৩৭. হাওড়া স্টেশনে

সমরেশ মজুমদার

হাওড়া স্টেশনে ট্রেনটা থামামাত্র দীপাবলীর মনে হল হাত থেকে জলভরা স্টেনলেসের গ্লাস মেঝেতে পড়ে গেলে যেভাবে জল ছিটকে যায় ঠিক সেইভাবে গলগল করে যাত্রীরা বেরিয়ে যাচ্ছে। এত মানুষ চারপাশে, সবাই বাংলা বলছে, অথচ কেউ তার পরিচিত নয়। কাউকে আত্মীয় ভাবতে একটুও ইচ্ছে করছে না। মুখগুলো কী নির্মম, কাজ হাসিলের জন্যে যেন সবকিছু এরা করতে পারে। অথচ এরা কারও ভাই কারও ছেলে কারও স্বামী। ছুটে চলার সময় গায়ে ধাক্কা লাগলেও দুঃখ প্রকাশ করার কোনও বালাই নেই। নিজের বিপত্তি খুব সামান্য হলেও হুংকার দিয়ে উঠছে কেউ কেউ। দীপাবলী ট্রেনের জানলায় চোখ রেখে এদের দেখছিল। দিল্লি স্টেশনেও এমন অসহিষ্ণু মানুষের ভিড় নজরে পড়ে না। কলকাতা বা পশ্চিমবাংলা বললেই বাইরে থাকলে মনের মধ্যে এক ধরনের আনন্দিত কাঁপুনি তৈরি হয়। কিন্তু হাওড়া স্টেশনে এসে ওর একটুও আনন্দ হচ্ছিল না। এই মানুষদের শহরে তাকে থাকতে হবে যাদের মুখোশটাই ধীরে ধীরে মুখ হয়ে যাচ্ছে।

অলোক কুলিদের নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবার বলল, ‘আমাদের নামতে হবে।’

দীপাবলী উঠল। নিজের শরীর খুব ভারী লাগছিল। ট্রেনে একটুও ঘুম হয়নি এবার। সে গম্ভীর মুখে অনুসরণ করল। গতবার দিল্লি যাওয়ার সময় প্রায় প্রতিটি স্টেশনে অলোক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। একই কামরায় যাওয়া হচ্ছে না বলে আফশোস করেছিল। কিন্তু এবার একই সঙ্গে পাশাপাশি ফেরা। অলোকের মনে সেই ঘটনাটা নিশ্চয়ই ছিল নইলে কেন বলবে, সেই ভাল ছিল। তোমার আমার কামরা আলাদা। মাঝে মাঝে আমি তোমার খবর নিয়ে ফিরে যাব। পাচ্ছি না বলে আফশোস করব কিন্তু তাতে এমন পুতুলের মতো পাশাপাশি বসার কষ্টটা থাকবে না।’ দীপাবলী চুপ করে ছিল। সেই প্রথম এবং শেষ। অলোক নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে আর একটিও কথা বলেনি। বরং পুরো পথটায় চমৎকার ব্যবহার করেছে। কোনও ব্যাপারে যেন তার অসুবিধে না হয় তা লক্ষ রেখেছে। এই মানুষটিকে সে বিয়ের আগে খুব ভালরকম চিনত। এমন মানসিকতার একটি লোককে তার স্ত্রী ছেড়ে চলে আসছে জানলে বিশ্বসুদ্ধ লোক তার সমালোচনা করবে। অথচ বিয়ের পর এই সময়টায় ওই অলোক একটু একটু করে কেমন পালটে গেল, কীভাবে অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল তা বাইরের লোক জানবে না। দীপাবলী অনেকবার নিজেকে একটা প্রশ্ন করেছে। মানিয়ে না-চলার অক্ষমতা কি শুধু অলোকের? তার নিজের কোনও দোষ নেই? তার ভেতরে কি অনেক সময় উন্নাসিকতা কাজ করেনি? অথবা শীতলতা। আচমকা কোনও কিছু মনের বিরুদ্ধে গেলেই সে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নেয় কেন? প্রতিটি মানুষ নিজের স্বপক্ষেই উত্তর দিতে ভালবাসে। দীপাবলীও দিয়েছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর শুধু এক রাত্রে গাড়িতে বসে খারাপ ব্যবহার করা ছাড়া অলোককে দেখে মনে হয়েছে সে যেন মুক্তির আনন্দ পাচ্ছে। এই যে তাকে পৌঁছে দিতে আসা সেটাও সেই আনন্দেরই প্রকাশ। এমনই ঠিক, তার এবং অলোকের স্বভাবে নেই মিলিত জীবনের দায় বহন করা। কিন্তু এসব কথা নিজের মধ্যেই রেখে দিতে হবে বাকি জীবন। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই তার কেবলই মনে পড়ছে না মিত্রের কথা। পঙ্কজান্দার সঙ্গে ওই একটাই সন্ধে তারা কাটিয়েছে। তবু ভদ্রমহিলাকে তার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। নন্দা বলেছিলেন, ‘ভাই, কোনও বাঙালি মেয়ে যখন নিতান্তই উপায় থাকে না তখনই স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাইরে পা বাড়ায়।’ কিন্তু এই কথাটা তো তার নিজের ক্ষেত্রে সত্য নয়। তাকে তো অলোক বাধ্য করেনি চলে আসতে। নিতান্তই উপায় থাকে না কথাটা অবশ্য খুব গোলমেলে। কারও ক্ষেত্রে সামান্যতে তা মনে হতে পারে কেউ আবার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে। কিন্তু বিয়ে করা আর একসঙ্গে বাস করার মধ্যে মানসিকতার রূপান্তর ঘটতে পারে তা জানা ছিল না।

ট্যাক্সির লাইনে দীপাবলী এইসব ভেবে যাচ্ছিল। অলোক তার সামনে দাঁড়িয়ে। মালপত্র নিয়ে কুলিরা। লাইনটা এগোচ্ছে না অনেকক্ষণ। অথচ এ নিয়ে কারও কোনও চিন্তা নেই। সামনের এক ভদ্রলোক বললেন, ‘অনেকক্ষণ গাড়ি আসছে না, বোধহয় বড়বাজারে জ্যাম হয়েছে।’

‘বড়বাজার মানে?’ অলোক জিজ্ঞাসা করল।

‘বাইরে থাকেন বুঝি? গেটওয়ে অফ ক্যালকাটা। ওয়ান অফ দি মোস্ট ইনডিসিপ্লিনড, ঘিঞ্জি এলাকা। দেখলে মনে হবে পশ্চিমবাংলা নয়। রাস্তা সরু, যে যার মতো তা আটকে রাখে তাই জ্যামটা হয়ে যায়। ট্যাক্সি পেলে দেখবেন পেরোতে একঘণ্টা লাগবে।’ বেশ জব্বব খবর দিচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন ভদ্রলোক।

দীপাবলীর অবাক লাগল। অলোক কি জেনেশুনে ভান করছে? যে-লোক এতবার হাওড়া দিয়ে কলকাতায় ঢুকেছে সে বড়বাজারের নাম শোনেনি? মাহাত্ম্য জানে না? নাকি ভদ্রলোকের মুখ থেকে কথাগুলো শোনার জন্যে অমন ভাব দেখাল। সে লাইনটার দিকে তাকাল। অন্তত শ’দেড়েক লোক দাঁড়িয়ে। দুটো ট্যাক্সি এসে থামতেই লাইন ভেঙে কিছু লোক হইহই করে এগিয়ে যাচ্ছিল। একজন পুলিশ তাদের সামলাতে পারছিল না। অলোক বলল, ‘অসম্ভব। ট্যাক্সির জন্যে অপেক্ষা করতে হলে এক জন্ম কেটে যাবে। কলকাতার মানুষ এত ধৈর্য কোথায় পায় বলো তো?’

এইসময় দালালগুলোকে দেখা গেল। শ্রবণসীমায় এসে গুনগুন করে বলছে, ট্যাক্সি চাই দাদা, প্রাইভেট ট্যাক্সি।’

অলোক উৎসাহিত হল, ‘এই যে ভাই?’

লোকটি সুড়ুত করে কাছে চলে এল।

অলোক জিজ্ঞাসা করল, ‘লেকগার্ডেন্স যাব। গাড়ি আছে?’

‘আছে। পঞ্চাশ টাকা লাগবে।’

সেই ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, ‘কী? দশ টাকাও মিটারে ওঠে না আর পঞ্চাশ চাইছ? নতুন লোক পেয়ে টুপি পরানোর মতলব?’

দালালটি বলল, ‘এই যে দাদু, আপনার সঙ্গে কে কথা বলছে। যার দরকার তাকে বলেছি, যেতে ইচ্ছে হলে যাবে নইলে না। অত কথা কীসের?’

অলোক জিজ্ঞাসা করল, ‘একটু কম করা যায় না?’

‘না দাদা! একটু বাদে আর রাস্তায় ট্যাক্সি পাবেন না। বেহালায় এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ঝেড়েছে, ওরা গাড়ি তুলে নিচ্ছে। যেতে হলে চলুন। ওপাশে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।’

অলোক দীপাবলীর দিকে তাকাল, ‘অগত্যা—, কী বলো?’

দীপাবলী মাথা নাড়ল, ‘না। আমি অত টাকা দিতে পারব না।’

‘আঃ, টাকার কথা তুলছ কেন?’

‘নিশ্চয়ই, আমার প্রয়োজনে তুমি কলকাতায় এসেছ। টাকাটা তাই আমি দেব।’

কাঁধ নাচাল অলোক। ওর মুখের চেহারা পালটাচ্ছে। অর্থাৎ স্বরূপটাও পালটাতে শুরু করবে এখনই। দীপাবলী অপেক্ষা করল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল অলোক নিয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দীপাবলীর কষ্ট হচ্ছিল দাঁড়াতে কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করল না।

দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে ওরা লাইন থেকেই ট্যাক্সি পেল। মালপত্র তুলে ট্যাক্সিতে বসে মনে হল বাঁচা গেল। অলোক জিজ্ঞাসা করে সর্দারজি ড্রাইভারের কাছে জানল কয়েকটা বড় মিছিলের জন্যে শহরে জ্যাম হয়েছে। বেহালার ব্যাপারটা ভদ্রলোক শোনেননি। অলোক চিড়বিড় করল, ‘লোকটা ভাঁওতা দিয়ে আমাদের নিতে চাইছিল।’ দীপাবলী কিছু বলল না।

হাওড়া ব্রিজ পার হবার আগেই গাড়ি দাড়িয়ে গেল। সামনে বড় বড় লরি, বাস, মিনি, ট্রাম থেকে ঠেলা কোনও কিছুই বাদ নেই। সমস্ত শহর স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু এ-ব্যাপারে কারও কোনও দুশ্চিন্তা নেই। ট্যাক্সির মিটার উঠছে। অলোক মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘দিল্লি ছেড়ে কোথায় এলে দ্যাখো। একমাত্র উন্মাদ হয়ে গেলেই কলকাতায় থাকা যায়।’

দীপাবলী হাসল, ‘আমি নিজে থেকে আসিনি, আমাকে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। আর সবকিছুই ধীরে ধীরে অভ্যেসে এসে যায়। প্রথম প্রথম যা খারাপ তা পরে তেমন লাগে না।’

অলোক সুযোগ নিল, ‘কথাটা সত্যি নয়। আমাদের ক্ষেত্রে তো নয়ই।’

দীপাবলী মুখ ঘুরিয়ে নিল। এ-প্রসঙ্গে কথা বলার মতো শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। তার চোখ পড়ল গঙ্গার ঘাটে। সেখানে কিছু লোক স্নান করছে। অদূরেই জলে কিছু একটা ভেসে যাচ্ছে। দুটো কাক তার ওপরে বসে পরমানন্দে ঠুকরে চলেছে। স্নানার্থীরা এ নিয়ে একটুও মাথা ঘামাচ্ছে না। কোথায় যেন পড়েছিল দীপাবলী ঈশ্বরকে পেতে হলে চারপাশের সমস্ত কিছু উপেক্ষা করতে হয়। নির্লিপ্ত হয়ে নিজের কাজ করে যাও। এখন মনে হচ্ছে কলকাতার মানুষেরা ওইভাবে স্বর্গের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে।

দেড় ঘণ্টা সময় লাগল পৌঁছাতে। তার পরেও কিছুটা সময় বাড়িটাকে খুঁজে বের করতে গেল। অলোক হোটেলে উঠতে চেয়েছিল, দীপাবলী রাজি হয়নি। কলকাতার হোটেলে দু’জনে দুটো ঘর নিলে অনেক কৌতূহল তৈরি হবে। তা ছাড়া, হোটেলে পৌঁছে অলোক যদি দুটো ঘরের প্রস্তাব উড়িয়ে দেয় তা হলে আর একটা সমস্যা হবে।

দারোয়ানকে ডেকে চিঠিপত্র দেওয়ার পর জানা গেল তারা ইতিমধ্যে খবর পেয়ে গিয়েছে। সিঁড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দীপাবলী খুশি। ঘরগুলো সুন্দর, জানলা খুলে দিতেই অনেক আলো অনেক হাওয়া হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল। বাথরুমেও পর্যাপ্ত জল। কিন্তু সমস্যা হল ফ্ল্যাটে কোনও ফার্নিচার নেই। বসার জায়গা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। অলোক বিরক্ত গলায় বলল, ‘এভাবে চলে এসে কী লাভ হল?’

‘কালকের মধ্যে কিছু কিছু কিনে নেব।’

‘কালকের কথা কালকে। আজ কী হবে?’

দারোয়ান চুপচাপ শুনছিল। সে বলল, ‘পাশের ফ্ল্যাটে ফার্নিচার খাটটাট সব আছে। ওর চাবিও আমাদের কাছে। কেউ নেই ওখানে। আজকের রাতটা ইচ্ছে করলে ওখানে থেকে সব ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।’

লোকটাকে দেবদূত বলে মনে হচ্ছিল। অলোক ওকে কিছু টাকা দিল খাবার আনার জন্যে। পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়ে চলে গেল লোকটা। ভেতরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ল অলোক, ‘আঃ কী আরাম।’

নিজের সুটকেস দ্বিতীয় ঘরটায় নিয়ে গিয়ে দীপাবলী দেখল সেখানেও খাট-বিছানা পাতা আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যবহার করা হয়নি অনেকদিন। দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও একটা ধুলোটে গন্ধ লেগে রয়েছে। তবু এই ভাল।

স্নান শেষ করে পরিষ্কার হয়ে দারোয়ানের আনা ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন খেল ওরা। অলোক জিজ্ঞাসা করল, ‘বিকেল হয়ে আসতে দেরি নেই। বেরুতে পারবে?’

‘বেরুতে তো হবেই।’

‘আমি ভাবছি এত জিনিসপত্র একসঙ্গে কী করে কিনবে?’

‘দেখি।’

‘আমি তোমাকে সাহায্য করলে আপত্তি করবে?’

‘হ্যাঁ। হঠাৎ চা খাওয়ালে অথবা দারোয়ানকে খাবার আনতে টাকা দিলে, এটা মেনে নেওয়া যায়। এই নিয়ে তর্ক করা অসভ্যতা। কিন্তু জীবনযাপনের জন্যে আমার যা প্রয়োজন হবে সেটা নিজেই করতে চাই।’ দীপাবলী শান্ত গলায় জানাল।

একটা লিস্ট করা হল। কয়েকটা কাপ প্লেট, রান্নার জিনিসপত্র, স্টোভ, একটা খাট আর একটা সাফা কাম বেড, জলের গ্লাস, জাগ, অন্তত চারটে চেয়ার আর একটা টেবিল, এক সেট তোষক গদি বালিশ চাদর অবিলম্বে দরকার। ট্রেনযাত্রার ক্লান্তিটা তখনও শরীরে, কিন্তু এখনই কেনাকাটা না করলে ওই ফ্ল্যাটে থাকা যাবে না। আলোকেব হাবভাবে আলস্য থাকলেও সে বাজি হতে বাধ্য হল। দীপাবলীর মনে পড়ল এর আগে কলকাতায় থাকার সময়ে সে পার্ক স্ট্রিট, ওয়েলিংটন এলাকায় বেশ কিছু ফার্নিচারের দোকান দেখেছিল। কেউ একজন বলেছিল ও-পাড়ায় অকশন হাউসগুলোতে খুঁজলে ভাল ফার্নিচার সস্তায় পাওয়া যায়। হয়তো সেগুলো একদা ব্যবহৃত কিন্তু এবা রং টং করে এমন সুন্দর রাখে যে পুরনো বলে মনে হয় না।

ট্যাক্সি নিয়ে ওরা প্রথমে পার্ক স্ট্রিট পাড়ায় চলে এল। অলোকের খুব আপত্তি ছিল সেকেন্ড হ্যান্ড খাট টেবিল চেয়ার কেনায়। কিন্তু জিনিসগুলো দেখার পর সে আকৃষ্ট হল। এমন অনেক আসবাব আছে যা দেখলেই বাড়িতে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সেগুলো এখনও চমৎকার মজবুত। আর এখানে এসে দীপাবলীর মনে এল লিস্টে একটা অবশ্য জিনিসের নাম বাদ পড়ে গিয়েছে। সেটা একটা আলমারি। কাপড়চোপড় থেকে যা কিছু মূল্যবান তা রাখার জন্যে ওটা চাই-ই।

দাম করতে গিয়ে ফাঁপরে পড়ল সে। অনেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা স্টিলের আলমারি, মোটামুটি চলনসই, বারোশো টাকার নীচে হচ্ছে না। খাটটার দাম চাইছে আটশো। সব মিলিয়ে এ-পাড়াতেই তিন হাজার খরচ হয়ে যাবে। একজন সেলসম্যান পরামর্শ দিল সাময়িক কাজ চালানোর জন্যে ফার্নিচার ভাড়া করে নিয়ে যেতে পারে। এসবের জন্যে মাসে তিনশো টাকা দিলেই চলবে। কলকাতার অনেকেই তাই করেন, বিশেষ করে যাদের বদলির চাকরি অথবা শহরে অল্প কয়েক মাস থাকেন। কিন্তু দীপাবলী কিনেই নিল। ব্যাগ থেকে সঞ্চয়ের অনেকটাই বের করে দিল সে। এরাই আগামীকাল ভোরে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে আসবে জিনিসগুলো।

অলোক আপাতত ভূমিকাবিহীন। সে এখন কোনও পরামর্শও দিচ্ছে না। দীপাবলী যখন টাকা গুনছিল তখন তার চোয়াল শক্ত হয়েছিল। তার যে কিছুই করার নেই, করতে চাইলেও প্রত্যাখ্যাত হবে, সেটা জানার পর নিজেকে নির্লিপ্ত রাখা ছাড়া উপায় নেই এবং সেটাই কষ্টকর।

রাসেল স্ট্রিট আর পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে দাড়িয়ে অলোক বলল, ‘একটু চা খাওয়া যেতে পারে?’

তেষ্টা পেয়েছিল দীপাবলীরও। সে মাথা নাড়ল। এদিকে ছোটখাটো কোনও দোকান নেই। হাঁটতে হাঁটতে পরের পর বার কাম রেস্তোরাঁর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দীপাবলী বলল, ‘তোমার রসদ এখানে সর্বত্র। ইচ্ছে করলে ঢুকতে পারো।’

অলোক হাসল, ‘আমি বারে বসে মদ খাই না। পেশাদার মাতাল বলে মনে হয়। অবশ্য তুমি যদি যেতে চাও তা হলে আমার আপত্তি নেই।’

দীপাবলী হজম করল। কাউকে চিমটি কাটতে গিয়ে পালটা চিমটি খেলে সেটা করতেই হয়। দিল্লিতে সে মদে চুমুক দিয়েছে অলোকের সঙ্গে পার্টিতে গিয়ে অলোক সেই খোচাটা দিল। মদ খেতে প্রথমে তার ভাল লাগেনি। বাঙালি মেয়ের রক্তে মদ খাওয়া সম্পর্কে অনেক আপত্তি মিশে থাকে। কোনও বাঙালি মেয়ে মদ খাচ্ছে মানে সে চরিত্রহীনা এমন একটা ধারণা কয়েক পুরুষ ধরে চলে আসছে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বোস ইউরোপে শীতের কারেস ব্রান্ডি খেয়েছেন, সৈয়দ মুজতবা আলি মদ্যপান করতেন নিয়মিত, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি কাজের শেষে মদের গ্লাসে চুমুক দেন জানা সত্ত্বেও তাঁদের বাঙালি চরিত্রহীন বলে মনে করে না।

ফ্লুরিজে ঢুকে কোণের টেবিলে বসতে বসতে অসীমের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এমনটা দীপাবলী কল্পনাও করেনি। অথচ রেস্টুরেন্টে ঢোকার সময় ওর কথা মনে পড়েছিল। এখানে সে অসীমের সঙ্গেই এসেছিল চা খেতে। একেই কি বলে কাকতালীয় ব্যাপার? অসীম বসে ছিল এক মহিলার সঙ্গে। তিনি যথেষ্ট সুন্দরী এবং আধুনিকা। অন্তত পোশাক এবং কেশবিন্যাসে তাই মনে হয়। বসামাত্র অসীমের সঙ্গে চোখাচোখি হল। ওর চোখের বিস্ময় তিন টেবিলের ব্যবধানেও বুঝতে অসুবিধে হল না। অলোক বলল, ‘বাঃ বেশ ভদ্র পরিবেশ তো।’

দীপাবলী কাছে আসা বেয়ারাকে চা আর প্যাটিস আনতে বলল। হয়তো শীততাপনিয়ন্ত্রিত বেস্টুরেন্টে শিক্ষিত ভদ্র খদ্দের চারপাশে ছড়িয়ে আছে বলে অলোক আরাম বোধ করছিল। বলল, ‘কলকাতায় এসে এটার নাম শুনেছিলাম, আজ প্রথমবার ঢুকলাম।’

দীপাবলী বলল, ‘আমি দ্বিতীয়বার। ওই যে ওপাশে যে ভদ্রলোক এক সুন্দরীর সঙ্গে বসে আছেন তার সঙ্গে প্রথমবার এসেছিলাম। আমরা সহপাঠী ছিলাম।’

অলোক মুখ ফিরিয়ে অসীমকে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘উনিই কি তোমার সেই প্রথম প্রেমিক? অসীম না কী যেন নাম?’

‘প্রেমিক নয়। বন্ধু। তবে ওর ইচ্ছে ছিল, আমার মনে শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেটা আসেনি। যা আমার কাছে শুনেছ তা সত্যি। এখন সত্যিটাকে ইচ্ছে করে বিকৃত কোরো না।’

‘আঃ, রসিকতাও নিতে পারো না?’

‘তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে এখন আর রসিকতা চলে না।’

‘আই অ্যাম সরি।’

বেয়ারা খাবার নিয়ে এল। ওরা চুপচাপ খাচ্ছিল। এইসময় দীপাবলী দেখল সুন্দরীকে সঙ্গে নিয়ে অসীম ওদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে। সে সোজা হল।

উলটোদিকে দাঁড়িয়ে অসীম হাসল, ‘বিরক্ত করছি। কিন্তু তোমাকে দেখে সেটা না করে পারছি না।

‘না না বিরক্ত কীসের। কেমন আছ?’ দীপাবলী জানতে চাইল।

‘ভাল। তুমি এখন কলকাতায়?’

‘হ্যাঁ। আজ থেকে। দিল্লিতে ছিলাম।’

‘আই সি! তোমার আর খবর কী?’

‘চলে যাচ্ছে। চাকরি করছি। ইনকামট্যাক্স।’

‘আচ্ছা? কী পোস্টে আছ?’

‘আমি আই আর এস পেয়েছিলাম।’

‘তাই বলো। তা হলে তো তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই হয়। বাই দ্য বাই, এ হল পত্রলেখা। গতমাসে আমরা বিয়ে করেছি।’

পত্রলেখা মাথা ঝুকিয়ে হাসতেই সেটা ফিরিয়ে দিয়ে দীপাবলী বলল, ‘আপনারা দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে?’

পত্রলেখা অসম্ভব ন্যাকা গলায় বলল, ‘ননা। আমার চায়ের হ্যাবিট নেই। অসি বলছিল আপনার কথা। আপনার মতো ফাইটিং স্পিরিট বাঙালি মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় না তাই আলাপ করতে এলাম। আমাদের আবার একটু বাদেই ক্লাবে যেতে হবে।’

‘ও, আচ্ছা।’

হঠাৎ অসীম বলল, ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়েথা করেছ?

দীপাবলী চট করে নিজের হাত দেখল। সেখানে সোনা বাঁধানো নোয়াটা এখনও রয়েছে। সেটা লক্ষ করে অসীম বলল, ‘না না, শুধু ওটার জন্যে নয়। বিবাহিতা মেয়েদের প্রথম ক’বছরে শরীরের গড়ন বদলে যায়। এই পত্রলেখাকে দেখে সেটা বুঝতে পারছি।’

পত্রলেখা হাসল, ‘সুখের অত্যাচার?’

দীপাবলী ঠোঁট কামড়াল। সে কি মোটা হয়ে গিয়েছে? এবং তখনই তার নজর পড়ল অলোকের দিকে। গম্ভীর মুখে অলোক জানলা দিয়ে পার্ক স্ট্রিট দেখছে। খুব দ্বিধায় পড়ল সে। এখন যদি সে অলোকের সঙ্গে এদের আলাপ করিয়ে না দেয় তা হলে প্রকাশ্যে নিজেদের সম্পর্কটাকে অস্বীকার করা হবে। সম্পর্কে ভাঙন এসেছে ঠিকই কিন্তু সেটা আছে নিজেদের মধ্যেই চাপা। আবার পাঁচজনের সামনে জোর গলায় অলোককে স্বামী বলে প্রচার করার পেছনে মনের কোনও সায় নেই।

সে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। আমরা বিয়ে করেছি।’

‘আমরা?’ অসীম জানতে চাইল।

দীপাবলী বলল, ‘অলোক, এ হল অসীম। তোমাকে এর কথা বলেছি। আর শুনতেই পেলে পত্রলেখা ওর স্ত্রী। অলোক মুখার্জি, দিল্লিতে থাকে।’

অসীম সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিল, ‘অভিনন্দন। আপনি মশাই দারুণ ভাগ্যবান। দীপাবলীকে নিয়ে অনেকে শুধু স্বপ্ন দেখে গেছে, কাজের কাজটা আপনি করলেন।’

পত্রলেখা ভ্রু কেঁচকাল, ‘সেই দলে তুমিও ছিলে নাকি?’

অসীম হকচকিয়ে গেল। কিন্তু তাকে রক্ষা করল অলোক। সে বলল, ‘স্বপ্নে যা রঙিন, সুন্দর, বাস্তবে তার ঠিকঠাক রং খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। তাই না?’

কথাটার মানে বোঝার জন্যে সময় নষ্ট করতে চাইল না অসীম। হয়তো পত্রলেখার মনে আর কোনও নতুন প্রশ্ন তৈরি হোক তা সে চাইছিল না। প্রায় আচমকাই বিদায় নিয়ে চলে গেল সে স্ত্রীর হাত ধবে। ওদের যাওয়া চুপচাপ দেখল দীপাবলী। অসীমের পাশে এখন বেশ মানিয়ে গেছে মেয়েটিকে। কলেজের সেই অসীমের সঙ্গে এখনকার অসীমের কোনও মিল নেই। অল্প বয়সের ভাবালুতায় মানুষ প্রায় সবসময় ভুল করে। সেটা না-ঘটায় নিশ্চয়ই এখন অসীম সঠিক সঙ্গিনী নির্বাচন করেছে। হয়তো এমন আত্মসর্বস্ব মেয়েদের পুরুষরা ভাল পছন্দ করে।

‘আমার যে-পরিচয়টা আব সত্য নয় সেটা আর পাঁচজনকে জানিয়ে লাভ কী?’

অলোকের কথায় সচেতন হল দীপাবলী। হেসে বলল, ‘ভদ্রতা। চলো, এবার উঠি।’

দরজা ঠেলে বাইরে পা দিয়ে অলোক বলল, ‘এমন ভদ্রতায় আমি অভ্যস্ত নই।’

‘আমিও ছিলাম না। কিন্তু করছি। যেমন তুমি স্রেফ ভদ্রতাবশত দিল্লি থেকে আমার সঙ্গে চলে এসেছ কাজ নষ্ট করে। ওই ট্যাক্সিটা ধরবে, প্লিজ!’ সাততাড়াতাড়ি বলে উঠল দীপাবলী।

গড়িয়াহাটা থেকে মোটামুটি লিস্ট মাফিক সবই পাওয়া গেল। কাচা বাজার বাদ দিয়ে ডিম পাউরুটি পর্যন্ত নিয়ে নিল ওরা। একসঙ্গে নয়, সময় বাঁচানোর জন্যে দুজনে আলাদা আলাদা জিনিসপত্র কিনছিল। দীপাবলী অলোককে টাকা দিয়ে দিয়েছিল। অত বোঝা ট্যাক্সিতে চাপিয়ে বাড়ির সামনে আসার পর দারোয়ানের শরণাপন্ন হতে হল। তাকেই টাকা দিল অলোক। রাত্রে দোকান থেকে রুটি মাংস এনে দেবে সে।

জিনিসপত্র ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেবার পর রান্নাঘরটা কোনওরকম ভদ্রস্থ করল ওরা। অলোক সাহায্য করছিল। বলল, ‘দুটো জিনিস তোমার এখনই দরকার। গ্যাস আর ফ্রিজ। একা মানুষের এ দুটো বেশি করে কাজে লাগে।’

কাজ করতে করতে দীপাবলী বলল, ‘এখন সামর্থ্য নেই। হলে কিনব।’

‘আমার যখন কিছু করা নিষেধ তখন বলে মুখ নষ্ট করব না।’

‘এই তো, নিজের বুদ্ধিমত্তার ভাল প্রমাণ দিলে।’

কেনা ব্যাগ এবং বাক্স থেকে জিনিসপত্র বের করতে করতে হঠাৎ দীপাবলী হতভম্ব। একটা প্রিমিয়াম হুইস্কির বোতল। বড়মাপের। জিনিসটা তুলে ধরে সে অলোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা?’

‘কিনলাম। অবশ্য তোমার টাকায় নয়।’

‘তা হলে এটা এখানে খুলো না।’

‘মানে?’

‘এই ফ্ল্যাটে ড্রিঙ্ক করলে আমার কাছ থেকে দাম নিতে হবে।’

অলোক হাসল, ‘অনেক ধন্যবাদ।’

পরিশ্রম হল খুব। এবং সেটা করতে করতেই ন’টা বেজে গেল। দারোয়ান এল খাবার নিয়ে। তাকে দীপাবলী বলে দিল সকালবেলায় ফার্নিচার আসবে। আর যদি সম্ভব হয় কিছু কেরোসিন তেলের ব্যবস্থা করে দিতে। লোকটা জানাল কোনও অসুবিধে নেই। কিছু এক্সট্রা টাকা দিলে কয়েক ড্রাম তেল পাওয়া যাবে। দীপাবলীর কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘এক্সট্রা চার্জ মানে? ব্ল্যাক মার্কেটে নাকি?’

অলোক সামাল দিল, ‘সার্ভিস চার্জ বোধহয়। টেক ইট ইন দ্যাট ওয়ে।’

দারোয়ান হাসল, ‘খোলা বাজারে এখন তেল পাবেন না। পেলেও লাইনে সারাদিন দাঁড়াতে হবে। এ-পাড়ার কিছু ছেলে কষ্ট করে তেল জোগাড় করে কিছু বেশি দাম নেয়।’

অলোক বলল, ‘তা হলে তো সার্ভিস চার্জ কথাটা মিথ্যে বলিনি।’

আর কী কী জিনিস বাজারে পাব না?’ দীপাবলী প্রশ্ন করল।

‘আজ্ঞে, বেবিফুড পাবেন না, গ্যাস পেতে অনেক দেরি হবে, এখন চিনি!’

‘ঠিক আছে। থাকতে গেলে এসব মানতে হবে। বেবিফুডের দরকার নেই। গ্যাস যদ্দিন না পাওয়া যাবে তদিন তুমি কেরোসিন সাপ্লাই দিয়ে যেয়ো। মেমসাহেব বড় সরকারি অফিসার, উনি এখানে থাকবেন, আমি কালই দিল্লিতে ফিরে যাব।’ অলোক জানাল।

বেবিফুড শব্দটি কানে আসতেই দীপাবলী সজাগ হয়েছিল। অলোকের দিকে তাকাতে অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু দারোয়ান চলে যাওয়ামাত্র প্লেটে অলোককে খাবার ঢালতে দেখে সে এগিয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে অলোক বলল, ‘বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এই ঘরে তোমার আর কোনও দরকার নেই। চলো, বন্ধ করে ওই ঘরে চলে যাই।’

এখন অলোক পাশের ঘরে। এ পাশেরটায় একা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দীপাবলী। বাসস্থান মোটামুটি ভালই হয়েছে। এর আগে যখন কলকাতায় ছিল তখন এমন ব্যবস্থার কথা ভাবতেই পারত না। এখন কলকাতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। কালই অফিসে গিয়ে জয়েনিং লেটার দেবে। কাজকর্মের ব্যাপারটা বুঝে—! হঠাৎ মনে পড়ে গেল ওর। ব্যাগ খুলে ইনল্যান্ডলেটার বের করল। তারপর ছোট্ট চিঠিটা লিখল। মনোরমা যেন তৈরি থাকেন। দীপাবলী যে-কোনও দিন চলে যেতে পারে তাঁকে নিয়ে আসার জন্যে। সে জানিয়ে দিল এখন থেকে একাই কলকাতায় থাকবে। সেইসঙ্গে এখানকার ঠিকানাও। যদি অঞ্জলি আসতে চায় তা হলে সে নিশ্চয়ই খুশি হবে। এতদিন যা দুঃখ ভোগ করার তা ওরা করেছে এখন থেকে আর নয়। সে বেঁচে থাকলে তো নয়ই। চিঠিটা লিখে বেশ ভাল লাগল।

বিছানায় শুয়ে এত ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম আসছিল না তার। নতুন জায়গা কিংবা নতুন জীবনের কথা বড় একটা মাথায় আসছে না। শুধু মনে হচ্ছে পাশের ঘরে অলোক রয়েছে। তার এখনও স্বামী। দু’জনে দু’জনের সঙ্গে আর মানাতে পারবে না বলে সব সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে দিয়েছে। তবু অলোক এসেছে তার সঙ্গে। তাকে সবরকম সাহায্য করেছে। এখন অলোককে খুব ভাল বন্ধু বলেই ভাবা যায়। বন্ধু? যার সঙ্গে রাতের পর রাত এক বিছানায় শুয়েছে, যে তাকে প্রথম শরীরের আনন্দের স্বাদ দিয়েছে, তাকে কী করে শুধুই বন্ধু ভাবা যায়? বেবিফুডের দরকার তাদের হবে না। একসময় অলোক বলেছিল সে খুব তাড়াতাড়ি বাবা হতে চায়। একটুও আপত্তি ছিল না দীপাবলীর। তারপরে ও নিজেই ঠিক করল বছর দুয়েক অপেক্ষা করবে। আর একটু ভালভাবে গুছিয়ে নিতে চায় সব। তখন নিয়ম মেনে চলতে হত। তারপর একসময় সেসবের পালা চুকল। মা হবার জন্যে কখনই ভেতর থেকে তাগিদ আসেনি। আজ হঠাৎ মনে হল তার সামনে শুধুই শূন্যতা। এই জীবনে আর কখনই শিশুর জননী হতে পারবে না সে। কে জানে, হয়তো তার ভেতরে একটা লজ্জাকর অক্ষমতা ছিল, যা প্রকাশ পেল না এ জীবনের মতো।

মধ্যরাত্রেও ঘুম না আসায় দীপাবলী নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হল। সে দরজায় খিল দেয়নি। ছিটকিনি তোলেনি। পরদাটা পড়ে ছিল। অলোকের ঘরের দরজা খোলা। দরজায় দাঁড়িয়ে দীপাবলী দেখল অলোক অঘোরে ঘুমোচ্ছে। খুব অসহায় দেখাচ্ছে এখন। হয়তো ঘুমন্ত মানুষেরাই অসহায় হয়। সে চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে এল।

সকাল থেকেই ব্যস্ততা। নতুন ফ্ল্যাটে ফার্নিচার এসে গিয়েছে। ভরাট না হলেও ভদ্র চেহারা পেয়ে গেল। কেরোসিন এনে দিয়েছে দারোয়ান। অতএব চা টোস্ট হবে স্টোভে। তারপর সেদ্ধভাত বসিয়ে দিল। খবরের কাগজ আনিয়েছিল অলোক। পড়ে বলল, ‘কাল শহরে ঘোরার সময় বুঝতেই পারিনি এতসব ঘটনা ঘটে গেছে। আজব জায়গা।’

কাজ করতে করতে মুখ তুলল দীপাবলী, ‘কী হয়েছে?’

‘দমদমে তিনটে খুন হয়েছে। মূর্তি ভেঙেছে নকশালরা। পুলিশ আর নকশাল সংঘর্ষে একজন মারা পড়েছে। কাল দেওয়ালে দেওয়ালে দেখছিলাম অবশ্য বন্দুকের নল শক্তির উৎস, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। এখানে থাকা তোমার খুব আরামদায়ক হবে না।’ অলোক বলল।

দশটার আগেই ওরা বের হল। অলোক যাবে টিকিটের জন্যে। বিকেলের ট্রেন পেলে আজই চলে যাবে দিল্লি। দীপাবলী যদি ছুটি না পায় তা হলে এক্ষেত্রে দেখা হবে না। দারোয়ানের কাছে চাবি রেখে যাবে। ওকে আর দু’-একদিন থাকতে বলতে পারত দীপাবলী। কিন্তু বলল না। দুটো দিনের পরেও তো আজকের সময়টা আসবে।

ট্যাক্সিতে আয়কর ভবনে পৌঁছে দিয়ে অলোক চলে গেল ফেয়ারলি প্লেসে। বলল, ‘যদি টিকিট পাই এবং তুমি ছুটি না পাও তা হলে ঠিক আড়াইটে নাগাদ তোমাদের এই গেটের সামনে নেমে এসো এক মিনিটের জন্যে প্লিজ।

জয়েন করে পরিচিত হতে যে সময়টা লাগল তাতেই একটা বেজে গেল। খোদ বড়কর্তা আজ নেই। অতএব কালকের আগে পোস্টিং হবে না। দীপাবলী ঘুরে ঘুরে আয়কর ভবনের ঘরগুলো দেখছিল। এখন এই একটার সময় অনেকে অফিসে ঢুকছে। হাতে ব্যাগ এবং হাঁটার ভঙ্গিতে তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কলকাতায় অনেকগুলো আয়কর অফিস রয়েছে। হেড অফিসের যদি এই দশা তা হলে অন্য জায়গায় কী হয় কে জানে!

দীপাবলী নীচে নেমে এল। আড়াইটে বাজতে দেরি নেই। সে জানত অলোক যেমন করেই হোক টিকিট পাবেই। অলোকের ট্যাক্সি এল মিনিট পাঁচেক আগেই। কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু তার আগেই দীপাবলী উঠে পড়ল দরজা খুলে। সারাটা পথ তেমন কথা হল না। প্ল্যাটফর্মে কামরা খুঁজে পেতেও অসুবিধে হল না। এবার অলোক বলল, ‘তোমাকে অনেক দূরে ফিরে যেতে হবে দীপা।’

‘দিল্লির থেকে বেশিদূরে নিশ্চয়ই নয়।’

‘আমাকে করুণা করতে না এলেই পারতে।’

‘করুণা করব কেন? আমি ঋণস্বীকার করতে এলাম। আমার অক্ষমতা তুমি বুঝিয়ে দিয়েছ।’

‘অক্ষমতা তো আমারও।’ অলোক বলল, ‘তুমি যদ্দিন একা থাকবে কলকাতায় এসে আমি তোমার কাছে উঠতে পারি?’

দীপাবলী স্পষ্ট গলায় বলল, ‘নিশ্চয়ই।’

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন