অর্পিতা সরকার
‘সেকি? শিবনাথদার বাড়িতে এখনও পুলিশ যায়নি? সেদিন যার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে অত গল্প করলাম, সকলেই পাড়ায় আসা নতুন ভাইঝি মনে করলাম, সে আসলে ইন্সপেক্টর লগ্নজিতা ভট্টাচার্য। শিবনাথদা বোধহয় গল্পটা বেশি করছিল তাই না বর্ণালীদি?’
বর্ণালী বাসুদেবের কথার উত্তর দেবার আগেই শিবনাথ বলল, ‘বলো কী? পুলিশ? তো আমাদের কাছে তার দরকারটা কী?’
বাসুদেব বলল, ‘ব্রজমোহনদার খুনের তদন্তে আছেন উনি। তাই আমাদের সকলের জেরা চলছে। আমার, মৃন্ময়ের আর অমিতের বাড়ি ঘোরা কমপ্লিট। একটা কথাই বুঝতে পারছি না, শিবনাথদা বাদ গেল কেন?’
অমিত বলল, ‘অথচ মোটিভ শিবনাথদার কিছু কম নেই। ব্রজদা মারা গেলে ধারের প্রায় লাখ তিনেক টাকা আর ফেরত দিতে হয় না, তাই না?’
শিবনাথ একটু অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘বড় বিপাকে পড়ে তোমাদের কাছে হাত পাতি। নিজের জন্য নয়, মেয়েটা যাতে কষ্ট না পায়। তাই বলে ব্রজমোহনকে খুন করে দেব এমন নৃশংস ভাবলে, বলার কিছু থাকে না। আজ কালের মধ্যেই বাসুদেবের টাকাটা শোধ দেব। আর এক সপ্তাহের মধ্যে অমিতেরটা। চিন্তা করো না, মরার আগে সব শোধ দিয়ে মরব। ঋণী হয়ে নয়।’
অমিত হেসে বলল, ‘আর ব্রজদারটা? বেশ মজা শোধ দিতে হবে না আর। রাহুল বোধহয় জানেও না তার বাবা কাকে কী ধার দিয়ে গেছে।’
শিবনাথ শান্ত গলায় বলল, ‘রাহুলকে শোধ দেব ধীরে ধীরে। আর যদি খুনের মোটিভের কথা বলো তাহলে সেটা আমাদের সকলেরই কিছু না কিছু আছে।’
বর্ণালী বলল, ‘না। আমার কোনো মোটিভ নেই ব্রজদাকে খুন করার। সকলকে কেন ঢোকাচ্ছেন শিবনাথদা?’
শিবনাথ গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আপনার ছেলে সুনির্মল যে তৃষার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সেটা আমরা সবাই জানি। তৃষার রেপ কেসের সময় সুনির্মলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়েও গিয়েছিল। শুনছিলাম ব্রজদা কেসটা রি-ওপেন করতে চাইছিল হাইকোর্টের এক বড় উকিলকে দিয়ে। তখন আবার আপনার ছেলের ডাক পড়ত। অযথা বদনাম কে চায় বলুন? তাই বলছি—মোটিভ সকলের আছে। সুতরাং শুধু টাকা শোধ করতে হবে না বলে ব্রজকে আমি খুন করেছি—এই যুক্তি বড্ড জোলো লাগছে। তার থেকে বরং রেয়ার সব মুদ্রা, গুপ্তধনের লোভ, শালাকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা, মেয়ের প্রেম বাঁচানোর চেষ্টাগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। তাই না বাসুদেব?’
বাসুদেব বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, ‘এই ব্রজদা মারা গিয়ে আমার ব্যবসার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেল। এখন পিছনে পুলিশ লেগেছে। যা করতে যাব, তাতেই অনৈতিক বলে জেলে ভরবে। আসল খুনি বাড়িতে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদিকে ক বছর হাঁটতে এসে আমাদের যত বিপদ। আর শিবনাথ একটা কথা তোমাদের আগেও বলেছি আবারও বলছি, ব্রজর কাছে যা দুর্মূল্য জিনিস ছিল, তার কয়েকগুণ বেশি জিনিস আছে আমার কাছে। তাই আমি ওসব ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করায় বিশ্বাসী নই। আমার এক-একটা ঘণ্টা খুবই দামি। পুলিশের নজর পড়লে কাজে ঝামেলা হবে—সেটাই একমাত্র চিন্তা। এরা তো আবার সব কাজই বেআইনি দেখে। শুধু নিজেদের বাঁ-হাতের ইনকাম ছাড়া। তবে একটা কথা বলি—ব্রজদা খুন হয়েছে না হয়নি—তা নিয়ে আমার একটু সন্দেহ ছিল। কিন্তু মন্টুর অমন বীভৎস মৃত্যু দেখে বুঝলাম ব্রজদা খুনই হয়েছে।’
বর্ণালী এতক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘দেখুন আমার ছেলে তৃষার প্রেমিক ছিল না। বন্ধু ছিল। একই টিউশনে ম্যাথ করত। সেই সূত্রে বন্ধু। তাই তৃষার রেপ কেসে ওর কোনো ভূমিকা নেই। এসব ফালতু আলোচনা করলে আপনাদের দলে আর আসা যাবে না।’
বাসুদেব বলল, ‘আর দল! এই মুহূর্তে কেউই কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না আমরা। তাই দল এমনিও ভেঙেই যাবে।’
মৃন্ময় বেশ ভেঙে পড়েছে। চেহারাটাও এই কদিনে বেশ ভেঙেছে। চোখের কোণে চশমার ফাঁক দিয়েই দেখা যাচ্ছে ঘুমহীন রাত্রি যাপনের চিহ্ন। গলার স্বরেও সেই উচ্ছাস নেই। ম্রিয়মাণ গলায় বললেন—’ব্রজদা নেই। নিজেদের মধ্যে অশান্তি করে আর লাভ কী?’
বাসুদেব একটু উচ্চস্বরে বলল, ‘লাভ তো তোমার। তোমার হবুজামাই এখন এত বড় সম্পত্তির একা মালিক। কিন্তু মৃন্ময়—তুমি কিন্তু বললে না ভাই, সকাল সাড়ে পাঁচটার সময় তুমি ব্রজদার বাড়ির সামনে কী করছিলে? আমি ডাকা সত্ত্বেও হনহন করে পালিয়েই বা গেলে কেন?’
মৃন্ময় বলল, ‘বড্ড ক্লান্ত লাগছে। এই একই কথা বলতে বলতে। আইনি তৎপরতায় ব্রজদার খুনি তাড়াতাড়ি ধরা পড়ুক—এটাই চাই। তার আগে পর্যন্ত সকালের এই ভ্রমণ বন্ধ থাকুক আমার। কারণ ব্রজদাকে কে খুন করেছে নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করে অযথা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।’
অমিত হেসে বলল, ‘বাপ হারা ছেলের দায়িত্ব এখন থেকে তোমার তো মৃন্ময়। রাহুলের সব দেখে রাখার দায়িত্বও তোমার। সম্পত্তি তো কিছু কম নয় ব্রজদার। বংশ পরম্পরায় বড়লোক ওরা।’
বাসুদেব বলল, ‘ওদের ধনেখালিতেও শুনেছি জমিজমা আছে। ব্রজদার দাদু এ চত্বরে বালির ব্যবসা ফেঁদেছিল, তারপরে তৈরি করেছিল ব্রজধাম নাতির নামে।’
শিবনাথ বলল, ‘ব্রজমোহনের কোনো এক পূর্বপুরুষ মিশরের রাজার বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিল। বাংলা থেকে ভাগ্য ফেরাতে মিশরে গিয়ে হাজির হয়েছিল। ওখানের ভাষা শিখে ওখানেই সংসার পেতেছিল। তারপর বোধহয় সে বাংলায় ফিরে আসে অনেক সম্পত্তি নিয়ে। ধনেখালিতে নাকি জমিদারিও কেনে। ধীরে ধীরে সেসব সম্পত্তি ব্রজমোহনের দাদুর হাতে এসে পৌঁছায় উত্তরাধিকার সূত্রে। তারপর ব্রজর দাদু নাকি ধনেখালির বাড়ি, সম্পত্তি ছেড়ে কলকাতায় চলে এসে নিজে ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সবই অবশ্য শোনা কথা। ব্রজমোহনের দাদুর বাবাই বোধহয় মিশরে গিয়েছিলেন যতদূর শুনেছিলাম।’
বাসুদেব বলল, ‘ওহ ওই জন্যই ব্রজদার বাড়িতে অত মিশরীয় জিনিস পত্রের সম্ভার।’ শিবনাথ আর অমিত মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
ব্রজমোহনের বাড়ির ওইসব অ্যান্টিক জিনিসের প্রতি বাসুদেবের যে একটা দুর্বলতা ছিল, সেটা আর জানতে বাদ নেই বন্ধুমহলে। বাসু বহুবার কেনার জন্য মোটা টাকা অফারও করেছিল। কিন্তু টাকার বিনিময়ে ব্রজর বংশমর্যাদা বিক্রি করতে হবে—এমন অবস্থা কোনোদিনই ছিল না। তাই বাসুদেবের সে আশা আর পূর্ণ হয়নি।
যে যার বাড়ির পথ ধরল। ব্রজমোহনের মৃত্যুর পরে প্রাতঃভ্রমণের সুর গেছে কেটে। সকলের চোখেই একটা সন্দেহের দৃষ্টির আনাগোনা। কেউই যেন কাউকে আর ঠিক বন্ধু ভাবতে পারছে না। অদ্ভুতভাবে একটা ঠান্ডা খুন সকলের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দিল। বিশেষ করে ওই গোলমুখের, বেঁটে, নিরীহ ছেলেটা যে ওরা ঢুকলেই কাউকে কিছু না বলেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেত বাজারে; ফুলকপির শিঙাড়া, ভেজিটেবল চপ নিয়ে চা করে হাজির করত ওদের আড্ডায়, তার ওরকম বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে সকলেরই। সেই নরম সকাল থাকলেও হাঁটার যে ছন্দপতন হয়েছে সেটা ওদের মুখের মিলিয়ে যাওয়া হাসিই বলে দিচ্ছে। এই বয়েসের মানুষদের বন্ধুত্বটা যেমন একাকীত্ব কাটাতে দ্রুতই হয়, তেমনই ভাঙন ধরেও তাড়াতাড়ি—কারণ অবুঝ অভিমান বুকের বাম দিকে বাসা বাঁধে অকারণেই। কাঁচা পাকা চুলের দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন