সমরেশ মজুমদার
কেউ কেউ বলেন জীবন দাবা খেলার মতো। শুরুর তিনটে চাল দিয়ে দেওয়ার পর যদি মনে হয় হিসেবে ভুল হয়ে গেছে, শুরুটা অন্যভাবে করলে সুবিধেজনক অবস্থায় থাকা যেত, তা হলে শুধু মন খারাপই হয়, প্রতিপক্ষ কিছুতেই সেই সুযোগ দেবে না। তখন ভুল চাল মাথায় রেখে নতুন করে রাস্তা খোঁজা। খুব বড় খেলোয়াড়ই তা খুঁজে পান। বেশির ভাগের ক্ষেত্রে গোড়ার ভুল চাল মাঝপথে ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় বড় দুঃসহ, কর্ণের মতো বুঝেসুঝেও হারের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও পথ নেই।
জীবনের শুরুটা কি বেশিরভাগ মানুষের এমনতরই হয়? ঈশ্বর নামক যে-শক্তিটি লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ত প্যাঁচ কষছেন তাঁর অষ্টপ্রহর শুধুই একই চিন্তা, যেমন করেই হোক মানুষের যাত্রাপথ গুলিয়ে দিতে হবে। সতেরো থেকে সাতাশ গুলিয়ে দিতে পারলেই হল, বাকি জীবনটা সে আর ভাঙা মাজা সোজা করতে পারবে না। ভদ্রলোকের তাতেই বড় আনন্দ। কোটি কোটি মানুষ দিগভ্রান্ত হয়ে কষ্ট পাক, কষ্টে ছটফট করুক এবং শেষে ওই কষ্টের কারণেই যখন তারা তাঁর শরণাপন্ন হবে তখন তিনি পতিতপাবন ইমেজটি তুলে ধরতে পারবেন। তাও ওই যে একটু আধটু সুখ ফিরিয়ে দেওয়া তা ইহজন্মে নয়, মৃত্যুর পরেও আর এক জন্মের কথা বলে তার জন্যে ভুলিয়ে রাখা। এও এক অদ্ভুত ভণ্ডামি। জন্ম থেকে মৃত্যু, বছরের পর বছর মানুষটা কষ্ট করে যাচ্ছে পরকালের জন্যে, যে-কালটাকে সে জানে না, কেউ জানে না। যেন অবিবাহিত এবং অপুত্রক মানুষ শুধু সঞ্চয় করে যাচ্ছেন যাতে তাঁর বংশধরেরা ভাল থাকে।
অথচ জীবন, যা কিছু সময়ের সমষ্টি, মুঠো থেকে গলে যাওয়া জলের মতো শুধু যার বেরিয়ে যাওয়া, মানুষের সাধ্য নেই তার পথ আটকানো। ভুল ট্রেন বুঝে নেমে পড়ে ফেরত ট্রেনে আবার। গোড়ার স্টেশনে ক’জন মানুষ আসতে পারে! এলেও তো সময় খরচ হয়ে যায়। সেই খরচ হয়ে যাওয়া সময় চিরকাল দগদগে হয়ে থাকে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে গিয়ে দীপাবলী দেখেছিল সে যা চেয়েছিল তা পায়নি। কিন্তু যা পেয়েছিল তাই আঁকড়ে ধরে কিছু বছর কাটিয়ে দেখল ওই পথটা আদৌ তার নয়। এই যে কিছু বছর নষ্ট হয়ে যাওয়া তার দাম দিতে হবে জীবনভর। কিন্তু পুরোটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার চেয়ে কিছু নষ্ট হওয়া ঢের ভাল, এই নীতিতে দাঁড়িয়ে সে জীবন শুরু করতে চাইল নতুনভাবে। যদি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তা পারে তা হলে সে কেন ওই দলে পোঁছোতে পারবে না।
কিন্তু কী করতে পারে সে! চব্বিশ বছর বয়সে বি এ ডিগ্রি নিয়ে সে চেষ্টা করলে স্কুলে ঢুকতে পারে কিন্তু সেইসঙ্গে আরও কিছু ডিপ্লোমা করে নিতে হবে। কিন্তু স্কুলে পড়াবার জন্যে সে এতদূর উঠে আসতে চায়নি। যেসব স্কুল মিস্ট্রেসকে সে এতকাল দেখে এসেছে তাদের মধ্যে অনেকেই কাজে যথেষ্ট সিরিয়াস ছিলেন। কিন্তু মাথা উঁচু করে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দেবার কথা যেমন তারা ভাবতেন না। তেমন সুযোগও ছিল না। এই বিদ্যে নিয়ে সে দরখাস্ত করলে অনেক চেষ্টার পরে হয়তো কেরানির চাকরি পেতে পারে। তাদের সঙ্গে পড়ত কেউ কেউ ইতিমধ্যে এ জি বেঙ্গলে সেই চাকরি পেয়েহে কেউ আয়কর বিভাগেও। সদাগরি অফিসে সুযোগ পাওয়া এখনও অসম্ভব নয়। কিন্তু সেই চাকরির বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ তার জানা হয়ে গিয়েছে। অন্যের হুকুমমতো মাথা গুঁজে কলম পিষে মাসের শেষে সামান্য কিছু টাকা রোজগার করতে আর যে পারুক সে পারবে না।
অথচ কলকাতা শহবে এমন কেউ নেই যিনি তাকে ওপরে ওঠার মই দিতে পারেন। একজন মামা অথবা কাকা অনেকের ভাগ্য কী চমৎকারভাবে পরিবর্তিত করতে পারেন। একসময় এই ব্যাপারটাকে। সে করুণা করত। জীবনের শুরুতে এরকম অনেক কিছুই আদর্শবিরোধী বলে মনে হয়। যতক্ষণ মন সাদা থাকে ততক্ষণ রুচি বিবেক ইত্যাদি ব্যাপারগুলো গগনচুম্বী হয়। কিন্তু বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাতে তিলতিল করে সেগুলো একসময় আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে। এই দেশে শুধু আদর্শ নিয়ে যারা পড়ে থাকে সময় তাদের কোনও প্রতিদান দেয় না।
চাকরিজীবনের সময়টা দীপাবলীকে এই শিক্ষা দিয়েছে। বাস্তব বড় নির্মম। মজার ব্যাপার হল সেই শিক্ষা তাকে শিক্ষিত করেনি। করলে নিশ্চিত বর্তমান এবং সুদূর ভবিষ্যতের মায়া ছেড়ে সে চলে আসত না ইস্তফা দিয়ে। আদর্শের পোকা কীভাবে যেন সক্রিয় থেকে গিয়েছিল। অবশ্য এখনও ওই কারণে তার মনে আফশোস জন্মায়নি। সরকারি চাকরিতে তার কোনও কাজ করার অবকাশ ছিল না। যদি সত্যি সে কাজ করার সুযোগ পেত তা হলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে আপোসের কথা না হয় ভাবতে পারত। এখন ওই সময়টাকে প্রায় দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। নতুন করে শুরু করতে হবে আবার, কিন্তু তখনই প্রশ্নটা উঠে আসে, কীভাবে?
মায়ার মায়ের ছাদের ঘরের বিছানায় বসে সে ইংরেজি কাগজে বিজ্ঞাপন খুঁজছিল। মেয়ের কথা শুনে মাসিমা সানন্দে তাকে এই ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। বস্তুত পার্টিশন পাকাপাকি হবার পর ঘরটা তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন তিনি। এখন সমস্ত ব্যবস্থা আলাদা। আর শরিকদের সঙ্গে এক কল-পায়খানা ব্যবহার করতে হয় না। এ বাড়ির সেইসব উদ্ভট নিয়মগুলো অন্য শরিকরা মানছে কিনা জানা নেই কিন্তু দীপাবলীকে আর অস্বস্তিকর ব্যাপারগুলোর মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। মাসিমা যখন রাজি হয়েছিলেন তখন টাকার কথা তুলেছিল সে। ভদ্রমহিলা চোখ বড় করেছিলেন, ‘ওমা, টাকা নেব কী, মেয়ে বাড়িতে এসে থাকতে চাইলে মা কি তার কাছে টাকা চাইতে পারে?’
শুনে মায়া হেসেছিল, ‘এবার তুই জবাব দে।’
দীপাবলী গম্ভীর হয়েছিল, ‘মাসিমা, তা হলে আমি রাত তিনেকের বেশি থাকতে পারব না।’
‘সেকী? কেন?’ ভদ্রমহিলা অবাক।
‘খুব বিপাকে না পড়লে মায়ারও তিন রাত্তিরের বেশি এখানে থাকা উচিত নয়।’
‘ওরে বাবা। এ তো দেখছি কথার জাহাজ।’
‘না মাসিমা। আমি আমার মতো থাকতে চাই। সেটা সম্ভব হবে যদি আপনি প্রতি মাসে কিছু টাকা নেন। তা হলে আমার মনে অশান্তি আসবে না।’
বেশ কিছুক্ষণ কথা চালাচালির পর ভদ্রমহিলা বাধ্য হয়েছিলেন রাজি হতে। ঘরভাড়া ঠিক হল একশো টাকা। আলো পাখার জন্যে আলাদা কিছু দিতে হবে না। ষাট দশকের কলকাতায় টাকাটা খুব অন্যায্য বলে মনে হল না দীপাবলীর। তারপরে উঠল খাওয়াদাওয়ার কথা। মাসিমার ইচ্ছে দীপাবলী তার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করুক। রান্না তো হয়ই, আর একজন খেলে বাড়তি কষ্ট কিছুই হবে না। উলটে দীপাবলীকে রান্না করতে গেলে ছাদে যে-ব্যবস্থার দরকার তা এখনই এ বাড়িতে করা অসম্ভব। ওপরে যে বাথরুম রয়েছে সেখানে ভারীকে দিয়ে জল তোলাতে হয়। যেভাবে সে কলোনিতে ঘরের ভেতরেই রান্না করত সেভাবে হয়তো করা সম্ভব ছিল কিন্তু মাসিমা সেটাকে মেনে নিতে পারলেন না। এখনও কোনও মেয়ের পক্ষে দু’বেলা হোটেলে খেতে যাওয়া কলকাতায় সম্ভব নয়। এমনকী পাড়ার চায়ের দোকানগুলোতে সকাল-বিকেলে চা খেতে ঢুকলে সবাই অস্বস্তিতে পড়বে। এই অস্বস্তিটা দেখতে সে একদিন কাণ্ডটা করেছিল।
এই বাড়িতে আসার দিনদুয়েক বাদে এক বিকেলে খুব চায়ের তেষ্টা পেয়েছিল। মাসিমার ঠিকে কাজের লোকটি সাধারণত পাঁচটার সময় আসে। তারপর চা হয়। কী কারণে সে দেরি করছিল। দপাবলী চুপচাপ নীচে নেমেছিল। মায়াদের গলিতে ঢোকার মুখে একটা চায়ের দোকান রোজই নজরে পড়ত। সাদামাটা পাড়ার দোকান। উনুন এবং জল গরম করার ড্রাম বাইরের দিকে। যেতে আসতে। ভেতরে চেয়ার টেবিল দেখেছে সে।
ফুটপাত ছেড়ে সে যখন দোকানের সিঁড়িতে পা রেখেছিল তখনই আবহাওয়া পালটে গেল। তার আগে পর্যন্ত খুব হইচই হচ্ছিল দোকানের ভেতর। চুনী গোস্বামীর নামটা শোনা যাচ্ছিল। গতকাল তিনি যে গোলটা করেছিলেন সেটা অফসাইড থেকে এমন দাবি করছিল কেউ কেউ। কিন্তু তাকে দেখান। সেসব মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। বিস্মিত মুখগুলো দেখে নিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করল দীপাবলী। ‘চা পাওয়া যাবে?’
একগাদা কাপ প্লেট ছোট কেটলি এবং চা বানাবার সরঞ্জাম নিয়ে বাবু হয়ে বসেছিল দোকানদার, প্রশ্নটা শোনামাত্র নড়েচড়ে উঠল। এবং এস্তে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, হবে। নিয়ে যাবেন? ক’কাপ দেব?’
দীপাবলী মাথা নাড়ল, ‘নিয়ে যেতে আসিনি, খাব এখানে। খাওয়া যাবে না?’
‘আপনি দোকানে বসে চা খাবেন!’ লোকটি বিস্ময় গোপন করতে পারল না।
‘হ্যাঁ। অসুবিধে আছে?’
‘না না। আসুন। এই কেলো, কোনার বেঞ্চিটা ভাল করে পুছে দে।’
হুকুম শোনামাত্র একটি শীর্ণ বালক ন্যাতা হাতে ছুটে গিয়ে বেঞ্চি পরিষ্কার করল। তার ধরন দেখে। এবার দু’জন নির্বাক দর্শক হেসে উঠল। মুখ তোলা সংকোচটাকে চেপে রেখে এগিয়ে গিয়ে বসল বেঞ্চিতে। বসেই বুঝল এইরকম পাড়ার অতি সাধারণ চায়ের দোকানে এই কলকাতা শহরেও কোনও মেয়ে চা খেতে ঢোকে না। আর সেই কারণেই এদের অস্বস্তি।
বসার পরেই বিদঘুটে গন্ধ টের পেল দীপাবলী। ময়লা থেকে তৈরি হওয়া গন্ধ। ইতিমধ্যে খদ্দেররা নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করেছে। যদিও তাদের আগের স্বাভাবিক ছন্দ কেটে গিয়েছে। প্রত্যেকেই চোরা চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। অস্বস্তিটাকে আর দমিয়ে রাখা যাচ্ছিল না।
চা নিয়ে এল দোকানদার নিজেই। লম্বা টেবিলের কোনায় কাপ ডিশ রেখে এমনভাবে দাড়াল যে দীপাবলী বুঝল লোকটা কিছু বলতে চাইছে। সে কাপ তুলল। বিবর্ণ কিন্তু ফাটা নয়। গম্ভীর মুখে চুমুক দিয়ে দেখল চা খারাপ নয়। দোকানদার জিজ্ঞাসা করল, ‘খারাপ হয়নি তো?’
‘দীপাবলী হাসল, না, ভালই।’
লোকটা বীরদর্পে চারপাশে তাকাতেই একজন বলে উঠল, ‘স্পেশ্যাল খাতির করছ বকুদা, চা তো ভাল হবেই। আমাদের জন্যে যা বানাও তা ওঁকে দিলে গিলতে পারতেন না।’
‘তোদের মন ভরাতে পারব না জীবনে।’ দোকানদার মুখ ফেরাল, ‘আপনাকে এই পথ দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছি কয়েকবার। কোন বাড়িতে থাকেন?’
দীপাবলী মায়াদের বাড়ির হদিশটা দিল।
লোকটির জানার আগ্রহ কমছিল না, ‘নতুন ভাড়া এসেছেন বুঝি?’
‘ঠিক ভাড়া নয়। ওঁরা আমার পরিচিত। আমি আগে সরকারি চাকরি করতাম।’
শেষ কথাটা শোনামাত্র গুঞ্জনটা আবার থেমে গেল। দীপাবলী দেখল দোকানদারের মুখের চেহারাও বদলে গেল, ‘ও, ও। তা আপনি বললে সকাল বিকেলে কেলোকে দিয়ে আমি চা পাঠিয়ে দিতে পারি। আসলে আমার এই দোকান আপনাদের ঠিক উপযুক্ত তো নয়।’
‘কেন? এই তো ওনারা খাচ্ছেন!’
এবার একটি ছেলে বলে উঠল, ‘এবার জবাব দাও বকুদা। আমরা মানুষ নই, বলো।’
দোকানদার হেঁহেঁ করে হাসল, ‘আঃ, তোমরা হলে ব্যাটাছেলে!’
‘তাতে কী তফাত হল!’ প্রশ্নটা করল দীপাবলী।
সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি উঠে এল, ‘একশোবার। ঠিক বলেছেন দিদি। তুমি এক পয়সা দোকানের পেছনে খরচ করবে না অথচ লাভ করবে ষোলোআনা। তাই দোকানটাকে নরক করে রেখেছ। এখন দিদির মতো মহিলারা এলে তোমার অসুবিধে হবে।’
‘আমার কোনও কিছুতেই যখন ভাল দেখতে পাও না তখন এখানে আসো কেন? আসাও চাই আবার সুযোগ পেলেই জ্ঞান দেবে। না দিদি, এ-পাড়ায় তো মেয়েদের চায়ের দোকানে ঢোকার চণ নেই। ওই ট্রাম রাস্তার ধারে যেসব বড় চায়ের দোকান আছে সেখানেই তারা যায়। প্রথম দিন বলে সবাই চুপ করে আছে কিন্তু ভেতরে যেসব খিস্তি খেউড় চলে তাতে আপনি দু’দণ্ড বসতে পারবেন না।’
দীপাবলী কাপ নামিয়ে রাখল। দোকানদারের শেস কথাগুলোর প্রতিবাদ কেউ করল না। বরং ছেলেটি বলল, ‘কথাটা কিন্তু খাঁটি। আসলে বকুদার দোকানে এসে প্রাণ খুলে কথা বলা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে, আপনি এলে একটু অস্বস্তি হবেই।’
চায়ের দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সে। আর তার পরের দিনই মায়ার মা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোমার চা খেতে ইচ্ছে করছিল আমাকে বললানি কেন? ছি ছি। পাড়ার ওই উদোম দোকানে গিয়ে কখনও চা খেতে হয়।’
দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘কে বলল আপনাকে?’
‘কাজের মেয়েটা। পাড়াতে এটা এখন খবর।’
‘দোকানটায় চা বিক্রি হয়, সবাই খাচ্ছে তাই আমিও খেতে গেলাম। অবশ্য গিয়ে বুঝলাম আমি যাওয়াতে ওদের খুব অসুবিধে হয়েছে।’
‘তুমি জানো না ওখানে কী না হয়। পরনিন্দা পরচর্চার কথা ছেড়ে দাও, রেসের স্লিপ লেখা থেকে সন্ধের পর ঝাঁপ বন্ধ করে মদ পর্যন্ত চলে।’
‘কিন্তু দিনের বেলায় ভদ্রলোকেরা গিয়ে চা খান।’
মায়ার মা হেসেছিলেন, ‘দীপা, আমরা চেষ্টা করলেও এমন অনেক জায়গা থেকে যাবেই যেখানে ছেলে এবং মেয়ের পার্থক্য থাকবে। জোর করে তুমি তা দূর করতে পারবে না।’
ইংরেজি কাগজের বিজ্ঞাপনগুলোর একটাও মনের মতো নয়। স্কুলের ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সি খবরই বেশি। কিছু চাকরি বেসরকারি অফিসগুলোতে এবং সেখানে অভিজ্ঞতার উল্লেখ প্রথমেই। শর্টহ্যান্ড টাইপ শিখলে স্টেনোগ্রাফারের কাজ পাওয়া যায়। দীপাবলী কাগজ ভাঁজ করল। এবং তখনই তার মাথায় ভাবনা এল। একবার চেষ্টা করলে হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভাল ফল হয়নি মানে এমন নয় যে আর কখনও হবে না। সরকারি চাকরিতে শুরুটা যদি ওপর থেকে করা যায় তা হলে প্রথম দিকে যতই অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হোক স্বাধীনভাবে কাজ করার কিছু সুযোগও পাওয়া যাবে। যেটা সে প্রথমবারে পায়নি তা দ্বিতীয় বারেও পাবে না এমন কে বলতে পারে। আর এটা হাতের মোয়া নয় যে সে চাইলেই পেয়ে যাবে। বাংলা ছবির নায়িকারা পরীক্ষা দিলেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়। জীবনের ছবি যে অন্যরকম তা সে হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখেছে তা একমাত্র ওপরতলার সরকারি চাকরিতেই সম্ভব। কর্তৃত্ব চাই। একজন সওদাগরি অফিসের মোটা মাইনের অফিসারের চেয়ে সাধারণ সরকারি অফিসার জনতার কাছে বেশি মর্যাদা এদেশে এখনও পেয়ে থাকেন। সার্টিফিকেটের হিসেবে এখনও তার হাতে সেই পরীক্ষা দেবার কিছু সময় অবশিষ্ট আছে। অবশ্য তার সঠিক বয়স আর সার্টিফিকেটের বয়সের তফাতেই বা কী!
ক্রমশ একটা জেদ প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরল দীপাবলীকে। হাতে যা টাকা আছে তাতে অন্তত মাসিমাকে এক বছরের জন্যে থাকা খাওয়ার পয়সা দিয়ে সে পরীক্ষাটা নিয়ে থাকতে পারবে। যে-সময় নষ্ট হল তা কখনও ফিরে আসবে না, কিন্তু শেষ চেষ্টা করতে দোষ কী! হ্যাঁ, এই একবছর সে চা-বাগানে ঋণশোধের টাকা পাঠাতে পারবে না।
দুপুরে বেরিয়ে সে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিসের সিলেবাস এবং কাগজপত্র আনতে গিয়ে দেখল সময় আর বেশি নেই। এদের পরীক্ষায় বসতে গেলে এখনই ফর্ম জমা দেওয়া দরকার। দীপাবলী ফর্ম নিল। সেইসঙ্গে খাম। বিকেলে বাড়িতে ফিরে আগে ফর্ম ভরতি করল। আনুষঙ্গিক কাগজপত্র তৈরি করতে কালকের দিনটা যাবে। এরপর বইপত্র জোগাড় করা দরকার। ঠিক যেভাবে একটি সিরিয়াস ছাত্র কলেজের শেষ পরীক্ষায় বসে সেইভাবে তাকে তৈরি হতে হবে।
খামের ওপরে মনোরমার ঠিকানাটা লিখল দীপাবলী। তারপর চিঠিটা লেখা শুরু করল। ‘শ্রীচরণেষ ঠাকুমা, আশা করি তোমরা সবাই ভাল আছ। ব্যক্তিগত কারণে আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় আছি। পরবর্তী চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত একটু আর্থিক অসুবিধে হয়তো হবে, কিন্তু বিশ্বাস আছে চালিয়ে নিতে পারব। মাকে জিজ্ঞাসা কোরো, যে-টাকা আমি প্রতি মাসে নীতিগত কারণে পাঠাতাম তা যদি সাময়িক বন্ধ রাখি তা হলে কি তার খুব অসুবিধে হবে? তোমাদের অনেক দিন দেখিনি। মাঝে মাঝেই দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সংসারের নিয়ম মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। ভালই আছি। তুমি এবং মা আমার প্রণাম নিয়ো। ইতি তোমাদের দীপা।’
লিখতে লিখতেই বুকের ভেতরটায় কেমন থম ধরছিল। শেষ করে সে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। বসে রইল। এইসময় ছাদে পায়ের আওয়াজ এবং তারপরেই মায়ার গলা পাওয়া গেল।
চিঠি খামে ভরার আগেই মায়া ঘরে ঢুকল, ‘যাক, তোকে পাওয়া গেল। এইসময় তুই বাড়িতে থাকবি আশা করিনি।’ চেয়ার টেনে বসে পড়ল সে।
মায়ার দিকে তাকাল দীপাবলী। আজ ওকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। সে তাকিয়ে আছে দেখে মায়া। চোখ কোঁচকাল, ‘কী দেখছিস হাঁ করে?’
‘তোকে বেশ দেখাচ্ছে আজ।’
সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট ওলটাল মায়া, ‘কোনও ছেলে তো একথা বলে না।’
‘কেউ বলে না?’ হাসল দীপাবলী।
মায়া সোজা হল, ‘দ্যাখ, তোকে একটা কথা সোজাসুজি বলছি। তুই এত অহংকারী কেন?’
‘আমি! অহংকারী!’ অবাক হয়ে গেল দীপাবলী।
‘অবশ্যই। তুই এমনভাবে কথা বলিস যেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। কারও সঙ্গে মন খুলে কথাও বলিস না। সবসময় এমন একটা দূরত্ব রাখিস যে তোকে ছোঁয়া যায় না। তুই নিজে সুন্দরী এটা ভাল করে। জানিস অথচ আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে বলে খুশি করতে চেষ্টা করছিস। এটাও বানানো।’
‘তুই আমাকে ভুল বুঝছিস।’
‘মোটেই না। তুই কী! রক্তমাংসের মানুষ! একটা ফঁপানো আইডিয়া নিয়ে নিজের চারপাশে কাচের দেওয়াল তুলে বাস করছিস। রক্তমাংসের মানুষরা যা করে তা তুই ইচ্ছে করে করবি না।’
‘যেমন?’
‘আমি যদ্দিন তোকে দেখছি তুই তোর তৈরি করা রুচি নিয়ে গা বাঁচিয়ে আছিস। আমার মনে হয় এই আমাদের দেখে তোর মনে অনুকম্পা আসে।’
‘মিলল না। কিছুদিন আগে তুই আমাকে অভিযোগ করেছিলি শমিতকে আমি—।’
‘হ্যাঁ করেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝেছি সেটাও তোর অহংকার।’
‘মানে!’
‘শমিতকে মেনে নিলে আর পাঁচটা মেয়ের মতো তুই সাধারণ হয়ে যেতিস যেটা কিছুতেই হতে চাইবি না। একটু স্বাভাবিক হ দীপা।’
‘কীরকম?’
‘খুব মজা পাচ্ছিস আমার কথা শুনে, না?’
‘তুই মেজাজ সপ্তমে চড়িয়ে এসেছিস। সুদীপের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।’
‘আমরা আর ঝগড়া করি না। আচ্ছা, তোর নিশ্চয় খিদে তেষ্টা পায়, কেটে গেলে রক্ত পড়ে, তাই না?’ মায়া চেয়ার ছেড়ে খাটে উঠে এল।
চোখ বন্ধ করল দীপাবলী। তারপর বলল, ‘ঘাটা পড়ে গেছে।’
‘তার মানে?’
‘গোরু মোষের ঘাড়ে গাড়ি টেনে টেনে মোটা কড়া পড়ে যায়। তাকে ঘাটা বলে। প্রথম প্রথম নিশ্চয়ই খুব লাগত। তারপর ‘ঘাটা খুব পুরু হয়ে গেলে আর কোনও অনুভূতি থাকে না। তেমনি রক্ত পড়তে পড়তে সেটা অভ্যেসে এসে গেলে পরে আর টেরই পাওয়া যায় না রক্ত পড়ছে কি পড়ছে না।’ দীপাবলী হাসল।
মায়া স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। দীপাবলী খামে চিঠি ভরে রাখল চুপচাপ। তারপর বলল, ‘আমি তোর মতনই সাধারণ মেয়ে। তুই ছটফটিয়ে মুখে যা বলিস তা হয়তো আমি মনে মনে বলি। মুখে বলার অভ্যেসটা সেই বালিকা বয়সেই হয়তো চলে গিয়েছে।’
এবার হেসে উঠল মায়া, ‘এইজন্যে তোর সঙ্গে ঝগড়া বেশিক্ষণ করা যায় না!’
‘এবার বল তোর বৃত্তান্ত।’
‘আমার সমস্যার এবার সমাধান করতে হবে দীপা। সুদীপকে আমি কিছুতেই মানতে পারছি না।’
‘কেন? পাগলামি করিস না মায়া।’
‘না, পাগলামি না। একটা মানুষ দিনবাত ঈর্ষান্বিত হয়ে থাকলে তার সঙ্গে সংসার করা যায় না। ও সন্দেহ করে আমাকে। এবং সেই কারণে নাটকটাকে ব্যবহার করছে। ও মরিয়া হয়ে প্রমাণ করতে চায়। পরিচালক নাট্যকার অভিনেতা হিসেবে শমিতের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।’
‘তাতে তোর কী এসে গেল। ও যদি বড় হতে চায় তা হলে তুই সাহায্য কর।’
‘এই রেষারেষিটা যদি না বুঝতে পারতাম তা হলে নিশ্চয়ই করতাম।’
‘তুই আর রিহার্সালে যাচ্ছিস না?’
‘না।’ মুখ নিচু করল মায়া।
‘সেকী?’ তুই নাটক না করে বাঁচতে পারবি?
মুখ নিচু করেই মাথা নাড়ল মায়া। তারপর হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল সে। এটার জন্যে একটুও প্রস্তুত ছিল না দীপাবলী। আজ পর্যন্ত মায়াকে কখনও সে এমন ভেঙে পড়তে দ্যাখেনি। বরং ভিজে নেতিয়ে থাকা বাঙালি মেয়েদের মধ্যে সে প্রথম মায়াকেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেখেছিল। এ-কথা স্বীকার না করে উপায় নেই মায়াই তাকে পরোক্ষে মেরুদণ্ড শক্ত করতে সাহায্য করেছে। সেই মায়াকে এই অবস্থায় দেখে সে জড়িয়ে ধরল, ‘কী হয়েছে তোর? এই মায়া, কথা বল!’
সময় লাগল। কান্না বন্ধ হলেও বুকের ওঠানামা কমছিল না। ঠোঁট কামড়ে ছাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মায়া শেষপর্যন্ত বলল, ‘শমিত বিয়ে করেছে।’
চমকে উঠেই কোনওমতে নিজেকে সামলাল দীপাবলী। পরে এই নিয়ে সে অনেক ভেবেছে। শমিতের বিয়ের কথা শুনে সে কেন চমকে উঠেছিল? শমিতের কাছে তার আশা করার কিছু ছিল না। শমিতের জন্যে কোনও দুর্বলতা কি তার অজান্তেই মনে জমা ছিল!
মায়া বলে গেল, ‘মানুষটা আত্মহত্যা করল দীপা।’
‘ছিঃ। বিয়ে করেছে মানে আত্মহত্যা বলছিস কেন? বরং আমাদের সকলের খুশি হওয়া উচিত। ও খুব ভাল সংসারী হোক এমন কামনা কর।’
‘অসম্ভব। সংসারী হওয়া শমিতের ধাতে নেই। আর যাকে বিয়ে করেছে তার সঙ্গে ওর স্বভাবের কোনও মিল নেই। ওদের দলে কিছুদিন আগে অভিনয় করতে এসেছিল, কোন একটা স্কুলে পড়ায়। – দেখতে শুনতে ভাল নয়, অভিনয়ও সাদামাটা, নেহাত একটা মেয়ে ছাড়া যে কিছু নয় তাকে এমন টপ করে বিয়ে কেউ করে? শমিত ইচ্ছে করে করেছে।’
‘বেশ। কিন্তু এটা ওর সমস্যা, তুই কেঁদে মরছিস কেন?’
মাথা নামাল মায়া, ‘আমি এখন কী করব?’
হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল দীপাবলীর, কী করবি মানে? ন্যাকামি করছিস?
‘ন্যাকামি!’ থতমত হয়ে গেল মায়া।
‘তুই যখন সুদীপকে বিয়ে করেছিলি তখন শমিতের অবস্থার কথা ভেবেছিলি?
‘ভেবেছিলাম। শমিত তখন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই রাগেই সরে এসেছিলাম আমি। ও তখন বলেছিল আমাকে নাকি বন্ধুর মতো দ্যাখে। শুধু বন্ধু। একটি ছেলের সঙ্গে আমাকে কোনও তফাত করে না। কিন্তু আমি জানি ও মিথ্যে কথা বলেছিল। আমার বিয়ের খবর শুনে ওর মুখের চেহারা দেখে আমার বুঝতে বাকি ছিল না। আর ও জানে আমি ওকে কতটা ভালবাসি।’
‘এই ভালবাসা নিয়ে ও কী করবে? তুই সুদীপের ঘর করছিস, সুদীপের স্ত্রী।’
‘কিন্তু আমি ওকে জানিয়ে এসেছিলাম।’
‘কী জানিয়েছিলি?’
‘আমি আর পারছি না। আমি ভুল সংশোধন করতে চাই।’
‘ও কী বলেছিল?’
‘ও নিষেধ করেছিল!’
‘কেন?’
‘ও বলেছিল আমরা নাকি এভাবেই চিরকাল বন্ধুত্ব রাখতে পারব। দু’জনে কাছাকাছি হলে পরস্পরকে অল্পদিনের মধ্যেই সহ্য করতে পারব না।’
‘কেন বলেছিল?’
‘আমাদের মনে নাকি এর মধ্যে অনেক ক্লেদ জমে গিয়েছে। আমরা পরস্পরকে অবিশ্বাস করতে পারি এমন কাজ করে ফেলেছি। আমি এসব কথা শুনতে চাইনি। কিন্তু দ্যাখ, লোকটা আমাকে সযোগ। দিল না।’
‘অথচ এই তুই একদিন আমাকে দায়ী করেছিলি!’
‘সে-কথাও ওকে বলেছিলাম। ও হেসে বলেছে, ভুল নাকি ওরই হয়েছিল। তুই অন্য জাতের মেয়ে। অতএব আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। কিন্তু ও যে এমন কাণ্ড করে বসবে ভাবতে পারিনি দীপা।’
‘ঠিক আছে। এবার তুই নিজেকে শক্ত কর।’
‘আমি পারছি না দীপা। শমিতের বিয়ের খবর শুনে সুদীপ খুব হেসেছে। দল ভাঙার পর কোনওদিন শমিতের সঙ্গে দেখা করতে যায়নি। বিয়ের খবর পেয়ে ওর দলের নামে ফুলের তোড়া পাঠিয়েছে। শুভেচ্ছা হিসেবে। এটা আমি সহ্য করতে পারছি না।’
‘সহ্য করতে হবেই। এটাই জীবন।’
‘দুর! আমার আর বেঁচে থাকতে ভাল লাগছে না। কোনও কিছুই আর আমাকে টানছে না।’
‘মন শক্ত কর, এই বৈরাগ্য কেটে যেতে দেরি হবে না।’
‘তুই ঠাট্টা করছিস দীপা?’
‘না রে। এটাই সত্যি! বরং তুই সুদীপকে মেনে নে। ওর দলে যেমন নাটক করতিস তাই কর। কাজ নিয়ে থাক। শমিত যাকে বিয়ে করেছে তার কথা ভাব। সেই মেয়েটি তো কোনও দোষ করেনি। হয়তো সে শমিতকে সুখী করতে পারবে।’
‘অসম্ভব। উঁঠে দাঁড়াল মায়া, ‘এক জায়গায় স্থির হয়ে বসার মানুষ শমিত নয়।’
‘তা হলে তার জন্যে এমন কষ্ট পাচ্ছিস কেন?’
মায়া হাসল, ‘সেজন্যেই ওকে ভালবাসি। আর পাঁচটা অঙ্ক ক্যা পুরুষের মতো শমিত নয় বলেই। আমি চলি। পারলে কাল একবার আয় না।’
‘কখন?’
‘বিকেলে। সন্ধ্যায়।’
‘সন্ধ্যায় তো তোদের রিহার্সাল হয়।’
জবাব দিল না মায়া। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সেটা দেখে দীপাবলী বলল, ‘ঠিক আছে।’
‘তোর চাকরিবাকরির কী হল? ’
‘কিছু না।’
‘ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে কাজ করবি?’
‘নাঃ। এখন যা করব একেবারে পাকাপোক্ত। অন্যের জায়গায় প্রক্সি দেওয়া আর নয়।’
শুরু হল এক অদ্ভুত জীবন। রাস্তায় বের হওয়া তেমন নেই, শুধু ঘর আর চিলতে ছাদ। এখন সবসময়ের সঙ্গী বই। সর্বভারতীয় পরীক্ষাটাকে বেঁচে থাকার পরীক্ষায় পরিণত করল দীপাবলী। এইরকম নাছোড়বান্দা হয়ে কখনও পড়াশুনা করেনি সে। দিনকয়েকের মধ্যে অভ্যেসে এসে গেল তার রুটিন বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে রইল খবরের কাগজ, মায়ার মা এবং কখনও সখনও মায়া। মায়ার মা তাকে অনেকবার বলেছেন এইভাবে বই আঁকড়ে না পড়ে থাকতে। মানুষ যখন কোনও কিছুকে মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরে তখন তার ওপর প্রচণ্ড নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু কোনও কারণে অকৃতকার্য হলে সে যে দিশেহারা হয়ে যায় তা থেকে নতুন করে উঠে দাঁড়ানো অসম্ভব। পরীক্ষা দেবে দীপাবলী, তা দিক, কিন্তু সেটা সহজভাবে আর পাঁচটা কাজের সঙ্গে দেওয়াই ভাল। এই ছিল মায়ার মায়ের বক্তব্য। দীপাবলীও সেটা বোঝে। সে বাংলা ছবির নায়িকা নয় যে যা চাইবে তাই পাবে। কিন্তু এবার সে মরিয়া। একবার, শেষবার, ভারতবর্ষের সেরা সরকারি চাকরির জন্যে লড়াই করতে চায়। এবং তার জন্যে কোনওরকম ঝুকি নেবে না সে।
ঘর ছেড়ে পথে না বেরোবার ফলে মাঝে মাঝে তার একটা আলাদা অনুভূতি হয়। সে যে এই কলকাতা শহরে আছে তাই বোঝা যায় না। একটা ঘর বাথরুম এবং ছাদ পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় পেলে কি একই রকম বোধ তৈরি হয়। যে-লোকটিকে জেলের কনডেম্ড সেলে কয়েকবছর কাটাতে হয় তার কাছে কলকাতা দিল্লি অথবা নিউ ইয়র্ক কি একাকার? এই কলকাতাতে থেকেও আমি কলকাতায় নেই এমন ভাবতে মোটেই অসুবিধে হচ্ছিল না। প্রয়োজনে চা খেতে সে ঘরে কেরাসিনের স্টোভ আনিয়ে রেখেছে। মধ্যরাতে চা বানিয়ে ছাদে দাঁড়াতে যে কী ভাল লাগে। কিন্তু না, আকাশ পৃথিবীর সব জায়গায় নিশ্চয়ই এক নয়। চা-বাগান অথবা জলপাইগুড়ি শহরে যে ঝকমকে তারার আকাশ দেখতে পাওয়া যেত, কলকাতার ছাদে দাঁড়ালে মনে হয় তার ওপর একটা হালকা অস্বচ্ছ পরদা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো মাটির সঙ্গে আকাশের দারুণ বন্ধুত্ব। মাটি যেখানে দিগন্ত ছড়ানো সবুজ, আকাশও সেখানে ঝকমকে।
মায়া এখন অনেক সহজ। যখন আসে তখন ভুলেও শমিতের কথা তোলে না। সুদীপের সঙ্গে সম্পর্কটা কীরকম সেই আলোচনাতে উৎসুক নয়। এখন কথা হয় সাধারণ বিষয় নিয়ে। এবং সে আবার সুদীপের দলেই নাটক করছে। কাগজে সুদীপ যখন দলের নাটকের বিজ্ঞাপন দেয় তখন অভিনেত্রী হিসেবে মায়ার নাম ছাপে। ক্রমশ বাংলা নাট্যদর্শকের কাছে মায়া বেশ পরিচিত হয়ে উঠছে। কাজ নিয়ে ভুলে থাকলে বোধহয় কাজটা ভাল হয়। কাগজে শমিতদের নতুন দলের বিজ্ঞাপন এবং সমালোচনা পড়েছে দীপাবলী। শমিত এখন সমালোচকদের প্রিয় অভিনেতা ও পরিচালক। তাকে ছবিতে নামাচ্ছেন একজন প্রখ্যাত পরিচালক। অর্থাৎ শমিত তার নির্দিষ্ট পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। এসব খবরের কাগজ থেকেই জানা। যেন বহু দূরে বসে পরিচিতদের খবর রাখা। স্কটিশে বিপিনবাবু তাদের বাংলা পড়াতেন। খুব প্রাচীন মানুষ। অধ্যাপকসুলভ কোনও দূরত্ব রাখতেন না। থাকতেন একটা মেসে। তাঁর কাছে বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিল সে এক সকালে। তখন কলেজের প্রথম বছর সবে শেষ হয়েছে। গিয়ে দ্যাখে বিপিনবাবু ছোট্ট ঘরের মেঝেতে বসে জলচৌকিতে খবরের কাগজ রেখে গম্ভীর হয়ে পড়ছেন। ঘরে বসার জায়গা ছিল না। তাদের বসতে বললেন বারান্দা থেকে নেমে আসা সিঁড়িতে। ঘরটি বারান্দার নীচে। দীপাবলীরা বসেছিল যতক্ষণ না ওঁর কাগজ পড়া শেষ হয়। এবং তখনই আবিষ্কার করেছিল ঝকঝকে সদ্য ভাঁজ ভাঙা কাগজটা আজকের নয়। প্রশ্ন করতে বিপিনবাবু বলেছিলেন ওটা বছর দুই আগের কাগজ। সেই সকালে কোনও কারণে পড়ে উঠতে পারেননি বলে তুলে রেখেছিলেন যত্ন করে। এর মধ্যে সময় পাননি তাই আজ পড়ে নিচ্ছেন। দু’বছর আগের কাগজ অমন মন দিয়ে কেউ পড়ে? বিপিনবাবু বলেছিলেন, ‘বড় বড় খবরগুলো পড়ি না। ওসব তো বাসি। ছোট খবর পড়ি, আইন আদালতের পাতাটা দেখি। আমার কোনও চেনা ছাত্র কিছু করলে তা জানতে পারব। এই যে এখানে আছে অতনু মিত্র ডক্টরেট করেছে। খুব ভাল লাগল পড়ে। অতনুটা বি এ ক্লাসে অবশ্য কারক বিভক্তি বলতে পারত না।’ ওরা জেনেছিল অতনু মিত্রকে বিপিনবাবু গত আট বছর দ্যাখেননি। এবং এইটেই শেষ নয়। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের অধ্যাপকজীবনে যত ছাত্রছাত্রী এসেছে তাদের সবাইকে তিনি মনে রেখেছেন। নাম এবং রেফারেন্স দিলেই তার সম্পর্কে বলতে পারেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই তাঁর। তিনি একা একা সেইসব স্মৃতি নিয়ে মেসে বাস করেন।
এই একা থাকা মানে স্মৃতি নিয়ে থাকা? না। অন্তত দীপাবলীর ক্ষেত্রে তো নয়। কিন্তু মাসের পর মাস একা থাকতে থাকতে সে ক্রমশ নির্লিপ্ত হতে শিখে গেল। পৃথিবীর কোনও ব্যক্তিগত সুখদুঃখ তাকে আর স্পর্শ করছে না। কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে কোনও দুর্ভাবনা আসছে না মনে। শুধু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে নিজেকে বুঝে ফেলা এবং সবশেষে অদ্ভুত একটা শক্তি পেয়ে গেল সে। নিজেকে আর মোটেই একা বলে মনে হচ্ছিল না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন