গোপালকৃষ্ণ রায়
চন্দ্রবংশীয় রাজা ত্রিলোচন প্রতিষ্ঠিত ত্রিপুরার প্রাচীন রাজবংশে সহমৃতা বা সতীপ্রথার প্রচলন ছিল। সমাজের সাধারণ স্তরে এই প্রথা কতখানি ব্যাপক ছিল তার কোনো প্রামাণ্য ইতিহাস নেই। রাজপরিবার বহির্ভূত, ঊনবিংশ শতাব্দীতে একটিমাত্র সতীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং সেটাই সম্ভবত শেষ সতীর ঘটনা।
ত্রিপুরায় শেষ সতীর ঘটনা ঘটেছিল এক-শো পঁচিশ বছর আগে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। এই ঘটনার পর তদানীন্তন বঙ্গ সরকারের অনুরোধে ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্রমানিক্য বাহাদুর একটি রাজকীয় আদেশ জারি করে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেছিলেন।
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করে তদানীন্তন বাংলা সরকার যে আইন চালু করেছিলেন, ত্রিপুরার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য ছিল না। স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাজ্য হিসেবেই ত্রিপুরাকে তখন গণ্য করা হত। কিন্তু স্বতন্ত্র মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও ত্রিপুরার রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থায় ব্রিটিশের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল।
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ ডিসেম্বর সারাদেশে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ হলেও ত্রিপুরায় তা কার্যকর হয়নি। ১৮২৯ থেকে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো সতীর ঘটনা ঘটেছিল কি না তার কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায় না। সুতরাং, ধরে নেওয়া যেতে পারে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের পর ত্রিপুরায় আর কোনো সতীর ঘটনা ঘটেনি।
ব্রিটিশ সরকারের সতীদাহপ্রথা নিবারণের আদেশ কার্যকর করতে মহারাজা বীরচন্দ্রমানিক্য যথেষ্ট ইতস্তত করেছিলেন।
সেই সময় তিনিও ভেবেছিলেন যে, এই প্রথা রদ করলে, প্রজাদের ধর্মীয় আচরণের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপের শামিল হবে। বিরোধীরা এই আদেশকে রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের খেপিয়ে তোলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। অনেক চিঠিচাপাটির পর মহারাজা শেষ পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সতীদাহপ্রথা রদ করে রাজকীয় আদেশ জারি করেছিলেন। যদিও লিখিত কোনো দলিল নেই, তবুও রাজপরিবারে প্রবাদ আছে যে, বীরচন্দ্রের সর্বকনিষ্ঠা মহিষী মনমোহিনী দেবী সতীদাহপ্রথা রদ করাতে মহারাজার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
ইতিহাস বলে, ত্রিপুরা থেকে সতীদাহ বা সহমরণপ্রথা বিলোপের জন্য তদানীন্তন সহকারি ব্রিটিশ পলিটিক্যাল এজেন্ট বাবু উমাকান্ত দাস নিরন্তর চেষ্টা করেছিলেন। এই সম্পর্কে তাঁর কৃতিত্ব অবশ্যই স্মর্তব্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ত্রিপুরা থেকে দাসপ্রথা বিলোপসাধনও তাঁরই চেষ্টায় হয়েছিল। মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরকে দিয়ে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বংশানুক্রমিক দাসপ্রথা রদ করে এক আদেশ জারি করেছিলেন উমাকান্ত দাস। প্রবাদের মতো মনে হলেও এখনও প্রচলিত যে, দাসপ্রথা নিষিদ্ধকরণের পেছনে বীরচন্দ্রের প্রিয়তমা মহিষী রানি ভানুমতীর অনেক অবদান ছিল।
যে সতীদাহের মর্মান্তিক ঘটনায় উমাকান্ত দাস অত্যন্ত বিচলিত হয়ে এই কুপ্রথা বিলোপের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারও বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। স্বর্গীয় কৈলাসচন্দ্র সিংহ রচিত রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে এই ঘটনার সামান্য উল্লেখ আছে। কৈলাসচন্দ্র সিংহ চরণ সেনাপতির বিশদ পরিচয় না দিলেও উমাকান্ত দাস এই প্রথা নিবারণের জন্য যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, তাতে চরণ সেনাপতির বাড়ি ত্রিপুরার উত্তর জেলা কৈল শহরে ছিল বলে উল্লেখ করেছিলেন। কৈলাসচন্দ্র সিংহ তার রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে লিখেছেন ‘অ্যাসিষ্টান্ট পলিটিক্যাল এজেন্টবাবু উমাকান্ত দাস সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্য যত্নবান হইলেন। ১২৯৯ ত্রিপুরাব্দের ৮ জ্যৈষ্ঠ প্রকাশ ঘোষণাপত্র দ্বারা মহারাজা সতীদাহ নিবারণ করেন।’
ত্রিপুরার রাজপরিবারে সতীদাহ বা সহমৃতা প্রথার প্রচলন ছিল। রাজমালা ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে রাজপরিবারে সতী ও অনুমৃতাদের কাহিনি সংক্ষেপে উল্লেখ আছে। সম্ভবত রাজ-আক্রোশের ভয়ে তদানীন্তন লেখক ও ইতিহাস রচয়িতাগণ রাজমহিষীদের সতী হবার কাহিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেননি।
রাজপরিবারে প্রামাণ্য সতীর ঘটনা ঘটেছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে। ত্রিপুরার রাজবংশে প্রথম সতী হয়েছিলেন রানি কমলা। পরাক্রান্ত ধার্মিক ও প্রজাহিতকারী রাজা ধন্যমানিক্যের মৃত্যুর পর একই চিতায় অনুমৃতা কমলা দেবী রাজপরিবারে প্রথম সতী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন।
প্রায় উনচল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন রাজা ধন্যমানিক্য। রাজত্বকালের বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতে হয়েছিল। রাজা ধন্যমানিক্যই মাতাবাড়িতে ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৪২৩শকাব্দে যে মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল আজ সেই মন্দির হিন্দুদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান। কসবা গ্রামে রানি কমলা একটি দিঘি খনন করেছিলেন। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা এই দিঘি আজও কমলা সাগর নামে পরিচিত।
রানি কমলা প্রচলিত সতীপ্রথা প্রায় বংশানুক্রমিকভাবে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজপরিবারে চালু ছিল।
বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজা ধন্যমানিক্যের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ধ্বজমানিক্য সিংহাসনে আরোহণ করেন। একটি শিশুপুত্র রেখে তিনি অল্প বয়েসে মারা যান। ধ্বজমানিক্যের ছোটো ভাই দেবমানিক্য কৌশলে ভ্রাতুষ্পুত্র ইন্দ্রকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সিংহাসন দখল করেন। মূল রাজমালার দেবমানিক্য খন্ডে দেখা যায় দেবমানিক্যের সহধর্মিণী স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দিয়ে রাজবংশে সতীপ্রথা বহাল রাখেন।
ত্রিপুরার সিংহাসন দখল মাঝে মাঝে রক্তাক্ত হয়ে উঠত। রাজা দেবমানিক্য প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। ধ্বজমানিক্যের মহিষী রাজপুরোহিতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে দেবমানিক্যকে গোপনে হত্যা করেছিলেন। প্রধান পুরোহিত বা ত্রিপুরী ভাষায় ‘চন্তাই’ নাবালক ইন্দ্রমানিক্যকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজেই রাজ্য শাসন করছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস হবার পর দেবমানিক্যের বিশ্বস্ত সৈন্যবাহিনী প্রথমে চন্তাই এবং পরে ইন্দ্রমানিক্য ও তাঁর মাতাকে হত্যা করে।
ইন্দ্রমানিক্যের নিধনের পর দেবমানিক্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র বিজয়মানিক্য ত্রিপুরার সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৫৩২-১৫৬৪)। বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে তিনি তাঁর প্রথমা মহিষীকে অরণ্যে নির্বাসন দিয়েছিলেন। সে করুণ কাহিনি এখানে নয়—অন্যত্র লেখা যাবে।
বিজয়মানিক্যের অনেক রানি ছিল। রানির সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তিনিও বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেছিলেন। শোকসন্তপ্তা কয়েকজন রানি স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দিয়ে ত্রিপুরার রাজবংশে সতীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিলেন।
বিজয়মানিক্যের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র অনন্তমানিক্য (১৫৬৪) সিংহাসনে বসেন। কথিত আছে যে, তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অমরমানিক্য প্রথম জীবনে সন্ন্যাস গ্রহণ করে কাশীতে বসবাস করছিলেন। অনন্তমানিক্য তাঁর পিতার প্রধান সেনাপতি গোপীপ্রসাদের কন্যা জয়াবতীকে বিবাহ করেছিলেন।
গোপীপ্রসাদ ছিলেন অত্যন্ত চতুর কূটনীতিক। তিনি অনন্তমানিক্যকে মদ্যপানে অভ্যস্ত করিয়ে নিজেই রাজ্যশাসন করছিলেন। একদিন সুযোগ বুঝে নিজের জামাতাকে হত্যা করে ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে উদয়মানিক্য নাম গ্রহণ করে ত্রিপুরার সিংহাসন দখল করেন।
রানি জয়াবতী পিতার এই দুষ্টকর্মকে মেনে নিতে পারেননি। ইতিমধ্যে রাজ্যে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে কয়েকজন রাজভক্ত কর্মচারী অমরমানিক্যকে কাশী থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। উদয়পুরে রাজধানী স্থাপন করে উদয়মানিক্য রাজ্য শাসন করেন ও রানি জয়াবতী কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরের সাহায্যে নিজের পিতাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। এবং অমরমানিক্যকে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসিয়ে (১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে) মৃত স্বামী অনন্তমানিক্যের প্রজ্জ্বলিত চিতায় আত্মাহুতি দেন। জানা যায়, স্বামীর চিতাকে তিনি গোপনে দীর্ঘকাল প্রজ্জ্বলিত রেখেছিলেন। রানি জয়াবতী রাজরক্তকে রাজ্যশাসনে ফিরিয়ে আনার জন্য পিতৃহত্যা করতেও কুন্ঠাবোধ করেননি। ত্রিপুরার রাজবংশে জয়াবতী তাই প্রাতঃস্মরণীয়া। ত্রিপুরার শেষ রাজা বীরবিক্রম কিশোরমানিক্য বাহাদুর জয়াবতী নামে একটি নাটক লিখেছিলেন।
রাজা অমরমানিক্য বহি:শত্রুর দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর নিজের ঘরেও শান্তি ছিল না। সিংহাসনের লোভে রাজকুমারগণ পরস্পরের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
অমরমানিক্যকে বারবার আরাকানের মগেদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। মগেরা ত্রিপুরার সৈন্যদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে রাজধানী উদয়পুর দখল করে নেয়। অমরমানিক্য সপরিবারে মনু নদীর ধারে একটি ছোট্ট অখ্যাত গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মগেরা পোর্তুগিজদের সাহায্যে রাজধানী উদয়পুর লুন্ঠন করে আরাকানে ফিরে যায়।
ভগ্নমনোরথ অমরমানিক্য এই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে পারেননি। গভীর রাত্রিতে মাত্রাতিরিক্ত আফিং সেবন করে আত্মহত্যা করেন। রাজপ্রাসাদ থেকে দূরে একটি অজ্ঞাতনামা গ্রামে ত্রিপুরেশ্বরের আত্মহত্যা ত্রিপুরার ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ঘটনা। অমরমানিক্য আত্মহত্যা করার পর তাঁর প্রধানা মহিষী স্বামীর সহগামিনী হন।
অমরমানিক্যের মহিষী স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হবার পর বেশ কিছুদিন রাজপরিবারে আর কোনো সতী হওয়ার ঘটনার কথা জানা যায় না। ইতিহাস বক্তাগণ এই বিষয়ে বেশ কিছুকাল নীরব ছিলেন। এই নীরবতার কারণও অজানা।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে মহারাজা মুকুন্দমানিক্যের সময় রাজবংশে আর একটি সতীদাহের ঘটনা ঘটে। মুর্শিদাবাদের সঙ্গে ত্রিপুরারাজের সম্পর্ক তখন ভালো ছিল না। রাজা মুকুন্দমানিক্য মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। যবন কতৃক বন্দি হবার অপমান তিনি সহ্য করতে পারেননি। তিনিও তাঁর পূর্বসূরি অমরমানিক্যের মতো বিষপানে আত্মহত্যা করেন। মুকুন্দমানিক্য ছিলেন ত্রিপুরার ১২৬তম নৃপতি। ১৭২৯খ্রিস্টাব্দে তিনি ত্রিপুরার সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
মুকুন্দমানিক্যের মহিষী স্বামীর চিতায় আরোহণ করে রাজবংশের সতীদাহপ্রথা বজায় রাখেন। অবশ্য ওই সময়ে রাজপুরোহিত তাঁকে এই কাজ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। পুরোহিতের সমস্ত প্রার্থনা অগ্রাহ্য করে রাজমহিষী স্বামীর প্রজ্জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিয়ে জীবন বিসর্জন দেন। সম্ভবত মুকুন্দমানিক্যের মহিষীই ত্রিপুরা রাজপরিবারের শেষ সতী। এর কিছুদিন আগে থেকেই ত্রিপুরায় ইংরেজ হস্তক্ষেপ শুরু হয়।
রাজমালা প্রণেতা ও ত্রিপুরা ঐতিহাসিকগণ যে কারণেই হোক, রানি কমলা ও জয়াবতী ব্যতীত আর কোনো সতী রানির নাম কোথাও উল্লেখ করেননি।
একদিন ত্রিপুরার রাজপরিবারে যেমন সতীদাহপ্রথা চালু ছিল, অপর দিকে তেমনি ত্রিপুরার নৃপতিগণ বহুবিবাহে বিশ্বাসী ছিলেন। চন্দ্রবংশীয় ত্রিপুরনৃপতিগণ একরানিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না।
দেশীয় রাজ্যের মধ্যে ত্রিপুরার প্রাচীনত্ব অনস্বীকার্য। রাজা ত্রিলোচন প্রতিষ্ঠিত ত্রিপুরা রাজ্যে ১৭৮জন নৃপতি রাজত্ব করেছেন। প্রথম রাজা ছিলেন রাজা ত্রিলোচন এবং ত্রিপুরার শেষ রাজদন্ড ধারণ করেছিলেন বীরবিক্রম কিশোরমানিক্য। ১৪৫৮খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার রাজাগণ মানিক্য উপাধি গ্রহণ করেন। কৈলাশচন্দ্র সিংহ তাঁর রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বলেছেন, ‘ত্রিপুর রাজবংশ অতিপ্রাচীন, এরূপ প্রাচীন রাজবংশ ভারতে দ্বিতীয় নাই।’
সতী ও বহুবিবাহপ্রথা একই সঙ্গে ত্রিপুরার রাজবংশে প্রচলিত ছিল। রাজ পরিবারে তিন প্রকারের বিবাহ সংঘটিত হত—ব্রাহ্ম, শান্তিগৃহীতা ও কাছুয়া। ব্রাহ্ম বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় বাঙালি বিবাহের অনুকরণে এবং এই বিবাহের প্রচলনই সর্বাধিক। শান্তিগৃহীতা বিবাহে কন্যা সম্প্রদানের কোনো প্রয়োজন থাকে না।
বর-কনে পাশাপাশি বসে পরস্পরের সঙ্গে মালা বদল করে। অবশ্য চন্তাই মন্ত্রোচ্চারণের পর শান্তিজল ছিটিয়ে দিলেই বিবাহ সিদ্ধ হয়। কাছুয়া বিবাহ প্রাচীন গান্ধর্বমতানুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়। শান্তিগৃহীতা মহিষীরাও মহারানি, মহাদেবী ও ঈশ্বরী উপাধি পেতেন। কিন্তু কাছুয়া মতে বিবাহিত মহিষী কোনো উপাধি ব্যবহার করতে পারতেন না। অবশ্য রাজার অনুমতি ক্রমে কাছুয়া মহিষী মহারানি বা মহাদেবী উপাধি ব্যবহার করতে পারতেন। কাছুয়া মহিষীর গর্ভজাত সন্তানদের অষ্টাবিংশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজরা জারজ বা দাসীপুত্র বলে উল্লেখ করেছে। কাছুয়া মতে বিবাহিত রানির মধ্যেও অনেকেই সতী হয়েছিলেন।
সেনাপতি গোপীনাথ উদয়মানিক্য নাম গ্রহণ করে ত্রিপুরা শাসন করেছিলেন। তিনি ছিলেন বহু পত্নীতে বিশ্বাসী। তাঁর মোট দু-শো চল্লিশ জন মহিষী ছিল। রাজা রত্নমানিক্য একশত পঁচিশটি ভার্যার অধিকারী ছিলেন। এক-শো পঁচিশজন স্ত্রী থাকা সত্বেও তিনি ছিলেন নি:সন্তান। একমহিষীতে সুখী এমন কোনো রাজা ত্রিপুরার রাজবংশের তালিকায় পাওয়া যায় না।
একদিকে স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হয়ে অনেক রানি যেমন সতী হয়েছেন, অপর দিকে তেমনি স্বামীসঙ্গ ও সোহাগ বঞ্চিতা অনেক রানি গভীর রাতে পরপুরুষের সঙ্গে অভিসারে লিপ্ত হয়েছেন। এমন ঘটনা ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিহাসে বিরল নয়।
রাজা উদয়মানিক্য তাঁর দু-শো চল্লিশ রানির মধ্যে বেশ কয়েকজনকে পরপুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার অপরাধে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন। গৌড় থেকে একজন মুসলমান রাজপুরুষ উদয়মানিক্যের রাজত্বকালে ত্রিপুরা পরিভ্রমণে এসেছিলেন। রাজঅতিথি হিসেবে প্রাসাদেই তাঁর থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সুবেশ সুদেহী সুন্দর মুখ রাজপুরুষকে দেখে দীর্ঘদিন স্বামীসঙ্গ বঞ্চিতা কয়েকজন রানির মনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। রাজপুরুষের অন্তরও তাঁদের রূপাগ্নিতে দগ্ধ হয়েছিল।
রানিদের গোপন অভিসারের খবর উদয়মানিক্যের কানে পৌঁছেছিল। তিনি গৌড়ের রাজপুরুষকে দেশ থেকে বহিষ্কার আর রানিদের হাতির পায়ের নীচে নিক্ষেপ করে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন।
রাজা বীরচন্দ্রের আমলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ত্রিপুরায় সতীদাহপ্রথা রদ হয়। মুকুন্দমানিক্যের মহিষী রাজপরিবারের শেষ অনুমৃতা হলেও সাধারণ সমাজে চরণ সেনাপতির স্ত্রী নিচ্ছন্দদেবী ত্রিপুরার শেষ সতী।
নিচ্ছন্দদেবী সম্পর্কে বিশেষ কোনো খবর পাওয়া যায় না। চরণ সেনাপতি কী করতেন তাও অজানা। তবে একথা স্বীকার্য যে, নিচ্ছন্দদেবী সতী হবার পর ত্রিপুরায় সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ করার পর গত এক-শো বছরের মধ্যে ত্রিপুরায় আর কেউ সতী হয়েছে কি না তার কোনো সরকারি রেকর্ড নেই।
মহারাজা বীরচন্দ্রের আমল থেকেই ত্রিপুরায় আধুনিক যুগের সূচনা। বীরচন্দ্র ছিলেন রুচিশীল সংস্কৃতিবান পুরুষ। তাঁর আমলে ত্রিপুরায় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতসাধনা চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। তিনি নিজেও ছিলেন কবি, চিত্রকর এবং সংগীতসাধক। তাঁর দরবারে সপ্ত-সংগীত সাধকের সমাবেশ ঘটেছিল। এঁদের মধ্যে যদু ভট্ট অন্যতম। মহারাজা বীরচন্দ্র তাঁকে ‘তানরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তাঁর আমলেই কিশোর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন