গোপালকৃষ্ণ রায়
প্রতিবছর আমি পুরী যাই। কেন যাই, তা আমি জানি না। জানার মতো বুদ্ধি আমার নেই। নীলাচলের মাহাত্ম্য ও মহত্ত্ব আমার বোধগম্য হয় না। তবুও বার বার বুদ্ধির অগম্য মহত্ত্বকে অবোধের মতো আঁকড়ে ধরতে যাই। শ্রীক্ষেত্রকে জানার ব্যাকুলতা থাকলেও উপলব্ধি করার ব্যাকরণ আমার অজানা। তাই প্রতিবছর অবোধের মতো ছুটে যাই আবার নির্বোধের মতোই ফিরে আসি। আসা-যাওয়া আর দিনকতক অবস্থানের মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই চাক্ষুষ করতে পারি, কিন্তু পৌরাণিক পুরীর মাহাত্ম্য আর মহত্ত্বকে আত্মস্থ করতে পারি না। আত্মস্থ করতে হলে যে আত্মাকে নির্লোভী করতে হয়, তা আমি করতে পারি না। তাই বহির্দর্শনই আমাকে খুশি থাকতে হয, অন্তর্দর্শন আমার হয় না।
অন্তর্দর্শনের কঠিন মার্গে পরিক্রমা না করে বহির্দর্শনের বেলাভূমিতে বিলম্বিত লয়ে পথ চলাই ভালো।
প্রতিবারই যাবার আগে একটা পরিকল্পনা করি। আমি ডায়েরি রাখি না, একটা নোট বই পকেটে থাকে। পরিকল্পনাটা সেই নোটবুকে লিপিবদ্ধ করি। পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে কী কী করতে হবে, কার কার সঙ্গে দেখা করতে হবে, তাও লিপিবদ্ধ করি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস না করলেও, আমি স্বীকার করছি, পুরীধামে পৌঁছোবার পর, সে-পরিকল্পনার ‘পরি’টা নীল সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, থাকে শুধু কল্পনা। সেই কল্পনাও আমার অজ্ঞাতসারে নানা জটিল কল্পনার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। নানাজনের নানা কথায় মন বিভ্রান্ত হয়ে যায়। যা জানতে চাই, তা অজানাই থেকে যায়।
একটি সাধারণ ব্যাপার। যেকোনো সাংবাদিকের মনে এরকম চিন্তা আসতেই পারে। আমারও এসেছিল।
খবরের পেছনে খবর থাকে। খবর ছাপিয়ে খবর থাকে। সেই খবরের জন্য যেকোনো সাংবাদিক উৎসাহী হয়ে উঠতে পারেন। বছর কয়েক আগে পুরীর মন্দিরের একটি ছোটো খবর দেশের প্রায় সব কাগজেই ছাপা হয়েছিল। কোনো গুরুত্ব না দিয়েই খবরটি ছাপা হয়েছিল। জগন্নাথ মন্দির সংস্কারের সময়, মন্দিরের ভেতরের দেয়ালের অভ্যন্তর থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছিল।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যের অন্তর্ধান নিয়ে, প্রায় পাঁচ-শো বছর ধরে একটি বিতর্ক চলছে। অনেক বিদগ্ধ পন্ডিত, শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটনের জন্য অনেকরকম চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত এখনও সমানভাবে চলেছে। শ্রীচৈতন্য জগন্নাথের মধ্যে লীন হয়ে গেছেন, অথবা ভাবাবেশে সমুদ্রে ডুবে গেছেন—কিংবা চৈতন্যবিরোধী গোষ্ঠী তাঁকে মন্দিরের মধ্যেই খুন করেছিলেন, গত পাঁচ-শো বছর ধরে, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলেছে। অনেকেই তাঁদের নিজস্ব মত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন, কার্যত তা গ্রাহ্য হয়নি। আপামর জনসাধারণ মেনেও নেয়নি। তাই চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য—রহস্যই থেকে গেছে।
প্রকাশিত খবরটি আমার মনে বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার একটি স্পর্ধা জাগিয়েছিল। অন্য বারের মতো এবারও একটি পরিকল্পনা করেছিলাম। প্রস্তুতি পর্বেই পরিকল্পনাটি একটি বড়োরকমের ধাক্কা খেল। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, অঙ্কুরেই সে বিনাশ হয়ে গেল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে কতৃক উদ্ধার করা কঙ্কালটি মানববিজ্ঞান সর্বেক্ষণের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা ও কার্বন ডেটিং ইত্যাদি করা।
মানববিজ্ঞান সর্বেক্ষণ, কঙ্কালটি নিয়ে একটি বাক্য খরচ করতেও রাজি হল না। অথচ তিন হাজার বছর পূর্বের পান্ডরাজার ঢিবি থেকে উদ্ধার করা কঙ্কাল নিয়ে, মানববিজ্ঞানীরা কত কথাই না বলেছিলেন। পুরীর মন্দির থেকে উদ্ধারীকৃত কঙ্কালটি নিয়ে, তাঁরা মুখ তো খোলেননি নয়, তাঁরা অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করলেন।
হতোদ্যম না হয়ে, নির্ধারিত দিনে শ্রীক্ষেত্রে পৌঁছে গেলাম। রিকশাচালক নিত্যানন্দ স্টেশনে ছিল। পঞ্চানন সাহা তাঁর কাকাতুয়া লজে আমার জন্য ঘরও রেখেছিলেন।
মানববিজ্ঞানীদের ব্যবহারে বুঝেছিলাম, উদ্ধারীকৃত কঙ্কালটি নিয়ে পুরীধামে যত্রতত্র যার-তার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত হবে না। অনুসন্ধানের সূত্রপাত কীভাবে করব, তাও ভেবে পাচ্ছিলাম না।
স্বর্গদ্বার থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে চক্রতীর্থ রোডের দিকে যাচ্ছি। শীতের অপরাহ্ণ। বালানন্দ আশ্রমের পাশেই রাস্তার ধারে একটি চায়ের দোকান। বেঞ্চের ওপর একজন সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক বসে আছেন। আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন তিনি। চোখে চোখ পড়তেই চোখের ঈশারায় ডাকলেন। তাঁর পাশেই বসলাম। বসার পর, আমাকে উনি আর গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না।
চা চাইলাম।
ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, কোথা থেকে? কলকাতা?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে, সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। আমার চা খাওয়া শেষ হবার আগেই উনি চোখে চোখ রেখে বললেন, এসব করতে যাবেন না। বিপদে পড়বেন।
কী করব না?
মন্দিরের কঙ্কাল নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করবেন না।
বলেই পাশের গলি দিয়ে হন হন করে চলে গেলেন। ভদ্রলোকের নাম জানি না, ধাম জানি না। কেন যে তিনি অযাচিতভাবে এই উপদেশ দিয়ে গেলেন, তা আজও আমি বুঝে উঠতে পারিনি। শুনেছি, অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা অপরের মনের কথা পড়তে পারেন। সম্ভবত উনি, তাঁদেরই একজন।
কঙ্কাল নিয়ে প্রথম ধাক্কা খেয়েছিলাম মানববিজ্ঞান সর্বেক্ষণের কাছে। আর এই অচেনা, অজানা ভদ্রলোক, আমাকে মোক্ষম ধাক্কা দিয়ে গেলেন। উৎসাহটা আমার অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেল। অস্বীকার করে লাভ নেই, ভদ্রলোকের সাবধানবাণী আমাকে অনেকটাই হতোদ্যম করেছিল। শুনেছি জগন্নাথধামে অনেক দৈবশক্তিধর মানুষ আসেন, যান। কেউ তাদের সত্য পরিচয় জানতে পারে না। অচেনা ভদ্রলোক কি তাঁদেরই একজন? কে জানে? সামনে সফেন সমুদ্র। বেলাভূমিতে বসে অনন্ত জলরাশির উন্মত্ত খেলা দেখছিলাম। সমুদ্রের মত্ততার বিরাম নেই। ছন্দবদ্ধ তরঙ্গলহরী একই সময়ে একই ভঙ্গিতে তট রেখায় আছড়ে পড়ছে।
পুরীতে গেলেই আমি একজনের সঙ্গে দেখা করি। তাঁর নাম প্রমীলা ঘোষ। পুরীর স্বর্গদ্বারে অবস্থিত প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন বসন্তকুমারী বিধবাশ্রম-এর শেষ আবাসিক প্রমীলা ঘোষ। বাইশ বছর বয়েসে বিধবা হয়ে, এই আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পঞ্চাশ বছর ধরে এই আশ্রমে রয়েছেন।
হ্যাঁ, এই বিধবা আশ্রম নিয়েই আমার কিছু বক্তব্য আছে। সে-কথায় পরে আসছি।
আশ্রমের শেষ বিধবা অসুস্থ প্রমীলা ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে যাই। পুরীর অনেক মান্যগণ্য বাঙালিকে চেনেন। অনেক সম্মানীয় ওড়িশাবাসীর সঙ্গেও তাঁর পরিচয় আছে। কঙ্কালের বিষয়টি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।
বিধবা আশ্রমের ইতিহাস দীর্ঘ। এই স্বল্পপরিসরে সেই দীর্ঘ ইতিহাস লেখা যায় না। বিধবা আশ্রমটি স্থাপন করেছিলেন স্যার প্রতুলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সহধর্মিণী লেডি বসন্তকুমারী চট্টোপাধ্যায়। সে তো সেই ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের কথা। বছর কয়েক এই আশ্রমটির অবস্থান ছিল কলকাতায়। তারপর পুরীর স্বর্গদ্বারে নির্জন, নিরালা সমুদ্র বেলাভূমির কাছে পাঁচ বিঘা জমির ওপর বিধবা আশ্রম গড়ে ওঠে। সেও তো প্রায় অনেক বছর আগে। এই আশ্রম গড়ে তোলার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আশ্রমের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সরোজনলিনী দত্ত স্মৃতি সমিতি। সেই সময় স্মৃতি সমিতির নারী সম্পাদিকা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ হেমলতা ঠাকুর। হেমলতা ঠাকুর নিজেও দীর্ঘদিন ওই আশ্রমে থেকেছেন। বিধবাশ্রম পরিদর্শন করেছেন দেশ-বিদেশের অনেক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। কয়েকজনের নাম অবশ্যই উল্লেখ করা যেতে পারে।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আশ্রমটি পরিদর্শন করেন স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারি, ড. রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে এই আশ্রমে এসেছিলেন সুখলতা রাও, মহারাজা শ্রীশ চন্দ্র নন্দী। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে এই আশ্রমে পদার্পণ করেছিলেন কস্তুরবা গান্ধি, সরোজিনী নাইডু। ১৯৩৯খ্রিস্টাব্দে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আশ্রমটির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করেছিলেন আরও অনেক বিদগ্ধ বিদ্বজ্জন। কার্যত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিধবাশ্রমটি বর্তমানে ভগ্নদশায় পরিণত। প্রমীলা ঘোষ ব্যতীত আর দ্বিতীয় কোনো বিধবা সেখানে নেই। অনেক জায়গায় বাউণ্ডারি ওয়াল নেই। অরক্ষিত জমি দখলের অবাঞ্ছিত চেষ্টাও সেখানে হচ্ছে।
সরোজনলিনী স্মৃতিসমিতির কর্মকর্ত্রীদের সঙ্গে, দু-বার দেখা করে, আশ্রমটি নিয়ে উপযাজক হয়ে আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু আশ্রম কতৃপক্ষ সংস্কার বা অন্য কোনো সেবাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে আদৌ আন্তরিক নন, দু-বারের আলোচনায় তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
পুরীতে কানাঘুষায় শুনেছি, পুরীর একটি বিশিষ্ট হোটেল ব্যবসায়ীর লোভী দৃষ্টি আশ্রমের জমির ওপর পড়েছে। আশ্রমের কর্মকর্ত্রীদের ও ঔদাসীন্যেই বহু মনিষীর স্মৃতি বিজড়িত আশ্রমটির জমিতে একদিন হোটেল ব্যবসায়ীর ‘স্বার্থসৌধ’ নির্মিত হলে অবাক হব না। তার জন্য অবশ্যই দায়ী থাকবেন সরোজনলিনী দত্ত স্মৃতিসমিতির বর্তমান পরিচালন সমিতি।
প্রমীলা ঘোষও পুরীর মন্দির থেকে উদ্ধার করা কঙ্কালের কথা শুনেছেন। সেই অচেনা ভদ্রলোকের সতর্ক বাণীর কথা বলতেই প্রমীলা ঘোষ বললেন, কঙ্কাল নিয়ে তুমি আর মাথা ঘামাবে না। কেউ যদি জানতে পারে, কঙ্কাল সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে এসেছ, তাহলে, তুমি আর কলকাতায় ফিরে যেতে পারবে না। আর কোনো কথা নয়, কঙ্কালের কথা এই মুহূর্তে ভুলে যাও। ৬৪ বছর আগে নেতাজির মৃত্যু রহস্য যেখানে উদঘাটিত হল না, সেখানে পাঁচ-শো বছর পূর্বে শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনের আর কী প্রয়োজন আছে?
কঙ্কালের ভাবনাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভালো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য দারুব্রহ্ম জগন্নাথের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন, এই বিশ্বাস নিয়ে থাকাই ভালো।
জগন্নাথধাম পুরীতে তো অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। আগেও ঘটেছে, এখনও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। কারণ শ্রীক্ষেত্রের মাহাত্ম্য আর মহত্ত্ব সাদা চোখে দেখা যায় না। মন দিয়ে দেখতে হয়।
সাধু-সন্ত-মহাপুরুষ-মোহন্ত যুগে যুগে এসেছেন, থেকেছেন, সাধন-ভজন ও পূজনের মাধ্যমে পুরীর মহত্ত্বকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলেছেন।
পুরীতে কবির এসেছিলেন, নানক এসেছিলেন, শ্রীচৈতন্য আঠারো বছর অবস্থান করেছিলেন।
কুন্টাই বেল্ট শাহীর আন্দুলা মঠে কিছুদিন অবস্থান করে, সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন হালিশাহীতে রাজপুরোহিত কাশীনাথ মিশ্রের বাড়ি। শ্রীগম্ভীরায় অবস্থান করেছিলেন আঠারো বছর। মিশ্র বাড়ির একটি প্রকোষ্ঠের নাম শ্রীগম্ভীরা। শ্রীগম্ভীরাতেই তো রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত খড়ম, কাঁথা, কমন্ডলু এবং আরও কিছু। বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্য পাদুকা দুটি রেখে নগ্ন পায়ে নবদ্বীপ থেকে পুরী এসেছিলেন চৈতন্যদেব। বিরহিনী বিষ্ণুপ্রিয়া স্বামীর নগ্নপদে পথ চলা কষ্ট হবে ভেবে, এক জোড়া খড়ম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রীগম্ভীরায় সেই খড়ম এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে। মা শচীদেবী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন একটি কাঁথা। শ্রীগম্ভীরায় সেই কাঁথা স্পর্শ করে আজও ধন্য হওয়া যায়।
শ্রীগম্ভীরার কাছে সিদ্ধ বকুল। এখানেই থাকতেন, ভক্ত হরিদাস। গম্ভীরা থেকে সপার্ষদ এখানে আসতেন মহাপ্রভু।
ভক্ত যবন হরিদাসের মৃতদেহ সকলের সঙ্গে মহাপ্রভুও বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন সমুদ্রের ধারে। নিজেই নির্দিষ্ট করেছিলেন সমাধি স্থল। কবর খোঁড়ার কাজে নিজেও হাত লাগিয়েছিলেন তিনি। হরিদাস মন্দিরে আজও দিবারাত্র কৃষ্ণনাম হয়।
৭৫৭টি মঠ ও মন্দির ছাড়াও রয়েছে, বহু সাধকের আসন। দিন মাস বছর লেগে যাবে, মঠ-মন্দির আর আসনের ইতিহাস জানতে। এক জীবনে পুরীর গভীরে যাওয়া যায় না। আর প্রারব্ধ না থাকলে, শ্রীক্ষেত্রের অন্তরের ধ্বনিও শোনা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বালাসোরের নিত্যানন্দ শ্রীক্ষেত্রের রিকশাচালক। শান্ত, ভদ্র, মার্জিত নিত্যানন্দই আমাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়।
সে-ই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল গির্ণারীবন্তায়। পুরীতে কতবার গেছি, কেউ আমাকে গির্ণারীবন্তার কথা বলেনি। স্বর্গদ্বার থেকে মাত্র দশ কিমি গির্ণারীবন্তা। এই গির্ণারীবন্তায় প্রায় চল্লিশ বছর অবস্থান করেছেন শ্রী দিগম্বর পরমহংসদেব—বা নাঙ্গাবাবা। বালি পাহাড়ের ওপর তাঁর সমাধি মন্দির। গির্ণারীবন্তা বড়োই শান্ত নির্জন। ৫০ বছর আগে ছিল গভীর জঙ্গল। এই নাঙ্গাবাবাই শিবতুল্য সাধক তোতাপুরী, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বেদান্ত দীক্ষাগুরু। আশ্রমের পরিবেশে মনের মালিন্য দূর হয়ে যায়। মহাপুরুষ দিগম্বর বাবার অশরীরী আত্মার সান্নিধ্য অনুভূত হয়। পাশেই লোকনাথ শিবের মন্দির। মন্দিরের প্রাচীনত্ব নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও, তার মাহাত্ম্য নিয়ে কারো মনে কোনো সংশয় নেই। নিত্যানন্দকে ধন্যবাদ—তার জন্যই আমার গির্ণারীবন্তা দর্শন হল।
নিত্যানন্দই আমাকে পৌঁছে দিল স্টেশনে। সেখানে যে একটি বিস্ময় অপেক্ষা করছে তা আমার জানা ছিল না।
স্টেশনে ঢোকার মুখে সেই অচেনা সৌম্যদর্শন মানুষটির সঙ্গে দেখা। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই হাসি মুখে বললেন, এখানে এসে কোনোদিন কঙ্কালের খোঁজ করবেন না। জেনে রাখুন।
‘‘অদ্যাপিও সেই লীলা করে গৌর রায়,
কোনও কোনও ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।।’’
এবার আসুন। ভালো থাকবেন।
এই মুহূর্তে মনে হল, মানুষটি আমার খুব পরিচিত। পরিচিত মানুষটি একমুখ হাসি নিয়ে জনারণ্যে মিলিয়ে গেলেন। যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মিলিয়ে গিয়েছিলেন দারুব্রহ্ম জগদীশ্বর জগন্নাথের মধ্যে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন