গোপালকৃষ্ণ রায়
ছোটোবেলায় একবার শঙ্খলাগা দেখেছিলাম। সে এক বিস্ময়কর অবিস্মরণীয় দৃশ্য। দুটি বিশাল বড়ো সাপ পরস্পরকে পাকে পাকে জড়িয়ে আছে। সাপ দুটির জড়ানো দেহ কখনো মাটি থেকে খাড়া হয়ে দু-ফুট উঁচুতে উঠছে, আবার কখনো বা ঘাসের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। একটি দাঁড়াশ আর একটি কেউটে। বাগানে কাজ করছিল কয়েকজন মজুর, তার মধ্যে কলিমুদ্দিন মাথার গামছা খুলে লিচুতলায় বিছিয়ে দিল। হে আল্লা। ওদের আমার গামছার ওপর পাঠিয়ে দাও।
অপরিণত মনে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে দুটি বিষধর সরীসৃপের ‘সংঘর্ষ’ দেখছিলাম। তখনও কলিমুদ্দিন আল্লার কাছে প্রার্থনা করে চলেছে। আয়, আয়, আমার গামছায় আয়। কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না দুটি বিষধরকে গামছার ওপর কলিমুদ্দিন ডাকছে কেন। পরে শুনেছিলাম—ওরা যুদ্ধ করছিল না। সম্ভোগে লিপ্ত ছিল। সম্ভোগরত সাপ দুটি যদি কলিমুদ্দিনের গামছার ওপর দিয়ে চলে যেত, তাহলে কলিমুদ্দিনের ভাগ্য ফিরে যেত। ওই গামছা মাথায় বেঁধে কাজ করলে সাফল্য অনিবার্য। চার দশক পূর্বের এই ঘটনা এক, কিন্তু প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ আলাদা।
আমাদের গন্তব্যস্থল চেরাপুঞ্জি। একদা মেঘ ও বৃষ্টির লীলাভূমি। ‘একদা’ বলছি এইজন্য যে, বৃষ্টির পরিমাণ সেখানে কমে এসেছে। এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী মউসিমরাম। সোহারা থেকে বৃষ্টি সরে যাচ্ছে মৌরায় বা মউসিমরামে।
প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। একদা বৃষ্টির জন্য বিখ্যাত চেরাপুঞ্জি এখন বিজ্ঞানীদের চোখে ‘হায়েস্ট রেইনফল ডেসার্ট এরিয়া’। সর্বোচ্চ বৃষ্টিধৌত মরুপাহাড়। শিলং থেকে মাত্র ৫৬ কিমি চেরাপুঞ্জি। কথা ছিল চেরাপুঞ্জিতে সারাদিন কাটিয়ে একই পথে ফিরে আসব লায়েতকর। সেখান থেকে হিন্দুতীর্থ মেঘালয়ের ‘অমরনাথ’। খাসি ভাষায় মাও জুঁইং বুঁইন অর্থাৎ প্রকৃতি সৃষ্ট নারীর স্তন। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি আর মউসিমরামের দূরত্ব প্রায় সমান।
চেরাপুঞ্জি পৌঁছোবার আগেই মউসমাইয়ের প্রাগৈতিহাসিক গুহা দেখতে গিয়েই পবিত্র বনবীথিতে বিস্ময়কর শঙ্খলাগা আমাদের চোখে পড়ে। প্রথমে দেখেন ওয়ালাং। মেঘালয়ের বনবিভাগের অন্যতম বড়োকর্তা। দৃশ্যটি দেখেই ভয়ে আঁতকে ওঠেন তিনি। পাশে ছিল শিয়ান্তি দিয়েং দো। আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে ‘থেলন থেলন’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন ওয়ালাং। আমাদের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরের দুটি বিশালাকায় সাপ পরস্পরকে জড়িয়ে সম্ভোগে আর সোহাগে নিজেদের তৃপ্ত করে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ছোটোবেলার সেই দৃশ্যের কথা আমার মনে পড়ে। কলিমুদ্দিন গামছা পেতেছিল আমি পকেট থেকে রুমাল বার করে পাততে যাই। ওয়ালাং ও শিয়ান্তি দুজনেই চিৎকার করে ওঠে। ডোন্ট-গো ডোন্ট-গো তাদের বাধা আমার কানে পৌঁছোয় না। দুটি সাপই প্রায় সমপরিমাণ লম্বা। আঠারো থেকে কুড়ি ফুট দীর্ঘ একটি অজগর অপরটি শঙ্খচূড়। পাকে পাকে জড়িয়ে শালের গুঁড়ির মতো পড়ে আছে। কখনো গড়িয়ে শঙ্খচূড় নীচে কখনো বা অজগর। মানুষের উপিস্থিতিতে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই।
শিয়ান্তি চিৎকার করে বলে, চলে আসুন। তাকিয়ে দেখি ওয়ালাং-এর প্রায় অজ্ঞান দেহ শিয়ান্তির শরীরে ঢলে পড়েছে। ধরাধরি করে ওয়ালাংকে ঝোরার পাশে নিয়ে যাই। চোখে-মুখে জল দিতেই ধাতস্থ হন তিনি। বলেন, গড সেভ আস ফ্রম থেলন।
ধাতস্থ হলেও আত্মস্থ হতে পারেন না ওয়ালাং। এতক্ষণ লক্ষ করিনি, শিয়ান্তির চোখে-মুখেও বিষণ্ণ ছায়া। দুটি সরীসৃপের সংগম দেখে এতটা বিচলিত হবার কারণ খুঁজে পাই না। একটা রহস্য আমার মনে কৌতূহলের জাল বুনে চলে। মেঘালয়ে এখনও বেশ কয়েকটি পবিত্র বনবীথি বা সেক্রেড গ্রোভ রয়েছে। খাসি, জয়ন্তিয়া বা গারো কেউই পবিত্র বনবীথির কোনো গাছ কাটে না। কোনো গাছের পাতা ছেঁড়ে না। ভুলেও কেউ কোনো গাছের ডাল ভাঙে না। সেই আদিমকাল থেকেই তারা এই সংস্কারে আবদ্ধ। আর এই সংস্কার মানে বলেই— মেঘালয়ে বন আছে, বনানী আছে। আর মেঘালয়ের আকাশে মেঘের আনাগোনা আছে। ওয়ালাং বলে, সংরক্ষণের চেয়ে ধ্বংসের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায়, চেরাপুঞ্জি থেকে বৃষ্টি সরে যাচ্ছে। মেঘেরও রং পালটে যাচ্ছে। চেরাপুঞ্জির আকাশে কালো মেঘে বিদ্যুৎ চমকানো কমে গেছে। শুধু ধূসর কুয়াশার মতো মেঘ পাহাড়ের গা বেয়ে গভীর গর্তে নেমে আসে। তাতে বড়ো একটা বর্ষণ হয় না।
কিছুক্ষণ আগে মউসমাইয়ের গুহায় ঢুকেছিলাম আমরা। শিয়ান্তি আর আমি। ওয়ালাং গুহার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। খাসি ও বাঙালি মিশ্রণের ফসল শিয়ান্তি।
প্যালিও-আর্কিওলজিস্টরা মনে করেন প্রস্তরযুগের মানুষ এই গুহাতেই বাস করত। কিছু দুঃসাহসিক মানুষ, এই গুহা অভিযান করেছিল, কিন্তু গুহার শেষ কেউ খুঁজে পায়নি।
শিয়ান্তির হাত ধরে অতলস্পর্শী গুহার বাইরে চলে আসি। চেরাপুঞ্জি পৌঁছোতে আমাদের আধ ঘণ্টাও লাগে না। জিপে সারাক্ষণ আমরা চুপ করেছিলাম, ওয়ালাং চোখ বুজে বসেছিলেন। চেরাপুঞ্জির পথের দু-ধারের নৈসর্গিক শোভা অপূর্ব। পাইন আর ওকের সারি। ডালে ডালে নাম না জানা প্রস্ফুটিত রং-বেরঙের অর্কিড। মেঘালয়ের অর্কিড পৃথিবী বিখ্যাত। অরণ্য সংহারের ফলে অনেক প্রজাতির অর্কিড হারিয়ে গেছে। অনেক প্রজাতি নির্মূলের পথে। তবুও যা আছে—তাতেই সৃষ্টি হয়েছে স্বর্গীয় সুষমা।
পাইনের পাতায় পাতায় ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দ। কেউ কখনো এই শব্দ থামতে শোনেনি। এ শব্দ থামে না। এই শব্দের মধ্যেই প্রকৃতি, এই শব্দের মধ্যেই জীবন। চেরাপুঞ্জিতে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গেই একঝাঁক ধূসর মেঘ হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে। আমাদের ক্লান্ত মুখে প্রকৃতি ঠাণ্ডা জলের স্প্রে ছড়িয়ে দেয়।
মেঘে মেঘে মেঘালয়। চেরাপুঞ্জির আকাশে সাদা, ধূসর আর কালো মেঘের খেলা। আকাশ থেকে ধীরে ধীরে পাহাড়ের বুকে নেমে এসে দ্রুত মিলিয়ে যায় গভীর খাদে।
টুরিস্ট স্পটে দাঁড়িয়ে চারদিকে দৃষ্টি ফেরাই। ওপরে উঁচু থেকে সশব্দে নামছে ঝরনা। এখন জুলাই মাস। তাই ঝরনা বেগবতী চঞ্চলা যুবতী। টুরিস্ট স্পটে দাঁড়িয়ে দেখা যায় না থিয়াং ফলস।
শিয়ান্তি বলে, সামনের উঁচু পাহাড় থেকে যে ঝরনা নেমে এসেছে তার নাম ডেইন থেলন ফলস। আবার কেউ কেউ বলে, মউসমাই ফলস। থেলন শব্দটি কানে খট করে বাজে। পবিত্র বনবীথিতে এই থেলন মনে হবে দীর্ঘাকার একটি অজগর সোজা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে। নামকরণ অবশ্যই সার্থক।
যে পাহাড়টায় তুমি দাঁড়িয়ে আছ এটাই আমাদের দেশের শেষ সীমানা। আর সামনে যে আদিগন্ত মাঠ-জলাভূমি দেখছ, এর নাম সুরমা ভ্যালি। বাংলাদেশ। এখানে দাঁড়িয়ে রাতের সিলেটের আলো দেখা যায়।
কোনো এক কালে সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের জায়গা ছিল চেরাপুঞ্জি। খরায় জ্বলে চেরাপুঞ্জির কাছে আধখানা মেঘ ধার চেয়েছিল কবি। যদিও এখনও সব মেঘ নিরুদ্দেশ হয়নি। তবে বর্ষণের ধারা কমে এসেছে।
চারের দশকে এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১১৮ ইঞ্চি। ১৮৯৯খ্রিস্টাব্দে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৬৪১ ইঞ্চি। আর এখন?
যদি ইকোলজির পুনর্জীবন না ঘটানো যায় তাহলে কালক্রমে চেরাপুঞ্জি আর চাঁচোলের মধ্যে কোনো তফাত থাকবে না। এত বৃষ্টি কিন্তু চেরাপুঞ্জিতে পানীয় জলের হাহাকার। সব জল নেমে যায় সুরমা ভ্যালিতে। আশার কথা, মানুষের মনে আবার অরণ্যপ্রীতি ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। রাত কাটাতে চেয়েছিলাম মউসিমরামে। কিন্তু আমরা থেকে গেলাম চেরাপুঞ্জিতে। এখনও আমাদের দেখা হয়নি ন-কাই-লিকা ফলস। পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ লম্বা জলপ্রপাত। চেরাপুঞ্জি থেকে আট কিমি পশ্চিমে। ন-কাই-লিকা ঝরনা স্বয়ং রোমান্টিক যুবতী। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি কিংবদন্তি। ওয়ালাং বলেন, চেরাপুঞ্জির প্রাকৃতিক পরিমন্ডলে শুধু প্রেম নেই, একটা ইতিহাস আছে। বিশ্বাসযোগ্য প্রবাদ আছে। মুগ্ধকর কিংবদন্তি আছে।
ওয়ালাং ঠিকই বলেছেন। বেশিরভাগ ভ্রমণপিপাসুরা নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে। কান পেতে পাইনের গান শোনে, অস্তমিত সূর্যের শেষ রশ্মিতে রঙিন হয়ে ওঠা রডোডেনড্রনের অনুপম সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে যায়। যাবার আগে অনেকে দু-এক বোতল মধু নিতে ভুল করেন না। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে চেরাপুঞ্জি ছিল ইংরেজদের কার্যত সদর দপ্তর। শাইলং তখনও শিলং হয়নি। চেরাপুঞ্জি থেকেই সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সহজ ছিল। যোগাযোগকে আরও সহজতর করার জন্য সুরমা ভ্যালির ওপর একটা রেললাইন বসানো হয়েছিল। কিন্তু একটা দুর্ঘটনার জন্য ইংরেজরা ওই লাইনে আর ট্রেন চালায়নি।
খাসিরা চেরাকে বলে সোহরা। সম্ভবত জায়গাটির নাম সোহরাই ছিল। ইংরেজরা সোহরাকে করেছে চেরা এবং পুঞ্জি যোগে কালক্রমে হয়ে উঠেছে চেরাপুঞ্জি।
চেরা রাজ্যের খাসিদের মধ্যে একটি প্রথা প্রচলিত আছে। খাসিরা রাজাকে বলে সিয়েম। সিয়েমের দেহ দাহ তার উত্তরাধিকারীকেই করতে হয়। কেউ যদি কোনো কারণে না করতে পারে—প্রজাবৃন্দ তাকে সিয়েম বলে স্বীকার করে না। চেরার প্রাসাদে এখনও দুজন সিয়েমের দেহ মমি করে রাখা আছে। একজন মারা গিয়েছিলেন ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে এবং আরেকজন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে।
মেঘালয়ের পাহাড় ভেঙে ওঠা-নামা করতে বিশেষ কষ্ট হয় না। রাজ্যের পশ্চিমাংশের কয়েকটি পাহাড় ছাড়া সব পাহাড়ই মোটমুটি ভদ্রস্থ। সিকিমের মতো চড়াই-উৎরাইয়ে হাঁফ ধরে না। এবার আমরা যাচ্ছি ন-কাই-লিকাই ফলস দেখতে। চেরাপুঞ্জি থেকে মাত্র আট কিমি পশ্চিমে। ন-কাই-লিকাই যেতে টোল চার্জ দিতে হয়। মিনিট কুড়ির মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই ন-কাই-লিকাই। মেঘালয়ের একটি দর্শনীয় ট্যুরিস্ট স্পট। চেরাপুঞ্জিতে দাঁড়িয়ে ডেইন-থেলন ফলস দেখে যাঁরা বিস্মিত হন, ন-কাই-লিকাই দেখে তাঁদের সেই বিস্ময়বোধ মুগ্ধতায় পর্যবসিত হয়।
ন-কাই-লিকাই পৃথিবীর চতুর্থ দীর্ঘতম জলপ্রপাত, সরকার একটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করেছেন। এই কেন্দ্র থেকে ন-কাই-লিকাইকে দেখতে হয়। ন-কাই-লিকাই ডেইন থেলনের মতো ধাপে ধাপে নামেনি। ওপর থেকে সোজা হাজার ফুট ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নীচে খাদের মধ্যে অদ্ভুত এক জলতরঙ্গ। বোল্ডারে বোল্ডারে আছড়ে পড়ে জলরাশি প্রতিমুহূর্তে রং বদলায়। এই রং বদলের খেলা সবাই নাকি দেখতে পায় না।
ওয়ালাং পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ন-কাই-লিকাই দেখছেন, অনাদি কাল থেকেই এই জলরাশি নেমে আসছে। একদিনের জন্যও সে থামেনি। থামার অপর নাম মৃত্যু। আর চলাই হচ্ছে জীবন। ন-কাই-লিকাই তাই জীবন্ত। ন-কাই-লিকাইতে জনবসতি কম। পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পাশে গোটা কয়েক দোকান।
জেইনসেম পরিহিতা খাসি সুন্দরী কং বা বী জিমবাম এগিয়ে দেবে। নানা রকমের পিঠে দিয়ে সাজানো জিমবাম বা খাবারের ঝুড়ি। যা খুশি তুলে নিন। ঝরনার দিকে তাকিয়ে বসে বসে খান।
খাসি রমণীদের পোশাকের মধ্যে একটি নান্দনিক ব্যঞ্জনা আছে। শহর এলাকায় জেইনসেমের স্থান জিন দখল করতে শুরু করেছে। গ্রামাঞ্চলে জেইনসেমের কদর আগের মতোই আছে। খাসি রমণীরা বেস্ট ক্লোথড উইমেন বলে বিশ্বে পরিচিত।
শিয়ান্তি বলে, ডেইন থেলন হল একটি দৈত্যাকার অজগর। ডেইন থেলনের পুরো গল্পটা এখন বলব না। শুধু জেনে রাখো আদিমকাল থেকে থেলন খাসিদের শত্রু। সেই ডেইন থেলন থাকত নীচের ওই গুহার মধ্যে। গুহাটার নাম হচ্ছে পমডলাই। একটি বিশাল পাথরের চাঁই দিয়ে গুহার মুখ বন্ধ। তাকিয়ে দেখো—পাথরের গায়ে কাটা চিহ্ন। ডেইন থেলনকে এই পাথরের ওপরেই কুচি কুচি করে কাটা হয়েছিল।
চেরাপুঞ্জি থেকে মউসিমরাম যাবার অন্য কোনো পথ নেই। চেরাপুঞ্জির মেঘ আকাশ পথে যত দ্রুত মউসিমরামে পৌঁছোতে পারে, আমরা তত দ্রুত যেতে পারি না। আমাদের পথ আঁকা-বাঁকা চড়াই-উতরাই। চেরাপুঞ্জি থেকে মউসিমরাম প্রায় তিরানব্বই কিমি। শিলং থেকে ৫৫ কিমি।
পাহাড়ের চেহারা সর্বত্রই প্রায় এক। মউসিমরামের পথে অরণ্যের চেহারা একটু আলাদা, চেরাপুঞ্জির অরণ্য সংহারের শিকার—মউসিমরামের বনানী এখনও ভার্জিন বা কুমারী। পবিত্র বনবীথির আয়তন এখানে বেশি। অরণ্য ঘন এবং গহীন। আকাশচুম্বী পাইনের সারি। সবুজ ঘন ওক। তাদের জড়িয়ে আছে অসংখ্য নাম না-জানা গাছ। পাহাড়ের গায়ে বন্য গোলাপের সমারোহ। বাতাসে আন্দোলিত ফুলঝাড়ুর বনে ঢেউ।
উইলোয় এসে চা খাই। এখান থেকে মউসিমরাম পৌঁছোতে আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে। ওয়ালাং বলেন, আমরা ভালো দিনেই যাচ্ছি। আজ সেখানে একটা উৎসব আছে। এখানে খাসি নাচ দেখতে পারবে।
বড়ো রাস্তা থেকে একটু নীচে মউসিমরামের গুহা। এ গুহার ইতিহাস কেউ জানে না। এ গুহা কিংবদন্তিতে মুখর।
এ গুহায় আছে দুটি প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ। একটি বড়ো আর একটি ছোটো। বড়োটির উচ্চতা প্রায় তিনফুট, ছোটোটি তার অর্ধেক। লিঙ্গ দুটির ঠিক ওপরে গুহার ছাদের সঙ্গে লাগানো দুটি মাও জুঁইং বুঁইন—প্রকৃতি-সৃষ্ট পাথরের দুটি স্তন। আর সেই স্তন থেকে লিঙ্গের মাথায় ফোঁটা ফোঁটা দুধ পড়ে। সুডৌল নারীর স্তনের বোঁটা থেকে প্রতি দশ সেকেণ্ডে একফোঁটা করে দুধ পড়ে। এত দুধ কোথায় আছে, কবে থেকে পড়ছে— কেউ তার হদিশ জানে না। বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন দুধ নয় চুনের জল। আস্তিকেরা প্রশ্ন তোলেন, স্তন দুটি এল কোথা থেকে? আর লিঙ্গ দুটি কেন ঠিক স্তনের নীচে? বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রকৃতির খেয়াল। ধার্মিকেরা মনে করেন, ঈশ্বরের লীলা।
মউসিমরাম কেভের প্রবেশমুখ বেশ প্রশস্ত। মউসমাই বা পমডলাই এর মতো সরু নয়। মুখ প্রশস্ত হলেও ভেতরে ক্রমাগত সরু হয়ে গেছে। গুহার গায়ে স্টালেগমাইটের বিচিত্র জাফরি। গুহার ছাদ থেকে স্টালেগমাইটের হাজারো রজ্জু। মনে হয় অনেকগুলি সাপ একসঙ্গে ঝুলছে। প্রকৃতি তার আপন খেয়াল অনুযায়ী কত কী তৈরি করে রেখেছে। কোনোটা-বা হাতির শুঁড়, আর কোনোটা বা সিংহের মুখ গুহার অভ্যন্তরে ছড়ানো-ছিটানো পাথরের চাঁই। পাথরের ওপর পা রেখে গুহার গভীরে যেতে হয়।
গুহার মধ্যে এক অদৃশ্য কলস্বিনীর কুলু-কুলু শব্দ। শুধু জলের শব্দ শোনা যায় কিন্তু জলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ডাইনে গেলে মনে হয় বাঁ দিকে জলের শব্দ। বাঁ-দিকে গেলে মনে হবে ডান দিকে। অথচ কোনো দিকেই জল খুঁজে পাওয়া যায় না। গুহার অভ্যন্তরে অদৃশ্য এক জলের ধারা জলতরঙ্গ বাজিয়ে চলেছে। এ ধারার উৎস কোথায় কেউ জানে না—কোথায় গিয়ে পড়েছে—সে-সন্ধানও কারও জানা নেই।
শিয়ন্তি বলে, এই অদৃশ্য জলের ধারা মউসিমরাম কেভের রহস্য। কোথা থেকে আসছে—আর কোথায় যাচ্ছে—অথবা কেভের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে—তা আজও মানুষের অজানা। মাও জুঁইং বুঁইন আর অদৃশ্য জলধারা মউসিমরামের রহস্য। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের কথা ভাবতে ভাবতে গুহার মুখে ফিরে আসি। বড়ো শিবলিঙ্গের কাছে দাঁড়িয়ে স্তন থেকে দুধপড়া দেখছেন ওয়ালাং। নিবিষ্ট মনে দেখছেন প্রতিটি ফোঁটা। ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন। দুটি ফোঁটার মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যতিক্রম ঘটে না। এতক্ষণ খেয়াল করিনি—দুটি স্তনের একটি ভাঙা। ছোটো শিবলিঙ্গের ওপরের স্তনটির সম্মুখভাগ কে যেন কেটে দিয়েছে। অবাক কান্ড সেই কর্তিত স্তন থেকে দুধ পড়া বন্ধ।
ওয়ালাং বলেন, এটা একটি দুর্ঘটনা। বহুকাল আগেই এই ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি এখন কিংবদন্তী। প্রকৃতির অস্তিত্বে অবিশ্বাসী কোনো এক কালাপাহাড় ধারালো বর্শার ফলক দিয়ে স্তনটি ভেঙে দিয়েছে।
মাও জুঁইং বুঁইন হিন্দুদের কাছে পবিত্র তীর্থ। লিঙ্গের মাথায় ফুল না দিলেও খাসি, জয়ন্তিয়ারা মনের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ভুল করে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন