৪. অর্জুন নায়েক

সমরেশ মজুমদার

অর্জুন নায়েক হেসে বলল, ‘খুব অসময়ে এসেছি, না? আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। আপনি যদি এখন কথা বলতে না চান তা হলে আমি চলে যাচ্ছি।’

কথা বলার কোনও আগ্রহ দীপাবলীর ছিল না। যদিও লোকটা খুবই বিনয় নিয়ে কথা বলছে তবু ওর ঠোঁটের কোণের সেই চটচটে হাসিটা দেখতে পাচ্ছিল সে হ্যারিকেনের আলোয়। লোকটা ধান্দাবাজ এবং নিঃসন্দেহে বদ লোক। কিন্তু হঠাৎ দীপাবলীর জেদ চেপে গেল। সে বলল, ‘আপনি বসতে পারেন।’

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ধপাস করে বসে দুটো পা ছড়িয়ে যেন আরাম পেতে চাইল অর্জুন। এবং তারপরেই যেন খেয়াল হল, পা গুটিয়ে বলল, ‘সরি।’

দীপাবলী কথা না বলে উলটো দিকের চেয়ারে বসে বলল, ‘অফিসের পরে যখন এসেছেন তখন নিশ্চয়ই জরুরি কিছু বলার আছে আপনার?’

‘থানার দারোগার সঙ্গে আলাপ হয়েছে আপনার?’

‘হ্যাঁ এস ডি ও-র অফিসে। কেন বলুন তো?’

‘লোকটার চাকরির বারোটা বেজে গেল। মিনিস্টার বললেন, অর্জুন, তুমি খবর পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আর আমারই দারোগা একবার আসার সময় করতে পারল না। ডি এম, এস ডি ও খবর পায় আর সে কোথাকার বাদশা?’

‘আপনি কী বললেন?’

‘আমি পাবলিক। মন্ত্রী সেনাপতিদের যুদ্ধে কথা বলব কেন?’

‘এই খবর শুনে আমি কী করব?’

পকেট থেকে একটা ছোট্ট পেতলের কৌটো বের করে দুই আঙুলের মাঝখানে কিছু গুঁড়ো তুলে মুখে ফেলল অর্জুন, ‘ম্যাডাম, বৃষ্টি হবার আগে পিঁপড়েরা ঠিক টের পেয়ে যায়। আপনার এখান থেকে সার্কিট হাউসে ফিরে যাওয়ার পরেই যারা জানার তারা জেনে গেল মিনিস্টার আপনাকে খুব পছন্দ করেছেন। নইলে তিনি এই রোদে গরমে নেখালির মানুষদের দেখতে আসতেন না। ম্যাডাম, এই দেশে নেখালির মতো হাজার হাজার গ্রাম, লক্ষ লক্ষ মানুষ ধুঁকছে। ক’জন মন্ত্রী ভুল করেও সেখানে পা দিয়েছেন বলুন তো?’

‘আপনি কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।’ খোলা দরজার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল দীপাবলী। তার অস্বস্তি হচ্ছিল।

‘খুব সহজ। এটা আপনার বোঝা উচিত ছিল!’

‘মানে?’

‘ম্যাডাম, মিনিস্টার যতদিন থাকবে, ততদিন আপনার ডিম্যান্ড থাকবে। মানে, যার যা প্রয়োজন মেটাতে আপনাকে এসে ধরবে। সবার ধারণা মিনিস্টার আপনার কথা ফেলতে পারবেন না।’

‘আপনার আসার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো?’

‘দারোগা এসে আপনাকে ধরবে মিনিস্টারকে বলে দেবার জন্যে। হয়তো চাইবে আপনি ওর হয়ে রাইটার্সে গিয়ে দরবার করুন। আপনাকে শুধু বলে রাখি লোকটা অত্যন্ত ফেরেব্বাজ। মন্ত্রী আসবে এদিকে তা জানত না। কেই বা জানত। তাই দারোগা গিয়েছিল নিজের ধান্দায়।’

‘আপনার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক কেমন?’ চট করে জিজ্ঞাসা করল দীপাবলী!

হাসল অর্জুন, ‘জলে যারা বাস করে তারা পরস্পরকে সামলে চলে ম্যাডাম।’

‘ঠিক আছে, কিন্তু অর্জুনবাবু, আপনি এটা কী করলেন?

‘কোনটা?’ চোখ ছোট করল অর্জুন।

‘এই যে নেখালিতে আজ সকাল থেকে কুয়ো খুঁড়তে লোক পাঠালেন?’

‘ওটা তো আপনারই হুকুম ম্যাডাম! তাই না?’

‘কিন্তু এর ফলে মন্ত্রী তো হাত গুটিয়ে নিতে পারেন।’

‘পারেন। তবে আদৌ যে হাত খুলতেন এই গ্যারান্টি কি ছিল?

‘ছিল না। কিন্তু উনি যখন এসেছিলেন তখন একটা কিছু হতই।’

‘সেটা এখনও হতে পারে। ম্যাডাম, লোকে আমাকে ভাগ্যবান বলে। ভাগ্যবানের বোঝা সবসময় ভগবান বয়ে থাকেন। নইলে আপনি বললেন আর লোক পাঠালাম কুয়ো খুঁড়তে, এমনটা হয় না। মানে কারও কথা আমি চট করে শুনি না। তা শুনে দেখুন বিরাট লাভ হল। মিনিস্টারের গুড বুকে চলে গেলাম। জিপে করে যাওয়ার সময় কত গল্প। সব ঠিকঠাক হলে আগামী বছর—!’ জিভে শব্দ করল অর্জুন! ‘আর এসব হয়েছে আপনার জন্যে।’

‘আমার জন্যে?’ দীপাবলী অবাক।

‘সত্যি কথা বলতে আমি দ্বিধা করি না। আপনার কথা শুনেছি বলেই আজ ডি এম পর্যন্ত আমাকে খাতির করলেন। লোকটা আগে আমাকে ঠিক পাত্তা দিত না। এবার বলুন, আপনার কী সেবা করতে পারি?’ অর্জুনের ঠোঁটে সেই চটচটে হাসি চলকে উঠল। তার চোখদুটো দীপাবলীর মুখের ওপর স্থির।

‘আপনি কী মিন করছেন?’ আচমকা মাথায় রক্ত উঠে এল।

‘ম্যাডাম, একটা কথা শুনেছি, রোমে গেলে নাকি রোমানদের মতো ব্যবহার করতে হয়। রাগ করবেন না, আপনি তো নিয়মের বাইরে যেতে পারেন না।’

‘অর্জুনবাবু, আপনি কিন্তু সীমা ছাড়াচ্ছেন।’ দীপাবলী উঠে দাঁড়াল।

এবার অর্জুন উঠল, ‘অনেক ধন্যবাদ মনে করিয়ে দেবার জন্যে। অপরাধ হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন। আপনি এরকম কথা বলবেন তা আমি আন্দাজ করেছিলাম। ঠিক হ্যায়, নেখালিতে না হয় আরও দুটো কুয়ো আর একটা নলকূপ করে দেব দিন চারেকের মধ্যে। তাতে নিশ্চয়ই আপনি আপত্তি করবেন না! চলি।’ নমস্কার করে খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল অর্জুন। একধাপ নেমে সে ঘুরে দাঁড়াল, ‘আপনার এখানে যে-মেয়েটা কাজ করে তাকে বলে দেবেন আমি মানুষ, ভয় পেয়ে ওইভাবে ছুটে যাওয়ার কোনও কারণ নেই।

দীপাবলী কেটে কেটে বলল, ‘কী করবেন বলুন, আপনার মতো মানুষদেরই ওর ভয়।’

অর্জুন হাসল, ‘ও যখন নেখালিতে থাকত তখন নিশ্চয়ই ওর ভয় ছিল। কিন্তু এই কোয়ার্টার্সে আসার পর থেকে আর কোনও ঝামেলায় পড়তে হয়নি নিশ্চয়ই। কারও বাগানে ঢুকে ফুল ছেঁড়ার ইচ্ছে আমার এখনও হয়নি ম্যাডাম।’ কথা শেষ করে অর্জুন চলে গেল। জিপের আওয়াজটা চারপাশ মাতিয়ে দুরে সরে গেল হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার কাটতে কাটতে। দরজাটা বন্ধ করল দীপাবলী। লোকটা যতক্ষণ এই ঘরে বসে ছিল ততক্ষণ এক ধরনের আড়ষ্টতা তাকে ঘিরে রেখেছিল। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না সে! লোকটা কেন এল? একটা অসৎ বদ লম্পট মানুষ কোন প্রয়োজনে তার কাছে আসতে পারে? এই জেলার বড়কর্তারা যার কথায় ওঠে বসে তার কোনও দরকার নেই তাকে খাতির করার? মন্ত্রীর নেকনজরে পড়ে লোকটা আরও রোজগার করবে। কিন্তু সেই কারণে তাকে ঘুষ দিতে আসবে কেন? সে রেগে উঠতেই নেখালির মানুষদের উপকার হবে এমন কাজ করার কথা বলল। দীপাবলীর পক্ষে সম্ভব ছিল না লোকটাকে ওই কাজ করা থেকে বিরত করা। কিন্তু অর্জুন নায়েক যতক্ষণ ছিল তাকে অসম্মান করার চেষ্টা করেনি। বরং যথেষ্ট বিনয় দেখিয়েছে। সে যে খারাপ মানুষ তা স্বীকার করতে দ্বিধা করেনি। অবাক লাগছে এখানেই।

‘দিদি, চা।’

দীপাবলী দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসে পড়েছিল। তিরির গলা শুনে মুখ তুলল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, ‘শোন, আমার এখানে তোর কোনও ভয় নেই। কেউ এলে ওইভাবে দৌড়ে পালাবি না।’

‘তুমি জানো না দিদি, লোকটা একেবারে শয়তানের বাচ্চা। নতুন নতুন মেয়ে না পেলে ওর চলে না।ওর সঙ্গে বেশি কথা বোলো না।’ তিরি উত্তেজিত।

‘তিরি!’ দীপাবলী ধমকে উঠল, ‘এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবি না।’

তিরি মাথা নিচু করল। আর তখনই দরজায় খুটখুট শব্দ হল। দীপাবলী বন্ধ দরজার দিকে প্রথমে তারপরে তিরির দিকে তাকাল। তিরি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কি দরজা খুলব?’

দীপাবলী এক মুহুর্ত ভাবল। এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় রাত্রের অন্ধকারে কিছু মানুষ যদি মতলব নিয়ে আসে তা হলে দুটি মেয়ের পক্ষে কোনও প্রতিরোধ তৈরি করা সম্ভব হবে না। সতীশবাবু অবশ্য বলেছেন তেমন বিপদ এই তল্লাটে এখনও কারও হয়নি। তবু—। সে নিচু গলায় বলল, ‘জিজ্ঞাসা কর, কে? তারপর খুলবি।’ একটু আগে অর্জুনকে দরজা খোলার আগে তার এই কাজটাই করা উচিত ছিল বলে মনে হল।

তিরি গলা তুলে জানতে চাইলে, ‘কে?’

বাইরে থেকে আওয়াজ এল, ‘আমি। দীপাবলী ফিরেছে?’

সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল দীপাবলী। তারপর তিরিকে বলল, ‘ঠিক আছে, তুই ভেতরে যা।’

তিরি পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল ভেতরের ঘরের দরজা পর্যন্ত। দীপাবলী এগিয়ে গিয়ে দরজা. খুলতেই আধা অন্ধকারে দাঁড়ানো শমিতকে দেখতে পেল। শমিত হাসল, ‘চমকে গেলে?’

‘একটু। এসো, ভেতরে এসো।’ কথাগুলো বলামাত্র দীপাবলীর খেয়াল হল কলকাতায় শেষবার দেখা হওয়ার সময়েও সে শমিতকে আপনি বলেছে। মনে মনে তৎক্ষণাৎ কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলল। শমিত ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তার কাঁধে ঝোলা হাতে ব্যাগ। পরনে সেই একই পোশাক। দাড়ি রেখেছে।

‘বোসো।’ দরজা বন্ধ করল দীপাবলী।

চেয়ারে বসে শমিত বলল, ‘আমি বিকেলের দিকে এসেছিলাম। শুনলাম তুমি নাকি মাননীয় মন্ত্রীমহাশয়ের সঙ্গে কাজে বেরিয়েছ। কখন ফিরবে তা তোমার মেইড সার্ভেন্ট জানে না। ফলে আমাকে একটা আস্তানার সন্ধানে যেতে হয়েছিল। কিন্তু এই জায়গা এমন পাণ্ডববর্জিত যে রাত কাটানোর কোনও ব্যবস্থাই নেই। ভয়ে ভয়ে ফিরলাম যদি তোমার দেখা পাই। আমি ভাবছি বেশ ভাগ্যবান, কী বলো?’

চুপচাপ কথাগুলো শুনল দীপাবলী। তারপর চুপচাপ উলটোদিকের চেয়ারে বসল।

শমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কি তোমাকে অসুবিধেতে ফেললাম?’

‘কেন?’

‘তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে।’

‘না। আমি ভাবছি হঠাৎ কী কারণে তুমি তোমার নাটক ছেড়ে এতদূরে, আমার ঠিকানাই বা পেলে কোথায়!’

‘এ সবই চেষ্টা করলে পাওয়া যায় দীপা। কিন্তু আমি খুব ক্ষুধার্ত, সারাশরীর গরমে ঘামে পচছে। একটু আরাম করে স্নান করা দরকার তার আগে।’

‘নিশ্চয়ই। কিন্তু এই অঞ্চলে জল খুব মূল্যবান বস্তু। অতএব একটু কৃপণের মতো খরচ করলে সবার উপকার হয়।’ দীপাবলী উঠে ভেতরের ঘরের দিকে যেতেই তিরিকে দেখতে পেল, ‘বাথরুমে একটা আলো দে।’

বাইরের ঘর থেকে শমিতের গলা ভেসে এল, ‘আমার কাছে স্নানের সব সরঞ্জাম আছে।’

‘যেমন?’ গলা তুলল দীপাবলী।

‘গামছা, সাবান।’

দীপাবলীর ঠোঁটে হাসি মিলিয়ে গেল। তিরি ফিরে আসা পর্যন্ত সে ভেতরের ঘরেই দাঁড়িয়ে রইল। তিরি বলল, ‘হয়ে গিয়েছে।’

দীপাবলী বাইরের ঘরে বেরিয়ে এল, ‘একটু সাবধানে যাও। এখানে ইলেকট্রিক নেই। ব্যাগটা ওখানেই থাক।’ শমিত ঝোলাটা নিয়েই তিরিকে অনুসরণ করে ভেতরে চলে গেল। খাটে এসে বসল দীপাবলী। অভদ্রতা করা যেখানে অসম্ভব, খুশি যেখানে চেষ্টা করেও হওয়া যায় না, সেখানে একধরনের চাপা অস্বস্তি থিকথিক করে। দীপাবলী কিছু ভাবতেই পারছিল না। তার এখন কী করা উচিত?

এইসময় তিরি ফিরে এল, ‘দিদি, উনি কি রাত্রে খাবেন?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে।’

‘কী হবে তা হলে? আমি তো মাত্র আমাদের জন্যে রেঁধেছি।’

‘আবার ভাত বসিয়ে দে। ডিম নেই?’

মাথা নাড়ল তিরি, ‘কিন্তু শোবে কোথায়?’

‘দেখি ভেবে।’

তিরি এক মুহূর্ত চুপ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কে হয়?’

দীপাবলী চমকে উঠল। কেউ না, বলতে গিয়েও থমকে গেল। যেটা স্বাভাবিক, সেই বন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করলে তিরি হজম করতে পারবে না। অথচ এমন প্রশ্নের জবাব দেবার একটা দায় থেকেই যায়। কর্তৃত্ব দেখিয়ে ধমকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। দীপাবলী উত্তর দিল, ‘আমাদের আত্মীয়। তুই রান্নাঘরে যা।’

তিরি চলে গেলে এই একটি বাংলা শব্দের কাছে কৃতজ্ঞ হল সে। আত্মীয় শব্দটি ঠিক আকাশের মতো। কোনও গণ্ডিতে আটকানো নয়। রক্ত অথবা আত্মার সম্পর্ক থাকলে তো বটেই আবার পাঁচজনের চোখে যা কাছের তাকে দূরে ঠেলতেও ওই একই শব্দ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু শমিত কেন এখানে?

বছরগুলো বেশি পুরনো নয়। সেই দুপুরে শমিতের বাড়ি থেকে চলে আসার পরে দীপাবলী ভেবেছিল হয়তো কিছুদিন সে তার সামনে আসবে না। সেদিন হস্টেলে ফিরে এসেছিল একটা ঘোরের মধ্যে। যত সময় যাচ্ছিল তত ভাল লাগা কুয়াশার মতো তার দশদিক আড়াল করে দিচ্ছিল। একটি ছেলে নাটক করে, কোনও বদ অভ্যাস নেই, পড়াশুনা করতে ভালবাসে এবং সেইসঙ্গে ব্যক্তিত্ব, তার ভালবাসা উপেক্ষা করার একটাই যুক্তি ভবিষ্যতে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে কিনা তার স্থিরতা নেই। কিন্তু ক্রমশ মনে হচ্ছিল সেই ঝুঁকি নেওয়া যায়। সৎ শিল্পের সঙ্গে যে-মানুষ জড়িত তার পাশে থাকায় নিশ্চয়ই এক ধরনের তৃপ্তি আছে। সেই তৃপ্তি ধনসম্পদের বিনিময়ে পাওয়া যাবে না।

শমিত প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে তাকে স্পর্শ করেছিল। সেই স্পর্শে কাম ছিল কিনা এখন বোধে নেই। সে এমন অপ্রাপ্তমনস্ক নয় যে শমিতের মন তার জন্যে তৈরি এই কথাটা এতদিনে বোঝেনি। অতএব নিরালায় একা পেয়ে শমিতের বাঁধ যদি ভেঙে যায় তা হলে প্রাথমিক যে-কুণ্ঠা মনে আসে তা দূর করার মতো যুক্তি খুঁজে নিচ্ছিল দীপাবলী। সেই কত বছর আগে জীবনীশক্তি ফুরিয়ে যাওয়া একটি অর্ধমৃত মানুষ শুধু আদেশ পালন করার তাগিদে তার শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন এই শরীর তৈরি হয়নি কোনও পুরুষের জন্যে। যে-মানুষটি স্বামী হিসেবে ফুলশয্যায় রাত্রে তাকে মা করতে চেয়েছিল তার ক্ষমতা কত সীমিত ছিল যে সামান্য প্রতিরোধ সহ্য করতে পারেনি। একধরনের জ্বালা ঘেন্না আতঙ্ক তার মনে তৈরি করে মানুষটি নেতিয়ে পড়েছিল। এত বছর পরে সেই ভাবনা মুখ নামিয়ে ছিল মনের কোণে। কোনও পুরুষ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি, পুরুষের স্পর্শের জন্যে একটুও আকাঙক্ষা হয়নি তার। ওই দুপুরে শমিতের স্পর্শে সেই ভাবনা মুখ তুলেছিল। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সেই ঘেন্না আকাশ ছুঁয়েছিল। কিন্তু রাত্রে সবকিছু থিতিয়ে যাওয়ার পর অনেক বছর আগের মৃত মানুষটিকে ছাপিয়ে একটি স্বাস্থ্যবান পুরুষের আবেগজড়ানো স্পর্শ তাকে যেন বিপরীত দিকে টানতে লাগল। সেই মুহূর্তে তার সারা আকাশ জুড়ে শমিত। যদি রাত না অন্ধকার ছড়াত, যদি বাস-ট্রাম বন্ধ না হয়ে যেত, তা হলে হয়তো সে ছুটে যেতে পারত শমিতের কাছে। কী বলত তা জানা নেই, জানতে ইচ্ছেও ছিল না। শুধু ছুটে যাওয়ার এক উগ্র আকাঙক্ষা বুকের পাঁজরে বারংবার ঘা মারছিল।

রাত কেটেছিল আধো ঘুম আধো জাগরণে। সেই একটি রাত যা তার সমস্ত ব্যক্তিগত আকাঙক্ষাকে মৃত করে দিয়েছিল। জলপাইগুড়ি থেকে যে-প্রতিজ্ঞা নিয়ে কলকাতায় এসেছিল তা যেন অর্থহীন মনে হয়েছিল। এক ফোঁটা ভালবাসার জন্যে যদি কোনও মানুষ লক্ষ মাইল হেঁটে যেতে পারে তা হলে একটা পুরো সমুদ্র পেলে সে কী করবে?

সকাল হল। রোদ উঠল রোদের মতন। অদ্ভুত আলস্য নেমে এসেছিল শরীরে, মনে। কিন্তু ভাল লাগছিল না, কিছু না। এমনকী স্নান বা খেতেও মন আসছিল না। দুপুর যখন ঠিক দুক্কুরবেলা, তখন সে বেরিয়েছিল হস্টেল থেকে। প্রায় উদভ্রান্তের মতো হাজির হয়েছিল মায়াদের বাড়িতে। মায়া বাড়িতে ছিল না। মাসিমা তাকে দেখে চমকে উঠে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কী হয়েছে?’

‘কই! কিছু না তো!’ হঠাৎ যেন নিজের ব্যবহারে আটপৌরে ভঙ্গি আনতে চাইল সে।

‘কিছু একটা হয়েছে। শরীর কেমন আছে?’

‘ভাল। মায়া কোথায়?’

‘বেরিয়েছে।’

‘কোথায়?’

‘বলে তো গেল ও আর সুদীপ শমিতের বাড়িতে যাচ্ছে।’

নামটা শোনামাত্র বুকের বাতাস স্থির হল, ‘কেন?’

‘কাল নাকি শমিত রিহার্সালে আসেনি। ও তো এমন কখনও করে না।’

‘মায়া সুদীপের সঙ্গে গিয়েছে?’

‘বলে তো গেল। একাও যেতে পারে। আমি মেয়েকে বুঝি না বাবা।’

‘কেন?’

‘মুখে আলগা আলগা ভাব দেখায় কিন্তু মনে যে শমিতের জন্যে টান আছে তা লুকিয়ে রাখতে চায়। দ্যাখো, শমিত ভাল ছেলে। কিন্তু—।’ হঠাৎ চুপ করে গেলেন মাসিমা, তারপর মাথা নাড়লেন, ‘নাঃ যখন ঠিক করেছি বাধা দেব না, তখন কিছুতেই বাধা দেব না। নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই বুঝে নিক। আমাকে তো দায়ী করতে পারবে না।’

মাসিমা নিশ্বাস ফেললেন। আর এই কথাগুলো শোনামাত্র মাথা থেকে একটা স্রোত ধীরে ধীরে পায়ের বুড়ো আঙুলে, শেষে শরীরের বাইরে নেমে উধাও হয়ে গেল দীপাবলীর। আচমকা যেন সবকিছু সহজ হয়ে গেল। হস্টেলে ফিরে এসে চুপচাপ নিজের খাটে শুয়ে শুধু একধরনের শূন্যতাবোধ ছাড়া আর কিছু মনে জড়িয়ে ছিল না।

অথচ সেই শূন্যতাবোধের যে কতখানি ভার, তার টের সে পেতে লাগল সময় যত পেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ যেন সিংহাসন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এমন অনুভূতি প্রবল হচ্ছিল। এবং সেইসঙ্গে এল ঈর্ষা, রাগ, অভিমান। নিজেকে খুব খেলো মনে হতে লাগল। মায়া কোনও এক সময় তাকে ঠাট্টার গলায় বলেছিল, দেখিস বেশি জড়িয়ে যাস না। সেটা কি সতর্কীকরণ ছিল? আমার সম্পত্তিতে হাত দিয়ো না! কিন্তু শমিত কারও সম্পত্তি হতে পারে না। মায়া শমিতকে ভালবাসে এটা নিছক অনুমানেই ছিল তাঁর। সেইমতো শমিতকে বলেছিল ওইসময়। শমিত অস্বীকার করেছিল, অর্থাৎ ভালবাসাটাসা নয়, স্রেফ শরীরের প্রয়োজনে তাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। যা একসময় আবেগের চূড়ান্ত প্রকাশ বলে মনে হয়েছিল তাকেই এখন পরিকল্পিত লাম্পট্য বলে মনে হল। আর তখনই অপমানবোধ প্রবল হল। ওই দুপুরের পর নিজের যে পরিবর্তন হয়েছিল তার জন্যে লজ্জায় ঘেন্নায় নুইয়ে যাচ্ছিল সে। ইচ্ছে করছিল সোজা মায়ার কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলে দেয়। যে-পুরুষ প্রেমিকাকে প্রতারণা করে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বোকামি। মায়াকে সতর্ক করে দেওয়া দরকার। মায়ার সঙ্গে কোনও আত্মিক সম্পর্ক নেই বলে শমিত যে তাকে ভুল বুঝিয়েছে তাও মায়ার জানা দরকার। মন স্থির করে ফেলেছিল দীপাবলী। আর তখনই ঘটনাটা ঘটল।

সন্ধে সবে ঘন হয়েছে। মায়া এল তার কাছে।

তখনও বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল দীপাবলী। মায়া একটা চেয়ার টেনে পাশে বসতে সে ধীরে, ধীরে উঠে বসে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কী ব্যাপার?’

‘আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলি?’ মায়ার গলায় কোনও তাপ নেই।

হঠাৎ কথা বলার ইচ্ছে, এতক্ষণ ধরে জমে থাকা কথাগুলো যেন হারিয়ে ফেলল দীপাবলী। সে নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

মায়া বলল, ‘শোন, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে। আমি শমিতের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তুই যদি ইচ্ছে করিস তা হলে শমিতকে বিয়ে করতে পারিস।’

চমকে উঠল দীপাবলী। বুকের ভিতরটাই যেন টলে উঠল। সে কপালে ভাঁজ ফেলে মায়ার দিকে তাকাল। মায়ার মুখ পাথরের মতো।

মায়া মুখ ফেরাল, ‘শমিত আমাকে বলেছে কী ঘটনা ঘটেছিল।’

‘তোকে শমিত বলেছে?’ বিশ্বাস করতেই পারছিল না দীপাবলী।

‘হুম। ও স্বীকার করেছে যে তোকে ভালবাসে!’

‘কেউ যদি আমাকে ভালবাসে তা হলে আমার কী করার আছে?’ হঠাৎই এক উদাসীনতা দীপাবলীর গলায় জড়িয়ে গেল।

‘কী বলছিস দীপা?’

‘নতুন কিছু না। পৃথিবীর কোটি কোটি পুরুষ প্রতি মুহূর্তে কোনও-না-কোনও মেয়েকে ভালবেসে ফেলছে। এ নিয়ে মাথা ঘামালে মেয়েদের তো কোনও কাজই করা হবে না।’

‘তোকে শমিত কী বলেছে?’

‘যা শুনেছিস।’

‘তোর প্রতিক্রিয়া হয়নি?’

‘হয়নি বললে মিথ্যে বলা হবে। নিজেকে খুব—।’

‘চুপ করলি কেন?’

‘বলতে ইচ্ছে করল না, তাই।’

‘শোন, তোকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করছি, তুই শমিতকে ভালবাসিস?’

‘কীসে এ-কথা মনে হল?’

‘মনে হয়েছে। শমিত তোকে যাদবপুরে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল শিফট করার সময়। মুখে ‘না’ বলেও আমার অসুস্থতার সময় তুই নাটক করলি আর যেই আমি সুস্থ হলাম নিজেকে গুটিয়ে নিলি। শমিত তোকে এই হস্টেল ঠিক করে দিয়েছে। শমিতের কাছে চাকরির জন্যে গিয়েছিলি? মিথ্যে কথা?’

দীপাবলী হাসল, ‘মায়া, তোর সম্পর্কে আমার অন্যরকম ধারণা ছিল। যারা রাজনীতি করে, পাঁচটা ছেলের সঙ্গে দলের প্রয়োজনে দিনরাত মেশে, যাদের পড়াশুনো আছে, তাদের দেখার চোখ অনেক ব্যাপক বলে ভাবতাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল। যে-কোনও ঘরকুনো মেয়ের সংকীর্ণতার সঙ্গে তোদের কোনও পার্থক্য নেই, অন্তত ঘা খেলে যে মুখোশটা খুলে যায় সেটা বুঝতে পারছি।’

‘তুই আমাকে অপমান করছিস দীপা। আমি সংকীর্ণ? সংকীর্ণ হলে নিজে এসে তোকে বলতাম না শমিতকে গ্রহণ কর।’

‘আমি কাকে গ্রহণ করব তা তুই ঠিক করে দিবি?’

‘আমার তো তাই মনে হয়েছিল। তুই শমিতকে আমার কথা বলেছিলি?’

‘বলেছিলাম। কারণ আমি বিশ্বাস করি তুই শমিতকে ভালবাসিস৷ না মায়া, আমি শমিতের জন্যে মোটেই ব্যগ্র নই। এ-কথা ভাল লাগছে শমিত যা করেছে, তা তোকে বলেছে। লোকটা খুব ছোট হয়ে ছিল এতক্ষণ আমার কাছে, এখন সত্যি শ্রদ্ধা হচ্ছে। কিন্তু আমি জানি তুই ওকে ভালবাসিস। তুই নিশ্চিন্ত থাক, শমিতের জন্যে আমার কোনও আগ্রহ নেই।’

‘তুই এ-কথা শমিতকে বলতে পারবি?’

‘নিশ্চয়ই। আমি তো বলেই এসেছি ওকে বন্ধু হিসেবে সম্পর্ক রাখতে।’

হঠাৎ মায়া দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেলল, ‘আমি এখন কী করব?’

দীপাবলী উঠল। এক হাতে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এবার তোকে আমার হিংসে হচ্ছে।’

‘ঠাট্টা করছিস?’ মুখ না তুলে বলল মায়া।

‘না রে। তোর মতো এমন ভালবাসা যদি কাউকে বাসতে পারতাম!’

‘কী হবে বেসে! শমিত আমাকে বুঝতে চায় না, বোঝে না!’

‘অপেক্ষা কর।’ দীপাবলী মায়ার মাথায় হাত বুলিয়েছিল, ‘শমিত নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। আমাকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করিস না।’

এরও দিন সাতেক বাদে শমিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। হস্টেলের সামনের রাস্তায়। একেবারে মুখোমুখি, ‘তোমার কাছে যাচ্ছিলাম।’

‘বলুন।’

‘তোমার চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের স্কুলের সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলেছি। তুমি সকাল ঠিক সাড়ে ন’টায় আমাদের বাড়িতে চলে এসো। আমি স্কুলে নিয়ে যাব।’

মন স্থির করাই ছিল। দীপাবলী হাসল, ‘আপনি অনেক করলেন আমার জন্যে। কিন্তু আমার পক্ষে আর আপনার স্কুলে চাকরি করা সম্ভব নয়।’

‘সেকী? কেন?’ অবাক হয়ে গেল শমিত।

‘আর সম্ভব নয়।’ মাথা নেড়েছিল দীপাবলী।

‘আমি কারণটা জানতে চাইছি।’

‘আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। সব কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’

‘কিন্তু আমাকে আগামীকাল কৈফিয়ত দিতে হবে সেক্রেটারিকে। তুমি কি এই ব্যাপারটাকে ছেলেখেলা বলে মনে করো? আমি অসম্মানিত হব তুমি চাইছ?’

‘বেশ, তা হলে বলি। সেদিন আপনার ব্যবহার আমি মেনে নিতে পারিনি।’

‘ও!’ থমকে গেল শমিত।

আপনার খারাপ লাগতে পারে কিন্তু আমার পক্ষে এক স্কুলে কাজ করা সম্ভব নয়। কারণ আপনাকে দেখলেই ওইসব মনে পড়বে। মায়া আপনাকে কিছু বলেনি?’

‘মায়া? না তো!’

‘ও। আপনি যে-ব্যবহার করেছিলেন তা হৃদয়ের সম্পর্ক নিবিড় হলেই মানুষ করে থাকে বলে শুনেছি। আপনাকে আমি ওই স্তরে ভাবতে পারছি না। অথচ আপনি যেহেতু প্রস্তাব করেছেন তাই একসঙ্গে কাজ করলে মনে হবে আমি সমস্যা তৈরি করছি। এই অস্বস্তিতে আমি থাকতে চাই না।’

‘এটাই তা হলে তোমার শেষ কথা?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু তুমি বলেছিলে বন্ধুত্ব থাকবে।’

‘বলেছিলাম। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বন্ধুত্বের মধ্যেও একটা ছোট্ট দেওয়াল থাকে। আপনি সেই দেওয়ালটাকে নড়বড়ে করে দিয়েছেন। তবে দেখা হলে নিশ্চয়ই কথা বলব। আশা করব আপনিও সহজ হয়ে কথা বলবেন।’

সেই শেষ দেখা। চাকরি নেবার সময় মায়াদের বাড়িতে গিয়েছিল দীপাবলী। মায়া ছিল না। ওর মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। ভদ্রমহিলা এসব ব্যাপারের কিছুই জানেন না। নিজের চাকরির বিস্তারিত ব্যাপার মহিলাকে জানিয়েছিল সেদিন। আর তারপর কলকাতা চোখের আড়ালে। খুব খারাপ লেগেছিল লাবণ্যর কাছ থেকে বিদায় নিতে। মেয়েটা এতদিনে যেন অনেক বুঝতে শিখেছে। সে বারংবার ওর দিদিমাকে বলেছিল লাবণ্যকে অন্তত গ্র্যাজুয়েট যেন করা হয়। শিক্ষিত একটি মেয়ে তার অতীত, যা পূর্বনারীরা তাকে দিয়েছিল, জেনে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করে নিক। ততদিন তার জন্যে সুস্থ পরিবেশ রাখা অত্যন্ত জরুরি।

‘বাপস! এত রাত্রেও জল ঠান্ডা হয় না এখানে?’

চমকে মুখ তুলল দীপাবলী। পাজামা পাঞ্জাবি পরে মাথায় ভেজা গামছা ঘষতে ঘষতে ঘরে ঢুকল শমিত, ‘পরনেরগুলো বাথরুমের বালতিতে ভিজিয়ে দিয়েছি। ওগুলো আর গায়ে রাখা যাচ্ছিল না।’

‘ঠিক আছে, তিরি কেচে দেবে।’

‘তোমার কাজের মেয়েটির নাম বুঝি তিরি? ফ্যানটাস্টিক নাম তো? তিরি মানে কী? তিরতিরে থেকে এসেছে নাকি?’ শমিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে প্রশ্নটা করামাত্র ভেতরের বারান্দা থেকে কৌতুক-মেশানো হাসি ছিটকে উঠেই আচমকা থেমে গেল। সেদিকে তাকিয়ে শমিত বলল, ‘বাঃ, চমৎকার বাংলা বোঝে তো!’

দীপাবলী ঠোঁট কামড়াল। বারান্দায় অন্ধকার। তিরি ওখানে যে ছিল বা আছে তা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু নির্ঘাত সে কথা শোনার লোভেই কাছাকাছি রয়েছে। শমিত আর কোনও বিষয় পেল না বলবার। সমস্ত ব্যাপারটাই খুব বিশ্রী লাগছিল দীপাবলীর। খাট থেকে নেমে বলল, ‘তুমি বাইরের ঘরে গিয়ে বসো, রাতের খাবার পেতে সময় লাগবে।’

‘আপাতত এক কাপ চা হলেই চলবে, সঙ্গে বিস্কুট।’ শমিত পা বাড়াল।

বারান্দার দিকে মুখ করে দীপাবলী গলা তুলল, ‘তিরি, তোর কানে গিয়েছে নিশ্চয়ই। চা নিয়ে আয়।’

বাইরের ঘরে ঢুকে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘তা হলে তুমি এখনও নাটক করছ?’

‘মানে?’

‘তোমার দাড়ি আর কাঁধের ব্যাগ বলে দিচ্ছে শিল্পের জন্যে সংগ্রাম করছ। শুনেছি সংগ্রাম করতে গেলে নাকি এইরকম বেশ দরকার।’

‘ঠাট্টা করছ?’

‘নাঃ। বলো, কী উদ্দেশ্যে আগমন? ’

‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। এসে লাভ হল।’

‘যেমন?’

‘তুমি তো আমাকে আপনি বলতে সবসময়, এসে পড়েছি বলে তুমি শুনলাম।

‘বয়স মানুষকে অনেক জায়গায় উদার করে।’

‘তোমার বয়স—!’

‘আমার কথা থাক। শুধু দেখার ইচ্ছের জন্যে যদি আসা হয় তা হলে অন্যায় করেছ। আমি এটা পছন্দ করছি না; মায়া কেমন আছে?’

‘মায়া! তুমি জানো না?’

‘কী জানব?’

‘মায়া বিয়ে করেছে। বছরখানেক হয়ে গেল।’

‘আচ্ছা?’ বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল দীপাবলীর।

হ্যাঁ। সুদীপকে। সুদীপ তো আমাদের দল ছেড়ে দিয়েছে।’

‘সুদীপকে?’ দীপাবলী যেন তল পাচ্ছিল না।

‘ইয়েস ম্যাডাম। জীবন এইরকম। আমি অবশ্য খুব খুশি হয়েছি। তবে মায়া আর সুদীপের টেম্পারামেন্ট আলাদা, এইটেই গোলমাল।’

অর্থাৎ মায়া আর শমিতের জীবনে নেই। এতক্ষণ যে-স্বাভাবিক ব্যবহার সে করছিল তা যেন অকস্মাৎ হারিয়ে গেল। শমিতের একা হওয়া মানে তার সমস্যা বাড়া—এমন অনুভূতি প্রবল হল। সে কোনওমতে জানতে চাইল, ‘আমার ঠিকানা পেলে কোথায়?’

‘তোমার হেডঅফিস থেকে।’

‘কী জন্যে এসেছ এখনও জানলাম না।’

‘এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? যদি আপত্তি থাকে বলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঠেঘাটে রাত কাটিয়ে ফিরে যাই।’

‘সেটা আর বলতে পারছি কোথায়?’

‘বলতে যখন পারছ না তখন এসো অন্য গল্প করি। তোমার চাকরি কেমন লাগছে? জায়গাটা কেমন?’

রাত্রে খাওয়াদাওয়া চুকে গেলে তিরিকে দিয়ে বাইরের ঘরে বিছানা পাতাল দীপাবলী শমিতের জন্যে। ভেতরের বারান্দায় একটা খাটিয়া পড়ে ছিল, সেটাকেই নিয়ে আসা হল। তিরি যেমন শোয় তেমনি শোবে দীপাবলীর ঘরে। শুতে যাওয়ার আগে দীপাবলী বলল, ‘কাল ভোর থেকেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তুমি কখন যাবে?’

‘আমি এখানে ক’দিন থাকব দীপা। একটা নাটক লিখছি এদিকের মানুষ নিয়ে। তাই এদের ভাষা, জীবন, জানা দরকার। একটা দেশলাই দাও তো?’

বিরক্ত দীপাবলী ঘরে ফিরে আসামাত্র দেখল তরতরিয়ে একটা দেশলাই নিয়ে তিরি বাইরের ঘরের দিকে যাচ্ছে।

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন