গোপালকৃষ্ণ রায়
নিজের গ্রামে ওরা প্রেম করতে পারে না। ভালোবাসার সন্ধানে ওরা ঘুরে বেড়ায় প্রতিবেশী গ্রামে। পাহাড়ি পথে ঘুরতে ঘুরতে সায়াহ্নে এক সময় নেমে যায় সেনালি ডিঙ্গো বা কুমারী শয্যাধামে।
বোনদোদের কথা বলছি। ওড়িশার আদিম উপজাতিদের মধ্যে অন্যতম বোনদো সম্প্রদায়। অস্ট্রো-এশিয়াটিক গোষ্ঠীর এই মানুষগুলি আজও সভ্যতা থেকে নিজেদের সযত্নে সরিয়ে রেখেছে। প্রস্তর যুগ থেকে যে ব্যবস্থা ও সংস্কার তাদের সমাজে চলে আসছে, আধুনিক সভ্যতা তাতে বড়ো একটা ফাটল ধরাতে পারেনি। আপন সমাজ ও সংস্কারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বোনদোদের বৈচিত্র্যময় জীবন শুধু নৃতাত্ত্বিক আর সমাজবিজ্ঞানীকে হাতছানি দেয় না—সব শ্রেণির মানুষের দর্শনেন্দ্রীয়কে লোভী করে তোলে। কিন্তু বোনদো সমাজের রমণীরা কোনোদিন বহিরাগতের লোভের শিকার হয় না।
উলঙ্গ না বলে প্রায় উলঙ্গ বলাই ভালো। নারী-পুরুষ উভয়ের কোমরে জড়ানো থাকে একচিলতে কাপড়। আজকার মালকানগিরির বাজার থেকে দু-এক গজ কাপড় কিনলেও কেনেঙের ছালে তৈরি মরিন্দার রং-এ রাঙানো পরিধানকে ওরা বিদায় দেয়নি। পোশাকের কথা থাক। বোনদোদের প্রেমের কথায় ফিরে আসা যাক। বোনদো যুবক-যুবতীর কাছে প্রেম একটি মহার্ঘ বস্তু। অনেক সন্ধান আর অনেক কৃচ্ছসাধনের পর ওরা প্রেমের খোঁজ পায়। যুবক মনের সঞ্চিত ভালোবাসা তখন আলোকলতার মতো প্রেমিকার দেহে জড়িয়ে থাকে।
আগেই বলেছি নিজেদের গ্রামে বোনদোরা প্রেম করতে পারে না। সেখানে প্রাকবিবাহ যৌন মিলনের প্রশ্নই ওঠে না। প্রেমের জন্য তাদের যেতে হয় সেনালি ডিঙ্গো-য়। সমাজের নির্দেশ আর প্রচলিত সংস্কারকে বোনদো যুবক-যুবতী উপেক্ষা করে না। একটি আধিভৌতিক ভয় তাদের মনকে সংস্কারের প্রতি সতত শ্রদ্ধাশীল রাখে। কেউ যদি তাদের এই মানসিকতা প্রস্তর যুগের বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করেন—তাহলে তিনি ভুল করবেন। কোরাপুট স্টেশনের পেছনে ছোটো একটি বাংলোয় বসে বোনদোদের জীবনবেদ শোনাচ্ছিলেন নরেন জেনা। উৎকলবাসী এই নৃতাত্ত্বিকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল—মধ্যপ্রদেশের কিরান্ডুলে। তিনি ভুবনেশ্বরে একটি সরকারি মানববিজ্ঞান গবেষণা সংস্থার সঙ্গে জড়িত।
বস্তারের মাড়িয়াদের সঙ্গে বন্দোপাড়া কদমগুড়া বা খুলড়িপাড়ার বোনদোদের জীবনচর্চার মিল আর অমিল খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি। এই দুই আদিম উপজাতির জীবনের সাদৃশ্য আর বৈসাদৃশ্য সন্ধান করে চলেছেন।
নরেন জেনা বলেন, স্বাধীনতার আগেও ওরা কোনোদিন বাজার থেকে কাপড় কিনত না। কেরেঙ গাছের ছাল আর একরকম লতার বড়ো বড়ো পাতা দিয়ে নিজেদের পোশাক তৈরি করত। সে-পোশাকে লজ্জা নিবারণ যত না হত—তার চেয়ে দেহের সৌন্দর্য বাড়ত বেশি। দেহকে সৌন্দর্যমন্ডিত করতেই ছাল আর পাতার পোশাক পরিধান করত। এখনও সেই প্রচলিত প্রথার মৃত্যু হয়নি। বাজারি নেংটির প্রচলন হলেও যুগ সঞ্চিত সংস্কারকে এখনও পরিত্যাগ করতে পারেনি। পোশাকের সঙ্গে বোনদোদের অনেক সংস্কার জড়িয়ে আছে। বোনদো রাজত্বে এখনও বেশির ভাগ মানুষ বাজারি নেংটি পরে না। কেরেঙের ছাল থেকে আঁশ বার করে নিজেদের তাঁতে কাপড় বুনিয়ে নেয়। বুনোফুল বা মরিন্দার পাতার রস দিয়ে সেই কাপড় রাঙিয়ে নেয়। দু-গজ লম্বা আর দশ ইঞ্চি চওড়া আপন হাতে বোনা সেই কাপড় কোমরে জড়িয়ে রাখে।
নরেন জেনা আবার সংস্কারের কথায় ফিরে আসেন। বলেন, বোনদো রাজত্বে এখনও অনেকে বাজারি কাপড় পরে না। যারা সভ্যতার প্রভাবে মালকানগিরির বাজার থেকে ধুতি বা শাড়ি কেনে, গোঁড়া বোনদোরা তাদের অস্পৃশ্য বলে মনে করে।
বোনদো মানে নগ্ন। নগ্নতা বোনদো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নগ্নতায় তাদের লজ্জা নেই—নগ্নতাকে তারা উপহাস করে না। বরং প্রতি ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি দিয়ে উপভোগ করে।
বোনদোদের নগ্নতা নিয়ে অনেক গল্প-গাথা আছে। তাদের পোশাকের সঙ্গে অনেক কিংবদন্তি জড়িয়ে আছে।
বোনদোরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে বলে মহাপ্রভু। না, নদিয়ার গৌরাঙ্গদেব নয়। গৌরাঙ্গদেবের অনেক আগে থেকে বোনদোরা পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তাকে মহাপ্রভু বলে জানে। এই মহাপ্রভু একদিন সস্ত্রীক আগুনের জন্য এসেছিলেন বোনদো গ্রামে। মাটির দাওয়ায় একটি উলঙ্গ বোনদো রমণী বসে বসে হোণ্ডা বা হালুয়া তৈরি করছিল। মহাপ্রভুকে দেখে একহাতে লজ্জা ঢেকে অপর হাতে আগুন এগিয়ে দিয়েছিল। মহাপ্রভুর স্ত্রী তাই দেখে নিজের শাড়ির একটি অংশ ছিঁড়ে সেই নগ্ন বোনদো রমণীকে দিয়েছিলেন।
স্ত্রীর বদান্যতায় হেসে উঠেছিলেন মহাপ্রভু। বলেছিলেন, লাভ নেই। ওরা হোন্ডা রমণী নয়—ওরা বোন্দা অর্থাৎ নগ্ন।
সেই থেকে বোনদোরা লজ্জা নিবারণের জন্য একটুকরো কাপড় ব্যবহার করে।
রাম, সীতা, লক্ষ্মণকে নিয়েও বোনদোদের সমাজে কিংবদন্তি আছে। নরেন জেনা বলেন, পোশাকের কথা থাক। আমরা ফিরে আসি, বোনদোদের প্রেমের কথায়। আগেই বলেছি, বোনদোরা নিজের গ্রামে প্রেম করতে পারে না। ভালোবাসার জন্য তাদের যেতে হয় প্রতিবেশী গ্রামে অথবা পাহাড়ের চূড়ায়। অবশেষে নেমে আসে সেনালি ডিঙ্গোয়। প্রাকবিবাহ যৌন সংসর্গ তাদের কাছে ট্যাবু। প্রাচীনকাল থেকে এই সংস্কার বোনদো সমাজে প্রচলিত। এখনও এই সংস্কার কেউ ভাঙেনি। অদূর ভবিষ্যতেও ভাঙার কোনো ইঙ্গিত নেই। আমার আর আর্কুভ্যালিতে যাওয়া হয় না। দেখতে চেয়েছিলাম ব্রডগেজ রেলওয়ের সর্বোচ্চ স্টেশন সিমলাগুড়ি। কিরাণডোল-বিশাখাপত্তনম শাখার এই স্টেশনটি প্রায় হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এখান থেকে যেতে চেয়েছিলাম বড়োগুহালু। এখানেই রয়েছে দেশের বৃহত্তম গুহা। ৩০০মিটার প্রশস্ত ও ৪০মিটার গভীর। গুহার অভ্যন্তরে রয়েছে শিবলিঙ্গ। গুহার ছাদ থেকে অনাদিকাল ধরে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে শিবের মাথায়। জনশ্রুতি বনবাসের সময় শ্রীরামচন্দ্র সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে ছিলেন এই গুহায়। তাও দেখা হল না।
নরেন জেনা বলেন, চলুন একসঙ্গে বোনদোদের রাজত্ব দেখে আসা যাক। দিন কয়েক পরেই ওদের ‘জিয়াগ জাইজ ’ বা গ্রীষ্মের উৎসব শুরু হবে, তখন বহিরাগতদের বোনদো রাজত্বে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
সে কী? সেখানে যেতে পাসপোর্ট বা অভ্যন্তরীণ অনুমতিপত্রের দরকার হবে নাকি?
নরেন জেনা বলেন, ঠিক তা নয়। এটা ওদের ধর্মীয় সংস্কার। এই উৎসবের সময় বোনদোরা গ্রামকে মন্ত্রপুত্র করে। কাঁটা আর পাথর দিয়ে গ্রামের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়। প্রবেশ পথে তির-ধনুক হাতে নিয়ে যুবকেরা পাহারায় থাকে।
বোনদোরা বিশ্বাস করে যে, উৎসবের সময় বহিরাগতদের উপস্থিতি গ্রামের পবিত্রতা নষ্ট করে। বাইরের লোকের কলুষ-কালিমা থেকে গ্রামকে মুক্ত রাখার জন্যেই তারা এই ব্যবস্থা নেয়। পাঁচ দিন চলে এই উৎসব। এই পাঁচদিন বোনদো রাজত্ব দেশের অন্যান্য স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে।
অবাক হয়ে বলি, এ তো বড়ো বিস্ময়ের ব্যাপার। নরেন জেনা বলেন, বোনদো জীবনে অনেক বিস্ময় রয়েছে। অনেক বিস্ময় এখনও অনুদঘাটিত। নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষায় যতটুকু জানা যায়, তাও কম বিস্ময়ের নয়। বোনদো চরিত্রে অবাক হবার মতো অনেক কিছুই আছে।
নরেন জেনা আবার মনে করিয়ে দেন, বোনদোরা নিজের গ্রামে প্রেম করতে পারে না। প্রেমের সন্ধানে তাদের যেতে হয় ভূগর্ভস্থ কুমারী শয্যাধামে।
অরুণাচলেও কুমারী শয্যাধামের কথা শুনেছি। কুমারী শয়নাগারকে অরুণাচলের উপজাতিরা বলে রাশেং।
নরেন জেনা বলেন, প্রায় একই রকম ব্যবস্থা বোনদোদের মধ্যে দেখতে পান। আচার-আচরণের কিছু তফাত থাকলেও মূল বিষয়ে সাদৃশ্য আছে।
বোনদোদের কুমারী শয়নাগার ভূগর্ভে অবস্থিত। পাহাড় খুঁড়ে গর্ত তৈরি করে। একটি বিস্তৃত গর্তে অন্তত পঞ্চাশ জন মানুষ তার মধ্যে থাকতে পারে। একটি সরু সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ঢুকতে হয়। বাইরের কোলাহল সেই গর্তের মধ্যে পৌঁছোয় না। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি জায়গায় কুমারী শয়নাগার। আর এখানেই জন্ম নেয় বোনদোদের প্রেম। এখানেই যুবক-যুবতীরা তাদের জীবন সঙ্গী নির্বাচন করে।
বস্তারে মুড়িয়াদের ঘটুল দেখেছি। সে এক অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতা। সেখানে চেলিক আর মোতিয়ারীর অভিসার দেখেছি। বিদায়ের বিষণ্ণক্ষণে ঘটুল বউয়ের কান্না শুনেছি। ঘটুল তো একটি প্রতিষ্ঠান। শুধু যৌন শিক্ষা নয়—জীবনের সব শিক্ষাই চেলিক আর মোতিয়ারীরা সেখান থেকে পেয়ে থাকে।
বস্তার আর কোরাপুট পাশাপাশি। হয়তো মুড়িয়াদের সামাজিক প্রভাব বোনদোদের মধ্যে পড়েছে—অথবা বোনদোদের কাছ থেকেই এই শয়নাগারের সন্ধান মুড়িয়ারা পেয়েছে। কিন্তু অরুণাচল? সে তো অনেক দূর। বোনদোরা যেমন অরুণাচলের নাম শোনেনি— তেমনি তিরাপের নানু গ্রামের ওয়ানচোরা বোনদোদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। অথচ উভয়ের জীবনের মূল বিষয়ে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
নরেন জেনা বোনদা পাড়ায় আগন্তুক নন। নিজের মনের এক অদম্য আকর্ষণে প্রায় প্রতিবছরই বোনদো রাজত্বে তিনি যান। তাদের আদিম জীবনচর্চার গভীরে প্রবেশ করে আচার-আচরণের মধ্যে নতুনত্বের সন্ধান করেন। কিন্তু এখনও তিনি বোনদোদের পূর্ণ আস্থা লাভ করতে পারেননি। বহিরাগতের সঙ্গে বন্ধুত্বে বোনদোরা সংশয়মুক্ত নয়। তাদের ধারণা বাইরের মানুষ তাদের লোভ দেখিয়ে রাজত্বের বাইরে নিয়ে গিয়ে খোজা করে দেয়।
আবার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি, সে কী! এ অদ্ভুত বিশ্বাস কেন? নরেন জেনা একটু হাসেন। বলেন, তাই বোনদোরা কখনো নিজের রাজত্ব ছেড়ে বাইরে আসে না। বোনদা রমণীরাও তাদের পুরুষকে সীমানার বাইরে যেতে দেয় না।
আর মেয়েরা?
নরেন জেনা বলেন, তাদের বাইরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
বহিরাগতের সংস্পর্শে তাদের দেহ এবং সযত্নে সংরক্ষিত যৌনদুর্গ কলুষিত হবার ভয়ে তারা অহেতুক ভীত।
অথচ নিজের গ্রামে তারা সহজ, সরল এবং সাবলীল। মুখে সর্বদা মিষ্টি হাসি। কিন্তু বেশিক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। নগ্ন দেহের উছলে পড়া যৌবন আপনার মনকে বিচলিত করবে— চোখের দৃষ্টি বিড়ম্বিত হবে। অবশ্য দু-চার দিন পর সবটাই সহজ হয়ে যায়।
নরেন জেনাকে মনে করিয়ে দিই, আপনি কিন্তু সুড়ঙ্গ শয়নাগারের কথা বলেছিলেন।
নরেন জেনা বলেন, হ্যাঁ, আমার মনে আছে। সুড়ঙ্গ শয়নাগারের কথায় ফিরে যাবার আগে—ওদের প্রাক-বিবাহ যৌন মিলন সম্পর্কে দু-চার কথা আপনার জানা দরকার।
বোনদোরা সাহসী। দৃঢ়চেতা ও স্বাধীন। ওরা জন্ম থেকে মুক্ত। বদমেজাজি বোনদোদের মাথায় মাঝে মাঝে খুনের নেশা চাপে। সামান্য ছলছুতোয় দু-একটা খুন করা তাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। অবশ্য গত দু-দশকে পরিস্থিতি কিছুটা পালটিয়েছে। খুনের মাত্রা কমে এলেও চিরাচরিত প্রথার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। মেজাজি মনের প্রাগৈতিহাসিক প্রতিক্রিয়া এখনও বিদ্যমান।
নরেন জেনা আবার বোনদোদের প্রাকবিবাহ যৌন মিলনের বিষয়ে ফিরে আসেন। বলেন, সর্বক্ষেত্রে পুরুষোচিত আচরণ করেও—ঠিক এই জায়গায় এসে বোনদোরা কাপুরুষ হয়ে যায়। প্রাকবিবাহ যৌন মিলনের ওপর একটি ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা বর্ণে বর্ণে মেনে চলে। বোনদো যুবতীরা মনে করে বিবাহের আগে যৌন সংসর্গ বাগদত্তার সমতুল্য। এক্ষেত্রে বিবাহ না হলে—আমৃত্যু অসতীর গ্লানি তাকে যন্ত্রণা দেয়।
ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার জন্যেই যুবক-যুবতীরা নিজেদের গ্রামে প্রেম করতে পারে না। নিরালায় নিভৃতে বনে বা পাহাড়ের অন্তরালে পরস্পরের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াও প্রথাবিরোধী।
নরেন জেনা বলেন, অরুণাচলের রাশেং-এর মতো বোনদোদের আছে সেনালি ডিঙ্গো বা কুমারী নিলয়। স্বাধীনতার আগেও ছিল ভূগর্ভে। এখন উঠে এসেছে ভূপৃষ্ঠে। একটু চুপ করে থেকে নরেন জেনা বলেন, সেনালি ডিঙ্গোকে আপনি বলতে পারেন স্বয়ংবর সভা।
স্বয়ংবর সভা?
নরেন জেনা বলেন, হ্যাঁ। এই সেনালি ডিঙ্গোতে কুমারী মেয়েরা ভিড় করে। আর যুবকেরা দল বেঁধে সেনালি ডিঙ্গোয় যায়। এখান থেকেই জন্ম নেয় প্রেম। প্রেম থেকে পরিণয়। জিজ্ঞাসা করি, যুবকদের ডর্মিটরিকে বোনদোরা কী বলে? নরেন জেনা বলে, ইঙারসিন। ইঙারসিনও ভূপৃষ্ঠেই অবস্থিত। ঘটুল বা মোরাং-এর মতো বোনদোদের ইঙারসিনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই।
আমি বলি, শৃঙ্গার থেকেই কি ইঙার? নরেন জেনা হেসে বলেন, আমার জানা নেই।
ইঙারসিন, সমবয়েসি অবিবাহিত যুবকদের আড্ডাখানা। অবসর সময়ে তারা নিজেদের মধ্যে আড্ডা জমায়। শিকারের ফন্দি আঁটে। অথবা মাচকুন্ড নদীতে মাছ ধরার পরিকল্পনা করে। আর প্রাকসায়াহ্নে অরণ্য পেরিয়ে, পাহাড় ডিঙিয়ে, সেনালি ডিঙ্গোয় হাজির হয়। এখানেই জীবনের সন্ধান পায়—যৌবনের অভিসার শুরু হয়।
বোনদো সমাজ অনেক ভেবেচিন্তেই সেনালি ডিঙ্গো স্থাপন করেছে। এখানে ছেলে-মেয়ে মুক্ত মনে মিশতে পারে। নিজেদের পছন্দের আদানপ্রদান করতে পারে। বোনদোরা বিশ্বাস করে, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে দুটি হৃদয় এক হয় আর সেই একাত্মবোধ আমৃত্যু থাকে। পরস্পরকে না জেনে কারো যদি বিয়ে হয়, বিশ্বস্ততার অভাব যেকোনো মুহূর্তে ঘটতেই পারে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস জন্মালে, মহাপ্রভু প্রেরিত বাঘ তাদের ধ্বংস করে। যাতে তেমন কোনো ঘটনা না ঘটে তার জন্যেই সেনালি ডিঙ্গো। নরেন জেনা মনে করিয়ে দেন, বোনদো যুবকেরা নিজের গ্রামে প্রেম করতে পারে না—বিয়েও করতে পারে না। সেনালি ডিঙ্গো বা স্বয়ংবর সভায় ভিড় করে প্রতিবেশী গ্রামের যুবকেরা।
নতুন শিল্পায়নের কোলাহলমুখর কোরাপুট। দু-দশক আগেও প্রাকসন্ধ্যায় কোরাপুট নির্জন থাকত। কিরাণডোল এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়াও—মালবাহী ট্রেন, বাইল ভিলা আর বিশাখাপত্তনমের মধ্যে আকরিক লৌহ নিয়ে যাতায়াত করে। কোরাপুট থেকে ভিন্ন রাজ্যে নিয়মিত বাসও চলাচল করে। তাই গভীর রাতেও শহর নিদ্রাহীন থাকে। নরেন জেনা বলেন, ভূগর্ভস্থ কুমারী কক্ষ নিয়ে অনেক গল্প কথা আর কিংবদন্তি আছে। কিংবদন্তির সূত্র ধরে আমরা এক আদিতে পৌঁছোতে পারি। বোনদো সমাজে সেনালি ডিঙ্গোর ভূমিকা বুঝতে পারি।
কুমারী কক্ষ সম্পর্কে কৌতূহল আমার বেড়ে যায়। উদগ্রীব দৃষ্টি মেলে নরেন জেনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
নরেন জেনা বলেন, সেনালি ডিঙ্গো বোনদো যুবক-যুবতীর পরীক্ষাগার। এখানেই বোনদো যুবককে জৈবিক শক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়—আর যুবতীকে দিতে হয় কুমারীত্বের পরীক্ষা। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তারা নতুন জীবনে প্রবেশ করে। একটি কথা মনে রাখবেন, বোনদো যুবতীরা তাদের চেয়ে কমবয়েসি যুবকের সঙ্গে প্রেম করতে ভালোবাসে। এর পেছনে কোনো ধর্মীয় কারণ না থাকলেও — যৌন কারণ অবশ্যই আছে।
অতীতে সেনালি ডিঙ্গো তৈরি করা হত দশেরার সময়। গর্তের ওপর তালপাতার ছাউনি থাকত। তার ওপর পাতলা মাটির আস্তরণ। গোবর দিয়ে লেপে তাকে সুশ্রী করা হত। কুমারী কক্ষ ব্যবহারের আগে একটি মুরগি ও একটি শূকর উৎসর্গ করা হত। মুরগি ও শূকরের রক্ত নবনির্মিত সেনালি ডিঙ্গোতে ছড়িয়ে দিয়ে পবিত্র করা হয়। পবিত্রকরণের আগে কুমারীরা সেনালি ডিঙ্গোয় প্রবেশ করতে পারে না। এখন শুধু গর্ত ছাড়া, আর সব প্রথাই মানা হয়।
বোনদোরা বিশ্বাস করে, প্রথম সেনালি ডিঙ্গো নির্মাণ করেছিলেন মহাপ্রভু নিজে। ঘর-বাড়ি তৈরি করার আগে আদিযুগে বোনদোরা এইরকম গহ্বরে থাকত। গর্তের অনুকরণে তারা বসবাসের জন্য আরও অনেক গর্ত বা গুহা তৈরি করেছিল। বলি, এই কিংবদন্তি কি আমাদের প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহার কথা মনে করিয়ে দেয় না? নরেন জেনা বলেন, আমারও তাই মনে হয়।
আগে বোনদোরা ছিল গুহাবাসী। বোনদো রাজত্বে খুঁজলে এখনও দু-চারটে প্রাগৈতিহাসিক গুহা পাওয়া যায়। বোনদো অঞ্চল থেকে আর্কুভ্যালি আর বড়োগুহালু বেশি দূরে নয়। দু-জায়গাতেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহা রয়েছে। বড়োগুহালুর গুহা তো পৃথিবীর দীর্ঘতম।
এই প্রাগৈতিহাসিক গুহার অনুকরণেই বোনদোরা কুমারী কক্ষ তৈরি করেছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কুমারী কক্ষেরও রূপান্তর ঘটেছে। কিন্তু স্বয়ংবর সভার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আজও স্বয়ংবর সভার ট্র্যাডিশন সমানভাবে চলেছে। গুহা থেকে গৃহ। কোনো এক সময়ের গর্তের সেনালি ডিঙ্গো ছাঁচ্যার বেড়া আর তালপাতার ছাউনির তৈরি গৃহে রূপান্তরিত হয়ে যায়। স্বয়ংবর সভা আজকাল ঘরেই বসে। গর্ত থেকে বেরিয়ে এলেও—ট্র্যাডিশনের হেরফের হয় না।
দল বেঁধে বোনদো যুবকেরা সেনালি ডিঙ্গোয় ঢোকে। নিজের পছন্দ মতো যুবতীর কড়ে আঙুল নিজের কড়ে আঙুলে জড়িয়ে নেয়। যুবতীর পছন্দ হলে মুখ নীচু করে থাকে। আর পছন্দ না হলে, একঝটকায় হাত সরিয়ে নেয়।
জিজ্ঞসা করি, দুটি যুবক যদি একটি মেয়ের কড়ে আঙুল ধরে তাহলে কী হবে?
নরেন জেনা বলেন, এমন যে হয় না, তা নয়। এক্ষেত্রে মেয়ের পছন্দটাই বড়ো।
পরস্পরের আঙুল জড়িয়ে ধরে ওরা নাচে। গান গায়। কিন্তু যৌন সংসর্গের চেষ্টা করে না। হয়তো ইঙারসিন থেকে এই সংযমের শিক্ষা ওরা গ্রহণ করে।
নাচ-গান নিয়েই ওরা মাস কয়েক কাটিয়ে দেয়। বোনদো যুবকেরা তিন-শো পঁয়ষট্টি দিন সেনালি ডিঙ্গোয় যেতে পারে না। আগস্ট মাস থেকে যাওয়া শুরু হয়—পরিণয়ের প্রতিজ্ঞা নিয়ে বেরিয়ে আসে—জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে।
অন্ধকার সেনালি ডিঙ্গো আলোকিত করার জন্য দেয়ালের গায়ে মশাল জ্বলে। অনেক সময় জ্বলন্ত মশালকে সাক্ষী রেখে ওদের প্রণয়ের পালা শুরু হয়। আগুনের সামনে পাশাপাশি দুজন। দুজনেই নীরব। দুজনেই মৌন। ছেলেটি একটি বাঁশের পাতা আগুনে পোড়ায়। সেই দগ্ধ বংশপত্রের দিকে মেয়ে যদি না তাকায়, তাহলে বুঝতে হবে, তার মনের বরফ গলতে শুরু করেছে। যুবকটি তখন তার হাত ধরে, মেয়েটি সরিয়ে নেয় না। হাত একসময় এসে মেয়েটির বুকের ওপর থেমে যায়। আবেশে মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে। যুবকটি তখন একটি ব্রেসলেট অথবা আংটি মেয়েটিকে পরিয়ে দেয়। সেনালি ডিঙ্গোর বন্ধুরা হাততালি দিয়ে তাদের অভিনন্দন জানায়।
নরেন জেনার মুখে বোনদোদের গল্প শুনতে শুনতে কোরাপুটে রাত নেমে আসে। দূরে পাহাড়ের গায়ে অন্ধকার ঘনীভূত হয়। দল বেঁধে জোনাকিরা উড়ে বেড়ায়।
নরেন জেনা বলেন, সেনালি ডিঙ্গোয় যে ভালোবাসার জন্ম হয়—অনেক আচার-আচরণ পালন করার পর পরিণয়ে তার পরিণতি ঘটে। বোনদোদের বিয়েও একটি প্রচন্ড পরীক্ষা। সেকথায় পরে আসছি।
বাগদত্তা হলেই যে বিয়ে হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা বোনদো সমাজে নেই। প্রেমিকের আংটি পরেও মেয়েরা সেনালি ডিঙ্গোয় যেতে পারে। সেখানে গিয়ে যদি তার মনের পরিবর্তন ঘটে— তাহলে, পূর্বপ্রেমিকের আংটি সে ফিরিয়ে দেয়। নতুন প্রেমিকের ব্রেসলেট পরে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। বাগদত্তার ফিরিয়ে দেওয়া আংটিটি অপর কোনো মেয়ের আঙুলে শোভা পায়।
বিবাহিত যুবকেরও সেনালি ডিঙ্গোয় যেতে বাধা নেই। অন্য কারো হাতে আংটি পরিয়ে নিজের পরিণীতাকে পরিত্যাগ করতে পারে। এর জন্য বোনদো স্বামীকে বিশেষ কোনো মূল্য দিতে হয় না। ত্যাজ্য স্ত্রীর বাবা-মাকে একটি শুয়োর আর একজোড়া মুরগি দিলেই বিবাহ বিচ্ছেদ সিদ্ধ হয়।
নরেন জেনা বলেন, তবে তাই বলে, এটাকে বহুল প্রচলিত ভাববেন না। বোনদোরা যদিও একাধিক স্ত্রীর সংসর্গ পেতে পারে—কিন্তু এক স্ত্রীতে আমৃত্যু কাটানোই তাদের প্রধান সামাজিক বিধি। বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা খুবই কম। বিচ্ছেদের দাবি উভয়ের তরফ থেকেই আসতে পারে এবং একবার সেই দাবি উঠলে জোড়াতালি দিয়ে জীবনযাপন করার বান্দা বোনদোরা নয়। ভাঙা আরশিতে তারা মুখ দেখে না।
মুড়িয়াদের ঘটুল আর বোনদোদের সেনালি ডিঙ্গোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। ঘটুলে যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও সেটি বিবাহের প্রতিষ্ঠান নয়। আর সেনালি ডিঙ্গোয় শুধু বিবাহ ছাড়া আর কিছুই হয় না। বরং অরুণাচলের আদিদের রাশেং-এর সঙ্গে সেনালি ডিঙ্গোর কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আচারগত কিছু তফাত থাকলেও—উদ্দেশ্য দুটি প্রতিষ্ঠানেরই এক। নরেন জেনা বলেন, সেনালি ডিঙ্গো থেকে জয়ী হয়ে ফিরলেও বোনদো যুবকের প্রেয়সীর পরশ পেতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগে। প্রায় প্রাত্যহিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই বোনদোদের সেবুং বা বিয়ের সূচনা হয়। দীর্ঘ নয় মাস নানারকম আচার-অনুষ্ঠান চলে। সেইসঙ্গে বর-কনেকেও অনেকরকম পরীক্ষা দিতে হয়। বোনদোদের সেবুং এক দীর্ঘদিন ব্যাপী বিলাসের ব্যাপার।
সেনালি ডিঙ্গোয় ভালোবাসার পর, মেয়ের হাতে হবু স্বামীর দেওয়া চুড়ি ওঠে। অভিভাবকের অনুমতি মেলার পর কনের বাড়ি বরতত্ত্ব যায়। বিয়ের পর প্রথম দু-দিন কনে বরের বাড়ি যায় না এবং রাতে সেনালি ডিঙ্গোয় অন্য মেয়ের পাশে ঘুমোয়।
এরপর কনে পর পর চারদিন থাকে। এবার খাবে—কিন্তু শোবে না। আর এই দিনগুলিতে কনেকে সংসারের নানা পরীক্ষা দিতে হয়। প্রথম দিন তাকে দিয়ে ধান ভানানো হয়। দ্বিতীয় দিন সে যায় মাছ ধরতে। তৃতীয় দিন বন থেকে কাঠ আনতে আর চতুর্থ বা শেষ দিন তাকে তালের পাতা কুড়োতে হয়।
জিজ্ঞাসা করি, এই চারদিনও কি তাকে সেনালি ডিঙ্গোয় রাত কাটাতে হয়?
নরেন জেনা বলেন, হ্যাঁ। বেচারি বর বউকে কাছে পেয়েও কাছে পায় না। সে বাড়িতে থাকবে, ঘুরে বেড়াবে—অথচ স্বামীকে তার সাহচর্য দেওয়া হয় না। কিছুদিন অপেক্ষা করার পর, কনের কাজে সন্তুষ্ট শ্বশুর মেয়েকে ছেলের সঙ্গে কিছু উপহার দিয়ে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এই পথটুকু ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে থাকে। সামান্য হলেও ওই সময়ে তারা রোমান্টিক হয়ে ওঠে। পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে পুলকিত হয়—কিন্তু জৈবিক আবেশের গহ্বরে তলিয়ে যায় না। এখানেও ধর্মীয় অনুশাসন বোনদো যুবক-যুবতীকে সংযমী করে রাখে।
জামাই-আদর শুধু আমাদের সমাজের নয়— বোনদো সমাজেও জামাই-এর খাতিরই আলাদা। শ্বশুরগৃহে পৌঁছোনো মাত্রই স্বয়ং শ্বশুর তাকে আপ্যায়ন করে। শ্যালক তার হস্ত প্রক্ষালন করে। বিনিময়ে জামাই তাকে একটি আংটি উপহার দেয়। জামাইকে উপলক্ষ্য করে, বাড়িতে ভোজের আয়োজন করা হয়। প্রতিবেশীরা শুয়োরের মাংস আর সলফী (সাগু গাছের রস) খেয়ে জামাইকে আশীর্বাদ করে যায়।
পক্ষকাল পর, ছেলের বাবা কনের বাবার ঘরে যায়। তখন আর একদফা ভোজের আয়োজন হয়। বর ও কনের বাবা মুখোমুখি বসে। একহুঁকোয় তামাক খেয়ে শালের পাতা দিয়ে তৈরি বাটিতে সলফীর নেশা করে। বরের বাবা বলে, আমার ছেলে তোমার বাড়িতে অন্ন গ্রহণ করেছে—কিন্তু তোমার মেয়ে আমার বাড়ির অন্ন এখনও খায়নি। দিন কয়েকের মধ্যে সাগুর ‘তংকা’ পাঠিয়ে দেব। আমার বাড়িতে তোমার মেয়ে চিরদিনের জন্য অন্ন পাবে।
কনে ফিরে আসবে শ্বশুরগৃহে। আহার-বিহার সবই চলে—কিন্তু স্বামীর সঙ্গে নিদ্রা যাওয়া চলে না।
বলি, এ যে, দেখছি, বড়ো নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া।
নরেন জেনা বলেন, সব প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। কনের পরীক্ষা শেষ হলে—শুরু হয় বরের পরীক্ষা। বরকেও পরীক্ষা দিতে হয়। ঠিক একইভাবে শ্বশুর বাড়ি, জামাই আদরে খায়—কিন্তু রাতে শুতে হয় ইঙারসিনে।
দিন কয়েক জামাই মাঠে কাজ করে। লাঙল দিয়ে চাষ করে—জাল দিয়ে নদীতে মাছ ধরে। তিরধনুক নিয়ে বনে শিকারে যায়। এ সবই হল বরের পরীক্ষা। এমনি করেই গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত আর শীত কাটে। প্রথম বসন্তে স্বামী-স্ত্রীর মিলন ঘটে। বসন্তের রাত নব দম্পতির কাছে মধুর হয়ে ওঠে।
রাত গভীর হয়। কোরাপুটের পাহাড় নৈ:শব্দে স্থির, অচঞ্চল। নরেন জেনা নিঝুম শহরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এখনও বোনদোদের কথা তাঁর শেষ হয়নি। বলেন, বোনদোদের জীবনের গল্প একরাতে শেষ হয় না। একবার, দু-বার বা বারবার গিয়েও তাদের জীবনের রহস্য জানা যায় না। তাদের জীবনের তালিকায় প্রবাদের প্রভাব বড়ো বেশি। কিংবদন্তির অনুশাসনে তাদের জীবনের চাকা চলে।
বোনদো রমণীরা সরল-সহজ কোষ্ঠী পাথরে খোদিত জীবন্ত মূর্তি। পুরুষেরা অপেক্ষাকৃত অলস। জন্মসূত্রে কর্কশ এবং কিছুটা নিষ্ঠুর। মাঝে মাঝে তারা খুনি হয়ে ওঠে। জেল খাটে। জেলে থেকে ক্ষুব্ধ হয় কিন্তু অনুতপ্ত হয় না।
নরেন জেনা বলেন, বোনদোদের মধ্যে স্তন খেলার প্রচলন আছে।
স্তন খেলা? সেটা আবার কী?
নরেন জেনা বলেন, হ্যাঁ, মেয়েদের স্তন নিয়ে ওরা খেলা করে। আমি অবাক হয়ে বলি, সে কী! এটি আবার কি ধরনের খেলা? আমাদের চোখে তো এটা অসভ্যতা!
নরেন জেনা বলেন, আমাদের সমাজে অসভ্যতা ও দৃষ্টিকটু হলেও এ খেলায় বোনদোদের জৈবিক চাহিদা থাকে না।
বোনদা রমণীর অঙ্গে বস্ত্রের আবরণ নেই। কোমরে একচিলতে কাপড়। আগে থাকত কেরেঙ গাছের ছাল অথবা মরিন্দার বৃহদাকার পাতা দিয়ে তৈরি খাগড়া। ঘন পুঁতির মালা দিয়ে ওরা বক্ষ আবৃত করে। শতেক গোছা নাভি পর্যন্ত লম্বিত পুঁতির মালা ওদের বক্ষে আভরণ ও বক্ষাবরণের কাজ করে। জিজ্ঞাসা করি স্তন নিয়ে কীসের খেলা খেলে?
নরেন জেনা বলেন, বোনদো পুরুষ যেকোনো রমণীর স্তন আলতো করে স্পর্শ করতে পারে। এলোমেলো পুঁতির মালা সুন্দর করে সাজিয়েও দিতে পারে, তাতে ওরা কিছু মনে করে না। এটাও বোনদোদের সংস্কৃতির অঙ্গ। যেহেতু খেলাটি নির্দোষ— সেহেতু রমণীরা আপত্তি করে না। কিন্তু কাঁধে হাত দিলেই গোখরো সাপের মতো ফুঁসিয়ে ওঠে। কোনো বোনদো মেয়ের কাঁধে হাত দেওয়া রীতি বিরুদ্ধ। বিবাহিতা রমণীর কাঁধে হাত দেওয়া অমার্জনীয় অপরাধ। বোনদোরা এই অপরাধীকে খুনও করতে পারে।
নরেন জেনা বলেন, আজ আর নয়। এই মুহূর্তে যদি সব কথা শুনে ফেলেন, বোনদো রাজত্বে গিয়ে কী শুনবেন? বলি, সব শুনে নিজের মনকে প্রস্তুত করা ভালো। নইলে হয়তো উলটোপালটা কিছু ঘটে যেতে পারে।
নরেন জেনা হাসেন। বলেন, সে সম্ভাবনা খুবই কম।
কেন?
নরেন জেনা বলেন, যে বোনদো রমণীর এত কথা শুনলেন, তারা কিন্তু কেউ অপ্সরা নয়। প্রথম দর্শনেই তাদের কুৎসিত মনে হবে।
কেন?
নরেন জেনা বলেন, একটি উলটো পুরাণ বোনদো সমাজে প্রচলিত। তাদের সমাজে ছেলেরা সুন্দর করে টেরি কাটে। নানা ছাঁদে কেশ বিন্যাস করে। আর মেয়েরা?
আমি জিজ্ঞাসা করি, হ্যাঁ বলুন, আর মেয়েরা কী করে? নরেন জেনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। কোরাপুট শহরে রাতের শেষপ্রহর নেমে আসে। কিছুক্ষণ বাদেই ভোরের সূর্যের সোনালি রশ্মি পাহাড়ের গায়ে ঠিকরে পড়বে।
নরেন জেনা ধীরে ধীরে বলেন, মেয়েরা মাথা মুণ্ডন করে—একগাছা লম্বা চুলও তাদের মাথায় থাকে না।
নরেন জেনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, মুন্ডিত মস্তক সুন্দরীদের আমাকে অবশ্যই দেখতে হবে।
নরেন জেনা বলেন, দু-দিন দেখলেই আপনার চোখের দৃষ্টি পালটে যাবে। কুৎসিতের প্রতি শক অচিরেই মন থেকে বিদায় নেবে।
মুখ আর মস্তক বাদ দিলে, ওদের সারাদেহ এক অপরিসীম সুষমায় মন্ডিত। বুক থেকে পা পর্যন্ত এক অনুপম রোমান্টিক সৌন্দর্য বিধৃত। ওদের প্রতিটি অঙ্গে সংগীতের ব্যঞ্জনা। কান পেতে থাকলে বোনদো রমণীর দেহে রোমাঞ্চের সুর শোনা যায়। প্রথম দর্শনের ধাক্কা মন থেকে দূর হয়ে যায়।
নাই বা থাকল চুল। ওরা যখন ফুলের তৈরি হেয়ার ব্যাণ্ড বা কেরেঙের আঁশ দিয়ে বোনানো রঙিন ফিতে মাথায় জড়িয়ে আসবে—আপনাকে তখন মুগ্ধ হতেই হবে।
চুল নেই—ভুরু গভীর নয়। নাক সামান্য চওড়া। ওষ্ঠ স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু মোটা। আর একটু নীচে নামুন— দেখতে পাবেন সুষম চিবুক। আর একটু নামুন—দুটি সুডৌল পুরুষ্টু সামান্য আনত মুগ্ধকর স্তন। তারও নীচে মেদহীন কোমর। আরও নীচে নামুন দেখতে পাবেন মসৃণ, কমনীয় নিতম্ব। দৃষ্টিকে নামিয়ে আনুন আরও একটু নীচে— দেখবেন রমণীয় দুটি ঊরু। মুগ্ধ হয়ে নরেন জেনার কথা শুনছিলাম। প্রায় চেঁচিয়ে বলি উঠি—আর আর কী দেখতে পাব? মৃদু হেসে শান্ত স্বরে, নরেন জেনা বলেন, সেনালি ডিঙ্গোর সেনালীদের।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন