জ্ঞাননৌকা – গোপালকৃষ্ণ রায়

গোপালকৃষ্ণ রায়

ডিঙির নাম ‘জ্ঞাননৌকা’। যন্ত্রচালিত বাতানুকূল স্টিলের একটি নৌকো। চারজন বসতে পারে। ৪৪০ পাউণ্ড ওজনের নৌকোটি এমনভাবে তৈরি যে ওলটালেও ডুববে না। পৌরাণিক পবিত্র মানস সরোবরে নৌকোটি ভাসানো হয়েছিল।

কল্পকথা আর অজস্র রহস্যে ঘেরা পবিত্র মানস সরোবরে নৌকোটি ভাসিয়েছিলেন সন্ন্যাসী বিজ্ঞানী-অভিযাত্রী স্বামী প্রণবানন্দ। ১৪,৯৫০ ফুট ওপরে কৈলাস ও মান্ধাতা পর্বতের পাদদেশে সমুদ্র-সদৃশ প্রাগৈতিহাসিক মানস সরোবরে নৌবিহারের জন্য নৌকো ভাসাননি প্রণবানন্দ। সমীক্ষা করার জন্য ৩২০ স্কোয়্যার কিমি পবিত্র সরোবরে নৌঅভিযান করেছিলেন সন্ন্যাসী অভিযাত্রী। ঠিক অর্ধ শতাব্দী পূর্বে সাধক অভিযাত্রী প্রণবানন্দ স্টিলের তৈরি নৌকোটি নিয়ে গিয়েছিলেন কৈলাস-মানস সরোবরে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কৈলাস-মানসে যাবার পথ ছিল অধিকতর দুর্গম। এই দুর্গম পথেই তিনি বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি স্টিলের নৌকো আর একটি রবারের ভেলা। স্টিলের নৌকোটির নামকরণ করেছিলেন ‘জ্ঞাননৌকা’ আর রবারের ভেলাটির নাম দিয়েছিলেন ‘জনমভূমি’।

সাধারণ মানুষের কাছে যা অকল্পনীয় ও অচিন্তনীয় স্বামীজির সেই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন ভাবনগরের তদানীন্তন মহারাজ কৃষ্ণকুমার সিনহা। বিশেষভাবে নির্মিত স্টিলের নৌকোটি স্বামীজিকে উপহার দিয়েছিলেন মহারাজা। তাঁর বদান্যতায় সাধক অভিযাত্রী প্রণবানন্দ প্রাগৈতিহাসিক পবিত্র মানস সরোবরে সর্বপ্রথম নৌঅভিযানের কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। শীত ও তুষারঝড় উপেক্ষা করে, ১৪,৯৫০ফুট ওপরে অবস্থিত তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ সরোবরে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করেছিলেন তিনি। মানস সরোবরের জল আর তেল পরীক্ষা করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। আর সেই সঙ্গে সরোবরের মধ্যে উষ্ণ প্রস্রবণের সন্ধান। অতলস্পর্শী সরোবরে তেল খুঁজে পেয়েছিলেন স্বামী প্রণবানন্দ। জলের গভীরতা পরিমাপ করেছিলেন তিন-শো ফুট। পরিক্রমা করে সরোবরের পরিধিও মেপেছিলেন তিনি। প্রায় ৩৬০ স্কোয়্যার কিমি।

স্বামী প্রণবানন্দজির মুখে এই কাহিনি শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ৩জানুয়ারি রাঁচিতে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমাদের সাক্ষাৎকারও একটি কৌতুকপ্রদ নাটক। পরিচয়ের পালা পরিবেশনে ফাঁক রাখা উচিত নয়। গল্পটি খুলেই বলা যাক।

রাঁচির সন্নিকটে মেশরায় অবস্থিত বিড়লা আই আই টি-তে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন বসেছে। দেশ-বিদেশ থেকে কয়েক হাজার নামিদামি বিজ্ঞানী এসেছেন। ৩জানুয়ারি বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদবোধন করলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি।

সপ্তাহব্যাপী বিজ্ঞান মেলায় দেশের বিজ্ঞান ভাবনার রূপরেখা আঁকা হয়। দারিদ্র্য দূরীকরণে বিজ্ঞানের প্রয়োগ, পরিবেশ সুস্থ রাখায় বিজ্ঞানীদের ভূমিকা ও পারমাণবিক শক্তিকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করার পরিকল্পনা বিজ্ঞান কংগ্রেসের আলোচ্য বিষয়।

বিজ্ঞানের সব শাখার বৈজ্ঞানিকেরা উপস্থিত। তাঁদের ঝুলিতে নতুন আবিষ্কারের বার্তা। সর্বশেষে, দেশের বিজ্ঞান-নীতি নির্ধারণের জন্য সমবেত বিজ্ঞানীদের সুপারিশ।

সাহেবি পোশাক পরিহিত সদাব্যস্ত বিজ্ঞানীদের মধ্যে ক্ষীণকায় গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীর উপস্থিতিতে আমার মনে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। সম্ভবত কিছু কৌতূকও অনুভব করেছিলাম।

পায়ে তালি-দেওয়া ক্যাম্বিসের জুতো। পরনে একফালি গেরুয়া কাপড়। এক মুখ সাদা দাড়ি। কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা সাদা-কালো চুল। কাঁধে ঝোলানো মলিন একটি কাপড়ের ব্যাগ। সাহেব-সুবো বৈজ্ঞানিক সমাবেশে এমন সন্ন্যাসী বড়ো বেমানান। বিজ্ঞান মেলায় তাঁর উপস্থিতি আমার বোধগম্য হয় না।

রাঁচি শহরের প্রান্ত সীমায় মেশরার শাল-সেগুন বীথির সরু রাস্তা ধরে অধিবেশন মঞ্চের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন তিনি। আমি ছুটছি। পরপর চারটে বক্তৃতা শুনতে হবে। বক্তৃতা করবেন দেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা। সন্ন্যাসীকে দেখার সময় কোথায়? তবুও তাঁর পাশে এসে আমাকে থামতে হয়।

অনেক ক-টা সিঁড়ি ভেঙে লেকচার হলে পৌঁছোতে হবে। ক্লিশিত দেহে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙছেন সন্ন্যাসী। কোথায় যাচ্ছেন তিনি? বিজ্ঞান সভায় সন্ন্যাসীর কী প্রয়োজন? কৌতূহল বড়ো বিষমবস্তু। একবার মনের মধ্যে তার জন্ম হলে নিবৃত্তি না হওয়া পর্যন্ত বড়ো বিব্রত করে। মনের মেক-আপে ঔৎসুক্য একটি বড়ো অন্তরায়। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠেছেন সন্ন্যাসী, পাশে পাশে চলেছি। একবারও মুখ ফিরিয়ে দেখলেন না। গভীর চিন্তায় আবিষ্ট মনে সিঁড়িতে পা রাখছেন। কখনো-বা ক্ষণিকের জন্য থামছেন। সুযোগ বুঝে জিজ্ঞাসা করি, আপনাকে সাহায্য করতে পারি? শুধু চোখ মেলে একবার দেখলেন অশীতিপর বৃদ্ধ সন্ন্যাসী। মুখে কিছু বললেন না। ঘাড় নাড়লেন শুধু। আরও অন্তত পনেরোটি সিঁড়ি ভাঙতে হবে তাঁকে। তারপর করিডোর ধরে হাঁটতে হবে কিছুক্ষণ। আবার থামতেই বলি, আমার কাঁধে হাত রাখতে পারেন। এবার মৃদু হাসলেন সন্ন্যাসী। ইংরেজিতে বলেলেন, অনেক ধন্যবাদ। তুমি এগিয়ে যাও। যেতে চাইলেও যেতে পারি না। সন্ন্যাসী আমাকে চুম্বকের মতো টানতে থাকেন। সন্ন্যাসী সম্পর্কে অনেক কৌতূহল ইতিমধ্যে আমার মনে জন্ম নিয়েছে। কৌতূহলের নিবৃত্তি দরকার। নিষেধ সত্ত্বেও পাশাপাশি চলতে থাকি। শেষ ধাপে এসে সন্ন্যাসী বলেন, আমি একা পঁচিশ বার মানস সরোবর আর তেইশ বার কৈলাস পরিক্রমা করেছি। কারোর সাহায্য নিইনি।

নিমেষের মধ্যে কৌতুক মিলিয়ে যায়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাঁর শ্বেতশ্মশ্রুমন্ডিত বলিরেখায় কুঞ্চিত মুখের দিকে চেয়ে থাকি। তেইশ বার কৈলাস আর পঁচিশ বার মানস সরোবর পরিক্রমা করেছেন? বয়েসের ভারে কিঞ্চিৎ ন্যুব্জ মানুষটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। একবার কৈলাস-মানস সরোবরে যাওয়া যেখানে ভাগ্যের কথা, সেখানে বারংবার গিয়েছেন তিনি। কেন? আবার আমার মনে সেই কৌতূহলের পুনর্জন্ম ঘটে। সাধনায় সিদ্ধি? আধ্যাত্মিক উত্তরণ? অথবা মুক্তির সন্ধান?

আরও কিছু বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। করিডোরে পৌঁছোতেই অবাক হয়ে যাই। সন্ন্যাসীকে দেখেই দূর থেকে ছুটে আসেন মি. জি কে দত্ত। ন্যাশনাল অ্যাটলস থিমাটিক ম্যাপিং অর্গানাইজেশনের ডিরেক্টর। সন্ন্যাসীকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন।

আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, স্বামীজির সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে? সন্ন্যাসী মৃদু হেসে বলেন, আমার সঙ্গে ওর পরিচয় করার ইচ্ছা হয়েছে।

দত্ত সাহেবের সঙ্গে সন্ন্যাসী চলে যান সভাকক্ষে। সেখানে ভূগোল ও মানচিত্র নিয়ে জনৈক বিশেষজ্ঞের বক্তৃতা চলছে। সন্ন্যাসী তাঁর বক্তৃতা শুনতে আসছেন।

আমার আর অন্য সভাকক্ষে বক্তৃতা শুনতে যাওয়া হয় না। যে সন্ন্যাসী কৈলাসে যান, পর্বতের গুহায় বসে ধ্যান করেন, আবার যে সন্ন্যাসী বিজ্ঞান কংগ্রেসে আসেন তাঁকে জানবার আগ্রহ দমন করতে পারি না। বিজ্ঞান কংগ্রেসে সন্ন্যাসী প্রণবানন্দ আমার কাছে খবর হয়ে ওঠেন। তাঁদের পিছু পিছু আমিও সভাকক্ষে ঢুকি। স্বামীজির পাশের চেয়ারে চুপ করে বসি। আর একবার মুখ তুলে আমার দিকে তাকান তিনি। অষ্টাশি বছরের বৃদ্ধ। তবু কী উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি। সন্ন্যাসীকে বসিয়ে দিয়ে সভাকক্ষ থেকে চলে যান দত্ত সাহেব।

বক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও বক্তব্য আমার কানে ঢোকে না। মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে একটি মানুষ কেমন করে পঁচিশ বার মানস সরোবর পরিক্রমা করলেন। কেমন করে তেইশ বার হর-পার্বতীর বাসস্থান কৈলাস প্রদক্ষিণ করলেন। ভাগ্যে না থাকলে একবার যেখানে যাওয়া যায় না। ১৯২৮খ্রিস্টাব্দ থেকে ফিবছর সেখানে কী করে গেলেন সন্ন্যাসী!

বুঝতে পারি পাশে বসায় প্রণবানন্দজি অস্বস্তি বোধ করছেন। এক সময় বলে ওঠেন, আমার সঙ্গে কি তোমার কোনো দরকার আছে?

সেইজন্যই তো বসে আছি।

তবে চলো। অন্য কোথাও যাই। এক মনে দুটি কাজ করা যায় না। হয় বক্তৃতা শুনতে হয়, আর নয় তোমার কথা। স্বামীজি উঠে দাঁড়ান। ঋজু দেহ। বয়েসের ভারে কিঞ্চিৎ ন্যুব্জ। ঝোলাটা কাঁধে তুলে নেন। বলেন, এসো। ধীরে ধীরে তাঁর অনুগমন করি।

শীতের প্রাক-মধ্যাহ্ন। কনকনে পৌষালি হাওয়া। সিঁড়ি ভেঙে আবার নীচে নামেন স্বামীজি। একটি সেগুনগাছের ছায়ায় এসে বসেন। এবার দুজনে মুখোমুখি। বলো, কী জানতে চাও তুমি?

আপনার কৈলাস-মানস সরোবর পরিক্রমা শুনতে চাই। কীসের আকর্ষণে বার বার আপনি সেখানে গেছেন? মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে স্বামীজির ওষ্ঠে।

আমি তো সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর বড়ো আকর্ষণই তো কৈলাস আর মানস সরোবর। এ দুটিই যে ‘মিথ’ আর ‘মিস্টিকে’ ভরা। অধ্যাত্ম সাধনার অতুলনীয় সংগমস্থল।

তবে বার বার ফিরে এসেছেন কীসের মায়ায়?

মায়া! বলেই কেমন যেন একটি নির্লিপ্ত দৃষ্টি মেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। তারপর ধীরে চোখ বোজেন। চোখ বুজলেই তিনি স্পষ্ট দেখতে পান তুষারমৌলি কৈলাস, বরফের চড়া পড়া মানস সরোবর, রাক্ষস তাল বা রাবণ হ্রদ। দেখতে পান কৈলাসের প্রতিবেশী মান্ধাতা পর্বত। চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে পৃথিবীর সর্বোচ্চ হ্রদ গৌরীকুন্ড।

এখানেও নৌঅভিযান করেছিলেন স্বামী প্রণবানন্দ। একটি রবারের ভেলা নিয়ে ১৮৪০০ফুট উঁচুতে অবস্থিত গৌরীকুন্ডে তিনি বিজ্ঞান সমীক্ষা করেছিলেন। বেশিদিন আগের কথা নয়, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। তখন তাঁর বয়েস পঞ্চাশ। একজন পূর্ণ প্রৌঢ় পুরুষ।

রবারের ভেলাটি স্বামীজিকে উপহার দিয়েছিলেন বোম্বাই-এর বিখ্যাত পত্রিকা জন্মভূমি-র প্রখ্যাত সম্পাদক অমৃতলাল শেঠ। প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে শেঠজি সর্বজন পরিচিতি।

শেঠজির রবারের ভেলা নিয়ে গৌরীকুন্ড পরিক্রমা করেছেন স্বামী প্রণবানন্দ। মানস-কৈলাস অভিযানের ইতিহাসে গৌরীকুন্ডে নৌপ্রদক্ষিণ একটি রেকর্ড। গৌরীকুন্ডকে কেউ কোনো দিন বরফমুক্ত দেখেনি। তিব্বতিরাও কোনোদিন এমন কথা শোনেনি।

নৌকো নিয়ে গৌরীকুন্ড পরিক্রমার কথা অনেকদিন থেকেই ভাবছিলেন স্বামী প্রণবানন্দ। সেই ১৯২৮খ্রিস্টাব্দ থেকে। কিন্তু কোনো বছরই গৌরীকুন্ডকে বরফমুক্ত দেখতে পাননি তিনি।

কৈলাসের পূর্ব দিকে গৌরীকুন্ড। কৈলাসবাসিনী গৌরী এই কুন্ডে অবগাহন করতেন বলেই তাঁর নামেই পরিচিত এই কুন্ড। কুন্ডকে বরফমুক্ত দেখার জন্য আঠারো বছর অপেক্ষা করেছিলেন স্বামীজি। বার বার গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন।

তিব্বতিরা গৌরীকুন্ডকে বলে ‘থুকি জিংব্যু’। একটি ডিম্বাকৃতি হ্রদ। লম্বায় প্রায় দু-কিমি। প্রস্থে প্রায় তার অর্ধেক। বছরে তিন-শো পয়ষট্টি দিন বরফে ঢাকা থাকে। শক্ত কিছু দিয়ে বরফ ভেঙে জল বার করে সেই জলে কাক-স্নান করে পুণ্যার্থীরা। অনেক সময় বরফ ভেঙেও জল পাওয়া যায় না।

চোখ খোলেন স্বামীজি। সেগুন গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদের ঝলকানি। ঝোলাটা কোলে রেখে প্রণবানন্দজি বলেন, বরফমুক্ত গৌরীকুন্ড তিব্বতিরা কোনোদিন দেখেনি বা শোনেনি।

আপনি নৌকো ভাসালেন কেমন করে?

সেই কথাই বলছি।

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ। মে মাসের শেষে আলমোড়া থেকে কৈলাস-মানস খন্ডে পৌঁছে গেছেন স্বামীজি। শেঠজির দেওয়া রবারের ভেলা আগের বছর এনে রেখেছিলেন। সারাবছর ধরে সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু গৌরীকুন্ড বরফমুক্ত হয় না।

ভাগ্য ভালো থাকলে সবই হয়। সত্যনিষ্ঠ ইচ্ছা থাকলে ভগবান সে ইচ্ছা পূর্ণ করেন। স্বামীজির ইচ্ছা পূর্ণ হয়। গত আঠারো বছর যে ইচ্ছাকে সযত্নে মনে মনে লালন করেছিলেন ১৯৪৬খ্রিস্টাব্দের ২৮আগস্ট সেই বাসনা পূর্ণ হল।

তারিখটা দেখছি, আপনার মনে আছে।

ওই তারিখ কি কোনো দিন ভোলা যায়। যায় না।

গৌরীকুন্ডে নৌকো পরিক্রমার ঘটনা কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না স্বামী প্রণবানন্দ। ১৯৪৬খ্রিস্টাব্দের ২৮আগস্ট গৌরীকুন্ড বরফমুক্ত হল। এ এক অকল্পনীয় ব্যাপার। এক অশ্রুতপূর্ব ঘটনা এবং এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। যারা এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁরা সকলেই ভাগ্যবান। আবার কবে গৌরীকুন্ড বরফমুক্ত হবে সে-কথা আগাম কেউ বলতে পারে না। ‘মিস্টিক’ তিব্বতি সাধুদের কাছেও অজানা। প্রবীণ বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ।

গৌরীকুন্ডের নীল জলে ঢেউ উঠেছে। সূর্যের কিরণে ঢেউয়ের মাথায় সহস্র বৈদুর্যমণি একসঙ্গে ঝকমক করছে। কৈলাসের বরফ-ঢাকা চূড়ার ওপর দিয়ে সূর্যের রশ্মি এসে পড়ছে পবিত্র গৌরীকুন্ডের নীল জলে। হয়তো সকলের অলক্ষ্যে কৈলাস থেকে নেমে এসেছেন গৌরী। অবগাহন করে আবার ফিরে গিয়েছেন হর-নিবাসে।

বিজ্ঞানী অভিযাত্রী স্বামী প্রণবানন্দ গৌরীকুন্ডে রবারের ভেলা ভাসালেন। একজনকে সঙ্গে নিয়ে চড়ে বসলেন সেই ভেলায়। বৈঠার টানে ঢেউ ভেঙে ভেলা এগিয়ে গেল মধ্যকুন্ডে। সমীক্ষা করলেন স্বামীজি। ‘জনমভূমিতে’ বসেই গৌরীকুন্ডের পরিধি মাপলেন। মাপলেন তার গভীরতা। কোথাও কম কোথাও বেশি। গড়ে গৌরীকুন্ডের গভীরতা চুরাশি ফুট। স্বামীজিই প্রথম অভিযাত্রী—তিনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ হ্রদ গৌরীকুন্ডে ভেলা নিয়ে সমীক্ষা করেছেন, তার গভীরতা পরিমাপ করেছেন।

গৌরীকুন্ড থেকে উদ্ধার করেছিলেন কয়েকটি নারী ও পুরুষের কঙ্কাল। কোনো কোনো কঙ্কালের কবজিতে লাগানো ছিল সোনা ও রূপোর কঙ্কণ।

কঙ্কাল! কঙ্কাল কেন?

হয়তো কোনো কোনো তীর্থযাত্রী এখানে এসে আর ফিরে যেতে পারেননি। এই পরমতীর্থে জীবন থেকে মুক্তি নিয়েছেন। সহযাত্রীরা সেই মরদেহগুলিকে বরফের নীচে কবর দিয়েছিলেন—কঙ্কালগুলি হয়তো তাঁদেরই। মানস থেকেও পেয়েছিলেন কিছু কঙ্কাল। মৃতদেহ মানস সরোবরে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল।

শুধু মানস সরোবর আর গৌরীকুন্ড নয়। রাক্ষস তাল বা রাবণ হ্রদেও নৌকো নিয়ে পরিক্রমা করেছেন স্বামী প্রণবানন্দ। রাক্ষস তালের দুর্গম দুটি দ্বীপে অবতরণ করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন কিছু ফসিল।

কৈলাস-মানস সরোবর পরিক্রমার আগেও তাঁর একটি জীবন ছিল। জীবনে স্বপ্ন ছিল—সাধ ছিল। স্বপ্নটি ছিল কৈলাস আর মানস সরোবর নিয়েই। সাধ ছিল কৈলাসের সানুদেশে আধ্যাত্মিক উত্তরণের জন্য ধ্যান আর সাধনা। সে স্বপ্ন তাঁর সফল হয়েছে। আধ্যাত্মিক উত্তরণের সঙ্গে বিজ্ঞান সাধনাও করেছেন তিনি। ভূগোলের পাঠ না নিলেও প্রকৃত ভূগোলজ্ঞের কাজ করেছেন।

তিনটি মন নিয়ে কৈলাস-মানস সরোবর প্রত্যক্ষ করেছেন প্রণবানন্দ। একটি মন নিয়ে মহান স্রষ্টার অনুসন্ধান করেছেন। অনুধ্যানের মাধ্যমে কৈলাস-মানসের কমনীয় আর রমণীয় রূপকে আত্মস্থ করেছেন। প্রকৃতির এই অপরূপ রূপকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না—তুলি দিয়ে আঁকা যায় না—সব অনুভূতি দিয়ে শুধু অনুভব করতে হয়। এই মন নিয়েই তিনি ধ্যানে বসেছিলেন। পরমা শক্তির আরাধনা করেছিলেন। কোনো এক সময় সেই শক্তির সাজুয্য লাভ করেছিলেন।

আর দ্বিতীয় মন ছিল বিজ্ঞান সাধনায় লিপ্ত। সেই মন নিয়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন নদ-নদীর উৎসস্থল। সন্ধান করেছেন উষ্ণ প্রস্রবণ। সংগ্রহ করেছেন নানাবিধ জীবাশ্ম। তৈরি করেছেন কৈলাস-মানস সরোবরের মানচিত্র।

তাঁর তৃতীয় মনে ছিল অভিযান। তাই তিনি সাধক-বিজ্ঞানী-অভিযাত্রী। বার বার গিয়েছেন কৈলাস-মানসখন্ডে। প্রতিবার আবিষ্কার করেছেন নতুন গিরিপথ। চিরাচরিত ও প্রচলিত পথ ছাড়াও অচেনা-অজানা দুর্গম পথে পথে এগিয়ে গেছেন নিজের গন্তব্যস্থলে। স্থির প্রতিজ্ঞ বলেই শেষপর্যন্ত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন তিনি।

অতীতের দেশি-বিদেশি অভিযাত্রীদের তালিকায় প্রণবানন্দের নাম অনন্য হলেও বর্তমানকালের অভিযাত্রীদের কাছে তিনি খুব বেশি পরিচিত নন। অনেকে হয়তো তাঁর নামই শোনেনি। অথচ কৈলাস-মানস সরোবরে যাবার অনেক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন তিনি।

মেশরায় আই আই টি-র বিশাল প্রাঙ্গণ জুড়ে বিজ্ঞানীদের মেলা বসেছে। প্রবীণ-নবীন বিজ্ঞানীদের মিলনে মেশরার শাল-সেগুনের বন মুখরিত।

একটি সেগুনগাছের নীচে প্রণবানন্দজির মুখোমুখি বসে আছি। সারাদেহে তাঁর বার্ধক্যের ছায়া। কিন্তু সাধনায় সিদ্ধ চোখের দৃষ্টি এখনও উজ্জ্বল—মনে এক অনুপম সারল্য। হঠাৎ প্রশ্ন করেন, কী হবে আর এসব কথা শুনে?

কিছু না। শুনতে ভালো লাগে।

এখন তো আর কৈলাস-মানস সরোবরে যেতে পারবে না। তিব্বত তো এখন চৈনিক পদানত। (সম্প্রতি মানস সরোবরে সরকারি পর্যায়ে যাবার ব্যবস্থা হয়েছে।) বলেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন স্বামীজি। হয়তো মনে মনে আবার ফিরে যান তুষারবৃত কৈলাসে বরফের চড়া পড়া রাবণ হ্রদে অথবা গৌরীকুন্ডে। বলেন, চিন যে তিব্বত দখল করবে-এ খবর আমি ৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলালকে দিয়েছিলাম। সীমান্ত নিয়ে যে একটি গন্ডগোল বাধতে পারে, সে খবরও তাঁকে জানিয়েছিলাম।

জওহরলালের সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল?

হ্যাঁ। ১৯৪৯খ্রিস্টাব্দে তোমাদের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আমার কৈলাস মানস সরোবর পুস্তকটির ভূমিকা লিখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।

বইটি কি এখন পাওয়া যায়?

অনেকদিন আগেই আউট অব প্রিন্ট। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য পুরোনো লাইব্রেরিতে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো।

ভারত-তিব্বতের সীমান্তের প্রশ্ন দ্বিতীয়বার তোলেন না প্রণবানন্দ। আবার তিনি ফিরে যান মানস সরোবরে। তিনি মানস সরোবরে বরফ জমতে দেখেছেন। বরফ গলতেও দেখেছেন। স্বামীজি মাস, বছর কাটিয়েছেন থুগোল-হো-বৌদ্ধ বিহারে। মানস সরোবরের কিনারায় অবস্থিত এই বৌদ্ধ বিহার। অ-বৌদ্ধ ও অ-তিব্বতীরা এই বৌদ্ধ বিহারে থাকতে পারেন না। কিন্তু বিহারের প্রাজ্ঞ বৌদ্ধ পুরোহিত স্বামীজিকে সাদরে থাকতে দিয়েছিলেন। একজন অবৌদ্ধ সন্ন্যাসীর পক্ষে এটি একটি দুর্লভ সম্মান।

সেপ্টেম্বর থেকেই শীতের শুরু। সেপ্টেম্বর থেকে মে পর্যন্ত তুষারঝড় আর শৈত্যপ্রবাহ চলে। জুলাই মাসে সর্বনিম্ন তাপাঙ্ক থাকে ১৮.৫ ডিগ্রি ফা.। আর ফেব্রুয়ারি মাসে নিজের থুতু মাটিতে পড়ার আগেই বরফের ঢেলা হয়ে যায়।

প্রকৃতি তার আচরণে বুঝিয়ে দেয়, এবার নীলাম্বু মানস সরোবর সাদা হয়ে যাবে। নভেম্বর থেকে বাতাসের বেগ বেড়ে যায়। মান্ধাতা পর্বতের শিখর থেকে একটি সাইক্লোনিক ঝড় মানস সরোবরকে সমুদ্রের মতো উত্তাল করে তোলে। বজ্রনির্ঘোষ শব্দে চারদিক সচকিত হয়ে ওঠে। তিব্বতিরা বলেন, মাঘী পূর্ণিমায় সমগ্র সরোবর বরফে ঢেকে যাবে।

স্বামীজি বরফ যেমন জমতে দেখেছেন তেমনি গলতেও দেখেছেন। ১৯৩৬-৩৭খ্রিস্টাব্দে একনাগাড়ে মানস সরোবরের কিনারায় থুগোল-হো-বৌদ্ধ বিহারে কাটিয়েছেন। কৈলাস-মানস সরোবরের প্রতিদিনের রূপ পরিবর্তন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রকৃতির খেয়াল আর খেলার সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হয়েছেন।

বরফ জমার পূর্বাভাসের মতো বরফ গলার পূর্বাভাস প্রকৃতির আচরণ থেকে পাওয়া যায়। মে মাসের সাত তারিখের পর থেকেই সারাকৈলাস-মানস সরোবরে একটি স্তব্ধতা নেমে আসে। পাখিরা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। সরোবরের কিনারা থেকে হাঁসের দল সরে যেতে শুরু করে। বাতাসের বেগ বাড়ে। মান্ধাতা আর কৈলাসের ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে হাওয়া সরোবরে আছড়ে পড়ে। দিন কয়েক চলে এমনি প্রাকৃতিক তান্ডব। একদিন ভোরে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। মনে হয় শত শত কামান একসঙ্গে গর্জে উঠছে। মানস সরোবরের জমা বরফ ফাটছে। সারাসরোবরে বিরাট ফাটলের সৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড় ভাঙতে ডিনামাইটের যেমন শব্দ হয় প্রতিমুহূর্তে সরোবর থেকে সেই শব্দ শোনা যায়।

কিনারা থেকে বরফ গলতে শুরু করে। তখন সরোবরকে মনে হয় নীল পাড়ের একটি বিশাল শুভ্র শাড়ি। বৈশাখী কৃষ্ণা দ্বাদশীর দিন বরফ মুক্ত হয় মানস সরোবর।

কূল কিনারাহীন মানস সরোবরে সমুদ্রের মতো উত্তাল ঢেউ। প্রকৃতির অপূর্ব লীলা। ঢেউ ওঠে সরোবরের কিনারে। মধ্য সরোবর থাকে শান্ত নিস্তরঙ্গ। আবার গলা উঁচু করে হাঁসের দল ভাসতে থাকে। আর সরোবরের জলে তুষারাবৃত কৈলাসের ছায়া পড়ে। মৃদু ঢেউ-এ মান্ধাতার প্রতিবিম্ব কাঁপে। সোনালি সূর্যের কিরণে ঢেউ-এর মাথায় জ্বলে ওঠে অজস্র অজগরের মণি। সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। ভাষা দিয়ে এ দৃশ্যের বর্ণনা করা যায় না, শিল্পীর তুলি দিয়েও এ দৃশ্য আঁকা যায় না। এ দৃশ্যকে ধরে রাখতে হয় মনের ক্যানভাসে। ধরে রাখতে পারলেই এ দৃশ্য উপলব্ধি করা যায়। আর সেই উপলব্ধির জন্য চাই প্রকৃতির কাছে সমর্পিত একটি বিবাগী মন।

স্বামীজিকে মনে করিয়ে দিই রাবণ হ্রদের কথা। স্বামীজি কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে থাকেন। হয়তো আবার মনে মনে চলে যান কৈলাস-মানস সরোবরে।

মানস সরোবরের সাত কিমি পশ্চিমে রাক্ষস তাল বা রাবণ হ্রদ। কথিত আছে লঙ্কাধিপতি রাবণ এই হ্রদের ধারে বসে কৈলাসাধিপতি শিবের আরাধনা করেছিলেন। এই হ্রদকে তিব্বতিরা বলে লাঙাক সো।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত স্বামীজি রবারের ভেলায় রাক্ষস তাল অভিযান করেছিলেন।

রাক্ষস তালে দুটি দ্বীপ আছে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে রাবণ হ্রদের বরফের চড়া অতিক্রম করে অভিযাত্রী প্রণবানন্দ সেই দ্বীপ দুটিতে পৌঁছেছিলেন। কখনো-বা হেঁটে আবার কখনো-বা ইয়াকের পিঠে চড়ে দ্বীপে পৌঁছেছিলেন তিনি। তাঁর বিজ্ঞানী মন সেখান থেকে সংগ্রহ করেছিল কিছু ফসিল। স্বামীজির সংগৃহীত সব ফসিলগুলি বর্তমানে জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার হেপাজতে আছে। উনি পেয়েছিলেন একটি সামুদ্রিক জীবের ফসিল। বয়স ১৯ কোটি বছর।

চারটি নদীর উৎস স্থল নির্ধারণ করেছিলেন স্বামী প্রণবানন্দ। নদীগুলি হল, সুটলেজ বা শতদ্রু, কর্ণালী, ব্রহ্মপুত্র ও সিন্ধু।

মানস সরোবরের কিনারায় থুগোল-হো-বৌদ্ধ বিহারের পাশে স্বামী প্রণবানন্দ একটি যজ্ঞবেদি নির্মাণ করে রেখেছেন। প্রতিবছর সেখানে শ্রীকৃষ্ণের জন্নদিন পালিত হত। এখন হয় কি না জানা নেই। স্বামীজি বলেন, এবার আমায় যেতে দাও। কৈলাস-মানস সরোবরের অনেক গল্প তো শুনলে। যাবে সেখানে?

বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রাতঃকালীন অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটেছে। দ্বিপ্রাহরিক আহারের জন্য সবাই ফিরে যাচ্ছেন।

স্বামী প্রণবানন্দ উঠে দাঁড়ান।

আমার আর কয়েকটি প্রশ্ন ছিল স্বামীজি—

বলো।

আপনি মানস সরোবরে স্বর্ণকমল দেখেছেন?

স্বামীজি মৃদু হাসেন। বলেন, তোমার মতো এ প্রশ্ন অনেকেই আমাকে করেছে। সেখানে স্বর্ণকমলও দেখিনি—রাজহংসও আমার চোখে পড়েনি। তবে তিন রকমের পাখি দেখেছি।

আমার আর একটি প্রশ্ন আছে।

বলো।

কোনো মুনি-ঋষির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে? সেখানে নাকি অশ্বত্থামাকে মাঝে মাঝে ঘুরতে দেখা যায়। বেশ জোরে হেসে ওঠেন স্বামীজি। বলেন, অশ্বত্থামার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।

এবার স্বামী প্রণবানন্দ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান, আমিও তাঁর পিছু পিছু যাই। স্বামীজি ঘুরে দাঁড়ান। বলেন, আরও কিছু প্রশ্ন আছে তোমার?

আজ্ঞে, আপনার গার্হস্থ্য জীবনের কথা শোনা হল না।

স্বামীজি উত্তর না দিয়ে হন হন করে এগিয়ে যান। শাল-সেগুনের আঁকা-বাঁকা পথ ধরে দ্রুত হাঁটতে থাকেন। কৈলাসের পথে এমনি করেই বার বার হেঁটে গেছেন সন্ন্যাসী বিজ্ঞানী প্রণবানন্দ।

ইণ্ডিয়ান জিয়োগ্রাফিক্যাল জার্নালে স্বামী প্রণবানন্দের প্রাক-সন্ন্যাসী জীবনের কথা পাই। অন্ধ্রপ্রদেশের পূর্ব গোদাবরী জেলায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে স্বামী প্রণবানন্দের জন্ম হয়। তাঁর গৃহী নাম কর্ণকাদন্ডি ভেঙ্কট সোমায়াজুলু।

পূর্ব গোদাবরী জেলায় জন্ম হলেও পিতার কর্মস্থল লাহোরে তিনি বড়ো হন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোরের ডি এ ভি কলেজ থেকে স্নাতক হন। কিছুদিন তিনি রেলের অ্যাকাউন্টস দপ্তরে চাকুরি করেছিলেন।

মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। কর্ণকাদন্ডি সেই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। রেলের চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

মানুষকে ভালোবাসা ও মানুষের সেবা ছিল তাঁদের পরিবারের আদর্শ। পারিবারিক সেবার আদর্শ তাঁকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করেছে।

কর্ণকাদন্ডি লাহোর থেকে ফিরে আসেন নিজের জেলায়। ১৯২০-২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। সেবার মধ্যেই সত্যের সন্ধান করেন তিনি। শাশ্বত সত্যের প্রতি ক্রমাগত তাঁর আকর্ষণ বেড়ে যায়। মহান হিমালয় সত্যের প্রতিমূর্তি বলে তাঁর মনে হয়। আধ্যাত্মিক উত্তরণে সত্যই যে একমাত্র সহায়, কর্ণকাদন্ডি তা উপলব্ধি করতে পারেন।

দীক্ষা গ্রহণ করেন আলমোড়ার নারায়ণ আশ্রমের বিজ্ঞানীসন্ন্যাসী স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজের কাছে। সন্ন্যাস জীবনের নাম হয় প্রণবানন্দ।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সেই শাশ্বত সত্যের সন্ধানে কৈলাস মানস সরোবরের পথে বেরিয়ে পড়েন নবীন সন্ন্যাসী স্বামী প্রণবানন্দ। তিনি কাশ্মীর লাডাক গার্তক হয়ে কৈলাস পৌঁছোন। তারপর থেকে ১৯৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বার বার কৈলাস-মানস সরোবরের পথে পথে ঘুরেছেন তিনি। বৌদ্ধ বিহারে বসে সাধনা করেছেন। তারই মধ্যে সময় করে কৈলাস-মানসখন্ডে বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা করেছেন।

পশ্চিম তিব্বতে তিনি ছিলেন সর্বজন পরিচিত ভারতীয় সন্ন্যাসী। কৈলাস-মানস সরোবরে সার্থক অভিযানের জন্য ইণ্ডিয়ান জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি স্বামী প্রণবানন্দকে আজীবন সাম্মানিক সদস্যপদ দিয়েছিলেন।

কৈলাস-মানস সরোবরের পরমসত্যের সঙ্গে স্বামী প্রণবানন্দ এখন একাত্ম হয়ে গেছেন।

সকল অধ্যায়

১. শাম্বরিক খরোলিকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
২. কাব্যে কেশ-ব্যবসায় চুল – গোপালকৃষ্ণ রায়
৩. মুড়িয়া শিল্পকলা – গোপালকৃষ্ণ রায়
৪. পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
৫. ড্রাগ : নেশার বিষাক্ত জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৬. হাজারদুয়ারি থেকে পলাশি – গোপালকৃষ্ণ রায়
৭. কলকাতার মৃত্যু-জগৎ – গোপালকৃষ্ণ রায়
৮. রবীন্দ্রনাথ ও একটি রিয়া – গোপালকৃষ্ণ রায়
৯. পৃথিবীর প্রাচীনতম মৃৎপাত্র – গোপালকৃষ্ণ রায়
১০. পুরীর মন্দিরে দুর্ঘটনা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১১. কোণারকের সূর্যমন্দির – গোপালকৃষ্ণ রায়
১২. কঙ্কাল কাহিনি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৩. জগন্নাথদেবের শেষ দেবদাসী – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৪. মা জুঁইং বুঁইন – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৫. জ্ঞাননৌকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৬. পুরাকথায় অমরনাথ – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৭. কিংবদন্তির দ্বারকা – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৮. খর্বাকৃতি দম্পতি – গোপালকৃষ্ণ রায়
১৯. ঋষি অরবিন্দ – গোপালকৃষ্ণ রায়
২০. তীর্থক্ষেত্র গঙ্গাবাস – গোপালকৃষ্ণ রায়
২১. কলকাতায় আদিম অতিথি – গোপালকৃষ্ণ রায়
২২. নলরাজার গড় – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৩. সেনালি ডিঙ্গো, কুমারীদের শয্যাধামে – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৪. সুনাবেড়া বৃত্তান্ত – গোপালকৃষ্ণ রায়
২৫. ত্রিপুরার রাজবংশে সতীপ্রথা – গোপালকৃষ্ণ রায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন