২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা

সমরেশ মজুমদার

বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা, স্মৃতির রকমফের ছবি, সম্পর্কের নানান টানটান মুহুর্ত একটু একটু করে অভিমান এবং অপমানবোধ থেকে জন্ম নেওয়া নির্লিপ্তির আস্তরণের তলায় চাপা ছিল। মাসিমা সেটাকেই উসকে দিলেন। বিশেষ করে নিজের মেয়ে, একমাত্র মেয়েকে হারিয়েও যখন ভদ্রমহিলা তাকে অতীত স্পর্শ করতে বললেন, তখন সে যত অবাকই হোক সেইসঙ্গে তাঁকে বুঝতে অসুবিধেও হয়নি। তার মনে হয়েছিল উনি আর দু’জন মানুষকে বুঝতে চেয়েছিলেন। নিজেকে দিয়ে তাদের অনুভূতিকে বিচার করতে তাঁর ভাল লেগেছিল। অথবা এসব কিছুই নয়, সন্তানকে হারিয়ে তাকে সন্তানের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছিলেন।

সন্তান। শব্দটির কোন অর্থে সে অঞ্জলির সন্তান? না কন্যা, না বংশধর, না সে তার অবিচ্ছেদ্য ধারা অথবা বিস্তার! সে মেয়ের মতন, নিজের মেয়ের সঙ্গে অঞ্জলি কোনও পার্থক্য রাখেনি ততদিন যতদিন না তার স্বার্থে আঘাত লাগে। এই সন্তানরা কখনই আসলের মর্যাদা পায় না। কিন্তু মনোরমা? সেই প্রৌঢ়ার মুখ মনে পড়তেই এইসব যুক্তি ভোতা হয়ে যাচ্ছিল। কত রাতের পর রাত মনোরমা তাকে পাশে শুইয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি ধ্যানধারণা তার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। শাসন এবং স্নেহে জড়িয়ে রেখেছেন। হ্যাঁ, তিনি তাকে বালিকা বয়সেই পাত্রস্থ করতে চেয়েছিলেন অন্ধতায়, কিন্তু বৈধব্যের মুহূর্ত থেকেই যেন এক টানে নিজেকে নামিয়ে এনেছিলেন তার সমরেখায়। মনোরমার আচার আচরণের অনেক কিছুই সে তখন মানতে পারেনি। প্রতিবাদ করার জন্যে নানান উপায় বের করেছিল। এখনও তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে বয়স একটা ঔদার্য এনে দেয়, তাই হয়তো প্রতিক্রিয়া তখন অন্যরকমভাবে প্রকাশ পেত। কিন্তু এই মহিলাই এখনও তাকে টানেন। অতীতের সঙ্গে যোগসূত্র রাখার একমাত্র অবলম্বন।

শিলিগুড়িতে নেমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। সুদীপ এবং মাসিমা চলে গিয়েছেন স্টেশনের দিকে। গতকাল থেকে শমিতের কোনও পাত্তা নেই। মায়াকে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল তার ইউনিটের সবাই। শমিত নাকি নেমে গিয়েছে আগেই। প্রযোজক পুলিশকে রাজি করিয়েছেন এটাকে দুর্ঘটনা বলতে। খুন নয়, যদি আত্মহত্যাও হয় তা হলে কার বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করত? সুদীপ অথবা শমিত কেউ মায়ার ভাবাবেগের জন্যে দায়ী নয়। মানুষ মরে গেলেই যদি তার সমস্ত আকাঙক্ষার শেষ তা হলে এখন কিছুই বলার নেই। কিন্তু মরে যাওয়া মানুষ জীবিতদের মনে যে-প্রতিক্রিয়া রেখে গেল তার দায় বইতে হয় অনেকদিন, কারও কারও ক্ষেত্রে সারাজীবন। শমিতকে সেই দায় বইতে হবে। নেখালিতে বসে অনাচার করে শমিত যে অশ্রদ্ধা পেয়েছিল দীপাবলীর কাছে, আজ সেই শমিতের জন্যে মন কেমন করে সমবেদনায় ভরে গেল।

শিলিগুড়ি-আলিপুরদুয়ারের বাসে সুটকেস নিয়ে উঠে বসল দীপাবলী। অনেকক্ষণ থেকে যে-ভাবনা অস্পষ্ট ছিল এখন সেটা প্রকট হল। চা বাগানে গিয়ে কোথায় উঠবে সে? এখন সাড়ে এগারোটা। অন্তত তিনটের আগে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই। গতকাল থেকেই পেটে কিছু পড়েনি। খুব ক্লান্ত লাগছে। মৃতদেহ সৎকার হবার আগে যেমন খাওয়ার প্রশ্ন ছিল না তেমনই শ্মশান থেকে ফিরে মাসিমাকে নিয়ে হোটেলে থাকার সময় তা ভাবাও যাচ্ছিল না। আজ সকালে শুধু এক কাপ চা পেটে পড়েছে। মনে হয় সুদীপেরও একই অবস্থা। মাসিমা খাওয়ার কথা বললেই মাথা নেড়ে গিয়েছেন। এই অবস্থায় ইচ্ছে হলেও তার পক্ষে খাওয়া সম্ভব ছিল না। এখন বাস যখন শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে সেবকের দিকে এগোচ্ছে তখন শরীর কেমন অসাড় লাগছিল তার।

সেবকের পথে বেশি যাওয়া আসা করতে হয়নি কখনও। উত্তর বাংলায় অনেক মানুষ কখনওই দার্জিলিং-এ যাননি। তাঁদের কাছে পাহাড়ের রোমাঞ্চ এনে দেয় সেবক ব্রিজ-সংশ্লিষ্ট পথটুকু। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ, নীচে বয়ে যাওয়া তিস্তার শব্দ, ঘুরপাক খাওয়া পথ, পাশের হাঁ করা খাদ, দীপাবলী চুপচাপ দেখে গেল। সমস্ত ভাবনা ছাপিয়ে হঠাৎ মায়ার মুখ চোখের সামনেটা জুড়ে বসেছে। মায়া নেই। একটি মধ্য কুড়ির যুবতী মেয়ে, যার অনেক ইচ্ছে ছিল এবং সেইসঙ্গে অভিমান, প্রয়োজনে যে তাকে সবসময় হাত বাড়িয়ে সাহায্য করেছে, সে আজ পৃথিবীর কোথাও নেই। কলেজের প্রথম বছরে যে মায়াকে সে দেখেছিল তার চেহারা ছিল শীর্ণ, সদ্য তরুণীর চাঞ্চল্যে ভরপুর, সেইসঙ্গে নিয়মভাঙার প্রবণতায় সবার চোখে পড়ে যেতে গর্বিত হত। একটু একটু করে তার শরীর এবং মন পালটাতে লাগল। দীপাবলী জানে শুধু অভিমানের বিষক্রিয়া মায়াকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। এমন কেন হয়? কত মানুষ তো কোনও কারণ ছাড়াই একশো বছর বেঁচে থাকেন। দীপাবলী জানলা দিয়ে তাকাল। এই মুহূর্তে বাস যদি ফুট তিনেক পিছলে যায় তা হলে সে-ও মায়ার মতো পৃথিবী থেকে মুছে যাবে। চোখ বন্ধ করল দীপাবলী। মায়া চলে গিয়েছে, কিন্তু অনেক বড় ক্ষত রেখে গিয়েছে দু’-একজনের মনে। মাসিমা এবং শমিত। সুদীপও হয়তো ভুলতে পারবে না সারাজীবন। কিন্তু সক্রিয়ভাবে স্মৃতিটাকে বহন করবে প্রথম দুইজন। সে চলে গেলে কেউ কি মনে রাখবে? কেউ? কোনও মুখ মনে আসছে না। বুকের ভেতরটা কেমন শুকনো, কাঠকাঠ। হঠাৎ আবছা হয়ে ভেসে এল অলোকের মুখ। যে-ভদ্রতা এবং পরিশীলিত আগ্রহ সে অলোকের মধ্যে দেখেছে তাও তো স্মৃতিবহন করার পক্ষে পূর্ণতা পায়নি। সোজা হয়ে বসল সে। এসব কী ভাবছে? মরে গেলে কে চিন্তা করবে কি করবে না তাতে তার কী দরকার? মরার পর সে কি দেখতে আসবে? যত্তসব! তা ছাড়া এত সাততাড়াতাড়ি সে মরবেই বা কেন? এইজন্যে বলে মৃত্যু বড় ছোঁয়াচে অনুভূতি তৈরি করে। শ্মশানে গেলে যে-কারণে বৈরাগ্য আসে।

দু’পাশে চায়ের বাগান রেখে বাস ছুটে চলছিল। আর এই চা-পাতা দেখামাত্র আচমকা ক্লান্তি সরে গেল মন থেকে, শরীরটাও ভাল হয়ে গেল। এত সবজ, এমন নীল আকাশ, এমন নিশ্চিত নির্জনতা যা কিনা সে জন্মাবধি দেখে এসেছে, আজ পরমাত্মীয় বলে মনে হল। বাজারহাট হয়ে বিনাগুড়ি দিয়ে বাস চলে যাবে গন্তব্যস্থলে। তাকে চা-বাগানে যেতে হলে বাস পালটাতে হবে বিনাগুড়িতেই। কিন্তু গিয়ে শোনা গেল পথে একটি ব্রিজ গোলমাল করায় বাস পালটানোর প্রশ্ন নেই। সে এবার চা-বাগানের মুখেই নামতে পারবে। ক্রমশ চোখের ওপর পরিচিত দৃশ্যগুলো ছুটে এল। সমস্ত বুকে এখন সুখের ঢেউ কলকল করছে। চৌমাথায় নেমে পড়ল দীপাবলী। নেমে দেখল জায়গাটা একদম পালটে গিয়েছে। রাস্তাটা তো চওড়া হয়েছেই কিন্তু তার চেয়ে বেশি চোখে পড়ছে দোকানের সাইনবোর্ড। প্রায় শহুরে চেহারা এনে দিয়েছে এই চৌমাথাকে। স্কুলে পড়ার সময় এই পথে কতবার যাওয়া আসা করেছে এককালে। তখন দোকান ছিল হাতে গোনা। হতশ্রী। সেগুলো এখনও আগের চেহারা নিয়ে টিকে আছে কিন্তু তার আশেপাশে আধুনিক চেহারার দোকান জাঁকিয়ে বসেছে। এমনকী উত্তম ছাঁটে উত্তম সেলুনও চোখে পড়ল।

বাস স্ট্যান্ডে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই তাকাচ্ছিল। কিন্তু একটিও চেনামুখ নেই। এইসময় একটি রিকশা এসে দাঁড়াল পাশে, ‘কোথায় যাবেন দিদিমণি?’

রিকশা? বাঃ, চমৎকার। সে উঠে বসল, ‘বাগানে যাব।’

তেমাথা ছেড়ে বাজারের পাশ দিয়ে রিকশা ছুটল। এই জায়গাগুলো একই আছে দেখে কিছুটা স্বস্তি এল। রবিবারে এখানে যখন হাট বসে তখন চেহারাটা পালটে যায়। সে দেখল জগু মণ্ডলের সাইকেলের দোকানের সামনে একটি যুবক দাঁড়িয়ে কাউকে নির্দেশ দিচ্ছে। একেই কি ছেলেবেলায় হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় সে দেখেছিল? বাঁ দিকে মুখার্জিদের স্টেশনারির দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। মন্টুদা আগে এইসময় খেতে যেত বাড়িতে। এখনও কি একই নিয়ম চলছে। এবার নদীটা। ছোট্ট পুল। কিন্তু এ কী অবস্থা। নদীতে এক ফোঁটা জল নেই। এই নদী এঁকেবেঁকে তাদের কোয়ার্টার্সের পেছন দিয়ে ফ্যাক্টরির দিকে চলে যেত। ফ্যাক্টরির বিদ্যুৎ তৈরিতে সাহায্য করত। রিকশাওয়ালা বলল, ‘এখন তো সব ইলেকট্রিক হয়ে গেছে দিদি। নদীর মুখ বন্ধ করে ওপাশ দিয়ে স্রোত ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

আর তখনই তার খেয়াল হল। এ কোথায় যাচ্ছে সে? এতকালের অভ্যস্ত পথে যাওয়ার তো কোনও কারণই নেই। অমরনাথের মৃত্যুর পরে চায়ের বাগানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। না বড় ভাইকে কোম্পানি চাকরি দিয়েছে। বড় ভাই, হেসে ফেলল সে। ওরা তো বড় হবার পর কখনই তাকে দিদি বলে স্বীকার করেনি। অঞ্জলি চা-বাগানের কাছে নতুন কলোনিতে কেনা জমিতে বাড়ি করেছে। সেখানেই আছে সবাই। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পরে ওকে নিশ্চয়ই কোয়ার্টার্স দিয়েছে কোম্পানি।

ততক্ষণে সেই বিরাট মাঠ, চাঁপাফুলের গাছ এবং সার সার বাবুদের বাড়িগুলোর সামনে রিকশা চলে এসেছে। মাঠের মাঝখানে রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল সে। সামনেই তাদের সেই কোয়ার্টার্স যেখানে সমস্ত ছেলেবেলা কেটেছে তার। মনে হচ্ছিল এখনই খবর পেয়ে অমরনাথ বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসবেন। ভাবামাত্র দরজা খুলে গেল। একটি বছর বারোর ছেলে এসে সেখানে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকে দেখতে লাগল।

দীপাবলী হাত নেড়ে তাকে কাছে ডাকল। প্রথমে ছেলেটি সংকোচে এগিয়ে আসতে চাইছিল না। দ্বিতীয়বারে শক্ত পায়ে কাছে এল। দীপাবলী তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা এখন এই বাড়িতে থাকো বুঝি?’

ছেলেটি নীরবে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।

‘তোমাদের আগে যারা এ-বাড়িতে থাকত তারা এখন কোথায় আছে, জানো?’

‘মা জানে!’ বলেই ছেলেটি দৌড়ে বারান্দা টপকে মা মা বলে ডাকতে ডাকতে ভেতরে ছুটে গেল। রিকশাওয়ালা বলল, ‘শুনেছি এ-বাড়িতে যিনি থাকতেন তিনি মারা গিয়েছেন।’

দীপাবলী জবাব দিল না। সে রিকশা থেকে নেমে চারপাশে নজর বোলাচ্ছিল। সময় মানুষের শরীর এবং জীবন থেকে যত দ্রুত সবকিছু কেড়ে নিতে পারে প্রকৃতির ক্ষেত্রে বোধহয় সেরকম সফল হয় না। এই মাঠ, ওই বাতাবি লেবুর গাছ এতগুলো বছরেও তেমন পালটায়নি, এমনকী ওই একটা ডালভাঙা চাঁপা গাছটাকেও অবিকল এই অবস্থায় দেখে গিয়েছিল।

এইসময় ভেতর থেকে খুব রোগা চেহারার মধ্যবয়সি মহিলা বেরিয়ে এলেন। সম্ভবত রান্নাঘরে ছিলেন কারণ তাঁর শাড়িতে অযত্ন স্পষ্ট। বারান্দায় পা দেবার সময় মাথায় ঘোমটা টানার একটা চেষ্টা ছিল। সম্ভবত কোনও পুরুষ সঙ্গে নেই বলে সেটা আর তুললেন না। মুখে চোখে অশিক্ষার ছাপ কিন্তু প্রশ্ন করলেন সরাসরি, ‘আপনি কাউকে খুঁজছেন?’

‘হ্যাঁ। একসময় আমি এখানে থাকতাম। আমার বাবা অমরনাথবাবু এখানে চাকরি করতেন।’

‘ও। আমরা ওঁর নাম শুনেছি। আপনার বাবা?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু ওঁর তো শুনেছি দুই ছেলে!’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি ওঁকে বাবা বলেই জানতাম।’

‘ও, হ্যাঁ। আপনি কলকাতায় থাকেন, না? অল্প বয়সে বিয়ে হবার পরেই বিধবা হয়েছিলেন? তাই তো?’ ভদ্রমহিলার মুখচোখে প্রবল উৎসাহ।

দীপাবলীর বুকে থম লাগল। এই সত্য, চূড়ান্ত সত্য, তাকে বারংবার আড়ষ্ট করবে। অন্তত ফেলে যাওয়া পরিধিতে ফিরে এলে।

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনার গল্প আমরা খুব শুনেছি। ওই যে, শ্যামলবাবুর বউ, উনি বলেন। কিন্তু আপনার ভাই তো কোয়ার্টার্স পায়নি।’

‘পায়নি?’

‘না। আপনারা চলে যাওয়ার পর তো কোম্পানি আর বাড়ি বানায়নি। অথচ বাবুর সংখ্যা বেড়েছে। ও মা ঠাকুমাকে নিয়ে কলোনিতেই থাকে। তবে এখানে শুনছি কোয়ার্টার্স হবে। ওই মাঠের ওপাশে, তখন নিশ্চয়ই পাবে।’

‘কলোনিতে কোথায় থাকে জানেন?’

‘তা তো বলতে পারব না। ফরেস্টের রাস্তায়। এই পুজোয় ওর মায়ের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে গিয়ে দেখা হয়েছিল।’

এইসময় রিকশাওয়ালা বলে উঠল, ‘ও হো, আমি বুঝতে পেরেছি। যে-বাবু কলোনি থেকে চা-বাগানে চাকরি করতে আসে তার বাড়িতে যাবেন তো? উঠে বসুন দিদিমণি, আমি নিয়ে যাচ্ছি।’ দীপাবলী স্বস্তি পেল। সে ভদ্রমহিলাকে ‘আসছি’ বলে রিকশায় উঠে বসল। দীপাবলীর মনে হল ভদ্রমহিলার কৌতূহল তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু রিকশা চলতে শুরু করামাত্র সে আবিষ্কার করল আবার সেই ক্লান্তি ফিরে আসছে। ভদ্রমহিলার কথায় যে একটু খুঁচিয়ে দেবার প্রবণতা ছিল। তাকে নিয়ে এখনও এই বদ্ধ জায়গায় গল্প তৈরি হয়। আচ্ছা, অতীত কেন উদার হতে পারে না! কেন সে এমনভাবে রক্তাক্ত করে চলে সমানে!

স্কুলের মাঠের পাশ দিয়ে ফরেস্টের দিকে মেছুয়া পুলের রাস্তায় এগিয়ে রিকশাটা ডান দিকে বাঁক নিল। এইসব অঞ্চল আগে পতিত ছিল। বুনো গাছে ভরা বলে কেউ আসত না। এখন তার চেহারা পালটেছে। পূর্ববঙ্গের মানুষেরা এখানে আশ্রয় নিয়ে সুন্দর কলোনি তৈরি করে ফেলেছেন। তবে বাড়িঘর এবং তার বাসিন্দাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আর্থিক অবস্থা খুব সুবিধের নয়। রিকশা থামল যে-বাড়ির সামনে তার সামনে বাখারিব বেড়া দেওয়া একটা জমি আছে যা হয়তো বাগানের জন্য ভাবা হয়েছিল কিন্তু কোনওদিন কখনই চেষ্টা হয়নি। রিকশাওয়ালা বলল, ‘এই বাড়ি’।

একতলা তিনঘরের কাঠের বাড়ি, সিমেন্টের মেঝে এবং টিনের চাল। পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে না। দীপাবলী ইতস্তত করল। বাড়ির কেউ সামনের দিকে নেই। সে রিকশাওয়ালাকে বলল, ‘তুমি ভাই একটু অপেক্ষা করো।’

এখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। ছায়া ঘন হচ্ছে। দীপাবলী গেট খুলে জমিটা পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে বন্ধ দরজায় শব্দ করল। দ্বিতীয়বারে যে-গলা সাড়া দিল তা যে অঞ্জলির বুঝতে অসুবিধে হল না। দীপাবলী বলল, ‘আমি’। নিজের স্বর কেমন অচেনা লাগল নিজেরই কানে। সে শক্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

দরজা খুলল অঞ্জলি। দীপাবলী চমকে উঠল। এ কী চেহারা হয়েছে! রোগা, চোখ গর্তে বসে গেছে, সামনের চুলে পাক ধরেছে। সেই সুন্দরী না হলেও সুশ্রী অঞ্জলিকে আর খুঁজে পাওয়াই যাচ্ছে না। সেইসময় অঞ্জলির মুখ থেকে ছিটকে এল, ‘তুই’!

‘তোমার এ কী চেহারা হয়েছে?’

ততক্ষণে অঞ্জলি বাইরে বেরিয়ে এসে প্রায় জড়িয়ে ধরেছে দীপাবলীকে, ‘আমার কথা থাক। কিন্তু তুই এসেছিস, আমি ভাবতেই পারছি না। দীপু, তুই?’

প্রচণ্ড অবাক হবার পালা এখন দীপাবলীর। সেই অঞ্জলির মুখে এখন কী স্বর শুনছে সে? যে-মানুষটি স্বার্থের কারণে তার সঙ্গে নীচ ব্যবহার করতে দ্বিধা করেনি একসময় তার আজ এ কী আচরণ? মুহুর্তেই সেই ছেলেবেলা, যখন অঞ্জলির আচরণ সত্যিকারের মায়ের মতো ছিল, যেন এক ছুটে চলে এল দীপাবলীর সামনে। দীপাবলীর শরীর থরথর করে উঠল। একরাশ আবেগ ঝাঁপিয়ে পড়ল বুকে। আর তখনই, অঞ্জলি তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠতেই বাঁধ ভেঙে গেল। মাকে জড়িয়ে ধরে মেয়েও কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতেই ওরা দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল। কান্না গলায় রেখে অঞ্জলি বলল, ‘তুই আমাকে ক্ষমা কর। আমি অনেক অন্যায় করেছি, ক্ষমা কর।’

দীপাবলী কিছু বলতে গিয়ে দেখল গলা জড়িয়ে যাচ্ছে। অঞ্জলি সমানে বলে যাচ্ছিল। সেই বিয়ে থেকে শুরু করে যেসব ব্যবহার সে করেছে নিজের এবং দুই ছেলের স্বার্থের জন্যে তার বিশদ বিবরণ দিয়ে আত্মসমালোচনা করছিল। শেষপর্যন্ত দীপাবলী বলতে বাধ্য হল, ‘মা, চুপ করো। এসব শুনতে তামার ভাল লাগছে না।’

তবু অঞ্জলি বলল, ‘তুই আমায় ক্ষমা করবি না দীপু?’ দীপাবলী নিশ্বাস ফেলল ‘তুমি যখন বুঝতে পেরেছ তখন সব শেষ হয়ে গিয়েছে।’

ব্যাপারটা হয়তো সেখানেই শেষ হত না যদি না রিকশাওয়ালা বারান্দা থেকে ডাকত, ‘দিদিমণি, আপনি কি আমাকে ছেড়ে দেবেন?’

অঞ্জলি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ওমা, তুই রিকশা ছেড়ে দিসনি? হ্যাঁ বাবা, তুমি চলে যাও। বাক্সটা দেখি। কত দিতে হবে।’

‘দুটো টাকা দিন। সেই চা বাগানের বাসা থেকে ঘুরে আসছি।’

অঞ্জলি অবাক, ‘তুই পুরনো বাসায় গিয়েছিলি?’

‘হ্যাঁ, খেয়াল ছিল না।’ দীপাবলী রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিতে সে চলে গেল। সুটকেসটা হাতে নিয়ে সে বলল, ‘একটা কথা বলব?’

‘হ্যাঁ, বল।’ অঞ্জলি দরজা বন্ধ করছিল।

‘আমি এখানে আজ থাকলে তোমাদের অসুবিধে হবে?’

অঞ্জলি চমকে ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখ বিস্ফারিত। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেল দীপাবলী, ‘আমি— মানে— জানি না—!’ সে কথা শেষ করতে পারল না।

‘আজ মানে?’

‘আমাকে কালকে চলে যেতেই হবে।’

‘কেন?’

‘মা। আমি আর পারছি না। কাল থেকে কিছু খাইনি। কাল আমার এক বন্ধু মারা গিয়েছে। তোমাকে পরে সব বলব।’

অঞ্জলি এগিয়ে এসে আবার তাকে জড়িয়ে ধরল, ‘মা হয়ে তোর কাছে ক্ষমা চেয়েছি। তারপর এমন কথা বলিস না যাতে আমি কষ্ট পাই।’

‘তোমার ছেলেরা—।’

‘এটা তোর বাবার টাকায় তৈরি বাড়ি। এই বাড়িতে থাকার সবরকম অধিকার তোর আছে। অন্তত আমি যতদিন বেঁচে আছি।’

দীপাবলী হাসল। এই প্রথম। তারপরেই মনোরমার কথা মনে পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠাকুমা কোথায়?’

‘এইমাত্র খেয়ে উঠল। বোধহয় কলতলায়।’

‘এত বেলায়?’ দীপাবলী সুটকেস নামিয়ে এগিয়ে বলল।

ভেতরের বারান্দায় রাজ্যের জিনিসপত্র স্তূপ করে রাখা। দেখলেই বোঝা যায় চা-বাগানের কোয়ার্টার্সে অঞ্জলি যে-আরামে থাকত তা এখানে সম্ভব হচ্ছে না। একটা উঠোন আছে, একটা কুয়োও। উঠোনের একপাশে কাঠের রান্নাঘর কিন্তু তার মেঝে বাঁধানো নয়। উলটোদিকে আর একটি কাঠের ঘর। তার ছাদ টিনের এবং মেঝে এক ইটের গাঁথনিতে তৈরি। ঘরের দরজা আধভেজানো, দীপাবলীর বুঝতে অসুবিধে হল না ওইটি মনোরমার ঘর। তার মনে হল কেমন যেন অবহেলা মিশে আছে ওই ঘরটিতে। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে দেখল অঞ্জলি ভেতরের দরজায় হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

দীপাবলী উঠোনে নেমে এল। পা থেকে জুতো খুলল। তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ঘরটার দিকে। ছোট্ট ঘর। মাটিতেই রান্নার ব্যবস্থা। পাশে একটি বড় তক্তাপোশ। তাতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন মনোরমা। চুল ভোলা। মুখ পেছন দিকের জানলার দিকে ফেরানো। জানলার বাইরে কলাগাছের ঝোপ। শেষ বিকেলের রোদ পড়েছে তার পাতায়। সেই দিকেই সম্ভবত চেয়ে আছেন মনোরমা মগ্ন হয়ে। এই সামনের দিকে পা ছড়িয়ে হাত কোলের ওপর রেখে ঈষৎ ঝুঁকে বসার ভঙ্গির মধ্যে ক্লান্তি স্পষ্ট। চুল উঠে গেছে অনেক। যা আছে তাতে রুপোলি ঝিলিক। উনি দেখতে বা বুঝতে পাচ্ছেন না দরজায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। বুক টনটন করে উঠল দীপাবলীর। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। প্রায় নিঃশব্দে মনোরমার পাশে বসল। কিন্তু তাতেই ঘাড় ঘোরালেন মনোরমা। তারপর মুখ ফিরিয়ে জানলার দিকে তাকালেন। কিন্তু সেটা এক মুহূর্ত মাত্র। চকিতে আবার তার মুখ ফিরল। এবার চোখ বিস্ফারিত, হাত কাপছে। দীপাবলী তাঁকে জড়িয়ে ধরল। ধরে কাঁধে মুখ গুজল। মনোরমা কোনও কথা বললেন না। তার হাত আবার কোলের ওপর পড়ে গেল। কেমন গুটিয়ে গেলেন তিনি। এবং তাঁর শরীরে প্রচণ্ড কাঁপুনি হচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পরে দীপাবলী কথা বলল। তার কণ্ঠস্বর প্রায় ফিসফিস শোনাল, ‘কেমন আছ?’

মনোরমা কথা বললেন না। দীপাবলী আবার একই স্বরে বলল, ‘আমি তোমাকে দেখতে এসেছি।’

‘কী দরকার?’ আমি তোর কে? কেউ না। আমাকে দেখতে আসার কী দরকার?’

দীপাবলী কিছু বলল না। এইসময় অঞ্জলির গলা পাওয়া গেল, ‘কাল থেকে কিছু খাসনি বললি, হাতমুখ ধুয়ে নে, আমি খেতে দিচ্ছি।’

মনোরমা মুখ ফেরালেন, ‘খাওয়া হয়নি কেন? কী হয়েছে?’

দীপাবলী হেসে ফেলল, ‘তোমার কী? তুমি তোমার রাগ নিয়ে থাকো।’

‘ঝগড়া করার জন্যে এখানে আসা হয়েছে।’

‘বুঝেছি। বাইরের কাপড়ে তোমাকে ছুঁয়েছি বলে রাগ হয়েছে।’

‘ওসব আর মানি না আমি।’

‘ওমা, সেকী, কবে থেকে?’

অঞ্জলি হেসে দরজা থেকে সরে যেতেই মনোরমা বললেন, ‘তুই কী রে? তোর মন এত পাষাণ? সব ভুলে গেলি তুই?’

‘আমি একা ভুলে গেছি ঠাকুমা? আর ভুললে আমি কি আজ এখানে আসতাম?’

মনোরমা কয়েক মুহূর্ত এক দৃষ্টিতে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘কাল থেকে খাসনি যখন তখন আর বসে থাকিস না। যা হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নে।’

বেলা নেই। বেশি খেতেও ইচ্ছে ছিল না। দীপাবলী দেখল অঞ্জলি তাকে রুটি তরকারি দিয়েছে। অমরনাথ বেঁচে থাকতে ওদের বাড়িতে রুটি হত রাত্রে। জলখাবার– হয় লুচি নয় পরোটা। সেসময় রুটি খাওয়ার চল তেমন ছিল না। দীপাবলী দুটো রুটি আব তরকারি খেল। তরকারি মুখে দেওয়ামাত্র মনে হল অমৃত। কতকাল এই চেনা স্বাদের তরকারি সে খায়নি! জল খাওয়ার পর মনে হল আর জেগে থাকতে পারবে না। সুটকেস আগেই মনোরমার ঘরে নিয়ে এসেছিল সে। অঞ্জলি খুব আপত্তি করেছিল। মূল বাড়িতে একলা একটি ঘরে থাকে সে। দীপাবলী স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে সেখানে। দীপাবলী সেই আপত্তি শোনেনি। হেসে বলেছিল, ‘সারাটা ছেলেবেলা ঠাকুমার পাশে শুয়েছি। আবার কখনও এই সুযোগ পাব না হয়তো। আজ সেটা ছাড়ছি না।’

খাওয়ার সময় মনোরমা এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর থানে সাদা ভাব কম। নিয়মিত কাচা হয় বটে কিন্তু থান তার জাত হারিয়েছে। চেহারাও খারাপ হয়ে গিয়েছে। খেতে খেতে তাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। কী চাকরি করত? চাকরিটায় কত মাইনে ছিল? এমন চাকরি সে ছাড়ল কেন, কোনও গোলমাল হয়েছিল কিনা? মেয়েছেলে হয়ে অমন চাকরি করার সময় কোনও অসুবিধে হয়নি তো? এখন সে কী করছে? কিছু না করে দুম করে কেউ চাকরি ছেড়ে দেয় নাকি? ইত্যাদি ইত্যাদি। যতটা সম্ভব ধৈর্য নিয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে গিয়েছে সে।

খাওয়ার পরেই সোজা চলে এসেছে মনোরমার ঘরে। কোনও কথা না বলে বিছানায় একপাশে টানটান হয়ে শুয়েছে এক মিনিট। তারপর উপুড় হয়েছে। তৎক্ষণাৎ নাকে বিছানার গন্ধ, সেই ছেলেবেলার রাতগুলো চলে এল। মনোরমা দরজায় এসে বললেন, ‘এই ভর বিকেলে ঘুমোবি? মাঝরাত্রে উঠে বসতে হবে! তার চেয়ে সন্ধে নাগাদ কিছু খেয়ে একেবারে শুয়ে পড় না?’

দীপাবলী কোনও জবাব না দিয়ে সেই গন্ধটাকে উপভোগ করতে লাগল। মনোরমার গায়ের গন্ধের সঙ্গে বিছানার গন্ধ মিশে আছে। সে চোখ বন্ধ করে তার আরাম পেতে চাইছিল। সময় যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, এত ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও তার ঘুম আসছিল না। এখন শরীর নাড়ার ক্ষমতাও চলে গিয়েছে। হাত পায়েও আলস্য। উপুড় হয়ে পড়ে থেকে হঠাৎ সে মাথায় পিঠে হাতের স্পর্শ পেল। মনোরমা পাশে এসে বসেছেন। তাঁর শীর্ণ আঙুলগুলো সেই ছেলেবেলার মতো তার শরীরে আরাম এনে দিচ্ছে। কতদিন কেউ তাকে এমনভাবে যত্ন করেনি ঘুমোবার সময়। এই পৃথিবীতে সে কীরকম একা হয়ে বেঁচে ছিল। অথচ পুরনো সম্পর্কগুলোয় জায়গা কখনও কখনও থেকে যায় তাই জানা ছিল না। দীপাবলী নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল। সে জানল না তাকে ছুঁয়ে মনোরমা বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে মশারি টাঙিয়ে দিলেন।

যেন গভীর জল ফুঁড়ে ওপরে উঠে আসার মতো একসময় চেতনা এবং অবচেতনার মধ্যে দীপাবলীর অদ্ভুত আরামের অনুভূতি এল। বাঁ হাত ঈষৎ প্রসারিত হতেই একটি শরীর ঠেকল আঙুলে। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরে সতর্কীকরণের ঘণ্টা বাজল যেন। তার পাশে কেউ শুয়ে আছে। একাকী শোওয়ায় অভ্যস্ত দীপাবলীর ঘুম মুহূর্তেই উধাও। সে ধড়মড় করে উঠে বসল। বুকের বাতাসে থম ধরেছে ততক্ষণে। মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল?’

‘ওঃ বাবা, তুমি!’ বুকে হাত চলে গেল, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে।

মনোরমা হাসলেন, ‘খুব ভয় পেয়ে গেছিলি?’

‘হুঁ’। আমার পাশে কেউ শোয় না তো!’ বলেই হাসল দীপাবলী, ‘তুমি ঘুমোওনি?’

‘তোর জন্যে বসে আছি। ওঠ, মুখ ধুয়ে আয়। দরজার কাছে বালতিতে জল আছে। আমি খাবার দিচ্ছি।’ মনোরমা উঠে মশারিতে হাত দিয়ে বললেন, ‘সাবধানে নামবি। একবার ভেতরে মশা ঢুকে গেলে সারারাত ঘুমোতে দেবে না।’

দীপাবলীর মনে পড়ল মশা সম্পর্কে সতর্ক করার অভ্যেস মনোরমার আগেও ছিল। সহসা ঘুম চলে যাওয়ায় খিদের বোধটাই আসেনি, দীপাবলী জিজ্ঞাসা’ করল, ‘ক’টা বাজে? এখনই খাব কেন?’

‘এগারোটা বেজে গিয়েছে। নাম।’ মনোৱমা নেমে দাঁড়ালেন। ঘরে একটা ভুসো ওঠা হ্যাঁরিকেন জ্বলছে। দীপাবলী মশারির ভেতরে বসেই জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে?’

‘আমি রাত্রে খাই না। বিকেলে খেয়েছি এখনও ঢেকুর উঠছে।’

‘তুমি দিনে একবারই খাও?’

‘এই বয়সে একবারই যথেষ্ট।’

রাত্রেও রুটি তরকারি এবং দুধ। দুধটা সরিয়ে রাখল দীপাবলী। এই নিয়ে একটু তর্ক হল। তারপর সে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা শুয়ে পড়েছে?’

‘হুঁ। আর কতক্ষণ জেগে থাকবে।’

খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র চিৎকার শোনা গেল। জড়ানো গলায় কেউ দরজা খুলতে বলছে। দীপাবলী মুখ তুলল, ‘কী ব্যাপার?’

‘ও কিছু নয়। কান দিস না।’

‘এ-বাড়িতেই মনে হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ। ছোটখোকা।’

‘মদ খেয়েছে?’

‘হুঁ। একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পড়াশুনা করেনি। ট্যাক্সি চালায়। আর রোজ রাত্রে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে এমন করে।’

‘তোমার বড় নাতি?’

‘সে ভাল। অফিস থেকে এসে তোর কথা শুনে দেখতে এসেছিল। ঘুমাচ্ছিলি বলে আর ডাকেনি। ওর জন্যেই সংসার টিকে আছে।’

বাইরে চেঁচামেচি চলছিল। এইসময় অঞ্জলির গলা পাওয়া গেল। যথাসম্ভব নিচু গলায় ছেলেকে বোঝাচ্ছে শান্ত হবার জন্যে। ছেলের গলা পাওয়া গেল, ‘কে?’

অঞ্জলির জবাব শোনা গেল না এতদূর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার, ‘এই বাড়িতে কেন? কেন এল? তুমি তো বলতে আমাদের সর্বনাশের জন্যে ও-ই দায়ী। বাবা ওর জন্যে মরে গেল। কেন এল?’

অঞ্জলি কিছু বলল। যেন অনুনয়। এবং তারপর হঠাৎই এই বাড়ি শব্দহীন হয়ে গেল। কাঠ হয়ে বসে রইল দীপাবলী। কথাগুলো কানের ভেতরে সিসে ঢেলে দিয়েছে যেন। মনোরমা বললেন, ‘যা, হাত ধুয়ে নে।’

‘তুমি শুনলে কথাগুলো?’ দীপাবলী চাপা গলায় বলল।

মাতালের প্রলাপ ধরতে নেই। ‘যা মুখ ধুয়ে আয়।’

আরও পরে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে মনোরমা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। তাঁর হাত জড়িয়ে ধরল দীপাবলী, ‘সব কেমন হয়ে গেল ঠাকুমা!’

‘হুঁ! আর কত দেখব? আমি আর পারছি না। সবার মরণ হয় কেন আমার হয় না? দীপা, তুই আমাকে তোর কাছে নিয়ে যাবি?’

‘আমার কাছে?’

‘আমি আর পারছি না রে!’

‘বেশ। আর ক’টা মাস অপেক্ষা করো। আমি এখান থেকে কলকাতায় ফিরেই ট্রেনিং-এ চলে যাব। বাবা, মাস্টারমশাই যা ভাবতে পারতেন না সেইরকম একটা চাকরি পেয়েছি আমি। ট্রেনিং শেষ হলে চাকরিতে যোগ দিয়েই আমি তোমাকে নিয়ে যাব আমার কাছে।’ মনোরমাকে জড়িয়ে ধরল দীপাবলী।

‘কী চাকরি করতে যাচ্ছিস তুই?’

‘সরকারি চাকরি। সরকারের যে-সমস্ত চাকরি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় এই চাকরিটা। তুমি ক’টা দিন অপেক্ষা করো।’

‘তুই বিয়ে করবি না?’

‘বিয়ে?’

‘হ্যাঁ, কত কী শুনতাম তোকে নিয়ে। তোর মামা জানাত।’

‘এখনও ভাবিনি। আমি যদি বিয়ে করি তোমার আপত্তি আছে, না?’

‘না। আগে ওসব ভাবতাম। কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি কী ভুলই না ভেবেছি। তেমন ভাল ছেলে যদি পাস তা হলে বিয়ে করিস। নিজের সব কথা বলিস তাকে।’ একটু থামলেন মনোরমা, ‘কিন্তু সে যদি আমার থাকা নিয়ে আপত্তি করে?’

দু’হাতে মনোরমাকে জড়িয়ে ধরল দীপাবলী। তারপর সেই ছেলেবেলায় গলায় জবাব দিল, ‘তা হলে তাকে একদম দুর করে দেব।’ বলেই হেসে উঠল, ‘তুমি নিশ্চিত থাকো, আমাকে কেউ বিয়ে করবে না।’

সকল অধ্যায়

১. ১. কাকভোর বলে কিছু নেই এখানে
২. ২. টেলিগ্রামটা ছিঁড়ল দীপাবলী
৩. ৩. এরকম একটা দিনের কথা
৪. ৪. অর্জুন নায়েক
৫. ৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে
৬. ৬. এস ডি ওর অফিসে
৭. ৭. অবস্থা খুব গোলমেলে
৮. ৮. দীপাবলী বসে পড়ল
৯. ৯. সতীশবাবু
১০. ১০. দাদাবাবু
১১. ১১. বাঙালির চরিত্র
১২. ১২. শুতে বসতে অস্বস্তি
১৩. ১৩. ন্যাড়া গাছটা
১৪. ১৪. হাটতলা পেরিয়ে
১৫. ১৫. সকালে উঠেই তিরি চলে গিয়েছে
১৬. ১৬. দোতলা বাসের জানলা
১৭. ১৭. জীবন দাবা খেলার মত
১৮. ১৮. এ এক অপূর্ব আনন্দ
১৯. ১৯. দিল্লী শহরে
২০. ২০. ইন্টারভিউ কেমন হল
২১. ২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর
২২. ২২. বুকের ভেতর জমে থাকা ছেলেবেলা
২৩. ২৩. ঘুম ভেঙ্গেছিল সাতসকালে
২৪. ২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল
২৫. ২৫. যাত্রাপথে
২৬. ২৬. কিছু ভাল ছেলেমেয়ে
২৭. ২৭. কর্মচারীদের আচরণবিধি
২৮. ২৮. শুভ্রাদের বাড়ির সামনে
২৯. ২৯. নতুন ফ্ল্যাটে
৩০. ৩০. দিল্লীতে দূরত্ব কোন সমস্যাই নয়
৩১. ৩১. সরকারি চাকরিতে
৩২. ৩২. চাকরির ক্ষেত্রে
৩৩. ৩৩. ঘরে বাইরে নিরন্তর যুদ্ধ
৩৪. ৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা
৩৫. ৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক
৩৬. ৩৬. দীপাবলী এবং অলোক
৩৭. ৩৭. হাওড়া স্টেশনে
৩৮. ৩৮. কলকাতা অফিসের এক নম্বর বস
৩৯. ৩৯. সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল
৪০. ৪০. মনোরমা কলকাতায়
৪১. ৪১. মনোরমার জ্বর
৪২. ৪২. মনোরমার বিদ্রোহ
৪৩. ৪৩. নিজের মনের অন্ধকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন