২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী

সমরেশ মজুমদার

টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী। এর আগে কখনও তার নামে কেউ টেলিগ্রাম পাঠায়নি। কৌতূহল ছিল তাই। শমিতের নামটা দেখে সে ভ্রূ কোচকাল। শমিত লিখেছে সে আসছে। কেন আসছে, কী জন্যে, এবং কতদিন থাকবে, তার বিশদ লেখার প্রয়োজন বোধ করেনি অথবা পয়সা বাঁচিয়েছে। সে যে এখানে আছে তা একমাত্র অমলকুমার ছাড়া কাউকে জানায়নি। তা হলে শমিত কী করে ঠিকানাটা পেল! টেলিগ্রামে ওর আসার দিনও উল্লেখ করা নেই।

দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে এল দীপাবলী। তিরি কাছেপিঠে নেই। বাড়ির প্রতিটি জানলা বন্ধ। বাইরে এখন সূর্যের কড়াই থেকে যেন লাভা ঝরছে। শরীরে জামাকাপড় রাখতে ইচ্ছে করে না। শাড়ি পর্যন্ত তেতে উঠেছে। বাঁচোয়া এই যে তেমন ঘাম হয় না। গলা তুলে দীপাবলী ডাকল, ‘তিরি, এক গ্লাস জল দে।’

তিরি এল মিনিট দেড়েকের মধ্যেই। জল দিয়ে হাসল। সেটা গলায় ঢেলে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ জল তুলে রেখেছিস?’

‘আজ কেন তুলব? কাল তুলেছি। ঘোলা জল ছিল, ঘেঁকে ফুটিয়ে কপূর দিয়ে রেখেছি। কেন, কপূরের গন্ধ পেলে না?’

‘পেয়েছি। তুই এমন চমৎকার বাংলা শিখলি কোখেকে?’

‘শিখে গিয়েছি।’

‘আচ্ছা, যদি একদিন দেখিস কুয়োতে এক ফোঁটা জল উঠছে না তো কী করবি?’

‘তুমি ছুটি নেবে আর আমি তোমার সঙ্গে এখান থেকে চলে যাব।’ হাসল তিরি, ‘না দিদি, এই কুয়োর জল কখনও শুকোয় না।’

‘তা হলে ওরা নিতে এলে আপত্তি করেছিলি কেন?’

‘দু’জনের জল দুশো জন নিলে থাকবে! দিদি, ও তোমাকে কী বলল?’

দীপাবলীর মনে পড়ল, হ্যাঁ, তুই অর্জুন নায়েককে দেখে আমাকে বাইরে বেরুতে মানা করছিলি কেন? ব্যাপারটা কী?’

মাথা নাড়ল তিরি, ‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুমি মেমসাহেব।’

‘তার মানে?’

‘মেমসাহেব বলে ও তোমাকে কিছু বলল না।’

‘খুলে বল তো, হেঁয়ালি করিসনি।’

‘আগে পাশের যত গ্রাম আছে ভাল মেয়ে দেখলেই ও কাজ দেবার নাম করে বদমায়েশি করে। সবাই জানে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না।’

দীপাবলীর চোয়াল শক্ত হল। অর্জুন নায়েকের কিলবিলে হাসিটা মনে পড়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোকে কিছু বলেছিল?’

‘সেইটাই তো আসল ব্যাপার।’ মাথা নাড়ল তিরি, ‘দাঁড়াও, আসছি রান্নাঘর থেকে।’

দীপাবলী হতাশ হল। সে খাটে শরীর এলিয়ে দিল। মেয়েটাকে কোনও প্রশ্ন করলে সরাসরি জবাব পাওয়া যায় না। ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেলে বনানীদির স্বভাবের কিছুটা পেয়েছে ও। বিকেলে বনানীদি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে বললেন, ‘উঃ, আজ যা কাণ্ড হয়েছে তোকে কী বলব!’ প্রথমদিকে দীপাবলী ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞাসা করত, ‘কী হয়েছে?’

‘আর বলিস না। সকালে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর দেখি মাথা ধরেছে। চা খেলাম তবু কমল না। খবরের কাগজ পড়লাম। সুজাতা বলল মাথা ধরার ট্যাবলেট খেতে। আমি আবার ওসব খেতে পারি না। সাততাড়াতাড়ি স্নান করে খেয়েদেয়ে স্কুলে গেলাম। গিয়ে শুনি আমাদের এক কলিগ্ স্বপ্নার কাল রাত্রে বাচ্চা হয়েছে। খুব শখ ছিল ছেলের, হল মেয়ে। ওর কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। তবে স্বপ্না এত রোগা যে ভালয় ভালয় হয়েছে এই ঢের।’

‘কী কাণ্ড হয়েছে বলছিলেন না?’

‘হ্যাঁ বলছি৷ দুপুরে হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল। আমাদের স্কুলে আবার মেটার্নিটি লিভ নেই। পুজোর ছুটি গরমের ছুটি তার ওপর নাকি মেটার্নিটি লিভ দেবেন না। বললেন, এমনভাবে প্ল্যান করুন যেন ছুটির সময় বাচ্চা হয়। বোঝ!’

দীপাবলী হেসে ফেলল, ‘তারপর?’

‘তুই হাসছিস? কীরকম কাণ্ডজ্ঞান দ্যাখ! ছুটির পর ভাবলাম আমার এক মাসতুতো বোনের বিয়ে হয়েছে গড়পাড়ে, ঘুরে আসব। গেলাম। ও তো খুব খুশি। ওর বরের নাকি নিউ মার্কেটে দোকান আছে। যাবি একদিন ওখানে?’

‘যেতে আপত্তি কী! কিন্তু কাণ্ডটা!’

‘হ্যাঁ, তা ওখানেই বোনের ভাশুরের সঙ্গে আলাপ হল। তার বউ মারা গিয়েছে বিয়ের পরের বছর। মাথায় বিশাল টাক। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স। পেটের গোলমালে ভোগে। অনেক খরচ করেছে, কমেনি। তা আমি বললাম গ্রে স্ট্রিটে একজন হোমিওপ্যাথ আছেন আমাদের মণিকার পেটের অসুখ সারিয়েছিলেন। তাই শুনে এমন ধরল যে ওকে নিয়ে যেতে হল সেই ডাক্তারের কাছে। আমি তো মণিকার সঙ্গে কয়েকবার গিয়েছিলাম। ওষুধটষুধ নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেল আমাকে হস্টেলে।’

‘এইটে তোমার কাণ্ড?’

‘দুর! তা কেন হবে?’

‘তা হলে?’

‘ভদ্রলোকের স্ত্রী, যিনি মারা গিয়েছেন, তিনি নাকি আমাদের হেডমিস্ট্রেসের বোন, ব্যাপারটা ভাব। সেই বোন যদি বেঁচে থাকত তা হলে মানুষটার অবস্থা কী হত?’

দীপাবলী কী উত্তর দেবে বুঝতে পারেনি। বনানীদি যদি শ্যামবাজারের কথা বলতে আসতেন তা হলে বালিগঞ্জ থেকে শুরু করতেন। এবং যে-কোনও বিষয়েই কথা বলতে গেলে একবার না-একবার হেডমিস্ট্রেস চলে আসতেনই।

খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ করে দীপাবলী ডাকল, ‘তিরি!’

তিরি দূর থেকে সাড়া দিল। তারপর তার পায়ের আওয়াজ ঘরে এল। দীপাবলী বলল, ‘শোন, তোকে আমি যখন যা প্রশ্ন করব তখনই তার উত্তর দিবি। ফেনাবি না।’

‘আমি তো উত্তর দিই!’ সরল গলায় বলল তিরি।

‘তোকে অর্জুন নায়েক কী বলেছিল?’

‘ও, ওই কথা! না, শুনলে তুমি রাগ করবে।’

‘আবার?’

‘মানে, আমার যখন চোদ্দো বছর বয়স তখন চার-চারটে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল। নেখালি থেকে না।যেসব গ্রামে বৃষ্টি হয়, চাষবাস করা যায়, সেইসব গ্রাম থেকে। বাবার তো পয়সা ছিল না যে বিয়ে দেবে। তা সবাই বলল অর্জুনবাবুকে গিয়ে ধরো। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাবা গেল। অর্জুনবাবু বলল, আগে তোমার মেয়েকে চোখে দেখি তারপর বিয়ের খরচ দেব। তাই শুনে মা কিছুতেই রাজি নয়। এ-গ্রামের মেয়েদের চেহারা ভাল না বলে ডাক পড়ে না। কিন্তু অন্য গ্রামের মেয়েরা নাকি হপ্তায় একদিন অর্জুনের কাছে কাজের নামে গিয়ে থাকে। একজনের পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল, অর্জুনবাবু নেখালির একটা ছেলেকে টাকা দিয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটা নেখালিতে আসার পরের বাতেই গলায় দড়ি দেয়। তাই মা আমাকে পাঠাল না।

‘তুই ধান ভানতে শিবের গীত গাইছিস কেন?’

‘মানে?’

‘তারপর কী হয়েছিল?’

‘মা পাঠাল না। আমার বিয়েও হল না। এক বছর পরে যখন বাবা-মা সবাই কাজে গিয়েছে, ওই যে তেঁতুলতলার রাস্তাটা তৈরি হচ্ছিল, তখন অর্জনবাবু লোক পাঠান আমাদের ঘরে। সেই লোক জিজ্ঞাসা করল আমি ওর ওখানে কাজ করতে যেতে চাই কিনা। আমি না বললাম। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে নেখালির মানুষদের কাজে নেওয়া বন্ধ করে দিল অর্জনবাবু। সবাই আমার ওপর খেপে গেল। গ্রামসুদ্ধ লোক বাবাকে গিয়ে বলল, তোমার মেয়েকে কাজে পাঠাও, না হলে আমরা না খেয়ে মরব। এইসময় বংশীদাদা এসে বাবাকে বলল এই কাজটার কথা। মা বলল, চলে যা নইলে তোকে বাঁচাতে পারব না। আমি চলে এলাম। তাই গ্রামের লোক খেপে গেল। বেশ কিছুদিন আমি এখানে চাকরি করতাম আর বংশীদার বাড়িতে থাকতাম। তারপর আগের সাহেব আসার পর—।’ মুখ নামাল তিরি।

‘অর্জুন জানে যে তুই এখানে কাজ করিস।’

‘সব জানে। কোন খবর ওর কাছে যায় না বলো!’

‘ঠিক আছে, তুই যা। আমাকে খাবার দে।’

চোখের ওপর হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইল দীপাবলী। এরকম চরিত্রের কথা কিছু গল্প-উপন্যাসে পড়েছে সে। লোকটার স্বভাবে একটা ডোন্টকেয়ার ভাব আছে, কিন্তু প্রথম দিনের আলাপে কখনও অসম্মান করেনি তাকে। এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন, শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশকে কাজে লাগানো ইত্যাদি কিছু দায়িত্ব চাকরির সূত্রে তার ওপর অর্পিত। এ-গ্রামে থানা নেই। থানার দারোগার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, ব্রিটিশ আমলের মানুষ। বছর দুয়েকের মধ্যে অবসর নেবেন। কিন্তু লোকটিকে মনে হয়েছে মেরুদণ্ডহীন এবং পাশ কাটানো। এস ডি ও কিংবা ডি এমের সঙ্গে যার সখ্যতা তাকে তো দারোগা দেবতাজ্ঞানে পুজো করবেন। অর্জুন নায়েক যদি মেয়েদের নিয়ে সুখী হতে চান তা হলে সে কিছুই করতে পারে না যতক্ষণ না ওইসব মেয়ে বা তাদের পরিবার তার কাছে নালিশ করছে। কিন্তু এস ডি ও শেষপর্যন্ত এলেন না। সতীশবাবুর ধারণাই সত্যি হল। ভদ্রলোক খবর পাঠালেন অর্জুন নায়েকের মাধ্যমে যেটা দীপাবলী মোটেই পছন্দ করছে না। এখন মনে হচ্ছে উনি বাহানা দিয়েছেন, আসার অভিপ্রায় তাঁর মোটেই ছিল না। এক্ষেত্রে নেখালির মানুষজনের জন্যে আপাতত কিছুই করা যাচ্ছে না।

এমন সময় বাইরে সাইকেলের ঘণ্টা বাজল। বন্ধ অফিসঘরে দরজায় শব্দ হল। দীপাবলী গলা তুলল, ‘তিরি, দ্যাখ তো কে এসেছে?’

‘যাচ্ছি।’ তিরি রান্নাঘর থেকে সাড়া দিল।

গরম বাড়ছে। যেই আসুক দায়ে না পড়লে এই রোদে বের হবে না। ঈশ্বর নামক শক্তিমানের খামখেয়ালিপনার শেষ নেই। আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত ক্রমাগত বৃষ্টি আর তিস্তা-করলার বুক ছাপানো জলের ঢালে জলপাইগুড়ির মানুষ বিব্রত হয় যেখানে—সেখানে এই মাইলের পর মাইল জমি জলের অভাবে বন্ধ্যা হয়ে থাকে। যে কলকাতা শহরে বৃষ্টির দরকার নেই সেখানে একদিন জল পড়লেই লোকে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে হাঁটতে বাধ্য হয়। সমস্ত শরীর চিড়বিড় করছে গরমে। শাড়ি খুলে শুতে পারলে ভাল হত। খাওয়াদাওয়ার পর ঘণ্টা তিনেক সেই সুযোেগ মেলে। তখন শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় সে। সংস্কার এমন জিনিস যা কাজের লোকের সামনেও নিজেকে সহজ হতে দিতে পারে না।

তিরি ঘরে এল একটা পিয়ন বুক হাতে, তার মধ্যে সরকারি বিধি। উঠে বসে চিঠিটা নিল সে। তিরি কলম এনে দিতে সই করতেই ওটা ফেরত নিয়ে গেল। খামের মুখ ছিড়ল দীপাবলী। ডি এমের সরকারি নির্দেশ। আগামীকাল সকাল দশটায় সমস্ত সাব ডিভিশন এবং ব্লকের অফিসারদের সার্কিট হাউসে উপস্থিত থাকতে হবে। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী আলোচনা করতে চান।

দীপাবলীর মনে হল এটা একটা বড় সুযোগ। তার পক্ষে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা বা কাজের ব্যাপারে অভিযোগ জানানো ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার শামিল। উপরওয়ালা, তস্য উপরওয়ালার অনুমতি চাই। এরকম একটা আলোচনাসভায় মন্ত্রী যদি কিছু জানতে চান তা হলে সরাসরি বলে ফেললে কেউ কিছু মনে করতে পারবেন না। সতীশবাবুকে বলতে হবে সমস্ত পয়েন্ট সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট তৈরি করতে।

সতীশবাবুর ওপর দায়িত্ব দিয়ে সকাল সাতটার বাস ধরল দীপাবলী। একটাই বাস দিনে দু’বার যায় এবং ফেরে। সকালের বাসে ভিড় ছাদেও থিকথিক করে। তাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কনডাক্টর ব্যস্ত হয়ে ভিড় হঠিয়ে জায়গা করে দিল বসার। দীপাবলী জানত না এখানে আসার এত অল্প দিনের মধ্যেই এত লোক চিনে গিয়েছে। বাসে বসে আর একটা অভিজ্ঞতা হল। চেঁচামেচি বকরবকর যা হবার তা হচ্ছে পেছন দিকে। তার সামনে যেসব দেহাতি এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি বসে তারা রয়েছে বেশ গম্ভীর মুখে। যেন কথা না বলে তারা তাকে সম্মান দেখাচ্ছে। এর মধ্যে বাসের জানলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গরম হাওয়ার জন্য। চুপচাপ বসে এল দীপাবলী। নামার আগে কনডাক্টরকে ডাকল সে, ‘এই যে ভাই, টিকিটের দাম নাও।’

লোকটার বয়স বেশি নয়, এক হাত জিভ বের করে মাথা নাড়ল।

‘কেন?’ দীপাবলী বেশ বিরক্ত হল।

‘না।মেমসাহেব, পারব না, আমার চাকরি চলে যাবে।’

‘তা হলে তো তোমাদের বাসে আমি উঠতেই পারব না।’

‘এ কী কথা বলছেন! আপনি হলেন গিয়ে আমাদের—না না।’ প্রায় পালিয়েই গেল সে। দীপাবলী বুঝল কোনও লাভ হবে না। সে মুখে যতই বলুক ভাড়া না নিলে বাসে উঠবে না কিন্তু ভাল করেই জানে বাসে না উঠে কোনও উপায় নেই। স্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিল সে। দশটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। এতবার লোক ওঠা নামা করছে যে দেড়ঘণ্টার পথ প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা লাগিয়ে দিল বাস। সে অবশ্য এস ডি ও-র অফিসে যেতে পারত। মিনিট চল্লিশেকের মধ্যেই পৌঁছোননা যেত সেখানে। এস ডি ও-র জিপে চড়ে সোজা শহরে। কিন্তু গতকালের ঘটনার পর ব্যাপারটা ভাবতেই ভাল লাগেনি।

সার্কিট হাউসের সামনে পৌঁছে মোটামুটি ভিড় দেখতে পেল। আদেশ মান্য করে সবাই জমায়েত হয়ে মন্ত্রীর অপেক্ষা করছেন। ডি এম নেই। জানা গেল তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে আসবেন। অরবিন্দ সেন এগিয়ে এলেন, নমস্কার মিসেস ব্যানার্জি, কেমন আছেন?’ দীপাবলী একটু আড়ষ্ট হল। সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে হলে নিজের ঠিকুজি জানিয়ে দিতে হয়। ইচ্ছা না থাকলেও দীপাকে নিয়ম মানতে হয়েছে। পরলোকগত অতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীর পরিচয় তাকে বহন করতেই হয় এই কারণে বাধ্য হয়ে। সে মাথা নাড়ল, ‘ভাল। আপনি?’

‘আর বলবেন না। খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমোতে পারছি না। যা গরম?’

‘আপনাদের ওদিকে প্রবলেম কেমন?’

‘নাথিং। কিছু নেই। আপনার হাতে ওটা কী?’

‘এই কিছু কাগজপত্র। মন্ত্রীমশাই যদি জিজ্ঞাসা করেন তা হলে বলতে হবে তো?’

‘তা হলে আপনি খুব সিরিয়াসলি কাজকর্ম করছেন বলুন।’

দীপাবলী হাসল। যেন কাজকর্ম করা একটা অন্যায় ব্যাপার এমনই মনে হল ওর এঁর কথা শুনে। সে দেখল তার এস ডি ও আর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন দূরে দাঁড়িয়ে। যাঁর সঙ্গে উনি কথা বলছেন তার নজর এদিকেই। দীপাবলীকে দুচোখে গিলছেন তিনি। হঠাৎ এস ডি ও এদিকে তাকালেন। তারপর ওঁরা এগিয়ে এলেন।

‘সরি মিসেস ব্যানার্জি, কাল শরীর এমন খারাপ হয়ে পড়ল যে যেতে পারিনি কিন্তু আমি আপনাকে খবর পাঠিয়েছিলাম।’ এস ডি ও বললেন।

‘হ্যাঁ। আপনি এখন কেমন আছেন?’

‘ভাল না। মন্ত্রী না এলে আজ বের হতাম না।’ বলেই যেন মনে পড়ল, ‘তা আপনি আমার ওখানেই তো আসতে পারতেন, আমি আসছিলাম—!’

‘বুঝতে পারিনি আসবেন কিনা, অসুস্থ শুনলাম?’

‘আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি সুধীর গুপ্তভায়া, সাউথ ডিস্ট্রিক্টের এস ডি ও। আমারই ব্যাচমেট।’

সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক দু’হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, ‘আপনার কথা আগেই শুনেছিলাম। আপনার মতো সুন্দরী মহিলা এই চাকরিতে আছেন ভাবাই যায় না!’

‘কেন? চাকরি বুঝি অসুন্দরী মহিলাদের জন্যে?’

‘না না, সুন্দরীরা সাধারণত পটের বিবি হন। এত খাটাখাটুনির চাকরি তাদের সহ্য হয় না। আমি এটাই মিন করতে চেয়েছি।’

দীপাবলী হাসল, ‘তা হলে বলব আপনার দেখার পরিধি বেশি বড় নয়।’

এইসময় তিনটে গাড়ি ছুটে এল। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এস ডি ও-রা এগিয়ে গেলেন ব্যস্ত হয়ে। গাড়ি থেকে মন্ত্রী, ডি এম নামলেন। দীপাবলী দেখল মন্ত্রীর বয়স হয়েছে কিন্তু খাদির পাঞ্জাবি ও ধুতিতে বেশ সৌম্য দেখাচ্ছে তাকে। পুলিশের সুপারও ছিলেন পেছনের জিপে। অফিসাররা সবাই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন— তাঁদের সারির মধ্যে দিয়ে নমস্কার করতে করতে মন্ত্রীমশাই ডি এম-কে নিয়ে সার্কিট হাউসে ঢুকে গেলেন বিনা বাক্যব্যয়ে।

মিনিট চারেকের মধ্যে মিটিং আরম্ভ হল। মন্ত্রী এবং ডি এম বসেছেন ঘরে একদিকে, এপাশে অফিসাররা। দীপাবলী দ্বিতীয় সারির এক কোণে বসে শুনছিল। ডি এম ভূমিকা করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে মন্ত্রীমশাই বললেন, না না, কথা বাড়ানোর দরকার নেই। আপনাদের সোজাসুজি কিছু কথা বলি। এই জেলায় খরা যেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে। বৃষ্টি হয় না তাই চাষবাসও হয় না। কৃষকরা খুব কষ্টে বেঁচে আছেন। আমরা অবশ্য তাদের নানারকম সাহায্য করি তা আপনারা জানেন। কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে যাতে এই এলাকায় চাষবাস হয়। এ-ব্যাপারে আপনাদের আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে। আর চাষ ছাড়া ওদের হাতে শ্রমের বিনিময়ে যাতে কিছু পয়সা আসে, নিয়মিত রোজগার করে যেতে পারে, তার জন্য আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। মনে রাখবেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বারংবার বলেছেন কৃষকরাই হল ভারতবর্ষের মেরুদণ্ড। সেই মেরুদণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সবরকম চেষ্টা করা উচিত। মন্ত্রী হাত বাড়িয়ে গ্লাস তুলে নিয়ে দুটো চুমুক দিলেন, ‘জল। এই জেলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল জলের অভাব। ঈশ্বর এই জেলাকে মেরে রেখেছেন কোনও বড় নদী না দিয়ে। জল ছাড়া চাষবাস করা সম্ভব নয়। আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে শুধু বছরের দু-তিন মাস নয়, বারো মাস ফসল ফলানোর ব্যবস্থা এখানে করা যায়। বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে অনেকরকম গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন। দুশো বছর ধরে ইংরেজরা শুধু ভারতবর্ষের গরিব কৃষকদের শোষণ করেছে কিন্তু তাদের উন্নতির কোনও চেষ্টাই করেনি। আমরা জনগণের নির্বাচিত সরকার, তাই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমাদের হাত হল আপনারা। আপনারাই পারেন গাঁধীজি জওহরলালের স্বপ্নের ভারতবর্ষকে বাস্তবে নিয়ে আসতে। বন্দেমাতরম!’ মন্ত্রী বসে পড়লেন। পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে কপাল গলা মুছে ডি এমের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকালেন।

ডি এম নিচু গলায় তাকে কিছু বলতে তিনি বাঁ হাত উলটে সম্মতি দিলেন। ডি এম উঠে দাঁড়ালেন, ইংরেজিতে বললেন, ‘মাননীয় মন্ত্রীমহাশয় অত্যন্ত ব্যস্ততা সত্ত্বেও এখানে এসে আমাদের যা বললেন তা নিশ্চয়ই স্মরণে রাখব। তবে আপনারা যারা এই জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন তাঁরা যদি কোনও সমস্যার কথা বলতে চান তা লিখিতভাবে আমার কাছে পাঠালে আমি নিশ্চয়ই কলকাতায় মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়ের দপ্তরে পাঠিয়ে দেব।’

হঠাৎ মন্ত্রী বলে উঠলেন, ‘স্পেশ্যাল কিছু সমস্যা আছে নাকি?’

অফিসাররা সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। মন্ত্রী বললেন, ‘চিঠি চাপাটিতে সময় নষ্ট করে বলে ফেলুন এখানে। আপনি বলুন ভাই?’

দীপাবলী দেখল সামনের সারিতে বসা তার এস ভি ও-র দিকে ইঙ্গিত করছেন মন্ত্রী। তিনি খুব নার্ভাস ভঙ্গিতে উঠে দাড়ালেন, ‘স্যার, অ্যাজ সাচ তেমন কিছু প্রবলেম নেই, শুধু গরম ছাড়া।’

সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। মন্ত্রীমশাইও সেই হাসিতে যোগ দিয়ে বললেন, ‘এ-ব্যাপারে সরকারের তরফে কিছু করার নেই। ঈশ্বরের ওপর আমাদের কোনও কন্ট্রোল নেই যে তাঁকে কথা শুনতে বাধ্য করব। সিট ডাউন প্লিজ।’ এস ডি ও বসে পড়লেন।

ডি এম তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন, ‘তা হলে আমরা এখানেই আজকের আলোচনা শেষ করছি। মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়কে জেলার পক্ষ থেকে এখানে আসার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’

অনেকক্ষণ থেকে উসখুস করছিল দীপাবলী। তার এস ডি ও-র এইরকম হাস্যকর মন্তব্য শোনার পর সে ঠিক করল উঠে দাঁড়াবে। ডি এম কথা বলতে শুরু করামাত্র সে তার হাত উঁচুতে তুলেছিল। কথা শেষ করে ডি এম সেটা দেখতে পেলেন। আলোচনা সভা শেষ হয়েছে ভেবে সবাই উঠে দাঁড়াচ্ছিল, ডি এস দু’হাত শূন্যে তুলে সবাইকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। দীপাবলী দেখল সবাই এখন তার দিকে কৌতুহলী চোখে তাকাচ্ছে। ডি এম বললেন, ‘মনে হচ্ছে আপনি কিছু বলতে চাইছেন?’

দীপাবলী উঠে দাঁড়াল, ‘হ্যাঁ।’

‘আপনি কোন ব্লকে আছেন?’

দীপাবলী উত্তর দিল। মন্ত্রী কিছু বললেন ডি এমকে। তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে সেটা শুনে হাসলেন। তারপর ইঙ্গিত করলেন দীপাবলীকে বলতে।

দীপাবলী হাতের ফাইলটা খুলল। তারপর বিনীত গলায় বলল, ‘মাননীয় মন্ত্রীমহাশয়, মাননীয় ডি এম। আমি খুব অল্প দিন হল এই জেলায় বদলি হয়ে এসেছি। যে-এলাকায় আমাকে কাজ করতে পাঠানো হয়েছে তার অবস্থা দেখে আমি শিউরে উঠেছি। স্বাধীনতার পর পনেরো বছর হতে চলল আমরা শাসনে এসেছি কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি এখানকার মানুষদের বেঁচে থাকার ন্যনতম সুযোগসুবিধে আমরা দিতে পারিনি।’

হঠাৎ একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। দীপাবলী অস্বস্তিতে পড়ল। মন্ত্রীমহাশয় হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন সবাইকে চুপ করতে। দীপাবলী একটু নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ জেদের বশে সে যা করতে যাচ্ছে তার পরিণতি আন্দাজ করতে পারছিল না। তবু এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। সে বলল, ‘আমার এলাকায় বৃষ্টি হয় না বললেই ঠিক বলা হয়। বছরের একটা সময় জল এত নীচে চলে যায় যে কুয়ো নতুন করে খোঁড়াতে হয়। আমি নেখালি নামের একটি গ্রামের ছবি মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়ের সামনে তুলে ধরতে চাই। নেখালি গ্রামে বাহান্নটি পরিবার কোনওমতে টিকে আছে। মাটি পাথর হয়ে গিয়েছে তাই চাষ হয় না। কোনওরকম গাছপালা নেই। গ্রামে কোনও কুয়ো বা নলকূপ নেই। কয়েক ক্রোশ দূর থেকে জল নিয়ে আসে তৃষ্ণা মেটানোর জন্যে। স্নানের কথা বছরে এক-দু’দিনের বেশি ভাবতে পারে না। মাঝে মাঝে দিনমজুরি করে এরা যে পয়সা পায় তাই দিয়ে কোনওমতে বেঁচে থাকে। কেন বেঁচে আছে তা এরা নিজেরাই জানে না। নেখালির প্রায় প্রতিটি মানুষ কমবেশি অসুস্থতায় ভুগছে। তবে চর্মবোগ ওদের মধ্যে ব্যাপক। আমি এদের দিকে তাকালে কোন ভারতবর্ষকে দেখতে পাব? আমরা এদের জন্য আজ পর্যন্ত কী করেছি?’

দীপাবলী থামতেই মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘আপনি কি সরকারকে অভিযুক্ত করছেন?’

সমস্ত ঘর মুহূর্তেই নিঃশব্দ হয়ে গেল। দীপাবলী মাথা নাড়ল, ‘না, আমি একজন কর্মচারী হিসেবে সরকারের অঙ্গ। সত্যিকারের ছবি তুলে ধরছি।’

‘কিন্তু আমি আপনার গলায় কমিউনিস্টদের সুর পাচ্ছি।’

দীপাবলী থমকে গেল। তারপর বলল, ‘মাননীয় মন্ত্রীমহাশয়, আমি রাজনীতির ধারে কাছে থাকি না। যা সত্যি তাই বলছি।’

এবার ডি এম, এস ডি ওর দিকে তাকালেন, ‘আপনার বক্তব্য কী?’

এস ডি ও বললেন, ‘মিসেস ব্যানার্জি আমাকে অবশ্য নেখালির কথা বলেছিলেন। সমস্যা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আমার মনে হয়েছিল মহিলারা একটু বেশি ভাবপ্রবণ হন।

‘দ্যাটস রাইট।’ ডি এম বললেন, ‘মিসেস ব্যানার্জি, আপনি যাদের কথা বললেন তাদের মতো অনেক মানুষ ভারতবর্ষে ছড়িয়ে আছে। মাননীয় মন্ত্রীমহাশয় নিশ্চয়ই তা জানেন। তবে সরকার কিছুই করছে না একথা আমরা বলতে চাই না।’

এবার মন্ত্রীমহাশয় উঠে দাঁড়ালেন, ‘একটু আগে যখন জানতে চেয়েছিলাম আপনাদের কোনও সমস্যা আছে নাকি তখন সবাই চুপ করে ছিলেন। একজন শুধু বলেছিলেন তাঁর খুব গরম লাগে। কিন্তু এখন উনি যে-গ্রামের ছবি তুলে ধরলেন তা যদি সত্যি হয় তা হলে বলতে হবে এ-জেলায় সরকারি কাজকর্ম ঠিকঠাক হচ্ছে না। রাজা কান দিয়ে দ্যাখে। আমাদের কান হলেন আপনারা। যা হোক, ঠিক ছিল আমি এখান থেকে কলকাতায় ফিরে যাব। কিন্তু আমি এই ইয়ং লেডির বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে চাই। ওই গ্রামটি এখান থেকে কতদূর?’

ডি এম, এস ডি ওর দিকে তাকালেন। এস ডি ও দীপাবলীর দিকে। দীপাবলী বলল, ‘গাড়িতে যাতায়াতে ঘণ্টা তিনেকের বেশি লাগা উচিত নয়। অবশ্য রাস্তা সব জায়গায় খুব ভাল নয়।’

ঘড়ি দেখলেন মন্ত্রী, ‘চলন, আর দেরি করে লাভ নেই।’ সভা ভাঙল। সবাই গুনগুন করতে লাগলেন, আগে জানলে তাঁরাও নিজেদের এলাকার সমস্যার কথা বলতে পারতেন। আফশোস এখন সবার মুখে।

দুটো জিপ রওনা হল। মন্ত্রী, ডি এম ও এবং এস ডি ও প্রথম জিপটাতে, দ্বিতীয়টাতে দীপাবলী এবং পুলিশের লোকজন। মন্ত্রীর পি এ প্রথম জিপে উঠলেন। শহর ছাড়িয়ে জিপ ছুটল। দীপাবলীর ভাল লাগছিল। বৃদ্ধ মন্ত্রী যে এভাবে নিজের চোখে নেখালি দেখতে যেতে চাইবেন তা সে অনুমান করেনি। যেভাবে সাজানো কথার মিটিং চলছিল সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা যায় না। কিন্তু একটা কথা তার মনে খচখচ করছিল। মন্ত্রীমশাই তার গলায় কমিউনিস্টদের সুর পেয়েছেন। ভবিষ্যতে এর ফল মারাত্মক হতে পারে। নিপীড়িত মানুষের কথা অন্যের মুখে শুনলে এঁরা কেন কমিউনিজম আবিষ্কার করেন তা এঁরাই জানেন। ধুলো উড়িয়ে জিপ ছুটছিল চাঁদিফাটা রোদূরে। মুখের চামড়া গরম হাওয়ার হলকায় জ্বলছে। আঁচলে মুখ ঢেকেও কষ্ট কমানো যাচ্ছে না।

সোওয়া ঘণ্টা নাগাদ জিপ থেমে গেল। রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। মন্ত্রীর পি এ দৌড়ে সামনের জিপ থেকে চলে এলেন, ‘মিনিস্টার আপনাকে সামনের জিপে যেতে বলছেন।’;দীপাবলী চটপট নেমে পড়ল। রাস্তাটুকু পার হতে মনে হল পায়ে ফোসকা পড়ে যাবে। জিপে উঠতেই মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় হে নেখালি?’

‘সোজা যেতে হবে।’

এবার এস ডি ও বললেন, ‘আমার অফিস হয়ে যদি যাই—!’

‘আপনার অফিস কোনদিকে?’

‘ডানদিকে?’

‘নেখালি তো উলটো পথ হয়ে যাবে। আপনার অফিসে গিয়ে টেবিল চেয়ার দেখতে আমি এসেছি নাকি?’

জিপ সোজা পথ ধরল। ডি এম বললেন, ‘সময়টা ভুল বাছা হয়েছে স্যার। এখন যাকে বলে স্কর্চিং ভোরভোর বা বিকেলে এলে দেখার সুবিধে হত।’

‘ঠিক কথা। ব্লক অফিস ওখান থেকে কতদূর?’

‘কাছেই স্যার।’ দীপাবলী জবাব দিল।

‘তা হলে ব্লকেই যাই আগে। চারটে নাগাদ নেখালি দেখে ফিরে যাব।’

মন্ত্রী কথাগুলো বলমাত্র এস ডি ও জিপের আওয়াজের আড়াল খুঁজে দীপাবলীকে বললেন, ‘আপনার ওখানে অ্যারেঞ্জমেন্ট কেমন? ফ্রিজ আছে?’

‘ফ্রিজ? ওখানে তো ইলেকট্রিসিটি যায়নি।’

‘মাই গড! তা হলে মন্ত্রীকে খাওয়াবেন কী?’

‘সেটা ওঁকে বলুন।’

এবার মন্ত্রীর পাশে বসা ডি এমের দিকে তাকিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগলেন, এস ডি ও। সেটা ডি এম বোঝার আগে মন্ত্রী দেখে ফেললেন, ‘কী হয়েছে? কিছু বলছেন?’

তো তো করলেন এস ডি ও ‘স্যার, ব্লক অফিসে আপনাদের জন্যে ভাল অ্যারেঞ্জমেন্ট করা সম্ভব নয়। মানে উইদাউট নোটিশ আর কী!’

ডি এম বললেন, ‘দ্যাটস রাইট।’

এস ডি ও সাহস পেলেন, ‘বলছিলাম কী, আপনি যদি আমার ওখানে যান, ওখান থেকে বেশি সময় লাগবে না!’

‘আপনি নেখালি গিয়েছেন?’ মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘না, মানে, স্যার, আমি তো নতুন এসেছি।’

‘উনি আপনাকে রিপোর্ট করার পরেও যাওয়ার সময় পাননি?’

স্যার, আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।’

ততক্ষণে ব্লক অফিস দেখা যাচ্ছে। দীপাবলী বলল, ‘ওই যে আমার অফিস।’

মন্ত্রী বললেন, ‘অনেকগুলো ঘর আছে দেখছি, চলো, ওখানেই চলো।’

অতএব জিপদুটো থামল। অফিসঘর বন্ধ। সতীশবাবুরা ঠিক দশটাতেই আজ চলে গিয়েছেন। তিনি দরজা খুলে দিতেই সবাই যেন প্রাণ বাঁচাতে ভেতরে ঢুকে পড়ল। মন্ত্রীকে নিয়ে দীপাবলী নিজের ঘরে চলে এল, সঙ্গে ডি এম।

‘অফিসে লোকজন কই হে?’

‘স্যার, এখানে গরমের জন্যে মর্নিং আর আফটারনুন অফিস হয়।

চেয়ারে বসে মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘জল খাওয়াও।’

দীপাবলী ছুটে ভেতরে চলে গেল। তিরিকে নির্দেশ দিল, প্রথমে জল, পরে চা দেবার জন্যে। নির্দেশ দিয়েই সে আবার দৌড়ে বাইরে চলে এসেছিল। মন্ত্রীমশাই তখন ডি এমের সঙ্গে গল্প করছেন। তাঁর ধারণা ছিল সরকারি কাজে মহিলারা শুধু শোভাই বাড়ান কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখে তাঁর ধারণা পালটাচ্ছে।

প্রায় এক কুঁজো জল শেষ হয়ে গেল। এস ডি ও বললেন, ‘শরবত করে দিন, এই গরমে কেউ চা খাবেন না।’

তিরি দাঁড়িয়েছিল দরজায়, বলে উঠল, ‘যা জল ছিল তা উনুনে বসিয়ে দিয়েছি চায়ের জন্যে, গরম জলে শরবত হবে কী করে?’

দীপাবলী বিরক্ত এবং রাগত ভঙ্গিতে বলল, ‘তোকে এখানে কথা বলতে কে বলেছে। ভেতরে গিয়ে কুয়ো থেকে জল তোল।’

‘এখন কুয়েতে জল নেই।’

‘মানে?’ দীপাবলী একদম অপ্রস্তুত।

‘তুমি চলে যাওয়ার পরে চারজন লোক এসে জোর করে জল তুলে নিয়ে গিয়েছে। আমাকে বলল মেমসাহেব বলেছেন নিয়ে যেতে। এখন কাদা পড়ে গিয়েছে, বিকেলের আগে জল জমবে না।’

‘কী আশ্চর্য! কারা এসেছিল?’

‘নেখালির ওরা।’

ঘরে সবাই একদম চুপ। এইসময় বাইরে একটি জিপ এসে থামল। এস ডি ও কৌতূহলী হয়ে বেরিয়ে গেলেন, পেছনে দীপাবলী। জিপ থেকে নামছে অর্জুন নায়েক। সে তার দুই সঙ্গীকে নির্দেশ দিচ্ছে কিছু নামাতে। তারা ভারী দুটো বাক্স নামাচ্ছে। এস ডি ও চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে আপনি?’

অর্জুন ঘরের ছায়ায় চলে এল, এই আর কী! শুনলাম মিনিস্টার নেখালি দেখতে এসেছেন তাই এই গরমে ওঁর সেবার জন্যে চলে এলাম। কোল্ড ড্রিঙ্কস আর তেমন কোল্ড নেই যদিও। নমস্কার মেমসাহেব, নেখালিতে আজ সকাল থেকে কুয়ো খুঁড়তে লাগিয়ে দিয়েছি। আপনার আদেশ অমান্য করিনি।’

দীপাবলী দেখল দু’হাতে অর্জুনের আনা দুটো ঠান্ডা পানীয়ের বোতল নিয়ে এস ডি ও মন্ত্রীকে দেবার জন্যে ছুটে যাচ্ছেন। অর্জুন ফিসফিস করল, ‘মিনিস্টার কোথায়?’

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন