গোপালকৃষ্ণ রায়
কাঁকের থেকে কোণ্ডাগাঁও। বাসে মাত্র দু-ঘণ্টার পথ। দু-দিকের গভীর বন চিরে ৪৩ নম্বর জাতীয় সড়ক সোজা চলে গেছে বস্তার জেলার সদর শহর জগদলপুর। কোণ্ডাগাঁও বস্তারের মহকুমা শহর। কোর্ট, কাছারি, স্কুল-কলেজ বিজলি থাকলেও, মহকুমা শহরের ঔজ্জ্বল্য পায়নি। জাতীয় সড়ক ছাড়া শহরের রাস্তাঘাট এখনও পাকা হয়নি। মহকুমা শহরের মর্যাদা নিয়েও কোণ্ডাগাঁও এখনও ঊনবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় পড়ে রয়েছে। বঞ্চিত আদিবাসীরা এতে খুশি। কাঁকুরে রাঙা মাটির পথের দু-ধারে আকাশমুখী শাল-সেগুন-অঞ্জন-অর্জুন। ঘন সবুজ পাতায় সতেজ যৌবন। নগ্ন পায়ে এই পথেই দলবেঁধে গ্রাম থেকে শহরে আসে মুড়িয়া হালবা আর ধুরওয়ারা। পরনে একই ধরনের শাড়ি, মাথায় একই রকমের টুকরি, পথ চলায় একই রকমের ছন্দ। সওদা শেষে, দল বেঁধে গলায় সমবেত সুর তুলে, সেই পথ ধরেই গ্রামে ফিরে যায় তারা।
কোণ্ডাগাঁও বাস স্ট্যাণ্ডে অপেক্ষা করছিলেন অধ্যাপক পান্ডে। নৃতাত্ত্বিক ইন্দু বিকাশ পান্ডে। স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক। অধ্যাপনার ফাঁকে ফাঁকে অরণ্যের অগ্নিশিখা মুড়িয়াদের শিল্পচর্চা নিয়ে সময় কাটান। পঞ্চাশোর্ধ মানুষটি সর্বদাই রসেবশে থাকেন।
স্কুটারে বসেই অধ্যাপক পান্ডে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি তামাক খান?
মুড়িয়াদের শিল্পচর্চার সঙ্গে তামাকের কী সম্পর্ক ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। তাঁর প্রশ্নের আরও ব্যাখ্যার জন্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
অধ্যাপক পান্ডে বলেন, মুড়িয়াদের জীবনে তামাকের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে।
—আরও একটু বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দরকার।
অধ্যাপক পান্ডে আর সেদিকে হাঁটেন না। স্কুটার স্টার্ট দিয়ে বলেন, বসে পড়ুন।
যাচ্ছি মালকোট। মুড়িয়াদের একটি গ্রাম। তাদের ঘটুল দেখতে এই গ্রামে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরা গিয়েছেন। এখনও অনেকেই যান।
কোণ্ডাগাঁও শহর থেকে মালকোট দশ কিমি। ৪৩ নম্বর জাতীয় সড়কের মতো মসৃণ পথ নয়। কাঁচা কাঁকুরে রাস্তা। দু-পাশে অঞ্জন, আমলা, অর্জুন আর বহেরা গাছের ঘন বন। লতা-গুল্ম আর দীর্ঘ ঘাস বনকে আরও গহন করে তুলেছে। আঁকা-বাঁকা পথ। মাঝে মাঝেই ছোটো-বড়ো টিলাকে পাকদন্ডী করে এগোতে হয়। তবে পথ শ্বাপদসংকুল নয়। মাংসাশী প্রাণীরা থাকে আরও অনেক ভেতরে। গভীর জঙ্গলে। বরাত ভালো থাকলে, দু-একটা দলছুট হরিণ ও দু-চারটি খরগোশ চোখে পড়ে।
পথ চলতে চলতেই অধ্যাপক পান্ডেকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি তামাক সেবনের কথা জানতে চাইলেন কেন? অধ্যাপক পান্ডে একটা বাঁকা মোড় কাটিয়ে, অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গায় স্কুটার থামালেন। জায়গাটি অবশ্যই সুন্দর। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে চারটে বড়ো গাছ অঞ্জন, আমলা, অর্জুন আর বহেরা পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। মনে হয় একটা কান্ডের মধ্যেই চারটি ভিন্ন প্রজাতির গাছের জন্ম। ভালোবাসায় পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। অথচ ডালে আর পাতায় নিজস্ব পরিচয় মেলে ধরেছে। মালকোটের মুড়িয়ারা যাতায়াতের পথে এখানে বিশ্রাম নেয়। তারা মনে করে এই বৃক্ষ চতুষ্টয়ের মধ্যে তাদের আরাধ্য দেবতা, সর্বশক্তিমান লিঙ্গপেন অবস্থান করেন।
লিঙ্গপেন কী?
অধ্যাপক পান্ডে বলেন, মালকোটে গিয়ে লিঙ্গপেনের কথা বলব। এখন তামাকের কথা শুনুন। যাত্রার শুরুতেই অধ্যাপক পান্ডে তামাক সেবনের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
তিনি বলেন, আমাদের অনেকের ঘরেই তাম্বুলবাটা থাকে। কারো ঘরে সোনার, কারো ঘরে রূপোর আবার কেউ বা রাখেন পিতলের। কত নকশাই না থাকে সেই সব পানবাটায়। পানবাটার মধ্যে প্রকাশ সেই পরিবারের শিল্পরুচি। মুড়িয়াদের তামাক বাটা শুধু শিল্প নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রেম ও ভালোবাসা।
ইন্টারেস্টিং।
অধ্যাপক পান্ডে বলেন, মুড়িয়াদের তামাক বাটা কাঠের। ঠিক ভরা যৌবনা যুবতীর স্তনের মতো দেখতে।
স্টপারটি ঠিক নিপ্পলের মতো। বলেই হেসে ওঠেন অধ্যাপক পান্ডে। সর্বদাই রসেবশে থাকেন তিনি।
তামাকবাটা দিয়ে মুড়িয়াদের প্রেমপর্বের শুরু। মুড়িয়া যুবক কোনো যুবতীর অন্তরঙ্গ হতে তামাকবাটার সাহায্য নেয়।
শুধু একরকমের তামাকবাটা তৈরি করে না তারা। কারুকার্য খচিত নানারকমের তামাক বাটা তৈরি করে। কোনো কোনো তামাক বাটা কচ্ছপের আকৃতিতে তৈরি হয়। তার গায়ে অত্যন্ত সুচারুভাবে সূর্য-চন্দ্র-তারা ও নানা জন্তুজানোয়ার খোদিত থাকে। কাঠের গায়ে সে এক অপূর্ব শিল্পকলা। মুড়িয়ারা অত্যন্ত দক্ষ কাষ্ঠ শিল্পী। এই শিল্পবোধ তাদের জন্মগত। অবশ্য দক্ষিণ বস্তারের অবুঝমারের মারিয়ারাও কাষ্ঠ শিল্পে সমান দক্ষ।
কাঁকই বা কঙ্কতিকা তৈরিতে মুড়িয়াদের তুলনা মেলা ভার। কাঠ দিয়ে মুড়িয়া কন্যারা কাঁকই বা বড়ো দাঁড়ের চিরুনি তৈরি করে। তাদের কেশ-বিন্যাস এক অনবদ্য শিল্প। কাঁকইয়ের সঙ্গে ব্যবহার করে কাঠের হেয়ার পিন বা কাঁটা। অবশ্য কাঁকই আর কাঁটা মুড়িয়া মেয়েরা ঘটুলেই ব্যবহার করে বেশি। মুড়িয়া কন্যাদের কঙ্কতিকা শিল্প অতুলনীয়। কঙ্কতিকার সঙ্গে কিছু সংস্কারও জড়িয়ে আছে। কাঁকই নিয়ে মুড়িয়াদের মধ্যে একটি সুন্দর প্রবাদ আছে। কাঁকই হল শুষ্ক ডালে প্রস্ফুটিত ফুল, কাঁকই বড়ো গোপন বস্তু / তামাকবাটা দিয়ে যদি প্রেমপর্ব শুরু হয়, কাঁকই দিয়ে তা পরিণতি লাভ করে। কোনো যুবতী কাঁকই গ্রহণ করলে, তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হয়। তাই কোনো মেয়ে চট করে কারো কাছ থেকে কাঁকই গ্রহণ করে না। ঘটুলে তো কাঁকই দেওয়াই নিষিদ্ধ।
অধ্যাপক পান্ডে বলেন, মুড়িয়াদের কাষ্ঠশিল্প নিয়ে দিনভর গল্প করা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় কী জানেন, এই শিল্পকে জনপ্রিয় করে তোলার কোনো পরিকল্পনা নেই। অ-আদিবাসীরা মুড়িয়াদের শিল্প সামগ্রী দেখে মুগ্ধ হয়, কিন্তু দৈবাৎ দু-একটি উপহার ছাড়া, তারা এসব জোগাড় করতে পারে না। পরিকল্পনা মাফিক কিছু করলে, দারিদ্র্যের সীমারেখার নীচে বসবাসকারি মুড়িয়াদের জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন হত।
একমাত্র কাঁকইয়ের গায়েই যে কতরকমের মোটিফ থাকে, না দেখলে তা কেউ বিশ্বাস করবে না। মুড়িয়ারা প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির মধ্যেই তারা তাদের জীবন, প্রকৃতি ও জীবিকার সন্ধান করে। তাদের শিল্পকলার মধ্যেও প্রকৃতির প্রাধান্য। গাছ, ফল, ফুল—এমনকী বন্যজন্তুর মোটিফ শুধু কাঁকইয়ের ওপর খোদাই করে না। প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় জিনিসের গায়েও প্রকৃতিকে খোদাই করে রাখে। তামাকবাটায় জীবন আর জৈবিক প্রকরণ ও জীবন সম্পর্কে মুড়িয়াদের ধারণা প্রতিফলিত হয়। কাঁকই ও অন্যান্য তৈজসপত্রে এমন কতকগুলি নকশা তৈরি করে, যা হরপ্পার সভ্যতাকে মনে করিয়ে দেয়। নাচের লাঠি, বাঁশি এমনকী সলকী পানের পাত্রটিকেও নানা মোটিফে দৃষ্টিনন্দন করে। জীবনকে যেমন তারা শিল্পের মধ্যে ধরে রাখে, মৃত্যুতেও তারা তেমনি সেই শিল্পেরই জয়গান গায়। তারা বিশ্বাস করে আদি শিল্পী লিঙ্গপেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে। সেজন্য তারাও তাদের রক্তকণিকায়, লিঙ্গপেনের উপস্থিতি অনুভব করে। লিঙ্গপেনের সতত উপস্থিতি মুড়িয়াদের শিল্পসত্তার একক এবং একমাত্র অনুপ্রেরণা।
মৃত্যুর পরেও তারা শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে। সমাধিক্ষেত্রে তার স্মারকস্তম্ভ স্থাপন করে, শিল্পীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। মৃত শিল্পীরা জীবনের বৃত্তান্ত সেই স্মারকস্তম্ভে খোদাই করে রাখে। নৃতাত্ত্বিকদের ভাষায় সেই স্তম্ভকে বলা হয় ‘জীবনীস্তম্ভ’। একটি মানুষের সারাজীবনের কর্ম ওই স্তম্ভের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। বহুবছর পূর্বে মুড়িয়ারা এই স্তম্ভকে বলত ‘উরসগত্তা’। এখন বলা হয় ‘মুণ্ডে বা খাম্বা’। দক্ষিণ-বস্তারের অবুঝমারিয়াদের মধ্যে ‘উরসগত্তা’ শব্দটি এখনও প্রচলিত রয়েছে। স্তম্ভের গায়ে খোদিত চিত্র দেখেই মৃত ব্যক্তির জীবনের একটি রূপরেখা জানা যায়।
অধ্যাপক পান্ডে বললেন, আর কতক্ষণ এককান্ডে চারগাছের নীচে বসে থাকবেন। এখনও চার কিমি পথ যেতে হবে। সামনে অরণ্য আরও গভীর। সূর্য ডোবার আগে মালকোটের ঘটুলে পৌঁছোতেই হবে।
এতক্ষণ শিল্পী মুড়িয়াদের কথা শোনা গেল। ঘটুলে গিয়ে জানা যাবে লিঙ্গপেন আর প্রেমিক মুড়িয়াদের কথা।
ঘটুলের প্রতিষ্ঠাতা লিঙ্গপেন, যিনি মুড়িয়াদের সর্বশক্তিমান দেবতা।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মুড়িয়ারা লিঙ্গপেনের আরাধক। চাষে-বাসে তারা যেমন লিঙ্গপেনকে স্মরণ করে, তেমনি প্রেম-ভালোবাসা ও বিয়েতে লিঙ্গপেনের আশীর্বাদ চায়। লিঙ্গপেন সর্বশক্তিমান। ঘটুলে তিনি সতত বিরাজমান। তাঁর অদৃশ্য উপস্থিতির জন্য কোনো ভূত-প্রেত, ডাইনি ও অপদেবতা ঘটুলে ঢুকতে পারে না। ঢোলক আর মোতিয়ারির কোনো ক্ষতি করতে পারে না। মুড়িয়াদের কাছে ঘটুল লিঙ্গপেনের আশীর্বাদপূতঃ একটি প্রতিষ্ঠান। মুড়িয়া যুবক-যুবতীরা এই ঘটুল থেকেই জীবন, জৈবিক ও সংযমের শিক্ষা পায়। এখান থেকেই সুস্থ নাগরিকবোধের জন্ম হয়।
অধ্যাপক পান্ডে বলেন, ঘটুল কাহিনি মুনশির কাছ থেকে শুনবেন। আপনাকে মালকোটে মুড়িয়াদের শিল্পকর্ম দেখাতে নিয়ে এসেছি। শিল্পী মুড়িয়াদের দেখে যান।
অভাব-অনটন মুড়িয়াদের নিত্যসঙ্গী হলেও, তাদের হাসিমুখে তার কোনো ছায়া পড়ে না। প্রকৃতিকে ভালোবাসে বলেই, মুড়িয়ারা পার্থিব জগতের লোভ থেকে মুক্ত।
যারা নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের কাছাকাছি থাকে, তাদের বলা হয় রাজ মুড়িয়া। পোশাকে-আশাকে তারা অরণ্যচারী মুড়িয়াদের চেয়ে কিছু আলাদা। শহরের প্রভাবে রাজ মুড়িয়াদের গায়ে উঠেছে কিছু স্বর্ণালংকার। কিন্তু বনবাসীরা কাঁসা, দস্তা ও টিনের তৈরি অলংকারেই খুশি। নিজস্ব সংস্কৃতি, তাদের স্বল্পদামি অলংকারের গৌরব।
পুঁতির কাজে অরণ্যবাসি মুড়িয়ারা সিদ্ধহস্ত। তাদের তৈরি পুঁতির গয়না, নি:সন্দেহে উচ্চমানের শিল্প।
লাল, সাদা ও নীল রঙের উজ্জ্বল পুঁতি দিয়ে মুড়িয়ারা নিজেরাই নিজেদের মস্তকবন্ধনী বা হেড ব্যাণ্ড তৈরি করে। কানের দুলের সঙ্গে লম্বমান ঝুমকো উদ্ভিন্ন যৌবনা মুড়িয়া কন্যাদের মুখকে হাস্যোজ্জ্বল করে তোলে। রুপোর ওপর কারুকার্য খোচিত কন্ঠহার—মাথায় পুঁতির মস্তকবন্ধনী, কানে দুল, হাতে কঙ্কণ ও পায়ে খারু, পরে দল বেঁধে পথ চলে তারা। সূর্যের আলোয় চকচক করে পুঁতির তৈরি মস্তকবন্ধনী, কন্ঠহার আর কানের দুল। পথ চলায় খারুর শব্দে শব্দে যখন সমবেত নিক্কণ ওঠে, মুড়িয়া কন্যাদের তখন মনে হয় মর্তের অপ্সরা। মুড়িয়াদের মধ্যে কড়ির ব্যবহার এখনও প্রচলিত। রুপোর বল আর কড়ি দিয়ে তৈরি করে কোমরবন্ধনী। নিতম্ববেষ্টিত সেই কোমরবন্ধনী, প্রতিটি মুড়িয়াকন্যার আবাল্য সাধ।
অধ্যাপক পান্ডে বলেন, মুড়িয়া আর অবুঝমারিয়াদের ‘নৃত্যছড়ি’ দেখেছেন? বড়ো যত্ন করে তারা এই ছড়ি তৈরি করে। রুপো বাঁধানো সেই ছড়িতে খোদিত থাকে প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক দৃশ্য। সামাজিক উৎসব ও পাল-পার্বনে নাচের আসর বসে। সেই নাচের আসরেই তারা ছড়িটি ব্যবহার করে।
অবুঝমারিয়া কন্যারা হাতে-পায়ে ও মুখে উল্কি কাটে। সেই উল্কিতেও থাকে প্রকৃতির প্রভাব। পাখি, ফুল-পাতা, তাদের উল্কির বিষয়বস্তু। অন্তরে তারা প্রকৃতির সাধক—বাইরেও তারা প্রকৃতির উপাসক। মালকোটে মুড়িয়াদের ঘরে নিয়ে যান অধ্যাপক পান্ডে। অনেকদিন যাতায়াতের ফলে, তিনি মুড়িযাদের ‘ঘরের মানুষ’ হয়ে গেছেন। অধ্যাপক পান্ডের সঙ্গে মুড়িয়াদের ভদ্রতার পরিচয় নয়—অন্তরের সম্পর্ক। তিনি কখনো মুড়িয়া ছেলে-মেয়েদের জন্য শহুরে লজেন্স আর চকলেট নিয়ে যান না। তাল আর খেজুর গুড় তিনি বাচ্চাদের মধ্যে বিলি করেন। কখনো বা মোয়া, খার, নাড়ু নিয়ে যান।
বাইরে মুড়িয়াদের ঘর ছন্দহীন হলেও, ভেতরটা চমকে যাবার মতো সুন্দর। দেওয়ালে সুন্দর চিত্র বা ফ্রেসকো। মসৃণ নিকোনো দেওয়ালে গাছপালা ও জন্তু জানোয়ারের চিত্র। দেওয়ালের গায়ে তারা কল্পনায় এঁকে রেখেছে বহু বিলুপ্ত প্রাণী। অধ্যাপক পান্ডের মতে, প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রের পরম্পরা এখনও মুড়িয়ারা ধরে রেখেছে। মানুষের বিবর্তনের ধারাও ফ্রেসকোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। রং ও তুলি তারা বাইরে থেকে কেনে না। বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকেই রং সংগ্রহ করে। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি করে তুলি। সেই রং আর তুলি দিয়ে নিপুণ হাতে দেওয়ালের গায়ে নানারকমের ছবি আঁকে। এই ছবির মধ্যেই ফুটে ওঠে, তাদের কল্পনা আর মনের মাধুর্য।
মুড়িয়াদের দেওয়াল চিত্র এখন আধুনিক শিল্পীরা অরণ্য থেকে নগরে নিয়ে এসেছে। মুড়িয়াদের কল্পনায় অঙ্কিত চিত্র, আধুনিকদের হাতে পড়ে জল ও তেল রঙে অঙ্কিত হচ্ছে। ভাস্করেরা মুড়িয়াদের অঙ্কিত মূর্তি ধাতব পদার্থে রূপায়িত করছে। কোন্ডাগাঁওয়ের জয়দেব বাগেল, সুখদেও বাগেল, সোনাধর, বিশ্বকর্মা আরও অনেকে আদিবাসীদের আদিম চিত্রকে বাইরের জগতে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে। তাঁদের তৈরি চিত্র, মূর্তি, সামগ্রী নিয়ে, দেশের বড়ো বড়ো শহরে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। বস্তারের ভিত্তি চিত্র এখন তো সর্বজন পরিচিত। অধ্যাপক পান্ডে বলেন, মনে রাখবেন, জনপ্রিয় হলেও আদি মুড়িয়া শিল্পের পরম্পরার মৃত্যুও যেমন ঘটেনি, তেমনি তাদের অভাব অনটনের কোনো সুরাহাও হয়নি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন