পোস্টমর্টেম রিপোর্ট

অর্পিতা সরকার

হ্যাঁ ইন্দ্রজিৎ, আমার কাছে ব্রজমোহন চক্রবর্তীর পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পাঠাও। আর যিনি রিপোর্টটা করেছেন ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের, তার সঙ্গেও সন্ধেতে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেট করো ইমিডিয়েট।’

ইন্দ্রজিৎ আন্তরিক গলায় বলল, ‘ম্যাডাম এই তো ঢুকলেন থানায়, একটু রেস্ট নিন।’

লগ্নজিতা সাব ইন্সপেক্টরের দিকে নিজস্ব ভঙ্গিমায় তাকিয়ে বলল, ‘আমি হলদিয়ায় রেস্টেই ছিলাম। আর বিশ্রামের প্রয়োজন নেই।”

 ইন্দ্রজিৎ জানে ম্যাডাম থানায় এন্ট্রি নেওয়া মানেই বসার সময় দেন না। নিজেও অবশ্য বসেন না। রিপোর্টটা ইন্দ্রজিতের কাছেই আছে ম্যাডামের নির্দেশে। উনিই বলছিলেন, উনি কলকাতা ফিরে দেখবেন। রিপোর্টটা ম্যাডামের টেবিলে দিয়ে ফরেন্সিক ডিপার্টমেন্টের লাহিড়ীবাবুকে ফোনে ধরল ইন্দ্রজিৎ।

লগ্নজিতার ধারণাই ঠিক। আত্মহত্যা নয়, এটা খুন। শ্বাসরোধ করে মৃত্যু হয়েছে ঠিকই কিন্তু মাথার পিছনে ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করার লক্ষণ সুস্পষ্ট। রাহুলের কথা মতো বডি সিলিংএ ঝুলছিল না, মেঝেয় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তাই পিছনে আঘাতের কোনো সম্ভবনা নেই। মৃত্যুর সময় আন্দাজ করা হয়েছে ভোর চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে। চক্রবর্তী বাড়ির সদর দরজা মন্টু খুলে দেয় চারটে বাজতে পাঁচ মিনিট আগেই। খুনি বাইরের যে কোনো পরিচিত অথবা অপরিচিত লোক হতেই পারে। মন্টুকে জেরা করতে হবে। পরেরদিনই জেরা করবে ভেবেছিল। কিন্তু মানিক চৌধুরীর দেওয়া জখমের জন্য অযথা এতগুলো দিন নষ্ট হয়ে গেল।

রাহুলকে কল করতেই রাহুল একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি কলকাতায় ফিরেছেন? প্লিজ ম্যাডাম একবার আমাদের বাড়িতে আসুন। মন্টু অদ্ভুত বিহেভ করছে। এলোমেলো কথাও বলছে। বাবা মারা যাবার দিন থেকে একটাও কথা বলেনি কারোর সঙ্গে। গতকাল রাত থেকেই ভুল বকছে।’

লগ্নজিতা চিন্তিত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ আসছি।’

মন্টুকে আজকে জেরা করবে কারণ হিসেব মতো ওরই প্রথম ব্রজমোহনবাবুর বডি দেখার কথা। কারণ সদর দরজা খুলে ও-ই চায়ের কাপ নিয়ে ব্রজমোহনবাবুকে দিতে যায়। আচমকাই লগ্নজিতার মাথায় এলো, সেদিন চক্রবর্তীদের বাড়িতে থাকাকালীন মন্টু নামের কাউকে তো দেখেনি লগ্নজিতা। রাহুল, ওর মা আর মীনাক্ষী নামের একজন পরিচারিকা ছিল দাঁড়িয়ে। মন্টু তো ছিল না। তবে কি পুলিশ আসছে দেখেই গা ঢাকা দিয়েছিল মন্টু? প্রায় দিন পাঁচেকের ব্যবধান হয়ে গেছে। খুনের পরের মুহূর্ত থেকে সবকিছুর ওপরে নজর রাখা উচিত ছিল। যদিও সহকারী ইন্দ্রজিৎকে নির্দেশ দিয়েছিল কেসটা দেখার জন্য। ইন্দ্রজিৎ দায়িত্বশীল অফিসার। এই থানায় এসেছে মাত্র মাস পাঁচেক। এর মধ্যেই ওর কাজে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছে লগ্নজিতা। ইন্দ্রজিৎকে দায়িত্ব দিয়ে একটু হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারে। ভাবনার মধ্যেই ইন্দ্রজিৎ ঢুকল ঘরে।

—ম্যাডাম, ফরেনসিক এক্সপার্ট ডক্টর লাহিড়ীর সঙ্গে সন্ধে ছটা নাগাদ অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখলাম। এনি প্রবলেম?

লগ্নজিতা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘ইন্দ্রজিৎ , তুমি চক্রবর্তী বাড়িতে কি আর গিয়েছিলে? মন্টুর একটা জবানবন্দী নিতে বলেছিলাম, সেটা কি হয়েছে?’

ইন্দ্রজিৎ মাথা নীচু করে বলল, ‘ম্যাডাম আমি ট্রাই করেছিলাম। কিন্তু সেদিনের পর থেকে মন্টু কোনো কথা বলছে না। রাহুল চক্রবর্তী বললেন, মন্টু নাকি কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি। এমনকি বাবাকে দাহ করার সময়েও কাঁদেনি একফোঁটা। অথচ জেঠু বলতে সে অজ্ঞান ছিল। ব্রজমোহনবাবুকে জেঠু ডাকত মন্টু। চায়ের দোকানের মালিকের হাতে মার খাচ্ছিল। তখন ওর বয়েস বছর দশ। তখনই নিজের বাড়িতে মন্টুকে নিয়ে এসেছিলেন ব্রজমোহন। সেই থেকেই ওদের বাড়িতে আছে। বাড়ির ছেলের মত। বাবার সব দিকে মন্টুর নজর থাকত। প্রায় বছর এগারো এ বাড়ির বাসিন্দা মন্টু। দিনরাত বকবক করার জন্য সরলাদেবীর কাছে মাঝেমধ্যে বকাও খেয়েছে মন্টু। সে যে এমন স্তব্ধ হয়ে যাবে—এ নাকি কল্পনার বাইরে। আমি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম, কিন্তু সে মাটির দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকল। একটা শব্দেরও উত্তর দিল না। ম্যাডাম, ঠিক কী করা উচিত?’

লগ্নজিতা আপসেট গলায় বলল, ‘মন্টুর কাছে অনেক ইনফর্মেশন আছে ইন্দ্রজিৎ। সেগুলো না পেলে এ কেসের কিনারায় পৌঁছানো খুব কঠিন। মন্টুকে কথা বলাতেই হবে। আমি আগামীকাল যাব চক্রবর্তী বাড়িতে।’

ইন্দ্রজিৎ বলল, ‘ম্যাডাম আমি ট্রাই করেছিলাম। বললাম, তুমি চাও না তোমার জেঠুর খুনি ধরা পড়ুক? প্লিজ আমাদের একটু হেল্প করো। সেই নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল ম্যাডাম। আপনি ট্রাই করে দেখুন।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন