গোপালকৃষ্ণ রায়
শৈব তীর্থ শিবনিবাস কোনোরকমে টিকে থাকলেও, হরিহরের মিলনতীর্থ গঙ্গাবাসের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে অনেককাল আগেই।
উপরিউক্ত দুটি তীর্থস্থানই নদিয়া জেলায় অবস্থিত। দুটি তীর্থস্থানের স্রষ্টা অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী শ্রীমান মহারাজ রাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
১৭২৮খ্রিস্টাব্দে নদিয়ার রাজসিংহাসনে বসে মহারাজা যে কাজটি করেছিলেন সেটি হল একটি মহাযজ্ঞ—‘অগ্নিহোত্র বাজপেয়ী।’ এই মহাযজ্ঞের জন্য তৎকালে খরচ হয়েছিল কুড়ি লক্ষ টাকা। শুধু বঙ্গদেশের মহাপন্ডিত ও বিদ্বজ্জনেরাই সেই মহাযজ্ঞে উপস্থিত ছিলেন না। বারাণসীর পন্ডিতবর্গের উপস্থিতিতে সেই ‘অগ্নিহোত্র-বাজপেয়ী’ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যজ্ঞ শেষে সম্মিলিত পন্ডিতগণ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে ‘অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
অষ্টাবিংশ শতাব্দীর তদানীন্তন বঙ্গদেশের ইতিহাসের অন্যতম নায়ক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র শুধু বিচক্ষণ ও চতুর রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন না, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অনন্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। খেলাধুলা ছাড়াও মৃগয়াভিলাষী ছিলেন তিনি। ঘোড়ায় ও হাতির পিঠে মাঝে মাঝেই মৃগয়ায় যেতেন। এই মৃগয়ায় গিয়েই তিনি একটি স্থান আবিষ্কার করেছিলেন। নিজেই সেই স্থানের নামকরণ করেছিলেন, শিবনিবাস। তিনদিকে নদীবেষ্টিত নিসর্গ সৌন্দর্যে শোভিত স্থানটিতে একটি নতুন নগরী স্থাপন করেছিলেন। যদিও আমরা জানি নদীর নাম চূর্ণী। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নাকি সেই নদীর নাম দিয়েছিলেন ‘কঙ্কনা’। কঙ্কনা এখন আর নেই। বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়র আর নদিয়া কাহিনি-তে কঙ্কনা নামটির উল্লেখ আছে।
তদানীন্তন ঐতিহাসিকগণ মনে করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজে নৈসর্গিক দৃশ্যে মোহিত হয়ে স্থানটি নির্বাচন করেননি, রাজ্য সুরক্ষার চিন্তাটিও তাঁর মাথায় ছিল। সেই সময় দেশজুড়ে বর্গির হাঙ্গামা চলছিল। তিনদিকে নদী থাকায়, প্রাকৃতিক সুরক্ষা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। অষ্টাবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে স্থানটিতে তিনি একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সেই সময়ে, প্রাসাদের সঙ্গে সংলগ্ন একটি বৃদ্ধাশ্রম ও অক্ষমালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজ আমরা যাকে প্রতিবন্ধী আবাস বলি, প্রায় আড়াই-শো বছর পূর্বে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এমনি একটি প্রতিবন্ধী আবাস শিবনিবাসে গড়ে তুলেছিলেন। নাগরিকদের শিক্ষার জন্য স্থাপন করেছিলেন কয়েকটি পাঠশালা ও টোল। সংস্কৃত ভাষার প্রতি তাঁর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। সংস্কৃতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মহারাজা অনেক সংস্কৃত পন্ডিতদের শিবনিবাসে পুনর্বাসন দিয়েছিলেন।
সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি। স্থান মাহাত্ম্যকে জনপ্রিয় করার জন্য পাঁচটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। অষ্টাবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যে মনোরম প্রাসাদ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন, ঊBনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যেই তা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু মন্দিরগুলি আজও বিদ্যমান। অবশ্য বয়েসের ভারে কিছুটা জীর্ণ। এই মন্দিরগুলি ঘিরেই শিবনিবাস আজ শিবতীর্থ।
অষ্টকোণাকৃতি শিবমন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে। মন্দিরে অবস্থান করছেন যে শিবলিঙ্গ তাঁর নাম রাজরাজেশ্বর। ভক্তরা আদর করে ডাকেন ‘বুড়ো শিব’। প্রবাদ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নাকি শিবনিবাসে ১০৮টি মন্দির নির্মণ করেছিলেন। অবশ্য এর সত্যতা সম্পর্কে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। বর্তমানে শিবনিবাসে পাঁচটি মন্দির রয়েছে। রাজরাজেশ্বর মন্দিরের উচ্চতা ৬০ফুট। এটি পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ মন্দির। রাজরাজেশ্বর নাকি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবলিঙ্গ। এই শিবলিঙ্গটি মহারাজা কোথা থেকে আনিয়েছিলেন, তার কোনো ইতিহাস আমাদের জানা নেই। লিঙ্গটি বঙ্গদেশেই নির্মিত হয়েছিল, অথবা মহারাজা অন্য কোথাও থেকে এনে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে-তথ্যও অজানা। রাজরাজেশ্বর মন্দির নির্মাণের আট বছর পর ১৭৬২খ্রিস্টাব্দে আর একটি চারচালা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন মহারাজা। মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরও একটি শিবলিঙ্গ। যার উচ্চতা সাড়ে সাত ফুট। মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছিল ‘রাজ্ঞীশ্বর’। রাজ্ঞীশ্বর মন্দিরের পূর্বদিকে নির্মাণ করেছিলেন চারচালা রাম-সীতার মন্দির। রাম-সীতা মূর্তির উচ্চতা প্রায় চারফুট। এটিও স্থাপিত হয়েছিল ১৭৬২খ্রিস্টাব্দে।
মহারাজা আর একটি চারচালা মন্দির নির্মাণ করে একটি প্রস্তর নির্মিত শীতলা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পঞ্চম মন্দিরটিও একটি শিবমন্দির। সেখানেও একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত।
ভীম একাদশী আর শ্রাবণী পূর্ণিমায় শিবনিবাসে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিবভক্তরা শিবনিবাসে সমবেত হন। ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ ধ্বনিতে শিবনিবাস মুখরিত হয়ে ওঠে। হাজার হাজার লিটার দুধ ঢালা হয় রাজরাজেশ্বর আর রাজ্ঞীশ্বরের মাথায়। আজও এই দুটো দিনে শিবনিবাস ফিরে যায় গৌরবোজ্জ্বল অষ্টাবিংশ শতাব্দীতে। যদিও সেই রাজপ্রাসাদ নেই, নেই মন্দিরের চালচিত্র তবুও ধর্মপ্রাণ মানুষকে শিবনিবাস আজও চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। দিন বদলায়। সময় বয়ে যায়। পালা বদলের পালা শুরু হয়। সেই পালা বদলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, শিবনিবাসকেও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। গড়ে তোলা যায় মন্দিরকেন্দ্রিক পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু সে উদ্যোগ কোথায়? অথচ শিবনিবাসের দূরত্ব বেশি নয়। জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে মাত্র ২৫কিমি। সড়ক পাকা, যানবাহনের অভাব নেই। রাণাঘাট গেদে রেল স্টেশনের মধ্যেই পড়ে শিবনিবাস। মাজদিয়া স্টেশনে নেমে হেঁটেও যাওয়া যায় শৈবতীর্থ শিবনিবাস। কঙ্কনা যদি চূর্ণী হয়, তাহলে সেই স্বচ্ছ সলিলা চূর্ণীতে রাজরাজেশ্বর মন্দিরের প্রতিবিম্ব মনের মধ্যে এক অপার্থিব আস্বাদ এনে দেবেই।
শিবনিবাস যদিও টিম টিম করে বেঁচে আছে, হরিহরের মিলনভূমি গঙ্গাবাসের আর অস্তিত্ব নেই। চূর্ণীর তীরে যে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি অলকানন্দার মৃদু কলতানে বানপ্রস্থের সংগীত শুনেছিলেন তিনি।
জলঙ্গীর একটি শাখার নাম অলকানন্দা। স্রোতস্বিনীটি গিয়ে মিশে গিয়েছিল পুণ্যতোয়া ভাগীরথীর সঙ্গে। ভাগীরথীর সঙ্গে মিশে নিজেও হয়ে উঠেছিল পুণ্যসলিলা। পুণ্যসলিলা অলকানন্দার ধারে আর একটি জনপদ গড়ে তুলেছিলেন অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী মহারাজন কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
১৭৬৬খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন একটি মনোরম প্রাসাদ। শিবনিবাসের অনুকরণে শাস্ত্রজ্ঞ পুনর্বাসন দেন সেখানে। হরি আর হরের যুক্ত প্রস্তরমূর্তি একটি দ্বিগম্বুজবিশিষ্ট মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন।
নদিয়ার সিংহাসনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বসেছিলেন ১৭২৮খ্রিস্টাব্দে। প্রায় চল্লিশ বছর রাজত্ব করে পুত্র শিবচন্দ্রকে রাজ্যপাট বুঝিয়ে দিয়ে, গঙ্গাবাসে বসবাস শুরু করেছিলেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেহরক্ষা করেন ১৭৮২খ্রিস্টাব্দে। বয়েস হয়েছিল ৭৩।
তিনি গঙ্গাবাসে দেহরক্ষা করেছিলেন, অথবা রাজধানী কৃষ্ণনগরে, সে তথ্য আমাদের জানা নেই। সারানদিয়া-জেলায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অজস্র কীর্তি আজও বিদ্যমান, কিন্তু তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত কোনো সৌধ নদিয়ার কোথাও নেই। তবে ভারতবর্ষের ইতিহাসের পাতায় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নায়ক ও দেশনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন।
গঙ্গাবাস মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আরও একটি কীর্তি। প্রায় ২৪০বছর পূর্বে অলকানন্দার তীরে তিনি যে জনপদ গড়ে তুলেছিলেন, আজ তার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। দ্বিগম্বুজবিশিষ্ট হরিহরের মন্দির কালের সঙ্গে সংগ্রাম করে বিধ্বস্ত। এই দেউলটিকে কেন্দ্র করে গঙ্গাবাস তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। শুধু হরি ও হরের সংযুক্ত প্রস্তরমূর্তি নয়, আরও ছ-টি দেব-দেবী ওই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। যেহেতু পূজার্চনায় কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না, তাই সর্বশ্রেণির ধর্মপ্রাণ মানুষ, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গঙ্গাবাসে সমবেত হতেন। বিশেষ করে পৌষ সংক্রান্তি, বারুণী ও দশেরার সময় ব্যাপক তীর্থযাত্রীর ভিড় হত। পবিত্র অলকানন্দায় অবগাহন করে হরিহরের পূজা দিতেন হাজার হাজার মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধুসন্তেরা এসে গঙ্গাবাসের গৌরব বৃদ্ধি করতেন।
শিবনিবাসের প্রাসাদের মতো গঙ্গাবাসের প্রাসাদটিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অষ্টবিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকে যে প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেই তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। গঙ্গাবাসের প্রাসাদ আজ বিশাল ধ্বংসস্তূপ। শ্বাপদসংকুল ভগ্নাবশেষ। প্রায় ভগ্ন হরিহরের মন্দির।
মহারাজা মৃত্যুর পূর্বে হরিহর ও অন্যান্য দেবদেবীর পূজার্চনার জন্য জনৈক তর্কবাগীশকে ১০২ বিঘা জনি দান করেছিলেন। তর্কবাগীশের কোনো বংশধর এখনও আছেন কি না আমার জানা নেই। হরিহরের মন্দিরে এখন কাঁসর ঘণ্টা বাজে কি না তাও বলতে পারব না। একটা পুণ্যক্ষেত্র গঙ্গাবাসের নাম এখন আর কারো মুখে শোনা যায় না।
পুণ্যতোয়া অলকানন্দারও আর কোনো অস্তিত্ব নেই। পলি পড়ে সে নদী এখন চাষের জমি। নদিয়ার একটি নদী অলকানন্দা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
শহর কৃষ্ণনগর থেকে গঙ্গাবাসের দূরত্ব মাত্র ৯কিমি। পরমতীর্থ নবদ্বীপের দূরত্ব মাত্র ৯ কিমি।
উল্লেখ্য গঙ্গাবাসেও একটি শিবমন্দির ছিল। কালভৈরব সেখানে অবস্থান করতেন। শ্রীশ্রীরামচন্দ্রের পদচিহ্নও সেখানে রাখা আছে। মহারাজা পদচিহ্নটি চিত্রকূট থেকে আনিয়েছিলেন। অলকানন্দার সঙ্গে তীর্থক্ষেত্র গঙ্গাবাসও বিলুপ্ত।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন