গোপালকৃষ্ণ রায়
পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই সম্ভবত মৃৎপাত্রের ব্যবহার প্রথম শুরু হয়েছিল। সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি মৃৎপাত্র দেখে বিশেষজ্ঞরা সেইরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে যেসব প্রাচীন মৃৎপাত্রের সন্ধান মিলেছে তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড় জেলার সরাই-নাহার রাই গ্রাম থেকে আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রটি সর্বাধিক প্রাচীন।
বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ড. প্রতাপ দত্তের নেতৃত্বে ভারতীয় নৃবৈজ্ঞানিক সর্বেক্ষণ বা অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়া সরাই-নাহার রাই গ্রামে একটি প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র খনন করে মৃৎপাত্রটি আবিষ্কার করেছেন। পাত্রটি আকারে নেহাৎ ছোটো হলেও সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার বিবর্তনের এক অনবদ্য সাক্ষ্য। এই অমূল্য ও অসাধারণ মৃৎপাত্রটি একটি সুরক্ষিত কবরের ওপর সযত্নে রক্ষিত ছিল।
শিলাভূত একটি নরকঙ্কালের পাশ থেকে অক্ষত অবস্থায় নৃতাত্ত্বিকেরা মৃৎপাত্রটি উদ্ধার করেছেন। যেভাবে মৃৎপাত্রটি কবরের পাশে সন্নিবেশিত ছিল, তা দেখে তাঁরা মনে করছেন, প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বেও মানুষ মৃতদেহকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় আচার পালন করত। কী ধর্ম তখন প্রচলিত ছিল বা বর্তমান মানুষের পূর্বপুরুষ কোন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, তার কোনো প্রমাণ বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। মৃতদেহের পাশে মৃৎপাত্র রেখে যে ধর্মীয় আচারই তারা পালন করে থাকুন না কেন, এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, জন্ম-মৃত্যুর প্রতি তাদের বিশ্বাস এবং প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি আনুগত্য ছিল। সমাধিক্ষেত্রের পাশে মৃৎপাত্র রাখার প্রচীন ধারা এখনও আমাদের সমাজে বর্তমান।
মৃৎপাত্রের সঙ্গে কবরের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি। নরকঙ্কালটির অবস্থান এবং কবরের আকার ও আকৃতি থেকে নৃতাত্ত্বিকেরা দশহাজার বছরের প্রাচীন সংস্কৃতি ও সভ্যতার অবস্থার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন।
নৃতাত্ত্বিকের আবিষ্কৃত এই কঙ্কালের নাম ‘সরাই-নাহার রাইয়ের মানুষ’। গ্রামের নাম অনুসারেই এই কঙ্কালের নামকরণ করা হয়েছে।
পরীক্ষাগারে নৃতাত্ত্বিকেরা দীর্ঘদিন এই নরকঙ্কাল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। রেডিয়ো কার্বন ডেটিং করে তাঁরা নরকঙ্কালটির বয়েস নির্ধারণ করেছেন। তাদের মতে নরকঙ্কালটির বয়স ৮৪৬৭ বছর। এবং কবরে সংরক্ষিত মৃৎপাত্রটি একই সময়ে নির্মিত।
মৃৎপাত্রের কথায় ফিরে আসা যাক। নৃতাত্ত্বিক ড. প্রতাপ দত্তের মতে আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম। এর আগে যেসব মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে তাদের চেয়ে সরাই নাহার রাই গ্রাম থেকে আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রটি প্রায় দু-হাজার বছরের অধিক প্রাচীন। তিনি মনে করেন, মৃৎপাত্রটি মানবসভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের অনুপম সাক্ষ্য। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই ভারতীয় সভ্যতার একটি লুপ্ত রূপরেখা খুঁজে পাওয়া যায়।
সরাই-নাহার রাই থেকে মৃৎপাত্রটি আবিষ্কারের আগে সবচেয়ে প্রাচীন মৃৎপাত্র আবিষ্কারের দাবিদার ছিলেন মেলার্ট। তিনি দক্ষিণ অ্যানাটোলিয়ার কাতাল হিউক নামক নবপ্রস্তর যুগের ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি সুন্দর মৃৎপাত্র আবিষ্কার করেছিলেন। অ্যানাটোলিয়ার মৃৎপাত্রের সঙ্গে উত্তর ইরাকের জেরিকোর প্রাক মৃৎপাত্রের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অ্যানাটোলিয়ার মৃৎপাত্র প্রায় সাত হাজার বছরের পুরোনো। কিন্তু সরাই-নাহার রাই-এর মানুষ মৃৎপাত্রের ব্যবহার শুরু করেছিল প্রায় ন-হাজার বছর আগে।
কোথায় আমাদের এই বিখ্যাত অথচ অবজ্ঞাত নাহার রাই? এখনও এই গ্রামটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে অজানা—অজ্ঞাত। অথচ প্রায় ন-হাজার বছর পূর্বে এই গ্রামে এবং তার পাশ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে একটি সভ্যতা জন্মগ্রহণ করেছিল। একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যে সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল।
জেলা হিসেবে উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড় পরিচিত হলেও জেলার সদর শহর থেকে তেইশ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সরাই-নাহার রাই এখনও অপরিচিত। এলাহাবাদ থেকে মাত্র আটত্রিশ কিমি উত্তরে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় অবস্থিত। আমরা মৃৎপাত্রটিকে মধ্য গাঙ্গেয় সভ্যতার প্রাচীন স্মারক হিসেবে মনে করতে পারি।
ভারতীয় নৃবৈজ্ঞানিক সর্বেক্ষণ সরাই নাহার রাই-এর মেসোলিথিক কবর খনন করে শিলীভূত নরকঙ্কাল ও তার পাশ থেকে পৃথিবীর প্রাচীনতম মৃৎপাত্রটি উদ্ধার করেছেন। শিলীভূত নরকঙ্কাল ও স্থানটির প্রত্নতাত্ত্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, আবিষ্কৃত নরকঙ্কালটি দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পীভূত প্রাচীনতম হোমো স্যাপিয়েন—স্যাপিয়েন।
মানবসভ্যতার শুরু থেকেই মাটির ব্যবহার শুরু হয়েছে। কিন্তু মাটি দিয়ে সুচারু পাত্র তৈরির বুদ্ধি ও কৌশল মানুষ ঠিক কত হাজার বছর আগে আয়ত্ত করেছিল, নির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে এখনো কেউ তা ঠিক করতে পারেনি। সরাই-নাহার রাই-এর মৃৎপাত্রটি অবশ্য সেই শূন্যস্থান কিছুটা পূরণ করেছে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রের মধ্যে সরাই-নাহার রাই-এর মৃৎপাত্রটি পৃথিবীর মধ্যে প্রাচীনতম বলে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন।
এই সঙ্গে তাঁরা একথাও ভাবছেন যে, আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রটি একক নয়। ওই সময়ে এই ধরনের মৃৎপাত্রটির নিয়মিত ব্যবহার প্রচলিত ছিল। সম্ভবত মানুষ আপন প্রয়োজনের তাগিদে মাটির ব্যবহার করেছে। হয়তো জীবন ধারণের সামগ্রী হিসেবে পাত্রও তৈরি করেছে। সরাই-নাহার রাই-এর গোরস্থান থেকে একটি নমুনা পাওয়া গেছে মাত্র। জায়গাটিতে বর্তমান যুগভিত্তিক অনুসন্ধান চালালে সম্ভবত মৃৎপাত্র সভ্যতার আরও নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে।
৮৪৯৫ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে যে মানুষটিকে কবর দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তার মাথার কাছেই এই মৃৎপাত্রটি রাখা ছিল আনুষঙ্গিক আরও কিছু সভ্যতার নিদর্শন থেকে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, ওই সময়ের মানুষ বনে শিকার করত, জলাশয়ে মাছ ধরত এবং ঘুরে ঘুরে খাদ্যের সন্ধান করত।
মৃৎপাত্রটি প্রমাণ করে সেই সময়ের মানুষ কিছু ধর্মীয় আচার পালন করত। সেটা যে কী ধর্ম ছিল, তার নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। মৃতের আত্মার সদগতিতে তাদের বিশ্বাস ছিল এবং কোনো একটা অদৃশ্য শক্তির প্রতি তাদের আস্থা ছিল।
কবরের ওপর বিস্ময়কর মৃৎপাত্রটি যে অবস্থায় ছিল নৃতাত্ত্বিকেরা সেই অবস্থায় তাকে উদ্ধার করেছে। মৃৎপাত্রটি কিছুটা গোলাকৃতি। কিন্তু নিম্নাংশ উপরিভাগের তুলনায় স্ফীত। মৃৎপাত্রটির মুখে ছোটো একটি গর্ত। বাইরের অংশটি প্রচন্ড শক্ত এবং চুন লাগানো। দেখা যাচ্ছে, মৃৎপাত্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সেই সময়ের মানুষ চুনের ব্যবহার করেছে। নৃতাত্ত্বিক ড. প্রতাপ দত্তের মতে যে মাটি দিয়ে পাত্রটি তৈরি করা হয়েছিল তা খুব এঁটেল ছিল না। মৃৎপাত্রটিকে শক্ত করার জন্য তারা অন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেছিল। মাটির সঙ্গে কিছু ছোটো ছোটো পাথরের কুচি মিশিয়ে শক্ত করা হয়েছিল।
ড. দত্তের আরও ধারণা, পাত্রটি হাতে তৈরি করা হলেও, তখনকার শিল্পীরা একটি ‘কুন্ডলী’ কৌশল অবলম্বন করেছিল। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, পাত্রটির মাটির চারটি স্তর আছে। একে পোড়ানোও হয়েছিল কিন্তু যথাযথ হয়নি। মৃৎপাত্রটির বহিরঙ্গের রং গভীর ধূসর হলেও ভেতরের রং ফিকে। ঠিক এইরকম আরও কয়েকটি মৃৎপাত্র ক্ষয়ে যাওয়া কবর থেকে নৃতাত্ত্বিকেরা উদ্ধার করেছেন।
অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে মৃৎপাত্রটির গায়ে কিছু কিছু কীটপতঙ্গের জীবাশ্ম লেগে আছে। পতঙ্গগুলি শিলীভূত হয়ে গেছে।
এই প্রাচীনতম মৃৎপাত্রটিকে ঘিরে পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক মহলে একটি বড়ো রকমের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। একটি লুপ্ত জগতের সভ্যতার নিদর্শন—অতীতের সন্ধানে, বিশেষজ্ঞদের উৎসাহিত করেছে।
আরও বিস্ময়ের বিষয়, কবরের উপরিভাগে যেমন ধর্মীয় আচার পালনের জন্য মৃৎপাত্রটি রাখা ছিল তেমনি কবরের আশেপাশে ছড়িয়েছিল আরও গোটা দুই পোড়া মাটির খন্ড। বিশেষজ্ঞরা পোড়ামাটির খন্ড দুটির সম্যক পরিচয় এখনও উদ্ধার করতে পারেননি। তা ছাড়া, অগ্নিদগ্ধ বন্য প্রাণীর হাড় এবং পাথরের অস্ত্র কবরের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
পৃথিবীর এই প্রাচীনতম মৃৎপাত্রটি লুপ্ত জগতের সভ্যতার যে সন্ধান দিয়েছে—তা আজকের বিশেষজ্ঞদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন