গোপালকৃষ্ণ রায়
গত দু-বছর থেকে মহর্ষি ভৃগু তুষারতীর্থ অমরনাথ দর্শনে যাচ্ছেন না। পাকিস্তানি আতঙ্কবাদীরা ভূস্বর্গ কাশ্মীরের শান্ত পরিবেশকে বারুদ পুড়িয়ে উত্তপ্ত করে তুলেছে। এ-কে ৪৭ আর আধুনিক রকেটের আঘাতে পাইন, চিনার ও জোনিফারের ছায়াসুশীতল সুদৃশ্য সরণিকে বিপদসংকুল করে তুলেছে।
এই অমর ঋষি সেই সত্যযুগ থেকে প্রতিবছর তুষার ধৌলি হিমালয় পরিক্রমায় বেরোন। মানস, কৈলাস, কেদারবদরী পরিভ্রমণ করে শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন পৌঁছে যান অমরনাথ। পূর্ণাবয়ব তুষারলিঙ্গ আলিঙ্গন করে ফিরে আসেন শ্রীনগরের কাছে মার্তন্ড মন্দিরে। অমরনাথের পূজারি মহান্তরা এই প্রাচীন মার্তন্ড মন্দিরে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে মহর্ষি ভৃগু আবার ফিরে যান কৈলাসে।
পঁচিশ বার মানস সরোবর পরিক্রমা করে যিনি বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন সেই স্বামী প্রণবানন্দকে আমি মহর্ষি ভৃগু ও মহাভারতের অন্যতম নায়ক অশ্বত্থামার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না জিজ্ঞাসা করেছিলাম। মূলত প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্রণবানন্দ আমার প্রশ্ন শুনে বালকের মতো হেসে উঠেছিলেন।
আলমোড়া আশ্রম থেকে তিনি এসেছিলেন রাঁচি। বিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দিতে। ব্রহ্মপুত্রের উৎসস্থল আবিষ্কারের দাবিদার স্বামী প্রণবানন্দ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আবার যদি কোনো দিন কৈলাস বা মানস সরোবরে যেতে পারি, তাহলে মহর্ষি ভৃগু আর অশ্বত্থামার খোঁজ নেব। মহর্ষির কাছ থেকে তাঁর অমরনাথ আবিষ্কারের কাহিনি জেনে নেব। বলেই অশীতিপর বিজ্ঞান-তাপস প্রণবানন্দ আবার শিশুর মতো হেসে বলেছিলেন, সত্যযুগের মহর্ষি যুগে যুগে মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন।
কিন্তু যা বলছিলাম, সেই সত্যযুগ থেকে নিয়ম করে প্রতিবছর যিনি শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন অমরনাথ গুহায় পৌঁছে যেতেন— সেই মহর্ষি ভৃগু গত দু-বছর থেকে মহাতীর্থে অনুপস্থিত। পাকিস্তানি আতঙ্কবাদীরা কাশ্মিরকে বড়ো বিপদসংকুল করে তুলেছে। মার্তন্ড মন্দির থেকে মহান্তদের পবিত্র ছড়ি নিয়ে পহেলগাঁও যেতে সশস্ত্র রক্ষীবাহিনির সাহায্য নিতে হয়।
কথিত আছে, বহুযুগ আগে মার্তন্ড মন্দির থেকে মহর্ষি ভৃগু ব্যোমযানে কৈলাস ফিরে যেতেন। সে যুগে যে এই ধরনের একটি ব্যাপার ছিল—আজকালকার মানুষ তা বড়ো একটা বিশ্বাস করতে চায় না।
অথচ এরিক ফন দানিকেন কিন্তু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। সাতের দশকে তিনি একবার কলকাতায় এসেছিলেন। ভারতীয় জাদুঘরে তাঁকে দেখার জন্য প্রচন্ড ভিড় হয়েছিল। গ্রহান্তরের মানুষ সম্পর্কে জাদুঘরের সেই মিটিং-এ তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। দানিকেনের ভক্ত ও তাঁর বইয়ের সফল অনুবাদক অজিত দত্ত আমাদের দানিকেন দর্শনের সুযোগ ও সৌভাগ্য ঘটিয়ে দিয়েছিলেন।
দানিকেনের কথায় আসতে হল এইজন্য যে, মার্তন্ড মন্দির থেকে মহর্ষি ভৃগু যে ব্যোমযানে ফিরে যেতেন দানিকেন তা প্রমাণ করেছিলেন। তিনি গাইগার কাউন্টার দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, মার্তন্ড মন্দিরের একটি অংশ তেজস্ক্রিয়। মার্তন্ড মন্দির কবে নির্মিত হয়েছিল সে কাহিনি এখানে উল্লেখের প্রয়োজন নেই। অমরনাথের পুরাকথা ও রহস্য (মিথ ও মিস্ট্রি) লেখার জন্য মহর্ষি থেকে মার্তন্ড, আর মার্তন্ড থেকে মন্ডল মিশ্র পর্যন্ত আমাদের ঘোরা-ফেরা করতে হবে। তার আগে অবশ্য আমরা মহামুনি কশ্যপের কথায় ফিরে আসতে পারি। মহামুনির নামানুসারেই নাকি কাশ্মীরের নামকরণ হয়েছে। পৌরাণিক যুগে কাশ্মীরের নাম ছিল কাশ্যপমার। কাশ্যপমার থেকে কালক্রমে হয়েছে কাশ্মীর। কাশ্মীর যে সেই সত্যযুগ থেকেই মহাভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কাশ্যপমার নাম থেকেই তার যথার্থ প্রমাণ মেলে। পাকিস্তানি ঘোড়ার ডাক যে কতখানি অসার পুরাণ থেকে তার প্রমাণ মেলে।
সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা যে কালে বাস করতেন সেই সত্যযুগে এই উপত্যকায় এক শ্রেণির দানবের বসবাস ছিল। তাদের আচার-আচরণ বর্তমান পাকিস্তানি আতঙ্কবাদীদের মতোই ছিল। তাদের অত্যাচারে শান্তিপ্রিয় মানুষ উপত্যকার সৌন্দর্য অবলোকন করতে যেতে পারত না। মানুষের বেদনা উপলব্ধি করে মুনিবর মহামায়ার তপস্যা করে তাঁকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। দানব-সংহারে মহামায়া অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। অচিরেই উপত্যকায় শান্তি ফিরে এসেছিল। কৃতজ্ঞ মানুষ তখন এই উপত্যকার নাম রেখেছিল কাশ্যপমার। সেই কাশ্যপমার আজকের কাশ্মীরে রূপান্তরিত।
কাশ্যপমারের সৌন্দর্যের কথা একদিন পৌঁছে গেল মহর্ষি ভৃগুর কানে। হিমালয় পরিক্রম করে একদিন তিনি এলেন স্বর্গসম কাশ্যপমারে। এখানে আসার পূর্বেই ধ্যানে তিনি জানতে পেরেছিলেন তুষারলিঙ্গ অমরনাথের কথা। তিনি নিজে তো দর্শন করলেনই—পরমতীর্থ অমরনাথের কথা স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে প্রচার করে বেড়াতে লাগলেন। মহর্ষি প্রথম ঘোষণা করেছিলেন যে, শ্রাবণী পূর্ণিমার পুণ্যলগ্নে গুহা-অভ্যন্তরে তুষারলিঙ্গ দর্শন করলে মানুষ পাপমুক্ত হয়। লিঙ্গের গাত্রবাহিত জলপানে মানবদেহে কোনো রোগ বাসা বাঁধতে পারে না। অমরনাথের মাহাত্ম্য প্রচারে যে মহাতপা ঋষি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন—সেই মহর্ষি ভৃগু গত দু-বছর থেকে অমরনাথ দর্শনে যাচ্ছেন না। যেতে কি তিনি পারেন না? অবশ্যই পারেন। কিন্তু যাচ্ছেন না। একদা যিনি আপামর ভক্তবৃন্দের জন্য অমরনাথের মহিমা প্রচার করে বেড়িয়েছিলেন—সেই ভক্তদের অমরনাথের যাত্রাপথ নাকি এখন বিপদসংকুল। নির্দোষ, নিরপরাধ ভক্তদের যাত্রাপথ যাতে নিরাপদ হয়—এখন তিনি সেই ব্যবস্থাই করছেন।
শেষনাগের বাসুকিও নাকি গত দু-বছর থেকে ছড়িদারদের দুধ-কলা খেতে আসছে না। এখন মহান্তজিরা শেষনাগের হ্রদের ধারে দুধকলা রেখে অমরনাথ দর্শনে যান। আর তাঁদের পিছু পিছু রক্ষী পরিবৃত ভক্তজনেরা চড়াই-উতরাই ভেঙে অমরনাথ দর্শন করে ফিরে আসেন।
সত্যযুগ থেকে এমনই সব নানা কারণে অমরনাথ ভক্তজনের কাছ থেকে মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সম্ভবত এটিই ভগবান অমরনাথের খেলা। তাঁর অপার লীলারই একটি অঙ্গ। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে আবার ফিরে আসতেন মহর্ষি ভৃগু। উদ্দেশ্য এক হলেও অন্যদেহে।
মহামায়া কতৃক দানব সংহারের পর মহর্ষি যখন প্রথম পরিক্রমায় এসেছিলেন তখন কাশ্যপমারের রাজা ছিলেন তক্ষকনাগ। দেব-দ্বিজে তাঁর অগাধ ভক্তি ছিল। তখনও তিনি জানতেন না, অমরনাথ গুহায় স্বয়ম্ভু তুষারলিঙ্গ অবস্থান করছেন। মহর্ষি ভৃগুই অমরনাথের দুর্গম পথের নিশানা তক্ষকনাগকে দিয়েছিলেন। মহর্ষি তক্ষকনাগকে একটি অভয় দন্ডও দান করেছিলেন। সেই দন্ডটি এখনও আছে কি না—তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। তবে ধর্মার্থ সংঘের মহান্তদের কাছে একটি প্রাচীন রৌপ্যদন্ড রয়েছে। যাত্রার পূর্বে দন্ডছড়ি নিয়ে আগে আগে মহান্তরা যান। সত্যযুগের সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানভাবে চলেছে।
পুরাণে বর্ণিত কাহিনি নিয়ে অনেকেই অনেকরকম প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু অমরনাথের প্রাচীনত্ব নিয়ে নিশ্চয়ই কারো দ্বিমত থাকতে পারে না। কবি কলহনের রাজতরঙ্গিণীতেও আমরা গুহাতীর্থের কথা জানতে পারি। কলহন রাজতরঙ্গিণী লিখতে শুরু করেছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। কলহনের পর পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত কাশ্মীরে যে ইতিহাস বিধৃত হয়েছে, তার লেখক ছিলেন কবি জোনরাজ। রাজতরঙ্গিনী সমাপ্ত করেছিলেন জোনরাজের শিষ্য কবি শ্রীবর। সত্যযুগ থেকে ১৪৮৬খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত রাজতরঙ্গিণীর মধ্যে আমরা ইতিহাসের একটি ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই। বিভিন্ন সময়ের পুরাকথার মধ্যেও একটি সাদৃশ্য খুঁজে পাই।
এই রাজতরঙ্গিণী থেকে আমরা গুহাতীর্থ অমরনাথের আরও একটি কাহিনি জানতে পারি। প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে, অর্থাৎ ঘুরে-ফিরে আমরা আবার মহর্ষি ভৃগুর যুগে ফিরে যাচ্ছি, কাশ্মীরের রাজা ছিলেন রামদেব। শুকদেব নামের জনৈক ব্যক্তি কাশ্মীরিদের বড়ো অত্যাচার করছিল। এই শুকদেবকে আমরা সহজেই মনে করতে পারি, পূর্ববর্ণিত দানবদের বংশধর। মহামায়ার রোষ থেকে বোধ হয় কোনোক্রমে বেঁচে গিয়েছিল সে। কিন্তু রাজা রামদেব তার অত্যাচার সহ্য করেননি। অত্যাচারী যে বেশিদিন তার অত্যাচার চালিয়ে যেতে পারে না, এই সত্য প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। কোনো এক সময় তাকে চরম মূল্য দিতে হয়।
রাজতরঙ্গিণী থেকে আমরা জানতে পারি, রাজা রামদেব শুকদেবকে অমরনাথের গুহায় বন্দি করে রেখেছিলেন। পরে বন্দি শুকদেবকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল নীলগঙ্গার প্রবল স্রোতধারায়।
রাজতরঙ্গিণী থেকে আরও জানা যায়, খ্রিস্টের জন্মের চৌত্রিশ বছর পূর্বে তদানীন্তন কাশ্যপমার রাজ সৈদিমতি অমরনাথ যাত্রায় অংশ নিয়ে তুষারলিঙ্গের দর্শন লাভ করেছিলেন।
পুরাণের কল্পকাহিনি পুরোনো হলেও তার পবিত্রতা হারায় না। এরমধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় অনেক মহাজীবন—আর দেবমাহাত্ম্যের অমৃত কাহিনি। বিশ্বাস নিয়ে মাহাত্ম্যের অমৃতে অবগাহন করলে লৌকিক জীবনে শান্তি লাভ করা যায়।
পূর্বেই বলেছি, নানা কারণে ভগবান মাঝে মাঝে ভক্তের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আবার তাকে জোড়া লাগান দেহান্তরিত মহর্ষি ভৃগু বা ঈশ্বরের বরপুত্র কোনো মহাতাপস।
প্রকৃতির নিয়মানুসারে সব কিছুর মধ্যেই মাঝে মাঝে অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। কিন্তু সেই সংকট চিরস্থায়ী হয় না। সংকট-মোচনে কারো আবির্ভাব ঘটে। পথের দিশারি হয়ে তিনি আবার পথ চলতে থাকেন।
অমরনাথের ইতিহাসেও বহুবার অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছিল। প্রতিবারই সেই সংকট দূরীকরণের জন্য কারো না কারো শুভাগমন ঘটেছে। মহর্ষি ভৃগু অন্য দেহ ধারণ করে অমরনাথের মহাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন।
অষ্টম শতাব্দীতে অমরনাথ কিছুদিনের জন্য ভক্তজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আদৌ তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শারদাপীঠের শংকরাচার্য মহর্ষি ভৃগুর স্থান গ্রহণ করেছিলেন। ভক্তের মধ্যেই ভগবানের লীলা প্রকট হয়ে ওঠে।
মাহিষ্মতীতে তর্কযুদ্ধে মন্ডল মিশ্রকে পরাজিত করে দিগবিজয়ী পন্ডিত হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন যুগাবতার শংকরাচার্য। তর্কে পরাভূত মন্ডল মিশ্র তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সেই মন্ডল মিশ্রকে সঙ্গে নিয়ে হিমালয় পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন শংকরাচার্য। ঠিক মহর্ষি ভৃগুর মতো তিনিও একদিন পৌঁছে গিয়েছিলেন কাশ্মীর। তিনিই আবার শুরু করেছিলেন অমরনাথ যাত্রা। প্রায় তেরো-শো বছর আগে শংকরাচার্য যে যাত্রা শুরু করেছিলেন—আজও সেই ধারা সমানভাবে চলেছে। মাত্র বছর দুই হল সেই যাত্রাকে বিঘ্নসংকুল করে তুলেছে পাকিস্তানি আতঙ্কবাদীরা।
এই সুযোগে—আমরা অপর একটি অমরনাথের কথা বলি। না, এই অমরনাথ কাশ্মীরে নয়। এই অমরনাথের অবস্থান ১৩,৫০০ ফুট ওপরে নয়। এই অমরনাথের লিঙ্গ তুষারে নির্মিত হয় না। তবে এই অমরনাথও একটি গুহায় অবস্থান করেন। এই গুহাও প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহা। এই গুহা মেঘালয়ে। এই প্রাগৈতিহাসিক গুহায় রয়েছে দুটি শিবলিঙ্গ। না, মানুষের তৈরি নয়, প্রকৃতি-সৃষ্ট। জায়াগার নাম মৌসিমরাম। গুহাটিকে খাসি ভাষায় বলা হয় মা জুঁইন বুঁইন। অর্থাৎ নারীর স্তন।
অমরনাথের গুহার ছাদ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে পূর্ণিমায় পূর্ণাবয়ব লিঙ্গে পরিণত হয়। কৃষ্ণপক্ষে গলতে গলতে তা আবার মিলিয়ে যায়।
মা জুঁইন বুঁইন গুহার ছাদের সঙ্গে লেগে আছে দুটি সুডৌল নারীর স্তন। শিবলিঙ্গ দুটির ঠিক ওপরে। আর সেই স্তন থেকে শত-সহস্র বছর ধরে লিঙ্গের মাথায় ফোঁটা ফোঁটা দুধ পড়ছে। কখনো দুধ পড়া বন্ধ হয়নি। দুটি ফোঁটার মাঝে সময়ের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। মা জুঁইন বুঁইন কে কবে আবিষ্কার করেছিলেন তার কোনো ইতিহাস নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মা জুঁইন-বুঁইন নিয়ে ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা হয়েছে। যখন কোনো কিছুর কুল-কিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না, যখন বুদ্ধিতে কোনো ব্যাখ্যা মেলে না, আমরা তখন সহজেই একটি দাওয়াই বাতলে দিই। সেই দাওয়াইয়ের নাম ন্যাচারাল ফেনোমেনন বা প্রাকৃতিক বিস্ময়।
মা জুঁইন বুঁইনের সঙ্গে তুষারলিঙ্গ অমরনাথের চরিত্রগত কোনো সাদৃশ্য নেই ঠিকই কিন্তু একজায়গায় আমরা বিশেষ মিল লক্ষ্য করতে পারি। দুটি ‘প্রাকৃতিক বিস্ময়’ গুহার অভ্যন্তরে—আর সেই গুহার বয়েসের কোনো গাছ-পাথর নেই। আর একটি সাদৃশ্য হল, অমরনাথের গুহার ছাদ দিয়ে বিন্দু বিন্দু জল পড়ে তুষার লিঙ্গের জন্ম হয়। মা জুঁইন বুঁইনের শিবলিঙ্গেও মাতৃস্তন থেকে ফোঁটা ফোঁটা দুধ পড়ে।
কালাপাহাড় অতীতেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। বেশ কিছুদিন আগে কোনো এক কালাপাহাড় মা জুঁইন বুঁইনের একটি স্তন কেটে দিয়েছে। তখন থেকেই সেই স্তন দিয়ে দুগ্ধ নির্গমন বন্ধ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতাও প্রায় অর্জন করে ফেলেছে আধুনিক বিজ্ঞান। কিন্তু পরিতাপের বিষয় কর্তিত স্তনটি কেউ মেরামত করতে পারেনি। করা সম্ভব হয়নি।
মেঘালয়ের অমরনাথ নিয়ে বিশেষ কোনো কল্পকাহিনি নেই। কোনো পুরাণেও তার অস্তিত্বের কথা উল্লেখ নেই। কিন্তু রহস্য আছে। এই প্রাকৃতিক রহস্যের সন্ধানের কাজ এখনও চলেছে।
আবার আমরা ফিরে আসি তুষারতীর্থ অমরনাথে। ভূবিজ্ঞানীদের মতে এটিও একটি প্রাকৃতিক বিস্ময়। ন্যাচারাল ফেনোমেনন। সবটাই ক্লাইমেটিক কন্ট্রোল।
যেদিন জলবায়ু, আবহাওয়া, পরিবেশ ও পরিমন্ডলের পরিবর্তন ঘটবে সেইদিন প্রাকৃতিক বিস্ময়গুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। অথবা লুপ্ত হয়ে যাবে। কাউকে আহত করার জন্য ভূতাত্ত্বিকেরা এ-মত পোষণ করেন না। এটি চিরাচরিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। এ ব্যাখ্যা গ্রহণে না আছে পীড়ন, না আছে প্রেরণা।
শুধু শ্রাবণী পূর্ণিমাতেই ভক্তজনেরা অমরনাথ যান না। বহু প্রকৃতিপ্রেমিক গুরু পূর্ণিমাতেও অমরনাথের তুষারলিঙ্গ দর্শন করেন। শংকারাচার্য উভয় পূর্ণিমাতেই অমরনাথ দর্শন করেছেন।
তুষারতীর্থ অমরনাথের সঙ্গে কিছু লোমহর্ষক কিংবদন্তিও জড়িয়ে আছে। এইসব কিংবদন্তির জন্ম মহর্ষি ভৃগুর আমলে হয়নি। হয়েছে মধ্যযুগে। ষোড়শ শতাব্দীর কথা। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরকে সাম্রাজ্যভুক্ত করার জন্য সম্রাট আকবর সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। তখন কাশ্মীরের সুলতান ছিলেন ইউসুফ খান। মোগল সৈন্যের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা বীরবল। কথিত, আক্রমণের পূর্বে অমরনাথকে স্মরণ করতে রাজা বীরবল ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে তিনি যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। এমনকী অমিতবিক্রম সম্রাটের সৈন্যেরা তাদের সেনাপতি বীরবলের দেহটিও খুঁজে পায়নি। এই ঘটনার পর সম্রাট আকবর অমরনাথ যাত্রীর স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। আইন-ই আকবরিতে অমরনাথের অনেক কথার উল্লেখ আছে।
মহর্ষি ভৃগু থেকে স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকলে প্রায় একই ভাষায় অমরনাথের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। পূর্বেই বলেছি, মাঝে মাঝে ভক্তের কাছ থেকে ভগবান বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। আবার কাউকে উপলক্ষ্য করে মিলনের সেতু গড়ে ওঠে। ভক্ত আর অমরনাথের মধ্যে শেষ মিলনের সেতু গড়ে তুলেছিলেন যিনি তাঁর নাম আক্রমবাট মল্লিক। অর্ধবিচরণশীল মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত মেষপালক। হারিয়ে যাওয়া মেষ খুঁজতে খুঁজতে আক্রমবাট নতুন করে অমরনাথ আবিষ্কার করেছিলেন। প্রাকৃতিক পরমবিস্ময়ের কথা গ্রামে ফিরে এসে প্রচার করেছিলেন তিনি। এই ঘটনা থেকে মনে করা যেতে পারে, অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কিছুদিনের জন্য অমরনাথ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
আক্রমবাটের বংশধরেরা আজও জীবিত। পুনরাবিষ্কারের সুবাদে তাঁরা অমরনাথের পূজার্ঘ্যের অংশীদার। ভক্তজনেরা অর্ঘ্যের এক তৃতীয়াংশের মালিক। বাকি দু-ভাগ পান মার্তন্ডমন্দিরের পূজারি আর ছড়িদার মহান্ত।
যাঁরা অমরনাথ যাত্রায় অংশ নেন তাঁরা নিজেদের জাতপাত বাক্সবন্দি করে রেখে যান পহেলগাঁও-এ। যাত্রা পথে সকলেই অমরনাথের ভক্ত। কেউ হিন্দু নন, কেউ মুসলমান নন, কেউ খ্রিস্টান নন, কেউ বৌদ্ধ-জৈন-শিখ নন। সমবেত কন্ঠে অরমনাথের জয়ধ্বনি করে পরস্পরকে আগলে তাঁরা দুর্গম পথ অতিক্রম করেন।
পরমবিস্ময়ের কথা হল, তুষারতীর্থে যাঁরা ‘বিভূতি’ বিতরণ করেন—তাঁরা কেউই ব্রাহ্মণ পূজারি নন—তাঁরা মুসলমান। অমরনাথ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহান প্রতীক।
মেষপালক আক্রমবাট যে অমরনাথ পুনরাবিষ্কার করেছিলেন—স্বামী বিবেকানন্দ সেকথা স্বীকার করেছেন।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভগিনী নিবেদিতাকে সঙ্গে নিয়ে অমরনাথ দর্শনে গিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। অমরনাথের কাছ থেকেই তিনি ইচ্ছা-মৃত্যু বর পেয়েছিলেন। দর্শন শেষে স্বামীজি ভগিনী নিবেদিতাকে সেকথা বলেছিলেন, সেই কথা দিয়েই এই নিবন্ধ শেষ করা যাক।
‘আই থট দ্যাট দ্য আইস লিঙ্গম ওয়াজ শিব হিমসেলফ।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন