জগন্নাথদেবের শেষ দেবদাসী – গোপালকৃষ্ণ রায়

গোপালকৃষ্ণ রায়

মাত্র আট বছর বয়েসেই ‘শাড়িবন্ধন’ হল। দেবোত্তম জগন্নাথ দেবকে স্বামীত্বে বরণ করলেন বালিকা পরশমণি। তাঁর ছোট্ট নিষ্পাপ দেহে জড়ানো পট্টবস্ত্র। পট্টবস্ত্রের আঁচলের সঙ্গে ভগবান জগন্নাথের চাদরে গিট বেঁধে দিলেন মুখ্য পুরোহিত। মন্দিরের অন্তঃপ্রাঙ্গণ উৎসব-মুখরিত। সিংহদ্বারে সানাইয়ের সুর। চুয়া-চন্দন-পুষ্প সে এক স্বর্গীয় পরিবেশ। বধূবেশী বালিকা নিশ্চল। তার আট বছরের দেহ ও মনকে জগন্নাথের সেবায় উৎসর্গ করা হল। পরশমণি হলেন দেব সেবার দাসী— দেবদাসী।

‘শাড়িবন্ধন’ শেষ হল। এবার হৃদয়েশ্বরের মনোরঞ্জনের পালা। পালিতা মা কুন্দমনি দেবদাসী পরশমণির হাত ধরে নিয়ে এলেন অন্তঃপ্রাঙ্গণের মধ্যভাগে। কন্যা ও মাতা জগন্নাথ দেবের সামনে হাঁটু ভেঙে বসলেন। করজোড়ে আবৃত্তি করলেন গীতগোবিন্দ। নুপূরের নিক্বণ উঠল। কুন্দমণির পায়ের তালে তালে তাল মেলালেন পরশমণি। একসময় নৃত্যরতা পরশমণিকে রেখে অন্তঃপ্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে গেলেন কুন্দমণি।

কুন্দমণিকেও একদা এমনি একা রেখে মন্দির থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর মা। দেবসেবার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে। নিজহাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন দেব আশির্বাদপূতঃ নূপুর। কুন্দমণিও সেই নূপুর পরিয়ে দিলেন পরশমণিকে। এক দেবদাসী থেকে অপর দেবদাসীতে হস্তান্তরিত করা হয় এই পবিত্র নূপুর। নূপুরের নিক্বণ তুলে কুন্দমণিও হয়েছিলেন জগন্নাথের কিংকরী। আর সেই নূপুর পরে পরশমণি কিংকরীর ধারাকে বজায় রাখলেন।

কিন্তু এই দেবপূতঃ নূপুরের ধারা আর বজায় থাকবে না। গভীর রাতে মন্দিরের অন্তঃপ্রাঙ্গণে নূপুরের রিমঝিম ধ্বনি আর কেউ তুলবে না। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন দেবদাসীপ্রথার পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। পরশমণিই হচ্ছেন শেষ দেবদাসী— শেষ দেবনর্তকী। তাঁর বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরীর মন্দির থেকে দেবদাসীপ্রথা বিলোপ হয়ে যাবে। কারণ পরশমণি আর কাউকে দত্তক নেননি। দত্তক উনি আর নেবেন না। দেবতার দাসী করার মতো ধৈর্য থাকলেও সহায়সম্বল আর সামর্থ্য তাঁর নেই।

পরশমণিকে দত্তক নিয়েছিলেন কুন্দমণি। সে তো প্রায় ছয় দশক আগের কথা। পরিশমণির বয়স তখন মাত্র দেড় বছর। জ্ঞান হবার পর থেকেই কুন্দমণিকে মা বলে জানেন পরশমণি। নিজের মা-বাবার সন্ধান তাঁর জানা নেই। কার ঔরসে আর কার গর্ভে তাঁর জন্ম হয়েছিল সেকথা কুন্দমণি তাঁকে কোনোদিন বলেননি। প্রথানুযায়ী বলবার কোনো নিয়ম নেই। পরশমণিরও জানবার কোনো অধিকার নেই।

দেবসেবার ভাগ্য আর দেবদাসী হবার সৌভাগ্য সকলের অদৃষ্টে থাকে না। দত্তক নেবার আগে কিছু লক্ষণ দেখে নিতে হয়। সেই লক্ষণ পরশমণির মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন কুন্দমণি। আর কুন্দমণির মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর পালিকা জননী। কোনো মেয়ের মধ্যে সেই লক্ষণের পরম্পরা আর খোঁজ করার চেষ্টা করেননি পরশমণি।

এখন আর সেসময় নেই। লক্ষণ খুঁজে কাউকে দেবদাসীতে তালিম দেবার সহায় সম্বল আমার নেই। বলতে বলতে পরশমণির চোখে-মুখে একটা বিষাদের ছায়া নেমে আসে। তাঁকে দিয়েই একটি প্রাচীন প্রথা শেষ হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে এই বেদনা বোধ তাঁর মনকে ব্যথিত করে। নিভৃতে বসে মাঝে মাঝে চোখের জল মোছেন।

গভীর রাতে শয্যায় শায়িত জগন্নাথ দেবের পদসেবা বন্ধ হয়ে যাবে। নৃত্যে আর গীতে তাঁর মনোরঞ্জন আর কেউ করবে না। জগন্নাথের সঙ্গে নতুন করে আর কেউ ‘শাড়িবন্ধন’ করবে না। বাহান্ন বছর আগে কুন্দমণি যে গাঁটছড়া বেঁধে দিয়েছিলেন পরশমণির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তা ছিন্ন হয়ে যাবে।

হয়তো এটাই তাঁর ইচ্ছা। তাঁর বাসনা। পরশমণির ভেজা গলায় শব্দ ক-টি উচ্চারিত হয়।

মুখোমুখি বসে পুরীর দেবালয়ের শেষ দেবদাসী পরশমণির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মন্দিরের পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত নির্জন গলিতে পরশমণির দোতলা বাড়ি। দেবদাসীর বাসস্থান—তাঁর গৃহস্থালি। নীলাচলে জগন্নাথ দেবের মন্দির নির্মাণ করেছিলেন উৎকলের গঙ্গা সাম্রাজ্যের পূর্বসূরি চোলীগঙ্গাদেব। তিনি গঙ্গেশ্বর নামেও কীর্তিমান ছিলেন। ১১২৭-১১৪৭খ্রিস্টাব্দ এই কুড়ি বছর মন্দির নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল।

মন্দিরের খাজাদ্বার খুললেই গলি। খাজাদ্বার বেশির ভাগ সময়েই বন্ধ থাকে। ভক্তজনেরা সাধারণত পূর্বের প্রধান বা সিংহদ্বার ও দক্ষিণের অশ্বদার দিয়েই মন্দিরে প্রবেশ করেন। খাজাদ্বার দিয়ে সন্ধ্যার পর মন্দিরে ঢোকেন জগন্নাথ সেবিকা পরশমণি দেবদাসী। পরশমণি তাঁর নাম—কিন্তু পরিচয় নেই। দেবদাসী নামেই তাঁর পরিচিতি।

জগন্নাথের মন্দিরে দেবদাসীর একটি বিশেষ মর্যাদা স্বীকৃত। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের পুরী টেম্পল (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট অনুসারে পূজার্চনা, উৎসব ও নিত্যসেবার একটি তালিকা তৈরি করা আছে। সেবায়েতের কাজ যেমন নির্দিষ্ট, তেমনি দেবদাসীর ভূমিকাও তালিকাভুক্ত। মন্দির থেকে তাঁর কী প্রাপ্য তাও লিখিত।

দেবদাসী সম্পর্কে বহিরাগতদের বিশেষ কোনো কৌতূহল না থাকলেও—স্থানীয় মানুষের দেবনর্তকীর প্রতি একটি শ্রদ্ধার ভাব অস্বীকার করা যায় না। জগৎপ্রভু জগন্নাথের সেবিকা বলেই সম্ভবত এই শ্রদ্ধা।

পট্টবস্ত্র পরিহিতা সালংকৃতা দেবদাসী নূপুরের নিক্বণ তুলে দ্বার দিয়ে যখন মন্দিরে প্রবেশ করেন, তখন সেবায়েতরা সম্ভ্রমে তাঁকে পথ ছেড়ে দেয়। এই প্রথা কয়েকশত বছরের প্রাচীন। যুগ ও মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও দেবনর্তকীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন আজও সমানভাবে চলেছে।

পরশমণির ‘শাড়িবন্ধন’-এর পরেও কুন্দমণি কিছুকাল মন্দিরে এসেছিলেন। বহিপ্রাঙ্গণে ভজন-কীর্তন করার পর—গভীর রাতে অন্তঃপ্রাঙ্গণে শায়িত জগন্নাথের সেবা করতেন তিনি। বয়েসের ভারে অচল কুন্দমণি এখন আর মন্দিরে যেতে পারেন না। দেবসেবার দায়িত্ব পেয়েছেন পরশমণি। প্রায় বাহান্ন বছর একনাগাড়ে দেবসেবা করে চলেছেন তিনি। বর্তমানে দেবসেবার দায়িত্ব তিনিও আর বেশিদিন পালন করতে পারবেন না। তাঁরও দেহে ও মনে বার্ধক্যের জড়তা দেখা দিয়েছে। দেড় বছর বয়েসে কুন্দমণি তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন। আর আট বছর বয়েসে ঋতুমতী হবার আগেই ‘শাড়িবন্ধন’ করিয়ে দিয়েছিলেন। আমৃত্যু এই বন্ধন থাকবে।

দেবদাসীর ব্যাবহারিক জীবন নিয়ে কেউ বড়ো একটা মাথা ঘামান না। কিন্তু মন্দিরে তাঁর সম্ভ্রম স্বীকৃত। তাই যখন-তখন তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। এই লেখককে পরশমণির সাক্ষাৎ পেতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছিল। প্রশাসনিক ও স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সহায়তায় পরশমণি সকাল সাড়ে ন-টায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন।

মন্দিরের পেছনে অপ্রশস্ত এবং অপেক্ষাকৃত নোংরা গলিতেই তাঁর দোতলা বাড়ি। নীচে দু-চারটে পান-বিড়ি ও মুদির দোকান। মানুষ চলাচল কম। গলির বেশির ভাগ অংশই গোরু আর ষাঁড়ের দখলে।

ছোটোবেলা থেকেই দেবদাসী সম্পর্কে আমার মনে যে ছবি আঁকা ছিল—পরশমণির সঙ্গে সে-ছবির কোনো মিল নেই। স্বভাবতই আমার মনে ধাক্কা লেগেছিল। দেবসভার নর্তকীদের রূপের কথা শুনেছি। ঊর্বশী, রম্ভা ও মেনকার রূপলাবণ্যের বিবরণ পুরাণে পড়েছি। দেবদাসী সম্পর্কে আমার সেরকমই একটি ধারণা ছিল। পরশমণি ঠিক তাঁর বিপরীত। রূপে তাঁর জৌলুস নেই। দেহ থেকে যৌবন বিদায় নিতে শুরু করেছে। কটাক্ষহীন চোখ কোটরাগত। পান আর দোক্তায় রঞ্জিত দাঁত। প্রশস্ত কপাল। ভারী ওষ্ঠ। গায়ের রং কালো। পরনে সাধারণ আটপৌরে শাড়ি।

দোতলায় পৌঁছোতেই সাদরে আপ্যায়ন করে ঘরে বসালেন পরশমণি। প্রায় আসবাবপত্রহীন ঘর। একটি হাতল-ভাঙা চেয়ার। তক্তপোষে একটি অর্ধমলিন বিছানা পাতা। দেয়ালের গায়ে চন্দনচর্চিত ভগবান জগন্নাথের একটি ছবি।

তবুও দেবদাসী। দেবানাং দাসী। দেবতার সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ। জগন্নাথের সেবিকা। ‘শাড়িবন্ধন’ করে জগন্নাথকে স্বামীরূপে বরণ করে নিয়েছেন। নাচে-গানে তাঁকে খুশি করাই পরশমণির কর্তব্য। পার্থিব জীবনের ভোগ-লালসা বিমুখহীন হয়ে মন-প্রাণ ঢেলে জগৎস্বামীর সেবা করাই তাঁর ধর্ম। বাহান্ন বছর ধরে সেই ধর্মই পালন করে চলেছেন তিনি।

পরশমণি বলেন, দেবদাসীর অনেক দায়—অনেক দায়িত্ব। অনেক কর্তব্য। পবিত্র মন নিয়ে তাঁকে ভগবানের সেবার দায়িত্ব পালন করতে হয়। পাপ মনের সেবায় দেবতা রুষ্ট হন।

আপনি কি তাহলে নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক? আমার প্রশ্নে গম্ভীর হয়ে যান পরশমণি। এমনি কঠিন বাস্তব প্রশ্নের মুখোমুখি তাঁকে কোনোদিন হতে হয়নি। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, প্রায়শ্চিত্তে পাপস্খালন হয়। আর প্রায়শ্চিত্ত করলে জগৎস্বামী ক্ষমা করেন। আমি সে ক্ষমা পেয়েছি। আরও একধাপ এগিয়ে জিজ্ঞাসা করি, আপনি যৌবন আর জৈবিক বাসনা অতিক্রম করলেন কী করে?

দেবদাসী এবার অধোমুখী হন।

জীবনের শেষ দরজায় পা দিয়ে মিথ্যাচারণ করতে মন চায় না পরশমণির। অকপট স্বীকৃতিতেও দ্বিধা বোধ করেন। অত্যন্ত ধীরে ধীরে বলেন, ব্যাবহারিক জীবনে প্রলোভন প্রত্যাখান করা বড়ো কঠিন। প্রলোভনে কেউ কেউ মন্দির ত্যাগ করে চলে গেছে কিন্তু আমি পুণ্যের সেবা থেকে সরে আসিনি।

স্পষ্ট না হলেও বুঝতে কষ্ট হয় না, ব্যাবহারিক জীবনের চাহিদাকে জগন্নাথের দাসী উপেক্ষা করতে পারেননি। লোভ ও দৈহিক লালসার কাছে তাঁকেও একদিন আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। ভগবানের পদতলে বসে নি:সংকোচ স্বীকৃতিতে তা স্খালন হয়ে গেছে।

একই প্রশ্ন বার বার করে মাতৃসমা পরশমণিকে বিড়ম্বিত করার ইচ্ছা করল না। পরশমণিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাই দেবদাসীর জীবনে। নৃত্য-গীত দেবদাসীর অবিভাজ্য অঙ্গ। ধ্রপদি ওড়িশি নৃত্যে পটিয়সী পরশমণি। ‘শাড়িবন্ধন’-এর আগে থেকেই নাচে আর গানে ওস্তাদের কাছে তালিম নিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ দশবছর একটানা তালিম নিয়ে ওড়িশি নৃত্যশিল্পে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। দেবদাসীর পক্ষে ভক্তিগীতি অবশ্যই শিক্ষণীয়। জন্মসূত্রে স্বর্ণকন্ঠ পেয়েছিলেন তিনি। ওস্তাদের তালিমে তা পূর্ণতা লাভ করেছিল। বহি:প্রাঙ্গণে এখনও ভক্তিগীতি পরিবেশন করেন পরশমণি। অন্তঃপ্রাঙ্গণে প্রতিদিন নাচতে পারেন না।

মন্দিরে আপনার নৃত্য-গীত কাদের দেখার অধিকার আছে? পরশমণি হেসে বলেন, বহি:প্রাঙ্গণে ভক্তিগীতি শোনার অধিকার সকলেরই আছে। কিন্তু গভীর রাতে অন্তঃপ্রাঙ্গণে নৃত্যের দর্শক একমাত্র জগন্নাথ। বাইরের কারো প্রবেশাধিকার সেখানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

মাপ করবেন, শুনেছি, অন্তঃপ্রাঙ্গণে দেবদাসী নাকি নগ্ন হয়ে নৃত্য করেন?

ভুল শুনেছেন। নগ্ন হয়ে নৃত্য করার কথা আমার জানা নেই। এসব কথা কুন্দমণিও আমাকে কোনো দিন বলেননি। ধরুন স্বামী-স্ত্রী একঘরে রয়েছে। স্ত্রীর বুকের আঁচল অজান্তে সরে গেলে সে কি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি তুলে দেয়? দেয় না। এখানেও তাই। নগ্ন হয়ে নাচার কোনো বিধান জগন্নাথের মন্দিরে নেই। দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো মন্দিরে আছে বলে আমি শুনেছি। এটি শুধু শোনা-কথা। সত্যাসত্য আমার জানা নেই।

পরশমণি বাহান্ন বছর আগে দেবদাসী হয়েছেন। তাঁর পালিকা মা কুন্দমণি জগন্নাথ দেবের সঙ্গে ‘শাড়িবন্ধন’ করে দিয়েছিলেন।

দীর্ঘ পাঁচ দশক জগন্নাথের সেবা করে কী পেয়েছেন পরশমণি তার হিসেব করতে চান না। এ তো আর পার্থিব জগতের লৌকিক সংসার নয় যে টাকাপয়সা, ধনদৌলতের চুলচেরা হিসেব করতে হবে। পরশমণি যে সংসার করেছেন— সে সংসারে ব্যাবহারিক জীবনের হিসেব চলে না। সেখানে দেহের নিবেদন নেই— সেখানে আছে আত্ম-শান্তির দাবিহীন আকুল আবেদন।

তাও কি পেয়েছেন?

পরশমণি চুপ করে একটু ভাবেন। কেন জানি না তাঁর চোখ জলে ভরে ওঠে। ভেজা গলায় বলেন, তাঁর কাছে কিছু চাইতে হয় না। চাওয়ার কোনো তাড়না থাকে না। তাঁর কাছে গেলেই সবকিছু পাওয়ার আনন্দে আপনিই মন ভরে ওঠে।

মন হয়তো ভরে। কিন্তু পেটের খিদে? এবার হাসেন পরশমণি। বলেন, রাজার আমলে কিছু জমি দেওয়া হয়েছিল দেবদাসীকে। নতুন জমানায় সে জমি বেদখল। মন্দিরে সহস্রাধিক আচার-আর উপাচারে দেবদাসীর একটি ভূমিকা আছে।

প্রাচীন প্রথানুযায়ী মন্দিরের প্রাত্যহিক খেই (ভোগ)-এর একটি অংশ দেবদাসীর জন্য বরাদ্দ থাকে। নিজের প্রয়োজনের জন্য সামান্য কিছু রেখে বাকি প্রসাদ নিলামদারের কাছে বিক্রি করে দিই। তাতে দেবতার দাসীর দৈনন্দিন জীবন কেটে যায়।

জগন্নাথের সেবা করে পরশমণি কি কোনো দিন স্বর্গীয় সুখ আর আনন্দ পেয়েছেন? কোনো অলৌকিক ঘটনা কি তাঁর জীবনে ঘটেছে?

পরশমণি ধীরে ধীরে বলেন, বাহান্ন বছরের মধ্যে একদিনের জন্যেও আমি প্রভুর সেবা বাদ দিইনি। ঝড়, জল-বৃষ্টিতেও আমি মন্দিরে পৌঁছে যেতে পেরেছি। অসুস্থ থাকলেও মন্দিরে যাবার আগে সুস্থ হয়ে উঠেছি। এ সবই তো তাঁর লীলা!

তা ছাড়া?

তা ছাড়া! সে-কথা কি আপনারা বিশ্বাস করবেন? করবেন না। নাচের পর একটি অতিন্দ্রীয়স্পর্শে আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। একটা স্বর্গীয় সুখের স্বাদে আমার মন ভরে থাকত। সে-স্বাদ যে অনুভব করেনি—তাকে বোঝানো যাবে না। ভাষা দিয়ে সেই স্বাদকে ব্যক্ত করা যায় না। দেহ ও মনের সব অনুভূতি দিয়ে তাকে উপলব্ধি করতে হয়।

মন্দির কতৃপক্ষ আর যদি অন্য কাউকে দেবদাসী নিযুক্ত না করেন, তাহলে পরশমণির পর, আট-শো বছরের প্রাচীন প্রথা বন্ধ হয়ে যাবে। নিয়ম অনুযায়ী নতুন কাউকে দেবদাসী করার দায়িত্ব পুরোনো দেবদাসীর ওপরেই ন্যস্ত। কিন্তু পরশমণি আর কাউকে দত্তক নেবেন না। নতুন করে আর কাউকে ‘শাড়িবন্ধন’ করাবেন না।

তাহলে মন্দির থেকে এই প্রথা লুপ্ত হয়ে যাবে?

পরশমণি বলেন, একজন দেবদাসী তৈরি করতে অনেক খরচ আর অনেক সাধনা করতে হয়। নাচে-গানে তালিম দেবার জন্য অর্থ চাই। সে-অর্থ আমার নেই। মন্দির থেকেও পাওয়া যাবে না। সুতরাং, নতুন করে দেবদাসী তৈরি আর সম্ভব নয়।

জানতে ইচ্ছা করে একজন দেবদাসী কতদিন দেবতার দাসী হয়ে থাকতে পারেন?

পরশমণি বলেন, আমৃত্যু।

কুন্দমণি কি এখনও দেবদাসী?

হ্যাঁ। উনিও দেবদাসী। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতার জন্য উনি এখন আর মন্দিরে যেতে পারেন না।

মন্দির থেকে উনি কি কোনো মাসোহারা পান?

না। কিছুই পান না তিনি। এখানে কোনো পেনশনের ব্যবস্থা নেই। এককালীন অর্থ সাহায্যও করা হয় না।

দেবদাসী শুধু জগন্নাথের সেবিকা নন। বাস্তবে ওঁরা শিল্পী। সংগীত আর নৃত্যের শিল্পী। আজকের বিখ্যাত ওড়িশি নৃত্য মন্দিরের দেবদাসীদেরই অবদান। পরশমণিও ওড়িশি নৃত্যশিল্পী। শিল্পী হিসেবেও সরকারি সাহায্য তিনি পেতে পারেন।

অনেকবার দরখাস্ত করেছি। কেউ কোনোদিন জবাব দেয়নি।

সময় শেষ হয়ে আসে। ভক্তদের কলরবে মন্দির মুখরিত। দোতলা থেকে সরু সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে আসি। পশ্চিমের অপেক্ষাকৃত নির্জন গলি পেরিয়ে দক্ষিণের অশ্বদ্বারের সামনে এসে দাঁড়াই। সেখান থেকে মন্দিরের বহি:প্রাঙ্গণ দেখা যায়। সন্ধ্যার পর পরশমণি এই বহি:প্রাঙ্গণে ভজন পরিবেশন করে গভীর রাতে অন্তঃপ্রাঙ্গণে চলে যাবেন। জগন্নাথ দেবকে ঘুম পাড়িয়ে সূর্য ওঠার আগেই আবার ফিরে যাবেন নিজের ঘরে।

দেবদাসী শুধু ভারতীয় প্রথা নয়। পূর্বকালে গ্রিস, অস্ট্রিয়া, মিশর ও ফিনিসিয়া প্রভৃতি দেশে দেবালয়ে দেবনর্তকী ছিল। গ্রিসের বীণাস দেবীর মন্দিরে দেবদাসীপ্রথা প্রচলিত ছিল। কোনো একসময়, অর্মেনিয়ায় নিয়ম ছিল যে, উচ্চবংশীয় লোকের কন্যাগণ বিবাহের পূর্বে অনাইতিস (অনাহিতা) দেবীর সেবায় নিযুক্ত হত। এ সময় তারা অসদাচরণ করলেও বিয়ের পর কেউ আর নিন্দা করত না। ব্যাবিলনে কোনো রমণীই মিলিত্তা (Mylitta) দেবের মন্দিরে একবার আত্মসমর্পণ না করে অব্যাহতি পেত না।

সকল অধ্যায়

১. শাম্বরিক খরোলিকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
২. কাব্যে কেশ-ব্যবসায় চুল – গোপালকৃষ্ণ রায়
৩. মুড়িয়া শিল্পকলা – গোপালকৃষ্ণ রায়
৪. পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
৫. ড্রাগ : নেশার বিষাক্ত জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৬. হাজারদুয়ারি থেকে পলাশি – গোপালকৃষ্ণ রায়
৭. কলকাতার মৃত্যু-জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৮. রবীন্দ্রনাথ ও একটি রিয়া – গোপালকৃষ্ণ রায়
৯. পৃথিবীর প্রাচীনতম মৃৎপাত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
১০. পুরীর মন্দিরে দুর্ঘটনা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১১. কোণারকের সূর্যমন্দির – গোপালকৃষ্ণ রায়
১২. কঙ্কাল কাহিনি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৩. জগন্নাথদেবের শেষ দেবদাসী – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৪. মা জুঁইং বুঁইন – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৫. জ্ঞাননৌকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৬. পুরাকথায় অমরনাথ – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৭. কিংবদন্তির দ্বারকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৮. খর্বাকৃতি দম্পতি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৯. ঋষি অরবিন্দ – গোপালকৃষ্ণ রায়
২০. তীর্থক্ষেত্র গঙ্গাবাস – গোপালকৃষ্ণ রায়
২১. কলকাতায় আদিম অতিথি – গোপালকৃষ্ণ রায়
২২. নলরাজার গড় – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৩. সেনালি ডিঙ্গো, কুমারীদের শয্যাধামে – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৪. সুনাবেড়া বৃত্তান্ত – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৫. ত্রিপুরার রাজবংশে সতীপ্রথা – গোপালকৃষ্ণ রায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন