২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে

সমরেশ মজুমদার

ঘুম ভেঙেছিল সাতসকালে। চোখ মেলতেই দেখেছিল পাশেমনোরমা নেই। এখন বাইরে অন্ধকার নেই কিন্তু আলোও ফোটেনি। দীপাবলী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে দেখল কুয়োর পেছনে একটা তুলসীগাছ থেকে পাতা তুলছেন মনোরমা। এর মধ্যে তাঁর বাসি কাপড় পালটানো হয়ে গিয়েছে। ইদানীং এই ব্যাপারে ছেলেলি অভ্যেস এসে গিয়েছে দীপাবলীর। ঘুম থেকে উঠেই কেন গায়ের পোশাককে অত নোনাংরা ভাবতে হবে তার বোধগম্য হয় না। যেটা এক ঘণ্টা আগেও আরামে শরীরে রাখতে পারা যেত সেটাকে না পালটালে অশুচি হতে হবে কেন? ছেলেদের ক্ষেত্রে তো সেটা প্রযোজ্য নয়! এই ভাবনাকে সাহায্য করত এক ধরনের আলসেমি। একা থেকে থেকে সেটা বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। তাই যা কিছু ছাড়াছাড়ি তা একেবারে স্নানের সময়। এখন মনোরমাকে দেখে তার অস্বস্তি হল। বাসি কাপড় সাতসকালে ছাড়ার অভ্যেসটা আকৈশোর এবং তারও পরে মনোরমাই তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ সে তাকে ধরে রাখেনি জানলে তিনি কি খুশি হবেন?

মুখহাত ধুয়ে, পরিষ্কার হয়ে দীপাবলী ঘরে ফিরে গিয়ে বিছানা তুলে কাপড় বদলাল। খামোকা একটি মানুষকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? যদিও এটা হিপোক্রেসি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কখনও কখনও তার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। পোশাক পরিবর্তনের সময় ঘরটির দিকে তার ভাল করে নজর পড়ল। কাল রাত্রে মাঝে মাঝে ঠান্ডা লাগছিল। খুবই অযত্নে তৈরি এই ঘরটিতে হাওয়া ঢোকার যথেষ্ট জায়গা আছে। জোরে বৃষ্টি হলে জল ঢোকে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। অমরনাথ স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না এমন ঘরে তার মা রাত্রিবাস করেন। হয়তো মূল বাড়িতে মনোরমাকে থাকতে বলেছিল অঞ্জলি, মনোরমাই রাজি হননি। এটুকু অনুমান করতে অসুবিধে হয় না। বৈধব্য নিয়ে আলাদা থাকার একটা জেদ মনোরমার অনেকদিনের।

এখন একটু চা হলে ভাল হত। ঘরের বাইরে এসে সে দেখল মনোরমা ফিরে আসছেন। অঞ্জলিরা কেউ ওঠেনি। পৃথিবীটা কী মনোরম শান্ত। মনোরমার মুখে হাসি ফুটল। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে চলেন এখন। বললেন, ‘বাসি কাপড় স্নানের সময় কেচে দিস৷ তোর দেখছি মেমসাহেব হওয়া হল না।’

নিজেকে প্রতারক মনে হচ্ছিল। কিন্তু বৃদ্ধার এই আনন্দটুকু নষ্ট করা এই সাতসকালে খুবই অন্যায় হবে। দীপাবলী বলল, ‘তুমি পুজোটুজো করো, আমি একটু ঘুরে আসি।’

‘ওমা, কোথায় যাবি?’

‘এমনি, হাঁটব।’ দীপাবলীর চোখে পড়েছিল পেছনে একটা গেট আছে, সে সেই দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হল এরা এই জায়গাটাকে কলোনি বলে বটে, কিন্তু তার দেখা যাদবপুরের কলোনির সঙ্গে কোনও মিল নেই। সেখানকার মানুষ এমন ফাঁকাফাঁকা থাকে না, সেখানে এত গাছগাছালিও নেই। এই সময়েই বাচ্চারা রাস্তায় বেরিয়ে শব্দ তোলে।

কলোনির ভেতর দিয়ে হেঁটে চলে এল দীপাবলী পিচের রাস্তায়। ডান দিকে একটু এগোলেই চা-বাগান আর তার পরেই মেছুয়াপুল ছাড়িয়ে খুঁটিমারির জঙ্গল। আকাশে পাখি উড়ছে। পুরো রাস্তাটা শুয়ে আছে চমৎকার আলস্য নিয়ে। নির্জনতায় বুক ভার হয়ে আসে।

দীপাবলী বাঁ দিকে হাঁটতে লাগল। কাল রিকশায় বসে যতটুকু চোখে পড়েছিল তাতে চৌমাথার দিকটাকে একেবারে শহর বলেই মনে হয়েছিল। এদিকের শ-মিলগুলো একই রকম রয়েছে, স্কুলের মাঠ এবং স্কুলবাড়িও পালটায়নি। সত্যসাধন মাস্টার নেই। মন কেমন খারাপ হয়ে গেল কথাটা মনে পড়তেই। ঠাকুরবাড়ির সামনে পৌঁছাতে একটি মানুষের দেখা পেল সে। বৃদ্ধ, বেড়াতে বেরিয়েছেন সম্ভবত। সে চিনতে পারল না। ছেলেবেলায় অবশ্য বাগানের বাইরে এই এলাকার বেশি মানুষকে সে চিনত না। বৃদ্ধ একটু বিস্মিত চোখে তাকে দেখে চলে গেলেন। ইচ্ছে করেই দীপাবলী চলে এল চৌমাথায়। দোকানপাট সব বন্ধ। একটা ট্যাক্সি মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে। একটুও ব্যস্ততা নেই কোথাও। দীপাবলীর মনে হল জায়গাটার শরীরে অনেক ভার চাপানো হয়েছে বটে কিন্তু তাতে তার চরিত্র বদল এখনও হয়নি। সে পিচের রাস্তা ধরে আংরাভাসার দিকে এগিয়ে গেল।

একটু একটু করে চেনা কাঠের বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে সে আংরাভাসার পুলের ওপর এসে দাঁড়াল। জল নেই, পাথরগুলো ধুলোয় ভরতি। এই নদী তার ছেলেবেলায় জড়িয়ে। বইয়ের পাতায় লেখা থাকে, সময় সবকিছু গ্রাস করে নেয়। এই সময়টা কত দিনে তা জানা ছিল না। কেউ তাকে তার ছেলেবেলা ফিরিয়ে দিতে পারবে না কিন্তু ইচ্ছে করলে এই হাড়জিরজিরে নদীতে আবার স্রোত আনা যায়, শুধু ওপাশের বাঁধটুকু কেটে দিতে যেটুকু পরিশ্রম।

কিন্তু প্রয়োজনের চেহারা বদলে গেলে আর বাঁধ কাটবে না কেউ। এটাই জীবনের সত্যি। ঠিক একই ব্যাপার, আজ এই মুহূর্তে এখানে একদম একা ভাবা। দীপাবলী পুল ছেড়ে এগোতে লাগল। এবার চা-বাগানের চৌহদ্দি শুরু। ওই যে শ্যামলদাদের কোয়ার্টার্স, ওপাশে বিশু আর খোনদের বাড়ি। খোকনদের বাড়ির গাছে বসে থাকত এক পেতনি। আঃ, সেই ছেলেবেলায় ব্যাপারটা কী দারুণ বিশ্বাসযোগ্য ছিল। ওই যে বড়বাবুর বাড়ি। বড়বাবুর বাবা তেজেন্দ্র কীরকম দুর্বল ছিলেন মেয়েদের সম্পর্কে! মনোরমা থেকে শুরু করে বালিকা দীপাবলী পর্যন্ত সবাই তার কাছে সমান যত্ন পেত। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই মারা গিয়েছেন। ওই মাঠ, তাদের খেলার মাঠ, কালীপূজার মাঠ এখন কীরকম নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে আছে! এসব দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছিল দীপাবলীর। কিন্তু সে রাস্তা থেকে নামল না। সোজা এগিয়ে গিয়ে থামল চা-বাগানের মধ্যে। চারপাশে এখন স্মৃতিরা তাদের নিজস্ব জায়গা নিয়ে বেঁচে আছে। এতগুলো বছরে এখানকার গঞ্জ এলাকার যত পরিবর্তনই হোক চা-বাগানের চেহারার ছবি একই অবস্থায় রয়েছে। এই গাছপালা, মাঠ, এমনকী ঘাসগুলোকেও তার বন্ধু আত্মীয় বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তাকে কেউ চেনে না। এই দীপাবলী এদের সম্পূর্ণ অচেনা। মনে মনে এমন অনুভূতি তৈরি হচ্ছিল।

হঠাৎ বুধুয়ার কথা মাথায় এল। বুধুয়া তো ওই বাগান পেরিয়ে কুলি লাইনে থাকত। কতকাল বুধুয়া তাদের বাড়িতে চাকরি করেছে। একবার গেলে কেমন হয়! সেই নিরক্ষর মদেশিয়া মানুষটি তাকে খুব সমীহ করত। এখন কি করবে?

দীপাবলী এগোতেই কানে গাড়ির আওয়াজ এল। জলপাইগুড়ির দিক থেকে একটা প্রাইভেট গাড়ি ছুটে আসছে। ফাকা রাস্তা বলে দুরন্ত গতিতে ছুটছে গাড়ি। দীপাবলী রাস্তা থেকে সরে ঘাসের ওপর গিয়ে দাঁড়াল। হুস করে গাড়িটা বেরিয়ে গিয়েও আচমকা গতি কমাতে লাগল। সম্ভবত ব্রেকে জোর চাপ পড়তেই শব্দ বাজল। দীপাবলী দেখল গাড়িটা বেশ কিছুদূরে গতির টানে এগিয়ে গিয়ে থামতে পারল। এরকম জায়গায় ওই গতির গাড়ির থামার কথা নয়। উত্তরবাংলার নির্জন রাস্তায় কখনও কখনও গাড়ি থামিয়ে অনেক কুকাণ্ড করত একসময়। অস্বস্তি নিয়ে সে দেখল গাড়িটার দরজা খুলে ড্রাইভাব নামছে। নেমে একটু দাঁড়িয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করছে।

এত দূর থেকে দীপাবলী কিছু বুঝতে পারছিল না। সে দেখল লোকটা তার দিকে দৌড়ে আসছে। এবং তখনই সে চিনতে পারল। এক দৌড়ে সামনে এসে খোকন বলল, ‘আরে তুই, আমি ঠিক চিনেছি, তুই এত বড় হয়ে গেছিস! একদম ভদ্রমহিলা! বাব্বাঃ। কবে এসেছিস?’

এতগুলো প্রশ্ন এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হওয়ামাত্র বুকের সমস্ত হিম উধাও হয়ে গেল। জবাবে শুধু হাসতে পারল দীপাবলী। খোকনকে এখন সত্যি চেনা যায় না। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লম্বা পুরুষালি চেহারা কিন্তু অভাবের ছাপ আছে। শার্ট প্যান্টেও সেটা স্পষ্ট। এই খোকন তার বাল্যকালের বন্ধুর চেহারা বহন করছে না। পূর্ণিমার রাত্রে যখন বাতাবির রস ঘন হয় তখন এই খোকনের ঠাকুমা আকাশ থেকে নেমে বাতাবির ডালে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে প্রথম ফলের রস চুষে নিশ্চয়ই খেতেন না।

‘কী রে? কথা কানে যাচ্ছে? হাঁ করে কী দেখছিস?’ খোকন ধমকে উঠল।

‘তোকে? তুই কীরকম হয়ে গেছিস!’ দীপাবলী জবাব দিল।

‘মানে? আমি ড্রাইভারি করি, ড্রাইভারদের চেহারা যেমন হয় তেমন হয়েছি। তুই শিক্ষিতা ভদ্রমহিলা, বড় চাকরি করিস বলে শুনেছি, তোর কথা আলাদা!’

‘একদম বাজে বকবি না।’ দীপাবলীর রাগ এল।

‘ওঃ, তোকে দেখে কী ভাল লাগছে ভাবতে পারছি না। কবে এসেছিস?’

‘গতকাল।’

‘থাকবি তো কিছুদিন?’

‘না রে। আজই চলে যেতে হবে।’

‘সে কী? কেন?’

হঠাৎ খুব খারাপ লাগল। এতক্ষণ নিজেকে বাইরের লোক বলে মনে হচ্ছিল। কেউ তাকে চেনে না বলে একটা কষ্ট ছোবল মারছিল। খোকন আসামাত্র তার জায়গায় অন্য কষ্ট এল। একটা দিন থাকতে পারলে ভাল লাগত। এখন পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ, যাদের সঙ্গে যৌবনের শুরু থেকে আলাপ হচ্ছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হয় অনেক মেপে, ভেবে। একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যেমন যাওয়া যায় না তেমনি সেই সীমার এপারে তাদের আসতে না দেওয়ার চেষ্টাও করতে হয়। এরা কেউ অসীম, কেউ শমিত, কেউ অলোক, আবার কেউ অর্জুন নায়েক। কিন্তু বাল্য বয়সের বন্ধু খোকনদের সঙ্গে কথা বলতে সেই সচেতন বোধ মোটেই কাজ করে না। খোকন এখন যেভাবে কথা বলছে পরে আলাপ হওয়া কোনও পুরুষ সেইভাবে কথা কখনই বলতে পারবে না। দীপাবলী জবাব দিল, ‘কাজ আছে রে!’

‘তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

‘এমনি। এসব জায়গা দেখছিলাম। ছেলেবেলার কথা মনে হতেই চলে এলাম। খোকন, তোর মনে আছে, ওইখান দিয়ে জঙ্গলের পাশের নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে আমরা হাতির তাড়া খেয়েছিলাম?’

খোকনের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘ও হ্যাঁ। তারপর সেই শ্যামলদার কেসটা?’ বলে হাসল, ‘শ্যামলদাটা মাইরি একদম বুড়ো হয়ে গিয়েছে। চিনতে পারবি না।’

‘আচ্ছা, তোর মনে হয় ওসব কথা, যখন এখান দিয়ে যাস?’

‘দুর, অনেকদিন পরে এসেছিস বলে আজ তোর মনে হচ্ছে। রোজ যদি দেখতে হত তা হলে মাথায় এসব ভাবনা আসতই না। বিয়ে করেছিস?’

‘করলে দেখে বুঝতে পারতিস না?’

‘মর্ডান মেয়েদের বোঝা যায় না।’

‘মর্ডান মেয়ে বলতে কী বুঝিস? সবাই সমান। ওইসব ব্যাপারে। তুই?’

‘হুম।’

‘আচ্ছা! কবে? তোর বউ কোথায়?’ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল দীপাবলী।

আর তখনই গাড়ির হর্ন বাজল। যাকে গাড়িতে বসিয়ে খোকন নেমে এসেছিল সে বোধহয় আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। খোকন গাড়ির দিকে তাকাল, ‘ভাড়া দেবে কম আবার হর্ন বাজাচ্ছে! তুই কোনদিকে যাবি? তোর মা-রা তো কলোনিতে থাকে।’

‘ওখানেই যাব।’

‘চল। লোকটাকে নামিয়ে দিয়ে তোর সঙ্গে গ্যাঁজাব।’

‘তুই কোত্থেকে আসছিস?’

‘জলপাইগুড়ি। কাল রাত্রে একটা হসপিটাল কেস নিয়ে গিয়েছিলাম ফেরার সময় একে পেয়ে গেলাম। আয়।’

হাঁটতে হাঁটতে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘রাত্রে ঘুমোসনি?’

‘না। অভ্যেস আছে। গাড়িতে স্পিড় তুলে একটু একটু ঘুমিয়ে নিই।’

‘তোর বউ কোথাকার মেয়ে?’

‘এখানকার। তুই চিনিস না। সত্যবতীর বাবা অনেক পরে এসেছে।’

‘সত্যবতী!’

‘আর বলিস না। ছোট করে ডাকলে মনে হয় ব্যাটাছেলেকে ডাকছি।’ খোকন ড্রাইভারের এপাশের দরজা খুলে দীপাবলীকে উঠতে বলে পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সরি স্যার। অনেক দিনের পুরনো বন্ধুকে দেখতে পেয়ে একটু—।’

দীপাবলী ফ্রন্ট সিটে বসে আয়নায় দেখল মাঝবয়সি লোকটা কঠিন মুখে তাকিয়ে আছে। সে নিজে ট্যাক্সি ভাড়া করে এলে ড্রাইভার যদি মাঝরাস্তায় বসিয়ে রেখে গল্প করত তা হলে কি একই প্রতিক্রিয়া হত? হয়তো।

গাড়ি চালু করে খোকন বলল, ‘এখন বাগানের বেশিরভাগ লোককে তুই চিনতে পারবি না। আমি

তো আর ওদিকে পা বাড়াই না।’

‘তুই আছিস কোথায়?’

‘ওই তো, শ্মশানের পাশে বাবা জমি কিনেছিল, সেখানেই বাড়ি করেছি একটা। বাবা মারা গিয়েছে, মা আছে এখনও। শালা বউয়ের সঙ্গে রোজ টিকটিকানি চলছে।’

গাড়ি আংরাভাসার পুল পেরিয়ে বাজারের ভেতর ঢুকে পড়ল৷ এখন রাস্তায় কিছু লোকজন। দোকানপাট খোলার তোড়জোড় চলছে। চৌমাথা পেরিয়ে পি ডবলু ডি অফিসের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গাড়ি থামাল খোকন। ভদ্রলোক নেমে ভাড়া দিলেন। তারপর একটু ইতস্তত করেই এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এক্সকিউজ মি, আমার মনে হচ্ছে আপনাকে আমি দেখেছি। আপনি কি, আপনি কি মিসেস ব্যানার্জি?’

খোকন আগ বাড়িয়ে জবাব দিল, ‘না না। ও হল দীপা, আমরা একসঙ্গে থাকতাম চা-বাগানে। সেই ছেলেবেলা থেকেই থাকতাম।’

দীপাবলীর ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল। খোকনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মনের সব রশি আলগা হয়ে গিয়েছিল, প্রশ্নটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে টানটান। এই লোকটি তাকে অবশ্যই চেনে। চা-বাগানে আজ পর্যন্ত কেউই তাকে মিসেস ব্যানার্জি বলে ডাকেনি। খুব বেসুরো লাগল ডাকটা, অন্তত এখানে।

সে খোকনকে বলল, ‘তুই থাম। হ্যাঁ, আমার নাম দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়।’

সঙ্গে সঙ্গে লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘ঠিক ধরেছি। কিন্তু কিছুতেই আমি মেলাতে পারছিলাম আমি মদনগোপাল দত্ত। এখানকার সাব ডিভিশনাল অফিসার। কাল ডি এম-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। জিপ খারাপ হয়ে গেল। যাক গে। আসুন আসুন, আমার বাড়িতে একটু চা খেয়ে তবে যাবেন।’

গাড়ি থেকে না নেমে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ’আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?’

‘আমি এককালে বীরভূম পুরুলিয়ায় পোস্টেড ছিলাম। ওই যেবার মন্ত্রী এসে ডি এম-এর বাংলোয় মিটিং করেন তাতে আমিও ছিলাম যে। ওঃ, আপনি যেভাবে মন্ত্রীকে আমেন্ট করে কনভিন্স করলেন তা আমার এখনও মনে আছে। আমাকে আপনার চেনার কোনও কারণ নেই। কিন্তু সেদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। এই চা-বাগানের মধ্যে আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর এর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে শুনে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। হেঁ হেঁ, বুঝতেই পারছেন।’

দীপাবলী শান্ত গলায় বলল, ‘লোকে যে-পোশাকে অফিসে যায় আর যে-পোশাকে রাত্রে নিজের বিছানায় শোয় তা নিশ্চয়ই এক হতে পারে না। কিন্তু আমি তো এখন আপনার বাড়িতে গিয়ে চা খেতে পারব না। অনেকদিন বাদে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে, ওর বাড়িতেই যেতে হবে। কারণ আজই আমি ফিরে যাচ্ছি।’

‘আচ্ছা, কানাঘুষোয় শুনেছিলাম আপনি নাকি রিজাইন করেছেন। আমি তখন এদিকে চলে এসেছিলাম বলে ব্যাপারটা ঠিক জানি না।’

‘হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন।’ বলে দীপাবলী খোকনকে ডাকল, ‘চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

গাড়ি গেটের বাইরে এলে খোকন বলল, ‘আই বাপ, লোকটা তোকে কীরকম খাতির করছিল রে, আর তুই ওকে পাত্তাই দিলি না।’

‘ওঁর সঙ্গে কথা বলার জন্যে আমি এখানে আসিনি।’

‘তুই সরকারি চাকরি করতিস, না?’

‘হুঁ’

‘রিজাইন দিলি কেন? কত খাতির, কত পাওয়ার!’

দীপাবলী প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল, ‘তোর বাড়িতে চল।’

‘আমার বাড়িতে? সত্যি বলছিস?’

‘নিয়ে যেতে অসুবিধে আছে?’

‘দুর! তুই আমাদের ঘরের লোক, তোকে নিয়ে যেতে অসুবিধে হবে কেন?’ চৌমাথা থেকে শ্মশানের দিকে গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে খোকন বলল, ‘মা তোকে দেখে চমকে যাবে। দেখিস তোর কাছে আমার নামে হেভি লাগাবে।’

‘লাগাবে কেন?’

‘বউটাকে শাসন করি না বলে।’

‘বউকে বুঝিয়ে বলিস না কেন?’

‘মেয়েছেলেকে বোঝানোনা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।’

‘ছোটলোকের মতো কথা বলিস না।’

‘ড্রাইভার তো ছোটলোকই।’

‘ড্রাইভারি করিস, কিন্তু তুই খোকন। আমাদের বন্ধু।’

‘বুঝলাম।’ খোকন হাসল, ‘তুই মাইরি একই রকম থেকে গেলি।’

‘মানে?’

‘আমাদের অন্য বন্ধুরা দেখা হলে দুটোর বেশি তিনটে কথা বলে না। আমি ড্রাইভার ক্লাসের লোক, কথা বললে প্রেস্টিজ যাবে। এখন কেউ আমাকে বন্ধু বলে না। যারা বলে তারা এই লাইনের লোক, মালফাল খায়। তোকে একটু ছোঁব?

‘মানে?’

‘আগে ছুঁতে দে।’ হাত বাড়াল খোকন। দীপাবলীর খুব মজা লাগছিল। সে খপ করে সেই হাত ধরল।

দীপাবলী হাসল, ‘ছুঁলি কেন?’

‘দোস্তিটা যাতে বহুত দিন টিকে থাকে।’

শ্মশানের পর থেকে আর এক নতুন জনপদ গড়ে উঠেছে আসাম রোডকে মাঝখানে রেখে। বেশ কিছুটা জমির ওপর পাকা একতলা বাড়ি। যদিও তাদের ছিরিছাদ খুবই সাধারণ তবু এলাকাটা যে বাড়ছে তার প্রমাণ। খোকনদের বাড়ির চারপাশে কোনও বেড়া নেই। একেবারে সিঁড়ির গায়ে দাঁড় করিয়ে সে গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করল, ‘মা, কে এসেছে দ্যাখো!’

কোনও সাড়া এল না ভেতর থেকে। খোকন ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর দীপাবলী গাড়ি থেকে নামল। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করল সে। এখন বেশ সকাল। হুট করে চলে আসা হয়তো ঠিক হয়নি। ভিতরে খোকনের গলা পাওয়া যাচ্ছে। এইসময় এক মহিলাকে দেখা গেল। খুবই আটপৌরে পোশাকে এবং সেগুলো বেশ ময়লাটে। মুখ চোখ মোটেই সুন্দর নয়। খোকন বেরিয়ে এল ভেতর থেকে, ‘আয় রে। এই হল আমার বউ।’

দীপাবলী নমস্কার করল, ‘খুব অসময়ে এসে বিরক্ত করলাম, না?’

মহিলা ঠোঁট টিপে না বললেন মাথা নেড়ে। খোকন বলল, ‘আমার বউকে কেমন দেখছিস?’

হঠাৎ মহিলা গলা তুললেন, ‘কেমন দেখবে? যেমন রেখেছ তেমন দেখবে।’

‘মুখ শুনলি? একেবারে মা মনসা। ভেতরে আয়।’

দীপাবলী খোকনকে অনুসরণ করে বলল, ‘কী যা তা বলছিস!’

জবাবে হো হো করে হাসল খোকন। যে-ঘরে দীপাবলী বসল তাতে অযত্ন স্পষ্ট। বেতের চেয়ার এখানে বেশ সস্তা। খোকন বলল, ‘কোনওমতে আছি বুঝলি। এখন লাইনে হেভি কম্পিটিশন, ননবেঙ্গলিরা এসে গিয়েছে।’

দীপাবলীর এই কথাগুলো খোকনের মুখে শুনতে ভাল লাগছিল না। সে প্রসঙ্গ ঘোরাতে যাচ্ছিল এমন সময় খোকনের মা দরজায় এলেন, ‘ওমা, দীপা, তুই?’

‘চলে এলাম। আপনি কেমন আছেন?’

‘ভাল নয়। অম্বলে অম্বলে শরীর শেষ হয়ে গেল। তোর কাকাবাবু নেই, জানিস তো। সে গেল আর আমার কপাল পুড়ল।’ নিশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা।

‘মা!’ খোকন চাপা গলায় বলল।

‘আহা, দীপা তো বাইরের লোক নয়। ওকে তো জন্ম থেকে দেখেছি।’

‘জন্ম থেকে দ্যাখেননি। আমার জন্ম হয়েছিল মালবাজারে।’

‘ও তাই তো! তবে অঞ্জলি তোকে বুকে করে মানুষ করেছে তো। সেই মা ঠাকুমাকে ফেলে রেখে তুই কলকাতায় কী করে বেড়াচ্ছিস রে?’

‘কী করছি?’

‘আর তোকেই বা কী বলব? আমার ঘরে যিনি এসেছেন তার স্বরূপই বা কী! তোর চেহারা কিন্তু বেশ ভাল হয়েছে। কলকাতার মেয়েদের মতন।’ খোকনের মা কথা শেষ করামাত্র চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল বউটি।

খোকনের মা তাকে বললেন, তুমি একে চিনবে না। তোমার বর আর এ একসঙ্গে বড় হয়েছে। অনেক লেখাপড়া শিখেছে। চোখের ওপর দেখলাম সব। বাপ মা জোর করে বিয়ে দিল, বিধবা হল, ঠাকুমার সঙ্গে ঠিক বিধবার মতো থাকত।’

‘আপনি বিধবা?’ বউটি চমকে উঠল।

চায়ের কাপ ধরেছিল দীপাবলী, শক্ত হয়ে গেল। খোকনের মা বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই আর বিয়ে করল না। এটা বাপু প্রশংসা করতেই হবে।

খোকন বলল, ‘তোমরা অন্য কোনও বিষয় পাচ্ছ না কথা বলার?’

‘বাঃ, অন্যায় কী বলেছি? হ্যাঁরে দীপাবলী?’

‘অন্যায় কিনা জানি না, তবে ভুল বলেছেন অর্ধেক। আমার মনে হয় বিয়ের বয়স এখনও যায়নি আর বিয়ে করব না এমন প্রতিজ্ঞাও আমি করিনি।’

বউটি বলল, ‘ঠিক তো। তা ছাড়া বিধবারা আজকাল বিয়ে করে।’

দীপাবলী মাথা নাড়ল, ‘আমি নিজেকে বিধবা বলে মনে করি না। কিছুদিন বাধ্য হয়ে ঠাকুমার জন্যে নিয়ম মানতাম, পরে বাবা বেঁচে থাকতেই আর মানিনি। যে-লোকটাকে স্বামী বলেই মনে হয়নি সে মারা গেলে আমি বিধবা হব কেন?’

‘তুই তো শুনেছি তাদের টাকায় বড়লোক হয়েছিস।’ খোকনের মা বললেন।

‘ভুল শুনেছেন। খোকন, চলি রে, আমাকে আজই কলকাতায় ফিরতে হবে।’

বউটি জিজ্ঞাসা করল, ‘আজই ফিরে যাবেন?’

‘হ্যাঁ ভাই। কলকাতা থেকে যেতে হবে দিল্লি। আমি একটা সরকারি চাকরি পেয়েছি। খুব ভাল লাগল তোমার সঙ্গে আলাপ করে।’

‘তুই চা খেলি না?’ খোকন জিজ্ঞাসা করল। বউটি বলল, ‘না, চা না খেলে যেতে দেব না। আপনাকে আজ প্রথম দেখলাম।’

নিতান্ত অনিচ্ছায় চা খেতে হল। খোকনের মায়ের কথা শুনে মন তেতো হয়ে গিয়েছিল। বিস্বাদ লাগল। খানিকটা রেখে দিল সে কাপে। তারপর বেরিয়ে এল বাইরে। খোকন এগিয়ে যাচ্ছিল গাড়ির দিকে। দীপাবলী তাকে বলল, ‘তুই কাল থেকে বাইরে আছিস। বাড়িতে থাক এখন, আমি এটুকু পথ হেঁটে যেতে পারব।’

‘খুব খচেছিস না? ওঠ!’

দীপাবলীর পাশাপাশি বউটি হাঁটছিল। তার কাঁধে হাত রেখে দীপাবলী বলল, ‘তোমার জন্যে আমার খারাপ লাগছে। এই সংসারে যখন এসে পড়েছ তখন মেনে নিতেই হবে। বয়স হয়েছে এটুকু ভেবেই মেনে নাও।’

‘মানতে আমার আপত্তি নেই দিদি। শুধু ও যদি আমাকে বুঝত! মাঝে মাঝে মায়ের পক্ষ নিয়ে অন্যায় তর্ক করে।’ বউটি মুখ নামাল।

গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে দীপাবলী দেখল বউটি একা দাঁড়িয়ে আছে, খোকনের মা বাইরে আসেননি। সে খোকনকে জিজ্ঞাসা করল, এরকম করিস কেন?’

স্টিয়ারিং-এ আঙুলের বোল তুলল খোকন, ‘না করলে পাবলিক বলবে আমি মাকে কষ্ট দিচ্ছি। অমানুষ!’

‘মাকে বোঝা। কথা বলার ধরন পালটাতে বল।’

খোকনের গলা নীচে নামল, ‘দীপা, তুই আমাকে ক্ষমা কর?’

চমকে তাকাল দীপাবলী ‘মানে?’

‘মায়ের কথা মনে রাখিস না।’

দীপাবলী কোনও কথা বলল না। একেবারে বাড়ির দরজায় গাড়ি নিয়ে এল খোকন। এবং মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘তুই সব জানিস তো?’

‘কী ব্যাপারে?’

‘তোর ছোট ভাইয়ের ব্যাপারে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি একদিন বলতে গিয়েছিলাম, আমাকেই অপমান করল।’

‘আর বলিস না।’ দীপাবলী গাড়ি থেকে নামতে নামতে দেখল অঞ্জলি দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে। খোকন তাকে দেখে হাত নাড়ল, ‘কেমন আছেন?’

‘ভাল। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল?’

‘হ্যাঁ। ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। চলি রে।’

‘আচ্ছা।’

‘আবার কবে আসবি?’

‘জানি না।’

‘তুই না এলে তো দেখা হবে না। আর আমার যা লাইন, কবে শুনবি আসাম রোডে ট্রাকের সঙ্গে

ভিড়িয়ে দিয়ে আমি ফোটো হয়ে গিয়েছি।’

‘তুই যাবি?’ দীপাবলী গলা তুলল।

খোকন হাসল, ‘যাচ্ছি। তুই কখন শিলিগুড়িতে যাবি?’

‘শিলিগুড়ি না। জলপাইগুড়ি থেকে থ্রু কোচে উঠব। একটার সময় বেরুলেই হবে।’

‘তা হলে তখন এসে তোকে বাস ধরিয়ে দেব। কবে দেখা হবে বললি না যখন তখন আমাকে আসতেই হচ্ছে।’ খোকন চলে গেল।

বড় ভাই বাড়িতে নেই। তার চা-বাগানে ডিউটি শুরু হয়ে গিয়েছে। ছোট ভাই ঘুমুচ্ছে। দীপাবলী আব অঞ্জলি ভেতরের উঠোনে এল। অঞ্জলি বলল, ‘তুই চায়ের সঙ্গে কী খাবি?’

‘কিছু না মা। তোমাদের খবর বলো।’

‘এই তো। বড় চাকরি পাওয়ায় বেঁচে গিয়েছি। তুই টাকা পাঠাতিস বলে সেইসময় সামলে নিয়েছি। কিন্তু ছোটটা নষ্ট হয়ে গেল। রোজ মদ খেয়ে ফেরে। শুনেছিস নিশ্চয়ই, ঠাকুমা বলেনি?’

‘নিজের কানে ওর চিৎকার শুনেছি।’

‘আমার কপাল।’

‘মা, আমি এখন ট্রেনিং-এ কলকাতার বাইরে যাব। ফিরে এসে সেটল্‌ড হলে ঠাকুমাকে আমার কাছে নিয়ে যেতে চাই।’

অঞ্জলি বড় বড় চোখে তাকাল। তারপর মুখে একটিও শব্দ উচ্চারণ না করে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। দীপাবলী সেটা লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘মন থেকে বলছ?’

‘হ্যাঁ। তোর বাবা বেঁচে থাকলেও তাই চাইতেন। ছেলেদের কাছে ওঁকে রাখতেন না।’

‘মা!’

অঞ্জলি হঠাৎ ঠোঁট আঁচলে টিপে ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে। দীপাবলী অবাক হয়ে গেল। যে অঞ্জলি নিজের গর্ভজাত সন্তানদের জন্যে স্বার্থ নিয়ে কী মারাত্মক বাড়াবাড়ি করেছিল একসময়, তার মুখ থেকে এ কী কথা উচ্চারিত হল? তার খুব ইচ্ছে করছিল অঞ্জলিকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু সে পারল এই মুহূর্তে।

ছোট ভাইয়ের দর্শন পেল না দীপাবলী। ঘুম থেকে উঠেই সে কাউকে কিছু না বলে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। দিদির আসার খবর বোধহয় রাত্রেই পেয়েছিল। তবু এ নিয়ে অঞ্জলির আফশোস। একদম খালিপেটে বেরিয়ে গেছে, তার ওপর ওসব খাবে। দুপুরে বড় ভাই এল। বাবার চেহারা পেয়েছে। গম্ভীর গলায় কুশল জিজ্ঞাসা করল এমনভাবে যেন বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলছে। দীপাবলী সেই দূরত্বই রাখল। দীপাবলীর মনে পড়ছিল, এই ছেলে যেদিন অমরনাথ অসুস্থ হয়েছিলেন সেইদিন তাঁর সামনে তাকে অসুস্থতার জন্যে দায়ী করেছিল।

একজন বৃদ্ধা তাঁর প্রৌঢ়া বউমাকে পাশে নিয়ে অত্যন্ত যত্ন করে খাওয়ালেন তাকে। ডাল ভাজা তরকারি বেঁধেছেন মনোরমা, মাছ অঞ্জলি। খাওয়াদাওয়ার পরেই খোকন গাড়ি নিয়ে হাজির। বেরুবার সময় অঞ্জলি কাঁদল, মনোরমা চুপচাপ। দীপাবলী তাঁকে জড়িয়ে ধরে নিচু গলায় বলল, ‘আর ক’টা দিন অপেক্ষা করো।’

গাড়িতে উঠে সে দেখল খোকনের মুখ গম্ভীর। কোনও কথা না বলে গাড়ি চালাচ্ছে। দীপাবলী চোখ বন্ধ করল। প্রতিটি মানুষের মনে নিজস্ব অশান্তি আছে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদা অভাববোধ এবং তা থেকে জাত দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকে। জীবন তাদের যতই শিক্ষা দিক তাদের মন তা মানতে চায় না। সে মনে করে কেউ তার সমস্যা বুঝতে পারবে না, তার মতো অশান্তিতে কেউ নেই। এই যে নিজেকে আলাদা করে ভাবার চেষ্টা এটা তাকে এক ধরনের সুখ দেয়। অথচ পৃথিবীর মানুষেরা কেউ তার নিজের জায়গায় সুখী নয়। খোকনের গলা কানে এল, ‘তোর বাস আসছে একটা। এটা ধরবি না পরেরটায় যাবি?’

দীপাবলী সোজা হল, ‘এটাই ধরব। গাড়ি থামা।’

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন