অর্পিতা সরকার
গাড়ি থেকে নামছে ইন্সপেক্টর লগ্নজিতা ভট্টাচার্য। সঙ্গে আরও দু-তিনজন কনস্টেবল। যার হাতে হাতকড়া পরানো রয়েছে তাকে দেখে আঁতকে উঠল রাহুল। গলা দিয়ে আচমকাই বেরিয়ে গেল, ‘আপনি? আপনি তো বাবার বন্ধু ছিলেন সেই কবে থেকে।’ ব্রজধামের বড় হল ঘরটাতে অনেকেই বসে আছে এই মুহূর্তে। লগ্নজিতাই আসতে বলেছিল এদের সকলকেই।
ব্রজমোহনের প্রাতঃভ্রমণের বন্ধুরাও উপস্থিত, উপস্থিত আছেন ডক্টর মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়। অপরাধীকে গ্রেফতার করতে গিয়েই একটু দেরি হয়েছে লগ্নজিতার ব্রজধামে পৌঁছতে। খুনি একেবারেই সতর্ক ছিল না অবশ্য। তাহলে হয়তো পালাত। মৃন্ময়বাবু আর চন্দ্রজাও রয়েছে। অপরাধীকেও লগ্নজিতা বসিয়ে রেখেছে গার্ড দিয়েই।
লগ্নজিতা বলল, ‘আপনি শুরু করবেন নাকি আমি মৃন্ময়বাবু? সেদিন ভোরে যেটা ঘটেছিল সেটা আপনিই বলুন। আর লুকিয়ে রেখে তো লাভ নেই।’
মৃন্ময়বাবু মাথা নীচু করে বললেন, ‘আসলে রাহুল আমার সন্তানতুল্য, ব্রজদাকে আমি শুধু বন্ধু ভাবতাম না, পরিবারের একজন ছিল। তাই এই কথা কাউকে বলতে পারিনি। তবে আজ বলে দেওয়াই ভালো। বুকের ভার কিছুটা লাঘব হোক।
ব্রজদার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই কলেজ পেরোনোর পরেই। ব্রজদার এ পাড়ায় বাড়ি সেটা আমি বরং পরে জেনেছি। আমি একদিন পাড়ার লাইব্রেরিতে গেছি দেখি একজন ভদ্রলোক ইতিহাস নিয়ে মশগুল হয়ে আছেন। আমিও ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই আলাপ করতে এগিয়ে গেলাম। বেশ ভাব হয়ে গেল। উনি আমার নাটক দেখতে গেলেন। তখনই সরলা ওকে আমার সঙ্গে দেখে। এবং খোঁজখবর করে জানতে পারে আমার বন্ধু ব্রজমোহন। ব্রজদার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। পড়াশোনা নিয়েই জীবন কাটাবেন এমনই ইচ্ছে ছিল। যদিও ব্রজদার মা এদিক-ওদিক সম্বন্ধ করছিলেন ছেলের বিয়ের জন্য। এবং ব্রজদাকেও চক্রবর্তী বংশ রক্ষার জন্য জোর করছিলেন। হঠাৎই আমাদের নাটক শেষ হলে সরলা এসে বলে, ও ইতিহাসে খুব কমজোরি, আর ওদের বাড়ির অবস্থাও ভালো নয়। ওকে যদি ফাইনাল পরীক্ষার আগে একটু দেখিয়ে দেয় ব্রজদা তাহলে খুব ভালো হয়। ব্রজদাও এক কথায় রাজি। উনি পড়াতে ভালোবাসতেন। সরলা ওদের বাড়িতে টিউশন করতে যেত। তারপরে ব্রজদার সঙ্গে বিয়ে করে নেয়। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ব্রজদার মা মারা যান, ভুগছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। ওর বাবা হরিদ্বারের একটা আশ্রমে থাকতেন স্বেচ্ছায়। মাঝে মাঝে এ বাড়িতে এসে কাটাতেন কয়েকমাস। আবারও ফিরে যেতেন হরিদ্বার। নাতি হবার পরে বোধহয় এ বাড়িতেই ছিলেন বেশ কিছু বছর। তবে হরিদ্বারেই শেষ বয়েস কাটিয়েছিলেন। এত বড় বাড়িতে শুধু ব্রজদা আর সরলা। ব্রজদা আপ্রাণ চেষ্টা করেন ওর থেকে প্রায় বছর দশ-বারোর ছোট স্ত্রীকে স্নেহ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে বেঁধে রাখতে। এরপর আমিও সদ্য চাকরি পেয়ে অল্পবয়সেই বিয়ে করি আমার এত বছরের প্রেমিকাকে। ব্রজদার বিয়েতে আমি ইচ্ছে করেই আসিনি। সম্পর্কে ব্রজদা হলেও, ব্রজদার অনুরোধে কখনো কখনো বন্ধুর মতো ব্রজমোহন বলেও ডেকেছি আমি। আমাদের বন্ধুত্বে কোনো খামতি ছিল না।
তারপর তৃষার আর রাহুলের জন্ম হয়। ব্রজদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকলেও ওদের বাড়ি বা সরলার থেকে আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখি। কারণ আমার স্ত্রী লোপা জানতো সরলার আমার প্রতি মারাত্মক দুর্বলতার কথা। তাই ক্রমশ দূরত্ব বেড়ে যায় দুই পরিবারের। তারপর কোনো একটা ঘটনায় আবারও ব্রজদার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়। রাহুল আর চন্দ্রার বন্ধুত্ব হয়। ইতিমধ্যে আমার স্ত্রী দীর্ঘরোগ ভোগে মারা যায়। আবারও সরলার সেই পুরোনো আবেগ বাড়তে থাকে। মাঝে মাঝেই ও আমার কাছে গিয়ে বলতে শুরু করে, আমি যেন ওকে নিয়ে সংসার শুরু করি। আমি ওকে অনেক বোঝাই ব্রজদার মতো মানুষকে ভালোবাসতে বলি কিন্তু ওর তখন আবারও সেই আগের মাথার সমস্যাটা চারা দিয়ে ওঠে। ব্রজদা একদিন আমায় ডেকে জিজ্ঞাসা করে সরলার প্রতি আমার ভাবনা কেমন? আমি ব্রজদাকে বুঝিয়ে বলি, আমি ওকে ব্রজদার স্ত্রী, রাহুল, তৃষার মা হিসেবে দেখি। তখন ব্রজদা বলে, তাহলে রাহুল আর চন্দ্রজার বিয়ে হতেই পারে কোনো আপত্তি থাকবে না কারোর। তৃষার আচমকা মৃতুর পর ব্রজদা আরও বেশি করে চন্দ্রাকে আপন করে নেন। হয়তো তৃষার ঘাটতি মেটাতে। সরলার সব আক্রোশ পরে চন্দ্রার ওপরে। যেহেতু আমি ওকে রিফিউজ করেছি তাই ও আমার মেয়েকে কিছুতেই ব্রজধামের বউ হয়ে ঢুকতে দেবে না এটা থেকেই। ব্রজদা একাই লড়াই করে সরলার সঙ্গে এটা নিয়ে। শেষে আমিও এ বিয়েতে অমত করতে বাধ্য হই। কারণ সরলা চন্দ্রজাকে হুমকি দিয়েছিল ওকে মেরে দেবে বলে। সেটা ব্রজদাকে বলতেই ব্রজদা আমার ওপরে অত্যন্ত রেগে গিয়ে বলে, চন্দ্রা আমার মেয়ে। ব্রজধামে ওর দায়িত্ব আমার। বিয়েটা আমি তাড়াতাড়িই দিতে চাই। আমি অমত করেছিলাম আগেরদিন সকালেই। রীতিমতো কথা কাটাকাটি হয়েছিল সেদিন। অনেকেই ভুল বুঝেছিল বন্ধুরা, ভেবেছিল ব্রজদার অমত, তাই আমি রাগ করেছিলাম। সেদিন ব্রজদার চোখে একটা অসহায়তা দেখেছিলাম। বলেছিল, আমি চাই না সরলার মতো রাহুলও যাকে ভালোবাসে তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে জীবনটা একটা নাট্য মঞ্চ করে তুলুক মৃন্ময়। আমি আর কথা না বলে চলে এসেছিলাম। খুবই খারাপ লাগছিল তখন। রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভোরে হাঁটতে যাওয়ার আগেই ব্রজধামে ঢুকে ব্রজদার কাছে ক্ষমা চেয়ে যাব। বলে যাব, বিয়ের ডেট ঠিক করতে। সেই কারণেই ব্রজধামে ঢুকেছিলাম। জানতাম মন্টু ওইসময় দরজা খুলেই রাখে। গেটে জ্বলে জোরালো একটা লাইট। বাড়ির বাগান পেরোনোর আগেই আচমকা সরলা এসে জড়িয়ে ধরল অধো অন্ধকারে। আমি ওকে জোর করে ছাড়িয়ে দিলাম। হাতটা বাগানের গোলাপের কাঁটায় লাগল। ছিঁড়ে গেল। মনে হল ব্রজদার ঘরের দরজায় কে যেন দাঁড়িয়ে দেখছে এই ঘটনা। ব্রজদা মনে করে পালিয়ে আসতে যাচ্ছিলাম। সরলা বলল, আজকেই তবে তোমার ব্রজদাকে খুন করে দেব আমি। তারপর দেখি তুমি আমায় নিয়ে সংসার করো কিনা। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম। সরলা যদি সত্যিই এটা করে! পালিয়ে এসেও গেটের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ব্রজদা বেরোয় কিনা দেখার জন্য। সরলা সত্যিই কিছু করবে না তো! এই দ্বিধায় ব্রজধামের পাশের একটা ঝাঁপ বন্ধ ছোট্ট দোকানের বেঞ্চিতে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। সরলার ওই জোর করে চুমু খেতে আসাটা কি দেখতে পেল ব্রজদা? আমাকে কি খারাপ ভাবল? এই ভাবতে ভাবতে কটা বেজেছে বুঝতেই পারিনি। হঠাৎই ব্রজধামের মধ্যে চিৎকার শুনলাম। এদিকে বাসুদেব আমায় ডাকছিল, আমি কোনোমতে পালিয়ে এলাম বাড়িতে। কিছুক্ষণ পরেই খবর পেলাম, ব্রজমোহন আত্মহত্যা করেছে। লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম এই বুড়ো বয়েসে নিজের স্ত্রীকে এরকম আচরণ করতে দেখেই ব্রজদা আত্মহত্যা করেছে, এমনই একটা ধারণা হল আমার। পরে যখন খুন শুনলাম, তখন নিশ্চিত হলাম, ওটা সরলার কাজ। আমি থাকলে হয়তো ব্রজদা মারা যেত না ভাবতে ভাবতেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলাম। কারোর কথার সঠিক জবাব দিতে পারিনি। অসুস্থ হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছি কিন্তু এ লজ্জার কথা কাউকে বলতে পারিনি। চন্দ্রা আর রাহুলের বিয়ে ফাইনাল করতে গিয়েও যে নিজেকে এভাবে বিপদে পড়তে হবে আমার কল্পনার অতীত ছিল।’
মৃন্ময়বাবু হাঁপাচ্ছেন। চন্দ্রজা জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘সরি বাবা। তোমায় কিছুক্ষণের জন্যও ভুল বোঝার জন্য।’
লগ্নজিতা বলল, ‘রাহুলও নিশ্চয়ই এই একই কারণে মানে মাকে আড়াল করতে গিয়েই বেশ কিছু মিথ্যে বলছিলেন। কিছুতেই বলতে চাননি মা মানসিকভাবে অসুস্থ। বা ওনার উত্তেজনা বা রাগের মাথায় লোকের গলা চেপে ধরে শ্বাস বন্ধ করে দেবার স্বভাব আছে।’
রাহুল মাথা নীচু করে বলল, ‘আমি চাইনি মা এই অসুস্থ অবস্থায় কোনো রকম সমস্যার সম্মুখীন হোক।’
লগ্নজিতা বলল, ‘এবারে আমি বলি। ব্রজমোহন, মন্টু আর ইন্দ্রজিৎ খুনের আসল রহস্য।
প্রথমেই বলি, খুনি কিন্তু একজনই। আমি কীভাবে খুনিকে শনাক্ত করলাম সেটাই বলি আগে।
ব্রজমোহন বাবুর মাথার পিছনে যে শক্ত অথচ ভোঁতা কিছু দিয়ে সেটা আর কিছুই নয় মিশরের মৃতজগতের দেবতা আনুবিস দিয়ে। ব্রজমোহনবাবুর পড়ার টেবিলের ঠিক পাশের র্যাকেই রাখা ছিল ওটা। এখন খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, শেয়ালের একটা কান ভাঙা। এই ছোট্ট ভাঙা কানটা আমি পেয়েছিলাম খুনির বাড়ির ওয়াশরুম থেকে। খুনি ভাঙা অংশটা ওখানে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল কারণ, এ বাড়ির মেঝেতে ফেলে রাখেনি প্রমাণ হিসেবে। হয়তো ফেলে দেবে ভেবেও ফেলতে ভুলে গিয়েছিল।
মন্টুর আলমারি থেকে একটা ঘড়ি পাওয়া গিয়েছিল যেটা তাকে এ বাড়ির কেউ উপহার হিসেবে দেয়নি। ঘড়িটার একটা লক ভেঙে গিয়েছিল। লকটাও পাওয়া গিয়েছিল ব্রজমোহনবাবুর মৃতদেহের পাশেই। ফসিলের ঘড়ি। মোটামুটি হাজার কুড়ি মতো দাম। এই একই কোম্পানির দামি আরেকটা ঘড়ি পেয়েছিলাম এস আই ইন্দ্রজিতের হাতে। ইন্দ্রজিৎকে ওই ঘড়িটা কেউ উপহার দিলেও মন্টুকে দেয়নি। মন্টু ওটা কুড়িয়ে পেয়েছিল, ব্রজমোহনকে খুন করে খুনি যখন পালাচ্ছিল তখনই।
এই ফসিলের ওয়াচের লিমিটেড কালেকশনের ঘড়ি সংগ্রহ করাটা তার নেশা ছিল। তার বাড়ির শোকেসে খুঁজলে আরও গোটা পাঁচেক পাবেন। মন্টু কেন চুপ করে গিয়েছিল ওই খুনটা দেখার পর? এ প্রশ্নটা নিশ্চয়ই ঘুরছে সকলের মাথাতেই। মন্টু খুনিকে বিশেষভাবে চিনত। তার দুমিনিট আগেই সে দু-কাপ চা রেখে গিয়েছিল এই ব্রজমোহনবাবুর ঘরেই। জিজ্ঞাসাও করেছিল, এত ভোরে? তিনি কিছু বলার আগেই হয়তো ব্রজমোহনবাবু বলেছিলেন, একটা ভীষণ দরকারি কাজে ওনাকে ডেকেছিলাম। গতকাল রাতে কলকাতা এসে পৌঁছেছেন তাই ভোরেই আসতে বলেছিলাম।
তারপর যখন মন্টু দেখেছিল, ব্রজমোহনবাবু মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, তখনই ছেলেটা মারাত্মক আঘাত পায়। কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল ওর মস্তিষ্ক। এদিকে ইন্দ্রজিৎকে খুনি একটু আধটু চিনত। সেই সূত্রেই আবার পরিচয় ঘনিষ্ঠ করে নিল। নজর রাখতে পাঠালো আমার ওপরে। কারণ ততদিনে তিনি জেনে গেছেন, যে এ রহস্যের সমাধানে আমি হাত দিয়েছি। ইন্দ্রজিৎ আমার ওপরে নজর রাখছিল, আর আমাকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করেছিল। ইন্দ্রজিৎ দামি ঘড়ি আর কিছু টাকার বিনিময়ে এই প্রফেশনটাকে আবারও প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। আমরা যেদিন মন্টুর জেরা করব বলে এ বাড়িতে পা দিলাম সেদিনই, মন্টুর ফোনে একটা বিশেষ নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোনে বলা হয়, ব্রজমোহনের খুনি ব্রজধামের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। পারলে প্রতিশোধ নাও। মন্টু দিগ্বদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়, আর যথারীতি ইন্দ্রজিৎ দুজন লোককে দিয়ে ওকে কিডন্যাপ করায়। মন্টুকে বাঁচিয়ে রাখলে খুনির বিপদ। কিন্তু উনি ঠিক প্রফেশনাল খুনি নন। উত্তেজনা আর লোভের বশেই ব্রজমোহনকে খুন করে ফেলেছেন। তাই নিয়ে গিয়েই মন্টুকে খুন করেননি।
ওকে একটা ঘরে আটকে রেখেছিলেন। আমার চোখে দ্বিতীয়বার ধরা পড়ল খুনি। মন্টুকে একই পদ্ধতিতে মাথার পিছনে মেরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারা হয়। ফাঁসের দড়িটা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মন্টুর মৃত্যুর পর ওর হাতে পেলাম একটা ছোট্ট মেটাল লোগো। জামার বোতাম নয়, ঠিক কী খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম ওটা একটা ব্র্যান্ডেড কোম্পানির বেল্টের লোগো। দুজনেরই গলায় কিসের দাগ চেপে বসে ছিল সেটা বুঝলাম। মোটা নয়, একটু সরু লেদার বেল্ট ইউজ করা হয়েছিল।
ইন্দ্রজিৎ খুনের সময়েও তার ভাড়া করা লোকেরা মাথার পিছনে বাঁশের আঘাত করেছিল ঠিকই, কিন্তু দেহাতি লোকজন বেল্টের বদলে গলায় গামছা দিয়ে শ্বাসরোধ করে ওর নির্দেশে। গলার দাগের তারতম্য আমার চোখ এড়ায়নি। পরের ক্লুটা দিলেন আমাদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রজমোহনবাবু প্রায়ই শান্তিনিকেতন যেতেন এবং থাকতেন। আর ওনার কাছেই ছিল ওনার বাড়ির এক সেট চাবি। যে চাবিটা এখনও ব্রজমোহনবাবুর লাইব্রেরির একটা বইয়ের পিছনে পড়ে আছে, যেটা সাধারণ মানুষের খুঁজে পাবার কথাই নয়। অথচ মৃতুর তিনদিন পরেই ওনার বাড়ির তালা খুলে কেউ একজন ঠিক ব্রজমোহনবাবুর ডায়েরিটাই চুরি করে নিয়ে গেছে। কেউ তালা ভাঙেনি বা চেষ্টাটাই করতে হয়নি। ওটা আলতো করে চাবি না ঘুরিয়েই গেটে দেওয়া ছিল। যাতে মেঘবালা বাজারে বেরিয়ে গেলেই ডায়েরিটা নিয়ে আসতে পারে সে। কারণ মেঘবালা তখন রাগে ফুটছে। যে স্ত্রী ব্রজদাকে খুন করে দেয় তার জন্যই ব্রজমোহন ওকে ভালোবেসেও দূরে সরিয়ে রেখেছিল। ব্রজমোহনের মৃত্যুর পর ওই গুপ্তধনের সন্ধান সরলাদেবী পাক এটা উনি চাননি। এবারে প্রশ্ন আসবে, ডায়েরিটা যে মেঘবালার কাছে ছিল সেটা খুনি জানল কী করে? এটা আমিও ঠিক জানি না। সম্ভবত ভোরবেলা ব্রজমোহনের বাড়িতে বসে গুপ্তধনের কথা আলোচনা করতে করতেই খুনি একবার ডায়েরিটা চেয়ে বসে। তখনই উত্তেজিত ব্রজমোহন বলেন, সে ডায়েরি তো শান্তিনিকেতনে মেঘবালার বাড়িতে। অথবা অন্য কোনোভাবে জেনেছিল অপরাধী। সেটা উনিই ভালো বলতে পারবেন। ব্রজমোহনবাবুর ফোন কলের ডিটেলস খুঁজে বুঝতে পারি, আগেরদিন রাতেই উনি বার দুয়েক কল করেছিলেন অপরাধীকে। অথচ অপরাধী আমায় জানান বহুবছর তাদের যোগাযোগ নেই। এমনকী অপরাধী একবারও স্বীকার করেন না, তাদের বন্ধুত্ব যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ ছিল। ব্রজমোহন ও অপরাধীর মধ্যে প্রায়ই ফোনে কথাও হত। দেখাও হয়েছে কলকাতায় বা শান্তিনিকেতনে। ইন্দ্রজিৎ যে আমার চোখে ধরা পড়ে গেছে হিন্দুস্থান ধাবাতেই সেটা অপরাধী ধরে ফেলেছিলেন। কারণ আমি ইন্দ্রজিৎকে তারপর থেকেই আর সেভাবে তদন্তের বিষয়ে কিছুই বলছিলাম না। তাই বিষয়টা ফাঁস হয়ে যেতে পারে ভেবেই খুন করা হয় ইন্দ্রজিৎকে। অপরাধী আরেকবার ধরা পড়ে আমার কাছে। আমি তাকে বলিনি আমি কাকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিনিকেতন যাচ্ছি। অথচ সে কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলে কৌশিকের নামটা। এমনকী কোপাইয়ের ধারে আছি সেটাও বলে ফেলে ভুল করে। আমাদের দূর থেকে কেউ যে একটা নজর রাখছিল সেটা তখনই বুঝি। কার নির্দেশে বুঝতে দেরি হয় না আর।’
রাহুল বলল, ‘কিন্তু অফিসার কেন করলেন উনি এটা?’
লগ্নজিতা বলল, ‘মেঘবালাকে উনি চিনতেন না অথচ ‘ইতিহাসের আনাচে কানাচে’ বইটা প্রকাশকের তরফ থেকেও উপহার পেয়েছিলেন মেঘবালা। তাই ওনার কাছে তিনটে কপি আছে। তার একটাতে পরিষ্কার লেখা আছে—বন্ধুর বান্ধবীকে প্রকাশক। আসলে মেঘবালা, ব্রজমোহন আর বিমানবাবু তিনজনই ভালো বন্ধু ছিলেন। ব্রজমোহন যবে থেকে মেঘবালাকে ইগনোর করতে শুরু করলেন তবে থেকেই এদের দুজনের বন্ধুত্ব বাড়ল। কারণ মেঘবালা ব্রজমোহনকে চান। তাই ওকে সাহায্য নিতেই হত। তখনও পর্যন্ত অপরাধীর মনে চুরি বা খুনের প্রবণতা জাগেনি বলেই আমার ধারণা। দুজনে একসঙ্গে বসে মিশরীয় ভাষা শেখার চেষ্টাও করেছেন। হঠাৎই বাসুদেববাবুর ঘন ঘন আসায় ব্রজমোহনবাবু ভয় পেয়েছিলেন, যদি অমূল্য ডায়েরিটি চুরি যায়! তখনই মেঘবালার কাছে সেটা রেখে আসেন। জেরক্স করে। বেশ কিছু জেরক্সের পাতা পেয়েছি আমি লাইব্রেরিতে।’
বিমানবাবু স্থির গলায় বললেন, ‘আগেরদিন রাতে আমি কলকাতায় এসেছিলাম হলদিয়া থেকে। কলকাতার বাড়িতে এসেছিলাম একটা কাজে। কলকাতা এলে ব্রজমোহনের সঙ্গে দেখা করেই যেতাম। দুজনের পছন্দের মিল ছিল বড্ড বেশি। সেই কারণে ফোনও করি দুপুরের দিকে। ব্রজমোহন উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, রাতে এসো সেই আমার পুরোনো ডায়েরির মর্মোদ্ধার করতে পেরেছি কিছুটা। গুপ্তধনের থেকেও বড় কিছু পেয়েছি। তুমি প্রকাশক ছিলে, তোমারও কাজে লাগবে। তারপরেই বলে, না থাক রাতে নয়। আমার আরেকটু কাজ বাকি আছে। ওটা শেষ করে নিই রাতের মধ্যে। তুমি ভোর চারটের সময় এসো। হাঁটতে যাবো না কাল। ভোরে বাড়িটা আমার একটু নিস্তব্ধ থাকে। বিশেষ করে সরলা জ্বালাতে আসে না ভোরে। ওইসময়েই এসো।
আমি ঢোকার আগেই দেখলাম, মেইন দরজা খোলা। মন্টু খুলে দিয়ে গেছে ব্রজমোহন বেরোবে বলে। মন্টু বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। আমি আসতেই খুশি হয়ে চা করতে গেল। আমি ঘরে ঢোকার পরে ব্রজমোহন বলল, এ সম্পদের মালিক শুধু আমি বুঝলে বিমান? আর কেউ নয়। এতদিন একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা। এখন আবিষ্কার হতেই এর মালিক শুধু ও হয়ে গেল! রাগ হচ্ছিল ওর অহংকারী স্বভাবের জন্য। তারপরেই বলল, এই কারণেই সে ডায়েরি আমি মেঘবালার হেপাজতে রেখে এসেছি। জানতাম চুরির সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমার কাছে সবগুলো পাতার জেরক্স কপি আছে। আমি বুঝলাম ও আমায় বিশ্বাস করছে না। তাই মিথ্যে বলছে। মেঘবালার কাছে রেখে আসেনি। আমায় দেখাতে চায় না। আমি বললাম, দুজনে একসঙ্গে কাজ করেছি ব্রজমোহন। এর দাবিদার কি আমি নই? ও আচমকা রেগে গেল। বলল, এ শুধু চক্রবর্তী বংশের সম্পদ। অন্য কারোর অধিকার নেই এতে। এ আবিষ্কারের ইতিহাসে ব্রজমোহন চক্রবর্তীর নাম থাকবে। অন্য কারোর নয়। বেইমানি আর সহ্য হচ্ছিল না। তাই ওর প্রিয় আনুবিসের মূর্তি দিয়েই ওকে আঘাত করলাম। ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ভয় পেয়ে গেলাম। তাই কোমরের বেল্ট দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে দিলাম। আনুবিসের কানের অংশ ভেঙে গিয়েছিল মেঝেতে পড়ে। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি তখনই মন্টুর সঙ্গে সজোরে ধাক্কায় ঘড়িটা খুলে পড়ে যায় হাতের। গেটের কাছে যেতে যেতেই মন্টুর জোরে চিৎকার শুনতে পাই। কলকাতা বা হলদিয়া নয় সোজা শান্তিনিকেতন চলে যাই। ওখানেই চুপচাপ ছিলাম। হঠাৎই মেঘবালা ফোনে জানালো ব্রজদা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু ওর মনে হয় রিন্তিদি খুন করে দিয়েছে। তারপর থেকে চেষ্টা চালাচ্ছিলাম খুনটা সরলার কাঁধে পড়ুক। মেঘবালাকে বললাম, ব্রজ বলেছিল তোমার কাছে যে ডায়েরিটা আছে ওটা সরলার হাতে পৌঁছে দিতে। জানতাম রেগে যাবে মেঘবালা। ও বলল, কিছুতেই এ জিনিস আমি রিন্তিদির হাতে দেব না। ওই ব্রজদার খুনি। তুমি এসে নিয়ে যেও, আমি যখন বাজারে বেরোব। তাতে যদি পরে রাহুল এসে খোঁজ করে ডায়েরির, বলবো চুরি হয়ে গেছে। প্ল্যান মতো আমি ডায়েরি নিয়ে আসি কিন্তু নিজের কাছে রাখি না, মহাদেবের হাতে দিয়ে বলি ব্যাগটা যত্ন করে রেখে দে। আমি দুদিন পরে নিয়ে যাব। হলদিয়ায় ফিরতেই লগ্নজিতা হাজির হয় আমার বাড়িতে। ওর হাতে তদন্তের ভার শুনে ভিতরে ভিতরে ভয় পেতে শুরু করি। যদি মন্টু বলে দেয়। শুনলাম মন্টুর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বলতে কতক্ষণ।’
লগ্নজিতা বলল, ‘তাই ইন্দ্রজিতের সঙ্গে সামান্য পরিচয়টা আরও গাঢ় করে নিল বিমানবাবু।’ কৌশিক খেয়াল করল আর বিমানমামা বলছে না জিতা।
‘ইন্দ্রজিৎকে আমার পিছনে লাগিয়ে দিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারল না। মন্টুকে কিডন্যাপ করল। তারপর আরও ভয় পেয়ে মন্টুকে খুন করে দিল ঠিক একই পদ্ধতিতে। কিন্তু বডি খুঁজে উদ্ধারের থেকে পুলিশকে আরও বিভ্রান্ত করার জন্য বডি ফেলে রেখে গেল ব্রজধামের সামনে। সম্ভবত বডি ফেলে দেওয়ার কাজটা প্রফেশনাল লোক করেছে।
মন্টুর ফোনে আর ইন্দ্রজিতের ফোনে একই অদ্ভুত একটা নম্বর দেখলাম। নম্বরটা ট্র্যাক করে দেখা গেল ওটা বিমানবাবুর মৃতা স্ত্রী কাজরীদেবীর নামে নেওয়া। উনি মারা যাবার পরে দীর্ঘদিন সিমটা রিচার্জ করালেও কাউকে ফোন করা হয়নি ওই ফোন থেকে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেভাবে পাওয়া যায়নি, সম্ভবত বডিতে মন্টু, রাহুল হাত দেবার ফলে যেগুলো ছিল সেগুলো আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।’ মৃন্ময়বাবু বললেন, ‘তার মানে আমি বারান্দায় একেই দেখেছিলাম হয়ত। ব্রজদা আরেকটু লম্বা।’
লগ্নজিতা বলল, ‘তারপর মহাদেবকে নির্দেশ দেয় ডায়েরিটা যেন অন্য কোথাও সরিয়ে দেওয়া হয়। মহাদেবের বোন যে কাজে আসেনি শরীর খারাপের জন্য এসেছিল অন্য একটি মেয়ে কৃষ্ণা, এটা আবার মহাদেব বাবুর ভয়ে বলেইনি বাবুকে। তাই কৃষ্ণার কাছ থেকে জানতে পারি বিমানবাবু মাত্র দিন দশেক আগেই শান্তিনিকেতনের এই বাংলোতে এসেছিলেন প্রায় দিন চার-পাঁচ। কৃষ্ণা এসে মহাদেবের নির্দেশে বাবুকে খেজুরের রস দিয়ে যাচ্ছিল। কৃষ্ণার অনুরোধে ওর কয়েকটা ছবিও তুলে দিয়েছিল বিমানবাবু। তাই আমরা বলাকাতে ঢুকতেই কৃষ্ণা বলেছিল, বাবু তোদের দিয়ে ছবিগুলো পাঠায়নি? কৃষ্ণার বাড়িতেই মহাদেব ডায়েরিটা রাখতে পাঠাচ্ছিল। আমার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হতেই সরল মেয়েটা বলতে শুরু করেছিল, মহাদেব একটা ব্যাগ দিল, ওদের বাড়িতে ইঁদুরের হামলা হছে তাই, আমার ঘরে দুদিন রাখতে হবে। সন্দেহ হতেই ব্যাগটা চেক করে দেখি, ব্যাগের মধ্যে পলিথিন পেপারে মোড়ানো চামড়ার ডায়েরিটা। বুঝতে দেরি হয় না। অপরাধী আরও সতর্ক হয়ে মহাদেবের বাড়ি থেকেও সরিয়ে দিতে চাইছে ডায়েরিটা।
আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি যে বললে তোমারও মাটির দুয়ার। তো ইঁদুর তো ওখানেও হবে। তুমি আমায় দাও, আমি সাবধানে আলমারিতে রেখে দিচ্ছি। কৃষ্ণা সরল হেসে বলল, নে সাবধানে রাখিস কিন্তুক। মহাদেব রগচটা লোক। আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি কাউকে বলো না এটা আমায় দিয়েছো। বলবে তুমিই রেখেও দিয়েছো। পরে যখন মহাদেব চাইবে তখন দিয়ে দেব। তাছাড়া মামার বাংলোতেই তো থাকছে। কৃষ্ণা নিশ্চিন্ত মনে চলে গিয়েছিল।
আমার হেফাজতে আছে এখন ডায়েরিটা। আমি যতবার শান্তিনিকেতন থেকে বিমানবাবুকে কল করি ততবার উনি বলেন—হলদিয়ার বাড়িতেই আছেন। অথচ ওনার অবস্থান দেখাচ্ছিল কলকাতা। উনি কদিন ধরে কলকাতাতেই আছেন। আরও কোনো মতলবে কিনা জানি না।’ বাসুদেববাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘কিন্তু কি আছে ব্রজর ওই ডায়েরিতে? যার জন্য মানুষটাকে চলে যেতে হল।’
লগ্নজিতা বলল, ‘একজন আসছেন। তিনি মোট ছটা ভাষায় পারদর্শী। তিনিই পড়ে শোনাবেন কী আছে এতে! ব্রজমোহনবাবু এ ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করেননি তাই অন্য কারোর সাহায্য তিনি চাননি। বিশ্বাস করেছিলেন একমাত্র বহুদিনের বন্ধু বিমানবাবুকে। ফল তো আপনার দেখতেই পাচ্ছেন।’
ব্যাগ থেকে বেরোলো সেই সোনার তালা দেওয়া ডায়েরিটা। পুরোনো চামড়ার ডায়েরি। ছোট্ট চাবিটা ভরা আছে ওই ডায়েরিরই চামড়ার পকেটে।
শুদ্ধশীল একজন বাঙালি। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ছয়টা ভাষা শিখে ফেলেছে। লগ্নজিতাকে এর খবর অবশ্য দিয়েছে ওরই ডিপার্টমেন্টের একজন কলিগ। যোগাযোগ করতেই এসে হাজির।
ডায়েরিটা পড়তে শুরু করল শুদ্ধশীল। সময় নিচ্ছিল একটু। হায়রোগ্লিফ থেকে ইংরেজিতে ট্রান্সসিলেট করে তারপর বাংলায় বলছিল ও।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন