গোপালকৃষ্ণ রায়
পাহাড়টির নামই হয়ে গেছে ন্যাক। এন এ সি। কেউই পুরো নাম উচ্চারণ করে না। আমিও করছি না। কারণ পুরো নামের সঙ্গে অনেকেই সবিশেষ পরিচিত নয়। ন্যাক সুনাবেড়ার সর্বোচ্চ পাহাড় না হলেও অবশ্যই জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার কারণ, পাহাড়-শীর্ষের একটি মন্দির। জগন্নাথদেবের মন্দির। পুরীর মন্দিরের আদলে নির্মিত। পুরীর মন্দিরের প্রাচীনত্বের তুলনায়, এটি নিতান্তই শিশু। এখনও পঞ্চাশ পেরোয়নি। তবু ভক্ত সমাগমের খামতি নেই। সকাল-সন্ধ্যায় ন্যাক-শীর্ষে জগন্নাথ মন্দিরে হাজারো ভক্তের সমাগম হয়।
৪৩নম্বর জাতীয় সড়কের পাশেই ন্যাক। সেখান থেকেই পাকা পিচের রাস্তা পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠে গেছে। ন্যাকের উচ্চতা প্রায় ৪০০ মিটার। ন্যাকের ঢালুতে গড়ে উঠেছে সুপার মার্কেট। সেখানেই রয়েছে অতিথিশালা। বৈদ্যুতিক আলো টেনে নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ শিখরে। শিখরে দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ সুনাবেড়ার দিকে তাকালেই আমার শিলং-এর কথা মনে হয়। রাতের শিলং আর সুনাবেড়ার মধ্যে বিশেষ কোনো তফাত খুঁজে পাওয়া যায় না।
সুনাবেড়ায় অসংখ্য পাহাড়। তবে বেশির ভাগই বিচ্ছিন্ন। এটিও প্রকৃতির খেয়াল। এইভাবেই প্রকৃতি সুনাবেড়াকে সাজিয়েছে। প্রতিটি পাহাড়ের পাশেই বিস্তীর্ণ সমভূমি। সমভূমিতে সবুজ ধান—আর সবুজ বনানীতে আবৃত পাহাড়। কোথাও ঘন-গহন বন— কোথাও রুক্ষ পাথর। ন্যাক হচ্ছে পাহাড়-ঘেরা সুনাবেড়ার মধ্যমণি। এখানে দাঁড়িয়েই সুনাবেড়ার সোনালি সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। এই অবলোকনে ক্লান্তি আসে না—বরং দৃষ্টিকে আরও লোভী করে তোলে।
অর্ধশতাব্দীর আগে সুনাবেড়ার সৌন্দর্য নাকি আরও সজীব ছিল। এখন যেসব জমি কর্ষিত, অর্ধশতাব্দী পূর্বে সেখানে ছিল গভীর বন। শাল-সেগুন-অর্জুনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে থাকত সহস্রজাতের জানা-অজানা লতা-গুল্ম। অজস্র বন্যপ্রাণীর অঘোষিত অভয়ারণ্য। গোটা এলাকাটাই দন্ডকারণ্যের অন্তর্ভুক্ত। তাই সুনাবেড়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রামায়ণের অনেক কাহিনি। গুপ্তেশ্বরকে কেন্দ্র করে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা এই অঞ্চল পরিভ্রমণ করতেন। মুনিঋষিদের অনেক আশ্রমও ছিল এখানে। অনার্যরা মাঝে মাঝেই তপঃসিদ্ধ তাপসদের আশ্রমে হানা দিত। জগদলপুরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক পন্ডিত সুন্দরলাল ত্রিপাঠী মনে করেন, এই অঞ্চলের প্রকৃতির মধ্যে এখনও যেসব দৃশ্য বিদ্যমান, শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসের কাহিনির সঙ্গে তার যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
৯৩ বছরের বৃদ্ধ পন্ডিত বর্তমানে বস্তার জেলার ইতিহাস রচনায় ব্যস্ত। সরকারি উদ্যোগে এই ইতিহাস রচনা করা হচ্ছে। বহু মূল্যবান পুস্তকের প্রণেতা পন্ডিত সুন্দরলাল ত্রিপাঠীর ওপর এই ইতিহাস তৈরির দায়িত্ব দিয়েছেন মধ্যপ্রদেশ সরকার। মধ্য নব্বইতে তিনি এখনও সচল ও সজাগ। তাঁর মতে, পূর্বগোদাবরী, কোরাপুট, বস্তার ও কালাহান্ডি নিয়ে গড়ে উঠেছিল ত্রেতাযুগের দন্ডকারণ্য। এখানকার আদিবাসীদের মধ্যে দন্ডকারণ্যের সংস্কৃতি এখনও বিদ্যমান।
সুনাবেড়ার প্রাচীনত্ব বোঝাতেই সুন্দরলাল ত্রিপাঠীর কথা এসে গেল। এই প্রাজ্ঞ পন্ডিত ব্যক্তিটির কথা পরে কোনো একসময় বলা যাবে। আমরা বরং আবার সুনাবেড়ায় ফিরে যাই। কিন্তু যাবার আগে অল্প সময়ের জন্য গুপ্তেশ্বর দর্শন করে যাওয়াই ভালো।
জেপুর থেকে গুপ্তেশ্বরের দূরত্ব মাত্র আটান্ন কিমি আর সুনাবেড়া থেকে ১০০ কিমি। সুনাবেড়া থেকে বাসে জেপুর। সেখান থেকে বাসে রামগিরি। রামের নামেই রামগিরি। বাকি ১৪ কিমি পথ জিপে যাওয়াই ভালো। হেঁটে যেতে পারলে আরও ভালো। প্রকৃতিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া যায়। তার অনাবিল রূপ-রস-গন্ধের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। প্রকৃতি এখানে গভীর প্রেমে প্রলিপ্ত। গুপ্তেশ্বর প্রাচীন প্রস্তর যুগের গিরিগুহা। চতুর্পার্শ্বস্থ সমভূমি থেকে প্রায় ১৫০মিটার উঁচু। গুহায় অবস্থান করছেন ভগবান শংকর। মূর্তিতে বিমূর্ত নন, লিঙ্গমে লম্বমান। অনেকগুলি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গুহাদ্বারে পৌঁছোনো যায়। আবার নেমে যেতে হয় পাতালে। এমন গুহা মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলায়ও কয়েকটি রয়েছে। এদের মধ্যে কাঙের ভ্যালির কুটুমশরের (কুটুমেশ্বর) বিখ্যাত। সম্প্রতি কুটুমশরের আশেপাশে আরও কয়েকটি গিরিগুহার সন্ধান পাওয়া গেছে। মেঘালয়ে এমন গুহার সংখ্যা অনেক। মিজোরামের সিলিপুক তো ভূতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিকদের কাছে অসামান্য মনে হয়েছে। গুপ্তেশ্বরের গুহায় কে বা কারা কবে শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিল, তা নিয়ে ইতিহাস দূরের কথা, কোনো কিংবদন্তিও নেই। তবে প্রাচীনত্ব বোঝাবার জন্যে শ্রীরামের সঙ্গে এটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও গুপ্তেশ্বর ওড়িশায় অবস্থিত, মধ্যপ্রদেশে এই গুপ্তেশ্বর গুপ্তকেদার নামেই পরিচিত।
সুন্দরলাল ত্রিপাঠী মনে করেন, সে-যুগের দন্ডকারণ্যে ছিল অনার্যদের আধিপত্য। প্রলয়ের দেবতা শিব ছিলেন তাদের আরাধ্য ঈশ্বর। গিরিগুহাকে তারা মন্দির হিসেবে বেছে নিয়েছিল। সে-যুগের দন্ডকারণ্যের ছবি রামায়ণে প্রতিফলিত হয়েছে। গুপ্তেশ্বরের কাছেই রয়েছে রামগিরি পর্বত।
আবার সুনাবেড়ার কথায় ফিরে আসি। পঞ্চাশ বছর আগেও সুনাবেড়া ছিল ওড়িশার আদিবাসীদের বাসভূমি। অরণ্যনির্ভর জীবনযাত্রায় এখনও আদিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তবে তাঁদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন আর প্রথম প্রত্যুষের সভ্যতা দেখা যায় না। নাগরিক সভ্যতা তাকে প্রায় গিলে ফেলেছে।
সুনাবেড়াকে দু-ভাগ করে ৪৩নম্বর জাতীয় সড়ক চলে গেছে। এই সড়ক ধরেই পৌঁছে যাওয়া যায় বিশাখাপত্তনম। আবার সেখান থেকে কিরণডোল এক্সপ্রেস ধরে ফিরে আসা যায় কোরাপুট। এই ট্রেন লাইন চলে গেছে বিশাখাপত্তনম থেকে মধ্যপ্রদেশের কিরণডোল পর্যন্ত। রেলপথের ধারেই পড়ে আরাকুভ্যালি। এই রেলপথে ভ্রমণ নগর-সজাগ মানুষকে স্বর্গের স্বপ্ন দেখায়। মানুষকে পৌঁছে দেয় অরণ্যের কাছাকাছি। রেলপথের কথা এখন নয়, পরে কোনো এক সময় লেখা যাবে। আগেই বলেছি, সুনাবেড়া-কোরাপুট জেপুরে একটানা কোনো হিল রেঞ্জ নেই। বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের সমাবেশ। প্রতিটি পাহাড় আকারে আয়তনে আলাদা। ন্যাক থেকে দাঁড়িয়ে এইসব পাহাড় নিরীক্ষণ করা যায়। প্রতিটি পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে নিজস্ব বৈচিত্র্য। পাহাড়ের বৈচিত্র্যই সুনাবেড়াকে দিয়েছে এক পৃথক মাত্রা।
আগেই বলেছি, সুনাবেড়ায় এখন প্রথম প্রত্যুষের সভ্যতা নেই। অরণ্য সভ্যতাকে হটিয়ে দিয়ে, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য আধিপত্য বিস্তার করেছে। দন্ডকারণ্য পুনর্বাসন প্রকল্পে তার রূপান্তর ঘটেছে। রামায়ণে উল্লিখিত দন্ডকারণ্যের বৃহত্তম অঙ্গ কোরাপুট জেলা। দেশের বৃহৎ জেলাগুলির অন্যতম। অন্যূনাধিক সাতাশ হাজার বর্গকিমি। জেলার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ছ-শো মিটার।
অধুনালুপ্ত পূর্বপকিস্তানের উদবাস্তুদের দন্ডকারণ্যের যেসব অঞ্চলে পুনর্বাসন হয়েছে সুনাবেড়া তার অন্যতম। পুনর্বাসিত উদবাস্তুরা জীবনের মূলস্রোতে ফিরে এসেছে। তদের মাথার ওপরে ছাদ—পায়ে শক্ত জমি। ছিন্নমূল জীবনের অবসানে তারা এখন স্বয়ংসস্পূর্ণ। অথচ কোনো রাজনৈতিক দল তাদের পুনর্বাসনে বাধা দিয়েছিল। বাঙালিত্ব হারিয়ে যাবে বলে রব তুলেছিল। তাদের চিৎকার যে কত অসার, সুনাবেড়া তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। পুনর্বাসিত উদবাস্তুদের সংস্কৃতি বিপন্ন হয়নি, বরং অন্য সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। সুনাবেড়ার পাহাড়ের ঢালে নির্মিত সারি সারি বাড়ি। স্বয়ংসম্পূর্ণ দু-ঘরের সুখের নীড়। বিজলি বাতি, নলবাহিত পানীয় জল ও টেলিফোনের সঙ্গে আধুনিক সুযোগসুবিধা।
গত পাঁচ দশকে উদবাস্তুদের জীবনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাদের বর্তমান প্রজন্ম লেখাপড়া শিখেছে। চাকরি বা ব্যাবসা করে, গৃহচ্যুত হবার বেদনাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। দন্ডকারণ্য প্রকল্প অনেকদিন আগে গুটিয়ে নেওয়া হলেও পুনর্বাসিতরা সেই প্রকল্পকে ভোলেননি। ভি পি বা ডিসপ্লেস পারসনস ক্যাম্প শব্দটিকে তারা তুলে দেননি। সম্ভবত ছিন্নমূল জীবনের স্মারক হিসেবে রক্ষা করে চলেছেন।
আদিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে বলে যারা প্রচার করে, আমি বলব, তাদের উদ্দেশ্যটাই খারাপ। আদিবাসীরা যেমন বাংলা শিখেছে, পুনর্বাসিত উদবাস্তুরাও তেমনি তাদের কথ্য ভাষা আয়ত্ত করেছে। শিক্ষা একই স্কুলে, খেলাধুলো একই মাঠে। এমনকী দু-চারটি বিয়েসাদির ঘটনাও ঘটে গেছে। বর্জনের প্রশ্ন নেই—গ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা সুখী।
ধর্মীয় বিধিনিষেধ নেই। উভয়েরই মনের বেড়া অনেকদিন আগেই ভেঙে গেছে। পুনর্বাসিত বাঙালিরা নির্মাণ করেছে দুর্গাবাড়ি। পাহাড়ে তৈরি করেছে একটি মন্দির। সেই মন্দিরের পূজিত দেবতা ভগবান শ্রীচৈতন্য। মন্দিরে সবার সমান প্রবেশাধিকার। মন্দিরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রতন দেবনাথের ভাষায়, আদিবাসী আর পুনর্বাসিতরা এখানে একসঙ্গে নাম-কীর্তন করে। মহাপ্রভু তো এমন মিলনই চেয়েছিলেন।
উড়োজাহাজের ইঞ্জিন তৈরির আধুনিক কারখানা গড়ে উঠেছে এই সুনাবেড়ায়। কারখানাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে একটি পরিকল্পিত শহর। সবরকম আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে এই ছায়া শহরে। হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক লিমিটেড এই কারখানা স্থাপন করে, একদা অরণ্যভূমি সুনাবেড়াকে শিল্প-মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছে। সুনাবেড়া থেকে ১৪কিমি দূরে দীমানজোড়িতেও গড়ে উঠেছে অ্যালুমিনিয়ম অ্যালুমিনা কমপ্লেক্স। আরও শিল্প গড়ে উঠবে, তার সমীক্ষার কাজও চলেছে। দন্ডকারণ্যের অরণ্যভূমি সুনাবেড়ার রূপান্তর প্রায় নি:শব্দেই ঘটে চলেছে। সুনাবেড়ার অবস্থানের দিনগুলি তো প্রায় শেষ হয়ে এল। কোরাপুট হয়ে জেপুর যাবার আগে সুনাবেড়ার আরও একটি দর্শনীয় স্থান দেখে নেওয়া ভালো।
অনেকেই দন্ডকারণ্যকে রাম-সীতা ভূমি বলে থাকেন। এই ভূমিতে রাম-সীতার মন্দির থাকবে না, তাই কী হয়? ন্যাকের সমউচ্চ আরও একটি পাহাড় রয়েছে এই সুনাবেড়াতেই। কোরাপুট যাবার পথেই পড়বে এই পাহাড়। বিচ্ছিন্ন এই পাহাড়ের নীচে সবুজ উপত্যকা।
ন্যাকে অবস্থান করছেন পুরুষোত্তম জগন্নাথ। আর এই পাহাড়ে পূজিত হচ্ছেন রাম-সীতা। ন্যাকের মন্দিরের মতো এটিও নতুন। ওড়িশার স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হয়। পাহাড়ের উপরিভাগ সমভূমি। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছেই চমকে উঠতে হয়। পাশেই রয়েছে পবন পুত্র হনুমানের বিশাল মূর্তি। কুড়ি ফুট উচ্চ পবনপুত্র করজোড়ে আহ্বান জানাচ্ছেন রামভক্তদের। হনুমানের এত বড়ো মূর্তি দেশের অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। বিশালাকার মূর্তির জন্যেই সম্ভবত পাহাড়ের নামকরণ হয়ে গেছে হনুমান পাহাড়।
এত কিছু থাকা সত্ত্বেও, সুনাবেড়া ওড়িশার ভ্রমণ মানচিত্রে স্থান পায়নি। তবু যদি কোনো ভ্রমণপিপাসু সুনাবেড়ায় যান—সিমিলিগুড়ার উচ্চভূমিতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে ভুলবেন না। সিমিলিগুড়ার সূর্যাস্তের স্বর্ণময় দৃশ্য চিরদিনের জন্য হৃদয়ে বর্ণময় হয়ে থাকবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন