর বলবেন না মেমসাহেব। এখানে মানুষ থাকে? সব এক একটা শয়তান চুকলিখোর, আপনি যত ওদের জন্য করুন কিছুতেই মন ভরবে না। কাজ করলেও দোষ, না করলে তো কথাই নেই। আমার দোষ কেন পয়সা রোজগার করছি। মানুষের নিন্দে করে ওরা সকালে দাঁত মাজে কিন্ত সামনে এলে বোবা। বুঝবেন বুঝবেন, ক’দিন থাকুন বুঝতে পারবেন।’ মাথা নাড়ল অর্জুন নায়েক।

‘আমি শুনেছি আপনি নেখালি গ্রামের কিছু মানুষকে খাটিয়ে অর্ধেক টাকা কেটে রেখেছেন ওখানে কুয়ো করে দেবেন বলে। কথাটা ঠিক।’

‘একশো বার ঠিক। আপনি ওখানে গিয়েছেন? গেলে বুকের হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। এক ফোঁটা জল নেই। খাবার নেই। কী দুর্দশা! গবমেন্ট যখন কিছু করছে না তখন তো ওদের নিজেদেরই সব করতে হবে। হাতে টাকা দিলে তার অর্ধেক খাবার খাবে বাকি অর্ধেক মদ। আমি সেই মদের টাকায় ওদের জন্য কুয়ো করে দেব ভেবেছি। খারাপ ভেবেছি, বলুন?’

কাজটা আপনি ঠিক করেননি। ওদের প্রাপ্যটা ওদেরই দেওয়া উচিত।’

‘তা হলে কুয়ো? জলের ব্যবস্থা?’

‘আপনি যখন এতটা ভেবেছেন তখন ওটা নিজেই করে দিতে পারতেন।’

অর্জুন একটু ভাবল চোখ বন্ধ করে, তারপর মাথা নাড়ল, ‘ঠিক হ্যায়, করে দেব। কালই লোক লাগিয়ে দেব। জবান দিচ্ছি, আজ বিকেলে কেটে রাখা টাকা ওরা ফেরত পেয়ে যাবে। আপনার উপদেশ আমি মেনে নিলাম।’

‘আপনি যদি এটা করেন তা হলে সত্যি আমি খুশি হব অর্জুনবাবু।’

‘জবান তো দিয়েছি। এখন আপনি বলুন আপনি কবে আমার বাড়িতে পা দিয়ে আমাকে খুশি করবেন?’ ঝুঁকে এল অর্জুন।

‘আপনার ওখানে যাওয়ার তো একটা কারণ চাই মিস্টার নায়েক। আপনি কিন্তু এখনও আপনার বক্তব্য বলেননি।’

‘বক্তব্য! আরে মেমসাহেব, আমি তো আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।’

‘তা হলে তো আলাপ নিশ্চয়ই এতক্ষণ হয়ে গিয়েছে।’

‘আপনি আমাকে চলে যেতে বলছেন? বেশ, যাচ্ছি। তবে আমার কিন্তু আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভাল লেগেছে। মুখের ওপরে সত্যি কথা বলার সাহস আপনার আছে, গুড। যখন যা লাগবে আপনি আমাকে বলবেন। সতীশবাবু চেনেন আমাকে, ওঁকে দিয়ে খবর পাঠাবেন।’

‘আমার কিছু প্রয়োজন হলে আপনাকে খবর দেব ভাবছেন কেন?’

‘মেমসাহেব। আপনি কি এদের জন্যে কাজ করতে চান না আপনার আগের লোকদের মতো চোখ বন্ধ করে থাকবেন? যদি কাজের ইচ্ছে থাকে তা হলে এই শর্মা আপনার উপকার করতে পারবে। বি ডি ও সাহেব তো বটেই, ডি এমের কাছে কোনও ফাইল আটকে থাকলে আমাকে বলবেন, এক দিনেই কাজ হয়ে যাবে। আচ্ছা, অনেক বিরক্ত করলাম, এবার আপনি আরাম করুন, আমি চলি। দরজার দিকে কথা শেষ করেই এগিয়ে গেল আচমকা অৰ্জুন। হঠাৎ কী মনে হল দীপাবলী ডাকল, ‘শুনুন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। কাল নাকি নেখালি গ্রামে খুব গন্ডগোল হয়েছে, কী ব্যাপার আপনি কি কিছু জানেন?’

চোখ বড় করল অর্জুন ঘুরে দাঁড়িয়ে, ‘কিছু না, আমি বলেছি ছেলেদের আর কাজে লাগাব না। ফাঁকি মারে কাজ কম হয়। এবার থেকে মেয়েদেরই কাজ দেব, তাই—! ও হ্যাঁ, আপনাকে একটা কথা বলতে একদম ভুলে গিয়েছি। একটা নয়, দুটো। প্রথমটা, আপনার এস ডি ও সাহেবের সঙ্গে আজ সকালে দেখা হয়েছিল। তার পেট খারাপ, আসতে পারবেন না আজ। আর দ্বিতীয়টা হল, পোস্ট আফসের পিয়ন আসছিল আপনার টেলিগ্রামটা নিয়ে। আমি আসছি বলে বেচারাকে কষ্ট দিলাম না, নিন।’

টেলিগ্রামটা দীপাবলীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে অর্জুন মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করে বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই তার গাড়ির শব্দ হল। দীপাবলীর ঘোর কাটতে সে টেলিগ্রামটার দিকে তাকাল।

অধ্যায় ১ / ৪৩

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন