২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে

সমরেশ মজুমদার

তিনটে বাজতে-না-বাজতেই শুভ্রাদের বাড়ির সামনে গাড়ির ভিড় জমতে শুরু করল। এখন আসছেন মেয়েরা। অলোকের বন্ধুদের শুধু স্ত্রীরাই নয়, তাঁদের বয়স্কা আত্মীয়রাও বাদ যাচ্ছেন না। হইচই হাসিতে জমজমাট বাড়ি। এইসব মহিলারা অবশ্যই সবাই সুন্দরী নন কিন্তু আজ সুন্দর হবার চেষ্টা করেছেন। একজন তো বলেই বসলেন, ‘কিছু মনে করবেন না ভাই, আপনার পছন্দসই মানুষটি বড় একরোখা। এত করে বললাম, একটু রাত্রের দিকে বিয়ের ব্যবস্থা করো আমরা দারুণ শাড়িটাড়ি পড়তে পারি, মেকআপ নিতে পারি, কিছুতেই শুনল না। বলল, ‘গোধূলি লগ্নেই সই করব, তারপর নাকি পঞ্জিকাতে বিবাহ নিষিদ্ধ।’

মোটাসোটা একজন বললেন, ‘যা বলেছ। এই দিনদুপুরে রাত্রের শাড়ি পরা যায়? আমি বলেছিলাম, অন্ধকার নামলে বিয়েবাড়িতে যাব। তা এমন করে বলল যে এখন না এসে পারলাম না।’

শুভ্রা হাসল, ‘তুমি না এলে কনেকে সাজাবে কে?’

প্রথম মহিলাটি বললেন, ‘তোমার এই শাড়ি দিনরাত দুটোতেই কভার করবে। আমারটা দ্যাখো, কীরকম ক্যাটক্যাট করছে।’

মোটা মহিলা বললেন, ‘একটা হালকা কিছু পরলে পারতে।’

‘তা হলে তো সাদা পরে আসতে হয় বিয়েবাড়িতে।’

সঙ্গে সঙ্গে হাসির ঝড় উঠল। সেটা থামলে শুভ্রা বলল, ‘তোমরা এমন করে কথা বলছ যেন সঙ্গে কেউ শাড়ি আনোনি! গাড়িতে দেখব?’

প্রথম মহিলা বলল, ‘আহা, আনিনি কখন বললাম? কিন্তু পরার ঝামেলা তো করতে হবে। এমন পেতনির মতো বিয়েবাড়িতে যাব নাকি?’

মোটাসোটা ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি কিন্তু আনিনি শুভ্রা।’

‘তোমার কথা আলাদা নীহারদি।’

অন্যসময় কী মনে হত সেটা আলাদা কথা, এখন দীপাবলীর বেশ মজা লাগছিল। কয়েকজন শিক্ষিতা ভদ্রমহিলা শুধু শাড়ির রঙের সমস্যা নিয়ে কথা বলে। যাচ্ছেন, কেউ যদি এতে ভ্রূ তোলেন তা হলে দীপাবলী এই মুহূর্তে তাদের দলে যাবে না। তার মনে হচ্ছিল এটাই স্বাভাবিক, উৎসবের আমেজ আনছে।

দীপাবলী কথা বলছিল কম, প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছিল মাঝে মাঝে। এঁরা সবাই জানেন সে আয়কর অফিসারের পোস্টে যোগ দিচ্ছে। নীহারদি বলেই ফেললেন, ‘আমি তখন থেকে ভাবছি কী করে কাজ করবে এই মেয়ে!’

‘কেন?’ প্রশ্ন না করে পারেনি দীপাবলী!

‘দিল্লির রাঘববোয়ালরা মানবেই না। ইনকাম ট্যাক্স অফিসার মানে হয় খুব রাশভারী গম্ভীর নয় খিটখিটে।’ নীহারদি হাসলেন।

শুভ্রা মাথা নেড়েছিল, ‘না নীহারদি, আমার এক বান্ধবীর স্বামী ইনকাম ট্যাক্সে কাজ করতেন। পাঁচজনের সামনে কিছুতেই সেই পরিচয় দিতে চাইতেন না। লোকে সন্দেহের চোখে তাকাত বলে।’

‘সন্দেহের চোখে তাকাত কেন?’ দীপাবলী অবাক।

‘ওই যে, একটা শেয়াল ডেকে উঠলেই জঙ্গলের বাকি শেয়ালরা যেমন গলা মেলায় তেমনি তোমাদের এই ডিপার্টমেন্টের এমন সুনাম যে একজনের জন্যে সবাইকে ঘুষখোর বলে ভাবে সাধারণ মানুষ।’

দীপাবলী গম্ভীর হয়ে গেল, ‘উদাহরণটা ঠিক হল না। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই অনেকেই আছেন। ঘুষ নেওয়া দণ্ডযোগ্য অপরাধ এবং তার জন্যে চাকরি চলে যেতে পারে।’

নীহারদি বললেন, ‘তা হলে কেউ ঘুষ নেয় না ইনকাম ট্যাক্সে?’

দীপাবলী মাথা নাড়ল, ‘আমি জানি না, আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আচ্ছা, আপনারা যে এসব বলছেন, আপনাদের কি অভিজ্ঞতা হয়েছে?’

হঠাৎ প্রশ্নে এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। শেষপর্যন্ত নীহারদি বললেন, ‘আমার হয়েছিল ভাই। কর্তা মারা যাওয়ার পর এস্টেট ডিউটি ক্লিয়ারেন্সের দরকার। ওঁর ব্যাঙ্কের টাকাপয়সা থেকে সবকিছু আমার নামে করতে হবে। হাতে বেশি টাকাও নেই। আমার ছেলেকে নিয়ে কয়েকদিন ঘোরাফেরা করলাম। একজন ল-ইয়ার সবকিছু তৈরি করে দিলেন। কাগজপত্র পেতে আমাকে আড়াইশো টাকা খরচ করতে হয়েছিল। তা না হলে কত দেরি হত বলা যাচ্ছিল না। ওটাই নাকি নিয়ম।’

‘টাকাটা আপনি কাকে দিয়েছিলেন?’ দীপাবলীর খারাপ লাগছিল।

‘আমি নিজের হাতে ওদের কাউকে দিইনি। ল-ইয়ার দিয়েছিলেন।’

‘উনি যে সত্যি দিয়েছিলেন তার প্রমাণ কী?’

‘বাঃ, উনি তা করবেন কেন?’

‘আমি জানি না। কিন্তু এক্ষেত্রেও তো আপনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই।’ শুভ্রা কথা না ঘোরালে এ-আলোচনা কোথায় গিয়ে শেষ হত কেউ জানে না। যে-কোনও আড্ডায় যেমন হয়, শুভ্রা প্রসঙ্গ পালটাতেই আলোচনা অন্য খাতে বইল। কাল পরশু দিল্লিতে নতুন বাংলা নাটক হচ্ছে, তাই নিয়ে কথাবার্তা। মাঝে মাঝেই ফোন আসছিল। কর্তারা ফোন করছেন। একবার অলোকের বাবা শ্ৰীযুক্ত পরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ফোন করে শুভ্রার কাছে জেনে নিলেন দীপাবলী কেমন আছে। দীপাবলীর মন একটু খিঁচিয়ে গিয়েছিল অভিযোগ শোনার পর। কিন্তু সেটুকু কাটিয়ে উঠতে সময় লাগল না। ওর বিস্ময় বাড়ছিল নীহারদিকে দেখে। পঞ্চাশ বছরের মহিলা, বিধবা, স্কুলে পড়ান, একা ছেলেকে নিয়ে দিল্লিতে থাকেন। লক্ষ না করলে বোঝা যাবে না যে উনি বিধবা। মুখ চোখের গড়ন ভাল, এখন মোটা হয়ে গিয়েছেন। বিধবা বলে কোনও সংস্কার নেই। জলপাইগুড়িতে কোনও বিধবাকে বিয়ের কনে সাজাতে ডাকা হত না, কলকাতাতেও সম্ভবত কেউ মনের এই আড় ভাঙতে পারেনি। অথচ দিল্লিতে এটা কোনও সমস্যা নয়। নীহারদিরও কোনও অস্বস্তি নেই। ভাল লাগছিল দীপাবলীর।

চারটে নাগাদ নীহারদি তাকে সাজাতে বসলেন। বসেই বললেন, ‘এখন কিছুক্ষণ নিজেকে আমার হাতে নিঃশর্তে ছেড়ে দিতে হবে। কোনওরকম প্রতিবাদ করা চলবে না। বিয়ের কনেকে বিয়ের কনে হিসেবেই দেখতে চায় সবাই।’

দীপাবলী হাসল, ‘আমাকে তুমি বলুন।’

‘সে তো বলতামই। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বলতাম।’ গম্ভীর মুখে দীপাবলীর মুখ লক্ষ করতে করতে বললেন নীহারদি। ঘরের অনেকেই এই সাজানো দেখছিল। কেউ কেউ উঠে গেছে তৈরি হতে। হঠাৎ নীহারদি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কখনও মেকআপ নাওনি, না?’

‘না। আমার ভাল লাগে না।’

‘বুঝলাম। তবে সামান্য মেকআপ নিলে তোমাকে আরও সুন্দর দেখাবে। আর এই মেকআপ নেওয়া মানে কিন্তু একগাদা রং মাখা নয়।’ নীহারদির হাত কাজ শুরু করল। দীপাবলী চোখ বন্ধ করল। যার প্রতি দিন কাটত বেঁচে থাকার জন্যে যুদ্ধ করে তার এসবে মন দেবার সময় কোথায় ছিল? আর সুন্দর? কার জন্যে সে সুন্দর হবে? কাকে দেখাবে নিজেকে? নীহারদির হাতের সঙ্গে মুখ চলছিল সমানে। বোঝা গেল তিনি কসমেটিকোলজি নিয়ে কিছু পড়াশুনা করেছেন। বসে থাকতে থাকতে একসময় পায়ে ঝিঁ ঝি ধরল, ঘাড় শক্ত। ভদ্রমহিলা কেন চেয়ারে তাকে বসালেন না সে বুঝতে পারছিল না।

কাজ শেষ করে নীহারদি বললেন, ‘শুভ্রা, কনে কোন শাড়ি পরবে নিয়ে এসো?’

শুভ্রা গোটা আটেক শাড়ি নিয়ে এল। নীহারদি পছন্দ করলেন একটা, ‘তুমি জানো কি তোমার চামড়ার সঙ্গে এই রংটা দারুণ যাবে?’

‘এ নিয়ে কখনও ভাবিনি।’দীপাবলী হাসল।

আয়নার সামনে দাঁড়ানোমাত্র অবাক হয়ে গেল সে। নিজেকে চিনতেই যেন অসুবিধে হচ্ছিল। নীহারদির হাতের ছোঁওয়ায় তার এমন রূপান্তর হবে কল্পনাও করতে পারেনি। নিজের দিকে তাকিয়ে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। নীহারদি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, হেসে বললেন, ‘কী, ভাল লাগছে তো? সবসময় কি অন্যের জন্য সাজতে হয়? নিজের জন্যেও তো সুন্দর হয়ে থাকতে ভাল লাগে, লাগে না?’

শুভ্রা বলল, ‘চান্স পেলে নীহারদি ছাড়বে না। দীপাবলী কত শিক্ষিত মেয়ে, বড় চাকরি করছে, আর এই সামান্য কথাটুকু জানে না ভেবেছ!’

কিন্তু এখন এই মুহূর্তে দীপাবলীর মনে হল সে নিজের জন্যে সাজার কথা জানত না। নিজের মনের জন্যেও যে ভাল লাগা তৈরি করতে হয় এটা কখনওই মাথায় আসেনি। সে মুখে কিছু বলল না।

যত সময় যাচ্ছে, যত সাজগোজ পূর্ণতা পাচ্ছে, তত শরীর আড়ষ্ট হচ্ছে, ভার বাড়ছে। সেইসঙ্গে একধরনের নার্ভাসনেস। আর অবধারিতভাবে তুলনা চলে আসছে। অনেক অনেক বছর আগে এক সন্ধ্যায় তাকে জবুথবু সাজ পরানো হয়েছিল। সেদিন শুধু তীব্র অনিচ্ছা আর ভয় ছাড়া অন্য কোনও অনুভূতি সক্রিয় ছিল না। দীপাবলী নিশ্বাস ফেলল।

ঠিক পাঁচটার সময়, মেয়েরা যখন বলাবলি করছে মুকুট পরানো উচিত ছিল কিনা, সেইসময় এই ফ্ল্যাটের সদর বেল বাজল। কাজের লোক এসে শুভ্রাকে জানাল একজন দেখা করতে এসেছে। শুভ্রা উঠল। ঘর-ভরতি মেয়েরা, সেন্টের গন্ধ, দামি শাড়ির খসখস আওয়াজ আর অনর্গল কথার মধ্যে চুপচাপ বসে ছিল দীপাবলী। বাইরের ঘর থেকে ফিরে শুভ্রা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘সেই ভদ্রলোক এসেছেন। শমিতবাবু। ও-ঘরে যাবেন না ওঁকে এখানে আসতে বলব?’

দীপাবলী সোজা হয়ে বসল। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘আমি যাচ্ছি।’

যেন ইতিমধ্যে বিয়ের কনে মেয়েদের সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল, তার উঠে যাওয়ায় সকলে কৌতূহলী। শুভ্রা তাঁদের বলল, ‘ওঁর পক্ষের একজন এসেছেন দেখা করতে।’

কোনও বিশদ ব্যাখ্যা নেই কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে মনে হল। এইসময় এ-পক্ষ এবং ও-পক্ষ তো হবেই। দীপাবলী ধীরে ধীরে বাইরে ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই শমিতকে দেখতে পেল। সেই শমিত, সেইরকমই। পাজামা পাঞ্জাবি এবং একটা হালকা জহরকোট। দেখামাত্র স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠল সে, ‘আরে! কী ব্যাপার? এত সেজেছ কেন? ব্যাপারটা কী বলো তো?’

দীপাবলী কথা খুঁজে পেল, ‘কেন, খারাপ লাগছে?’

‘মোটেই নয়। দারুণ। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। নাটক করার সময় তুমি যখন মেকআপ নিতে তখন এরকমই মনে হত।’

‘নাটক করার সময়!’ দীপাবলীব ঠোঁট থেকে অসাড়ে বেরিয়ে এল।

‘বাঃ, মায়া অসুস্থ হলে তুমি কয়েকটা শো করে দিয়েছিলে না?’

‘বসুন। আজ তো হাতে কাজ নেই।’

‘না। তবে সন্ধের পরে সবাই বসে বসেই রিহার্স করব ঠিক করেছি।’

‘নিজের লেখা নাটক?’

‘না। চেখভ! আমি আমাদের মতো করে নিয়েছি মাত্র। কিন্তু বাড়িতে তুমি এত সেজেগুজে আছ কেন? কেসটা কী?’

‘আজ আমার বিয়ে!’ শব্দ তিনটি কাটা কাটা উচ্চারণ করল সে।

কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না শমিত। তার চোখ মার্বেলের মতো স্থির। ওই কয়েক সেকেন্ডেই যেন অনেক কিছু খেলা করে গেল মুখের জমিতে। তারপর একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টায় বলল, ‘ভাগ্যবানটি কে?’

‘আমার এক বন্ধু। দিল্লিতেই থাকেন!’

‘এ-বাড়ি—?’

‘ওঁর সূত্রেই আমার বন্ধুদের।’

শমিত ঠোঁট কামড়াল। আর তখনই দীপাবলীর মনে হল পুরুষদের মানসিকতা অনেকটা হিংসুটে শিশুর মতো। তার নিজের যে জিনিস আছে তা অন্যের হাতে দেখলেই নেবার জন্যে হাত বাড়ায়। নিজে বিবাহিত হয়েও শমিত যেমন ওর বিয়ের খবরটা সহজভাবে নিতে পারছে না। অথচ ভান করছে, শিশুর সঙ্গে এটুকুই পার্থক্য।

হঠাৎ শমিত যেন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল ‘খু-উ-ব ভাল খবর। সুদীপের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়েছিল একদিন। শুনেছিলাম তুমি নাকি আই এ এস ট্রেনিং নিতে মুসৌরি গিয়েছ। এইসব ব্যাপার জানতাম না। খুব ভাল লাগছে। তা নেমন্তন্ন খাচ্ছি নিশ্চয়ই?’

প্রশ্নটা কানে যেতেই দীপাবলীর মনের সমস্ত গুমোটভাব কেটে গেল এক মুহূর্তেই। সে হাসল, ‘অবশ্যই। কিন্তু আমি একটা উপকার চেয়েছিলাম।’

‘আমি উপকার করব? কীভাবে?’

‘আমরা সই করে বিয়ে করছি। আপনি আমার পক্ষের সাক্ষী হিসেবে সই করবেন?’

শমিত কাধ নাচাল, ‘আরে এতে আমি তো সম্মানিত বোধ করছি। অনুষ্ঠানটা কখন? এই বাড়িতেই নাকি?’

‘না। একটু বাদেই আমরা সেখানে যাব। আমি খুব খুশি হলাম শমিত। আসলে এঁরা সবাই আমার হিতৈষী, কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল আমি যেন এখানে ভুঁইফোঁড়, আমার আগের চেনা কেউ নেই। আপনি রাজি হয়ে সেই অভাবটা মেটালেন।’

শমিত হাসল, ‘জীবন বড় অদ্ভুত দীপা। নেখালি গ্রামে আমি যা করেছিলাম তা ইচ্ছে করেই করেছিলাম। আঘাত করার নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরেও যে তুমি আমাকে এত বড় একটা কাজের জন্যে ডাকতে পারো—!’ নিশ্বাস ফেলল সে। তারপর বলল, ‘আজ মায়া থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হত।’

মায়ার নাম শমিতের মুখে শোনামাত্র চমকে উঠল দীপাবলী। কাজেকর্মে ডুবে আজকাল মায়ার কথা খুব কমই মনে আসে। শমিত কি এখনও মায়াকে মনে নিয়ে আছে? হ্যাঁ, মায়া নিশ্চয়ই খুশি হত। কিন্তু ওর চেয়ে বেশি খুশি হতেন: অমরনাথ। তালেগোলে যে-বিয়ে তিনি দিয়েছিলেন তার জন্যে আমৃত্যু যন্ত্রণা পেয়ে গিয়েছেন। আজ তিনি থাকলে অবশ্যই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেন। হঠাৎই খেয়াল হল যারা খুশি হতেন ভাবতে গিয়ে কেবলই মৃত মানুষদের কথা মনে পড়ছে। নইলে এইসঙ্গে সত্যসাধন মাস্টারের মুখ মনে পড়বে কেন?

পেছন থেকে শুভ্রার গলা পাওয়া গেল, ‘ওরা ফোন করেছিল। এসে গেল বলে।’

দীপাবলী সংবিতে এল, ‘ইনি শমিত। কলকাতার যে-নাটক কাল থেকে হবে তার পরিচালক অভিনেতা। আর উনি শুভ্রা। এঁদেরই বাড়ি।’

মিনিট তিনেকের মধ্যেই বাইরের ঘর জমজমাট। মেয়েরা অনেকেই চলে এসেছেন। এঁদের অনেকেই শমিতের অভিনয় দেখেছেন ছবিতে। আর শমিত, যে-কোনও চৌকস ছেলের মতো মেয়েদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মারতে শুরু করল। দীপাবলী চলে এল ভেতরের ঘরে। তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। শমিতকে সই করতে বলার পেছনে নিজের কোন মন কাজ করেছে সে তার হদিশ পাচ্ছিল না। সে কি সচেতনভাবে শমিতের মনের ওপর চাপ দিতে চেয়েছে? এইসময় শমিতের খোলা গলার হাসি কানে এল বাইরের ঘর থেকে। আর সঙ্গে সঙ্গে মনের সব জড়তা দূর হয়ে গেল দীপাবলীর।

ঠিক সাড়ে পাঁচটার মধ্যে অলোকের বন্ধুরা, ওর দাদা এসে গেলেন। মেয়েরা কনেকে তৈরি করে উত্তেজনায় ভরপুর। অলোকের দাদা দীপাবলীর সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘ওখানে সবাই অপেক্ষা করছে। বাবা আমাকে পাঠালেন তাঁর ভাবী পুত্রবধূকে নিয়ে যেতে।’

দীপাবলীর চিবুক নামল বুকে। শুভ্রা বলল, ‘দাদা, বড্ড নাটক হয়ে যাচ্ছে। ওই বেচারাকে কেন লজ্জায় ফেলছেন? আপনি ভাশুর না?’

অলোকের দাদার নাম অশোক। হাত নেড়ে বললেন, ‘নো। ওসব ভাশুরটাশুর হওয়া আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমরা দাদা বোন, ঠিক তো?’

দীপাবলী চোখ নামানো অবস্থায় মাথা নাড়ল।

কেউ একজন শাঁখ বাজাল। বাড়ির সামনে দাঁড়ানো গোটা দশেক গাড়ির মধ্যে যেটি ফুল দিয়ে সাজানো সেটিতে উঠল অশোক শুভ্রা নীহারদি দীপাবলীকে নিয়ে। নীহারদি অবশ্য অন্য গাড়িতে উঠতে চাইছিলেন, শুভ্রা ছাড়ল না। দীপাবলীরও ভাল লাগছিল ওঁর পাশে বসতে। মিছিল করে গাড়ি রওনা হল।

ইতিমধ্যে দীপাবলী জেনেছে বিয়ে এবং পার্টির জন্যে নিজেদের এলাকাতেই একটা বড় হল ভাড়া নিয়েছে অলোকরা। প্রথমে সেখানেই যেতে হবে তাদের। পথ অনেকটা কিন্তু সময় লাগল না বেশি। দূর থেকেই সানাইয়ের সুর শোনা গেল। বিয়েবাড়ির সামনে গাড়ির ভিড় জমতে শুরু হয়েছে। অলোকের মা দরজা খুলে দীপাবলীকে নামালেন। চিবুকে আঙুল ছুঁইয়ে আদর করে জড়িয়ে ধরতেই শুভ্রা বলে উঠল, ‘আহা মাসিমা, করছেন কী, সব সাজ নষ্ট হয়ে যাবে!’ ওর বলার ধরনে হাসির তুবড়ি ফাটল। ভদ্রমহিলা লজ্জিত।

হলঘর সুন্দর সাজানো। দীপাবলীকে নিয়ে ঢোকামাত্র উপস্থিত অতিথিরা হাততালি দিতে লাগল। পরেশবাবু এগিয়ে এলেন, ‘মা, ভাল আছ তো?’

দীপাবলী মাথা নাড়ল। এইসময় অলোকের এক বন্ধু ছুটে এল ভিড় সরিয়ে, ‘উঁহুঁ, মেসোমশাই, এখন আপনারা সরে যান, এবার আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। অলোক, অলোক কোথায়? এই অলোক, এগিয়ে আয়?’

দেখা গেল হলের এক কোনায় বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিল অলোক। চিৎকার শুনে বাধ্য হল এগিয়ে আসতে। বন্ধুটি বলল, ‘লগ্ন পার হতে দেরি নেই। যাকে ভালবেসেছিস তার হাত ধরে নিয়ে চল।’

সঙ্গে সঙ্গে শুভ্রা প্রতিবাদ করল, ‘ভালবেসেছিস মানে? ও একা ভালবেসেছে নাকি? দীপাবলীও ভালবেসেছে। ও শুধু কেন হাত ধরে নিয়ে যাবে, মেয়েও ওর হাত ধরে নিয়ে যাবে। একতরফা হবে না।’

বন্ধুটি গলা নামিয়ে বলল, ‘সে তো আপনার বিয়ের পরের দিন থেকে ধরবেন। তবে হাত নয়, নাক ধরে ঘোরাবেন।’ আর এক দফা হাসি উঠতেই পরেশবাবু সরে গেলেন সামনে থেকে। দীপাবলী অলোকের দিকে তাকাতে পারছিল না।

ওদের নিয়ে আসা হল হলের প্রান্তে যেখানে একটি লম্বা টেবিল রঙিন কাপড়ে ঢাকা রয়েছে। কয়েকটা ফুলদানি থেকে ফুল উপচে পড়ছে। সই যিনি করাবেন তিনি হাসিহাসি মুখে বসে আছেন টেবিলের ওপারে। এপারে দুটো চেয়ারে ওদের বসানো হল। ভদ্রলোক কাগজপত্র খাতা খুললেন। ঘড়ি দেখলেন। তারপর বললেন, ‘এবার কাজ আরম্ভ করা যাক। আপনি অলোক মুখোপাধ্যায়, শ্রীমতী দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বেচ্ছায় বিবাহ করতে সম্মত আছেন?’

অলোক প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে একজন পেছন থেকে বলে উঠল, ‘এ কীরকম প্রশ্ন, খেতে যে বসেছে তাকে জিজ্ঞাসা করছেন খাবেন কিনা?’

ভদ্রলোক মাথার ওপর হাত তুললেন, ‘আঃ। আমাকে আমার কাজ করতে দিন। প্লিজ বিরক্ত করবেন না। হ্যাঁ, বলুন।’

অলোক মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’

‘আপনি শ্ৰীমতী দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বেচ্ছায় শ্রীঅলোক মুখোপাধ্যায়কে বিবাহ করতে সম্মত আছেন?’

দীপাবলী ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। কেউ একজন ফোড়ন কাটল, ‘আরে বাবা, আই আর এস মেয়ে, ইন্টারভিউ করে কাত করতে পারবেন না।’

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন এবার। তারপর দীপাবলীর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘বলুন?’ দীপাবলী নিচুস্বরে বলল, ‘হ্যাঁ।’

এবার সই করার পালা। নির্দিষ্ট জায়গায় সই করার সময় শঙ্খ বাজতে লাগল, মেয়েরা উলু দিতে লাগল। মুহূর্তেই পরিবেশটা এমন আনন্দময় হয়ে উঠল যে দীপাবলীর সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত। আইনের কাজ শেষ হওয়ামাত্র শকুন্তলা এগিয়ে এল, ‘ঠাকুরপো, মালাবদল দেখতে চাই।’

অলোক নার্ভাস গলায় বলল, ‘বাকি রাখলে কী?’

সঙ্গে সঙ্গে রব উঠল, মালা বদল হবে, মালা বদল হোক। কেউ একজন সুর করে গেয়ে উঠল, ‘মালা বদল নাকি হৃদয় বদল, বদলে মন কেন যায় গো?’

অতএব নিমন্ত্রিত বন্ধুবান্ধবরা গোল করে ঘিরে ধরল ওদের। শকুন্তলা মালা এগিয়ে দিল, শাঁখ বাজল। ওরা মালাবদল করল। এবং সেটা শেষ হতেই শুভ্রা ধরে নিয়ে এল পরেশবাবু এবং তাঁর স্ত্রীকে ভিড় সরিয়ে, ‘মাসিমা, আশীর্বাদ করুন, বলুন রোজ রাত্রে যেন একবার ঝগড়া করে!’

সকলে হাঁ হাঁ করে উঠল। শুভ্রার স্বামী চাপা গলায় ধমকে উঠল, ‘এই হচ্ছেটা কী? এইসময় এ-কথা বলতে আছে?’

শুভ্রা ভালমানুষের মতো বলল, ‘বাঃ, আমি তো তাই শিখেছি। রোজ রাত্রে আমরা একবার ঝগড়া করি না? তুমি তো বলো ঝগড়া করে মনের কথা বলে ফেললে ভেতরে রাগ আর পোষা থাকে না। সম্পর্ক টিকে থাকে।’

কথা শেষ হওয়ামাত্র হাসির তুবড়ি ফাটল আর একবার।

প্রথমে অলোক পরে দীপাবলী প্রণাম করল। অলোকের মা বউমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘এবার তোমার সাজ নষ্ট হলেও শুনছি না।’ তারপর নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সুখী হও মা। জীবনে সবকিছু মনের মতো মেলে না, মানিয়ে নিতে হয়। মেনে নিলে দেখবে একসময় ঠিক সুখ ফিরে আসবেই।’

পরেশবাবু বললেন, ‘এ একেবারে জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া কথা!’

মাসিমা ধমকে উঠলেন, ‘চুপ করো তো!’

এইসময় রেজিস্ট্রার ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘এখনও কিন্তু বিয়ে কমপ্লিট হয়নি। সাক্ষীদের সই করতে হবে। কারা করবেন?’

অশোক এগিয়ে এল, ‘আমি পাত্রের দাদা, আমি করতে পারি?’

‘আপত্তি নেই। আর একজন?’

এবার শমিতের গলা পাওয়া গেল। সে যে এতক্ষণ এখানে দর্শক ছিল তা টের পাওয়া যায়নি। তার বিশাল শরীর নিয়ে যখন এগিয়ে এল তখন সবাই তাকে দেখতে লাগল। সামনে এসে শমিত হাসল, ‘কোথায় সই করতে হবে?’

‘আপনি?’ রেজিস্ট্রার প্রশ্ন করলেন।

‘আমি পাত্রীর আত্মীয়।’ অম্লানবদনে বলল শমিত।

কথাটা কানে যাওয়ামাত্র অলোক চমকে তাকাল। শমিতকে তার চেনার কথা নয়। সে দীপাবলীকে দেখল। দীপাবলীও বেশ অবাক, আত্মীয় শব্দটি শমিত উচ্চারণ করবে তা কল্পনাই করেনি। আর এতক্ষণ, গাড়ি থেকে নামার পরের সময়টা এমন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল যে তার শমিতের কথা খেয়ালেই ছিল না।

অশোক এবং শমিত নিজের পুরো ঠিকানা দিয়ে সই করল। এইসময় আর একদফা শাঁখ বাজল। দীপাবলী বুঝতে পারছিল অলোকের মনে শমিত সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন জমে গেছে এর মধ্যেই। পাশে দাঁড়ানো শুভ্রাকে সে ফিসফিস করে কিছু বলতেই শুভ্রা ডাকল, ‘এই যে পরিচালক মশাই, কন্যাদান করলেন যার হাতে তার সঙ্গে আলাপ করবেন না? এদিকে আসুন।’

শমিত এগিয়ে এল, ‘ভাগ্যবানদের সঙ্গে সবাই পরিচিত হতে চায়। আমি এতক্ষণ সুযোগ পাচ্ছিলাম না।’

শুভ্রা বলল, ‘ইনি শমিত, বিখ্যাত অভিনেতা পরিচালক, বাংলা ফিল্‌মে অভিনয় করেন, কাল দিল্লিতে নাটক করবেন বলে কলকাতা থেকে এসেছেন। দীপাবলীর খুব ভাল বন্ধু ইনি৷ আর এ হল অলোক!’

শমিত হাসল, ‘অভিনন্দন। আমাকে এমনভাবে খবরটা দেওয়া হয়েছে যে শুধু অভিনন্দন জানানো ছাড়া আর কিছু দেবার মতো তৈরি আমি নই।’

এইসময় মেয়েরা এসে ধরে নিয়ে গেল দীপাবলীকে। তাকে একটি সাজানো কেদারায় বসানো হল। মাথায় ঘোমটা, গলায় মালা, অলোকের মনে হল দীপাবলীকে রাজেন্দ্রাণীর মতো দেখাচ্ছে। নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পালা শুরু হল। ও ব্যাপারটায় উদ্যোগী হয়েছে অনেকেই।

বন্ধুদের সঙ্গে জমে গিয়েছিল অলোক। মাঝে মাঝে তার কর্মক্ষেত্রের কেউ এসে পড়লে তাকে নিয়ে যেতে হচ্ছে দীপাবলীর কাছে। ওপাশে বুফে ডিনার শুরু হয়ে গেছে। কিছু বয়স্ক মানুষ আলোচনা করছেন দিশি ও বিদেশি মেজাজ নিয়ে, এমন বিয়েই এখন বাংলাদেশে হওয়া উচিত। কেউ কেউ অবশ্য মন্তব্য করছেন মন্ত্র না পড়লে বিয়েটাকে ঠিক বিয়ে বলে মনে হয় না। এই নিয়ে তর্ক উঠছে।

অলোক মূল দরজায় দাঁড়িয়ে আপ্যায়ন করছিল। হঠাৎ ভাইঝি এসে বলল, ‘কাকিমা ডাকছে, একবার এসো কাকু।’

‘কাকিমা?’ প্রশ্নটা বের হওয়ামাত্র লজ্জিত হল অলোক। তার বন্ধুরা হেসে উঠল। অতএব অলোককে দীপাবলীর কাছে পৌঁছোতে হল। দীপাবলীর পাশের টেবিল উপঢৌকনে উপচে পড়ছে। শকুন্তলা এবং শুভ্রা সেখানে বসে। শুভ্রা বলল, ‘তুমি তো সবাইকে দেখছ, আসল লোকে খেয়েছে কিনা খবর রেখেছ?’

‘আসল লোক?’

‘শমিতবাবু। তোমাদের বিয়ের সাক্ষী।’

‘ও, হ্যাঁ, উনি কোথায় গেলেন?’ অলোক চারপাশে তাকাল।

এবার দীপাবলী নিচু গলায় বলল, ‘তুমি একটু দ্যাখো!’

অলোক মাথা নাড়ল। তারপর তন্নতন্ন করে বিয়েবাড়ি খুঁজে দেখল। কিন্তু কোথাও শমিত নেই। তার খুব খারাপ লাগছিল। এই লোকটা কোত্থেকে এসে উদয় হয়ে দীপাবলীর আত্মীয় বলে সাক্ষী হিসেবে সই করল, অথচ সে ভদ্রলোকের কথা জানতই না। বরং কোনও আত্মীয় নেই বলেই দীপাবলী তাকে জানিয়েছিল। আর এল যখন তখন এভাবে না বলে চলে গেলই বা কেন? এসব ভাবনার সঙ্গে তার মনে হচ্ছিল লোকটাকে খুঁজে বের না করলে দীপাবলীর কাছে অস্বস্তিতে পড়বে।

এইসময় শুভ্রাকে একা দেখতে পেয়ে সে বলল, ‘শমিতবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না। উনি কোথায় উঠেছেন তা জানো?’

শুভ্রা মাথা নাড়ল। তারপর ঠিকানাটা বলল। অলোক সোজা অশোককে ডেকে বলল, ‘দাদা, দীপার ওই আত্মীয় ভদ্রলোক বোধহয় না খেয়ে চলে গিয়েছেন। ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। তুমি গাড়িটা নিয়ে গিয়ে একটু দেখবে।’

অশোক ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হাজার হোক মেয়েপক্ষের একমাত্র প্রতিনিধি ভদ্রলোক। কিন্তু অশোককে যেতে হল না। দুটো গাড়ি এসে থামল গেটের সামনে। অলোকের বন্ধুদের গাড়ি। তাদের একজন গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘ভাই তোর বিয়ে, একদম নির্জলা থাকতে ইচ্ছে করল না, তাই ক’জন একটু মেরে এলাম।’

অলোক দেখল পেছনের গাড়ি থেকে শমিত নামছে। সে বিরক্ত গলায় বলল, ‘ওই ভদ্রলোককে ধরে নিয়ে গিয়েছিস কেন?’

‘আরে, উনি শিল্পী মানুষ, আলাপ হল, জমে গিয়ে নিয়ে গেলাম। কেউ কিন্তু আউট হইনি। তোর ভয় নেই।’ বন্ধু হাসল।

অলোক শমিতের কাছে এগিয়ে গেল, ‘আপনি না জানিয়ে চলে যাওয়াতে দীপাবলী খুব চিন্তা করছে। আসুন।’

‘ও, তাই নাকি, চলুন, কোথায় ও? ’

পাশাপাশি হাঁটার সময় মদের গন্ধ নাকে এল। যদিও শমিত বেতাল নয়। একেবারে দীপাবলীর সামনে পৌছে শমিত বলল, ‘এসে গেছি। অলোকবাবুর বন্ধুদের ধরে একটা দোকান খুলিয়ে এই বইটি উদ্ধার করেছি।। এটাই আমার তরফে তোমার জন্যে—।’

দীপাবলী হাত বাড়িয়ে বইটি নিল। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বাংলা কবিতা। অলোক খুশি হল, ‘আচ্ছা, আপনি এবার খেতে চলুন।’

‘আমি জাস্ট দুটো মিষ্টি খাব। কারণ গ্রুপের ছেলেদের এসব জানাবার সুযোগ পাইনি। ওরা না খেয়ে আমার জন্যে বসে থাকবে। খাওয়ার জন্যে জোর না করে যদি আপনি আমাকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেন খুশি হব।’

সবকিছু চুকে গেলে, অতিথিরা বিদায় নেবার পরে প্রায় মধ্যরাত্রে ওরা ফিরে এল। অলোকের নিজের ঘরটা সাজানো হয়েছিল আগেই। আপাতত কিছুদিন এখানে থাকবে দু’জনে। নতুন ফ্ল্যাট ঠিকঠাক করে উঠে যাবে। শকুন্তলা ওদের নিয়ে এল ঘরে। বিছানা ফুলে ফুলে ফুলময়।

শকুন্তলা বলল, ‘এবার দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ো। মা বলে দিয়েছেন আর রাত না বাড়াতে।’ তারপর দীপাবলীর হাত ধরে ছেড়ে দিল, ‘মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দি নাইট। আজ তোমাদের ফুলশয্যা। এরপর আমার থাকা ঠিক নয়।’ হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল শকুন্তলা।

দীপাবলী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। অলোক দরজা বন্ধ করল। তারপর হাসিমুখে বলল, ‘জামাকাপড় চেঞ্জ করে নাও। খুব পরিশ্রম গিয়েছে সারাদিন।’

দীপাবলী কিছু বলতে চেয়েও পারল না। অলোক এক পলক তাকাল। তারপর বলল, ‘আজ থেকে আমরা স্বামী এবং স্ত্রী। তুমি খুশি?’

‘হুঁ।’ দীপাবলী মাথা নাড়ল।

‘কিন্তু আজ রাত্রে আমি তোমাকে বিরক্ত করব না, শুধু আজকের রাতটা।’ দীপাবলীর বুকের ভেতরটা টলটলে হয়ে উঠল। কোনওরকমে নিজেকে সামলাল সে। আর এই মুহূর্তে মনে হল অলোক অনেক উঁচু দরের মানুষ। বারো বছরের সেই ফুলশয্যার রাতটার স্মৃতি মুছে দিতে চায় যে তার কাছে কৃতজ্ঞ তো হতেই হয়।

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন