ড্রাগ : নেশার বিষাক্ত জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়

গোপালকৃষ্ণ রায়

ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য ভারতকে বেআইনি নেশাদ্রব্য তথা ড্রাগের বৃহত্তম বন্দর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ড্রাগ মাফিয়ারা দেশের কতগুলি স্পর্শকাতর এলাকাকে নেশার ড্রাগ ও নারকোটিক বা তন্দ্রা উদ্রেককারী উত্তেজক ওষুধ পাচারের কেন্দ্র করে তুলেছে। আমাদের কয়েকটি সীমান্ত রাজ্য এবং সংলগ্ন প্রতিবেশী দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে ড্রাগ ব্যারনেরা তাদের বেআইনি ও অমানবিক ব্যাবসাকে সন্দেহাতীতভাবে রমরমা করে তুলেছে। মানবস্বার্থের পরিপন্থী নারকোটিকের ব্যবসা বর্তমানে এমন একটি স্তরে পৌঁছে গেছে যে, এর দৌরাত্ম্য আর বিষময় ফল আণবিক বোমার চেয়েও ক্ষতিকারক হয়ে উঠেছে। ড্রাগের সর্বনাশা নেশায় আসক্ত করে শুধু ব্যক্তি ও সমাজ নয়, গোটা দেশকে পঙ্গু করে দেবার একটি আন্তর্জাতিক চক্র সর্বাত্মক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

শুধু বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হলে, বিশেষ কোনো চিন্তার কারণ থাকত না। নেশার প্রতি আসক্তির ঘটনা দেশের প্রতিটি প্রান্তে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ড্রাগের সঙ্গে সমাজবিরোধী ছাড়াও সম্পর্ক রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও উগ্রপন্থীদের। নারকোটিক উগ্রপন্থীদের আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের মাধ্যম। ড্রাগের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করে আতঙ্কবাদীরা একদিকে যেমন দেশের স্থিতি ও শান্তি বিঘ্নিত করছে অপরদিকে তেমনি লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে ড্রাগাসক্তে পঙ্গু করে ফেলছে।

গত আশির দশকে ড্রাগের সর্বনাশা প্রভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। দেশের মহানগর ও নগরগুলিতেই নেশার ড্রাগের প্রভাব সীমাবদ্ধ নেই—সীমান্ত রাজ্যগুলির মানুষের জীবন ড্রাগের ছোবলে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।

ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী ভারত গোল্ডেন ট্র্যাঙ্গল বা স্বর্ণ ত্রিভুজ ও সোনালি অর্ধচন্দ্র বা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট দিয়ে পরিব্যাপ্ত। লাওস, বার্মা ও থাইল্যাণ্ডকে বলা হয় স্বর্ণ-ত্রিভুজ আর ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে বলা হয় গোল্ডেন ক্রিসেন্ট বা সোনালি অর্ধচন্দ্র। এর অধিকাংশ দেশের সঙ্গে ভারতের সীমানা রয়েছে চব্বিশ হাজার কিলোমিটার। সীমান্তের বেশির ভাগ অংশই উন্মুক্ত এবং প্রাকৃতিক কারণেই যথাযথভাবে সুরক্ষিত নয়। সীমান্তের ভৌগোলিক অবস্থান ড্রাগ মাফিয়াদের পক্ষে অনুকূল।

স্বর্ণ ত্রিভুজের বড়ো অংশীদার বার্মার সঙ্গে আমাদের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় একহাজার কিমি আর সোনালি অর্ধচন্দ্রাকারের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩,৩০০ কিমি। স্বর্ণ ত্রিভুজ আর সোনালি অর্ধচন্দ্রে উৎপন্ন ড্রাগ তথা নারকোটিক দীর্ঘ সীমান্তের চোরাপথ ধরে প্রতিদিন বেআইনিভাবে ভারতে পাচার হচ্ছে। আর এখান থেকেই কোটি কোটি টাকা মূল্যের নেশাদ্রব্য পশ্চিমি দেশগুলিতে গোপন পথে পাড়ি জমাচ্ছে। একই ধরনের চোরাপথ ধরে আমাদের দেশেও নেশাদ্রব্য ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে ড্রাগ মাফিয়াদের সম্পর্ক গভীর। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণ ত্রিভুজের ড্রাগ মহাজনেরা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লে— সোনালি অর্ধচন্দ্রের ড্রাগ ব্যবসায়ীদের পৃথিবীব্যাপী ব্যবসা রমরমা হয়ে ওঠে। আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদের ব্যাবসা সম্প্রসারণের সুযোগ এনে দেয়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের ফলে সে-দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ আফগানি পাকিস্তান ও ইরানে গিয়ে আশ্রয়গ্রহণ করে। বাস্তুচ্যূত আফগানেরা পাকিস্তানের উত্তরাংশকে ড্রাগ তৈরির আদর্শ স্থান হিসেবে বেছে নেয়। তারা আফিং থেকে অন্যান্য নেশাদ্রব্য তৈরির গোপন কারখানা স্থাপন করে। আর আফিং থেকে তৈরি কোটি কোটি টাকার ড্রাগ পশ্চিমি দেশগুলিতে চোরাপথে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন বৃদ্ধি পায় এবং উগ্রপন্থীরা পাঞ্জাবে তৎপর হয়ে ওঠে। দুটি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। মূলত পশ্চিমিদেশগুলির চাপেই পাকিস্তান ড্রাগ মাফিয়াদের উপর কঠোর নজর রাখতে শুরু করে এবং পশ্চিমি দেশগুলির চাপেই পাকিস্তান দেশের উত্তরাংশে পপি চাষ প্রায় বন্ধ করে দেয়। কিন্তু পাকিস্তানি নজরদারিতে ড্রাগ পাচারকারীরা বিন্দুমাত্র হতোদ্যম হয় না। পাকিস্তান সরকার করাচির সামুদ্রিক বন্দর ও বিমান বন্দরে ড্রাগ-বিরোধী তৎপরতা চালালে—মাফিয়ারা নতুন পথের সন্ধান শুরু করে। তারা ভারত-পাক সীমান্ত রাজ্য রাজস্থানকে ড্রাগ চোরাচালানের বড়োরকমের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। বর্তমানে মুম্বাই ড্রাগ পাচারের বড়ো ঘাঁটি।

১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে অপারেশন ব্লু-স্টারের পর ড্রাগ মাফিয়ারা তাদের গোপন আস্তানা পাঞ্জাব থেকে সরিয়ে রাজস্থানে নিয়ে যায়।

ভারত-নেপাল সীমান্ত দিয়ে প্রধানত নেপালি গাঁজা পাচার হয়। নেপালের ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে গাঁজার চাষ হয়ে থাকে। এই গাঁজা থেকে তৈরি হয় হাশিশ। আর সীমান্ত এলাকার চোরাপথ ধরে সেগুলি চলে আসে ভারতে।

ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের দেশে আফিং-এর চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের পপি উৎপাদন এলাকা থেকে আফিং-এর চাহিদা মেটানো হয়। সরকারি তথ্যে প্রকাশ, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে পপি চাষের জন্য একলক্ষ ছিয়াত্তর হাজার লাইসেন্সধারী চাষি রয়েছেন। পপি থেকে আফিং-এর শুদ্ধিকরণ হয় উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর ও মধ্যপ্রদেশের নিমুচে।

ড্রাগের ব্যাবসা রমরমা করে তুলতে বড়ো বড়ো ড্রাগ ব্যবসায়ীরা বেকার যুবক, মহিলা ও কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের কাজে লাগায়।

পয়সার লোভে শত শত বেকার, সুন্দরী মহিলা ও কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা বর্তমানে ড্রাগ বিক্রির চলমান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী ও মন্দসৌর এবং রাজস্থানের চিতোরে ড্রাগ মাফিয়ারা ড্রাগ পাচারে বেকার যুবকদের ব্যাপকহারে ব্যবহার করে চলেছে। রাজস্থানে মহিলা ও কুষ্ঠরোগীরা এই কাজে নিযুক্ত। রাজস্থানের চিতোর থেকে কলকাতার চিৎপুর পর্যন্ত একই ধারায় তা ছড়িয়ে পড়ছে।

ডায়রেক্টর অব রেভিনিউ ইনটেলিজেন্স সংক্ষেপে ডি আর আই-এর মতে এখন দেশের কোনো বড়ো শহরই ড্রাগের ছোবল থেকে মুক্ত নয়। এর জালে আটকে পড়েছে ধনী-নির্ধন, স্ত্রী-পুরুষ সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে।

কিছুদিন পূর্বে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সি বি আই) আকস্মিকভাবে হানা দিয়ে তীর্থভূমি বারাণসী ও ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ শহরে দুটি গোপন ল্যাবরেটরি আবিষ্কার করেছে। হেরোইন তৈরির জন্য এই ল্যাবরেটরি দুটি আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জামে সজ্জিত ছিল। শিক্ষিত কেমিস্ট ও বিজ্ঞানের ছাত্রেরা ল্যাবরেটরিতে মানুষকে পঙ্গু করার এই ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল।

সি বি আই ও ডি আর আই ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরিরও সন্ধান পেয়েছে। ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরিতে স্ম্যাক তৈরি হত। উত্তর প্রদেশের মিরাট ও হরিয়ানার শোনপাত থেকে ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

ড্রাগ মাফিয়ারা একদিকে যেমন অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে বেকার যুবক-যুবতী ও কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের মাদকদ্রব্য বিক্রির কাজে লাগিয়েছে, অপরদিকে তেমনি শিক্ষিত কেমিস্ট ও বিজ্ঞানের ছাত্রকে ড্রাগ তৈরির কাজে গোপন ল্যাবরেটরিতে নিযুক্ত রেখেছে।

আন্তর্জাতিক নারকোটিক নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বা ইন্টারন্যাশনাল নারকোটিক কমফোর্ট বোর্ড তাদের সাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বীকার করেছে যে, মাফিয়ারা ভারতকে নেশার ড্রাগ সরবরাহের অন্যতম বৃহত্তম বন্দর হিসেবে ব্যবহার করছে। পশ্চিম এশিয়া থেকে ড্রাগ ভারতের মাটি ছুঁয়ে পশ্চিমি দেশগুলিতে পাচার হচ্ছে। আর সেই সুযোগেই একশ্রেণির মাফিয়া দেশের অভ্যন্তরে নেশার ড্রাগের বেআইনি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

ড্রাগ মাফিয়াদের বাড়াবাড়িতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চিন্তিত। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলি ড্রাগের বৃহত্তম শিকার। ড্রাগের দুর্দৈবকে ঠেকাবার জন্য মার্কিন প্রশাসন প্রায় ন-হাজার মিলিয়ন ডলারের এক ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশ আজ পারমাণবিক বোমাকে যত বেশি ভয় না পাচ্ছে, ড্রাগকে ভয় পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এই ড্রাগ তিলে তিলে নতুন প্রজন্মকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।

মানবজাতির এই সমূহ বিপদকে রাষ্ট্রসংঘ বা ইউনাইটেড নেশনস উপেক্ষা করতে পারেনি। রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে দূর প্রাচ্যের দেশগুলির নারকোটিক নিয়ন্ত্রণ বিভাগীয় কর্মকর্তা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির কর্মকর্তাদের সঙ্গে ড্রাগ পাচার বন্ধের জন্য যৌথ আলোচনার ব্যবস্থা হয়েছিল। ভারতীয় প্রতিনিধিরা সেই যৌথ সম্মেলনে ভারতকে ড্রাগ পাচারের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করায় গভীর উদবেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে ড্রাগবিরোধী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছিলেন।

প্রাচীনকাল থেকেই ভারত আফিং রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু পাকিস্তান থেকে অধিকমাত্রায় আফিং ভারতে অনুপ্রবেশের ফলে আফিং-এর যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ভারতীয় প্রতিনিধি ওই যৌথ সম্মেলনে একটি দলিল দাখিল করেছিলেন। সেই দলিল থেকে প্রমাণ হচ্ছে, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে যেখানে ৪৯০ কেজি আফিং ধরা পড়েছিল—ঠিক তার পরের বছর বাজেয়াপ্তের পরিমাণ ছিল ১,৫৪০ কেজি। পরবর্তী বছরগুলিতে প্রায় একই হারে পাকিস্তান থেকে ভারতে আফিং পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যে-পরিমাণ আফিং বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তার দশ থেকে পঁচিশ গুণ আফিং ভারতে পাচার করা হয়েছে। পাকিস্তানি কতৃপক্ষের আশ্বাস সত্ত্বেও বেআইনি আফিং পাচার এখনও সমানভাবে চলেছে।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতে হেরোইন পাচারের মাত্রাও প্রতিদিন বেড়ে যাচ্ছে। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বাজেয়াপ্ত হেরোইনের পরিমাণ ছিল মাত্র দেড় কেজি! ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সেই পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক হাজার কেজি।

ভারতে পপি চাষের কথাও সেই যৌথ সম্মেলনে আলোচিত হয়েছিল। পপি চাষ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ভারতের গৃহীত ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রসংঘের নারকোটিক সম্পর্কিত কমিশন মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতে পপি চাষ নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৬জুন। তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে অপিয়াম অ্যাক্ট কার্যকর করেন। এই অ্যাক্টের মুখবন্ধে বলা হয়েছিল যে, পপি চাষ ও আফিং তৈরির প্রচলিত সরকারি ব্যবস্থাও সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সংগতিহীন। এই অসংগতি দূরীকরণের জন্যই এই আইন কার্যকর করা হয়েছিল। বেআইনি পপি চাষ ও আফিং তৈরি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এই আইন প্রযোজ্য। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে এই অ্যাক্টকে সংশোধন করা হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮খ্রিস্টাব্দে সেই সংশোধিত আইনকে সংবিধানের ৩৭২ ধারা অনুযায়ী রক্ষা করা হচ্ছে।

অপিয়াম অ্যাক্ট ছাড়াও, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার ডেঞ্জারাস ড্রাগ অ্যাক্ট উক্ত খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ থেকে কার্যকর করেছিলেন। এই আইনের মাধ্যমে কতকগুলি সাংঘাতিক ওষুধ বা ডেঞ্জারাস ড্রাগস কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার এবং এগুলির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এই আইনকে কার্যকর করা হয়েছিল। যদিও পপি চাষ ও আফিং উৎপাদন ভারতে বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। তবুও কোনো সময়ে বেআইনিভাবে আফিং পাচারের জন্য কোনো দেশ বা রাষ্ট্রপুঞ্জ ভারতকে দোষারোপ করেনি। অর্থাৎ ভারতীয় আফিং দেশে অথবা বিদেশে কোনোদিন কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেনি।

স্বর্ণ ত্রিভুজ বা গোল্ডেন ট্র্যাঙ্গুলারে আফিং উৎপাদন নিয়ে পশ্চিমি দেশগুলির মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও আমেরিকা ও ব্রিটিশ দু-দেশই মনে করে, পৃথিবীতে উৎপাদিত মোট আফিং-এর ষাট থেকে আশি ভাগ একমাত্র বার্মাতে উৎপন্ন হয়। স্বর্ণ ত্রিভুজে আফিং উৎপাদনে বার্মার স্থান যেমন সর্বোচ্চ তেমনি সোনালি অর্ধচন্দ্রে পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি আফিং উৎপাদন করে থাকে। পাকিস্তানে উৎপাদিত আফিং বেশির ভাগ পশ্চিমি দেশগুলির গোপন বাজারে চলে যায়।

আন্তর্জাতিক নারকোটিক কমিশনের মত অনুযায়ী ব্রিটেনের বাজারে আশি ভাগ আফিং পাকিস্তান থেকে পাচার হয়। গোল্ডেন ক্রিসেন্টে উৎপাদিত আফিং-এর ৫২ভাগ আমেরিকার বাজার দখল করে আছে। গোল্ডেন ট্র্যাঙ্গুলারে উৎপাদিত আফিং-এর বিশ ভাগ এবং বাকি লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে মেক্সিকো থেকে আমেরিকার বাজারে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় আফিং পাচার প্রায় শূন্যের ঘরে। বরং সীমান্ত অতিক্রম করে অধিক মাত্রায় আফিং চোরাপথে ভারতের বাজারে প্রবেশ করায় আফিং-এর অবৈধ কারবার প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

নারকোটিক ও ড্রাগাসক্তদের সংখ্যা যথাযথভাবে কেউ নিরূপণ করেনি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন) ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে একটা আনুমানিক হিসেব বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিল। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, গোটা পৃথিবীতে পঞ্চাশ মিলিয়ন ড্রাগাসক্ত রয়েছে। সহজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে গত পাঁচ বছরে ড্রাগাসক্তদের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তামাম পৃথিবীতে ৩০ মিলিয়ন মানুষ মারিজুয়ানায় আসক্ত। প্রায় আট মিলিয়ন মানুষ কোকেন-এ অভ্যস্ত। সতেরো লক্ষ মানুষ আফিং খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। প্রায় ৭০,০০০ মানুষ হেরোইন-এ আসক্ত। বাকিরা অন্যান্য তন্দ্রাউদ্রেককারী উত্তেজক গ্রহণ করে। আমাদের নারকোটিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এই হিসেব এখন অপ্রচলিত। যে পরিমাণ নেশার ড্রাগ ধরা পড়ছে তা থেকে আন্দাজ করা যায়, বিভিন্ন ড্রাগাসক্তদের সংখ্যা এক-শো মিলিয়ন অতিক্রম করে গেছে। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে পৃথিবীতে ড্রাগাসক্তদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।

ভারতে ড্রাগাসক্তদের নির্দিষ্ট হিসেব নেই। হিসেব করাও সম্ভব নয়। সরকারিভাবে একটা মোটামুটি হিসেব করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য না হলেও, সহজেই বলা যায়, গোটা দেশে ড্রাগাসক্তদের সংখ্যা প্রায় কুড়ি মিলিয়ন। এর মধ্যে বৃহৎ শহরগুলিতে ড্রাগাসক্তদের সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ। দিল্লির স্থান সর্বোচ্চ তারপর মুম্বাই। কলকাতায় ড্রাগের নেশায় আক্রান্তদের সংখ্যা সরকারিভাবে সত্তর হাজার বলা হলেও বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন, মহানগরীতে ড্রাগাসক্তদের সংখ্যা লক্ষ অতিক্রম করে গেছে। একটি নির্ভুল ও সঠিক চিত্র তুলে ধরার বিশেষ কোনো প্রয়াস এখনও নেওয়া হয়নি। তবে ড্রাগাসক্তদের সংখ্যা নিরূপণের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।

রাজ্য হিসেবে মণিপুর ড্রাগের নেশায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যই কম-বেশি ড্রাগের ছোবলে আক্রান্ত। বার্মার সঙ্গে সীমান্ত ঘেঁষা মণিপুর, নাগ্যল্যাণ্ড ও মিজোরামে ড্রাগাসক্তদের সমস্যা রাজ্য সরকারের বড়ো রকমের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছে।

ড্রাগের ক্রমবর্ধমান সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কতগুলি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।

নারকোটিক পাচার রোধের জন্য ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের অপিয়াম অ্যাক্ট ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের এক্সাইজ অ্যাক্ট, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ডেঞ্জারাস ড্রাগ অ্যাক্টস এবং ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের কাস্টম অ্যাক্ট অনুযায়ী এই সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবুও নেশার ড্রাগের অবাধ এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ করা সম্ভব হয়নি। একদিকে চোরাচালান বন্ধের জন্য ব্যবস্থা যত নিশ্ছিদ্র করা হচ্ছে, অপরদিকে চোরাচালানীরা নিত্যনতুন ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমে ভারতে নেশার ড্রাগের আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছে।

আশির দশকের মাঝামাঝি নেশার ড্রাগের দৌরাত্ম্য এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যায় যার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও কঠিন আইন তৈরি করতে হয়। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ আগস্ট লোকসভা নারকোটিক ড্রাগস অ্যাণ্ড সাইকোট্রপিকস সাবস্ট্যানসেস অ্যাক্ট (এন ডি পি এস অ্যাক্ট) পাস করে।

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ড্রাগ অ্যাডিকশন বিষয়ে যে গোপালন কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেই কমিটির সুপারিশেই এই সর্বশেষ আইনটি লোকসভায় পাস হয়। গোপালন কমিটি ড্রাগ অ্যাডিকশন মোকাবিলা করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় আইন এবং ড্রাগ অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন।

১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ১৪ নভেম্বর এই আইন সারাদেশে কার্যকর হয়েছে। এই আইন কার্যকর হবার সঙ্গে সঙ্গে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের অপিয়াম অ্যাক্ট এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ডেঞ্জারাস ড্রাগ অ্যাক্ট বাতিল হয়ে যায়।

এই নতুন আইনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই আইন অনুসারে ড্রাগ পাচারকারীকে দশ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং একলক্ষ টাকা জরিমানার সংস্থান রয়েছে। প্রয়োজনে এবং অপরাধের মাত্রা বিচারে এই সাজা দশ বছর থেকে বাড়িয়ে কুড়ি বছর এবং জরিমানার পরিমাণ দ্বিগুণ করা যাবে। যদি কোনো অপরাধী একই অপরাধ বারবার করে সেক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী পনেরো বছর সশ্রম কারাদন্ডের সংস্থান আছে। এই কারাদন্ড ত্রিশ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যাবে। এসব ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ দেড় লক্ষ থেকে বাড়িয়ে তিন লক্ষ টাকা করার ব্যবস্থা রয়েছে।

গাঁজা ও চরস চাষের ক্ষেত্রে ন্যূনপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। অপরাধের মাত্রা বিচারে কারাদন্ড ও জরিমানা দ্বিগুণ করা যেতে পারে। এই আইন প্রয়োগের ঢালাও ক্ষমতা বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে।

এই আইন বলবৎ হবার পর থেকে চোরাই নেশার ড্রাগ বাজেয়াপ্তর মাত্রা বেড়ে গেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি একক ও যৌথভাবে গোপন স্থানে হানা দিয়ে গাঁজা, হেরোইন, মরফিন, ম্যানড্রেকস এবং কোকেন বাজেয়াপ্ত করেছে। কিন্তু আফিং বাজেয়াপ্তর মাত্রা কমে গেছে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন স্থানে হানা দিয়ে যেখানে বাইশ হাজার কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছিল, নতুন আইন কার্যকর হবার পরেই, সেখানে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে গাঁজা বাজেয়াপ্তর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে সাতচল্লিশ হাজার কেজি। ছ-হাজার কেজি হাশিশের জায়গায় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল ১,৬৫০০ কেজি। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৩৯ কেজি হেরোইন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। নতুন আইনে বলীয়ান হয়ে প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা ২,৭০০ কেজি হেরোইন আটক করেছে। আটক নেশার ড্রাগের পরিমাণ দেখে মনে করা হচ্ছে, আইনের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে ড্রাগ মাফিয়ারা চোরাই চালানের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে।

গতবছরে বাজেয়াপ্ত বিভিন্ন নেশার ড্রাগের মূল্য নিরূপণ করা হয়েছিল কয়েক-শো কোটি টাকা। দিল্লির যমুনা নদীর তীরে বাজেয়াপ্ত হেরোইনের বার কয়েক সৎকার করা হয়েছে। সমস্ত বাজেয়াপ্ত ড্রাগ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কলকাতায় বাজেয়াপ্ত ত্রিশ কোটি টাকা মূল্যের নেশার ড্রাগ কোনো একটি বড়ো ফ্যাক্টরির বয়লারের গনগনে আগুনে ভস্ম করা হয়েছে।

ভারতে গাঁজার চাষ বর্তমান বছর থেকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হবে। পূর্বতন সরকারের এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় মোর্চা সরকার কার্যকর করবেন কি না তা জানা নেই। একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, দেশে গাঁজার চাষের পরিমাণ অবশ্যই হ্রাস পেয়েছে। তবে মেঘালয়ের কয়েকটি অঞ্চলে বেআইনি গাঁজা চাষ চলেছে। সাধারণত নেপাল থেকেই গাঁজা চোরাপথে ভারতে চালান হয়ে থাকে। নেপালে গাঁজার চাষের ওপর নিয়ন্ত্রণ না আনলে ভারতে গাঁজার চাষ নিষিদ্ধ করে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হয়তো বন্ধ করা যাবে, কিন্তু চোরাই চালান অবশ্যই বেড়ে যাবে।

আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে গোপন পথে আসে হাশিশ। এগুলি পাঞ্জাব, রাজস্থান ও কচ্ছ সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। নতুন আইন বলবৎ হবার পর হেরোইন বাজেয়াপ্তর পরিমাণ সরকারি হিসেবমতো কুড়ি গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অভ্যন্তরীণ নজরদারি জোরদার করার পর ড্রাগ মাফিয়ারা চোরাচালানের কৌশল কিছু কিছু পরিবর্তন করেছে। চোরাপথে ড্রাগ চালান অব্যাহত রাখার জন্য সীমান্তের অন্য পথ ব্যবহার করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি ভারত-নেপাল সীমান্ত ড্রাগ মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। তাই হেরোইন ভারতে এই সীমান্ত দিয়েই বর্তমানে পাচার করা হচ্ছে।

ভারতে ম্যানড্রেকস প্রস্তুত ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গোপন ল্যাবরেটরিতে ম্যানড্রেকস তৈরি হচ্ছে কি না এখন পর্যন্ত তার নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে নেশার ড্রাগের বিরুদ্ধে নজরদারি জোরদার করার ফলে কিছু কিছু ম্যানড্রেকস ধরা পড়েছে। আফ্রেকিয়ানদের কাছ থেকে ভারতে ঢোকার মুখে ম্যানড্রেকস ধরা পড়েছে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে কোনো কোকেন বাজেয়াপ্তর নজির নেই। তবে পরবর্তী বছরে বেশ কিছু পরিমাণ কোকেন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। সম্ভবত এখনও গোপন পথে ভারতে কোকেন পাচার অব্যাহত আছে। নেশার ড্রাগের মধ্যে আফিং সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন। পপি থেকে আফিং তৈরি হয়। ভারত ও তুরস্ক কেবল এই দুটি দেশই আন্তর্জাতিক আইনানুসারে আফিং প্রস্তুতকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃত। অন্যান্য দেশে যেভাবে আফিং তৈরি হয়, তাতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। তুরস্ক অবশ্য ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে আফিং উৎপাদন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে স্বীকৃত দেশ হিসেবে একমাত্র ভারতে সরকারের কঠোর নজরদারি ও ব্যবস্থাপনায় আফিং তৈরি হয়। উত্তরপ্রদেশে, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে আফিং তৈরির ব্যবস্থা আছে।

১৮২০ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের গাজীপুরে দেশের প্রথম আফিং তৈরির কারখানা বসানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য কোনো একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আফিং সরবরাহ। বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও আফিং ব্যবহারে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিষিদ্ধও ছিল না। নানা-জাতীয় ওষুধে আফিং নিয়মিত ব্যবহার করা হয়। সেই সময় ওষুধের সঙ্গে আফিং মিশ্রণের কথাও উল্লেখ থাকত না। পৃথিবীতে সালফা ড্রাগের ব্যবহার শুরু হবার আগে পর্যন্ত আফিং যন্ত্রণা নিবারক, ও আমাশয় নিরাময়ের দাওয়াই হিসেবে ব্যবহার হত।

শারীরিক যন্ত্রণা উপশমের কার্যকর ওষুধ হিসেবে মরফিন ব্যবহৃত হত। আফিং থেকে মরফিন তৈরি হয়। একডোজ মরফিনে কুড়ি শতাংশ আফিং থাকে। সাদা স্ফটিক, বড়ি বা ইঞ্জেকশন হিসেবে মরফিন বাজারে বিক্রি হয়। গন্ধহীন এবং স্বাদে তেতো। আফিং থেকে মরফিন সহজেই তৈরি করা যায়।

হেরোইন বর্তমানে বহু উচ্চারিত নাম। কম-বেশি সকলেই এই নামের সঙ্গে পরিচিত। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে মরফিন থেকে হেরোইন সিন্থেসাইজ করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত হলেও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে হেরোইনের ব্যবহার বিশেষ ছিল না। আবিষ্কারের বহু বছর পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন—হেরোইনের মধ্যে আসক্ত করার শক্তি রয়েছে। খাঁটি হেরোইন সাদা রংয়ের গুঁড়ো এবং স্বাদে তেতো। আজ হেরোইনের রূপান্তর ঘটেছে। এর সঙ্গে নেশা বৃদ্ধি ও উত্তেজক কিছু দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই আবিষ্কার বর্তমানে বিংশ শতাব্দীর অভিশাপ। একবিংশ শতাব্দীতে পা রাখার আগেই হেরোইনকে পৃথিবী থেকে নির্বাসন দিতে না পারলে যুবশক্তি পঙ্গু হয়ে যাবে।

বিদেশি নাম মারিজুয়ানা, ভারতে গাঁজা হিসেবে পরিচিত। চরস বা ভাং গাছের পুষ্পিত অংশ থেকে মারিজুয়ানা তৈরি হয়। অনাবৃত ও অবহেলার মধ্যেও প্রচুর পরিমাণে এই গাছ আমাদের দেশে জন্মায়। ক্যানাবিজের সুদৃশ্য পত্র-পল্লব থেকে ভাং তৈরি হয়।

হাশিশ বর্তমানে পরিচিত নাম, ধুনোর মতো দেখতে ক্যানাবিজের রস। এই রসকে শুকিয়ে বিভিন্ন মাপের শিট, বল ও কেক তৈরি করা হয়।

কোকেনের নামের সঙ্গেও অনেকেই পরিচিত। কোকা গাছের মোমের মতো পাতার রস থেকে কোকেন তৈরি হয়। এই গাছ ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশেই পাওয়া যায়। অবশ্য আমাদের দেশে এই গাছ জন্মায় না। কোকেন এক রকম স্বচ্ছ পাউডার। নস্যির মতো নাক দিয়ে টানতে হয়। আমেরিকার বিজ্ঞানীরা সিন্থেসাইজড কোকেন তৈরি করেছেন। প্রাকৃতিক কোকেনের অভাব ঘটলেও আবিষ্কৃত সিন্থেসাইজড কোকেন—ড্রাগ মাফিয়ারা নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছে।

ক্র্যাক নেশার জগতে একটি নতুন সংযোজন। সাধারণ সোডার সঙ্গে কোকেন সিদ্ধ করে ক্র্যাক তৈরি করা হয়। সঙ্গে অ্যামোনিয়া দেওয়ায় ফট ফট শব্দ হয়। শব্দের জন্যেই এই নেশার নাম রাখা হয়েছে ক্র্যাক। মারিজুয়ানা থেকে ক্র্যাকে দশগুণ বেশি নেশা হয়।

যেসব নেশার ড্রাগের ইতিবৃত্ত এই নিবন্ধে আলোচিত হল সেসব নেশার ড্রাগের সন্ধানে মেয়েরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মাদকের মত্ততা গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কি না, এখন পর্যন্ত তার কোনো সরকারি প্রমাণ নেই। তবে শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে দেশের বড়ো বড়ো শহরগুলোতে নেশাখোর বা ড্রাগ অ্যাডিক্ট মহিলার সংখ্যা বর্তমানে উদবেগজনকভাবে বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের হিসেব অনুযায়ী মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ। অর্থাৎ আশি কোটি মানুষের মধ্যে ষোলো কোটি মানুষ কোনো-না-কোনো মাদক দ্রব্যে আসক্ত। মোট ড্রাগাসক্ত মানুষের মধ্যে চোদ্দো ভাগের একভাগ মহিলা।

দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, মাদ্রাজ, হায়দরাবাদ প্রভৃতি শহরে ড্রাগাসক্ত নারীর সংখ্যা বেশি। দেশের বিভিন্ন ডি-অ্যাডিকশন সেন্টারে খোঁজ নিলে নারী ড্রাগাসক্তদের খবর মিলবে।

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রধানত দুটি কারণে মহিলারা ড্রাগাসক্ত হচ্ছেন। প্রথমত ড্রাগাসক্ত স্বামীর ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ড্রাগের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন। দ্বিতীয়ত অর্থ। ড্রাগ মাফিয়ারা শিক্ষিত ও সুদর্শনা মহিলাদের ড্রাগ পাচারের কাজে লাগাচ্ছে। রাজধানী দিল্লিতে এদের সংখ্যা বেশি। কলকাতার জনৈকা সুবেশা সুন্দরী ড্রাগ পাচারকারিণী কিছুদিন আগে ধরা পড়েছিলেন।

ড্রাগ মাফিয়ারা গোপন নেশার ড্রাগের ব্যাবসাকে জোরদার করার জন্য পুলিশকেও প্রলুব্ধ করেছে। এককোটি টাকা মূল্যের হেরোইনসহ সম্প্রতি কলকাতায় এক পুলিশ ধরা পড়েছে। ড্রাগের নেশা যদি পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বিভাগে অনুপ্রবেশ করে, তাহলে গোটা দেশ বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে।

শুধু আইন দিয়ে এই-জাতীয় বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। এর জন্য চাই সম্মিলিত সামাজিক সদিচ্ছা।

সকল অধ্যায়

১. শাম্বরিক খরোলিকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
২. কাব্যে কেশ-ব্যবসায় চুল – গোপালকৃষ্ণ রায়
৩. মুড়িয়া শিল্পকলা – গোপালকৃষ্ণ রায়
৪. পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
৫. ড্রাগ : নেশার বিষাক্ত জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৬. হাজারদুয়ারি থেকে পলাশি – গোপালকৃষ্ণ রায়
৭. কলকাতার মৃত্যু-জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৮. রবীন্দ্রনাথ ও একটি রিয়া – গোপালকৃষ্ণ রায়
৯. পৃথিবীর প্রাচীনতম মৃৎপাত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
১০. পুরীর মন্দিরে দুর্ঘটনা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১১. কোণারকের সূর্যমন্দির – গোপালকৃষ্ণ রায়
১২. কঙ্কাল কাহিনি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৩. জগন্নাথদেবের শেষ দেবদাসী – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৪. মা জুঁইং বুঁইন – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৫. জ্ঞাননৌকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৬. পুরাকথায় অমরনাথ – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৭. কিংবদন্তির দ্বারকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৮. খর্বাকৃতি দম্পতি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৯. ঋষি অরবিন্দ – গোপালকৃষ্ণ রায়
২০. তীর্থক্ষেত্র গঙ্গাবাস – গোপালকৃষ্ণ রায়
২১. কলকাতায় আদিম অতিথি – গোপালকৃষ্ণ রায়
২২. নলরাজার গড় – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৩. সেনালি ডিঙ্গো, কুমারীদের শয্যাধামে – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৪. সুনাবেড়া বৃত্তান্ত – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৫. ত্রিপুরার রাজবংশে সতীপ্রথা – গোপালকৃষ্ণ রায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন