গোপালকৃষ্ণ রায়
একদল আদিম আন্দামানি কলকাতায় বেড়াতে এসেছিল। আদিম অরণ্যচারী অতিথিরা কলকাতায় পদার্পণ করেছিল ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৬৫খ্রিস্টাব্দে। সাতজনের একটি দল ১৪৮বছর আগের কলকাতায়, সম্মানীয় অতিথি হিসেবে পক্ষাধিক কাল অবস্থান করেছিল। হাওড়া ও ব্যারাকপুরেও তারা দিন কয়েক কাটিয়েছিল।
১৪৮বছর আগের কলকাতার চেহারাটা অন্যরকম ছিল। তখনও কলকাতায় বিদ্যুৎ আসেনি। রাস্তায় জ্বলত গ্যাসের আলো। ঘোড়ায় টানা ট্রামও চলত না। টগবগ শব্দ তুলে, বাবু-বিবিরা ফিটন গাড়িতে চলা ফেরা করতেন। দক্ষিণ কলকাতা তখনও গড়ে ওঠেনি। জলা আর জঙ্গলের মধ্যে সন্ধ্যার পর শেয়াল ডাকত। চৌরঙ্গী-পার্ক স্ট্রিট এলাকা সাহেব-মেমদের দখলে। ‘নেটিভরা’ ওই সব অঞ্চলে ভয়ে ভয়ে যেত। উত্তর কলকাতায় তখন অবশ্য বাবুদের রমরমা।
আন্দামানি অতিথিরা যখন কলকাতায় এসেছিল, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়েস চার বছর, বিবেকানন্দ সবে জন্মেছেন। তাদের পদার্পণের বছর আটেক আগেই সিপাহিবিদ্রোহ ঘটেছিল। কলকাতায় জাগরণের হাওয়া সবে উঠতে শুরু করেছে।
জাগরণের উন্মেষের যুগে আন্দামানের হারবার মাস্টার ও পোর্টব্লেয়ারের সুপারিনটেনডেন্টের সহকারি জে এন হমফ্রে সাতজনের একটি আদিম মানুষের দল নিয়ে কলকাতা বন্দরে পৌঁছেছিলেন। তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৬৫।
বর্তমানে যে জাঁকজমক সহকারে ভি আই পি-দের সংবর্ধনা জানানো হয়, সেরকম হয়তো কিছু করা হয়নি। কিন্তু তদানীন্তন ইংরেজ শাসক ও শিক্ষাবিদেরা আদিম অর্ধ উলঙ্গ আন্দামানের অতিথিদের ভি আই পি-দের মতোই আদরযত্ন করেছিলেন। অরণ্যের অভ্যস্ত জীবন, নাগরিক সভ্যতায় যাতে কষ্টদায়ক হয়ে না ওঠে, তারজন্য সম্ভাব্য সবরকম ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিলেন। তাদের নগ্ন দেহে সভ্যতার আবরণ দেবার কোনো চেষ্টা হয়নি কিন্তু লজ্জা নিবারণের জন্য একপ্রস্থ পরিচ্ছদ দেওয়া হয়েছিল মাত্র। বরং ‘অবাক জগৎ’ সম্পর্কে তাদের কৌতূহল মেটাবার সব চেষ্টাই করা হয়েছিল।
হারবার মাস্টার জে এন হমফ্রে ছিলেন আদিম দলটির ‘অভিভাবক’। অরণ্যবাসী মানুষগুলি তাঁকে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করত। অরণ্যের ছায়াদুর্গ থেকে প্রাসাদনগরীতে এসে হমফ্রেকে তারা ঘিরে থাকত। হমফ্রে তাদের যেভাবে নির্দেশ দিতেন আদিম মানুষগুলি, পরমনিশ্চিন্ততায় তা পালন করত। খাদ্যদ্রব্য থেকে জামাকাপড় সবই তাদের কাছে অপরিচিত। তাই কোনো জিনিস গ্রহণ করার আগে, তারা হমফ্রের কাছ থেকে যাচাই করে নিত। হমফ্রের অনুপস্থিতিতে খাবারও তারা খেত না, তেমনি কেউ কিছু দিলে তাও গ্রহণ করত না।
হমফ্রে তাদের ভাষা না বুঝলেও তাদের মনোভাব বুঝতে পারতেন। আকারে-ইঙ্গিতে তাদের কথা হত, ভাব বিনিময় হত।
কলকাতায় তাদের কেন আনা হয়েছিল, তার কোনো স্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে এশিয়াটিক সোসাইটির মাসিক সভার কার্যবিবরণী থেকে মনে হয়, নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষার জন্যেই, আদিম আন্দামানিদের কলকাতায় আনা হয়েছিল।
১৮৬৫খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের কার্যবিবরণীতে আদিম দলটির কলকাতায় আগমন, অবস্থান ও আচার-আচরণের, বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে। মানবজাতি তত্ত্ব বিষয়ক বৈশিষ্ট্যগুলি এশিয়াটিক সোসাইটি রেকর্ড করার সুযোগ পেয়েছিল। সম্ভবত এই কারণেই হমফ্রের নেতৃত্বে আদিম দলটিকে কলকাতায় আনা হয়েছিল।
এশিয়াটিক সোসাইটির তদানীন্তন সভাপতি এ গ্রোট আদিম দলটির প্রায় প্রতিদিনের আচার-আচরণ, হাব-ভাব-ভঙ্গি, হর্ষ-বিষাদ-বিস্ময় ও শারীরিক বর্ণনা দিয়ে, একটি দীর্ঘ নোট কার্যবিবরণীর সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছিলেন। আদিম দলটির কলকাতায় অবস্থানের দুটি ছবি কলকাতার তদানীন্তন ফোটোগ্রাফিক কোম্পানি ওয়েস্ট ফিল্ড ডা. বয়েস স্মিথের মাধ্যমে এশিয়াটিক সোসাইটিকে দিয়েছিল।
১৮৬৫খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে সোসাইটির মাসিক সাধারণ সভায় অনেক বিষয়ে আলোচনা হলেও, আদিম আন্দামানিদের নিয়ে সোসাইটির সভাপতি মি. গ্রোট একটি দীর্ঘ বিবরণ লিখেছিলেন।
সোসাইটির মিউজিয়ামের জন্য সেই সময় প্রতি সভায়, কেউ না কেউ কিছু উপহার দিতেন। বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত নানা সামগ্রীতে মিউজিয়াম বড়ো হয়ে উঠেছিল। বাঙালিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। ইংরেজ রাজপুরুষদের সঙ্গে তাঁরাও অনেক কিছু দান করেছিলেন। নভেম্বরের সাধারণ সভায় ক্যাপ্টেন এ বি মেলভিলে দুটি বুদ্ধ মন্দির ও কাশ্মীর ও লাডাকের প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষের ছবি দিয়েছিলেন, তেমনি বাবু গৌরদাস বসাক বাগেরহাট অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত একটি গ্রিক শৈলীর মূর্তি দিয়েছিলেন। মিউজিয়াম গড়ে তোলার সেইসব মানসিকতা এখন হারিয়ে যাচ্ছে।
আমরা আবার আদিম অতিথিদের কথায় ফিরে আসি। আগেই বলেছি সাত সদস্যের আদিম দলটিকে নিয়ে হারবার মাস্টার জে এন হমফ্রে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর কলকাতায় পৌঁছেছিলেন।
দলটির সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই ছিল মহিলা। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ও ১১বছরের একটি বালক। পুরুষটির বয়েস ত্রিশ এবং খুব সপ্রতিভ। নিজেকে ছটফটে ও সক্রিয় রাখার চেষ্টা করা সত্ত্বেও মাঝেমাঝে কমজোরি হয়ে পড়ত। তার চোখেও একটি অসুখ ছিল। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘আরকাস সেনেলিস।’
এগারো বছরের বালকটি ছিল দলের সবচেয়ে ক্রিয়াশীল মধ্যমণি। সে ছিল অত্যন্ত হাসিখুশি ও বুদ্ধিমান। হঠাৎ হঠাৎ কিছু একটি করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল, তার খেলা।
আদিম হলেও তাদের মধ্যে নাম ও গোত্রের প্রচলন ছিল। পুরুষটির নাম ছিল এরোলা। তার স্ত্রীর নাম ছাপ্পা দারোলা। সে তিনটি সন্তানের মা। বালকটির নাম কালুলা। অবশ্য সবাই তাকে ‘সিদি সাহিব’ বলে ডাকত।
ওই দলে ছিল চারজন অবিবাহিতা মেয়ে। তাদের মধ্যে দুজনের একই নাম—পুঙ্গলা। তৃতীয় ও চতুর্থ মেয়ের নাম রেকরোলা ও লোকাতোলা। অবশ্য ইংরেজ রাজপুরুষেরা ওই চারজনকে চারটি ইংরেজি নাম দিয়েছিলেন। সারাহ, স্যানী, লুইসা ও পুগনোস।
গ্রোট সাহেব আদিম দলটির প্রতিমুহূর্তের হাবভাব, আচার-আচরণ, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া অনুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের মন ছিল পাপ প্রবণতা থেকে মুক্ত। অজ্ঞাতসারে কোনো অন্যায় করে ফেললে, লজ্জায় অধোমুখ হত।
ধূমপানে তারা খুব খুশি হয়ে উঠত। সাহেবরা তাদের চুরুট দিতেন। চুরুট হাতে পেলেই তারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠত। একটি চুরুট শেষ হলেই, সেই চুরুটের আগুন দিয়ে আর একটি চুরুট ধরাত। প্রায় সারাক্ষণই তারা চুরুট টানত, আর সবসময়েই থুতু ফেলত।
গ্রোট সাহেবের বিবরণী থেকে আরও জানা যায়, আদিম দলটি মাঝে মাঝেই মেঝেতে শুয়ে পড়ত। বিশেষ করে মধ্যাহ্নিক নিদ্রা তারা উপভোগ করত। একটি সহজাত ‘গ্রহণশক্তি’ গ্রোট সাহেব তাদের মধ্যে লক্ষ করেছেন। যদিও তারা সভ্যতার সীমানায় বেশিদিন ছিল না, তবুও সভ্য মানুষের আচার ব্যবহার, ওঠা-বসা সুন্দরভাবে অনুকরণ করতে পারত। ইজিচেয়ার ও সোফায় কীভাবে বসতে হয়, কয়েকদিনের মধ্যে তারা তা বেশ রপ্ত করে নিয়েছিল।
আদিম দলটিকে ইউরোপিয়ান পার্টিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আদিম অতিথিরা সেখানে কোনো বন্য আচরণ করেনি। ঝলমলে পোশাকে সজ্জিত ইউরোপীয় পুরুষ ও মহিলাদের পাশে প্রায় নগ্ন মিশমিশে কালো আদিম অতিথিরা আদৌ কুন্ঠাবোধ করেনি। সাহেবরা যেভাবে চেয়ারে বসত, তারাও সেইভাবেই বসত। চুরুট টানত; বার বার থুতু ফেলাই ছিল একমাত্র দোষ। অবশ্য তাদের এই বদভ্যাস সাহেব-সুবোরা মেনে নিয়েছিলেন। সুখের বিষয় আদিম নারীর নগ্নদেহের লাবণ্যকেও কেউ কখনো অপমান করেনি।
আদিম অতিথিরা একা কখনো রাস্তায় বেরোত না। সকলেই একসঙ্গে থাকত। জে এন হমফ্রে ছিলেন তাদের অভিভাবক। তারা তাদের ভাষায় হমফ্রেকে ডাকত ‘মিজুলা’ বলে। মিজুলা হল—রক্ষক। হমফ্রেকে তারা শুধু বিশ্বাসই করত না, অরণ্যের ঘর ছেড়ে প্রাসাদপুরীতে, একমাত্র তাঁকেই তারা রক্ষাকর্তা বলে ভাবত। ভাষা না বুঝলেও, তাদের হাব-ভাব ইঙ্গিতে সব কিছু বুঝতে পারতেন হমফ্রে।
হমফ্রে তাদের নিয়ে কিছুদিন হাওড়ায় বাস করেছিলেন। গ্রোট সাহেবের বিবরণী থেকে জানা যায়, তারা রাস্তায় বেরলে, শত শত মানুষ তাদের অবাক হয়ে দেখত। জামাকাপড় পরিহিত মানুষ দেখে অর্ধ-উলঙ্গ আদিম অতিথিরা কখনো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত। কখনো-বা কৃত্রিম রাগ প্রকাশ করে, লাঠি হাতে তাদের তাড়া করত। দর্শকেরা এদিক-ওদিক ছুটে যেতেই—তারা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি যেত। এটাও ছিল তাদের কাছে একরকমের খেলা। মাঝে মাঝে যে বিরক্তবোধ করত না, তা নয়। বড়ো বেশি ভিড় জমে গেলে, তারা অঙ্গভঙ্গি করে বিরক্তি প্রকাশ করত। মিজুলাকে জড়িয়ে ধরে, ভিড়ের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করত।
জনসাধারণ তাদের কিছু উপহার দিলে, সহাস্যে তারা তা গ্রহণ করত এবং মাথা নীচু করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত। অনেকেই তাদের জামাকাপড় ও অন্যান্য চকচকে সামগ্রী উপহার দিত। সব কিছুই তারা সাদরে গ্রহণ করত। বিশেষ করে কেউ যদি তাদের তামাক বা চুরুট দিত, তাহলে তারা, সেই ব্যক্তিকে খুশিতে জড়িয়ে ধরত। নিজেদের রীতিতে আদর করত।
হমফ্রে আদিম অতিথিদের নিয়ে নিয়মিত বেড়াতে বেরোতেন। কলকাতা ও হাওড়ার দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখিয়ে তাদের নিয়ে গিয়েছিলেন ব্যারাকপুর। অতিথিদের নিয়ে কীভাবে হমফ্রে ব্যারাকপুর পৌঁছেছিলেন, গ্রোট সাহেব তার কোনো বিবরণ দেননি। সম্ভবত রেলে চাপিয়েই তাদের ব্যারাকপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই সময়, ব্যারাকপুর বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কলকাতা থেকে লাটসাহেব মাঝে মাঝে লাটবাগানে যেতেন। ব্যারাকপুরের গঙ্গার ধারে ও আশপাশে কলকাতার বাবুদের অনেক বাগানবাড়ি ছিল। ইউরোপিয়ানরাও ব্যারাকপুরে পার্টি দিত। হই-হুল্লোড় করে আবার কলকাতায় ফিরে আসত।
সেই ব্যারাকপুরে আদিম অতিথিদের বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন জে এন হমফ্রে। ভীষণ খুশি হয়েছিল অতিথিরা। ব্যারাকপুর পার্কে (চিড়িয়াখানা) বন্যজন্তু দেখে তারা আনন্দে নৃত্য করতে শুরু করেছিল। আন্দামানে অরণ্যের ছায়াদুর্গে আশপাশে প্রতিনিয়তই বন্যজন্তু দেখতে পারত তারা। ব্যারাকপুরে সেই বন্যজন্তু দেখে, তাদের মধ্যে অরণ্যের আনন্দ ফিরে এসেছিল।
আদিম অতিথিরা আয়নাতে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হত। কেউ তাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়নি। এ পরীক্ষার কথা হয়তো কারো মনেও ছিল না। প্রতিবিম্বের ঘটনাটি আকস্মিকভাবেই ঘটে গিয়েছিল। ঘটনাটি কোথায় ঘটেছিল, গ্রোট সাহেব তাঁর বিবরণীতে তা উল্লেখ করেননি। কলকাতা, হাওড়া অথবা ব্যারাকপুর যেখানেই ঘটুক, ঘটনাটি সেই সময়ে স্মরণীয় হয়েছিল।
অতিথি দলের সবচেয়ে দেমাকি সদস্য বিরোলা—ইংরেজরা যার নাম রেখেছিল লুইসা, প্রমাণ সাইজ আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখে, প্রথমে বিস্ময় ও পরে ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠেছিল। আরও একজন বিরোলা কী করে এখানে এল! সে যা করে, আয়নার বিরোলা তাই করে কেন! ভয় তো পাবারই কথা! বিরোলা ছুটে গিয়ে মিজুলার কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্যাপারটি আদিম অতিথিদের বোধগম্য করে তুলতে হমফ্রের অনেক সময় লেগেছিল।
গ্রোটের বিবরণীতে শুধু ‘আন্দামানিজ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আন্দামানে বিভিন্ন আদিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। জারোয়াদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন তো সেদিনের কথা। সেন্টেনেলিজরা এখনও দূরের নক্ষত্র। গ্রোট সাহেব অতিথিদের চেহারার যে-বর্ণনা দিয়েছেন—তাতে তাদের সম্ফেন জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। ওঙ্গি ও গ্রেট আন্দামানিজ গোষ্ঠীর সদস্য বলেই মনে করা হচ্ছে। গ্রোট সাহেব ‘গ্রেট’ শব্দটি সম্ভবত বাদ দিয়েছেন। শুধু আন্দামানিজ লিখেছেন। গ্রোটের বিবরণ অনুযায়ী হমফ্রে গ্রেট অন্দামানিজ জনগোষ্ঠীর সাত সদস্যের একটি দলকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন। নৃতাত্ত্বিকদের সমীক্ষা অনুযায়ী এই দুই গোষ্ঠী—ওঙ্গি ও গ্রেট আন্দামানিজ জঙ্গলে থেকেও তখন সভ্যতার কাছে এসেছিল।
কলকাতার আতিথ্য যারা গ্রহণ করেছিল, তারা গ্রেট আন্দামানিজ জনগোষ্ঠীর সদস্য। বর্তমানে গ্রেট আন্দামানিজ পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটো জনগোষ্ঠী। বাইরে থেকে গোষ্ঠীতে মিলে যাওয়া তিনজনকে ধরে এই গোষ্ঠীর মোট সংখ্যা মাত্র একত্রিশ।
১৩২ বছর আগে তাদের অবস্থা এমন ছিল না। ১৮৫৭খ্রিস্টাব্দেও তাদের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের ওপর। ১৯০১খ্রিস্টাব্দের শুমারিতে তাদের সংখ্যা নেমে এল ৬২৫-এ। বর্তমানে তাদের নিজস্ব সংখ্যা ২৮। সভ্যজগতের একটি বিধবা তার দুটি কন্যাসহ একটি আন্দামানি যুবককে বিয়ে করায় ওই গোষ্ঠীর জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১। এই জনগোষ্ঠী বর্তমানে অবলোপের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে— শেষের সেই ভয়ংকর দিনের জন্য অপেক্ষা করছে।
আবার গ্রোট সাহেবের বিবরণীতে ফিরে আসা যাক। আন্দামানের অরণ্যে তারা হিংস্র হলেও, কলকাতায় তাদের ‘বিনয় ও ভদ্রতা’ সকলকে অবাক করে দিয়েছিল।
গ্রোট সাহেব আদিম অতিথিদের একবাক্স চুরুট উপহার দিয়েছিলেন। বিনয় ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সেই উপহার তারা শুধু গ্রহণই করেনি, তাদের ‘মিজুলা’ জে এন হমফ্রের মাধ্যমে আকারে-ইঙ্গিতে গ্রোট সাহেবকে তাদের দেশে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
পক্ষাধিক কাল কলকাতা, হাওড়া ও ব্যারাকপুরে অবস্থানকালে তারা অনেক উপহার পেয়েছিল। সাহেবসুবোরাও যেমন পোশাক-পরিচ্ছদ ও নানা ধরনের সামগ্রী উপহার দিয়েছিল, তৎকালীন বঙ্গশিরোমণি ও সাধারণ মানুষও তাদের নানা জিনিস উপঢৌকন দিয়েছিল। সমস্ত উপহারগুলি জাহাজের খালাসির বড়ো প্যাঁটরার মধ্যে ভরে অরণ্যের ঘরে ফিরে গিয়েছিল। অত্যন্ত যত্নসহকারে সমস্ত সামগ্রী প্যাঁটরার মধ্যে গুছিয়ে নিয়েছিল। প্যাঁটরাটি ছিল চার ফুট লম্বা ও দু-ফুট উচ্চ। এই বিশাল প্যাঁটরাটি সাহেবসুবোদের পোশাক, নল, চুরুট, তামাক, বিস্কুট, বাদাম, কতগুলি গাছের বীজ ও অন্যান্য সামগ্রীতে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এসব সামগ্রী তাদের কাছে সোনার চেয়েও মূল্যবান ছিল।
গ্রোট সাহেব লিখছেন, যেসব জিনিস সভ্যসমাজে তুচ্ছ বলে পরিগণিত, আদিম অতিথিরা সেগুলি সানন্দে গ্রহণ করে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
অরণ্যে তারা উলঙ্গ থাকলেও, কলকাতায় পদার্পণের আগে হমফ্রে তাদের প্রত্যেকের গায়ে আবরণ তুলে দিয়েছিলেন। ভালো সার্জের নীল রং-এর স্যুট। পোশাক পরে অত্যন্ত বিপন্নবোধ করেছিল তারা। কিন্তু মিজুলার নির্দেশে, কষ্ট হলেও অবিন্যস্তভাবে গায়ে রেখেছিল। তাদের গ্রহণশক্তি অবশ্যই প্রশংসনীয়। নগ্ন হয়ে স্নান করে আবার যথাযথভাবেই পোশাক পরে নিত তারা।
ওয়েস্ট ফিল্ডের স্টুডিয়োতে ছবি তোলাতে তাদের নিয়ে গিয়েছিলেন হমফ্রে। সেখানে কিছু বাইরের লোক উপস্থিত ছিল। খুব বিপদে পড়েছিলেন হমফ্রে। আগন্তুকদের সামনে তারা নগ্ন হতে চাইছিল না। পরে অবশ্য আগন্তুকদের সরিয়ে দিয়ে, তাদের নিজস্ব পোশাক পরিয়ে ছবি তোলা হয়।
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ‘টুবাল কেইন’ নামক জাহাজে কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে আদিম অতিথিরা আবার আন্দামানের অরণ্যে ফিরে গিয়েছিল। কলকাতায় এমন অতিথি আর কোনো দিন আসবে কি?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন