নলরাজার গড় – গোপালকৃষ্ণ রায়

গোপালকৃষ্ণ রায়

নলরাজার গড়

নিম্ন হিমালয়ে চিলাপাতার সান্দ্রবনাঞ্চলে কেউ কি কখনো নলপ্রেয়সী দময়ন্তীর বিলাপ শুনেছে? কেউ কি কখনো শুনেছে যে, অভ্রভেদী চম্পক বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে কামার্ত ব্যাধ রাজ্যহারা নল ভার্যা দময়ন্তীকে প্রেম নিবেদন করেছে? ভুজঙ্গ দংশিত নলের নিষ্প্রাণ দেহ বুকে জড়িয়ে ধরে চিলাপাতার গহন অরণ্যে দময়ন্তী কি সত্যি কান্নার রোল তুলেছিল? এই সব কিংবদন্তীর পেছনে কোনো পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক সমর্থন মেলে না। না মিললেও ক্ষতি নেই। নল-দময়ন্তীর এই জনশ্রুতি চিলাপাতার নিভৃত বনাঞ্চলকে রহস্যময় করে রেখেছে। এই কাব্যময় কিংবদন্তিকে কেন্দ্র করে মেন্দাবাড়ি বা বানিয়া ধ্বংসাবশেষ নলরাজার গড় নামে পরিচিত।

ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, পুরাণে উল্লিখিত নল-দময়ন্তীর সুদূর অতীতের প্রচলিত উপাখ্যান ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে উত্তরবঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সেই জনপ্রিয়তা আজ বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি।

বাইশ বছর পূর্বে আবিষ্কৃত মেন্দাবাড়ি বা বানিয়া পুরাকীর্তি নল-দময়ন্তীর উপ্যাখ্যানের সঙ্গে জনশ্রুতিতে জড়িত হলেও—কোনো কালেই চিলাপাতার শ্বাপদ-সংকুল গভীর অরণ্যে তাদের উপস্থিতি ছিল না।

যে অনুপম পুরাকীর্তি বনের অভ্যন্তরে আবিষ্কৃত হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে গুপ্তযুগে নির্মিত প্রাকার বেষ্টিত একটি দুর্গ। এই প্রাচীন দুর্গের প্রাকার, বুরুজ, খিলান, পয়ঃপ্রণালী ও দারুনির্মিত কক্ষ, পুরাতাত্ত্বিকদের শুধু আকৃষ্টই করেনি—সার্বিক অনুসন্ধান ও খননের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল। আবিষ্কারের আগ্রহ আমাদের মধ্যে যত বেশি তীব্র—আবিষ্কারের পর রক্ষণাবেক্ষণের প্রচেষ্টা ঠিক ততখানি কম। নলরাজার গড় অথবা মেন্দাবাড়ি বা বানিয়ার পুরাকীর্তি অবহেলার একটি জলজ্যান্ত নিদর্শন। ঠিক একই রকমভাবে অবহেলার বলি উত্তর চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতু গড়, বর্ধমানের পান্ডু রাজার ঢিবি, পাক-বেড়িয়ার জৈন সৌধ, আর পশ্চিম দিনাজপুরের বাণ রাজার গড়। ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ এইসব স্থানগুলিতে কিছু করা হয়নি, শুধু রংচটা সাইনবোর্ড লাগিয়ে কর্তব্য সমাধা করা হয়েছে।

কালের পরিক্রমায় কিংবদন্তির বিকৃতি ও অপভ্রংশের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিষাদ অধিপতি নল না হয়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের নরসিংহ গুপ্ত বালাদিত্য হতে পারে। কারণ বানিয়ার পুরাকীর্তি গুপ্তযুগের শিল্প সৌকর্যে সমৃদ্ধ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হিমালয়ের পাদদেশের শৈলাঞ্চল ও বনাঞ্চলের ওপর একদা গুপ্ত সাম্রাজ্যের আধিপত্য ছিল। ঐতিহাসিকদের আরও ধারণা, নিম্ন শৈলাঞ্চল ও সংলগ্ন গভীর বনাঞ্চল কিরাতভূমি নামেও পরিচিত ছিল। কিরাত দত্ত নামীয় কোনো এক ইন্দো-মঙ্গোলিয়ান ব্যক্তিকে গুপ্তরাজা পুন্ডবর্ধনভুক্তি এই এলাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। বানিয়া ধ্বংসাবশেষের নিম্নতম এলাকা থেকে গুপ্তযুগে নির্মিত ইটের নিদর্শন পাওয়া গেছে। পরীক্ষা করে ইটের সময়কাল ধার্য করা হয়েছে ৩৮০খ্রিস্টাব্দ।

আবার কেউ কেউ মনে করেন নররাজার গড় অপভ্রংশ হয়ে নলরাজার গড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। কুচবিহার অধিপতি নরনারায়ণ অথবা তাঁর ভাই নরসিংহের নামেও পরবর্তীকালে এই ধ্বংসাবশেষের নামকরণ হতে পারে। নলরাজার গড়ই হোক, আর নররাজার গড়ই হোক, মেন্দাবাড়ি বা বানিয়া দুর্গপ্রাকার গুপ্তযুগের শৈলীতে নির্মিত। পাল রাজারা এই দুর্গপ্রাকারের সংস্কার ও বিস্তার করেছিলেন। এই দুর্গকেও তাঁরা সীমান্তরক্ষার ব্যুহ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। পালযুগের পর অনেকবার হস্তান্তরিত হয়ে এই দুর্গটি কোচ-রাজাদের অধীনে চলে যায়। দুর্গপ্রাকারটি কবে পরিত্যক্ত হয়েছে এখনও তা পুরাতাত্ত্বিক সন্ধানের জন্য অপেক্ষমান। আপাতদৃষ্টিতে তাঁরা মনে করছেন, ষোড়শ শতাব্দীতেও এই দুর্গপ্রাকার লোকলশকরে মুখরিত ছিল।

খরস্রোতা বানিয়া নদীর তীরে বলেই সম্ভবত বানিয়া ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু মেন্দাবাড়ি কেন? যা নলরাজার গড় নামে প্রসিদ্ধ তা-ই মেন্দাবাড়ি বা বানিয়া ধ্বংসাবশেষ নামে পরিচিত। নলরাজার কিংবদন্তি যতই ঠুনকো হোক, চিলাপাতার গভীর বনাঞ্চলের এই পুরাকীর্তি নলরাজার গড় বললে সকলেই একবাক্যে চেনে কিন্তু বানিয়া ধ্বংসাবশেষের কথা বললে বুঝতে পারে না। মেন্দাবাড়ি, বানিয়া বা নলরাজার গড় ইতিহাসের গোলকধাঁধায় গোলমেলে হয়ে উঠলেও মূলত একই প্রাচীন দুর্গপ্রাকারের ধ্বংসাবশেষ। শুধু নামের পার্থক্য।

ঐতিহাসিকেরা মনে করেন মেন্দা নামক যে উপজাতি নৃপতি তিব্বত অধিকারের জন্য বক্তিয়ার খিলজিকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, তাঁর নামানুসারেই মেন্দাবাড়ি দুর্গপ্রাকার। কিন্তু ইতিহাসে এ ধরনের নাম পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকদের ধারণা, কোনো একসময় এই দুর্গপ্রাকার কোচ-মান্দীদের দখলে ছিল। মান্দা থেকেই মেন্দা হয়েছে। এই এলাকা ষোড়শ শতাব্দীতে টেপাস বা কালো কোচেরা নিজেদের দখলে রেখেছিল—যখন তিব্বত ভুটানকে আপন বশে এনেছিল।

ইতিহাসের কথা থাক। ইতিহাসের চুলচেরা বিচারের জন্য ঐতিহাসিকেরা আছেন। সন, তারিখ, স্থান কাল যুদ্ধের বিবরণ তাঁরা খুঁজবেন, লিখবেন। আমি লিখতে চাই নলরাজার গড়ের অবহেলার কথা। রক্ষণাবেক্ষণের অবহেলার ফলে গুপ্তযুগের একটি অনুপম পুরাকীর্তি ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

প্রায় বাইশ বছর আগে—চিলাপাতার বনাঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছিল এই বিশাল দুর্গপ্রাকারের ধ্বংসাবশেষ। গভীর বনের অভ্যন্তরে জন্তুজানোয়ারের হিংস্রতা উপেক্ষা করে রাজ্য সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই দুর্গনগরীকে লোকচক্ষুর সামনে তুলে ধরেছিলেন।

রাজ্যের পুরাতত্ত্ব বিভাগ নলরাজার গড় খননের বহু আগেই ১৯৫১খ্রিস্টাব্দে আলিপুরদুয়ারের তদানীন্তন মহকুমা শাসক দুর্গম অরণ্যের অভ্যন্তরে অবস্থিত দুর্গনগরী দেখে, রাজ্য সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন। জলপাইগুড়ির আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়াকে তদানীন্তন রাজ্য সরকার নলরাজার গড়, দুর্গপ্রাকার খনন ও সংরক্ষণের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা সে অনুরোধ রক্ষা করেননি। জন্মের পর থেকে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ আপন মর্জিমাফিক চলে। তাদের ধারণা সার্ভের বাইরে যারা পুরাকীর্তি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা ‘কোয়াক’। এ সম্পর্কে তাঁদের ধ্যান-ধারণা ও জ্ঞান-গম্মি কোয়াকের স্তরেই সীমাবদ্ধ। সুতরাং, রাজ্য সরকারের অনুরোধ ময়লা কাগজের বাক্সে ফেলে দেওয়ার মধ্যে বিশেষ কোনো নতুনত্ব নেই। আজ পর্যন্ত সার্ভের সেই মানসিকতার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।

রাজ্য সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নলরাজার গড়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বনের গভীরে ক্ষয়প্রাপ্ত পুরাকীর্তিকে আবার মানুষের সামনে তুলে ধরলেন। নলরাজার গড় অভিযান ও আবিষ্কারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজ্য পুরাতত্ত্ব অধিকারের অধিকর্তা প্রখ্যাত পরেশচন্দ্র দাসগুপ্ত। পুরাতত্ত্ব গবেষকদের জগতে অন্যতম বিতর্কিত পুরুষ।

রাজ্য সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগই আবিষ্কার করেছিলেন নলরাজার গড়। আবিষ্কারের সব কৃতিত্বই তাঁদের প্রাপ্য। গুপ্তযুগের দুর্গনগরী। দুর্গপ্রাকারের সর্ব নিম্নস্তরে যে ইটের গাঁথুনির নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে স্পষ্টই গুপ্তযুগের রীতি ও শৈলীর সন্ধান মেলে। ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে পুরাতাত্ত্বিকেরা মনে করছেন, দুর্গপ্রাকারটি পরবর্তীকালে সংস্কার করা হয়েছিল। সংস্কার করেছিলেন নবম-দশম শতাব্দীতে পাল রাজন্যবর্গ।

উপরিস্তরে আবিষ্কৃত প্রবেশদ্বার ও জল নিষ্কাশনের জন্য পয়ঃপ্রণালী পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সুদূর অতীতে এই দুর্গ উচ্চস্তরের সেনাছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দুর্গের বহি: ও অন্তঃ প্রাচীর সম্ভবত কোচ রাজাদের আমলেও সংস্কার করা হয়েছিল। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে পুরাতাত্ত্বিকদের ধারণা, ইংরেজ শাসনের পূর্বেই এই দুর্গনগরী পরিত্যক্ত হয়েছে। যে দীর্ঘ পরিখা ও পাকা পয়ঃপ্রণালী দুর্গনগরীকে বানিয়া নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করেছে—তা কোনো এক কালে গোপন বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পয়ঃপ্রণালীর উভয় দিক ইট দিয়ে বাঁধানো। নৌকো নোঙর করার প্রাচীন ব্যবস্থাও পুরাতাত্ত্বিকেরা আবিষ্কার করেছেন।

জঙ্গল সরিয়ে মূল দুর্গপ্রাকারের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে পুরাতত্ত্ববিদেরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এই বিপুলায়তন দুর্গনগরী গুপ্তযুগের কোনো এক শতকে নির্মিত হয়েছিল। নলরাজার গড়ের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের প্রাকারে দুটি অপূর্ব খিলান আবিষ্কৃত হয়েছে। ইটের স্তূপ, পাললিক বালুকা আর লতাগুল্ম সরিয়ে যে অংশটি আবিষ্কৃত হয়েছে তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, দুর্গপ্রাকারের দক্ষিণভাগ খুবই উঁচু ছিল। নলরাজার গড়ে আবিষ্কৃত খিলান, পথ, পয়ঃপ্রণালী সামরিক স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। এই খিলান-পথটিকে পুরাতাত্ত্বিকেরা ভারতের অন্যতম প্রাচীন কালভার্ট বলে অভিহিত করেছেন। দুর্গের অভ্যন্তর থেকে যে গভীর পরিখায় জল নিষ্কাশিত হত তার অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান।

দুর্গের পশ্চিম প্রাকারে দুটি বুরুজে, অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সারিবদ্ধ কুলুঙ্গি এবং চিমনি। দক্ষিণ ও উত্তরের বুরুজ দুটি’র দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৩৩.৫০মিটার ও ৭৬.২৫মিটার।

বুরুজ-এর নীচেই আবিষ্কৃত হয়েছে দীর্ঘ অথচ সংকীর্ণ পাটাতন। এ ছাড়াও গড়ের দক্ষিণ দিক থেকে পুরাতাত্ত্বিকেরা ১৪টি নলবিশিষ্ট কুলুঙ্গি আবিষ্কার করেছেন। পোড়ামাটির চাকা দিয়ে কুলুঙ্গির নলগুলি নির্মিত। পুরাতাত্ত্বিকদের ধারণা নলরাজার গড়ের পশ্চিম-প্রাকারের অন্তর্ভুক্ত এই নলযুক্ত কুলুঙ্গি সমগ্র ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের এক আশ্চর্য বিষয়বস্তু। দুর্গের চারদিকে চারটি প্রবেশ পথের চিহ্নও আবিষ্কৃত।

নলরাজার গড় থেকে উদ্ধারিকৃত ইটের আয়তন গুপ্তরীতির সাক্ষ্য দেয়। পুরাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে দুর্গের অভ্যন্তরে মাটির নীচে ইট নির্মিত হর্ম্যাদির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। দুর্গের পূর্ব প্রাকার সংলগ্ন এলাকায় প্রস্তর নির্মিত বিভিন্ন দেব-দেউলের ধ্বংসাবশেষের সন্ধানও তাঁরা পেয়েছেন। আবিষ্কৃত মন্দিরগুলির মধ্যে কিছু কিছু পালযুগের স্থাপত্যের নিদর্শন মিলেছে। গুপ্তযুগের পর রাজন্যবর্গের অধীনে যে এই দুর্গ-প্রাকারটি ছিল, আবিষ্কৃত দেউল তার সাক্ষ্য।

১৯৬৭খ্রিস্টাব্দের পর ১৯৮৭খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের পুরাতত্ত্ব বিভাগ নলরাজার গড় আবার নতুন করে সমীক্ষা করেন। প্রায় কুড়ি বছর অবহেলিত থাকার ফলে প্রথম অভিযানে আবিষ্কৃত অনেক মূল্যবান নিদর্শন লুন্ঠিত, অপহৃত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনষ্ট হয়ে গেছে।

নলরাজার গড়ের অনাবিষ্কৃত নিদর্শন আবিষ্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে পুরাতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার অভিযান চালিয়েছিলেন। দুই দশকের অবহেলায় প্রথম অভিযানে আবিষ্কৃত নলরাজার গড়ের স্থাপত্যসৌন্দর্য প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও মানুষের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। বলতে দ্বিধা নেই কিছু পর্যটক ও বনবিভাগের কিছু কর্মীর দায়িত্বহীনতায় দুর্গপ্রাকারের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা কোনোদিনই কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না। দুর্গের আবিষ্কৃত অংশের সব সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পুরাকীর্তির প্রতি অনাগ্রহ ও সংরক্ষণের অনীহায় গুপ্তযুগের একটি অনবদ্য স্থাপত্য, শিল্পের অনুপম নিদর্শন হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ রাজ্য সরকারের একটি পুরোপুরি পুরাতত্ত্ব বিভাগ রয়েছে। লোকলশকরের অভাব নেই। অভাব শুধু সংরক্ষণের বাস্তব পরিকল্পনার। প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণের কোনো কার্যকর পরিকল্পনা রাজ্য সরকার আজও গ্রহণ করেননি। যে গতানুগতিক পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে—তাও যথাযথ রূপায়ণের ব্যবস্থা নেই।

অতীতের স্থাপত্য ও শিল্পমানস বর্তমান প্রজন্মের প্রেরণা হতে পারে, এই চিন্তাধারার অভাবের জন্যই রাজ্যের পুরাকীর্তি ধ্বংসের মুখে।

বনদপ্তর নলরাজার গড়ে আবিষ্কৃত বিশাল প্রাকার ও প্রাচীর স্থানে স্থানে ভেঙে বনের অভ্যন্তরে পথ নির্মাণ করেছে। পুরাতত্ত্ব বিভাগের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়োজনবোধও তারা করেনি। যা ধ্বংস করা হয়েছে, তা আর কোনোদিন পুনর্নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু যা অবশিষ্ট রয়েছে তা সংরক্ষণের যাথাযথ ব্যবস্থা কি করা হবে?

দ্বিতীয়বার অভিযানে নলরাজার গড় থেকে আরও কিছু চমৎকৃত জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে। দ্বিতীয়বার খননের ফলে, দেখা যাচ্ছে, নলরাজার গড় শুধু সেনাছাউনি ছিল না— সেখানে বসবাসের জন্য প্রাসাদোপম অট্টালিকাও ছিল। প্রথমবার অভিযানে হর্ম্যাদির অবস্থানের যে ইঙ্গিত ছিল, দ্বিতীয়বারের অভিযানের মধ্য দিয়ে তা যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে। দুর্গের অভ্যন্তরে এবং সংলগ্ন এলাকায় প্রাসাদের অবস্থান পুরাতাত্ত্বিকেরা নির্দিষ্ট করেছেন। প্রাসাদের মেঝে ত্রিস্তরীয় এবং সযত্নে নির্মিত। দুর্গপরিখার সঙ্গে প্রাসাদের সংযোগ রক্ষার সোপানশ্রেণি দ্বিতীয়বার অভিযানের সময় আবিষ্কৃত হয়েছে। ৩ মিটার ও ১৪মিটার প্রশস্ত দুর্গপরিখা বানিয়া নদীর সঙ্গে যুক্ত। কোনো এক সময় ওই পরিখা দিয়ে নৌকো চলাচল করত, দ্বিতীয় অভিযানের সময়, পুরাতাত্ত্বিকেরা তার অনেক নিদর্শন উদ্ধার করেছেন।

দুর্গের পূর্বপ্রান্তে প্রস্তর-নির্মিত বেশ কয়েকটি দেবালয়, দ্বিতীয়বার অভিযানের সময় আবিষ্কৃত হয়েছে। দুর্গের পূর্বদিকের প্রাচীরপ্রান্ত থেকে প্রায় তিন-শো মিটার দূরে মন্দিরগুলি অবস্থিত। বানিয়া নদীর ধারেই মন্দিরগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল। গড়ের অন্যান্য স্থান থেকে কিছু মৃৎপাত্র উদ্ধার করা হয়েছে। মৃৎপাত্রগুলি আপাতদৃষ্টিতে অষ্টম-নবম শতাব্দীর। সম্ভবত রাজা দেবপালের সময় তৈরি করা হয়েছিল।

আবার ফিরে আসি কিংবদন্তিতে। প্রায় দু-শো একর বনাঞ্চল জুড়ে যে দুর্গনগরী গুপ্তযুগের কোনো এক শতকে নির্মিত হয়েছিল, তা কেন নিষাদপতি নলের সঙ্গে যুক্ত করা হল?

মধ্যভারতের কাসিসিন্ধু নদীর অদূরে অবস্থিত প্রাচীন নলপুর (বর্তমান নীরওয়ার) থেকে কি কোনো রাজা রাজ্য বিস্তারে হিমালয়ের নিম্ন শৈলাঞ্চল ও বনভূমির দিকে কোনো অভিযান চালিয়েছিলেন? এই কিংবদন্তি ঐতিহাসিক সত্যতায় প্রমাণিত হয়নি। ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকরা কিংবদন্তির সোপান বেয়ে কোনো একদিন প্রামাণ্য স্থানে নিশ্চয়ই পৌঁছোতে পারবেন।

চিলাপাতার গভীর অরণ্যে অবস্থিত নলরাজার গড় এবং মধ্যভারতের নলপুর একই জনশ্রুতির মাহাত্ম্যে সমুজ্জ্বল। নীরওয়ার অনুশাসনে নলপুরকে মহাদুর্গ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। চিলাপাতার নলরাজার গড়কে একই বিশেষণে ভূষিত করা যায়।

ভুটানের প্রথম সীমান্ত শহর ফুন্টশলিং থেকে ৩৬ কিমি দক্ষিণে, চিলাপাতা বনবিভাগের অফিস থেকে ৬ কিমি উত্তর পশ্চিমে এবং মেন্দাবাড়ি থেকে ৬কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে জনশ্রুতিতে বিধৃত নলরাজার গড়। জলদাপাড়া অভয়ারণ্য থেকে মাত্র সাত কিমি পশ্চিমে। কিন্তু তার আগে নলরাজার গড়ের সার্বিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, ধ্বংসাবশেষের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণকে নলরাজার গড়কে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।

নলরাজার গড় উত্তরবঙ্গে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে।

সকল অধ্যায়

১. শাম্বরিক খরোলিকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
২. কাব্যে কেশ-ব্যবসায় চুল – গোপালকৃষ্ণ রায়
৩. মুড়িয়া শিল্পকলা – গোপালকৃষ্ণ রায়
৪. পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
৫. ড্রাগ : নেশার বিষাক্ত জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৬. হাজারদুয়ারি থেকে পলাশি – গোপালকৃষ্ণ রায়
৭. কলকাতার মৃত্যু-জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৮. রবীন্দ্রনাথ ও একটি রিয়া – গোপালকৃষ্ণ রায়
৯. পৃথিবীর প্রাচীনতম মৃৎপাত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
১০. পুরীর মন্দিরে দুর্ঘটনা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১১. কোণারকের সূর্যমন্দির – গোপালকৃষ্ণ রায়
১২. কঙ্কাল কাহিনি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৩. জগন্নাথদেবের শেষ দেবদাসী – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৪. মা জুঁইং বুঁইন – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৫. জ্ঞাননৌকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৬. পুরাকথায় অমরনাথ – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৭. কিংবদন্তির দ্বারকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৮. খর্বাকৃতি দম্পতি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৯. ঋষি অরবিন্দ – গোপালকৃষ্ণ রায়
২০. তীর্থক্ষেত্র গঙ্গাবাস – গোপালকৃষ্ণ রায়
২১. কলকাতায় আদিম অতিথি – গোপালকৃষ্ণ রায়
২২. নলরাজার গড় – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৩. সেনালি ডিঙ্গো, কুমারীদের শয্যাধামে – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৪. সুনাবেড়া বৃত্তান্ত – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৫. ত্রিপুরার রাজবংশে সতীপ্রথা – গোপালকৃষ্ণ রায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন