সমরেশ মজুমদার
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না দীপাবলী। চাপা গলায় প্রশ্ন করল, ‘কোন দাদাবাবু? কী বলছিস তুই?’
‘হ্যাঁ, ওই দাদাবাবু, হাসপাতাল থেকে এসেছে, আমি জানলা দিয়ে দেখলাম।’ তিরির মুখে কি খুশি? কিন্তু গলার স্বর যেন সারাদিনের থেকে আলাদা। দীপাবলী বলল, ‘তুই রান্না করতে যা, আমি দেখছি।’
‘আমার রান্না হয়ে গিয়েছে।’ তিরি মাথা নাড়ল।
‘ওঃ। তুই ভেতরে যা।’ তিরি যতক্ষণ ভেতরের উঠোনের দিকে চলে না গেল ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল দীপাবলী। তারপর শব্দ করে পা ফেলে বাইরের ঘরের বন্ধ দরজার কাছে এসে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে ওখানে?’
‘আমি, শমিত।’ স্বরে দুর্বলতা স্পষ্ট, ‘আর দাঁড়াতে পারছি না।’
দরজা খুলল দীপাবলী, তারপর গম্ভীর গলায় জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার?’
দু’দিনেই লোকটার চেহারা পালটে গিয়েছে। তবু হাসার চেষ্টা করল, ‘এলাম।’
‘কেন? এখানে কেন?’
‘মানে?’
‘আমি বলে এসেছিলাম অন্য কোথাও চলে যেতে।’
‘ও। কিন্তু আমার জিনিসপত্র তো পড়ে আছে এখানে।’
‘সেটা আগামীকাল হাসপাতালে পৌঁছে যেত।’
‘আগামীকাল তো আমাকে হাসপাতালে পেতে না।’ শমিত এগিয়ে এল, ‘আমি আজ দুপুরেই হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি।’
‘চলে এসেছেন মানে? ওরা আপনাকে ছেড়ে দিল?’
‘না। নিজে নিজেই চলে এলাম।’
‘সেকী! পালিয়ে এসেছেন?’
‘আর শুয়ে থাকতে ভাল লাগছিল না। কিন্তু এখন—।’
‘এখন কী?’
‘একটু না বসতে পারলে—, শরীর ঠিক লাগছে না। আমি বুঝতে পারছি ঠিক করছি না, হয়তো ভিলেনের মতো আচরণ করছি, কিন্তু করে ফেলার পর তো আর শোধরানো যায় না।’
‘ঠিক আছে, ভেতরে আসুন, এই ঘরেই থাকবেন। কিন্তু আজকের এই রাতটা। কাল সকালে আপনাকে এখানে দেখতে চাই না আমি।’ দীপাবলী সরে দাঁড়াল। কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে ঢুকে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে একটু হাঁপাল শমিত। দীপাবলী যখন দরজা বন্ধ করছে তখন শুনতে পেল, ‘কেন?’
‘আমার ইচ্ছে।’
‘কিন্তু আমি তো কোনও অন্যায় করিনি।’
উত্তর না দিয়ে শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে পৌঁছে দীপাবলী বলল, ‘আমি লোকাল থানায় খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি, হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসাটা অপরাধ।’
‘আশ্চর্য! থানায় খবর দেবার কী হয়েছে। আমি তো সকালেই চলে যাচ্ছি।’
দরজা বন্ধ করতে গিয়েও পারল না দীপাবলী। ভদ্রতা শেষতক আড়াল করল। ঘরে ঢুকে খানিক আগে লেখা পদত্যাগপত্রটা যত্ন করে রেখে দিল। আসলে ও এখন কী করবে বুঝতে পারছিল না। সে ভেতরের দরজার দিকে তাকাল, তিরিকে দেখা যাচ্ছে না।
‘দীপা, দীপা!’
দীপাবলী এগিয়ে গিয়ে মাঝখানের দরজায় দাঁড়াল, ‘প্লিজ, আপনি আমার নাম ধরে ডাকবেন না, আমার নিজেকে অপবিত্র লাগছে।’
‘যাঃ বাবা। কী ফিল্ম করছ বলো তো?’
‘ফিল্ম?’
‘অফকোর্স। আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম, সত্যি কথা হল আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সকালে মনে হল বেশ ভাল আছি, নার্সকে বলে কাজ হল না তাই চলে এসেছি। মানছি না বলে আসা ঠিক হয়নি কিন্তু তাই বলে তুমি বাংলা ফিল্ম সংলাপ বলবে, এ কেমন কথা!’
‘আমি কিছুই বলতে চাই না। আপনি আপনার মতো আজকের রাতটা থাকুন। কিন্তু দোহাই, আমাকে আর জ্বালাতন করবেন না!’
‘আমি কথা বলা মানে তোমাকে জ্বালাতন করা?’
‘এই সরল সত্য না বোঝার তো কোনও কারণ নেই!’
‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না।’
‘সেটা আপনার সমস্যা।’ দীপাবলী চলে এল দরজা থেকে। এসে নিজের খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। মিনিট দশেক চুপচাপ। পায়ের শব্দ হল। তিরি খাটের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘খাবার দেব?’
‘না। আর খাবার ইচ্ছে নেই। তুই খেয়ে নিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়।’
কথাগুলো শোনার পরেও খানিক দাঁড়িয়ে তিরি ভেতরে চলে গেল। এবং তখনই বাইরের ঘর থেকে ডাক ভেসে এল, ‘দীপা, দীপা, এই দীপা!’
শুয়ে শুয়েই গলা তুলল দীপা, ‘বলুন!’
‘এভাবে কথা বলা যায়? আমি কি ভেতরে যাব?’
দীপাবলী উঠল। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী বলছেন?’
‘আমার খুব খিদে পেয়েছে।’
‘আর কিছু? যা বলার একবারে বলে ফেলুন।’
‘না, মানে, ও বুঝতে পেরেছি। আমি সারাদিন গ্রামে কাটিয়েছিলাম বলে তুমি রাগ করেছ? আমি দুঃখিত, তোমাকে সত্যি বলছি, দুঃখিত!’
‘চমৎকার! আর কিছু?’
‘ওঃ। তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?’
‘আপনি আমাকে কী ভাবেন বলুন তো?’
‘পরে বলছি। আগে কিছু খেতে দেবে?’
ঠোঁট কামড়াল দীপাবলী। তারপর ভেতরের ঘরে ফিরে এসে চিৎকার করে তিরিকে ডেকে বলল, ‘আমার খাবারটা বাইরের ঘরে দিয়ে আয়।’
ঘরের কোণে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল সে। এখন ব্যাপারটাকে উপদ্রব বলে মনে হচ্ছে। শমিত ইচ্ছে করেই তাকে জ্বালাতে এসেছে। কোনও অপমান গায়ে না মেখে এমন ব্যবহার করার ছেলে ও ছিল না। মানুষ পালটায়। কিন্তু কতখানি?
ভেতর থেকে এক হাতে থালা আর অন্য হাতে জল নিয়ে তিরি আড়ষ্ট পায়ে বেরিয়ে এল। দীপাবলীর চোখের সামনে দিয়ে বাইরের ঘরে গেল এবং পলক পড়বার আগেই সেগুলো নামিয়ে রেখে ফিরে এল। এই আসাটা চোখে ঠেকল, একদমই স্বাভাবিক নয়। কিছু করার নেই। একটা রাতের জন্যে অত্যাচার মেনে নিতেই হবে। কিন্তু গত পরশু ডাক্তারকে চিন্তিত দেখেছিল সে। ভদ্রলোক উত্তেজনা এড়াবার জন্যে তাকে দেখা করতে নিষেধ করেছিলেন। পরশু দুপুর শমিতের শরীরের দুরবস্থার কথা সে নিজে ভাল করে জানে। সেই মানুষ কী করে পরের দিনই এতটা পথ একা পাড়ি দিয়ে এল। হয়তো প্রচণ্ড অসুস্থ এখনও এবং সেটা বুঝতে দিচ্ছে না। হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে গেল সে। শমিত যদি এখানে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এমনকী মরেও যায়! তা হলে কী হবে? একটা কৈফিয়ত দেওয়া থেকে সে নিজেকে সরাতে পারবে? ভাবনাগুলো মাথার ভেতরে কেবলই ঘাই মারতে লাগল কিন্তু সমাধানের কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। আর এইসময় দীপাবলী আবিষ্কার করল, না, শমিতের সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র দুর্বলতা নেই। থাকলে আর যাই হোক ওর মৃত্যুচিন্তা করত না সে।
চোখ বন্ধ করে বসেছিল, পায়ের শব্দ এবং সেইসঙ্গে গলা কানে এল। কথা বলতে বলতে শোওয়ার ঘরে চলে এসেছে শমিত, ‘আমার যে একটু বাথরুমে যাওয়ার দরকার।’
হ্যারিকেনের আলোতেও এখন স্পষ্ট লোকটা অসুস্থ। সে হাত নাড়ল, মুখে কিছু বলল না। শমিত ভেতরে চলে গেল। ওর হাঁটার ভঙ্গি ভাল নয়। তারপরেই ভেতর থেকে গলা শুনল, তিরি ব্যস্ত হয়ে বলছে, ‘না না, এদিকে, এদিকে।’
‘ও, দিক ভুল হয়ে গিয়েছিল।’ শমিতের গলা পাওয়া গেল, ‘একটু আলো দেখাও, সব যে ঘুটঘুটে অন্ধকার।’
মিনিট তিনেক বাদে শমিত ফিরল। একা একাই। ঘরে ঢুকে বলল, ‘খেয়েদেয়ে বেশ ভাল লাগছে। হ্যাঁ, এখন বলো, আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করছ?’
‘তুমি বাইরের ঘরে গিয়ে বসো, আমি আসছি।’ শক্ত গলায় বলল দীপাবলী।
‘ও, আচ্ছা।’ শমিত যেন মেপে মেপে পা ফেলল।
মিনিট তিনেক বাদে দীপাবলী উঠল। দরজার গিয়ে দেখল শমিত গা এলিয়ে দিয়েছে। তাকে দেখেও উঠে বসার চেষ্টা করল না, হাসল।
‘তোমার শরীর কেমন আছে এখন?’
‘ভাল, খুব ভাল।’ শমিত হাত নাড়ল।
‘কী জিজ্ঞাসা করছিলে?’
‘আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছ কেন?’
‘তোমার সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করব বলে আশা করো?’
‘আশ্চর্য! বন্ধুর মতো। আমি তো ক্ষমা চেয়েছি।’
‘ক্ষমা? দ্যাখো শমিত, আমার জীবনে অনেকেই যে ঘটনা ঘটিয়েছেন তার জন্যে পরে ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটায় এখন আর কোনও চমক নেই আমার কাছে। তুমি আমার এখানে এসেছিলে কেন?’
‘সঠিক জবাব দিলে এই রাত্রে বের করে দেবে না তো?’
‘আমি কথা দিতে পারছি না।’
‘তা হলে আমি রিস্ক নেব না।’
‘ভাল। আজ রাত্রে আমার এখানে এমন কাণ্ড কোরো না যা আমাকে এমন কঠোর হতে বাধ্য করবে। তিরির সঙ্গে তুমি কথা বলবে না যতক্ষণ এখানে আছ। ব্যাপারটা ভাবতেই আমার ঘেন্না লাগছে।’
‘মানে?’ শমিত বলল, ‘তিরি আবার এর মধ্যে এল কেন?’
‘তুমি তিরির সঙ্গে কী ব্যবহার করেছ জানো না?’
‘জানি।’
‘তা হলে? নির্লজ্জ হবার একটা সীমা আছে শমিত।’
‘আশ্চর্য! তিরি একজন মহিলা। স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী। অবশ্য সৌন্দর্যের যে-সংজ্ঞা আমার কাছে গৃহীত তা তোমাদের কাছে না-ও হতে পারে। আফটার অল শি.ইজ ডটার অফ সয়েল। এইরকম এক বন্য এবং সহজ মহিলাকে আমি প্রস্তাব করেছি সে যদি আমাকে বিয়ে করে তা হলে আমি খুব গর্বিত হব।’
‘বিয়ে?’
‘হ্যাঁ? তিরিকে আমি এই প্রস্তাব দিয়েছিলাম।’
‘তুমি তিরিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে?’ যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না দীপাবলী।
‘চেয়েছিলাম কিন্তু ও আমাকে রিফিউজ করেছে। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাকে কেউ আর অ্যাকসেপ্ট করে না।’
‘শমিত, তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ?’
‘নো। পাগল কেন হব? এখানে কেন এসেছিলাম জিজ্ঞাসা করছিলে না? হ্যাঁ। তোমার কথা কখনওই আমি ভুলতে পারিনি। মায়াকে নিয়ে সন্দেহ করেছিলে। সন্দেহটা যে একদম খামোকা ছিল তা আমি বলছি না। কিন্তু মায়াও আমাকে ছেড়ে সুদীপের সঙ্গে ঘর বাঁধল। একা একা শুধু নাটক করা, দল ভেঙে নতুন দল গড়ে আবার নাটক করতে করতে আমি ক্রমশ হাঁপিয়ে পড়ছিলাম। আর তখন তুমি আমাকে টানছিলে৷ শেষপর্যন্ত মরিয়া হয়ে চলে এলাম তোমার কাছে। একটা রাতের ব্যবহার থেকে আমি বুঝে গেলাম তোমার জীবনের কোথাও আমি নেই। আর ওই মেয়েটাকে দেখলাম যার মধ্যে বিন্দুমাত্র শহুরেপনা নেই। মনে হল জটিলতাহীন জীবন যাপন করতে পারব ওর সঙ্গে। তাই সেদিন সকালে খুব ভালভাবে প্রস্তাবটা দিলাম ওকে। শুনে ও আঁতকে উঠল। যেন কেউ বিষ খেতে দিয়েছে।’
চুপ করল শমিত। ও এখন হাঁপাচ্ছিল। অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়েছিল দীপাবলী। দু’হাতে মাথা ঢেকে কিছুক্ষণ বসে থেকে শমিত বলল, ‘আমার সমস্ত অহংকার চুরমার করে দিল মেয়েটা। আমার প্রস্তাব রিফিউজ করেছিল কী বলে জানো, বলেছিল, কোনও পুরুষকে নাকি ও সৎ হয়ে স্বামী বলতে পারবে না। ওর কাছে পুরুষ মানেই খারাপ লোক।’ শমিত মাথা নাড়ল।
‘আর তাই এখান থেকে রোদ মাথায় এত জায়গা থাকতে চলে গেলে নেখালি গ্রামে যাতে সেখানকার মানুষগুলোকে আমার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে পারো!’
‘তোমার বিরুদ্ধে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী যা-তা বলছ?’
‘কতগুলো প্রতিশ্রুতি রাখতে পারিনি বলে ওরা আজ উত্তেজিত। এই উত্তেজনা তুমি ওদের মধ্যে ছড়িয়েছ। ওদের একত্রিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছ। করোনি?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে নয়।’
‘তা হলে?’
‘এই সিস্টেমটার বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল আর সরকারি আমলারা যে-সিস্টেম তৈরি করেছে তার বিরুদ্ধে ওদের বুঝিয়েছি আমি। এর সঙ্গে তুমি একমত নও?’
‘এই আলোচনাটি কি তুমি মাতলির সঙ্গে করেছ, একা একা?’
‘মাতলি? কে মাতলি?’
‘যে-বারবনিতাটির ঘরে বসে মদ্যপান করেছ তার নাম জিজ্ঞাসা করার সময় পাওনি বোধহয়।’
‘আচ্ছা! হ্যাঁ, মেয়েটি রসালো?’
‘বাঃ। তা তাকেও বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতে। হয়তো সে তোমাকে দুঃখ দিত না।’ বিদ্রুপ ছিটকে উঠল দীপাবলীর গলায়।
‘দিত। সে গল্প করতে করতে বলেছে এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে যে এখন নাকি তার একটি পুরুষে মন ভরে না।’
‘চমৎকার। বিপ্লব আলোচনা করার কী চমৎকার পরিবেশ।’
‘ওরা কি বিদ্রোহ করেছে?’
‘নাঃ। ওরা ব্যবহৃত হয়েছে। অবশ্য আমি যে-কথা দিয়েছিলাম তা যদি রাখতে পারতাম তা হলে সেই লোকটির মোকাবিলা করতে পারতাম।’
‘কেউ কথা রাখে না দীপা।’
‘আমার নাম তুমি আবার উচ্চারণ করছ?’ দীপাবলী ঘুরে দাঁড়াল। জিপের শব্দ ভেসে আসছে। শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে।
শমিত কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে ইশারায় চুপ করতে বলল দীপাবলী। এত রাত্রে আসতে পারেন এ তল্লাটের জমিদারবাবু। কিন্তু সে দেখা করবে না। ভেতরে ঢুকে তিরিকে ডাকল, ‘শোন, অজুনবাবু এলে বলবি আমার শরীর খুব খারাপ, দেখা করতে পারব না আজ রাত্রে।’
তিরি মাথা নেড়ে বাইরের ঘরে চলে গেল। দরজায় শব্দ নয়, ঘনঘন হর্ন বাজতে লাগল। শেষপর্যন্ত বোধহয় হাল ছেড়ে নেমে এল ড্রাইভার। দরজায় শব্দ করল, ‘মেমসাহেব আছেন?’
তিরি জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’
‘আমি ডি এম-এর ড্রাইভার।’ বাইরে থেকে জবাব এল।
‘দিদির শরীর খারাপ, দেখা করতে পারবে না।’
‘ও। ওঁকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন ডি এম।’
দীপাবলী নিজে বাইরের ঘরে বেরিয়ে এল, ‘তুই ভেতরে যা।’
তিরি চলে গেলে সে দরজা খুলল। প্রৌঢ় ড্রাইভার তাকে দেখতে পেয়ে সেলাম করল, ‘চিঠি মেমসাহেব।’ পিয়ন বই এগিয়ে ধরল লোকটা।
সই করে চিঠি নিল দীপাবলী। ড্রাইভার আর অপেক্ষা না করে জিপে উঠে বসল। আলো মুখ ফেরাতেই দরজা বন্ধ করে শোওয়ার ঘরে চলে এল সে। খামের মুখ ছিঁড়ে টাইপ করা চিঠিটা বের করল। ডি এম তাকে জানাচ্ছেন মন্ত্রীমশাইয়ের বিশেষ উদ্যোগে নেখালির মানুষদের জন্যে একটি বিশেষ অর্থ মঞ্জুর করা হয়েছে। দীপাবলীর দেওয়া প্রপোজাল পঁচাত্তর ভাগ ওই টাকায় হয়ে যাবে বলে তাঁর বিশ্বাস। এ-ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করতে ডি এম-এর সঙ্গে দীপাবলী যেন অবিলম্বে দেখা করে। বরাদ্দ অর্থ খুব শিগগিরই পাওয়া যাবে।
হতভম্ব হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর তার মুখে হাসি ফুটল। পঁচাত্তর ভাগ। তাই বা কম কী? মন্ত্রীমশাই তা হলে বিস্মৃত হননি। মানুষ সম্পর্কে সব আশা নষ্ট করে ফেলার নিশ্চয়ই এখন কোনও কারণ নেই। দুটো হাত মুঠো করল সে। তারপর এক লাফে উঠে গিয়ে লিখে-রাখা পদত্যাগপত্রটি বের করে কুচি করে ছিঁড়ে জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলল। সটান দরজার কাছে পৌঁছে সে বলল, ‘শমিত, আমরা অনেকক্ষণ খুব নিচুস্তরে কথা বলেছি। আসলে আমাদের মধ্যে কোনও কমন প্লাটফর্ম নেই যে একমত হব। যা হোক, তুমি এবার শুয়ে পড়ো। কাল সকালে চা খেয়ে চলে যেয়ো। গুড নাইট।’ আজ মাঝখানের দরজাটা বন্ধ করল দীপাবলী। শমিতের ভয়ে নয়, বন্ধ করার কারণ ভেতরের মানুষের জন্যে।
সকালবেলায় সতীশবাবুকে দীপাবলী সুখবরটা দিল। সতীশবাবু হাসলেন, ‘আপনার জন্যেই হল মেমসাহেব। এরকম ব্যাপার এই প্রথম দেখলাম।’
‘আপনি ফাইলটা নিয়ে দেখুন যা খরচ দেখিয়েছিলেন তার পঁচাত্তর ভাগ টাকায় কী কী জিনিস এখনই করা যায়।’
‘দেখছি। তবে—।’
‘তবে কী?’
‘আপনি একবার অর্জুনবাবুর সঙ্গে কথা বলুন।’
‘অর্জুনবাবু? কেন? ওঁর সঙ্গে কথা বলার কী দরকার?’
‘কাজটা তো ওঁকে দিয়েই করাতে হবে।’
‘আশ্চর্য! আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।’
‘সরকারি টাকা তো পাবলিকের জন্যে আমরা সরাসরি খরচ করতে পারি না। যেসব কনট্রাক্টরের নাম সরকারের খাতায় তোলা আছে তাদের দিয়েই করাতে হবে। আর আমাদের এলাকায় অর্জনবাবুই একমাত্র সেই লোক।’
‘আমরা নিজেরাই লোক লাগিয়ে যদি করি?’
‘অল্প টাকা হলে কিছু কথা উঠবে না। কিন্তু বেশি টাকার কাজ হলে অডিট আটকে দিতে পারে। আপনি ডি এম-এর সঙ্গে কথা বলুন।’
‘অন্য কোনও কনট্রাক্টর এই জেলায় নেই?’
‘আছে। তবে তারা এখানে কাজ করতে আসবে না। লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যাপার হলে অবশ্য আলাদা কথা ছিল।’
সতীশবাবু নিজের টেবিলে ফিরে গেলে দীপাবলী মাথা নাড়ল। অর্জুন যে এতখানি বুদ্ধি ধরে তা তার জানা ছিল না। এখন এই সরকারি কাজ হাতে নিয়ে নিজের আধখোঁড়া কুয়ো শেষ করে তার জন্যে পুরো পয়সা নেবে। এক আনা খরচ করে তিন আনার বিল করবে। ও কি জানত এমন একটা ব্যাপার হবে? তাই কি কুয়ো খুঁড়তে নিষেধ করেছিল মজুরদের? সে ঠিক করল আজই ডি এম-এর অফিসে যাবে। সমস্ত কথা ফাইনাল করে ফিরবে।
ঘড়িতে এখন সকাল সাতটা। দীপাবলী উঠে পেছনের দরজা দিয়ে নিজের কোয়ার্টার্সে ফিরে এল। শমিতের বোধহয় চা খাওয়া শেষ। কাপ নামিয়ে রেখে বলল, ‘ভাবছিলাম অফিসে ঢুকে দেখা করে যাব কিনা। আমি এবার যাচ্ছি।’
‘শরীর কেমন লাগছে?’
‘আর যাই হোক রাস্তায় পড়ে যাব না।’
‘বেশ।’
‘যে-অসুবিধেগুলো ঘটালাম তার জন্যে আবার ক্ষমা চাইছি।’
‘বারংবার শুনলে মনে হয় ব্যাপারটা বানানো।’
‘ও।’ জিনিসপত্রগুলো তুলতে গেল শমিত।
‘দাড়াও। তিরিকে বলছি বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত ওগুলো পৌঁছে দিতে।’
‘তিরিকে? সেকী!’
দীপাবলী জবাব দিল না। ভিতরের ঘরে ঢুকেই তিরিকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘দাদাবাবুর শরীর এখনও ঠিক হয়নি। তুই একটু সঙ্গে যা।’
তিরি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল? শুনতে পাচ্ছিস?’
‘আমাকে দাদাবাবুর সঙ্গে যেতে বোলো না।’
‘কেন?’
তিরি জবাব দিল না, তেমনি গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই অবাধ্যতা সত্ত্বেও রাগ করতে পারল না দীপাবলী। অফিসে চলে এসে বংশীকে পাঠাল শমিতের সাহায্যের জন্য। এখনও রোদের দাঁত ধারালো হয়নি। জানলা খোলাই ছিল। নিজের চেয়ারে বসে সে দেখল শমিত বংশীর পেছন পেছন এগিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এটাই ওর শেষ যাওয়া। এই জীবনে আর দেখা না হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। একটু আত্মসম্মানজ্ঞান থাকলে শমিত নিশ্চয়ই তাকে বিরক্ত করতে আসবে না। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল দীপাবলীর। সে হেসে ফেলল। ক্ষত সেরে যাওয়ার পর ব্যান্ডেজ তোলার সময়ও তো অস্বস্তি হয়। হয় না?
গতরাত্রে খাওয়া হয়নি, সকালে শুধু চা বিস্কুট পেটে গেছে, ন’টা নাগাদ দীপাবলী ভেতরে চলে এল। খিদে পেয়েছে খুব। দুটো ঘরের কোনওটাতেই নেই তিরি। ভেতরের বারান্দায় গিয়ে রান্নাঘর দেখল সে। ঘরের দরজা ভেজানো, কেউ নেই। উঠোন কুয়ো কোথাও মেয়েটা নেই। ব্যাপারটা অদ্ভুত। একমাত্র বিশেষ প্রয়োজন পড়লে ও একা হাটতলায় যায়। বাজারপত্তর বংশীকে বললে সে-ই করে এনে দেয়। বাইরের জগৎ সম্পর্কে যে-মেয়ে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে সে তাকে না জানিয়ে কোথায় যাবে। এবার চোখে পড়ল খিড়কির দরজা ভেতর থেকে আটকানো নেই। অর্থাৎ তিরি ওই পথে বেরিয়েছে তাকে এড়িয়ে যেতে। এইসময় তার ভেতরে আসার কথা নয়, সেই সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়? হঠাৎ মনে হল ও শমিতের চলে যাওয়া দেখতে যায়নি তো। খেয়ালের ঘোরে শমিত ওকে বিয়ের প্রস্তাব করেছে এবং তাতে মেয়েটার সব ভাবনা গোলমেলে হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তবু মেয়েটা শমিতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। যদিও পরে এই কারণে আফশোস করেছে তবু সেই মুহূর্তের প্রত্যাখ্যানে সততা ছিল। তা হলে এখন যাবে কেন? দীপাবলী খিড়কির দরজাটা বন্ধ করতে এগিয়ে গেল। ফিরে এলে ও যখন এই পথে ঢুকতে পারবে না তখন বাধ্য হবে সামনে আসতে। আর যাই হোক এইভাবে সমস্ত বাড়ি খোলা রেখে যাওয়াটা যে অন্যায় হয়েছে তা ওকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।
খিড়কির দরজায় হাত দিতেই সে একটা পুরুষকণ্ঠ শুনতে পেল, ‘তা হলে তুই আমার সঙ্গে যাবি না? শেষবার বলছি।’
দীপাবলী অবাক। বাড়ির এই পেছনদিকটায় শুধু মাঠ, ভাঙা মাঠ। সচরাচর কেউ এদিকে পা দেয় না। এখানে কে কথা বলছে? সে দাঁড়াল চুপচাপ। এবার তিরির গলা পাওয়া গেল, ‘আমি নেখালিতে ফিরে যাব না।’
‘কেন?
সেখানে গেলেই আমাকে অর্জুনবাবুর কাছে যেতে হবে।’
‘বাজে কথা বলিস না।’
‘আমি যে ঠিক বলছি তা তুমি জানো।’
‘ওহো, ঠিক আছে, তুই তো সতী না। এই অফিসার যদি মেয়েছেলে না হত তা হলে কি তোকে ছাড়ত?’
‘তা হলে আমি এখানে থাকতাম না।’
‘ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। বুঝলাম তুই আমাকে আর মানিস না।’
‘আমি কি তাই বলেছি?’
‘আমার কোনও কথাই শুনছিস না!’
‘বলছি তো, যদি অন্য কোথাও গিয়ে ঘর নাও আমি রাজি আছি। তুমি এসব কথা বলছ, তাও রাজি।’
‘আমি এখান থেকে কোথাও যেতে পারব না।’
‘তা হলে আর আমার সঙ্গে দেখা করতে এসো না।’
‘ও বুঝেছি। মেমসাহেবের ওই ভাইটা তোকে মতলব দিয়েছে!’
‘খবরদার! ওঁর সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা বলবে না।’
‘কেন রে? তোর গায়ে লাগল কেন?’
‘মানুষটা সত্যি ভাল। আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।’
‘তাই নাকি? করলি না কেন?’
‘এঁটো শরীর দিয়ে পুজো হয় না, তাই।’
ছেলেটা হেসে উঠল। দীপাবলী আর দাঁড়াল না। দ্রুত উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় চলে এল। একেবারে অফিসঘরে পৌঁছে সে নিশ্বাস ফেলল যেন। চলে আসার সময় খিড়কির দরজা বন্ধ করার কথা খেয়ালেই আসেনি।
সে সতীশবাবুকে ডাকল। বৃদ্ধ সামনে এসে দাঁড়াতেই বসতে বলল। সতীশবাবু বললেন, ‘হয়ে এসেছে, আর মিনিট পনেরোর মধ্যে টাইপে দেব।’
‘ঠিক আছে। আপনাকে অন্য প্রশ্ন করব।’
‘বলুন।’
‘আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন আপনি অনুরোধ করেছিলেন তিরিকে যেন বাড়ির কাজে রাখি। ওর সম্পর্কে আপনি কী জানেন?’
‘আজ্ঞে, নেখালির মেয়ে কিন্তু অল্পবয়সে গ্রামছাড়া। ভদ্রলোকের বাড়িতে কাজ শিখে বেশ ভব্য হয়েছিল। তারপর ওকে নিয়ে গ্রামে গোলমাল হয়। আর তখন আপনার জায়গায় যেসব অফিসার এসেছিলেন তাঁদের লোকের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় তিরির মতো কাজ জানা মেয়ের কাজ পেতে অসুবিধে হয়নি।
‘মেয়েটির চরিত্র কেমন?’
‘সেটা আপনি বলতে পারবেন মেমসাহেব। অনেকদিন তো দেখলেন। মেয়েরাই মেয়েদের চরিত্র ভাল বোঝেন!’ সতীশবাবু মাথা নামালেন।
‘আমার আগের অফিসারদের সঙ্গে সম্পর্ক—।’
‘দেখুন মেমসাহেব, অভিভাবকহীন নারীর যদি ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষা না থাকে তা হলে তারা তো অসহায় হয়ে পড়েই। কেন, ও কি কিছু করেছে?’
‘তেমন কিছু নয়। কিন্তু নেখালির কেউ ওর সঙ্গে গোপনে দেখা করতে আসে।’
‘ও বুঝেছি।’
‘আপনি জানেন?’
‘সবাই জানে না। আমি জানি। আমি মিঠাইকে এর আগে নিষেধ করেছিলাম।’
‘মিঠাই? সেই লোকটা?’
‘হ্যাঁ। বালিকা বয়সে মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল মিঠাইয়ের সঙ্গে।’
‘বিয়ে? সেকী?’
‘হ্যাঁ। স্বামী ওকে ব্যবহার করে পয়সা রোজগার করতে চায় বলে ও ঘর করেনি। রোজগার করতে পারছে না তা ছাড়া মিঠাইয়ের অবশ্য কোনও আফশোস নেই।’
দুপুরে অফিস বন্ধ হতে দীপাবলী ভেতরে এলে তিরি জিজ্ঞাসা করল, ‘খেয়ে নেবে? কাল তো কিছু খাওনি?’
‘তুই খেয়েছিলি?’
‘না।’
হঠাৎ দীপাবলী কেঁপে উঠল। তার মনে হল সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন