২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি

সমরেশ মজুমদার

Government servants should, at all times maintain absolute integrity and devotion to duty, especially those holding positions of trust and responsibility, should not only be honest and impartial in the discharge of their official duties but also have the reputation of being so.

কর্মচারীদের চাকরিতে নিয়োগ করার সময় সরকার ভবিষ্যতে তাঁদের আচরণবিধি কীরকম হবে তা একটি পুস্তকে সমন্বিত করেছেন। এই পুস্তকটি প্রতিটি সরকারি চাকুরের অবশ্যপাঠ্য এবং পরবর্তীকালে চাকরিতে প্রমোশনের জন্যে যেসব পরীক্ষা দিতে হয় তাতে এই বিষয়টিও থাকে। সরকার জানতে চান তার কর্মচারী আচরণবিধি ভাল করে জানে কিনা। নাগপুরে দীপাবলীকে আয়কর, সম্পত্তিকর, দানকর আইনের বিশদ ব্যাখ্যার সঙ্গে এই বিষয়টিও পড়তে হচ্ছে।

মুসৌরি থেকে ছেলেমেয়েরা যে যার নিজস্ব বিভাগে ট্রেনিং নিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে এসেছে নাগপুরে। চৌদ্দ মাসের এই ট্রেনিংয়ের পরে একজন প্রথম শ্রেণির আয়কর অফিসার হিসেবে তাকে কাজ শুরু করতে হবে। অলোকের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে সেইমতো পোস্টিং-এর জন্যে সে আবেদন করেছে দিল্লিতে। আশা আছে তা গ্রাহ্য হবে।

আচরণবিধি বা সেন্ট্রাল সিভিল সার্ভিস কনডাক্ট রুলস বইটিতে মাত্র পঁচিশটি রুল আছে যা কর্মচারীদের অবশ্যই পালনীয়। প্রতিটি রুলের আবার বাই রুল আছে। এই বইটি দীপাবলীকে খুব আকৃষ্ট করল৷

চাকরির শুরুতে সরকার তাঁর কর্মচারীদের কাছে যা যা আশা করেন তার মূল তিনটি হল, সম্পূর্ণ আনুগত্য, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা এবং এমন কিছু না করা যা সরকারি চাকুরে হিসেবে বেমানান।

যে-কোনও চাকরি করতে গেলে প্রথমেই এই তিনটি মানতে হয়। যে আমাকে মাইনে দিচ্ছে তার কাজ আমি ভালভাবে করব। এ নিয়ে কোনও বিতর্ক উঠতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারকে এইসব কথা আইন করে বলতে হচ্ছে। শ্রমিক মালিক সম্পর্ক নষ্ট হয় যখন তখনই কাজে ব্যাঘাত ঘটে। উৎপাদন কমে যায়। হয় মালিকের স্বেচ্ছাচার যা শ্রমিকের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে তাদের দুরবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়, নয় অধিকার কায়েম করার উগ্র আকাঙক্ষায় কর্মচারীরা সীমা ছাড়িয়ে যান, সংঘাত মূলত এই কারণে। এইরকম একটি বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন সামনে থাকলে সরকার এবং তাঁর কর্মচারীরা আগাম জেনে যাচ্ছেন তাঁদের কী করা উচিত কী উচিত নয়। যদি কোনও কিছু অত্যন্ত আপত্তিকর বলে মনে হয় তা হলে সরকারের বক্তব্য হতেই পারে, আপনি এই চাকরি নেবেন না। জেনেশুনে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিক্ষোভ দেখানো অর্থহীন।

সরকারি কর্মচারীদের কী কী কাজ করা উচিত নয় তার বিস্তৃত তালিকায় চোখ রেখে চমকে উঠল দীপাবলী। পড়তে পড়তে তার হাসি পাচ্ছিল। তাকেও এই বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। ঠিকঠাক লিখলে পাশ করবে। স্কুলে পড়ার সময় এমন অনেক বিষয় পড়তে হয়েছে যার সঙ্গে জীবনের কোনও যোগ নেই। পরবর্তীকালে মনে হয়েছে যাঁরা সিলেবাস বানান তাঁরা কেন ছাত্রছাত্রীদের সময় এবং শক্তির এমন অপচয় করেন। এই আচরণবিধি পড়তে গিয়ে একই অনুভূতি হল। সরকারি অফিসে যা যা মানা হয় না তাই মানতে বলা হয়েছে এই বইতে। থিয়োরি এবং প্র্যাকটিসের যে বিপুল প্রভেদ তা দূর করার কোনও চেষ্টাই কি হয়? বলা হয়েছে কোনও সরকারি কর্মচারী একা বা দলবদ্ধভাবে যদি ওপরওয়ালার আইনসংগত আদেশ অমান্য করেন তা হলে তা অপরাধ বলে চিহ্নিত হবে। বিশ্বাসঘাতকতা, অসৎ আচরণ, চুরি বা জালিয়াতি, ধর্মঘট, পিকেটিং বা ঘেরাও বা তাতে যোগ দিতে প্ররোচিত করা, চাকরিতে নেশা করে আসা এবং কাজের সময় অসংলগ্ন আচরণ করা, নিয়মিত দেরিতে অফিসে আসা, কাজে অবহেলা এবং বেআইনিভাবে ছুটিতে থাকা এ সবই অপরাধ এবং সরকার এ কারণে শাস্তি দিতে পারেন। দীপাবলী অবাক হল। স্ট্রাইক বা পিকেটিংকে সরকার কেন অন্য অপরাধগুলোর সঙ্গে একই সারিতে বসাবেন! ধর্মঘট শ্রমিকের গণতান্ত্রিক অধিকার যদি হয় তা হলে তাকে এমন নোংরা চেহারা দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?

অথচ দেশের সরকারি অফিসগুলোর কথা বললে যে-চেহারা ভেসে ওঠে তাতে এইসব আইনের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। এ-দেশে বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারীর কোনও দায় নেই দশটায় অফিসে ঢোকার। তিনি যানবাহনের সমস্যার কথা বলবেন, বাসস্থানের দূরত্ব কারণ হিসেবে দেখাবেন। কিন্তু তিনি বিস্মৃত হবেন যে চাকরিতে যোগ দেওয়ার মুহূর্তে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন ঠিক দশটা থেকে কাজ শুরু করতে। দশটা পাঁচে কোনও সাধারণ মানুষ যদি প্রয়োজনে অফিসে যান তা হলে তাঁর কাজ করে দিতে তিনি বাধ্য। এই কর্তব্যটুকু করার জন্যে যে তিনি মাইনে পাচ্ছেন তা তাঁকে বোঝায় কার সাধ্য। সরকার এই কর্তব্যহীনতার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগ কতখানি হচ্ছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

পাঁচ নম্বর রুলে নজর পড়ল দীপাবলীর। কর্মচারীদের রাজনীতি এবং নির্বাচনে অংশ নেবার ব্যাপারে সতর্কীকরণ রয়েছে এতে। কোনও সরকারি কর্মচারী রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সহযোগী হতে পারবেন না। এমনকী তাঁর নিকট আত্মীয় যদি এই কাজ করেন তা হলে তিনি তাঁকে নিবৃত্ত করবেন এবং এ ব্যাপারে অক্ষম হলে অবশ্যই সরকারকে তা জানিয়ে দেবেন। তিনি নির্বাচনে কোনও প্রার্থীর হয়ে প্রচার বা অংশ নিতে পারবেন না।

দীপাবলীর মনে হল এমন হাস্যকর আইন নিয়ে কেউ কোনও প্রতিবাদ করছে না কেন? ভারতবর্ষের সংবিধানে স্পষ্ট বলা হয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা ভোগ করবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে সমস্ত ভারতবাসী। তাঁরা ভোট দেবেন। যখনই কোনও ভোটার ভোট দিতে যাচ্ছেন তখনই তাঁকে পছন্দ করতে হয় প্রার্থীকে। এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভোট হয় না, রাজনৈতিক দলই সেখানে প্রার্থী। অতএব একাধিক রাজনৈতিক দলের কর্মপ্রণালী এবং নীতির মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিতে হবে ভোটারকে। সেই রাজনৈতিক দলকে ভোট দেওয়া মানে তিনি তাদের সমর্থন করলেন। অর্থাৎ রাজনীতিতে তিনি অংশ নিলেন। সরকার তার বাইরের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন কিন্তু তার মানসিক অংশগ্রহণকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার পাননি। তা হলে তা সংবিধান পরিপন্থী হয়ে যাবে। সরকার বড়জোর বলতে পেরেছেন যে সরকারি কর্মচারী ভোট দিতে পারেন, কিন্তু কাকে দিতে চান বা দিলেন তার কোনও ইঙ্গিতও. দেবেন না। মজার কথা হল এই ব্যাপারটা ভারতীয় সংবিধান সমস্ত জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার জন্যেই নির্দেশ করেছে। ভোট হবে গোপন ব্যালটে যাতে কেউ জানতে না পারে ভোটার কাকে ভোট দিচ্ছেন। এই জনসাধারণের ক্ষেত্রে যেহেতু সরকারি কর্মচারীরাও পড়েন তাই তাঁদের আলাদা করে গোপনে ভোট দিতে বলা বাহুল্যমাত্র। অতএব যা ছিল সাধারণ ভোটারদের ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ, তাই সরকার ব্যবহার করতে চাইলেন অস্ত্র হিসেবে। কিন্তু একটি মানুষকে রাজনীতি করতে নিষেধ করা হচ্ছে একদিকে, অন্যদিকে ভোট দিতে বলা হচ্ছে-— এ কেমন গজকচ্ছপ ব্যবস্থা! অতএব এই রুলটি যদি সোনার পাথরবাটি হয়ে দাঁড়ায় তা হলে কারও কিছু বলার নেই। সরকারি কর্মচারীরা ইউনিয়ন করবেন। এবং তা হবে অরাজনৈতিক। ঠিক কথা। কিন্তু এ-কথা সবাই জানে তাঁদের ইউনিয়নগুলো যে কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে যুক্ত তা কোনও-না-কোনও রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনে লালিত। ইউনিয়নগুলো যে সবসময় মাইনে বাড়ানো বা কাজের পরিবেশ সুস্থ করার দাবিতে আন্দোলন করে তাও নয়। রাজনীতি শব্দটি আর বদ্ধ জলায় আবদ্ধ নেই। সরকার এসব জানেন কিন্তু আইন তৈরি করে ধৃতরাষ্ট্রের মতো বসে আছেন। জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনের পরিবর্তনের কথা কারও মাথায় আসে না।

আয়কর আইনের মূল যে গ্রন্থটি তাকে বলা হয় ম্যানুয়াল। একই কথা কত জটিল করে বলা যায় তার প্রমাণ বইটি। শব্দের মারপ্যাঁচে প্রথম পাতায় যে ধারণা জন্মায় তা দ্বিতীয় পাতা পড়তে গিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছিল দীপাবলীর। তার মনে হচ্ছিল এসব কথা সরল করে বলা যেত। প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থা না থাকলে কোনও দেশের আর্থিক উন্নতি সম্ভব নয়। সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ, নানারকম নিরাপত্তামূলক খরচ চালানোর জন্যে যে-অর্থের প্রয়োজন তা দেশের মানুষের চাঁদা করে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই অর্থবান মানুষদের আয়, সম্পত্তি ইত্যাদির ওপর বিভিন্ন স্তরের কর আরোপ করে ওই খরচ চালানোর একটা পথ করা হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত দেশই যে-সমস্ত উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করে আয়কর তার অন্যতম। করের স্তর সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের দ্বাদশ বছরে উনিশশো একষট্টি সালের তেরোই সেপ্টেম্বর যে-আয়কর আইন সংসদে অনুমোদিত হয় তার ওপর ভিত্তি করে কাজ করতে হবে তাদের। পরবর্তীকালে অনেক পরিবর্তন এবং সংযোজন হয়েছে এবং হবে। বিশাল এই গ্রন্থটির আইনের মূল এবং উপধারা মনে রাখা সত্যি দুষ্কর। নাগপুর কলেজে পড়তে গিয়ে দীপাবলী জানল এক্ষেত্রেও শর্টকাট মেথড আছে। যেসব আইন প্রতিদিনের ব্যবহারিক কাজে প্রয়োজন সেগুলো জানলেই কাজ চলে যায়। জটিল বিষয় কদাচিৎ আসে এবং তখন বই দেখে নিলেই হবে।

আয়কর, সম্পত্তিকর, এস্টেট ডিউটি, দানকরের সঙ্গে অফিস প্রসিডিওর যেমন জানতে হচ্ছে তেমনি অ্যাকাউন্টেন্সির ওপর মোটামুটি ধারণা অবশ্যই দরকার। ছোট বা বড় করদাতা তাঁদের আয়করের রিটার্নের সঙ্গে যে ব্যালান্সশিট এবং প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট দেবেন সেটি খুঁটিয়ে দেখার ক্ষমতাই একজন আয়কর অফিসারের অন্যতম গুণ বলে স্বীকৃত। ধরে নেওয়া হচ্ছে দেশের প্রায় সমস্ত আয়করদাতা সৎ এবং নিজেদের আয়-ব্যয়ের হিসেবে কারচুপি করবেন না। কিন্তু যিনি করবেন তিনি যে ব্যালান্সশিট বা প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট দেবেন তা খুঁটিয়ে দেখে তাঁর কারচুপি ধরতে হবে। মজার কথা হল এই আয়করদাতা অবশ্যই কোনও কমার্স গ্রাজুয়েট অথবা চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্টকে দিয়ে কাগজপত্র তৈরি করাবেন। যে-বিষয়ে নিয়ে সে কোনওদিন পড়াশুনা করেনি তার ভুল কী করে ধরবে? এই চৌদ্দ মাসে সে অ্যাকাউন্টেন্সির ওপর কতটা দখল পাবে? বারংবার মনে হচ্ছিল আয়কর অফিসার পদের জন্যে অন্তত কমার্স, গ্রাজুয়েট চাওয়া সরকারের উচিত।

তবু নতুন বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ সময়টাকে দ্রুত পার করে দিচ্ছিল। দু’-দুটো পরীক্ষা ডিঙিয়ে যেতে অসুবিধে হল না। দীপাবলী এই সময়টায় (খাটছে খুব) আটান্ন বছর বয়স পর্যন্ত যে বিষয়গুলোর মধ্যে বাঁচতে হবে তাদের নিয়ে দিন কাটিয়েছে। এবং করতে গিয়ে দেখল এরও একটা সহজ উপায় তৈরি করে রাখা হয়েছে। যেমন, একজন আয়করদাতা হিসেব দাখিল করলেন একটি অ্যাসেসমেন্ট, বছরে তিনি চার লক্ষ টাকার ব্যাবসা করেছেন। যদি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে তিনি লেনদেন করেন তা হলে সেটা তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে জানা যাবে। এবার তিনি যেসব বিভাগে খরচ দেখাচ্ছেন সেগুলো পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে হিসেব ঠিক কিনা। কোন কোন খরচ আয়কর ধারায় গ্রহণযোগ্য নয় তাও আয়কর অফিসার জানেন। ব্যাবসার মূলধন জোগাড় করার সূত্রও তিনি যাচাই করবেন। ক্রমশ ব্যাপারটা একটা ফর্মুলার পর্যায়ে চলে যাবে আয়কর অফিসারের কাছে। আর যদি ব্যাঙ্কের মাধ্যম না হয়, যদি নগদ টাকায় লেনদেন হয়, তা হলে হয় আয়কর দাতার হিসেবের ওপর নির্ভর করতে হবে, নয় গোপনে অনুসন্ধান করতে হবে যে দাখিলকরা হিসেবের বাইরে কোনও আয় আছে কিনা। একটি মানুষ এক লক্ষ টাকা রোজগার করলে যেসব ছাড় পেয়ে থাকেন সেগুলো বাদ দিতে বাকি আয়ের প্রায় চল্লিশ শতাংশ তাঁকে কর দিতে হয়। যেহেতু অঙ্কটা মোটেই কম নয় তাই হিসেব দাখিল করার সময় তিনি কিছুটা কারচুপি করেন। আয়কর ম্যানুয়াল মানে একটি গম্ভীর সাঁড়াশি। সেটি যাদের ব্যবহার করার অধিকার দেওয়া হয়েছে তাদের সঙ্গে করদাতাদের একটা গোপন সমঝোতা তৈরি হতেই পারে।

দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো যেখানে ভেঙে পড়ছে, মূল্যবোধের চেহারা যখন দ্রুত বদলাচ্ছে, তখন তার প্রতিক্রিয়া আয়কর দপ্তরে পড়তে বাধ্য। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যে আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে যখন সামঞ্জস্য ঘটছে না তখন ব্যক্তিমানুষ চোখ বন্ধ করে বাঁকা পথে পলকের জন্যে হাঁটছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে আয়করদাতাদের একাংশ। দীপাবলীর মনে হল এই বজ্র আঁটুনিতে সরকারের যতটা আয় হচ্ছে তার অনেক বেশি হত যদি ব্যবস্থাটা আরও সহজ এবং সরল হত। আয়করের চাপটা কমানো যেত, আইনের চোখ রাঙানো না হয়ে সাদা হত। একজন ব্যবসায়ী যা করে পরিত্রাণ পেতে পারেন একজন চাকরিজীবীর পক্ষে তা সম্ভব হয় না। চাকরিজীবীর আয় নির্দিষ্ট, করের টাকা তাই বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতে হয়। অথচ আয়কর কর্তৃপক্ষের চোখে তিনি এবং একজন ব্যবসায়ীর মধ্যে কয়েকটি নিয়মকানুনের তফাত ছাড়া কর প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনও ব্যতিক্রম নেই।

কলেজের শেষ মাসে দীপাবলী একটি প্রশ্ন না করে পারেনি। একজন আয়কর অফিসার হিসেবে তার কর্তব্য সরকারি কোষাগারে আয়করদাতাদের কাছ থেকে কর আদায় করে জমা দেওয়া। কিন্তু কোনও করদাতা যদি প্রশ্ন করেন কর দেবার বিনিময়ে তিনি সরকারের কাছ থেকে কী সুবিধে পাচ্ছেন। তা হলে তাঁকে কী জবাব দেওয়া হবে? তিনি তো চাইতেই পারেন জীবনধারণের ক্ষেত্রে একটু আরামে থাকবেন। কেউ এক লক্ষ টাকা রোজগার করে চল্লিশ হাজার করে দশ বছর কর দিয়ে গেলেন। বাকি যাট হাজার তাঁর এক বছরের সংসার চালাতে খরচ হল অথবা ব্যবসায় লাগল। দশ বছর বাদে তাঁর ব্যবসায় ভরাডুবি হল এবং একটি পয়সাও আয় হল না। সেই আর্থিক দুরবস্থার সময় তিনি জানেন গত দশ বছরে সরকারকে চার লক্ষ টাকা কর দিয়েছেন। এই চার লক্ষ টাকার বিনিময়ে তিনি যদি এখন সামান্য সাহায্য দাবি করেন তবে তা পূর্ণ করা সম্ভব নয়। এই লোকটি সেটা জানেন। তাই চারের বদলে দুই লক্ষ কর দিয়ে বাকি দুই লক্ষ যদি তিনি সরিয়ে রাখেন তা হলে বর্তমান ব্যবস্থা কি তাঁকে সেটা করতেই উৎসাহিত করছে না?

জবাব জানা ছিল। ভারতবর্ষ অনুন্নত অর্থনৈতিক অবস্থায় চলছে। নানান ঋণে জর্জরিত। সরকার যে-টাকা কর বাবদ পাচ্ছেন তা কিছুই নয়। আর এটুকু পাচ্ছেন বলে কোনওমতে চলে যাচ্ছে। আদায়ীকৃত কর থেকে তাই কোনও সুবিধে ব্যক্তিগত করদাতাকে দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই। সামগ্রিকভাবে একটু সবল সরকারের স্বাধীন ছত্রচ্ছায়ায় তিনি আছেন এটাকেই বিনিময়ে পাওয়া বলে তাঁকে মনে করতে হবে। যদি কখনও ভারতবর্ষ আমেরিকা বা আর্থিক উন্নত রাষ্ট্রের পর্যায়ে যেতে পারে, তা হলে করদাতাদের জন্যে নানান সুবিধের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।

বক্তব্যে কোনও ফাঁক নেই। কিন্তু একজন আয়করদাতা যখন জানেন তাঁর দেওয়া করের বিনিময়ে অনেক মানুষ উপকৃত হচ্ছে তখন তাঁর নিজেকে মহানুভব ভাবার মতো স্বাদেশিকতাবোধ আজ অবশিষ্ট নেই। দীপাবলী জানল তাকে কর্মক্ষেত্রে যন্ত্রের মতো চলতে হবে। কিন্তু সেইসঙ্গে সে স্থির করল কখনওই আপোস করবে না। সরকার তার ওপর যে-দায়িত্ব অর্পণ করছেন তা পালন করতে কোনও দ্বিধা করবে না। কিন্তু তা করতে গেলে নিজেকে আরও শিক্ষিত করতে হবে। আরও বিশদ জানতে হবে।

নাগপুরে থাকাকালীন জানা গিয়েছিল দীপাবলীর পোস্টিং দিল্লিতে হয়েছে। এর মধ্যে অলোক একবার এসেছিল নাগপুরে। সে দিন ঠিক করে রেখেছে। দিল্লির চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই সইসাবুদ হয়ে যাবে। ফলে বাসস্থানের সমস্যা নিয়ে দীপাবলীকে চিন্তা করতে হবে না।

অলোক দ্বিতীয় যে প্রস্তাব দিল সেটা নিয়ে ভাবনা হচ্ছিল। পিতা পরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে বাস করতে চায় না অলোক। প্রথম কথা ওখানে একটি শোওয়ার ঘর এবং একখানি ড্রয়িংরুম ছাড়া আর কোনও জায়গা পাওয়া যাবে না। যদিও সম্পর্ক খুবই ভাল তবু বিয়ের পর নানান কারণে সংঘাত হতে পারে। বিবাহিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অবিবাহিতদের কিছু কিছু তফাত থাকতেই পারে। দূরে সরে থাকলে যদি সম্পর্ক সুস্থ থাকে তবে সেটাই করা উচিত। দীপাবলীর কথাগুলো ভাল লাগছিল না। তার মনে হচ্ছিল দু’জনে একা একা থাকতে ভাল লাগবে না। মা বাবা ভাইবোনের সঙ্গে সুন্দরভাবে বাস করা বড় হবার পর তার ভাগ্যে জোটেনি। অলোকের মাকে তার খুবই ভাল লেগেছে। ওঁর সঙ্গে থাকতে তার কোনও অসুবিধে হবে না। মানুষ হিসেবে পরেশবাবু চমৎকার। এঁদের সঙ্গ সে পাবে না ভাবতে খারাপ লাগছিল। আর ওঁরাও তো ভাবতে পারেন যে সে ওঁদের ছেলেকে পর করে দিল। কিন্তু অলোক জানাল এই ব্যবস্থায় ওর মায়ের সমর্থন রয়েছে। তিনিও চান আলাদা থেকে সম্পর্ক ভাল রাখতে।

কিন্তু দিল্লিতে যাওয়ার আগে দীপাবলীর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একবার কলকাতায় ঘুরে আসতে। কেউ নেই সেখানে, কোনও বন্ধু বা আত্মীয়, তবু যেতে ইচ্ছে করছিল। অথচ হাতে বেশি সময় নেই। অলোকের ইচ্ছে, স্টেশন থেকে সোজা তাকে নিয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে যাবে। সেখানে বিশ্রাম এবং বেশ পরিবর্তন করে তার নিজের বাড়িতে, রেজিস্ট্রার সেখানে আসবেন। সাক্ষী রেখে বিয়ে হবে। তারপর পার্টি। ও যে দিন ঠিক করেছে তা নাকি ওর মায়ের ইচ্ছানুযায়ী। অতএব কলকাতায় গেলে এসব বানচাল হয়ে যাবে। কেন কলকাতা তাকে টানছে জানে না দীপাবলী, কিন্তু যাওয়া বাতিল করতে হল, মনে ভার জমল।

নাগপুর থেকে দিল্লিতে প্রথম শ্রেণির যে কুপেতে দীপাবলী জায়গা পেয়েছিল তা একদম ফাঁকা। ব্যবস্থাটা অলোকই করে গিয়েছিল। ভাবী স্ত্রীকে একটু আড়ালে নিয়ে আসতে চেয়েছে দিল্লিতে। তার ইচ্ছে ছিল সঙ্গী হবার, দীপাবলী নিষেধ করেছিল। একা ছুটন্ত ট্রেনের কামরায় বসে কী করবে বুঝে উঠছিল না সে। সঙ্গে পত্রিকা আছে কিন্তু তা পড়ার মতো মনের অবস্থা নেই। অলোক দিল্লি থেকে নাগপুরে এসে আবার তাকে নিয়ে ফিরে যাবে, এ কেমন কথা। এটুকু পথ যে সে একাই যেতে পারে তা অনেকবার প্রমাণিত। কিন্তু আজ সে আবিষ্কার করল মস্তিষ্ক যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। কিছুই ভাবতে পারছে না। আগামী দিনগুলো তার জীবনে নতুনভাবে আসছে। সে একজনের স্ত্রী হবে। এতদিনের লড়াই করা দিনগুলোর অবসান ঘটল।।

ঠিক আনন্দিত বলতে যা বোঝায় তা কেন সে হতে পারছে না বুঝতে পারছিল না দীপাবলী। বরং তিরতির করে একটা চোরা ভয় ঢুকছিল মনের আনাচে-কানাচে। এত বছর এইভাবে একা থাকার পর অলোকের সঙ্গে থাকতে কোনও বিরোধ ঘটবে না তো? দীপাবলী মাথা নাড়ল। না। অলোক ভদ্র, মার্জিত, শিক্ষিত। মতে না মিললেও সে কোনও ব্যাপার নিয়ে ওর সঙ্গে বিরোধে যাবে না।

স্টেশনে যে এত লোক থাকবে তা ভাবতে পারেনি দীপাবলী। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই অলোকের পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘ওয়েলকাম। দিল্লি ধন্য হল।’

দীপাবলীর গালে রক্ত জমল। অলোকের কয়েকজন বন্ধু এবং তাঁদের স্ত্রীরাও এসেছেন তাকে রিসিভ করতে। একটি সুদর্শনা মহিলা এগিয়ে এসে তার হাত ধরলেন, ‘আসুন ভাই। এদের ঠাট্টা রসিকতায় কান দেবেন না। বাড়িতে চলুন। ওখানে বিশ্রাম নেওয়ার পরে গল্প করব।’

অলোক কিছু বলল না। নতুন বরেরা যেমন বিয়ের দিন কিছু বলে না তেমনভাবে হাসতে লাগল। দীপাবলীর অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছিল। যেন তারই বিয়ে হচ্ছে, অলোকের নয়, সবাই এমনভাবে তাকাচ্ছে!

স্টেশনের বাইরের অনেকগুলো গাড়ির একটাতে উঠতে হল দীপাবলীকে। এবার অলোক এগিয়ে এল, ‘আমি আর যাচ্ছি না। তুমি আপাতত গোবিন্দ-শুভ্রার বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নাও। ফোনে কথা বলে নেব।’

শুভ্রা তার পাশে বসে বলে উঠল, ‘ঠিক আছে, আর চিন্তা করতে হবে না মশাই, আপনার ভাবী স্ত্রীকে মোটেই অযত্ন করব না।’

স্টিয়ারিং-এ বসে গোবিন্দ বলল, ‘এই প্রথম তোমাকে আনস্মার্ট লাগছে অলোক।’ অলোক হেসে সরে গেল অন্য গাড়ির দিকে। দীপাবলীর ভাল লাগল।

করলবাগের পুসা রোডে গোবিন্দ-শুভ্রার বাড়ি। বাবা-মা নেই। বাচ্চাকাচ্চা নেই। বন্ধুবান্ধবরা এমন জায়গায় আড্ডা জমাতে আসে। গোবিন্দ তাদের নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজ সারতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। শুভ্রা ঘরে ঢুকে বলল, ‘এই হল আমার বাড়ি। বিয়ের পর ছ’মাস শাশুড়িকে দেখেছি। তারপর তিনিও চলে গেলে একদম একা। তাই ওর বন্ধুরা যে যখন পারে চলে আসে, আমাদেরও সময় কাটে। আপনি একটুও সংকোচ করবেন না। এটা আমাদের গেস্টরুম। পাশে বাথরুম টয়লেট আছে। রেস্ট নিয়ে চেঞ্জ করে বলবেন, খাবার দেব।’

দীপাবলী না বলে পারল না, ‘শুধু শুধু আপনাদের ওপর—!’

‘আবার সংকোচ। আপনি দেখতেই পাবেন। শনিবার রাত দুটো-আড়াইটে পর্যন্ত সবাই পার্টি করবে, কাঁপা হাতে নিজের ডিশ ধোবে, তারপর হইহই করে বাড়ি ফিরবে। যার বেশি খাওয়া হয়ে যায় তাকে গাড়ি চালাতে দেয় না গোবিন্দ। কেউ কেউ থেকেও যায় এখানে।’ শুভ্রা হাসল।

কথাটা কানে ঠেকেছিল, দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘ডিশ ধোয় কীরকম?’

‘ওঃ এটা ওরাই করে নিয়েছে। এক্কেবারে আমেরিকান স্টাইল। পার্টির দিন আমি খাবারদাবার করে টেবিলে সাজিয়ে দিই। ওরা নিজেরাই প্লেটে তুলে নেয়। খাওয়ার পর বেসিনে যায় ধুতে। ধুয়ে রেখে গেলেও পরে অবশ্য আমাকে ধুতেই হয়।’

কে যেন বলেছিলেন, চিনতে পারার কতগুলো সূত্র আছে। পায়ের গোড়ালি দেখলে মেয়েটির স্বরূপ বোঝা যায়। ময়লা গেঞ্জি একটি পুরুষের রুচি সম্পর্কে যেমন ধারণা দেয় ময়লা পেটিকোটও নারীকে নোংরা করে। তেমনি কারও বাড়িতে গিয়ে বাথরুম দেখলে সেই বাড়ির মানুষদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব। আর যাই হোক, সুন্দর পরিষ্কার শুকনো বাথরুম যাঁরা পছন্দ করেন তাঁরা অবশ্য রুচিবান মানুষ। শুভ্রাদের বাথরুমে ঢুকে এ-কথাই মনে হল। দেওয়াল জুড়ে বেসিন, একপাশে লম্বা বাথটব, দেওয়াল চাপা আলো, পরদা, কমোড এবং সবকিছুই ঠিকঠাক গোছানো। নীচে ঘাসের কার্পেট পাতা, অর্থাৎ কেউ জল ফেলে স্যাঁতস্যাঁত করে রাখে না। এরকম একটা বাথরুমের কথা প্রায়ই বলতেন অমরনাথ। বলতেন, সাহেবরা বাথরুমকে খুব পবিত্র জায়গা বলে মনে করে। আমাদের বাথরুমগুলো হল দুর্ঘটনা ঘটার ফাঁদ। জল ছিটিয়ে পিছল করে রাখি। এসব সত্ত্বেও এখন নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ সতর্ক হতে হল দীপাবলীকে।

শুভ্রার সঙ্গে খাবার খেতে হল। এদের ফ্ল্যাটটি চমৎকার। খেতে খেতে শুভ্রা জিজ্ঞাসা করল, ‘সন্ধেবেলায় কে কে সই করবে তার জন্যে গতকাল টস হয়েছে, জানেন? আচ্ছা, আপনার তরফ থেকে কেউ থাকবেন না?’

উত্তর দেবার আগে টেলিফোন বাজল। শুভ্রা টেবিল ছেড়ে রিসিভারে কয়েকটা কথা বলে ইশারায় তাকে ডাকল। একটু বিস্মিত হয়েই দীপাবলী এগিয়ে গেল। রিসিভার কানে রেখে বলল, ‘হ্যালো!’

‘কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? অলোকের গলা।

‘না না।’ দীপাবলী লজ্জা পেল।

‘আমি ভাবলাম—। ঠিক আছে, রাখছি। রেস্ট নাও।’

রিসিভার রাখার শব্দ হতে দীপাবলীর ঠোঁটে হাসি ফুটল। শুভ্রা জিজ্ঞাসা করল, ‘বাঃ, এটুকু? এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল?’ দীপাবলী জবাব দিল না।

গেস্টরুমের বিছানায় শুয়েছিল দীপাবলী। ট্রেন জার্নি সত্ত্বেও শরীর ঘুমাতে চাইছে না। শুভ্রা একটা ইংরেজি কাগজ দিয়ে গিয়েছিল। সেটা নিয়ে অন্যমনস্ক হতে চাইল সে। নতুন কোনও খবর নেই। মন্ত্রীরা বড় বড় আশার কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। কলকাতায় বামপন্থীরা ধর্মঘট করেছে। হঠাৎ সিনেমা থিয়েটারের কলমে নজর পড়তেই সে চমকে উঠল। কলকাতার থিয়েটার দিল্লিতে, আগামীকাল এবং পরশু। দলের এবং পরিচালকের নাম দেখে খুব ভাল লাগল। যাক, শমিত শেষপর্যন্ত দিল্লির দর্শকদের কাছেও পৌছাতে পারছে। আর যাই হোক, নাটকের ব্যাপারে ওর জেদ পরিশ্রম এবং সততা নিয়ে কখনও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কোনও মানুষের যদি এই তিনটের সঙ্গে প্রতিভা থাকে, জীবন তাকে সাফল্য দেবেই। শমিতের ক্ষেত্রে যা হয়েছে।

এইসময় শুভ্রা এল, ‘কী? উত্তেজনায় ঘুম আসছে না?’

‘না, তা নয়।’ খবরের কাগজ সরিয়ে রাখল দীপাবলী।

‘কী শাড়ি পরা হবে তা ঠিক করি চলুন। নাকি এখানেই আনব?’

‘আনবেন মানে?’

‘ও হরি! আপনার ভাবী বর একগাদা বাজার করেছেন। বিয়ের শাড়ি, ফুলশয্যার শাড়ি, কত কী? শুধু জামার মাপ নেওয়া হয়নি বলে আমার মাপে করিয়েছে। বলল একইরকম ফিগার। আমারও মনে হচ্ছে ভুল বলেনি।’

‘যা হোক একটা পরলেই তো হল।’

‘মোটেই না। বেস্ট জিনিস পরতে হবে।’

দীপাবলী কথা ঘোরাল, ‘আচ্ছা, এখানে বাংলা নাটক খুব হয়, না?’

‘খুব। এখানকার কয়েকটা দল তো ভালই করে। কলকাতা থেকেও আসে। এই তো এবারই আমাদের করলবাগে কলকাতা থেকে একটা মাঝারি দল এসেছে। কলকাতায় নাকি খুব নাম করেছে ওরা। কাল পরশু শো।’

‘ওরা কি এসে গেছে?’

‘ঠিক জানি না। কেন বলুন তো?’

‘যিনি পরিচালক তিনি আমার পরিচিত। একসময় ওই দলে আমি কিছুদিন অভিনয় করেছিলাম।’ দীপাবলী হাসল।

‘দাঁড়ান, জেনে বলছি।’ শুভ্রা বেরিয়ে গেল। হঠাৎ দীপাবলীর মাথায় একটা ভাবনা এল। একটু দ্বিধাও সেইসঙ্গে। ব্যাপারটা শমিত কীভাবে নেবে বোঝা যাচ্ছে না। এইসময় শুভ্রা ফিরে এল, ‘হ্যাঁ ওরা আজই এসেছে। করলবাগের একটা গেস্টহাউসে উঠেছে সবাই। এই হল নম্বর।’ ছোট্ট একটা কাগজে টেলিফোন নম্বর লেখা, এগিয়ে দিল শুভ্রা।

দীপাবলী খাট থেকে নেমে এল, ‘একটা টেলিফোন করতে পারি?’

‘অবশ্যই।’ শুভ্রা ওকে নিয়ে ঘর থেকে বের হল।

ডায়াল ঘোরাতেই গেস্টহাউসের কেয়ারটেকার ইংরেজিতে কথা বললেন। দীপাবলী তাঁকে শমিতের কথা বলতে তিনি ধরতে বললেন। মিনিট দুয়েক বাদে শমিতের গম্ভীর গলা পাওয়া গেল, ‘হ্যালো? কে বলছেন?’

‘আমি দীপাবলী।’

এক মুহূর্ত চুপচাপ, তারপরই উচ্ছ্বাস, ‘আরে ব্বাবা! তুমি কোথায়?’

‘দিল্লিতেই। কাগজে দেখলাম নাটক করতে এসেছেন।’

‘এসেছেন? ও, ঠিক আছে। হ্যাঁ। কল শো পেয়েছি। দেখা হচ্ছে কখন?’

‘আজ সন্ধ্যায় কী করছেন?’

‘একটু বাদে হলে যাব। সন্ধেবেলায় স্টেজ পাওয়া গেল না তাই বেকার।’

‘একটু আসবেন?’

‘কোথায়?’

শুভ্রার কাছে ঠিকানা জেনে জানিয়ে দিল সে, ‘আপনার ওখান থেকে খুব দূরত্ব নয়। খুব দরকার আছে।’

‘কী ব্যাপার? আমি এখানে এসেছি কাগজ দেখে জেনেছ। অতএব খুব দরকারটা কী করে এখনই হয়ে গেল?’ শমিতের গলায় কৌতুক।

‘আপনার মিসেস কি সঙ্গে এসেছেন? তা হলে তাঁকেও আনতে হবে।’

‘ না, আমি একাই এসেছি।’

‘উনি দলে নেই?’

‘ না। কিন্তু ব্যাপারটা কী?’

দীপাবলী নিশ্বাস ফেলল, ‘না এলে বলব না। ঠিক পাঁচটার মধ্যে চলে আসুন। আপনি আমার একটা উপকার করবেন?’

‘কী ধরনের?’

‘ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনার কাছে একবার চাকরি ছাড়া কিছু চাইনি কখনও। দিল্লিতে আমার নিজের কেউ নেই। আপনি আমার বন্ধু ছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় আমাকে মায়ার বাড়িতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই দাবিতেই—।’

‘ঠিক আছে, বলতে হবে না। আমি ঠিক পাঁচটায় পৌঁছে যাব।’ শমিত খুব সহজ গলায় জানাল।

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন