গোপালকৃষ্ণ রায়
ঠিক দুই যুগ নির্জনবাসে ছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। ১৯২৬খ্রিস্টাব্দের ২৪ নভেম্বর নির্জনবাসে চলে যান তিনি। একমাত্র শ্রীমা ব্যতীত ওই সময়ে কেউই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন না। বছরে দু-একদিন অন্তরঙ্গ ভক্তদের দর্শন দিতেন। দোতলার বারান্দায় কয়েক মিনিটের জন্য দাঁড়াতেন। নীচে থেকে নীরব ঋষিকে প্রণাম জানিয়ে শিষ্য-ভক্তরা ফিরে যেতেন।
একবার মাত্র এই ব্যবস্থার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। নির্জনবাসের মধ্যেও সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন একজনকে। সেই সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। পন্ডিচেরির দোতলার কক্ষে মাত্র দশ মিনিটের জন্য মুখোমুখি হয়েছিলেন দুই মহাজীবন। তারিখ ২৯ মে, ১৯২৮। বিশ্ববরেণ্য কবি ও তপঃসিদ্ধ ঋষির সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারের বিশদ বিবরণ কোথাও নেই।
এই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের বিবরণ রবীন্দ্রনাথও বিশদে জানাননি—শ্রীঅরবিন্দের শিষ্যরাও এ বিষেয়ে নীরব থেকেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তখন দক্ষিণ ভারতে। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন প্রশান্ত ও রানি মহালানবিশ এবং দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ। শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তিনি। নির্জনবাস সত্ত্বেও এই সাক্ষাৎকারে সম্মতি জানিয়েছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। দুই মহাপুরুষের সাক্ষাৎকারের সময় অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না। প্রশান্ত-রানি মহলানবিশ ও অ্যান্ড্রুজকে নিয়ে নীচে বসেছিলেন শ্রীঅরবিন্দ-শিষ্য নলিনীকান্ত গুপ্ত।
অরবিন্দ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে মাত্র আট বছর যুক্ত ছিলেন। ১৯০২ থেকে ১৯১০। তার মধ্যে প্রথম চার বছর সাংগঠনিক কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। পরবর্তী চার বছর সক্রিয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই সারাদেশ তাঁর ‘জ্যোতিতে’ উদ্ভাসিত হয়েছিল।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আলিপুর বোমা মামলায় তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। একই সঙ্গে আরও ৩৮জন বিপ্লবীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ভারত-আন্দোলিত সেই মামলায় অরবিন্দের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। বিচারাধীন বন্দি অরবিন্দ বছরখানেক জেলে কাটিয়েছিলেন। মামলার উপসংহারে দেশবন্ধু ভবিষ্যদবাণী করেছিলেন যে, মানবপ্রেমিকরূপে অরবিন্দ প্রতিভাত হবেন এবং তাঁর মানবতার বাণী সারাবিশ্বে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে। দেশবন্ধুর ভবিষ্যদবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলেছে। অরবিন্দ মুক্তি পেলেও, সেই সময় আর যেসব বিপ্লবীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে অনেকের প্রাণদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ হয়েছিল। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত তাঁদেরই একজন। প্রাণদন্ডাদেশ শোনার পর উল্লাসকর বিনীতভাবে একটি গান গাইবার অনুমতি চেয়েছিলেন। অনুমতি পেয়েছিলেন উল্লাসকর। আদালত কক্ষে গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে।’
কারাগারেই অরবিন্দের আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। সেখানেই তিনি ভগবান দর্শন ও কৃপালাভ করেন। ঐশ্বরিক উপলব্ধির মধ্য দিয়েই অরবিন্দের সামনে স্বাধীন ভারতের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশ্বের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি যে শীঘ্রই মুক্তি পাবেন এমন একটি উপলব্ধি তাঁর মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকেই যোগ অভ্যাস শুরু করেছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। এ বিষয়ে মহারাষ্ট্রীয় যোগী লেলের কাছ থেকে নির্দেশ নিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ নিমগ্ন হয়েই ধ্যান করতেন তিনি। নিমগ্নতার মধ্যে পরমব্রহ্ম ও নির্বাণ উপলব্ধি করতেন শ্রীঅরবিন্দ। কারাগারের দিনগুলি তাঁর কাছে দৈবচেতনাসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বরের দর্শন ও তাঁর সতত উপস্থিতি শ্রীঅরবিন্দের অনুভূতির সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। সাধন মার্গের যাত্রা সেখান থেকেই শুরু।
মুক্তি পাবার পর তিনি একটি ইংরেজি (কর্মযোগী) ও বাংলা (ধর্ম) সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে পুনরায় লিখতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে চলতে থাকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মধারা। বিশেষজ্ঞদের মতে সেই সময় থেকে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর, উত্তরপাড়ায় তিনি যে স্মরণীয় ভাষণ দিয়েছিলেন—তাতেই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১জুলাই তিনি হুগলিতে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কনফারেন্স আহ্বান করেছিলেন। ‘অ্যান ওপেন লেটার টু মাই কান্ট্রিমেন’ শীর্ষক একটি ‘খোলা চিঠি’ কর্মযোগী-তে প্রকাশ করেন। তাতেই তাঁর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মসূচি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। সেই ‘খোলা চিঠি’ ব্রিটিশ শাসকদের বিচলিত করে তোলে। তারা তাঁকে পুনরায় কারারুদ্ধ করতে চায়। ১৯১০খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস। ৪নভেম্বর শ্যামপুকুর লেনে অবস্থিত কমযোগী-র অফিসে বসে কাজ করছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। কাজে নিমগ্ন অরবিন্দ একটি ‘দৈববাণী’ শুনতে পান। কে যেন তাঁকে বলে গেলেন, আগামীকালই তাঁর অফিস তল্লাশি হবে এবং তিনি গ্রেফতার হবেন। অনির্দেশ্য একটি সত্তা তাঁকে তৎক্ষণাৎ চলে যাবার নির্দেশ দেন। সঙ্গে সঙ্গেই অরবিন্দ মনস্থির করেন এবং ফরাসি শাসনাধীন চন্দননগরে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
সময় খুব সংক্ষিপ্ত। রাতের মধ্যেই তাঁকে চন্দননগর পৌঁছোতে হবে। অন্তরঙ্গ দু-একজন সহযোগীর সহায়তায় একটি দেশি নৌকোয় সেই রাতেই কলকাতা ত্যাগ করেন। অনেকে মনে করেন, সেই সময় ভগিনী নিবেদিতা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল সত্য, কলকাতা থেকে নিষ্ক্রমণে তিনি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন কি না তার কোনো প্রমাণ নেই। অনেকে মনে করেন কলকাতা থেকে নিষ্ক্রমণ নিবেদিতার অজ্ঞাতসারেই ঘটেছিল।
চন্দননগরে দিন কয়েক আত্মগোপন করেছিলেন অরবিন্দ। ছদ্মনাম নিয়ে সেখান থেকে তিনি পন্ডিচেরিতে চলে যান। এই সময় তাঁকে সাহায্য করেছিলেন অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও সুরেশ চক্রবর্তী। এটিও একটি মহানিষ্ক্রমণের কাহিনি। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, অমরেন্দ্র ও সুরেশের সঙ্গে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন অরবিন্দ। ছদ্মনামে কলম্বোর টিকিট কাটা ছিল। ডুপ্লে জাহাজে চড়ে বসেন অরবিন্দ। ছদ্মনামের যাত্রীটি নিয়ে ‘ডুপ্লে’ কলকাতা বন্দর ত্যাগ করে। দক্ষিণ ভারতের কোনো একটি বন্দরে নেমে পড়েন অরবিন্দ। সেখান থেকে ১৯১০খ্রিস্টাব্দের ৪এপ্রিল পন্ডিচেরিতে পৌঁছে যান।
ব্রিটিশ সরকার ফরাসি অধিকৃত পন্ডিচেরি থেকে তাঁকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছিলেন—কিন্তু সফলকাম হননি। ১৯১০খ্রিস্টাব্দের ৪এপ্রিল থেকে আনির্বাণ তিনি পন্ডিচেরিতেই ছিলেন। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট কলকাতায় শ্রীঅরবিন্দের জন্ম হয়। পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষিত যশস্বী চিকিৎসক। তিনি জাতীয়তাবাদী অন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ রাজানারায়ণ বসুর জ্যেষ্ঠা কন্যা স্বর্ণলতা দেবীকে বিবাহ করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষানুরাগী কৃষ্ণধন তাঁর ছেলেদের ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়েসে অরবিন্দ পিতার সঙ্গে লণ্ডনে যান। অল্প বয়েসেই তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, ইটালিয়ান ও স্প্যানিশ ভাষা শিখেছিলেন। এগারো বছর বয়েসে তিনি গ্রিক, ল্যাটিন ও ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। পরে অবশ্য বাংলা সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। সেই পরীক্ষায় গ্রিক ও ল্যাটিনে তিনি যে নম্বর পেয়েছিলেন, ইতিপূর্বে কোনো পরীক্ষার্থী তা পাননি।
লণ্ডনে থাকতেই তিনি অনুভব করেছিলেন যে, ভবিষ্যতের জাগতিক কর্মধারায় তাঁর একটি বিশেষ ভূমিকা থাকবে। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় মজলিশের কর্ণধাররূপে তিনি বিপ্লবাত্মক ভাষণ দিতেন। সেই সময়ে ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা পেশ করতেন।
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েও তিনি ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করতে অস্বীকার করেন। ১৮৯৩খ্রিস্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়েসে তিনি বরোদা স্টেট সার্ভিসে চাকরি নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। রাজস্ব বিভাগে কিছুদিন কাজ করার পর স্টেট কলেজে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। পরে তিনি অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেছিলেন। অরবিন্দ বরোদায় তেরো বছর ছিলেন। এই তেরো বছর ছিল তাঁর জীবনের প্রস্তুতিকাল। এই সময় তিনি সংস্কৃত, মারাঠি, গুজরাটি ও কথ্য বাংলা শেখেন। প্রাচীন ভারতের মহাকাব্য উপনিষদ ও অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্য পড়েন। ইংরেজি ভাষায় কাব্য, নাটক ও অন্যান্য প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার গুপ্তসংস্থাটি তাঁর নির্দেশে স্থাপিত হয়। সেই বছরেই ভগিনী নিবেদিতা এই কেন্দ্রে যোগ দেন এবং ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অরবিন্দের সহকর্মী ছিলেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে অরবিন্দ ভূপালচন্দ্র বসুর কন্যা মৃণালিনী দেবীকে বিবাহ করেন। মৃণালিনী দেবীর বয়েস তখন মাত্র তেরো। অরবিন্দ-জীবনে মৃণালিনী দেবী উপেক্ষিতা—অনেকেই এই মত পোষণ করেন। বিষয়টি অংশত সত্য হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়। বছর খানেক বন্দি জীবন বাদ দিলে, প্রায় আট বছর মৃণালিনী দেবী অরবিন্দের সাহচর্য লাভ করেছিলেন।
বিবাহের পর সস্ত্রীক হিমালয় ভ্রমণেও গিয়েছিলেন তিনি। নৈনিতালে স্ত্রীকে নিয়ে কিছুকাল কাটিয়েছিলেন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের পর মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি।
পিতৃগৃহে কখনো কলকাতা ও কখনো শিলং-এ থাকতেন মৃণালিনী। তাঁকে পন্ডিচেরিতে পাঠাতে গিয়ে ভূপালচন্দ্র বসু অরবিন্দের অনুমতি চেয়েছিলেন। অরবিন্দ অসম্মতি জানিয়েছিলেন। মৃণালিনী দেবীকে পন্ডিচেরি পাঠাবার পরিবর্তে তাঁর স্বাক্ষরিত কোনো একটি পুস্তক পাঠাতে বলেছিলেন।
শ্রীশ্রীসারদা মার সঙ্গে মৃণালিনী দেবীর যোগাযোগ ঘটেছিল। সারদা মা তাঁকে বউমা বলে ডাকতেন। একসময় সারদা মার কাছে দীক্ষাও নিতে চেয়েছিলেন তিনি। অরবিন্দ দীক্ষা নেবারও বিরোধী ছিলেন। ১৯১৮খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩০ বছর বয়েসে মৃণালিনী দেবী পরলোকগমন করেন। অরবিন্দ পন্ডিচেরি চলে যাবার পর, মৃণালিনী দেবী যে ক-বছর বেঁচেছিলেন, স্বামীর অধ্যাত্ম জীবন ধ্যান করেই অতিবাহিত করেছেন। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর প্রায় আট বছর পর শ্রীঅরবিন্দ নির্জনবাসে চলে যান।
পন্ডিচেরিতে আসার পর, অরবিন্দর জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে। রাজনীতির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে অধ্যাত্ম সাধনায় নিমগ্ন হয়ে যান। এই সময় সাধন মার্গে তাঁকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন পল রিশার ও তাঁর স্ত্রী। পরবর্তীকালে মাদাম রিশার মাদার বা শ্রীমা নামে খ্যাত হন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন