গোপালকৃষ্ণ রায়
আমার সঙ্গে একবার কাশীশ্বর মিত্রের দেখা হয়েছিল। আমি তখন গঙ্গার ঘাটে অন্তর্জলি যাত্রীদের দেখাশোনা করতাম। সেই সময়ের হিন্দুরা বিশ্বাস করত যে, অন্তর্জলি করে মৃত্যুবরণ করলে নরককে পাশ কাটিয়ে সরাসরি স্বর্গে যাওয়া যায়। কিন্তু মুমূর্ষু মৃত্যুযাত্রী ও তাদের আত্মীয় পরিজনদের কষ্ট দেখে আমি দুঃখ পেতাম। নিম্নাঙ্গ জলের মধ্যে ডুবিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকত মৃত্যু প্রতীক্ষিত মানুষটি। ঘরে থাকলে মানুষটি হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচত। কিন্তু ঘরে মৃত্যু যে অপঘাত তুল্য। আত্মার শান্তি হয় না। মনে অশান্তি নিয়ে বাড়ির চারদিকে ঘুরঘুর করে।
স্বর্গের রথের অপেক্ষায় নিম্নাঙ্গ গঙ্গায় ডুবিয়ে যিনি হরিনাম করছেন, তাঁকে তো আর ফেরানো যাবে না। ফেরানোটা হবে মহাপাতকের কাজ। তারচেয়ে অন্তর্জলি যাত্রীর আত্মীয়স্বজনের জন্য একটা আশ্রয়শালা করে দিলে বেচারিরা অন্তত রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-জলের হাত থেকে বাঁচবে। মুমূর্ষুযাত্রীর স্বর্গের রথ কবে আসবে, তার তো কোনো ঠিক নেই। শুধু শুধু আত্মীয়-পরিজনেরা কষ্ট পায় কেন!
একদিন গঙ্গার ঘাটেই দেখা হয়ে গেল কাশীশ্বর মিত্রের সঙ্গে। মিত্র মশাই মহাধনী। গঙ্গার ধারেই তাঁর বিশাল বাড়ি। টাকাপয়সা ধনদৌলত থাকলে কী হবে! মিত্রমশাইয়ের মনে সুখ ছিল না। চার-চারটে বিয়ে করা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নি:সন্তান। সৎ কাজে বেহিসাবি ছিলেন মিত্রমশাই। সেকালে মানুষ তাঁকে অষ্টাবিংশ শতাব্দীর কলকাতার দাতাকর্ণ বলত।
গঙ্গার ধারে ধীরে ধীরে বেড়াচ্ছিলেন কাশীশ্বর। সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে করজোড়ে বললাম, হজুর, একটা নিবেদন আছে।
কাশীশ্বর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি অন্তর্জলি যাত্রীদের দেখাশোনা করো, না?
আমায় চিনতে পেরেছেন দেখে আহ্লাদে গদগদ হয়ে উঠি। দন্তবিকাশে আমার হাসি বিগলিত হয়।
হুজুর আমার একটা নিবেদন আছে।
বলো।
অন্তর্জলি যাত্রীর পরিজনেরা খোলা আকাশের নীচে বড়ো কষ্ট পায়। স্বর্গারোহণের সময় তো কারো জানা নেই। কেউ কেউ চার-পাঁচ দিনও টিকে যায়। আর এই চার-পাঁচ দিন পরিজনেরা রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে। একটু নিশ্চিন্তে বিশ্রামও নিতে পারে না। তাই বলছিলাম, হুজুর যদি একটা বিশ্রামাগার তৈরি করে দেন—তাহলে মানুষগুলির বড়ো উপকার হয়।
আমার নিবেদন মঞ্জুর করেছিলেন কাশীশ্বর মিত্র। একটি ঘাট আর একটি গঙ্গাযাত্রীর আবাস নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। সেটা ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের কথা।
আমার মনে পড়ে, কলকাতায় হিন্দুদের শবদেহ সৎকারের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। গোটা গঙ্গার ধারটাই ছিল শ্মশান। গঙ্গার ধারেই মৃতদেহ পোড়ানো হত। কেউ কেউ আবার মৃতদেহের গলায় মাটির কলসি বেঁধে সুরেশ্বরী গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিত। মৃত্যুর পর জন্তুজানোয়ারদেরও পবিত্র গঙ্গার জলেই গতি হত। মানুষ আর জানোয়ার স্রোতের ঢালে পাশাপাশি ভেসে যেত। কাশীশ্বর মিত্রের ঘাট সম্ভবত কলকাতার হিন্দুদের প্রথম স্থায়ী শ্মশান। কাশী মিত্র ঘাট তৈরি হবার প্রায় এক-শো বছর পর ১৮৮২-৮৩ খ্রিস্টাব্দে জনৈক অক্ষয়চন্দ্র গুহ একটি গঙ্গাযাত্রীর আবাস তৈরি করে দিয়েছিলেন।
হিন্দুদের জন্য স্থায়ী শ্মশানঘাট না থাকলেও খ্রিস্টানেরা শবদেহ সৎকারের জন্য নির্দিষ্ট সমাধিক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। কাশী মিত্র ঘাট তৈরির সাত বছর আগেই ইংরেজরা তদানীন্তন বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডে বিশাল এলাকা নিয়ে সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করেছিলেন। ইংরেজদের কান্ডকারখানা দেখেই আমি মিত্রমশাইকে একটা পাকা শ্মশান তৈরির আবেদন করেছিলাম। দেশপ্রেমিক মিত্রমশাই, যিনি মহারাজ নন্দকুমারের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন, কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি পাকাপোক্ত শ্মশান তৈরি করে দিলেন। এই ঘাটের সঙ্গেই তাঁর নাম জড়িয়ে আছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিলেন জন্তুজানোয়ারের সঙ্গে মানুষের মৃতদেহও গঙ্গার জলকে দূষিত করে তুলছে। তদানীন্তন স্যানেটারি কমিশনের প্রেসিডেন্ট জন স্ট্র্যাচি ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন ‘যে গঙ্গা কলিকাতাবাসীর জীবনধারণের সব কাজে ব্যবহার হয়, সেই গঙ্গায় প্রতি বছর পাঁচ হাজারের ওপর মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়।’
স্ট্র্যাচির রিপোর্টের একদশক আগেও তদানীন্তন বাংলা সরকার গঙ্গায় মৃতদেহ নিক্ষেপ বন্ধের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হিন্দুদের বিরোধিতায় সে-প্রথা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তাপিত দেহ গঙ্গার জলে স্নিগ্ধ না হলে স্বর্গারোহী আত্মার কষ্ট হয়!
কাশীশ্বরবাবুর সঙ্গে দেখা হবার ঠিক এক-শো বছর পরে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে নড়ালের জমিদার চন্দ্রকান্তবাবুকে কাশীপুর ঘাটে দেখেছিলাম। নিজের জমিতে দাঁড়িয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একসঙ্গে গোটা চারেক শব ভেসে চলেছে। না পুড়িয়েই মৃতদেহ ভাসিয়ে দিয়েছে কেউ। একটা নির্দিষ্ট শ্মশানের অভাবেই সম্ভবত মৃতদেহগুলি সৎকার না করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নমস্কার করে পাশে দাঁড়াতেই রাজাবাবু আমার মুখের দিকে তাকালেন। করজোড়ে কাশীশ্বর মিত্রকে যা বলেছিলাম ঠিক সেই কথাই চন্দ্রকান্তবাবুকে বললাম। রাজাবাবু জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কে?
আজ্ঞে মিউনিসিপ্যালিটির চিত্রগুপ্ত! জন্ম-মৃত্যুর হিসেব রাখি।
রাজাবাবু আমার আপাদমস্তক পরিলক্ষণ করে বললেন, তোমাদের কমিশনারগণকে বলো, এখানে একটা শ্মশানঘাট তৈরি করে দিক।
সবিনয়ে বললাম, রাজাবাবু জমিটা তো আপনার। আপনি যদি দান করেন, তাহলে মিউনিসিপ্যালিটি শ্মশানঘাট তৈরি করে দেবে।
রাজাবাবু কথা রেখেছিলেন। পরের দিনই দু-ভাই মিউনিসিপ্যালিটিকে কাশীপুর ঘাটে স্থায়ী শ্মশান নির্মাণের জন্য জমি দান করে দিলেন।
মাত্র কয়েক বছর আগে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের তিরোধান উৎসবে কাশীপুর ঘাটে গিয়েছিলাম। রামকৃষ্ণের স্মৃতি-ফলকের সামনে দাঁড়াতেই চন্দ্রকান্তবাবু হাজির হলেন। বললেন, কী হে, শ্মশানটা তোমার পছন্দ হয়েছে? বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলি, আজ্ঞে আপনার জমি পুণ্যভূমি। পরমহংসদেবের পবিত্র দেহ এখানেই দাহ করা হয়েছে। চন্দ্রকান্তবাবু বলেন, আমি প্রতিদিন এসে প্রণাম করে যাই। বলি, আপনার এই পুণ্যভূমিতে অনেক পুণ্যবানের দেহ দাহ করা হয়েছে। এখানেই রামকৃষ্ণের সরাসরি শিষ্য স্বামী অভেদানন্দের নশ্বরদেহ বিলীন হয়ে গেছে। চন্দ্রকান্তবাবু বলেন, এ তো সেদিনের কথা। ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ। বলি, সারদা মায়ের আদরের শিষ্য স্বামী কৃষ্ণানন্দকে এখানে দাহ করা হয়েছিল। রামকৃষ্ণ দেবের সন্ন্যাসিনী শিষ্যা গৌরীমাতার দেহকেও এই শ্মশানঘাটেই ভস্ম করা হয়। রামকৃষ্ণ-সারদা মায়ের আরও অনেক শিষ্য-শিষ্যার নশ্বর দেহ এই ঘাটেই লীন হয়ে গেছে।
তাকিয়ে দেখি চন্দ্রকান্তবাবু চলে গেছেন। আমি না বললেও নিশ্চয়ই তিনি জানেন, তাঁর দানকৃত জমিতে বিংশশতাব্দীর নাট্যজগতের প্রাণপুরুষ শিশিরকুমার ভাদুড়ীর দেহ দাহ করা হয়েছে। চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির (ডি জি) নাট্যাচার্যের পাশেই স্থান নিয়েছেন। বছর আষ্টেক আগে এই শ্মশানে দাঁড়িয়ে আমার সহকর্মী সুকান্ত গাঙ্গুলির শেষকৃত্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
মাত্র কয়েক বছর আগেও এসপ্ল্যানেড ট্রাম ডিপোর পাশে একটা স্তম্ভে সাইন বোর্ড লাগানো ছিল। ‘ওয়ে টু নিমতলা’। ট্রাম কোম্পানির কোনো রসিক ব্যক্তি এই বোর্ডটি লাগিয়েছিলেন। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, এখান থেকে নিমতলার ট্রাম ছাড়ে। নিমতলার নাম শুনলেই আমরা আঁতকে উঠি। আমরা ধরেই নিই, জীবিত অবস্থায় কেউ নিমতলায় যায় না। মৃতদেহ সৎকারের প্রকৃষ্ট ও প্রশস্ত স্থান নিমতলা শ্মশান ঘাট। কাগজে লেখালেখির পর ট্রাম কোম্পানি সাইনবোর্ডটি সরিয়ে নিয়েছিলেন। সাইনবোর্ড সরালেই কি নিমতলার হাতছানি থেকে কেউ রেহাই পায়? পায় না। একদিন না একদিন আমাদের সকলকেই হয় নিমতলা, নয় কেওড়াতলা আর নয় কাশীপুরের ঘাটে যেতেই হবে।
গত ২২ শ্রাবণ নিমতলা শ্মশান ঘাটে গিয়েছিলাম। পৌরপিতা ও মহানগরের অনেক মহানাগরিক সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতর্পন করেছিলেন তাঁরা। লক্ষ লোকের অশ্রুসজল চোখের সামনে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের নশ্বর দেহ এখানে দাহ করা হয়েছিল।
ইংরেজদের মৃতদেহ নিয়ে মহানগরীর কর্মকর্তাদের খুব বেশি ভাবতে হয়নি। ইংরেজরা শবদাহ করে না—সমাধি দেয়। তাই তাদের মৃতদেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবার প্রশ্নই ওঠে না। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে অষ্টাবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ইংরেজদেরও কোনো নির্দিষ্ট সমাধিক্ষেত্র ছিল না। তারা মৃতদেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে না দিলেও এখানে সেখানে কবর দিত। যখন ইংরেজদের জনসংখ্যা বাড়তে লাগল এবং মৃত্যুর হারও যখন বেড়ে গেল তখন তারা একটি নির্দিষ্ট সমাধি ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করল। বড়ো বড়ো রাজপুরুষদের তো যেখানে-সেখানে কবর দেওয়া যায় না। তাদের স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্য সৌধও তৈরি করতে হয়।
সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে কোম্পানির কাজে যেসব ইংরেজরা ভারতে এসেছিল—তখনকার জলহাওয়া তাদের স্বাস্থ্যের অনুকূলে ছিল না। অকালমৃত্যুর হার সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি প্রকাশিত ঐতিহাসিক জিওফ্রে মুরহাউসের ইণ্ডিয়া ব্রিটানিকা পুস্তকে অষ্টাবিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় ইংরেজদের মৃত্যুর একটা হিসেব ছাপা হয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর মধ্যে বারো-শো ইংরেজ কলকাতায় ছিল। ওই সময়ের কোনো এক খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে ৪৬০ জন মারা গিয়েছিল। মুরহাউস বলছেন, ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতায় সেই সময় কোম্পানির কাজে যত ইংরেজ ছিল—তাঁর সাতান্ন ভাগই বিভিন্ন রোগে মারা গিয়েছিল। ইংরেজদের সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল ১৭৪৭ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ। ওই সময়ে কোম্পানির মোট কর্মচারীর ৭৪ ভাগ মারা গিয়েছিল। কোনো কোনো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
যত্রতত্র সমাধি দেওয়া ইংরেজরা পছন্দ করত না। পলাশি যুদ্ধের দশ বছরের মধ্যেই তারা কলকাতার ওপর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ইংরেজরা দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিট এলাকায় আগে যার নাম ছিল বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোড, একটি পাকা সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করল। শান্ত, নির্জন, মনোরম সমাধিক্ষেত্র। কেউ কোনো দিন এখানে অশরীরী আত্মাকে আনাগোনা করতে দেখেনি। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে এই সমাধিক্ষেত্র স্থাপন করা হয়। অর্থাৎ কাশী মিত্র শ্মশানঘাট তৈরির সাত বছর আগেই ইংরেজরা তাদের মৃত আত্মীয়স্বজন পরিজনদের অন্তিম শয্যার পাকাপাকি ব্যবস্থা করেছিল। এখানে অনেকের দেহই সমাধিস্থ আছে। সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি অষ্টাবিংশ শতাব্দীর কিছু বিনীত, শিক্ষিত, রুচিবান, হৃদয়বান ও কিছু দুর্বিনীত, দুঃশাসক, দুর্দান্ত অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজপুরুষের অন্তিম মিলনস্থল।
যার দেহ সমাধি দিয়ে খ্রিস্টান গোরস্থান ১৭৬৮খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করেছিল, সেই মিসেস সারহা পিয়ারসনের সমাধির পাশে বসেছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, কয়েক মিনিটের জন্য যদি সারহা পিয়ারসন আসেন, তাহলে গোরস্থানের প্রথম বাসিন্দা হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথা শোনা যেত। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর কেউই এল না। এসে হাজির হল একটি সাদা বেড়াল। বড়ো ন্যাওটা। গা ঘেঁসে না বসলে তার ভালো লাগে না। এই নির্জন সমাধিক্ষেত্রে বেড়াল কেন? এখানে তো কোনো রান্না-বান্নার বালাই নেই। মাছ-মাংসের প্রশ্নই ওঠে না। তবে নাদুস-নুদুস বেড়ালটি এখানে কেন? অন্তিম শয্যায় শায়িত কোনো ইংরেজ আত্মা বেড়ালের রূপ পরিগ্রহ করে এল নাকি?
স্থান পরিবর্তন করেও তার হাত থেকে রেহাই নেই। যেখানে বসছি, ও সেখানেই গিয়ে হাজির হচ্ছে। থাক। পায়ের কাছে যদি চুপ করে বসে থাকে, আপত্তি কী? বিদেহী আত্মার অভয়ারণ্যে অন্তত একটা জীবন্ত প্রাণী তো পাশে রয়েছে।
কখন যে বৃদ্ধ ওল্ডহ্যাম আমার পাশে এসে বসেছিলেন, বুঝতে পারিনি। তাঁর ভগ্ন জীর্ণ সমাধিস্তম্ভের দিকে তাকিয়ে ওল্ডহ্যাম বললেন, জানো, আমার সমাধিক্ষেত্র তৈরির জন্য কোথা থেকে পাথর আনা হয়েছিল? উত্তর শোনার জন্য সাগ্রহে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
ওল্ডহ্যাম বলেন, তোমাদের প্রাচীন গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাথরগুলি এনেছিল।
তাঁর কথা শুনে ভীষণ রাগ হল। আমাদের প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ভাঙার অধিকার তাদের কে দিয়েছিল? আমার জবাব শোনার আগেই ওল্ডহ্যাম তাঁর নিজের সমাধিতে মিলিয়ে যান।
বেড়ালটা আর একটু দূরে অপর একটি প্রায় ভগ্ন সমাধির ওপর গিয়ে বসে। একটা জীবন্ত প্রাণীর সাহচর্য পেতে আমিও সেখানে চলে যাই। শীতের পড়ন্ত বেলা। এমনিতেই সমাধিক্ষেত্রে আবছা অন্ধকার। বেলা পড়ে যাওয়ায় আরও অন্ধকার নেমে আসে। সারা সমাধিক্ষেত্র জুড়ে একটা প্রদোষের ছায়া।
একটি নারীকন্ঠে চমকে উঠি। সেইসঙ্গে একটু ভালোও লাগে। মেরি বাওয়ার্স। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই সমাধিক্ষেত্রের বাসিন্দা।
মেরি বাওয়ার্স বলেন, তোমাদের নবাবের সৈন্যের হাত থেকে আমি কেমন করে বেঁচেছিলাম জানো?
না। আপনার মুখেই শুনি।
বাওয়ার্স বলেন, ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে তোমাদের নবাব সিরাজদৌল্লা যখন ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে নেয়—আমি বাধা দিয়ে বলি, নেয় নয়, বলুন নেন। মিসেস বাওয়ার্স একটু লজ্জিত হয়ে বলেন, দুঃখিত। ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে নেবার পর ইংরেজরা কিছু মহিলা ও শিশুকে নৌকো করে ফলতায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। ডাচদের আংশিক সাহায্যে বড়ো দৈন্য ও কষ্টের মধ্যে আমাদের দিন কাটাতে হয়েছে। অনেকদিন অর্ধাহারেও থেকেছি। প্রায় আট মাস পর অ্যাডমিরাল ওয়াটসন ও কর্নেল ক্লাইভ সসৈন্যে মাদ্রাজ থেকে পৌঁছে যান। তার পরের কথা তো তোমরা সবাই জানো। আমরা যারা ফলতায় আশ্রয় নিয়েছিলাম—তাদের মধ্যে আমি একা বেঁচে কলকাতায় ফিরে আসি।
সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়। সমাধিক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ম্লান আলো জ্বলে ওঠে। সে-আলোয় অন্ধকার দূর হয় না। বরং অন্ধকারকে আরও রহস্যময় করে তোলে। মনে মনে ভাবি, একে একে যদি সবাই আসতে শুরু করেন, সারারাতেও তাঁদের কাহিনি শেষ হবে না। এই মুহূর্তে আসতে পারেন জেনারেল স্যার জন ক্লেভারিং, আসতে পারেন মেজর জেনারেল জন গ্রাষ্টিন, রাজা দ্বিতীয় চার্লসের প্রপৌত্রী লেডি অ্যান মনসন, ভারততত্ত্ববিদ ও এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্স।
আসতে পারেন মেজর জেনারেল স্টুয়ার্ট। যিনি ইতিহাসে হিন্দু স্টুয়ার্ট নামে পরিচিত। ভারতবন্ধু হেনরি ডিরোজিও, কবি কিপলিং-এর নায়িকা লুসিয়া পক, কবি ল্যানডরের প্রেমিকা রোজ আইলমারও এসে হাজির হতে পারেন। বেচারি আইলমারও তাঁর মাসিমা মিসেস রাসেলের সঙ্গে কলকাতায় দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি আর ফিরে যেতে পারেননি। সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে শেষ শয্যা গ্রহণ করেছেন।
অন্ধকারে আমার আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছিল। মনে মনে অষ্টাবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত সুন্দরী এলিজাবেথ স্যাণ্ডারসনের কথা ভাবছিলাম। জগৎজোড়া তার রূপের খ্যাতি ছিল। তাকে কেন্দ্র করে ইংরেজ রাজপুরুষদের মধ্যে অনেকের দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়েছে। অবশেষে সুন্দরীকে লাভ করেছিলেন রিচার্ড বারওয়েল। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভুবনমোহিনী রূপসীকে এখানেই কবর দেওয়া হয়েছিল।
এই সিমেট্রিতে এক আশ্চর্য সমাধি প্রস্তর রয়েছে। সমাধি প্রস্তর থেকে রক্তক্ষরণ হয়! অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি ঘটনা। কেউ শুনেছেন, আর কেউ-বা প্রত্যক্ষ করেছেন। খ্রিস্টানেরা এই সমাধি স্তম্ভের নাম রেখেছেন ‘ব্লিডিং টুম’। অপেক্ষাকৃত অজানা ডেনিসন পরিবারের পারিবারিক সমাধি প্রস্তরে এই রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটে। শোনা যায়, প্রতি বছর একটা বিশেষ সময়ে সমাধি প্রস্তর জলীয় পদার্থে ভিজে ওঠে। সেই পদার্থের রং রক্তের মতো লাল।
হঠাৎ বেড়ালটা সরে যায়। অন্ধকারে আমি একা হয়ে পড়ি। দু-শো বাইশ বছরের পুরোনো সমাধিক্ষেত্র থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসি। শান্ত পরিবেশ থেকে আবার জনকলরোলে মিশে যাই।
বাগমারির গোরস্থানে আলি আহজানের সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল। হিন্দুদের শ্মশানে যারা চিতা রচনা করে, তাদের বলা হয় চন্ডাল। আর মুসলমানদের গোরস্থানে যারা গোর খোঁড়ে তাদের কী বলা হয়? বাগমারির গোরস্থানের তদারককারী আলি আহজান নিজেই একটি জীবন্ত কিংবদন্তী। তার গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। প্রশ্ন করার কোনো অবসর থাকে না।
প্রায় কুড়ি হেক্টর জমি নিয়ে এই গোরস্থান। এই মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছে কত পুণ্যাত্মা-পীর, ফকির আর দরবেশরা। তার পাশে খুঁজলে পাওয়া যাবে অনেক দুরাত্মাও। আলি আহজান বলেন, গোরের নীচে গেলে সব আত্মাই সমান। পুণ্যাত্মা আর পাপাত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্যই থাকে না। গোর দেবার সময় আল্লার কাছে প্রার্থনা করি, তুমি ওকে বেহেস্তে স্থান দিয়ো।
সত্তর বছরের আলি আহজান পনেরো বছর বয়েস থেকেই গোর খুঁড়ে চলেছে। আজ পর্যন্ত প্রায় চোদ্দো হাজার গোর খুঁড়েছে। নিজের অগ্নিদগ্ধ আত্মজার গোরও সে নিজেই খুঁড়েছে।
আগে বাগমারির শান্ত পরিবেশে অনেকে বেড়াতে যেতেন। ফুলে ফুলে সাজানো ছিল বাগমারির গোরস্থান। লেকের জলে মৃদু ঢেউ। চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কলকাতা পৌরসভার কতৃত্বাধীনে পরিচালিত।
গোরস্থানের একটি ঘরে থাকে আলি আহজান। কোনো দিন অঘটন ঘটেনি। কোনো বিদেহী আত্মা তাকে বিরক্ত করেনি।
আলি আহজান বলে, এ তো মহাপুণ্যের কাজ। আমি সকলের অন্তিম শয্যা রচনা করি। পাপের কথা মনে আসে না। মনে হয় আমি পুণ্যবান। সব মানুষের আশীর্বাদে আমার বেহেস্তে যাবার পথ পরিষ্কার হচ্ছে। একদিন আমিও মরব। সবাইকে বলে রেখেছি, পীরের কবরের পাশে আমায় গোর দিয়ো।
প্রায় এক-শো সত্তর বছর আগে এশিয়ার বৃহত্তম গোরস্থান এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। গোরস্থানের লেক বেশ কিছু দিন থেকে অদ্ভুত আচরণ শুরু করেছে। লেকের নীচে মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই কয়েক-শো কবর লেক গ্রাস করেছে। সীমানার পাঁচিল ভাঙা। গোরু-মোষ-ছাগলের অবারিত বিচরণ।
আলি আহজান বলে, দুঃখের কথা কী জানেন? গোরস্থানে পাপ কাজ চলছে। সমাজবিরোধীরা এখানে মদ খায়, জুয়া, সাট্টা খেলে। বাধা দিলে ওরা হয়তো আমাকে জ্যান্ত গোর দিয়ে দেবে।
আলি আহজানের কথায় মন খারাপ হয়ে যায়। পুণ্যভূমির পবিত্রতা নষ্ট করার অধিকার কারো নেই। তবুও এক শ্রেণির মানুষ তাই করে চলেছে। সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতেও সমাজবিরোধীদের জুয়া খেলতে দেখেছি। গোরস্থান আর সমাধিক্ষেত্রে এদের দেখতে আমার ঘেন্না করে। তারচেয়ে নিস্তব্ধ শান্তিতে চলে যাওয়া ভালো। পারসিদের শব সৎকারের পবিত্র স্থান। এখানে শব্দহীন শান্তি। বসে বসে ভাবি, ধনে নয়, ধ্যানে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন