১৪. হাটতলা পেরিয়ে

সমরেশ মজুমদার

হাটতলা পেরিয়ে যাওয়ামাত্র শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ওর বাড়িতে কখনও গিয়েছেন?’

উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসেছিল দীপাবলী, প্রশ্ন শোনামাত্র মাথা নাড়ল, ‘না। আমার তো কখনও যাওয়ার দরকার পড়েনি।’

শঙ্কর ঘোষ মাথা নাড়ল, ‘ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে ঈশ্বর জানেন। লোকটার বাড়িতে বড় বড় কর্তাদের যাতায়াত আছে। আর এতটা পথ ঠেঙিয়ে এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কেন আসবেন তারা বুঝতেই পারছেন!’

‘পারছি। কিন্তু কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’ কথাটা বলেই নিশ্বাস ফেলল দীপাবলী, ‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’

‘নাঃ, এ নিয়ে চিন্তা করার কোনও মানে হয় না আর।’ কথাগুলো বললেও দারোগার গলার স্বর স্বাভাবিক ঠেকল না।

অন্ধকার চিরে হেডলাইটের আলোগুলো যখন বাড়িটাকে আঁকড়ে ধরল তখন দীপাবলীর মনে হল অর্জুন সত্যিই বড়লোক। প্রাসাদ বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কিন্তু এই এলাকার যে-কোনও বাড়িকেই এর পাশে নিতান্তই কুঁড়েঘর বলে মনে হবে। এবং তার চেয়ে যেটা তাজ্জব সেটা হল বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। গাড়ির শব্দ বন্ধ হওয়ামাত্র জেনারেটারের শব্দ পাওয়া গেল। দু’খানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে অর্জুনের জিপের পাশে। কয়েকটি লোক নীচে বসে ছিল। তাদের একজন উঠে এগিয়ে আসামাত্র দারোগা চাপা গলায় বললেন, ‘সর্বনাশ। এস ডি ও সাহেবের ড্রাইভার!’

‘ড্রাইভারকে দেখে ভয় পাওয়ার কী আছে?’

‘ধোয়া মানেই আগুন আছে পেছনে।’

‘আপনার কাজ আপনি করুন।’ দীপাবলী জিপ থেকে নেমে দাঁড়াতেই দারোগা এবং পুলিশ বাহিনী নামল। এস ডি ও-র ড্রাইভার সেলাম করে বলল, ‘আপনি এখানে দারোগাবাবু?’

‘তোমার সাহেব এ-বাড়িতে এসেছেন?’

‘হ্যাঁ, ভেতরে যাবেন না। সাহেব রেগে যেতে পারেন।’

বাড়ি থেকে ছিটকে আসা আলোয় দারোগা শঙ্কর ঘোষ শেষবার তাকালেন দীপাবলীর দিকে। দীপাবলী কঠোর মুখে ঘাড় নাড়তেই পুলিশ বাহিনী ভেতরে ঢুকল। নীচের তিনখানা ঘরে কেউ নেই। পুলিশ দেখে দু’জন চাকর গোছের মানুষ হতভম্ব হয়ে তাকাল। এস ডি ও-র ড্রাইভার এগিয়ে যাচ্ছিল, তাকে থামাল শঙ্কর ঘোষ, ‘তুমি এখানেই থাকো। অর্জুনবাবু কোথায়?’

লোকটি যেন খুব অবাক হল, ‘ওপরে। কিন্তু আপনাদের সাবধান করে দিচ্ছি ওপরে যাবেন না। সাহেব খেপে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তার ওপর অর্জুনবাবুও ওখানে আছেন।’

সিঁড়িতে তেমন আলো নেই কিন্তু ওপরে উঠতে অসুবিধা হল না। সিঁড়ি ভাঙার সময় গ্রামোফোন রেকর্ডের গান ভেসে আসছিল, ‘এ শুধু গানের দিন এ লগন গান শোনাবার…।’ সেইসঙ্গে স্পষ্ট হল স্খলিত গলার উচ্ছ্বাস ধ্বনি।

এমন একটা দৃশ্য যে বাকি জীবনের জন্যে অপেক্ষা করছে তা দীপাবলী ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি। জীবনের অনেক অনেক একলা রাতে চোখ বন্ধ করলেই ওই দৃশ্যটি ভেসে উঠেছে। পুরুষের অক্ষম আকাঙক্ষার সঙ্গে সে পরিচিত হয়েছিল যৌবন শুরু হবার আগেই। সেই অক্ষমতা তাকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু লালসা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, যখন পুরুষের মানসিক বিকৃতি পূর্ণ করতে নারী স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে সহযোগিতা করে, তখন কোনারকের মন্দিরের গায়ে শৃঙ্গাররত মূর্তিগুলোও লজ্জিত হবে।

দুটি নারী, অবশ্যই তাদের শরীর, গায়ের রং এবং মুখের গড়ন প্রমাণ করছে তারা এই অঞ্চলের গ্রাম থেকে উঠে এসেছে, সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে অর্জুন নায়েক এবং এস ডি ও সাহেবের বাহুলগ্ন হয়ে মদ্যপানে অংশ নিয়েছে। নারীশরীর যে এত কুৎসিত হয়ে উঠে পুরুষকে শিষ্টাচারের বেড়া ডিঙিয়ে নিয়ে যেতে পারে তা অনুমানেও ছিল না। শঙ্কর ঘোষ এবং দীপাবলী থমকে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দুই নারীর একজনের চোখ পড়ল দরজায় আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল সে, গ্রামোফোনের রেকর্ড থেমে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে ঠিক বাঘের মতো ঘুরে উঠে দাঁড়াল অর্জুন নায়েক। তার চোখ মুখ মুহুর্তেই বীভৎস হয়ে উঠল। এস ডি ও-র প্রতিক্রিয়া হল বিপরীত। এরকম একটা গোপন আনন্দের সময় দারোগা এবং দীপাবলীকে দেখতে পেয়ে তিনি চোখ বন্ধ করলেন। পালিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় থাকলে ভদ্রলোক বোধহয় বেঁচে যেতেন। ততক্ষণে অর্জুন নায়েক গর্জন করে উঠেছে, ‘আপনারা এখানে? কার হুকুম নিয়ে দোতলায় উঠেছেন? এইসময় আমাদের বিরক্ত করার সাহস পেলেন কী করে?’

দারোগাবাবু থতমত হয়ে দেখলেন এস ডি ও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছেন। মেয়েদুটি ততক্ষণে ঘরের এক কোণে চলে গিয়েছে। দু’জনের এত নেশা হয়েছে যে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার শক্তি নেই।

উত্তর না পেয়ে অর্জুন হুংকার দিল, ‘মান সিং।’

সম্ভবত সেটি কোনও রক্ষীর নাম, কানে যাওয়ামাত্র সচকিত হলেন শঙ্কর ঘোষ, ‘মিস্টার নায়েক। আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’

‘আমাকে?’ অর্জুন যেন নিজের দুটো কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না, ‘আমি কী করব তা আপনি ঠিক করবেন?’

‘নিশ্চয়ই। আমি থানার দারোগা। আপনাকে অ্যারেস্ট করার অনুমতি আমার কাছে আছে। আশা করছি আমাকে অভদ্র হতে আপনি বাধ্য করবেন না। আসুন।’ শঙ্কর ঘোষ এক পা এগিয়ে গেলেন।

প্রায় যাত্রা দলের ভিলেনের মতো হেসে উঠল অর্জুন, ‘অ্যারেস্ট! আমাকে! আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল দারোগাবাবু! কিন্তু অভিযোগটা কী?’

‘মার্ডার চার্জ। আপনি কয়েকটি ভাড়াটে লোক দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারী কিছু মানুষকে হত্যার চেষ্টা করেছেন।’

অর্জুন হাসল, ‘এইসব আজগুবি কথা শোনার সময় আমার নেই। আর পনেরো মিনিট বাদে হিরোইনের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আপনাদের ব্যাপারটা আমি পরে বুঝে নেব। এখন আসতে পারেন।’

এমন তাচ্ছিল্য করে এইরকম সময়েও কেউ কথা বলতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হত। দীপাবলী লক্ষ করছিল অর্জুন তার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না, সে যে এখানে এসেছে তা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করছে। সে শঙ্কর ঘোষকে বলল, ‘আপনি আদেশ মান্য করুন মিস্টার ঘোষ।’

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল অর্জুন। তার মুখের চেহারা ধীরে ধীরে পালটে গেল। সেই অদ্ভুত শব্দ-করা হাসি হাসল, ‘বড় অসময়ে আপনাকে অতিথি হিসেবে পেলাম। আপ্যায়ন করার কোনও সুযোগ দিলেন না ম্যাডাম। বুঝতে পারছি মিস্টার ঘোষ আপনার আদেশ মান্য করছেন। কিন্তু অভিযোগ তো ধোপে টিকবে না ম্যাডাম। প্রমাণ করতে পারবেন না।’

দারোগা বললেন, ‘আপনি অনেক সময় নিচ্ছেন কিন্তু।’

‘ও আচ্ছা। আপনাকে যিনি আদেশ দিয়েছেন তাঁর ওপরওয়ালা এখানে আছেন। এস ডি ও সাহেব, দারোগাকে বুঝিয়ে দিন কী করতে হবে।’

এস ডি ও নড়লেন। তাঁর মুখ তুলতে খুব সংকোচ হচ্ছিল। অর্জুন দূরে ভয় পেয়ে বসে থাকা মেয়েদুটিকে হাত নেড়ে ধমকাল, ‘অ্যাই! তোরা আর এখানে কেন বসে আছিস! যা, চলে যা।’

মেয়েদুটি পরস্পরকে অবলম্বন করে টলতে টলতে কোনওমতে পাশের ঘরে ঢুকে গেলে এস ডি ও বললেন, ‘ঠিক আছে, এখন আপনারা চলে যান। কাল সকালে অফিসে আসুন। আলোচনা করে ব্যবস্থা নেব।’

সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন বলে উঠল, ‘চমৎকার। ওপরওয়ালার অর্ডার পেয়ে গেছেন। জেলা কোর্টের রায় হাইকোর্টে স্থগিত রাখল। এবার আপনারা আসুন। ম্যাডাম, আপ্যায়ন করতে পারলাম না বলে ক্ষমা চাইছি।’ দুটো হাত জোড় করল অর্জুন।’

দীপাবলী শঙ্কর ঘোষের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, ‘স্পেসিফিক চার্জে আমরা অর্জুনবাবুকে অ্যারেস্ট করছি। আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করার কোনও দরকার নেই। আর যে মেয়েদুটো এখানে ছিল তাদেরও আপনি নিয়ে চলুন। একজন অসৎ চরিত্রের সরকারি অফিসারের এই মুহূর্তে হুকুম করার কোনও অধিকার নেই যখন তিনি ব্যভিচারে লিপ্ত রয়েছেন। যান!’

অর্জুন হাসল, ‘চমৎকার ম্যাডাম। নাটক দারুণ জমেছে।’

‘মানে!’ দীপাবলীর মুখ থেকে শব্দটা ছিটকে এল।

‘এক শালিক কেন বধ করবেন, জোড়া শালিকের দায় এসে পড়ল যে। কীসব বললেন না, তার জন্যে এই এস ডি ও সাহেবকেও আপনি নিশ্চয় গ্রেপ্তার করতে বলবেন। তাই বলছিলাম নাটক দারুণ জমেছে।’

এবার শঙ্কর ঘোষ এগিয়ে এলেন, “অনেক হয়েছে, এবার আপনি চলুন।’

অর্জুন তাঁর বাড়ানো হাত সরিয়ে দিল, ‘আমি ইচ্ছে না করলে আপনার থানার ওই ক’টা ছারপোকার ক্ষমতা নেই আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়ায়। আর আপনি জানেন সময় পেলে আমি কী করতে পারি!’

এতক্ষণে শঙ্কর ঘোষের পুলিশি রক্ত সম্ভবত জেগে উঠল। তিনি হাঁকডাক করে দু’জন সেপাইকে নিয়ে অর্জুন নায়েকের হাতে লোহার বালা পরালেন। ও দুটো পরামাত্র অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল লোকটা। দীপাবলীর দিকে হাতকড়া তুলে ধরে বলল, ‘এটার কোনও দরকার ছিল ম্যাডাম?’

‘খুনের আসামি বলে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে তার সম্পর্কে কোনও ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয় অর্জুনবাবু।’ দীপাবলী ততক্ষণে খুব খুশি।

‘বাঃ। আর কিছু বলার নেই। এবার নিশ্চয়ই দ্বিতীয় কাজটা করবেন?’

‘কী বলতে চাইছেন?’

‘এই লোকটা আমাকে সুযোগ দেয়, আমি ওর আনন্দের ব্যবস্থা করি। উনি এসেছেন নায়িকার সঙ্গে নিভৃতে আলাপ করতে। আগে এসে পড়েছেন তাই সময় কাটাতে চা-জলখাবার খাচ্ছেন। একটু আগে যেসব শব্দ বলছিলেন— সেই অভিযোগে এঁকে গ্রেপ্তার করা কি আপনাদের কর্তব্য নয়? অদ্ভুত শব্দ করা হাসিটি হাসল অর্জুন।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করলেন এস ডি ও, ‘অর্জুনবাবু, আপনি কিন্তু নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন!’

মাথা নাড়ল অর্জুন, ‘ভুল হল, আমি নিজের সীমা নিজেই স্থির করি। আমাকে যদি কোর্টে তোলা হয় তা হলে বলতেই হবে আপনি আমার সঙ্গে গ্রেপ্তারের আগে এই ঘরে বসে কী করছিলেন। আর এঁরা সেটা দেখেও কোনও অ্যাকশন নেননি। ব্যাপারটা কি সুবিধের হবে?’

হঠাৎ এস ডি ও দারোগার সামনে এগিয়ে এসে উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘বন্ধ করুন এসব নাটক। ছেড়ে দিন ওঁকে।’

দীপাবলী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘স্যার, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি চুপ করে থাকতে। আপনি আমাদের সঙ্গে থানায় আসুন।’

‘আমি! থানায়!’ ভদ্রলোক হতভম্ব।

‘হ্যাঁ। আমি ভদ্রভাবে ব্যাপারটা করতে চাই।’

‘আপনি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন না মিসেস ব্যানার্জি।’

‘আমার এলাকায় যদি মন্ত্রীমশাইও কোনও অপরাধ করেন তা হলে আইন আমাকে যতটুকু করার ক্ষমতা দিয়েছে ততটক নিশ্চয়ই করতে পারি।’ কথাগুলো বলে দরজার বাইরে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেল দীপাবলী। গিজগিজ করছে লোক। এত রাত্রে এই বাড়িতে এত মানুষের থাকার কথা নয়। সামনের সারিতে যে চার পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে তাদের চেহারা এবং ভঙ্গি প্রমাণ করে অপরাধ করার নিয়মিত অভ্যেস তাদের রয়েছে। এই ভিড় ঠেলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়া মুশকিল। দারোগা সেপাইদের নির্দেশ দিলেন পথ করে দেবার জন্যে। সেপাইরা লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু কাজ হল না। লোকগুলো পাথরের মূর্তির মতো অপেক্ষা করছিল অর্জুন নায়েকের কাছ থেকে একটা আদেশের জন্যে।

এইসময় পেছন থেকে আওয়াজটা ভেসে এল। সেই ঘিনঘিনে হাসির শব্দ। দীপাবলী পেছন ফিরে তাকাতেই অর্জুন বলল, ‘ভয় পাবেন না ম্যাডাম। আমি চাই না এখানে কোনও দাঙ্গা বাধুক। অন্য কেউ হলে কী করতাম জানি না কিন্তু আপনার সম্মান নিশ্চয় থাকবে। তবে একটু সময় চাই।’

শঙ্কর ঘোষ বললেন, ‘সময় যথেষ্ট পেয়েছেন, ওদের সরে যেতে বলুন।’

কিছুক্ষণ এই নিয়ে বাগবিতণ্ডা চলল। শেষপর্যন্ত দীপাবলী এবং পুলিশবাহিনী যখন ওদের নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল তখন কয়েকশো মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছে। এই মধ্যরাত্রেও কীভাবে এদের টেনে আনা হল দীপাবলী অনুমান করতে পারল না। অর্জুন হেসে বলল, ‘ম্যাডাম, সকাল পর্যন্ত সময় পেলে এখানে একটা কুম্ভমেলা বসিয়ে দিতে পারতাম।’

এস ডি ও-র গাড়িটা নেওয়া হল। জিপে ওঠার আগে অর্জুন একটি লোকের দিকে তাকাল, ‘মান সিং, আমি একটু ঘুরে আসছি। তুমি হিরোইন মেমসাবকে বলবে অপেক্ষা করতে।’

মান সিং ঘাড় নাড়ল। সে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এই জনতাও শব্দরহিত। অর্জুন নায়েককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে এমন দৃশ্য দেখার কথা কেউ কখনও কল্পনাও করেনি। সেইসঙ্গে দু’জন কোনওমতে কাপড় পরা যুবতী, যাদের তারা খুব ভালভাবে জানে, একজন সরকারি সাহেব, কোনওভাবেই তারা কূল পাচ্ছিল না।

বাকি রাতে ঘুম হবার কথা নয়, হয়ওনি। দীপাবলী থানা হয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছিল ভোরের মুখে। এস ডি ও সাহেব তার কাছে কাকুতিমিনতি করেছিলেন। নিজের সর্বনাশের ছবি দেখতে পেয়ে শুধু পায়ে পড়তে বাকি রেখেছিলেন ভদ্রলোক। একসময় বলেই ফেললেন, ‘আপনি তো চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চলেই যাচ্ছেন, তা হলে এসব কাণ্ড করতে গেলেন কেন?’

দীপাবলী জবাব দেয়নি। তবে সে বিস্মিত হয়েছিল শঙ্কর ঘোষকে দেখে। যে-দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা বিদেশি সরকার চলে গেলেও গায়ে একটুও আঁচ না লাগিয়ে একই চেহারায় রয়ে গিয়েছে, যার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শুধু ওপরওয়ালাকে সন্তুষ্ট করে নিজের গুছিয়ে নেবার মন্ত্রে দীক্ষিত, সেখানে শঙ্কর ঘোষের মতো একজন সামান্য দারোগা অর্জুন নায়েকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটুও বিচলিত না হয়ে নিজের কাজ করে গেলেন। অথচ এই লোকটি ও বাড়িতে যাওয়ার আগে অভ্যাসজাত দুর্বলতায় বারংবার কেঁপেছিলেন। শকুনির পাশার ছক হয়ে তাঁর বড়সাহেবদের মতো গড়িয়ে পড়লে দীপাবলী কিছুই করতে পারত না। আর তাতে হয়তো ভবিষ্যতে লাভবান হতেন ভদ্রলোক। কিন্তু প্রাথমিক দোলা কাটিয়ে নিজেকে একটি ব্যতিক্রমী চরিত্রে নিয়ে গেলেন তিনি। এ-দেশের প্রশাসনে এখনও কিছু শঙ্কর ঘোষ আছেন বলে সুস্থ জীবনের আশ্বাস পাওয়া যায়। বিদায় নেবার সময় গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ম্যাডাম, খুব ভাল লাগছে আজ। ভবিষ্যতে কী ঘটবে অনুমান করতে পারি কিন্তু আপনি আমাকে দিয়ে একটা বড় প্রায়শ্চিত্ত করালেন, আপনাকে আমার—!’ কথা শেষ করেননি ভদ্রলোক।

সারারাত ঘুম নেই, তবু স্নান করে অফিসে গিয়ে বসল দীপাবলী। সতীশবাবু এলেন সবার আগে। প্রায় ছুটতে ছুটতেই। এসে বললেন, ‘এ কী করে সম্ভব হল মেমসাহেব!’

‘পৃথিবীতে কোনও কিছুই অসম্ভব নয় সতীশবাবু।’

‘তা ঠিক। কিন্তু শুনলাম অর্জুন নাকি একটুও বাধা দেয়নি?’

‘দেবার সুযোগ পায়নি।’ কথাটা বলতে ভাল লাগল দীপাবলীর।

মাথা নাড়লেন সতীশবাবু, ‘না মেমসাহেব, এটা খুব রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে। দারোগাবাবুর ওই ক’টা শুটকো সেপাইকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে পারত অর্জন। কিন্তু সেসব না করে মেনে নিল কেন?’

‘অর্জুন জানত ওটা করলে সদর থেকে পুলিশবাহিনী আসত।’

আবার মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, ‘সে ব্যাপারেও সন্দেহ আছে মেমসাহেব।’

‘কী যা তা বলছেন। এ-দেশে কেউ আইনের ওপরে নয়।’

সতীশবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন, ‘শুনতে আপনার নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে কিন্তু ভালবাসা ছাড়া কিনতে পারা যায় না এমন কিছু নেই। ওই আইনটাইনের কথা বইয়ের পাতায় লেখা থাকে। আমার মনে হচ্ছে অর্জুন ব্যাপারটা মেনে নিল তার কারণ ওর মাথায় আরও বড় কোনও মতলব আছে। কিন্তু এস ডি ও সাহেব তো চাইবেন জাল কেটে বেরিয়ে আসতে। আমার তাই খুব ভয় করছে মেমসাহেব।’

‘ভয়! কেন!’

‘আঘাত পেলে সাপ ছোবল মারবেই। আপনি বরং ছুটি নিয়ে নিন।’

বৃদ্ধের চোখে মিনতি স্পষ্ট। হেসে ভদ্রলোককে কাজে যেতে বলেছিল সে।

সেই মুহূর্তে সে জানত না ভবিষ্যতের পাতা ওলটানোর সময় অতীতের অভিজ্ঞতা কতখানি জরুরি ভূমিকা নেয়।

সকালের অফিস যখন বন্ধ হচ্ছে তখন জিপের আওয়াজ হল। জানলা দিয়েই দীপাবলী দেখতে পেল শঙ্কর ঘোষ নামছেন। নিশ্চয়ই গত রাত্রে প্রচণ্ড পরিশ্রম হয়েছে ভদ্রলোকের, কিন্তু মনে হল বেশ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন এরই মধ্যে। ঘরে ঢুকে নমস্কার বলে, অনুমতি ছাড়াই বসে পড়লেন তিনি, বসে বললেন, ‘সব পণ্ডশ্রম হল ম্যাডাম।’

‘মানে?’

‘আজ সকালে কেস পাঠাবার আগেই ডি এম আর এস পি উপস্থিত। ওঁদের দেখে তো আমি অবাক। আধঘণ্টা আগে আমি ছাড়া পেলাম। এত গালাগাল আমি জীবনে শুনিনি।’ ভদ্রলোক দু’হাতে মুখ ঢাকলেন। দীপাবলী পাথর হয়ে গেল।

একটু সময় নিয়ে শঙ্কর ঘোষ বললেন, ‘ডি এম সাহেবের নির্দেশে এস ডি ও সাহেব গতকাল এদিকে একটা তদন্ত করতে এসেছিলেন। সন্ধের সময় তাঁর জিপ নাকি খারাপ হয়ে যায়। শহরে ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় ছিল না, রাত কাটাবার কোনও বাংলোও নেই, তাই অর্জুন নায়েকের বিশেষ অনুরোধে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক।

‘আর অর্জুন নায়েক?’ গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল দীপাবলীর।

‘গতকাল দুপুরে বড় রাস্তায় ওঁর জিপ একটা ছোটখাটো অ্যাকসিডেন্ট করে। জিপের শব্দে ভয় পেয়ে গাড়ি সমেত দুটো গোরু ওঁর জিপের সামনে চলে আসে। অনেক চেষ্টার পরে গোরুদুটোকে বাঁচিয়ে শুধু গাড়ির ওপর দিয়ে দুর্ঘটনাকে যেতে দেন ভদ্রলোক। সেই অভিযোগ পেয়ে আমি ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। থানায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। যদি এই ব্যাপারে কোনও কেস ওঠে তা হলে তিনি ডাকামাত্র হাজির হবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। এ ছাড়া স্বেচ্ছায় সেই গোরুর মালিককে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়েছেন। অতএব কেস ওঠার কোনও সম্ভাবনা নেই।’

হতভম্ব হয়ে গেল দীপাবলী। সে শুধু বলতে পারল, ‘কিন্তু কাল রাত্রে আপনি ডায়রিতে সব নোট করেননি?’

‘না। জায়গা কম হবে বলে ডিটেলসে লেখার জন্যে আলাদা শিটে লিখে ওদের দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছিলাম।

‘সেটা কোথায়?’

‘ওটা এস পি সাহেব নিয়ে নিয়েছেন।’

‘আপনি দিলেন?’

মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, ‘কোনও উপায় ছিল না। উনি আমার কর্তা, তার ওপর ডি এম বসেছিলেন সামনে।’

‘ছিঃ! আপনি একটু প্রতিবাদও করলেন না?’

‘ম্যাডাম। কাল রাত্রে আপনাকে বলেছিলাম আপনি আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে সাহায্য করেছেন। আমি সত্যি সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ অর্জুন নায়েকের বিরুদ্ধে সমস্ত রিপোর্ট তৈরি করেও ছিঁড়ে ফেলে দিতে হল কারণ বাকি জীবন ধরে আমার পরিবারের মোটামুটি বেঁচে থাকার সুবিধেগুলো আমি কেড়ে নিতে পারি না।’ বিক্ষত বিবেক যেন চোখেমুখে ফুটে উঠল।

দীপাবলী কোনও কথা বলতে পারছিল না। এই একটি লোককে সে সাধারণ মানুষ থেকে ধীরে ধীরে কত ওপরে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, এক লহমায় সেই উচ্চতা থেকে বামনে চলে আসতে পারে শুধু এটুকুই মাথায় ছিল না। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শঙ্কর ঘোষ যেন আর একটু অসহায় হয়ে পড়লেন, ‘ম্যাডাম, আপনি আমার অবস্থাটা বুঝুন। এস ডি ও পর্যন্ত কড়া গলায় কথা বলতে পেরেছি, কিন্তু ডি এম বা সুপার তো কোনও অন্যায় করেননি, ওঁদের সঙ্গে— মানে, আমি তো সাবঅর্ডিনেট, আফটার অল।’

‘ডি এম আপনাকে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলতে বললেন?’

‘আপনি এ নিয়ে কাউকে কিছু বলবেন না ম্যাডাম। আসলে ডি এম-এর কথায় যুক্তি ছিল। উনি বললেন কেস নাকি জেলা আদালতেই টিকবে না। ওই মারপিট অথবা হত্যার চেষ্টা অর্জনবাব যে তাঁর লোক দিয়ে করিয়েছিলেন সেটা নাকি আদালতে প্রমাণ করা যাবে না। অর্জুনবাবু নিজে স্পটে ছিলেন না। যারা আমাদের সাক্ষী দেবে বলে কথা দিয়েছে তারা, অর্জুনবাবু জামিন পাওয়ামাত্র কথা গিলে ফেলবে। বরং উলটে তারাই বলবে অর্জুনবাবু দেবতা। ওঁদের আনন্দ করার সময় হামলা করে আমরা খুব অন্যায় করেছি। কারণ নাচ-গান ইত্যাদি যে অশ্লীলভাবে করা হয়েছিল তা আমরা কোর্টে গিয়ে মুখে বলতে পারি কিন্তু প্রমাণ করার চেষ্টা অসম্ভব। যে-মেয়ে দুটি বিবস্ত্রা ছিল তারা শাড়ি পরে ঘোমটা মাথায় দিয়ে এসে কোর্টকে বলবে ওই বাড়িতে কাজ করে। কোনওদিন কোনও খারাপ কাজ করেনি। ব্যস, হয়ে গেল। প্রমাণ না করতে পারলে উলটে হাস্যাস্পদ হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আরও ওপরতলা থেকে চাপ আসতে আরম্ভ করবে। পালটা অ্যাকশন যদি অর্জুনবাবু নিতে চান, চাইবেনই, কোথায় দাঁড়াব তা নাকি অনুমান করা সম্ভব নয়।’ মাথা নিচু করলেন শঙ্কর ঘোষ।

ঠোঁট কামড়াল দীপাবলী। ‘নতুন গল্পদুটো তৈরি করার কী দরকার ছিল?’

‘ডি এম সাহেব বললেন আমরা প্রকাশ্যে এমন বাড়াবাড়ি করেছি যে একটা সাজানো ঘটনা তৈরি না করে কোনও উপায় নেই। জনসাধারণের সামনে এঁদের একটা ভাল ছবি আমাকে রাখতেই হবে।’

‘আমার কথা কিছু বলেননি? এত ঘটনা ঘটল আমাকে তো ডাকা হল না?’

মাথা নিচু করলেন শঙ্কর ঘোষ। ‘ডি এম সাহেব বলেছেন।’

‘কী বলেছেন?’

‘আপনি রেজিগনেশন দিয়েছেন। আজ বাদে কাল কোনও পাত্তা পাওয়া যাবে না। যা কিছু ঘা নাকি আমার হবে। কথাটা খুব ভুল নয় ম্যাডাম। আপনি তো চাকরি ছেড়েই দিচ্ছেন। আপনার কোনও বিপদ আসবে না। এস পি সাহেব বললেন, রেজিগনেশন দেওয়ার পর এতবড় একটা সিদ্ধান্ত আপনি একা নিয়েছেন, এটা নাকি অত্যন্ত রীতিবিরুদ্ধ কাজ হয়েছে।’ শঙ্কর ঘোষ গলা নামালেন, ‘ম্যাডাম, আপনার কাছে এলে বুকের ভেতর সততা টততা ব্যাপারগুলো কীরকম সুড়সুড় করে ওঠে। কিন্তু সেটাই জীবন নয়। তাই আপনাকে বলি, আপনার মাথার ওপর সবকটি সাপ এখন আহত হয়ে ফণা তুলেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যান। আমাকে কখনওই কোট করবেন না, এটা আনঅফিশিয়ালি বললাম।’ শঙ্কর ঘোষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

‘আপনার নিজের অবস্থা এখন কীরকম মিস্টার ঘোষ?’

‘নর্দমা থেকে উঠতে চেয়েছিলাম বলেই গায়ে মুখে কাদা দেখা যাচ্ছিল। আবার নর্দমায় ঢুকে পড়েছি অতএব সেগুলো ঢাকা পড়ে গেল।’ শঙ্কর ঘোষ নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন। জানলা দিয়ে তাঁর জিপের চলে যাওয়া দেখল সে। হঠাৎ নিজেকে বেদম কাহিল, প্রায় ছিবড়ে বলে মনে হচ্ছিল দীপাবলীর। শহর থেকে অনেক দূরে বসে অর্জুন নায়েক নামক এক স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার যে-আকাঙক্ষা তিল তিল করে বেড়ে উঠেছিল, গত রাতে তা পূর্ণ করে অদ্ভুত আত্মপ্রসাদ এসেছিল। কিন্তু আজ সকালে তা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে জীবন প্রমাণ করল আদর্শ নামক বেড়ালটিকে প্রথম রাতেই মারা হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন আগে সুদীপ একটা চমৎকার কথা বলেছিল। সে-সময়ে প্রচুর তর্ক করেছে সে। আজ মনে হচ্ছে সুদীপ মিথ্যে বলেনি। ভারতবর্য পৃথিবীর অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ। সংবিধান নামক বইটিতে এ-দেশের প্রতিটি নাগরিককে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। আইনের আশ্রয় নিয়ে এ-দেশের নাগরিক নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে নিতে পারে। কারও দুটো ভোট দেবার অধিকার নেই। সবই ওই বইটিতে লিপিবদ্ধ যা ভাবীকালের ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে সম্মান আদায় করবে। কিন্তু আজ নেখালি বা ওইরকম কোনও গ্রামের মানুষের ক্ষুদ্র জমিতে অর্জুন নায়েকদের মতো মানুষের প্রতিনিধি খুঁটি গেড়ে বলে সেই জমি নাকি তার, তা হলে নিঃস্ব মালিকটি থানায় যাবে প্রতিকারের জন্যে।

দারোগা বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পরামর্শ দেবেন জেলার আদালতে মামলা দায়ের করতে। আইন তাঁকে যা করতে বলবে তিনি তাই করবেন। যে-লোকটি হয়তো সাবডিভিশনাল শহরের বাইরে কখনও যায়নি সে অনেক চেষ্টার পর ঘটি বাটি বিক্রি করে ধার নিয়ে জেলা শহরে গেল মামলা লড়তে। একটি কম দামি উকিল তার কেসও নিল। কিন্তু দিন যাবে অথচ মামলা উঠবে না আদালতে। প্রতিপক্ষ তো বটেই নিজের উকিলও অকারণে ঘোরাবে তাকে। আর প্রতিদিন গ্রাম থেকে শহরে যাতায়াতের খরচ, কাজ ফেলে রোজগার হারিয়ে পাগল হওয়া লোকটিকে বেসামাল হতে হবে উকিলের দক্ষিণা মেটাতে। আর তারও পরে ভাগ্য সদয় হলে মামলার শুনানি হবে। বিচারক যদি সাদা চোখে তাঁর রায় দেন, তা হলে উল্লসিত হবে মানুষটি। কিন্তু অন্যায়ভাবে দখল হয়ে যাওয়া জমি ফেরত নিতে গিয়ে সে জানবে প্রতিপক্ষ আরও উঁচু আদালতে আপিল করেছে। সেখান থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে দিল্লি, আশ্রয় ভিক্ষে করার দরজাগুলো সেই অর্থবানের প্রতিনিধির কাছে খোলা। এই দরিদ্র মানুষটি চোখে পিচুটি আর বুকে জ্বালা নিয়ে শুনবে উচ্চ আদালতে তার অনুপস্থিতিতে একতরফা রায় দিয়েছে প্রতিপক্ষের অনুকূলে। নিঃস্ব এই মানুষটির পকেটে একটিও পয়সা নেই নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার, যা সংবিধান নামক বইটি তাকে দিয়েছে, আদায় করার জন্যে আর এক পা এগিয়ে যাওয়ার। আর এই সুযোগ নিয়ে এ-দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক আমলা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে ওই অর্থবানদের পাশে দাঁড়িয়ে দিনকে রাত অথবা রাতকে দিন করতে একটুও দ্বিধা করেন না। অর্থনৈতিক বৈষম্য যেখানে চূড়ান্ত সেখানে সমান অধিকারের স্লোগান হায়েনার ডাকের মতো শোনায়, এ-কথা সংবিধান রচয়িতারা বুঝেছিলেন কিনা জানা যায় না কিন্তু সুদীপদের মতো কেউ কেউ তা ভাবে। আদর্শ আর আবেগে শিহরিত দীপাবলীরা তার বিরুদ্ধে তর্ক করে যায় যতক্ষণ না বাস্তবের কংক্রিট দেওয়ালে তাদের মাথা ঠুকে যায়।

আজ সুদীপকে ভীষণ মনে পড়ছিল। সুদীপ সরাসরি রাজনীতি করত না। নাটক লিখত। কিন্তু ভারতবর্ষে বাস করে প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ভাবনা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। একা বিচ্ছিন্ন একটি কুটোর মতো শুধু ভেসে যাওয়া ছাড়া তার কিছু করার নেই। মতবিরোধ ঘটলে তাকে শুধু সরে দাঁড়াতে হবে।

দীপাবলী উঠল। যাওয়ার সময় এখনও অনেক ছিল। কিন্তু আজ এই ঘটনার পরে সময়টা একলাফে এগিয়ে দিল এখনই, আজই। একে কি পালিয়ে যাওয়া বলে। সে ভেবেছিল যাওয়ার আগে জায়গা তৈরি করে যাবে। পালিয়ে যেতে হলে তার অবকাশ পাওয়া যাবে না।

সে বাড়ির ভেতরে পা দিয়ে তিরিকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘আজ থেকে তোর ছুটি।’

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন