গোপালকৃষ্ণ রায়
শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী আজ আর কিংবদন্তি নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর। সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রচেষ্টায় দ্বারকা নিয়ে কল্পলোকের পৌরাণিক কাহিনি এই মুহূর্তে ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত।
যুগ যুগ ধরে দ্বারকা আর দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে অনেক কল্পকাহিনির জন্ম হয়েছে। তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে সত্য ঘেঁষা তর্কের চেয়ে পৌরাণিক কিংবদন্তিতে মানুষ মুগ্ধ ছিল। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন কি ছিলেন না, দ্বারকা প্রাসাদের অস্তিত্ব ছিল কি ছিল না, তা নিয়ে বিতর্কের চেয়ে কল্পকাব্য তৈরি হয়েছে অনেক বেশি। সেইসব কল্পকাহিনির আঙ্গিক, ভাষা আর চরিত্র চিত্রণের মুনশিয়ানায় মায়ালোকের দ্বারকা আমাদের কাছে অতিপরিচিত আর দ্বারকাধীশ আপনজন। তাঁর ব্যক্তিত্ব আর পৌরুষকে যুগ যুগ ধরে মানুষ দেবত্ব আরোপ করেছে। অবিসংবাদিত কূটনীতিক হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কাছে কল্পলোকের কাহিনি ছাড়া কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
কল্পকাহিনিকে ভিত্তি করে মানুষ কল্পনায় তাঁর অবয়ব এঁকেছে। তাঁর পৌরুষকে প্রাণময় ও জীবন্ত করে তুলেছে। তাঁর সীমাহীন কূটনৈতিক প্রজ্ঞাকে বিশ্লেষণ করেছে। কিন্তু দ্বারকার সেই প্রাসাদ আর প্রাসাধীশের অস্তিত্ব উদ্ধার করতে পারেনি।
কথিত, মথুরার লীলা শেষ করে শ্রীকৃষ্ণ চলে গিয়েছেন দ্বারকায়। সেখানে গিয়ে দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতে নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে লেখা হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মহাভারত। ভাষা, আঙ্গিক আর জাদুকরি রচনাশৈলীর প্রভাবে মহাভারতের সব চরিত্র আপন মহিমায় মানুষের মনে ভাস্বর।
মহাভারতের কথা থাক। আমরা আবার ফিরে আসি কিংবদন্তি দ্বারকার কথায়। ইঙ্গিতবাহী কল্পলোকের দ্বারকার অস্তিত্বের সন্ধান সম্প্রতি মিলেছে। দ্বারকার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় শুধু কিংবদন্তির অবসান ঘটল না, এক মহান কল্পকাব্যের নগরী প্রাচীন ইতিহাসের মর্যাদা পেল। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিকেরা পৌরাণিকী কিংবদন্তির অবসান ঘটিয়ে যে সত্য প্রতিষ্ঠা করলেন, প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে তা এক বিরল ঘটনা। দ্বারকা নিয়েই আমাদের দেশে সামুদ্রিক প্রত্নতত্ত্বের যাত্রা শুরু। আর একই সঙ্গে বলা চলে, দ্বারকার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় পৌরাণিকী কল্পকাহিনি এই প্রথম ঐতিহাসিক সত্যে চিহ্নিত হল।
কিংবদন্তির সারণি ধরে ইতিহাসের পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় ছ-বছর আগে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে। দেশের আহিতনামা প্রত্নতাত্ত্বিক ড. এস আর রাও দ্বারকার যুগ-সঞ্চিত কিংবদন্তির অবসান ঘটালেন। গোয়ায় অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব মেরিন আর্কিওলজির সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আরব সাগরের তলদেশে খনন আর অনুসন্ধান চালিয়ে দ্বারকার অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। অনুসন্ধানে তাঁরা মায়ালোকের স্বপ্নসৌধ পাননি, পেয়েছেন বালি, প্রস্তর লোহার বিম দিয়ে নির্মিত একটি ঐতিহাসিক শহর। কয়েক হাজার বছর আগে আরব সাগরের গর্ভে তলিয়ে যাওয়া কল্পলোকের দ্বারকাকে সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বাস্তবের বেলাভূমিতে নিয়ে এলেন।
সামুদ্রিক প্রত্নতত্ত্ব আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত নতুন। অবশ্য পৃথিবীর অন্যত্রও এ বিষয়ে বিশেষ কোনো কাজ হয়নি। সুতরাং খুব বেশি পেছিয়ে থাকার প্রশ্ন ওঠে না। দ্বারকা নিয়ে ড. রাওয়ের সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শুধু নিজেদের মধ্যেই সীমিত ছিল না—ইউনেসকো এবং উন্নতিশীল কয়েকটি রাষ্ট্র এই যুগসঞ্চিত কিংবদন্তি অবসানের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
সমুদ্রের তলদেশ থেকে সত্যকে তুলে আনার একটি পঞ্চবার্ষিক প্রকল্প রচনা করেছিলেন ড. রাও। আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য এসেছিল ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের কাছ থেকে। কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রও আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করেছিল।
প্রকল্পের প্রথম চার বছর সামুদ্রিক প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিশেষজ্ঞ, ঐতিহাসিক, অমিতবিক্রম ডুবুরিরা আরব সাগরে হারিয়ে যাওয়া দ্বারকার কল্পসৌধ সন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন। প্রকল্প রূপায়ণ করে তাঁরা প্রমাণ করেছিলেন দ্বারকা আর শ্রীকৃষ্ণের কিংবদন্তি নগরী নয়, এক প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর।
তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের তলদেশে অনুসন্ধান চালানো প্রত্নতাত্ত্বিকদের পক্ষে খুব একটি সহজ কাজ ছিল না। সমুদ্রের প্রতিকূল পরিবেশ বার বার তাঁদের কাজে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। সন্ধানের কাজ ব্যাহত করেছে। কিন্তু আবিষ্কারের উন্মাদনায় স্থিরপ্রতিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা নির্দিষ্ট পথ থেকে সরে আসেননি। মৃত্যু ভয়ে তাঁরা ভীত হননি। ভয়াল তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের জলে কেউ ডুবেও যাননি। অতিকায় জলজপ্রাণীর মুখোমুখি হয়েও কেউ আতঙ্কে মূর্ছা যাননি। কারণ সত্য প্রতিষ্ঠায় জীবন ত্যাগেও তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন।
জীবনের ঝুঁকি কেন নিয়েছিলেন ড. রাও? কিংবদন্তির পেছনে এমন করেই বা ছুটেছিলেন কেন? কীসের তাড়নায়? কোন শক্তি আর সূত্র সত্যের সন্ধানে তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছে?
সে এক অবিশ্বাস্য কাহিনি! হয়তো এই কাহিনিই কোনো একদিন কিংবদন্তিতে পরিণত হবে। ড. রাও শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক নন—একজন প্রাজ্ঞ সংস্কৃত পন্ডিত। তিনি মনে করেন, সত্য ছাড়া কোনো কিংবদন্তির জন্ম হয় না। কিংবদন্তির অন্তরালে কিছু না কিছু সত্য থাকেই। এই বিশ্বাসে তিনি বিশ্বাসী। শ্রীকৃষ্ণ প্রতিষ্ঠিত দ্বারকাকে তিনি কিংবদন্তি বলে স্বীকার করেননি। আর করেননি বলে কিংবদন্তির দ্বারকা আমাদের কাছে এখন ইতিহাস।
মহাভারতের গৌরচন্দ্রিকা প্রাচীন হরিবংশ তাঁর প্রেরণার উৎস। হরিবংশ-এর পাতায় শ্রীকৃষ্ণ নির্মিত দ্বারকার বিস্তৃত বিবরণ বিধৃত। আরব সাগরের তলদেশে আবিষ্কৃত দ্বারকা নগরীর সঙ্গে হরিবংশ-এ বিবৃত নগরীর সম্পূর্ণ মিল খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক ড. রাও। দ্বারকার স্থলভাগের দৃশ্য—পারিপার্শ্বিকতার যে বিবরণ হরিবংশ-এ রয়েছে—বর্তমানের সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে। হরিবংশ-এ বিবৃত পথ ধরেই সত্যের সন্ধানে আরব সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।
ড. রাওয়ের মতে হরিবংশ-এ উল্লিখিত দ্বারকার পরিধি ছিল বারো যোজন। দ্বীপটি মূল-ভূখন্ডের সঙ্গে সুংযুক্ত। ভাটার সময় এখনও তার প্রমাণ মেলে।
আরব সাগরের তলদেশ খনন করে যে নগরীর সন্ধান মিলেছে তারও সীমানা বারো যোজন। এ থেকে প্রমাণ হয়, হরিবংশ শুধু কল্পকাহিনি নয়, বাস্তব তথ্যে সমৃদ্ধ একটি ঐতিহাসিক দলিল।
সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক আর সাহসী ডুবুরিরা সমুদ্রের অতল থেকে তুলে নিয়ে এলেন কতগুলি সিলমোহর। উদ্ধারীকৃত সিলমোহরের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সিলমোহরের আকৃতিগত সাদৃশ্য রয়েছে। তাঁরা তুলে আনলেন চার্ট ব্লেড, অক্ষর-খোদিত একটি পাত্র, পাথরের একটি ছাঁচ এবং সরু-গলা সুদৃশ্য মৃৎঝাঁঝর। সমুদ্রগর্ভ থেকে উদ্ধারীকৃত এই সব জিনিসের তাৎপর্য কী? এই প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাবও ড. রাও দিয়েছেন।
ড. রাওয়ের জবাবের পথ বেয়ে আমরা এখন এগিয়ে যেতে পারি। আমরা এখন কল্পসৌধ থেকে চলে যেতে পারি ঐতিহাসিক প্রাসাদে। যে প্রাসাদে কোনো এক সময় দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণ বাস করতেন। সমুদ্রগর্ভে এইরকম একটি প্রাসাদের সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। ধারণা করে নিতে পারি, ওই প্রাসাদেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দলিল তৈরি হয়েছিল। মহাভারত হল সেই মহাদলিল। সদ্য আবিষ্কারের পারম্পর্য আমাদের সেই সিদ্ধান্তের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞ ও ডুবুরিরা সমুদ্রগর্ভে বিলীন দ্বারকা থেকে যে সিলমোহর উদ্ধার করেছেন—তার সঙ্গে হরিবংশ-এ বর্ণিত বিবরণের মিল রয়েছে। সেই সময়ে কোনো ব্যক্তির সিলমোহর ছাড়া দ্বারকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এই সময়ে আমরা যাকে পরিচয়পত্র বলি, সিলমোহরগুলি ছিল সেই সময়ের পরিচয়পত্র। হরিবংশ-এ এই পরিচয়পত্রের কথা উল্লেখ আছে। বর্তমানে আমাদের দেশে পরিচয়পত্র না থাকায় কিছু মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
হয়তো সেই সময় এই সমস্যা সমাধানের জন্যেই পরিচয়পত্রের প্রয়োজন ছিল।
দ্বারকার চার্ট ব্লেডগুলির সঙ্গে শেষ হরপ্পা এবং হরাপ্পাত্তোর চার্ট ব্লেডের মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। যে অলপিন (OLPIN) সমুদ্রের তলদেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে—প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ইটালিয়ান সে পিনের সঙ্গে তার সাদৃশ খুঁজে পেয়েছেন।
আরও যেসব প্রামাণ্য তথ্য সমুদ্রের তলদেশের ধ্বংসাবশেষ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে—তার মধ্যে একটি পাথরের বিষ্ণুমূর্তি ও লৌহ নির্মিত ধারালো অস্ত্রের বয়েস নির্ধারণ করা এখনো সম্ভব হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা লৌহের বয়েস নির্ধারণের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বয়েস নির্ধারণের পর আর একটি বিস্ময়কর সত্যের রহস্য উদঘাটিত হবে। যদি প্রমাণ হয়, এই লৌহনির্মিত অস্ত্রের বয়েস পাঁচ হাজার বছর, তাহলে বিদেশ থেকে লৌহ আমদানির যুগ-সঞ্চিত ধারণা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
আবার আমরা ফিরে আসি বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের তলদেশে। স্থলদেশে যা সহজে সম্ভব—গভীর সমুদ্রের তলদেশে তা প্রায় অসম্ভব। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। সন্ধানের জন্য তারা বেছে নিয়েছিলেন নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। ওই সময় সমুদ্র অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকে।
এই সত্য-অনুসন্ধানে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। কিছু আধুনিক প্রযুক্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল বিদেশ থেকে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পাঁচ বছরে খরচ হয়েছে পনেরো লক্ষ টাকা।
সত্য সন্ধানের অনেক তথ্য এখনও অজানা। পরীক্ষা আর বিশ্লেষণের পর সব সত্য আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ড. রাওয়ের প্রকল্প তিনি অনুমোদন করেছিলেন।
সত্যের জন্যেই সত্যের সন্ধান চিরদিন চলে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন