গোপালকৃষ্ণ রায়
ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়া একটি ভালো কাজ করেছে। অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক হাজারদুয়ারি প্রাসাদকে রক্ষা করেছে। অন্তত বেশ কয়েক দশকের জন্য এই নবাবি প্রাসাদের পরমায়ু বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রশংসনীয় কাজটি আরও দু-দশক আগে করতে পারলে শুধু মেহনত আর ব্যয়ের মাত্রাই কম হত না, অনেক অমূল্য সম্পদ রক্ষা পেত। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বহুদিন আগেই প্রাসাদের রক্ষাকবচ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, কিন্তু আইনের বেড়াজাল থেকে সহজে প্রাসাদকে মুক্ত করা যাচ্ছিল না। নবাবির অবসান বহুবছর আগে ঘটলেও সম্পদ ও সম্পত্তির দাবিদারদের কন্ঠ নীরব ছিল না। বড়ো, মাঝারি ও ছোটো অনেক দাবিদার প্রাসাদ অধিগ্রহণের অন্তরায় হয়ে উঠেছিল। সম্পদ ও সম্পত্তির মালিকানার দাবি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সব অন্তরায়গুলি একে একে দূর করে প্রাসাদকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনতে কম করে দু-দশক সময় লেগেছিল। এই সময়ের মধ্যে প্রাসাদ আরও জীর্ণ হয়েছে। দেয়ালের ফাটল দীর্ঘতর হয়েছে। কপাট ও জানালায় উই ও ঘুণ ধরেছে। পলেস্তারা খসে পড়েছে। সর্বাঙ্গে ঘা নিয়ে ধসে পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল ১৬১ বছরের প্রাচীন নবাবি প্রাসাদ হাজারদুয়ারি। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সেই অনিবার্য ধ্বংসের কবল থেকে এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে রক্ষা করেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্কার করে প্রাসাদের পরমায়ু আরও কয়েক দশক বাড়িয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক কৌলিন্যে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছে।
প্রাসাদ নির্মাতা নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহ প্রাসাদের জীর্ণদশা দেখে কবরের নীচেই দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। প্রাসাদ সংস্কার করে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ শুধু জাতীয় কর্তব্য সম্পাদন করেনি, নবাব-নাজিমের বিদেহী আত্মাকে শান্তি দিয়েছে।
স্থাপত্যের অনবদ্য নিদর্শন নির্মাণ করেও বেশিদিন বাস করতে পারেননি নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহ। কেউ বলেন কয়েকমাস, কেউ কেউ বলেন ঘটা করে গৃহপ্রবেশের পরেই নবাবের দেহান্ত ঘটে।
ইতিহাসও প্রায় একই রকম কথা বলে। নবাব হুমায়ুন এই প্রাসাদ তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে। শেষ করতে সময় লেগেছিল আট বছর। অর্থাৎ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রাসাদের নির্মাণ কার্য শেষ হয়েছিল। নবাব নাজিম হিসাবে হুমায়ুন মুর্শিদাবাদের মসনদে ছিলেন মাত্র চোদ্দো বছর। ১৮২৪ থেকে ১৮৩৮। তাই হাজারদুয়ারিতে বেশিদিন বাস করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
উত্থান-পতনের ইতিহাস নিয়েই মুর্শিদাবাদ। অষ্টাবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে উত্থানের যে ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছিল, ওই শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে কার্যত তার পতন ঘটে। পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদের কোনো স্বতন্ত্র সত্তা ছিল না।
ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। ভাগীরথীর পূর্বতীরে অবস্থিত মুখসুসাবাদে জায়গাটি তাঁর ভারি পছন্দ হয়েছিল। মুখসুসাবাদে রাজধানী স্থাপন করে নিজের নাম অনুসারেই নামকরণ করেছিলেন মুর্শিদাবাদ। অষ্টাবিংশ শতাব্দীর গোড়ার কাহিনি। ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ হলেন বাংলা, বিহার ওড়িশার সুবেদার। সম্রাট ঔরংজেব তখন ভারতেশ্বর।
অনেক গুণের সমন্বয় ঘটেছিল মুর্শিদকুলি খাঁর মধ্যে। সংযমী শাসক হিসেবে মানুষের মনে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। দীর্ঘ সাতাশ বছর (১৭০০-১৭২৭) বাংলা, বিহার ও ওড়িশার ভাগ্যবিধাতার দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
ভাগীরথীর পূর্ব পারে নতুন রাজধানী স্থাপন করলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। তৈরি হল নবাব মহল, বেগম মহল, দরবার, প্রশাসনিক ভবন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র। একটি মিন্ট তৈরি করেছিলেন তিনি। একমাত্র কাটরা মসজিদ ছাড়া মুর্শিদকুলি খাঁ নির্মিত আর কোনো স্থাপত্য স্মৃতির চিহ্ন নেই।
মৃত্যুর চার বছর আগে নির্মাণ করেছিলেন কাটরা মসজিদ। কাটরা মসজিদ নির্মিত হয়েছিল ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমানে মুর্শিদাবাদ রেলস্টেশন থেকে তিন কিমি উত্তর পূর্বে কাটরা মসজিদ অবস্থিত। পঞ্চাশ মিটার উঁচু এই মসজিদের অভ্যন্তরে মুর্শিদকুলি খাঁর মরদেহ শায়িত রয়েছে। হাজারদুয়ারির চেয়ে শতাধিক বছরের প্রাচীন এই মসজিদ পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। এর স্থাপত্যও কিন্তু অটুট ও অক্ষুণ্ণ নেই। কালের নিয়মে ক্ষয়ে গেছে। কোনো কোনো গম্বুজ ভেঙে পড়েছে। দেওয়ালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জরা বাসা বেধেছে। আড়াই-শো বছরের এই প্রাচীন স্থাপত্য, জীর্ণতা নিয়েও মুর্শিদকুলি খাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে।
এসব কথা ইতিহাসে লেখা আছে। তার পুনরাবৃত্তি করে মূল বিষয় থেকে সরে যাবার দরকার নেই। হাজারদুয়ারিকে কেন্দ্র করে ভাগীরথীর উভয় তীরে যেসব ঐতিহাসিক সৌধ রয়েছে তা নিয়েই পর্যটন মানচিত্রে মুর্শিদাবাদের স্থান।
মুর্শিদাবাদের সঙ্গে জাতির বেদনা আর কলঙ্ক মিশে আছে। সচ্ছসলিলা ভাগীরথী ছাড়া এই কলঙ্ক আর বেদনার সাক্ষী আর কেউ নেই। ইতিমধ্যে অনেক কিছুই সে গ্রাস করেছে। কিন্তু ইতিহাসকে গ্রাস করতে পারেনি। ইতিহাস তার আপন নিয়মে চলেছে। তাকে থামানো যায় না, গ্রাসও করা যায় না।
১২৭ × ৬২ × ২৭মিটার চকমেলানো প্রাসাদে পঞ্চাশটি হল ও গ্যালারি আছে। প্রাসাদের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে দরবার কক্ষ। গোলাকৃতি দরবার কক্ষকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে ২৪.৫ মিটার উঁচু একটি অলংকৃত গম্বুজ। দরবার কক্ষের চারদিকে চারটি দরজা। প্রতিটি দরজার মধ্যবর্তী স্থানে অলংকৃত করিন্থিয়ান স্তম্ভ। গ্রিসের অন্তর্গত করিন্থ নগরীর প্রাসাদে এইরকম স্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায়। স্থপতি জেনারেল ম্যাকলিওড ডানকান করিন্থ নগরীর অনুকৃত স্তম্ভ দিয়ে হাজারদুয়ারিকে গ্রিসীয় চেহারা দিয়েছেন। দেয়ালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গম্বুজ সমর্থিত আয়তাকার স্তম্ভ।
গম্বুজের অভ্যন্তরের উপরিভাগে ষোলোটি পুষ্পবীথি। সঙ্গে দৃষ্টি মুগ্ধকর দ্রাক্ষালতার সারি। দেয়ালের রন্ধ্রে নোনা ধরলেও অঙ্কিত দ্রাক্ষালতার সারি সম্পূর্ণ অক্ষত। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে, কোনো এক নিপুণ শিল্পী কিছুক্ষণ আগে এঁকেছেন।
দরবার কক্ষে ঝুলন্ত অনুপম দীপাধার। সৌন্দর্যের ব্যঞ্জনায় অপরূপ। মানুষের দৃষ্টিকে বিস্ময়াভূত করে রাখে। ৯৬টি দীপ এই অতুলনীয় দীপাধারে সাজানো। ৯৬টি কেন? নয় কেন এক-শো? এর কারণ বোধ হয়, একমাত্র নবাব নাজিম হুমায়ুনই জানেন।
হাজারদুয়ারি শুধু স্থাপত্য শিল্পের অনবদ্য নিদর্শনই নয়, প্রত্নতত্ত্বের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। এই সংগ্রহশালায় রয়েছে বিভিন্নরকমের অস্ত্রশস্ত্র, রয়েছে ডাচ, ফ্লেমিশ, ফ্রান্স ও ইতালির বিখ্যাত চিত্রকরদের অঙ্কিত তৈলচিত্র। এই সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে কতগুলি মর্মরমূর্তি। সংগ্রহশালার সঙ্গেই রয়েছে গ্রন্থাগার। যে গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করেছে সোনার জলে লেখা চিত্রিত পবিত্র কোরান। পুরোনো দলিল দস্তাবেজ, কিছু বাদশাহি ও নবাবি ফরমান-এর সঙ্গে রয়েছে কয়েক হাজার মূল্যবান পান্ডুলিপি। রয়েছে কিছু বাদশাহি আর নবাবি পোশাক, রত্নখচিত স্বর্ণালংকার, রৌপ্য নির্মিত সিংহাসন আর নবাবি পালকি।
ব্রোঞ্জ ও হাতির দাঁতের বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে নবাব নাজিম সংগ্রহশালটিকে আরও সমৃদ্ধশালী করেছিলেন। এ ছাড়াও রয়েছে সিরামিকের কতগুলি অনুপম পুষ্পাধার, কাচের দীপাধার ও কাঠের আসবাবপত্র।
এইসব মহামূল্যবান নিদর্শনগুলি বহুদিন থেকে সংগ্রহশালার ১৫টি গ্যালারিতে সাজানো থাকলেও দীর্ঘদিন অযত্নে ছিল। অনাদর ও অবহেলায় অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক নিদর্শনের ঔজ্জ্বল্যের ওপর মালিন্যের আস্তরণ পড়েছে। তিন দশকের অনাদরে হতশ্রী নিদর্শনগুলিকে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের বিশেষজ্ঞরা দিনরাত পরিশ্রম করে সেগুলিতে পূর্বের শ্রী ফিরিয়ে এনেছেন। ১৫টি গ্যালারিই তাঁরা নতুন করে সাজিয়েছেন। বিখ্যাত শিল্পীদের অঙ্কিত তৈলচিত্রগুলি আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এই তৈলচিত্রগুলি একক। এর দ্বিতীয় কপি পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
ধুলো আর মাকড়সার জালে যে তিন হাজার পান্ডুলিপি ধূসর হয়ে উঠেছিল, তাদের ঔজ্জ্বল্য আবার ফিরিয়ে এনেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রায় সাত হাজার প্রাচ্য ও ইংরেজি ভাষায় লিখিত পুস্তক গ্রন্থাগারে নতুন করে সাজিয়েছেন। আগেই বলেছি ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের বিশেষজ্ঞদের পরিশ্রমে হাজারদুয়ারির পরমায়ু শুধু বেড়ে যায়নি পর্যটকদের কাছে আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মসজিদ রয়েছে। বাংলার মসনদে আরোহণ করার চার বছর পর উঁচু গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ তৈরি করেছিলেন তিনি। নিজের সমাধি আর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার সমাধি ভাগীরথীর অপর পাড়ে খোশবাগে রয়েছে।
ইতিহাস থেকে ফিরে আসা কষ্টকর। কারণ মুর্শিদাবাদ মানে ইতিহাস। মুর্শিদাবাদ মানেই বণিক ইংরেজদের শাসক হিসেবে উত্তরণ।
বরং আমরা ফিরে আসি হাজারদুয়ারিতে। নবাব নাজিম নির্মিত এক অনুপম স্থাপত্যশিল্পে। অনেক ইতিহাস থাকলেও এই হাজারদুয়ারিই আজ মুর্শিদাবাদের প্রাণবিন্দু। হাজারদুয়ারিকেই কেন্দ্র করে পর্যটন মানচিত্রে তাঁর স্থান। বর্তমানে হাজারদুয়ারি পর্যটকদের কাছে প্রথম ও প্রধান আকর্ষণ। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সংস্কার ও শ্রীবৃদ্ধি করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে হাজারদুয়ারিকে অবশ্যই আকর্ষণীয় করে তুলেছেন।
স্থাপত্যশিল্পের সাধক নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহ তাঁর পূর্বসূরিদের কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষে সযত্নে সাজিয়ে রেখেছিলেন। নবাবদের কীর্তিকলাপ ও তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত অনেক দ্রব্য সংগ্রহ করে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর দূরদর্শিতা ছিল। এই সংগৃহীত ও সংরক্ষিত নিদর্শনগুলি যে একদিন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে—নবাব নাজিমের মধ্যে সে-চিন্তাও সক্রিয় ছিল।
এই সুযোগে নতুন করে সংস্কৃত হাজারদুয়ারির একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। বর্ণনায় স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কথা এসে পড়বে।
আগেই বলা হয়েছে হাজারদুয়ারির নির্মাণ কার্য শুরু হয়েছিল ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে আর শেষ হয়েছিল ১৮৩৭-এ। তাজমহল তৈরি করতে সম্রাট শাহজাহানের সময় লেগেছিল ছ-বছর—হাজারদুয়ারি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে আট বছর। তাজমহলের সঙ্গে হাজারদুয়ারির কোনো তুলনাই চলে না। দুটি স্থাপত্যশিল্পের উদ্দেশ্য আলাদা, অবয়ব আলাদা, এমনকী নির্মাণের পেছনে যে সেন্টিমেন্ট কাজ করেছে তার রূপ ও রস সম্পূর্ণ ভিন্ন।
একহাজার দরজা আছে বলে হাজারদুয়ারি। কিন্তু সত্যিই কি একহাজার দরজা আছে? না, নেই। আসলে সত্যি দরজা ও দরজা সদৃশ্য কৃত্রিম দরজা নিয়ে হাজারদুয়ারি। গ্রিক স্থাপত্যের আদলে ও অনুকরণে নির্মিত এই প্রাসাদের স্থপতি ছিলেন জেনারেল ম্যাকলিওড ডানকান।
পান্ডুলিপি ধূসর হয়ে উঠেছিল— তাদের ঔজ্জ্বল্য আবার ফিরিয়ে এনেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রায় সাত হাজার প্রাচ্য ও ইংরেজি ভাষায় লিখিত পুস্তক গ্রন্থাগারে নতুন করে সাজিয়েছেন। আগেই বলেছি ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের বিশেষজ্ঞদের পরিশ্রমে হাজারদুয়ারির পরমায়ু শুধু বেড়ে যায়নি পর্যটকদের কাছে আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে মুর্শিদাবাদের স্থান সর্বোচ্চ। ঐতিহাসিক কারণে মুর্শিদাবাদ পর্যটকদের কাছে টানে। সিরাজের সমাধি থেকে ইমামবাড়ার প্রতিটি ইট ইতিহাস। সমাধি, মসজিদ আর স্মৃতিসৌধের স্থাপত্যশৈলী মুর্শিদাবাদের সম্পদ। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে মিরজাফরের বেগম নির্মাণ করেছিলেন চক মসজিদ। পলাশির যুদ্ধের একদশক পর। কেউ কেউ বলেন এই ধর্মস্থান তৈরি করে মুন্নি বেগম স্বামী মীরজাফরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। ইতিহাসে এসব কথা লেখা না থাকলেও লোকগাথায় এ কাহিনি পাওয়া যায়।
২০৯ মিটার লম্বা ইমামবাড়া আর একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য। ইমামবাড়া তৈরি করেছিলেন নবাব নাজিম ফেরাদুন জাহ ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে। হাজারদুয়ারি নির্মাণের ঠিক একদশক পর। মুর্শিদাবাদের মাটিতে কান পেতে শোনা আর চোখ মেলে দেখার অনেক কিছু আছে।
ইতিহাসের খাতিরেই এই ঐতিহাসিক পর্যটন স্থানটির সম্প্রসারণ প্রয়োজন। মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পলাশি। নদিয়া জেলার এই গ্রাম ইতিহাসের পাতায় বিধৃত। বিশ্বের সুধী সমাজের কাছে পলাশি পরিচিত। বস্তুত এই গ্রাম থেকেই ভারতে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত।
মুর্শিদাবাদ থেকে ৩৫কিমি দূরে নদিয়া জেলায় এই গ্রাম। পলাশির প্রান্তরে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য থাকা সত্ত্বেও ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লা। এই মর্মান্তিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা পলাশির কান্নার সঙ্গে অত্যন্ত পরিচিত।
তদানীন্তন পলাশির চেহারা কেমন ছিল আমরা তা জানি না। সেখানে একটি আম্রকুঞ্জ ছিল, ইতিহাসে তার উল্লেখ আছে। সেখানে একটি প্রান্তর ছিল, তাও আমরা ইতিহাসে পড়েছি। সেই প্রান্তরে ক্লাইভের সঙ্গে নবাব ফৌজের যুদ্ধের প্রহসন ঘটেছিল সেকথাও ইতিহাসে লেখা আছে।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন। ক্লাইভ পলাশির প্রান্তরে নবাব ফৌজকে আক্রমণ করলেন। ক্লাইভের ফৌজে ৮০০ ইংরেজ ও দু-হাজার তিন-শো ভারতীয় সৈন্য ছিল। পলাশির যুদ্ধে ক্লাইভের ৬৫ জন সৈন্য মারা গিয়েছিল। নবাব পক্ষের নিহতের সংখ্যা পাঁচ-শো। পলাশির এই যুদ্ধ একটা প্রহসন হলেও সারাদেশে একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। মিরজাফরের কাছ থেকে ক্লাইভ ২,৩৪,০০০ পাউণ্ড সওগাত পেয়েছিলেন। এসব ইতিহাস সবার জানা। পলাশির যুদ্ধের পর ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মানচিত্র ধীরে ধীরে পালটে গেল। পলাশি শুধু নাম নিয়ে বেঁচে থাকল। বীর মিরমদন আর মোহনলালের শহিদবেদি ছাড়া সেখানে আর কিছু গড়ে ওঠেনি। ইংরেজরাও তাদের বিজয় সৌধ স্থাপন করেনি। তবে ইংরেজ শাসকেরা পলাশিতে একটি রেলওয়ে স্টেশন স্থাপন করেছিল। অবশ্য রেলওয়ে স্টেশন থেকে তথাকথিত যুদ্ধক্ষেত্র প্রায় দশ কিমি দূরে অবস্থিত।
মুর্শিদাবাদের পতনের ইতিহাসের সঙ্গে পলাশি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
তাই ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদের পর্যটন চক্রটি পলাশি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করলে কেমন হয়? কিন্তু তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন উঠবে—পর্যটকদের জন্য পলাশিতে কী আছে? রণক্ষেত্রের কোনো চিহ্ন নেই। ঐতিহাসিক আম্রকুঞ্জ নিশ্চিহ্ন। সত্যি কথা। সত্যিই পর্যটকদের দেখাবার মতো কিছুই নেই, শুধু পলাশি নামটি ছাড়া।
এই নামের খ্যাতি বা অখ্যাতি নিয়েই পলাশিকে একটা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। কিন্তু কেমন করে? তাহলে প্রস্তাবটি একটু খুলেই বলা যাক।
প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার কলকাতা মহানগরী থেকে সব ইংরেজ রাজপুরুষের মূর্তি অপসারণ করেছে। মূর্তির সঠিক সংখ্যা জানা নেই। কমল সরকারের বইয়ে কলকাতা শহরের সব মূর্তি ও তার ইতিহাস লেখা আছে। মূর্তির সংখ্যা পঞ্চাশও হতে পারে, এক-শোও হতে পারে। কোনো মূর্তি পাথরের, কোনোটি-বা ব্রোঞ্জের। মানুষগুলি যাই হোক, মূর্তিগুলি শিল্প-সৌকর্যের অপূর্ব নিদর্শন।
গত তেইশ বছর ধরে মূর্তিগুলি ব্যারাকপুরের লাটবাগানে স্তূপীকৃত করে রাখা আছে। মূর্তি সরানো গেলেও ইতিহাসকে নড়ানো যায়নি। ইতিহাসের পাতা থেকে কোনোদিনই মুছে দেওয়া যাবে না যে, ভারতবর্ষ প্রায় দু-শো বছর ব্রিটিশের পদানত ছিল।
মূর্তিগুলি ব্যারাকপুরের লাটবাগানে স্তূপীকৃত করে না রেখে পলাশির সেই প্রান্তরে পুনর্বাসন দেওয়া যেতে পারে। যে মূর্তিগুলি এক সময় ব্রিটিশ-কলকাতার শোভাবর্ধন করেছিল— সেই মূর্তিগুলি দিয়ে পলাশির প্রান্তরে মুক্ত সংগ্রহশালা নির্মাণ নিশ্চয়ই অবাস্তব নয়। প্রতিটি মূর্তির গায়ে সংক্ষিপ্ত পরিচয় লেখা থাকবে। সময় ও কালের উল্লেখ থাকবে। মূর্তির বিবরণের মধ্যেই ফুটে উঠবে সেই মানুষের চরিত্র, তার কীর্তিকলাপ। পলাশিই হতে পারে মূর্তিগুলির পুনর্বাসন কেন্দ্র। আর সেটা করেই পর্যটন মানচিত্রে মুর্শিদাবাদের সঙ্গে পলাশিকে যুক্ত করা যেতে পারে।
শুধু মূর্তি নয়, আরও কিছু করা যেতে পারে পলাশিতে। করা যেতে পারে একটি মুক্তাঙ্গন কামানের গ্যালারি। অষ্টাবিংশ ও তারও আগের বহু কামান পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে কোম্পানির আমলের অনেক কামান ফলতা আর ডায়মণ্ড হারবারে পড়ে আছে।
নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে ক্লাইভ একটি বৃহৎ কামান উপহার দিয়েছিলেন। কামানের গায়ে সেই উপহারের কথা খোদাই করা আছে। এই কামানটিও নাকি পলাশির যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই কামানটিকে মধ্যমণি করে একটি মুক্তাঙ্গন কামানের গ্যালারি করা যেতে পারে। এই দুটি কাজ করলেই স্বাভাবিকভাবেই পলাশির আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে বেড়ে যাবে।
পলাশির প্রান্তরে ক্লাইভের যে কামান নবাবি ফৌজের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল—কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে রক্ষিত সেই কামান দিয়ে স্বাধীনতার রৌপ্য জয়ন্তী পালন করেছিলেন নাগরিকেরা। সেই কামান দিয়েই পঁচিশবার তোপধ্বনি করে স্বাধীনতার রৌপ্য জয়ন্তী পালন করেছিলেন। তখন নদিয়ার জেলাশাসক ছিলেন দীপক ঘোষ। প্রস্তাবিত পলাশিতে মূর্তির মুক্ত সংগ্রহশালায় শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলে পলাশির ঐতিহাসিক মূল্য বেড়ে যাবে।
কিছুদিন আগে ফোর্ট উইলিয়াম নামের পরিবর্তন করে সিরাজদৌল্লার নামে দুর্গের নামকরণের দাবি জানিয়ে রাজ্য বিধানসভায় একটি বেসরকারি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। তার রূপায়ণের অগ্রগতি আমাদের জানা নেই। ‘পর্যটন বর্ষে’ মুর্শিদাবাদের সঙ্গে পলাশি পর্যটন মানচিত্রে স্থান পেলে সেই সময়ের ইতিহাসের একটি চিত্র পর্যটকেরা খুঁজে পাবেন।
কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে এগিয়ে আসবেন কে?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন