কাব্যে কেশ-ব্যবসায় চুল – গোপালকৃষ্ণ রায়

গোপালকৃষ্ণ রায়

কাব্যে কেশ-ব্যবসায় চুল

মানুষের চুল এখন আর শুধু কাব্যের অলংকরণ নয়, জীবিকার উপকরণও বটে। প্রাচীনকাল থেকেই কবি ও শিল্পীরা চুলের সৌন্দর্যকে নানাভাবে তাঁদের কাব্য ও চিত্রে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে নারীর চুলের প্রশস্তি অকুন্ঠ চিত্তে প্রকাশ করেছেন। নারীর রূপ ও সৌন্দর্যের বর্ণনায় সম্ভবত স্তনের পরেই চুলের স্থান। কেউ কেউ আবার শুধু চুলের বর্ণনা দিয়েই নারীকে মোহময়ী ও মদিরেক্ষণা করে তুলেছেন। কিছু রদবদল হলেও চুলের সৌন্দর্য বর্ণনার প্রাচীন ধারা আজও সমানভাবে চলেছে। ঘন যামিনীর মতো নারীর কেশদাম যেমন কালিদাস থেকে জীবনানন্দের কাব্যের অলংকরণ ও উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে—তেমনই পুরুষের চুলের বাহারি ভাবও কাব্য ও চিত্রকলায় উপেক্ষিত হয়নি। কালীঘাটের পটুয়ারা বাবু-বিবির চুলের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। পুরুষের কোঁকড়ানো চুলের টেরি আর নারীর ঘন কেশগুচ্ছ পটুয়াদের পটে যেমন জীবন্ত—তেমনই কবি ও সাহিত্যিকদের মনের আঙিনায় মানুষের চুলের সৌন্দর্য স্বচ্ছন্দে বিচরণশীল।

তবে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর পিঠময় ছড়ানো কালো কেশদাম অথবা লম্বমান সুশৃঙ্খলিত বেণী ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। পুরুষের মতো চুল ছাঁটা আজকাল মেয়েদের কাছে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংক্রামক ব্যাধির মতো তা ক্রমশ সব শ্রেণির মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।

মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতায় কেশবিন্যাস একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ফ্যাশন শব্দটি না থাকলেও পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও কেশ নিয়ে পরিচর্চার কমতি ছিল না। মেঘের মতো কালো গভীর চুল তখন কুঁচবরন কন্যার সৌন্দর্যের অঙ্গ ছিল। অর্ধ শতাব্দী পূর্বেও দীর্ঘ চুলের প্রতি নারীর সহজাত মমত্ববোধ দেখা যেত। যুগের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নারীর হৃদয় থেকে সেই মমত্ববোধ বিদায় নিচ্ছে। আধুনিকাদের দীর্ঘ চুলের প্রতি অনীহা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। পুরুষের মতো কেশ বিন্যাস করে নারীমুক্তি হচ্ছে কি না জানি না—তবে নারীত্ব ও মাতৃত্বের সৌন্দর্য ব্যাহত হচ্ছে সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

অরণ্যের আদিবাসীই হোক আর বিচরণশীল উপজাতিই হোক—কেশবিন্যাসে তারা নিজেদের রুচি প্রকাশ করে। বিভিন্ন ছাঁদে চুলে পারিপাট্য এনে যৌবনের সৌন্দর্যকে উদ্দাম করে তোলে। আধুনিকাদের মনে সে পিয়াস থাকলেও প্রয়াস নেই।

কেশ যেমন মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে—তেমনই কেশ নিয়ে কুরুক্ষেত্রও হয়। ধর্মপ্রাণ সমাজে নারীর কেশগুচ্ছ দিয়ে গুরুর পদবন্দনা বৈদিক যুগেও ছিল—এ যুগেও আছে। তবে ধ্যানধারণার ওলট-পালটে সংখ্যায় তা কমে এসেছে। শহরের জীবন থেকে গুরুবন্দনা কার্যত বিদায় নিয়েছে। গ্রামগঞ্জের ভক্তিমার্গের কিছু মানুষ এখনও সেই ধারাকে কোনোরকমে টিকিয়ে রেখেছে।

আজকাল শহর এলাকায় কুঁচবরন কন্যার মাথায় আর আগের মতো মেঘবরণ কেশ দেখা যায় না। কোনো মেয়ে এখন আর মেঘের মতো কালো চুলের ভার বইতে চায় না। কবি আর শহুরে মেয়েদের দেখে লিখতে পারেন না ‘শিথিল কবরী বাঁধিও।’ কারণ কবরী বাঁধার মতো চুল তাদের মাথায় থাকে না। মনে মনে তারা কিন্তু চুলের সৌন্দর্যকে অস্বীকার করতে পারে না। সামাজিক অনুষ্ঠানে বেনারসির সঙ্গে নানা ছাঁদে খোঁপা তাদের বাঁধা চাই। নাই বা থাকল নিজস্ব চুল। পরচুলার তো আর অভাব নেই! আজকাল আসল পরচুলার সঙ্গে সিন্থেটিক চুলে বাজার ছেয়ে গেছে। চুলের সঙ্গে এখন চলেছে আসল পরচুলার প্রতিযোগিতা।

কেশ নিয়ে শুধু কাব্য ও সাহিত্যই হয় না—ব্যাবসাও হয়। সিন্থেটিক চুল কেশ-ব্যবসার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। কাব্য-সাহিত্যের কথা বাদ দিয়ে এবার ব্যবসার কথায় আসা যাক।

সব দেশের মানুষের চুল একরকম হয় না। চুলের রঙেরও হেরফের হয়। কোনো দেশের মানুষের চুল সোনালি, কোনো দেশের বাদামি। ভারতীয় চুলের রং মূলত কালো এবং মসৃণ। কুচকুচে কালো আর মসৃণতার জন্যেই ফ্যাশনের জগতে ভারতীয় চুলের কদর বেশি। নমুনার দিক থেকে ইতালীয় চুলের পরেই ভারতীয় চুলের স্থান। তবে ইতালীয় চুল ফ্যাশনের সম্পূর্ণ চাহিদা মেটাতে পারে না। ইতালীয় চুলের মতো চাহিদা না থাকলেও ভারতীয় চুলের কদর আদৌ উপেক্ষণীয় নয়। ভারতীয় চুল পরিমাণে বেশি ও বিভিন্ন সাইজের পাওয়া যায়। সিন্থেটিক চুল বাজারে আসার আগে ভারতীয় চুলের চাহিদা ছিল প্রায় একচেটিয়া। শুধু ভারতীয় চুলের নয়—সব দেশের চুলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে বাজারে হাজির হয়েছে সিন্থেটিক বা কৃত্রিম চুল। ফলে ফ্যাশনের বাজারে ভারতীয় চুলের রমরমা আধিপত্য অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। রপ্তানির মাত্রাও যথেষ্ট কমেছে। একটা সরকারি হিসেব দেখলে বোঝা যাবে, সিন্থেটিক চুল ভারতীয় চুলের কত বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী!

১৯৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় চুলের রপ্তানির পরিমাণ ছিল আশি লক্ষ টাকা। গত আর্থিক বছরে সেই রপ্তানির পরিমাণ কমে এসে দাঁড়ায় মাত্র ত্রিশ লক্ষ টাকা! সিন্থেটিক চুল বাজারে আসার ফলে ভারতীয় চুলের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা কমে যায়।

পরচুলা ব্যবহারকারীদের মতে আসল চুলের তুলনায় সিন্থেটিক চুল বেশি টেকসই। আমেরিকা ও ইউরোপের ফ্যাশনের বাজারে সিন্থেটিক চুল বেশি জনপ্রিয়।

রপ্তানির পরিমাণ কমে এলেও বিদেশি ফ্যাশনের বাজারে এখনও ভারতীয় চুলের কদর আছে। ভারতীয় চুলের মসৃণতা ও চকচকে ভাবের জন্য বিদেশি থিয়েটার ও অপেরা ছাড়াও নিয়মিত পরচুলা ব্যবহারকারী বেশি আকৃষ্ট হয়। আসল চুলের পরচুলা থাকা সত্ত্বেও সিন্থেটিক চুলের প্রতি দেশীয় ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ বেড়ে গেছে। ফলে চুলের ব্যবসায়ীরা দেশে ও বিদেশে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে।

ব্যাবসার কথা থাক। ব্যাবসায় প্রতিযোগিতা থাকবেই। প্রতিযোগিতা না থাকলে দ্রব্যের রকমারিত্ব আসে না। তার চেয়ে চুলের জোগানের কথা বলা যাক। সকলের চুলই প্রয়োজনীয় নয়। সবরকম চুলের ব্যবহার হয় না। ব্যবসায় চুলের মাপ-মাত্রা, শ্রেণি ও গুণ অবশ্যই বিচার্য।

চুলের জোগান প্রধানত দক্ষিণ ভারত থেকেই আসে। ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের রাজত্ব তিরুপতি থেকেই চুলের সর্বাধিক জোগান পাওয়া যায়। বিশেষ আশা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের উদ্দেশ্যে দেব-দেবীর কাছে মানত রাখা ভারতীয় ধর্মীয় মানসিকতার সঙ্গে জড়িত। কোটি কোটি ভক্ত মনোভিলাষ পূরণার্থে ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের কাছে চুল মানত করে চুল উৎসর্গ করে ভগবানের পূজা দেয়। মস্তক মুন্ডনের প্রথা উত্তর ভারতেও প্রচলিত। পূর্ব ভারতেও দেবতার উদ্দেশ্যে চুল মানতের প্রচলন রয়েছে। উত্তর ও পূর্ব ভারতে মস্তক মুন্ডনের প্রথা প্রচলিত থাকলেও বেশিরভাগ মানতকারী চুল নদীগর্ভে সমর্পণ করে।

কিন্তু দক্ষিণ ভারতে নদীতে চুল ভাসিয়ে দেবার রীতি নেই। দেবতার উদ্দেশ্যেই সমর্পিত হয়। ফলে ভগবান ভেঙ্গটেশ্বরকে কেন্দ্র করে তিরুমালা-তিরুপতিতে মানুষের চুলের বিরাট ব্যাবসা গড়ে উঠেছে। এই দুটি তীর্থক্ষেত্র থেকেই চুলের সর্বাধিক জোগান পাওয়া যায়। তিরুমালা মস্তক মুন্ডনের প্রধান কেন্দ্র আর সেখান থেকে পঁচিশ কিমি দূরে তিরুপতিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো চুল নিলামের কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।

সাধারণত চুলের ত্রৈমাসিক নিলাম হয়। তিনমাস ধরে যত চুল তিরুমালায় জমে ওঠে— সেই সব চুল তিরুপতিতে এনে নিলামে তোলা হয়। চুল নিলামের সব অর্থই ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের প্রাপ্য।

প্রতি নিলামে গড়ে প্রায় দশ লক্ষ টাকা ভেঙ্কটেশ্বরের কোষাগারে জমা পড়ে। প্রায় পনেরো হাজার কেজি চুল ত্রৈমাসিক নিলামে বিক্রি হয়। অর্থাৎ বছরে প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকা মূল্যের ষাট হাজার কেজি চুল একমাত্র তিরুপতির নিলামে বিক্রি হয়। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে দু-লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার কেজি চুল নব্বই লক্ষ টাকায় নিলামে বিক্রি হয়েছিল। তিরুপতির চুল নিলামের ক্ষেত্রে এটি একটি রেকর্ড। একটিমাত্র কেন্দ্র থেকে পৃথিবীর আর কোথাও এত পরিমাণ চুল পাওয়া যায় না। মানুষের চুল নিলামের কেন্দ্র, বিশ্বের আর কোথাও আছে কি না জানা নেই। ভগবান ভেঙ্কটেশ্বর দেশের সবচেয়ে ধনী দেবতা। এই দেবভূমিতে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। দেবতার ধনাগার থেকেই সকলের মাইনে দেওয়া হয়।

ভক্তদের মস্তক মুন্ডনের জন্য কয়েক হাজার ক্ষৌরকার তিরুমালাতে কর্মরত। তারা সকলেই ভগবানের এস্টেটের মাইনে করা কর্মী। দিবা-রাত্রি শিফটে ভক্তদের মস্তক মুন্ডনের কাজ চলে। আরও একশ্রেণির কর্মী সেখানে কাজ করে। তারা মুন্ডিত মস্তকের চুলের মাপ ও গুণাগুণ পরীক্ষা করে আলাদা বস্তায় বা বাক্সে ভরে। প্রতিদিন বস্তাবন্দি সেই সব চুল ট্রাকে করে তিরুপতির নিলাম কেন্দ্রে চালান করা হয়। প্রতি মাসে গড়ে বিভিন্ন মাপের পাঁচ হাজার কেজি চুল তিরুমালা থেকে পাওয়া যায়। শ্বেত শুভ্র পক্ব কেশও ফেলে দেওয়া হয় না। পক্ব কেশও ফ্যাশন এবং থিয়েটার সিনেমায় ব্যবহৃত হয়।

মস্তক মুন্ডনের পর অভিজ্ঞ কর্মীরা মাপ ও গুণাগুণ বিচার করে চুলকে তিন ভাগে ভাগ করে। লম্বায় ষোলো ইঞ্চি বা তার চেয়ে বড়ো মাপের চুল প্রথম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এই চুলকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘মুদি’। চুলের গোছা ঠিক রাখার জন্য আগে থেকেই ঝুঁটি বেঁধে ক্ষৌরকার মানতকারীর মস্তক মুন্ডন করে।

আট থেকে ষোলো ইঞ্চি লম্বা চুল দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। আর বাকি সব তৃতীয় শ্রেণির পর্যায়ে পড়ে। পরিমাণে তৃতীয় শ্রেণির চুল বেশি পাওয়া যায়। নিলামিরা এই তৃতীয় শ্রেণির চুলই বেশি পছন্দ করে। এই চুল দিয়ে সহজেই চোখের পাতা, ভুরু, দাড়ি ও গোঁফ তৈরি করা যায়। আর এসব জিনিসের চাহিদাও বাজারে বেশি। প্রথম শ্রেণির চুল সাধারণত বিশ্বের ফ্যাশন বাজারে রপ্তানি করা হয়।

শ্রেণিবিভাগের পর মানত করা চুল তিন-চার দিন রোদে শুকোতে হয়। চুলের জলীয় ভাগ নির্মূল করার জন্যেই এই ব্যবস্থা। এসব কাজ ভগবান ভেঙ্কটশ্বরের মাইনে করা কর্মীরা করে। নাপিত ছাড়াও চুল শুকোনো ও বাক্স ও বস্তাবন্দি করার জন্য আরও কয়েক হাজার মাইনে করা কর্মী কাজ করে। অর্থাৎ তিরুপতিতে চুল এখন শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

প্রথম শ্রেণির চুল কাঠের বাক্সে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির চুল চটের থলিতে ভরতি করে ট্রাকে তিরুপতির নিলাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়। প্রথম শ্রেণির চুল কাঠের বাক্সে কুড়ি কেজির বেশি ভরা হয় না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির চুল দিয়ে ত্রিশ কেজির বস্তা তৈরি করা হয়।

কেশ সংগ্রহ, শ্রেণি বিভাগ ও ওজন করার জন্য ভগবান ভেঙ্কটশ্বরের মার্কেট ডিভিশন আছে, এই মার্কেট ডিভিশন চুল নিলামের বিজ্ঞপ্তি জারি করে। নিলামের একপক্ষ কাল আগে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। স্থানীয় নিলামকারীরা সমবায় ভিত্তিতে চুলের নিলামে অংশগ্রহণ করে। মাদ্রাজভিত্তিক কিছু নিলামকারী বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী চুলের নিলাম ডাকে।

প্রথম শ্রেণির চুল বিদেশে পরচুলা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। রপ্তানি করার আগে সব চুল শ্যাম্পু করা হয়। মার্কেটিং ডিভিশন বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে শ্যাম্পু সরবরাহের জন্য টেণ্ডার আহ্বান করে। মার্কেটিং ডিভিশন প্রতিবছর কয়েক হাজার লিটার শ্যাম্পু ক্রয় করে থাকে।

স্থানীয় নিলামকারীরা সাধারণত দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির চুল ক্রয় করে। এইসব চুল দিয়ে বেণী ও খোঁপা তৈরি হয়। খোঁপা ও বেণীতে লাভের অঙ্ক বেশি। এক কেজি চুল দিয়ে সাধারণত তিনটি বেণী তৈরি করা যায়। বেণীর তারতম্য অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একটি বেণী নব্বই থেকে দু-শো টাকার মধ্যে বিক্রি হয়।

বিদেশের বাজারে সিন্থেটিক ব্যতীতও চিন চুল রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী। পৃথিবীর ফ্যাশনের বাজারে সবচেয়ে বেশি চুল রপ্তানি করে চিন। হংকং-এ চিনা চুল বেশি রপ্তানি হয়। ফ্যাশনের জগতে হংকং একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে সেখানে একটি করে নতুন ফ্যাশনের জন্ম হয়। ভারতীয় চুলের তুলনায় চিনা চুলের দাম হংকং-এ অবশ্য কম।

এবার নিজেদের দেশের দিকে তাকানো যাক। আমাদের শহরগুলিতে বিউটি পার্লারের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। শুধু মহানগরগুলিতেই নয়—শহরতলি ও জেলা শহরগুলিতেও বর্তমানে বিউটি পার্লারের রমরমা ব্যাবসা চলেছে। শুধু বিত্তশালী পরিবারের মেয়েরাই বিউটি পার্লারের খদ্দের নয়—চাকুরে মেয়েরা নিয়মিতভাবে বিউটি পার্লারে যায়। বিউটি পার্লারে যাওয়া সংক্রামক ব্যাধির মতো মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। কলেজ ও উচ্চশ্রেণি বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও বিউটি পার্লারে যেতে শুরু করেছে। শুধু নিজেকে সুন্দরী ও পুরুষকে মুগ্ধ করার জন্যই নয়—যুগের হাওয়ায় তারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। মা ও মেয়ে একই সঙ্গে একই বিউটি পার্লারে গিয়ে সুন্দরী সেজে দুই সখীর মতো বেরিয়ে আসে।

বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের দিন বিউটি পার্লারগুলিতে লাইন পড়ে যায়। ষোলো থেকে ষাট বছরের মাহিলারা বিউটি পার্লারে ভিড় করে। পুরুষের মতো চুল ছেঁটে যারা অফিস-কাছারি করেন, সামাজিক অনুষ্ঠানের দিন তাঁরাই পরচুলার বেণী অথবা খোঁপা বেঁধে রূপবতী হয়ে ওঠেন। নিজের চুল বিসর্জন দিয়ে পরচুলা লাগিয়ে সুন্দরী সাজার এই প্রবণতার রহস্য দেবতারও অজানা।

আমি বা আমার মতো আরও কিছু মানুষ পছন্দ না করলে কী হবে! এরা না গেলে বিউটি পার্লারই বা চলবে কী করে? কলকাতা মহানগরের বিউটি পার্লারের কোনো হিসেব নেই। সারাশহরে কয়েক হাজার বিউটি পার্লার রয়েছে। সেখানে কয়েক হাজার মেয়ের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা হচ্ছে। বিউটি পার্লার এখন স্বনিযুক্তি শিল্পসংস্থা।

বেণী ও খোঁপা ছাড়াও নানাভাবে চুলের ব্যবহার হয়। যাত্রা থিয়েটার ও সিনেমার নায়ক-নায়িকা ও অন্যান্য চরিত্রের মেক-আপের জন্য চুলের ব্যবহার অপরিহার্য। চোখের পাতা-ভুরু, দাড়ি ও গোঁফ এইসব পরের চুল দিয়েই তৈরি হয়। একমাত্র কলকাতায় ফি-বছর কয়েক লক্ষ টাকার পরচুলা, বেণী, খোঁপা, ভুরু ও দাড়ি-গোঁফের কারবার হয়ে থাকে। সিন্থেটিক চুলের ব্যবহারও কলকাতায় শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের চুল সহজলভ্য হওয়ায় সিন্থেটিকের বাজার অতটা তেজি নয়।

আগেই বলেছি, উত্তর ও পূর্ব ভারতে দেবতার উদ্দেশে চুল-দাড়ি উৎসর্গ করার প্রথা প্রচলন থাকলেও চুলের জোগান পাওয়া যায় না। সব চুল নদীগর্ভে বিসর্জন দেওয়া হয়।

তারকেশ্বরে বাবার থানে বহু ভক্তই মস্তক মুন্ডন করে মানত বজায় রাখে। তিরুপতির তুলনায় তারকেশ্বরে চুলের পরিমাণ নিতান্তই নগণ্য। কলকাতার বাবুঘাট ও অন্যান্য ঘাটে প্রতিদিন কয়েক-শো মানুষ মস্তক মুন্ডন করে। মুন্ডিত মস্তকের সব চুলই হুগলি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বৈষ্ণব তীর্থ নবদ্বীপেও মস্তক মুন্ডন নিয়মিত হয়। সেসব চুলও গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। জলে ভাসিয়ে দেবার প্রথা প্রচলিত থাকায়—উত্তর ও পূর্ব ভারতে চুলের ব্যাবসা গড়ে উঠতে পারেনি।

কলকাতার বিউটি পার্লারগুলি দিল্লি ও মুম্বাইয়ের পরচুলা ব্যবসায়ীদের দখলে। চুলের তৈরি সব কিছু এই দুটি শহর থেকে কলকাতায় আমদানি হয়। কলকাতায় পরচুলার কোনো ফ্যাক্টরি আছে কি না জানা নেই। কোনো উদ্যোগী চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

সকল অধ্যায়

১. শাম্বরিক খরোলিকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
২. কাব্যে কেশ-ব্যবসায় চুল – গোপালকৃষ্ণ রায়
৩. মুড়িয়া শিল্পকলা – গোপালকৃষ্ণ রায়
৪. পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
৫. ড্রাগ : নেশার বিষাক্ত জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৬. হাজারদুয়ারি থেকে পলাশি – গোপালকৃষ্ণ রায়
৭. কলকাতার মৃত্যু-জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৮. রবীন্দ্রনাথ ও একটি রিয়া – গোপালকৃষ্ণ রায়
৯. পৃথিবীর প্রাচীনতম মৃৎপাত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
১০. পুরীর মন্দিরে দুর্ঘটনা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১১. কোণারকের সূর্যমন্দির – গোপালকৃষ্ণ রায়
১২. কঙ্কাল কাহিনি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৩. জগন্নাথদেবের শেষ দেবদাসী – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৪. মা জুঁইং বুঁইন – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৫. জ্ঞাননৌকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৬. পুরাকথায় অমরনাথ – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৭. কিংবদন্তির দ্বারকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৮. খর্বাকৃতি দম্পতি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৯. ঋষি অরবিন্দ – গোপালকৃষ্ণ রায়
২০. তীর্থক্ষেত্র গঙ্গাবাস – গোপালকৃষ্ণ রায়
২১. কলকাতায় আদিম অতিথি – গোপালকৃষ্ণ রায়
২২. নলরাজার গড় – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৩. সেনালি ডিঙ্গো, কুমারীদের শয্যাধামে – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৪. সুনাবেড়া বৃত্তান্ত – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৫. ত্রিপুরার রাজবংশে সতীপ্রথা – গোপালকৃষ্ণ রায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন