গোপালকৃষ্ণ রায়
বনাম্বরকে নিয়ে গল্প লিখলেই ভালো হত। তাকে নিয়ে অভিনব উপন্যাসও লেখা যায়। উপন্যাসের সব উপকরণ এই একমিটার লম্বা মানুষটির মধ্যে আছে। তার জীবন আছে। জৈবিক চাহিদা আছে। সে বিবাহিত। ৯০ সেমি লম্বা স্ত্রীর প্রতি রাগ-অনুরাগ আছে। সর্বোপরি বনাম্বর দুটি কন্যার গর্বিত পিতা। সুতরাং, এমন মানুষটিকে নিয়ে অভিনব উপন্যাস লেখা গেলেও—এই মুহূর্তে তাকে নিযে সচিত্র নিবন্ধ লেখা ভালো। নিবন্ধের ফ্রেমের মধ্যে তার জীবনের পরিমন্ডলকে ধরে রেখে, অন্য কোনো সময় না হয়, একটি গল্প লেখা যাবে। অথবা বাস্তবভিত্তিক বনাম্বরের জীবনালেখ্য। আপাতত নিবন্ধের মধ্যেই তার বিচিত্র জীবনের একটি রেখাচিত্র আঁকা যাক।
বনাম্বর লম্বায় একমিটার। ফোলানো ঘন চুল বাদ দিলে তার উচ্চতা আরও একসেন্টিমিটার কম হবে। কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত তার অবয়ব স্বাভাবিক। কোমরের নীচে থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত বিকৃত এবং বিধাতার খেয়ালে অভিশপ্ত।
চেয়ারে বসে থাকলে সে একটি পূর্ণাবয়ব মানুষ। কিন্তু দেহের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিসদৃশ ৪০ সেমি লম্বা পায়ে সে যখন দাঁড়ায় এবং তুর তুর করে হাঁটে—তখন তাকে পাঁচ বছরের ছোটো শিশু মনে হয়। কাছে গিয়ে মুখের দিকে তাকালেই ভুল ভাঙে। মুখ দেখে মনে হয় বয়েস তার পাঁচ নয় পঁয়ত্রিশ। একটি পোড়খাওয়া মুখ।
মাথায় ব্যাক ব্রাশ করা কালো কোঁকড়ানো চুল। ঘন কালো মোটা গোঁফ। চোখে চতুর দৃষ্টি। কপালে কুঞ্চন নেই। জোড়া ভুরু বুদ্ধিদীপ্ত।
পরনে হাফ শার্ট আর ফুল প্যান্ট। সে কখনো চটি পায়ে দেয় না। পাঁচ ইঞ্চি পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দ্রুত চলাফেরা করে।
চলতি ভাষায় বনাম্বর বামন।
বনাম্বরের সঙ্গে আমার পরিচয় পুরীর সি-সাইড-ইন-এ। দিন কয়েকের জন্য পুরী গিয়েছিলাম। বেড়াতেও নয়, বিশ্রাম নিতেও নয়। কলকাতার কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে। নির্জন সৈকতে সি-সাইড-ইন। স্বর্গদ্বারের মতো কোলাহল আর জনাকীর্ণ নয়। চক্রতীর্থ রোড অপেক্ষাকৃত নির্জন। সি-সাইড-ইন একটি পুরোনো বাংলো টাইপের বাড়ি। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মাঝে মাঝে বসবাসের জন্য শ্রীক্ষেত্রে এই বাড়ি করেছিলেন কোনো এক শৌখিন জমিদার। হাত বদল হয়ে এখন সি-সাইড-ইন। বাংলা করলে দাঁড়ায়—সাগর-তীর-পান্থনিবাস।
পান্থনিবাসে পরিণত হলেও—বাংলোর আভিজাত্য ক্ষুণ্ণ হয়নি। সামনে-পেছনে লন। সিঁড়ি থেকে গেট পর্যন্ত নুড়ি বিছানো রাস্তা। দু-ধারে ফুলের কেয়ারি। জানালার পাশে শিউলি ফুলের গাছ। নোকর নিবাস বা সারভেন্ট কোয়ার্টারকে ভেঙে প্রায় তিন-তারা হোটেলের চেহারা দেওয়া হয়েছে। দরজায়-জানলায় দামি পর্দা। চার-চালা বারান্দায় অসমের বেতের চেয়ার টেবিল। সামনেই সমুদ্র। অন্তহীন নীল জল—সীমাহীন নীলিমায় অন্তর্লীন। মাথায় বৈদুর্যমণির ঝলকানি নিয়ে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ তটরেখায় আছড়ে পড়ছে। সহস্র অজগরের মতো সমুদ্র অহরহ গর্জায়। রাতে সমুদ্র গর্জায় বেশি। মনে হয় বাংলোর নীচে কতগুলি অজগরের যুদ্ধ চলেছে। সকালে সমুদ্র শান্ত। নীল সমুদ্রের সীমাহীনতায় প্রত্যুষে সোনালি সূর্য উঁকি দেয়। সূর্য যত বেশি ওপরে ওঠে—সমুদ্র তত বেশি উত্তাল হয়। ঢেউ শুধু ঢেউ। অসংখ্য ঢেউ। সকালের সোনালি ঢেউ—দুপুরে রুপোলি হয়ে ওঠে। বারান্দায় বসে দেখা যায়, পালতোলা জেলে ডিঙিগুলি কখনো ঢেউয়ের মাথায় ভেসে উঠছে—আবার চোখের নিমেষে তলিয়ে যাচ্ছে। ডুবছে আরভাসছে। ভাসা আর ডোবার জীবন-পণ-করা জীবিকার অন্বেষণ শেষে সন্ধ্যার আগেই কূলে ফিরে আসে তারা।
এই সি-সাইড-ইন-এ বনাম্বরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এই পান্থনিবাসে চাকরি করে সে। তার ওপরেই আমার দেখাশোনার ভার।
তার দেহকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। পা থেকে কোমর আর অপর অংশ কোমর থেকে মাথা। বছর পাঁচের বয়েসের শিশুর কোমরে একটি হৃষ্ট-পুষ্ট বয়স্ক মানুষের মাথা বসিয়ে দিলে যেমন বেমানান দেখায় বনাম্বরকে দেখে তেমনি মনে হয়। ৪০ সেমি লম্বা পায়ে অত্যন্ত দ্রুত লয়ে এ-ঘর থেকে সে-ঘর ছুটে যায়। পথ চলে প্রায় দৌড়িয়ে। এ-ঘর থেকে ডাক পেয়ে ছুটে আসে বনাম্বর—ও-ঘরে বেল বেজে উঠলে ছুটে যায় সে। কখনো খাবার আনছে—কখনো চা। তার ক্লান্তি নেই। মুখে-চোখে বিরক্তি নেই। ঠোঁটের ফাঁকে উজ্জ্বল হাসির রেখা কখনোই মিলিয়ে যেতে দেখিনি।
নতুন কেউ এলেও বনাম্বরই তার সঙ্গে কথা বলে। ঘর খালি থাকলে ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যায়। না থাকলে নিজেই বলে দেয়। টেলিফোন বেজে উঠলে ছুটে গিয়ে ধরে। ইয়েস, নো, নো-রুম— বেশ কয়েকটি ইংরেজি শব্দও সে বলে। চক্রতীর্থ রোডের সি-সাইড-ইন যদি দেহ হয়—বনাম্বরকে নির্দ্বিধায় প্রাণ বলা যায়। পান্থশালার অন্য বয়দের নাম কেউ জানে না। কেউ তাদের ডাকে না। সকলের মুখেই বনাম্বর। তার অনুপস্থিতিতে অন্যেরা উঁকি মারলেও তাদের একই প্রশ্ন শুনতে হয়—বনা কোথায়?
নিরলস বনাম্বর। ছোটো পা দুটি সতত চঞ্চল সর্বদা ছুটে চলেছে। কালো গভীর পুরু গোঁফের নীচে সরল হাসির রেখা। মুহূর্তের জন্যও ভুরু বিরক্তিতে কুঞ্চিত হয় না। এই বনাম্বরের ওপর আমার দেখভালের দায়িত্ব।
ঠিক ছ-টা বাজতেই শয্যা-চা নিয়ে হাজির। চা দিয়েই মই বেয়ে তর তর করে ওপরে ওঠে। জানালা খুলে দেয়। দরজার পর্দা সরিয়ে দেয়। সমুদ্র থেকে ভেসে আসা হাওয়ায় ঘর ভরে যায়।
বাংলোর জানলাগুলি উঁচু বলে বনাম্বর নাগাল পায় না। একটি বাঁশের মই তৈরি করে নিয়েছে। জানালা বন্ধ ও খোলা, সুইচ অফ-অন সবই ওই মই দিয়ে করে। কেউ যদি মনোযোগ দিয়ে তার কর্মতৎপরতা দেখে—তাকে অবশ্যই বিস্মিত হতে হবে। বনাম্বর আমার চোখেও বিস্ময়। আরও বিস্ময় তার জীবন। তার ঘরসংসার, স্ত্রী-সন্তান।
বনাম্বর যে বিবাহিত— সে খবরে আমি অবাক হয়ে যাই। কোন মহিলা ১মিটার লম্বা বিকৃতদেহী বামনকে বিয়ে করল! আর সেই বিবাহিত জীবন কতটা শান্তির আর কতটাই বা সুখের!
বিয়ের খবর বনাম্বরের মুখেই শুনেছিলাম। সন্ধ্যার পর বারান্দায় বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছি। বনাম্বর চা আনতে গেছে। বিশাল সমুদ্রের ওপর একটি কালো আবরণ নেমে এসেছে। দূর নীলিমায় কিছুই দেখা যায় না। সীমাহীন ক্ষুব্ধ তরঙ্গ শুধু গর্জে চলেছে। মুহূর্তের জন্য সে গর্জন থামে না। বিরামহীন বিক্ষুব্ধ গর্জন। কার ওপর সমুদ্রের এত রাগ! কার ওপর সে এত ক্রুদ্ধ!
বনাম্বর বলে, জানেন স্যার, আমার স্ত্রী আছে। আমি চমকে উঠি। চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তার মুখের দিকে। ওই মুখ দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না— সর্বসাকুল্যে তার উচ্চতা ১মিটার। পূর্ণ প্রৌঢ় পুরুষের মুখ। ঘন কালো চুল। ব্যাক ব্রাশ। মোটা গোঁফ। বুদ্ধিদীপ্ত দুটি কালো চোখ। পরনের প্যান্টটাই মাত্র দেখা যায়। পা দুটো কারো চোখে পড়ে না। কোমর থেকে পা পর্যন্ত অভিশপ্ত।
তুমি বিয়ে করেছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার স্ত্রী আমার মতোই বামন। আমার চেয়ে লম্বায় তিন ইঞ্চি ছোটো। এমন বামন দম্পতিকে দেখার কার না লোভ হয়। দেখতে ইচ্ছে করে খর্বাকৃতি বনাম্বরের খর্বকায় বউকে। জানতে ইচ্ছে করে কতটা নারীত্ব আর কতটা নারীসুলভ লালিত্য তার মধ্যে আছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বনাম্বর আর একটি বিস্ফোরণ ঘটায়।
আমার দুটি মেয়ে আছে, স্যার। সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে তার ছোটো কথা দুটি আমাকে কেমন যেন স্তম্ভিত করে দেয়।
নব্বই সেন্টিমিটার লম্বা মেয়ে কী করে মা হল? ডাক্তারি শাস্ত্রে এই অদ্ভুত ঘটনার কি কোনো নজির আছে! থাকলেও থাকতে পারে, আমার জানা নেই। আমার বিস্ময়, এইটুকু পেটে কী করে সন্তান এল! হয়তো অপরিণত মানব শিশু। বনাম্বরের চেয়ে, তার স্ত্রীকে দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠি। জানতে ইচ্ছে করে, কোথায় সন্তান হল? কেমন করে হল? সন্তান দুটি কি স্বাভাবিক অথবা তাদের মতোই বিকৃত—খর্বাকৃতি।
বনাম্বরের একটি মেয়ে তাদের মতো। আর একটি সুস্থ, স্বাভাবিক। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেয়াল। বিজ্ঞানীদের কাছে ব্যাখ্যা থাকলেও—আমার বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা মেলে না।
বনাম্বর বলে, আমার স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারেরা খুবই বিপদে পড়েছিলেন। তাঁরা নাকি এমন ‘মা’ জীবনে দেখেননি।
স্বাভাবিক প্রসব করতে পারেনি বনাম্বরের স্ত্রী। লেবার পেইন উঠতেই সিজারিয়ান করে সন্তানটি বার করেছিলেন ডাক্তারেরা। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন—বনাম্বরের স্ত্রীর সন্তান ধারণের ক্ষমতা স্বাভাবিক হলেও—নর্মাল ডেলিভারি সম্ভব নয়। পিতা-মাতার দৈহিক বিকৃতির প্রভাব থেকে প্রথম মেয়েটি মুক্তি পায়নি। একটি খর্বাকৃতি দম্পতির তাদের মতোই সন্তান জন্মেছে।
যাতে দ্বিতীয় সন্তান না আসে তার জন্য ডাক্তারেরা তাকে পই পই করে বারণ করেছিল। কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করতে পারেনি বনাম্বর দম্পতি। আবার সেই হাসপাতাল। আবার পেট চিরে সন্তান বার করা। চিকিৎসাজগতে আবার একটি বিস্ময়ের সৃষ্টি। বিকৃতদেহী যে মহিলাটির সন্তান ধারণে অক্ষম হওয়া উচিত—দু-বছরের মধ্যে সে দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিল! এবারের সন্তান হল সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক কন্যা সন্তানটিও চিকিৎসকদের কাছে আর একটি বিস্ময়। বাবা-মায়ের দেহের বিকৃতি সন্তানের ওপর বর্তানোই স্বাভাবিক। প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। কিন্তু দ্বিতীয় সন্তান সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হওয়ায় চিকিৎসকদের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে! বনাম্বরের স্ত্রী চিকিৎসা জগতে এক নতুন নজির সৃষ্টি করেছে।
তোমার বিয়ে হল কী করে? উপযুক্ত পাত্রীই বা জুটল কেমন করে?
বনাম্বর গলা ছেড়ে হেসে ওঠে। সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে হাসির রেশ মিলিয়ে যাবার আগেই বনাম্বর বলে, সে এক কাহিনি, স্যার।
হোটেলে কাজ করার ফলে স্যার আর ম্যাডাম বলাটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। ট্রাকের একটি ড্রাইভার বিয়েটা ঠিক করেছিল। তখন একটি মোটর গ্যারেজে কাজ করত বনাম্বর। পুরী থেকে মাইল কয়েক দূরে একটি গ্রামে সেই ড্রাইভারের এক আত্মীয়ের মেয়ে আছে। তারাও উপযুক্ত বামন পাত্র খুঁজছিল। যোগাযোগের পর বিয়ে হয়ে গেল। চক্রতীর্থ রোডের কাছে একটি ভাড়া ঘরে দুই কন্যা নিয়ে খর্বাকৃতি দম্পতির সংসার।
তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছিল বনাম্বর। যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি—একমিটারের কিছু কম দুই কন্যার জননীর সংসার। কিন্তু বনাম্বর কন্যাদ্বয় ও স্ত্রীকে এনে আমায় দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। খর্বাকৃতি মেয়েটির সঙ্গে মায়ের চেহারার পুরো মিল আছে। নাক, চোখ-মুখের গড়ন এক। কিন্তু স্বাভাবিক কন্যাটির চেহারাই আলাদা। গায়ের রং অপেক্ষাকৃত ফর্সা। নাক-মুখ-চোখ, বাবা-মায়ের সঙ্গে মিল নেই।
মনে মনে ভাবি, বড়ো হলে স্বাভাবিক কন্যাটির মনের প্রতিক্রিয়া কী হবে?
হয়তো কিছুই হবে না। যা দেখছে—তাই চোখে সয়ে যাবে। সব কিছু মেনে নেবার জন্য মনটাও তার সেইভাবে তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
এটি নিবন্ধও হল না—গল্পও হল না। একটি খর্বাকৃতি দম্পতির জীবনের একটি অসম্পূর্ণ রেখাচিত্র অঙ্কিত হল মাত্র। কোনো একসময় বনাম্বরকে নিয়ে একটি নভেলেট লেখা যাবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন