গোপালকৃষ্ণ রায়
প্রতিদিন সন্ধ্যায় গড়িয়াহাটের মোড়ে ভিড়ে ঠাসা ওষুধের দোকানের সামনে একটি গাড়ি এসে থামে। মধ্যবয়স্কা সুবেশা ভদ্রমহিলা গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে দোকানের কাউন্টারের পাশে এসে দাঁড়ান। কাউন্টারের ভদ্রলোক চোখ তুলে তাঁকে একবার দেখেন। সুন্দর মুখ দেখেও যে কারো চোখে-মুখে এমন বিরক্তিভাব ফুটে উঠতে পারে, কাউন্টারের ভদ্রলোককে না দেখলে তা কেউ বিশ্বাস করবে না।
একসময় ভদ্রলোকের কন্ঠে চাপা বিরক্তি ফেটে পড়ে। প্রায় দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে চাপা স্বরে বলে ওঠেন, আবার এসেছেন? না, পাবেন না। যান, যান এখান থেকে।
ভদ্রমহিলা নড়েন না। ধিকৃত হয়েও তাঁর মুখ বিকৃত হয় না। উলটে দৃষ্টিতে কাতর, করুণ আকৃতি ফুটে ওঠে। দু-একজন খদ্দের আড়চোখে দেখে। ভ্রূক্ষেপ করেন না ভদ্রমহিলা। একসময় কাউন্টারের ভদ্রলোক উঠে যান। কাগজে মোড়া ছোটো একটি প্যাকেট একরকম ছুড়ে দিয়ে আবার চাপা স্বরে বলেন, লজ্জা-ঘৃণা থাকলে, কাল থেকে আর আসবেন না। ছোট্ট মোড়কটি হাতে পেয়ে সুবেশা ভদ্রমহিলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মহামূল্যবান কোহিনূর পাবার আনন্দ তাঁর চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। কোনো কথা বলেন না। নি:শব্দে আবার গাড়িতে ফিরে আসেন।
গড়িয়াহাটের মোড়ে ভিড়ে ঠাসা একটি ওষুধের দোকানে এটি প্রতিদিনের দৃশ্য। এই দৃশ্য গত একদশক ধরে একই সময়ে অভিনীত হচ্ছে।
ছোট্ট মোড়কে কী আছে? তন্দ্রা উদ্রেককারী স্বর্গীয় স্বপ্ন-সঞ্চারী একটি ওষুধ। মরফিন। প্রতিদিন মরফিন চাই ভদ্রমহিলার। মরফিন ইনজেকশন নিয়ে ঘরে বসে তিনি স্বর্গের স্বপ্ন রচনা করেন। পার্থিব জগতের একঘেয়ে বিরক্তি থেকে মুক্তি নেন। মনকে রঙিন করে নন্দনকাননের অনিন্দিতা হয়ে ওঠেন। আজ আর উনি একা নন। ওঁর মতো কয়েক শত, হয়তো কয়েক হাজার, অথবা কয়েক লক্ষ ছেলে-মেয়ে ড্রাগের শিকার। নেশার ড্রাগ আজ ড্রাগের নেশায় রূপান্তরিত। এই রূপান্তরণের ইতিহাস বড়ো ব্যাপক এবং ভীষণ বেদনাদায়ক।
সোমরস পানে মনের প্রফুল্লতা আনার যে সাধনা মানবসভ্যতার ঊষালগ্নে শুরু হয়েছিল—হাজার বছর পথ হেঁটে বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে পৌঁছে সেই সাধনা মনোবিকলনের কাজে সিদ্ধিলাভ করেছে। প্রাচীন ভারতে আমাদের সাধু-সন্ত মানসিক শক্তি ও মনকে ঈশ্বরকেন্দ্রিক করার জন্য নিভৃত গুহা ও কন্দরে ধ্যান করতেন, কিন্তু তাঁদের উত্তরসূরি আজকের মানুষ ধ্যানের কঠিন পথ পরিহার করে স্বপ্ন-সঞ্চারী মহৌষধী আবিষ্কার করেছে। দুর্গম পাহাড়ে বসে এখন আর ধ্যানের প্রয়োজন নেই, অর্ধাহারে, অনাহারে দেহকে ক্লিষ্ট করে ঈশ্বর সমীপে পৌঁছোবার কষ্ট নেই। একপুরিয়া অহিফেন, ছোটো একটি এল এস ডি বড়ি অথবা একচিলতে হেরোইন কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বর্গের নন্দনকাননে পৌঁছে দেবে। সেখানে বসে উর্বশী, মেনকা আর রম্ভার সঙ্গে স্বর্গীয় সুধাপান করাবে।
এক সময় ক্র্যাকের ক্রিয়ার কাজ শেষ হয়। যে মন এতক্ষণ রম্ভার সম্ভোগে উৎফুল্লিত ছিল সেই মন ক্লান্তি আর অবসাদে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। হাশিশের ধোঁয়ায় যে দেহ চনমনে চিরাগ হয়ে উঠেছিল—ক্রিয়াশেষে সেই দেহ বিপন্ন হয়ে পড়ে। দেহ ও মন নিয়ে মানুষের যে শক্তি—মাদক শক্তি তাকে অসহায় করে তোলে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন দ্রব্য নিয়ে মানুষ, রক্ত ও ধমনীর ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছে। নিশ্চেতন মনকে উত্তেজিত করার জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে সুরা, রাগী পাকস্থলীকে শান্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বেলেডোনা, উদবেগ আর দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাবার জন্য আবিষ্কৃত হয়েছিল অহিফেন। তপোবনের যুগে যা ছিল ব্যাধি-মুক্তির প্রয়াস, আণবিক যুগে তাই হয়ে উঠেছে ব্যাধিগ্রস্ত করে তোলার অপপ্রয়াস। আজকের মানুষ দুটি ভয়ংকর শত্রুর মুখোমুখি। একটি পরমাণু বোমার আতঙ্ক, অপরটি ড্রাগের নেশা। এই দুটি হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান সভ্যতার অভিশাপ। পরমাণু বোমার কথা থাক, এ নিবন্ধকে মাদক শক্তির কথায় নিবদ্ধ রাখা যাক।
মাদকাসক্তি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে যুব-সম্প্রদায়ের মধ্যে। কেন বাড়ছে, তার কতগুলি লৌকিক কারণ অনেকেই বলেছেন। এখনও নতুন করে অনেকেই ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছেন। তাঁদের সেই ব্যাখ্যা অর্থ ও সমাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন পৃথিবীব্যাপী মাদক শক্তির নির্বাধায় রাজত্ব করার অন্তরালে একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। বিশ্বের, বিশেষ করে উন্নতিশীল দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেবার জন্য এই ষড়যন্ত্র। কে এই ষড়যন্ত্রের খলনায়ক? স্পষ্টভাবে তা কেউ জানে না। কিন্তু অদ্ভূত বিস্ময়ের ব্যাপার, সব দেশই উদবিগ্ন, কিন্তু সম্মিলিত প্রয়াস নিয়ে এই শক্তির বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধ ঘোষণা করছে না। শুধু একটা ছায়ার বিরুদ্ধে ফলপ্রসূহীন সংগ্রামের স্লোগান তুলছে। যারা ধরা পড়ছে তারা মৃতসৈনিক।
তিল তিল করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পঙ্গু করার এই ‘ষড়যন্ত্র’ এখন অনেক গভীরে, এর জাল অনেকদূর বিস্তৃত। এই জাল ধ্বংস করতে শুধু আইন আর অর্ডিন্যান্স প্রয়োগ করলে চলবে না। একে ধ্বংস করতে দরকার সম্মিলিত সামাজিক বিপ্লব। এই বিপ্লব কোনো একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ঘটাতে পারে না। সবরকম প্রতিষ্ঠানের প্রয়াসে মাদক শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হতে পারে। বিপ্লব না ঘটলে, পরমাণু বোমার চেয়ে শক্তিশালী মাদক শক্তিকে ধ্বংস করা যাবে না। উঠতি বয়েসের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ড্রাগ, পেপ, পিল আর ক্যাপসুল ক্রমাগত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ছাত্রাবাসগুলিতে নেশার ড্রাগের বাড়বাড়ন্ত।
সম্প্রতি কলকাতার সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ও বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ড্রাগের নেশা আর নেশার ড্রাগ নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছেন। সমীক্ষার শেষে সমীক্ষকেরা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ছাত্রাবাসে বসবাসকারী মেডিক্যাল ছাত্রদের মধ্যে ড্রাগের নেশা একটা ভয়ংকর স্তরে এসে পৌঁছেছে অভিভাবকদের দৃষ্টির বাইরে থাকার ফলে, ড্রাগের ছোবল তাদের ওপর বেশি করে পড়েছে। তাদের কাছে নেশার ড্রাগ সহজলভ্য বলেই, আক্রান্ত তারাই বেশি হচ্ছে।
উন্নত দেশে যা ফ্যাশন হিসেবে শুরু হয়েছিল, উন্নতিশীল ও অনুন্নত দেশে তাই হন্তারক হয়ে উঠেছে। ধরতে গেলে গোটা পৃথিবীতে ড্রাগের নেশা মহামারির আকার ধারণ করেছে। স্বপ্ন-সঞ্চারী, তন্দ্রা-উদ্রেককারী উত্তেজক ড্রাগ উঠতি প্রজন্মের দেহ ও মনকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন এই নেশার ড্রাগের মহামারি সচ্ছল দেশগুলিতে বেশি। কথাটি আংশিক সত্য হলেও পুরো সত্য নয়। উন্নতিশীল ও পিছিয়ে পড়া দেশেও এই সর্বনাশা মাদক শক্তি প্রচন্ড প্রভাব বিস্তার করেছে।
কেন এই ড্রাগের নেশা ছড়াচ্ছে? কেন উঠতি বয়েসের ছেলে-মেয়েরা ড্রাগের জালে জড়িয়ে পড়ছে? অনেকেই কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এ পর্যন্ত যেসব কারণের সন্ধান পাওয়া গেছে তা হল ড্রাগ মনে একটা থ্রিল বা শিহরন তোলে। ড্রাগ ভুলিয়ে দেয় পার্থিব উদবেগ, ড্রাগ ভুলিয়ে দেয় প্রেমের ব্যর্থতা। সাময়িক হলেও এক তুরীয় আনন্দে পৌঁছে দেয়। তারপর? ড্রাগের ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার সংগ্রামে প্রতিনিয়ত দেহ ও মন ক্ষয় হতে থাকে। বড়ো বেশি দ্রুত ক্ষয় হয়। স্মৃতি-বিভ্রম ঘটে। ধমনী নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে দেহ-মন এক সময়ে পঙ্গু হয়ে যায়। শুরু থেকে শেষ হতে সময় লাগে মাত্র কয়েক মাস। সর্বস্ব ত্যাগ করে যে পিতা-মাতা ছেলে-মেয়েদের মানুষ করার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন— নেশার ড্রাগের শিকার হয়ে সেই পিতা-মাতার চোখের সামনে ছেলে বা মেয়ে শেষের সেই ভয়ংকর দিনের জন্য অপেক্ষা করছে। মাদকাসক্ত নেশার অসহনীয় যন্ত্রণা পরে উপলব্ধি করতে পারলেও তার কবল থেকে সে আর নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। একবেলা ভাত না খেয়ে থাকতে তার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু ঠিক সময় নেশার ড্রাগ না পেলে তার মস্তিষ্কের বৈকল্য ঘটবে। পয়সা নেই, পাঠ্যপুস্তক আছে, মায়ের গয়না আছে, ঘরে গেরস্থালির তৈজসপত্র আছে, তাই বিক্রি করে তাকে নেশার ড্রাগ কিনতেই হবে। খাবার না থাকলেও চলতে পারে, কিন্তু নেশার ড্রাগ না পেলে উন্মত্ত হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
কোথা থেকে এই সর্বনাশা ড্রাগ আসছে? হদিশ যে মেলেনি, তা নয়। ড্রাগের উৎস সব দেশের কতৃপক্ষ জানেন। উৎস-মুখেই একে ধ্বংস করার সম্মিলিত চেষ্টা চললেও—সাফল্য এখনও অনেক দূরে। এই নেশা আমদানির মূল উৎস দুটি। একটা ব্যাপক এলাকা জুড়ে নেশার বাজার ছড়িয়ে আছে। এই এলাকাকে বিশেষজ্ঞমহল নামকরণ করেছেন— গোল্ডেন ট্র্যাঙ্গেল বা সোনালি ত্রিভুজ। স্বর্ণ ত্রিভুজের সীমানা বলা হয়েছে থাইল্যাণ্ড সীমানা থেকে বার্মা ও লাওস। এই স্বর্ণ ত্রিবর্গের মূলকেন্দ্র হল হংকং। অহিফেনের সম্রাট খুন-সার রাজত্ব হল এই স্বর্ণ ত্রিভুজ। যদিও দাবি করা হয়, ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে থাইল্যাণ্ডের স্থল ও বায়ু সেনা এই ত্রিভুজকে ধ্বংস করে দিয়েছে—কিন্তু সেখান থেকে নেশার ড্রাগের চোরাপথে রপ্তানি বন্ধ হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা দ্বিতীয় উৎসস্থলের নাম দিয়েছেন গোল্ডেন ক্রিসেন্ট বা স্বর্ণ অর্ধচন্দ্রাকার। ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ত্রিসঙ্গম। ইউরোপের যেসব দেশে হেরোইন ধরা পড়েছে, দেখা যাচ্ছে তার বেশিরভাগই রপ্তানি করা হয়েছে স্বর্ণ ত্রিসঙ্গম থেকে। যার কার্যত রাজধানী হল পাকিস্তান। সংবাদে প্রকাশ, চোরাপথে হেরোইন রপ্তানির বিষয়ে আমেরিকা পাকিস্তানের কাছে বার বার প্রতিবাদ করেছে। এমনকী চোরাগোপ্তা হেরোইন রপ্তানি বন্ধ করতে পাকিস্তান অপারগ হলে আমেরিকা সাহায্য বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়েছিল। হেরোইন মার্কিন মুলুকে একটা ভয়াবহ সমস্যা।
আমেরিকায় যা ফ্যাশন হয়ে ঢুকেছিল ষাটের দশক থেকে তাই আমাদের দেশে হন্তারকের ভূমিকা গ্রহণ করতে শুরু করেছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা অতিক্রম করে, গ্রামাঞ্চলেও এ সর্বনাশা নেশার ঢেউ পৌঁছে গেছে।
তুরীয় আনন্দে মেতে ওঠার জন্য ধনীর দুলালেরা যে নেশার ড্রাগ খেতে শুরু করেছিল—কালক্রমে তাই ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে ড্রাগের নেশায় রূপান্তরিত হয়েছে। মেধাবী ও বুদ্ধিমান যুবক-যুবতী এই ড্রাগের নেশার বড়ো শিকার। এই নেশার ছোবলে তাদের মেধা বিধ্বস্ত আর বুদ্ধির বিলুপ্তি ঘটেছে। এককথায় এখন তারা দেহ ও মনে নি:স্ব। স্বপ্ন-সঞ্চারী ড্রাগ তাদের জীবনকে বড়ো অসহায় আর বিড়ম্বিত করে তুলেছে।
মেয়েরাও এই নেশার ড্রাগের কবল থেকে মুক্ত নয়। কতগুলি বিশেষ দৈহিক ও মানসিক কারণে, বেদনা-হরক ওষুধের প্রতি মেয়েদের একটা দুর্বলতা আছে। ব্যথা থেকে মুক্তির জন্য নেশার ড্রাগ তাদের মধ্যেও বিস্তার লাভ করছে। অর্থাৎ ঘরে-বাইরে এই শত্রুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
আমাদের দেশে কত মাদকাসক্ত আছে তার সঠিক কোনো হিসেব নেই। করাও প্রকৃতপক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি হিসেব দিয়েছেন। এই হিসেব থেকে নেশার ড্রাগের বাড়বাড়ন্তের একটা আবছা ধারণা পাওয়া যেতে পারে মাত্র।
মুম্বাই মহানগরী দেড়-লক্ষাধিক মাদকাসক্ত নিয়ে দেশের সব মহানগরীর মধ্যে শীর্ষস্থানে আছে, তার পরের স্থান রাজধানী দিল্লির। সেখানে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় একলক্ষ। কলকাতার স্থান তৃতীয়। মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় সত্তর হাজার। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, চলতি হারে ড্রাগের নেশা বেড়ে চললে, এই শতাব্দীর শেষে সারাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা এসে দাঁড়াবে দু-কোটি। কেউ কেউ ভাবতে পারেন ১২৫ কোটি লোকের দেশে দু-কোটি মাদকাসক্ত থাকলে কী আর ক্ষতি হবে!
ড্রাগের ক্রিয়ার কম-বেশি তারতম্য আছে। চিকিৎসকেরা মনে করেন, স্ম্যাকে যাদের আসক্তি তারা হাতের বাইরে চলে গেছে। এবং অচিরেই তারা জীবনের বাইরে চলে যাবে।
হেরোইন মানুষকে ক্রমাগত উন্মত্ত অপরাধী করে তোলে। হেরোইন এমন একটি নেশার ড্রাগ যা মানুষের কোমল বৃত্তিকে বিনষ্ট করে তাকে অপরাধপ্রবণ করে তুলবেই।
একগ্রাম ব্রাউন সুগারের দাম পথে-ঘাটে ষাট টাকা। ব্রাউন সুগারে যাদের আসক্তি তাদের প্রতিদিন একগ্রাম চাই-ই। ষাট টাকা সংগ্রহ করা তার পক্ষে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। অথচ এই নেশা না পেলে সে খুনি হয়ে উঠবেই। ইম্ফলে এই ধরনের কয়েকটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ব্রাউন সুগারের প্রাধান্য ইম্ফলেই বেশি। ধরতে গেলে গোটা ইম্ফল ভ্যালি ব্রাউন সুগারের কবলে। ইম্ফল থেকে ব্রাউন সুগারের ছোটো ছোটো পুরিয়া চোরাপথে চালান হচ্ছে অন্যান্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে।
এই উপমহাদেশ এখন নেশার ড্রাগে আচ্ছন্ন। নেপাল, বার্মা ও শ্রীলঙ্কায় মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। পাকিস্তান থেকে হেরোইনের চোরাচালান আমেরিকা ও ইউরোপে চলেছে। সেখানকার অবস্থা প্রায় আয়ত্তের বাইরে। দু-দশক আগেও হেরোইনের নাম সেখানে অজানা ছিল—পাকিস্তান সরকারের স্বীকৃতি থেকে জানা যায়, বর্তমানে সে-দেশে একমাত্র হেরোইন আসক্তের সংখ্যা প্রায় আট লক্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্টের জনৈক সমাজবিজ্ঞানীর মতে, পাকিস্তানে মাথাপিছু হেরোইনের ব্যবহার আমেরিকার দ্বিগুণ।
আমাদের দেশও ধোয়া-তুলসী পাতা নয়। সত্যি কথা বলতে বাধা নেই। মাদক শক্তি ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে আমরা নিজেদের পাপস্খালন করতে পারি না। সহজ কথায়, এই পরিণতির জন্য আমরা নিজেরাই কিছুটা দায়ী। মাদক শক্তি যখন প্রায় মহামারিতে পরিণত হয়েছে তখনও আমাদের দেশে পপির চাষ বেড়েই চলেছে। একটা ছোটো হিসেব তুলে ধরলেই আমাদের নিজেদের পাপ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারত পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম আফিং উৎপাদক দেশ। পপি চাষের এলাকা ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৩৮০০০ হেক্টর থেকে বাড়িয়ে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৬৬০০০ হেক্টর করা হয়েছে। শেষ হিসেব অজানা। সম্ভবত পপির চাষের এলাকা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আফিং-এর উৎপাদন বেড়েছে ৭৯০ টন থেকে ১৬৫০ টন।
গাঁজা চাষ বেআইনি। সরকারি অনুমতি ব্যতীত নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া কেউ গাঁজা চাষ করতে পারবে না। কিন্তু বেআইনিভাবে শত শত হেক্টর জমিতে গাঁজা চাষ চলছে।
ড্রাগের নেশার বাড়বাড়ন্তে সরকারও উদবিগ্ন। কেন্দ্রীয় সরকার নারকটিকস ড্রাগস ও সাইকোট্রফিকস সাবস্ট্যানস অ্যাক্ট ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে কার্যকর করেছেন। অ্যাক্ট অনুসারে প্রতিটি রাজ্য সরকারকে বিশেষ নারকটিকস সেল গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমদানির উৎসপথে তল্লাশি ও খবরদারি জোরদার করা হয়েছে। নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও চোরাপথে নেশার ড্রাগ আসছে এবং তা রোখা যাচ্ছে না। সজাগ পাহারা আর সতর্ক দৃষ্টি রাখার ফলে চোরাপথে আমদানি বর্তমানে কিছুটা থমকে গেছে। আটকের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে যেখানে মাত্র চার কেজি হেরোইন ধরা পড়েছিল কড়া দৃষ্টি রাখার ফলে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তার মাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১.২ টন। অর্থাৎ গোটা ইউরোপ ও আমেরিকায় যে পরিমাণ নেশার ড্রাগ ধরা পড়েছিল—এর পরিমাণ তার তিনগুণ! আর মূল্য? সাত বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ আমাদের দেশের সপ্তম পরিকল্পনার এক তৃতীয়াংশ। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দকে আমরা নির্দ্বিধায় নেশার ড্রাগ আটকের প্লাবন বলে আখ্যা দিতে পারি। ওই বছর সারাদেশে আটক নেশার ড্রাগের পরিমাণ ছিল ২.৭ টন। এই ড্রাগ খাইয়ে একসঙ্গে যত মানুষকে পঙ্গু করা যায় একটা আণবিক বোমার বিস্ফোরণে হয়তো মৃতের সংখ্যা এত হবে না। বিশেষজ্ঞদের কাছে নেশার ড্রাগ পরমাণু বোমার মতোই ভয়ংকর বিভীষিকা।
অঙ্কুরে বিনাশ না করার ফলে বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি প্রায় যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের নারকটিকস অ্যাক্ট কার্যকর করা ছাড়াও সম্প্রতি একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে নেশার ড্রাগের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিন্তু আইন করেই কি সব কিছু বন্ধ করা যায়? অতীতেও যায়নি, বর্তমানেও যাবে না, ভবিষ্যতেও হয়তো সম্ভব হবে না। আইনের সঙ্গে আরও কিছু ব্যবস্থা চাই। চাই ভালোবাসা আর সেবা। এই দুটি অস্ত্র দিয়েই মাদকাসক্তদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব হতে পারে। সময় লাগলেও সেটাই হবে স্থায়ী ব্যবস্থা।
নেশা থেকে মুক্তির বিশেষ কোনো ওষুধ নেই। পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ধ্যান ও যোগ মাদকাসক্তকে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুলতে পারে। দেশের যোগব্যায়াম কেন্দ্রগুলিকে এই কাজে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ধর্মীয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলি এ কাজে এগিয়ে এলে, ড্রাগের নেশার কবল থেকে আমরা বাঁচতে পারি, আমাদের দেশ বাঁচতে পারে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন