অর্পিতা সরকার
—আপনি আচমকা বাড়িতে চলে এলেন যে? দেখুন, পাড়ার কারোর সঙ্গে আমার মেলামেশা নেই। তাই আমি এ পড়ার কাউকেই বাড়িতে ডাকি না, চাই না কেউ আসুক।
লগ্নজিতা বাসুদেববাবুর কথার উত্তর না দিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই বলল, ‘আপনার রুচির তারিফ করতেই হয়। দুর্দান্ত সাজিয়েছেন তো ড্রয়িংটা। একাল-সেকালের দারুণ মিশেল।’
বাসুদেববাবুর সন্দেহের ভ্রুটা তবুও কুঁচকেই আছে। লগ্নজিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তো আমার ড্রয়িংরুম দেখতে এলেন নাকি?’
লগ্নজিতা নিজের আইডি কার্ড বের করে বলল, ‘না। সেই কারণে আসিনি। আসলে ব্রজমোহন খুনের তদন্তের ভার আমার ওপরে। সেই কারণেই আসা। ড্রেস ছাড়া এলাম কারণ পাড়ার মধ্যে কৌতূহল তৈরি হোক- এটা আমি চাই না। আপনি মান্যগণ্য মানুষ, তাই ভাবলাম পুলিশের পোশাক ছাড়াই একটু গল্প করে আসি।’
বাসুদেববাবুর চোখে সচেতনতা ও সাবধানতার প্রতিচ্ছবি। বললেন, ‘বসুন। প্রথম দিন তাহলে নিজের ভুয়ো পরিচয় দিয়েছিলেন আপনি মিস লগ্নজিতা ভট্টাচার্য?’
লগ্নজিতা বলল, ‘আচ্ছা, আপনাদের দলের বাকিদের আপনার কেমন মনে হয়? এরা কেউ ব্রজমোহনকে খুন করতে পারে? মানে এরকম শত্রুতা ছিল নাকি কারোর সঙ্গে?’
বাসুদেববাবু বললেন, ‘শত্রুতা থাকলে কি আর ব্রজমোহন আগের দিন অবধি চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরত? আমরা সকলেই ওকে ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম। তাছাড়া সবাই একসঙ্গে থাকলে মনোমালিন্য হতেই পারে, কিন্তু খুন কেন করে দেবে কেউ? তাছাড়া ব্রজকে খুন করে আমাদের পাওয়ারই বা আছে কী?’
লগ্নজিতা বলল, ‘ব্রজমোহনবাবুর স্ত্রী নাকি আপনার মেয়েকে বেশ পছন্দ করতেন। নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়েও দিতে চাইতেন?’
বাসুদেববাবু হেসে বললেন, ‘বিয়েটা তো আর সরলাবৌদি করতেন না, করত রাহুল। রাহুলের অন্যত্র সম্পর্ক আছে জেনে আমিই বা আমার একমাত্র মেয়ের তার সঙ্গে দেব কেন?’
লগ্নজিতা বলল, ‘সেটা অবশ্য ঠিকই। তবে শুনলাম ব্রজমোহনের বংশমর্যাদা গর্ব করার মতো। অনেকেই চাইবে অমন একটা উচ্চবংশে মেয়ের বিয়ে দিতে।’
বাসুদেববাবু একটু ব্যঙ্গাত্মক হেসে বললেন, ‘শুনুন মহাশয়া, ওসব ব্রজর নিজস্ব ধারণা। মিশরের রাজা মানে কোনো এক রাজবংশ নাকি ওর কোনো এক পূর্বপুরুষকে কিছু কয়েন আর কিছু সোনার জিনিসপত্র দিয়েছিলেন। সেটা বংশপরম্পরায় ব্রজর দাদুর হাতে এসে পৌঁছায়। ব্রজর দাদু মিশরীয় ভাষাও বোধহয় শিখেছিলেন, নাকি শোনা কথা হবে। তার থেকেই জানা যায় ওদের বংশের কোনো এক পূর্বপুরুষ মিশর রাজবংশের বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। ওই সময় ব্রিটিশ আর মিশরের মধ্যে যুদ্ধ উপস্থিত হয়। তখন সমস্ত রাজকর্মচারীরাও সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে এমনই নির্দেশ দেন ওই মিশরীয় রাজা। তাই ব্রজর পূর্বপুরুষ তখন ভারতে পালিয়ে আসেন। সম্ভবত উনিই নিজের বংশের ইতিহাস লেখেন। সেটা উদ্ধার করার জন্যই ব্রজর দাদু মিশরীয় ভাষাও বোধহয় শেখেন। ইনফ্যাক্ট, ব্রজও ওই কারণে এসব শেখার আগ্রহ প্রকাশ করত। এসব ব্রজর মুখেই শোনা। কিন্তু আপনিই বলুন, এটা কী এমন গৌরবের ইতিহাস? আরে মিশরের রাজবংশের তোরা কেউ ছিলিসই না। ছিলিস তো নিতান্ত বেতনভুক কর্মচারী। তাও তো বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়ে গিয়েছিল। তার গরমে ব্রজমোহন সবসময় উষ্ণ হয়েই থাকত। আরে, আমার চোদ্দোগুষ্টি নাকাশীপাড়ার জমিদার ফ্যামিলি মশাই। মির কাশেম এসেছিল আমার বংশে। এখনও নাকাশীপাড়ার অর্ধেক জমি আমাদের বংশেরই কারোর না কারোর কাছে আছে। ও আমায় বংশমর্যাদা শেখাতে এলে হবে? আরে রাজার বেতনভুক কর্মচারী আর জমিদারের মধ্যে পার্থক্য নেই?
গোটা চক্রবর্তী পরিবার ওই মিশরীয় রাজার গরিমা ভাঙিয়ে জল খেয়ে গেল। তার ডায়েরি পড়বে বলে হায়েরোগ্লিফ শিখে গেল চক্রবর্তীরা। ব্রজমোহনও তো প্রচুর খাটাখাটনি করত। আমি একবার এক হায়রোগ্লিফ জানা লোককে ধরে এনেছিলাম ওদের ওইসব পড়তে পারবে বলে। তো ব্রজ তাকে বিশ্বাসই করল না। পড়তে দিল না। নিজে শিখেছিল কিনা আমি অবশ্য জানতে পারিনি। এই বংশমর্যাদা নিয়ে ও এসেছিল আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে। তারপর নাকাশীপাড়াতে গিয়ে আমাদের প্রাসাদ দেখে লেগে গেছে তাক। যদিও এখন ভেঙেচুরে গেছে।’
লগ্নজিতা বলল, ‘তাহলে তো আপনার ঐতিহ্যের তুলনায় কিছুই নয় ব্রজমোহনের বংশ।’
বাসুদেববাবু টেবিল চাপড়ে বললেন, ‘একশো বার। কিন্তু ওকে বোঝাবে কে? ওই জন্যই তো যখের ধনের মতো মিশরীয় জিনিসপত্র আগলে রাখত। কাউকে বিশ্বাস করে ছুঁতে অবধি দিতো না ওসব। আমি এসব বুঝতাম তাই দেখিয়েছিল একবার।’
লগ্নজিতা গল্পের ছলে বলল, ‘তা কেমন দাম হবে সেসব জিনিসের? নিশ্চয়ই তেমন নয়? সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার হয়তো।’
বাসুদেববাবু উত্তেজনার বশে বললেন, ‘না। দাম প্রচুর। যে তিনটি কয়েন আমায় দেখিয়েছিল, তার দাম কোটি টাকার ওপরে। রেয়ার জিনিস যে!’
লগ্নজিতা আর দেরি না করে বাউন্সারটা ছুঁড়ে দিল বাসুদেববাবুর দিকে—’এত দাম? তার মানে ব্রজমোহন খুন হওয়ার যথেষ্ট কারণ কিন্তু আছে। আবার বললেন, সিন্ধু না হরপ্পা সভ্যতার আমলের কিছু কয়েনও নাকি আছে ওনার কাছে?’
বাসুদেববাবু উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘শুনুন, ব্রজমোহন খুন হয়নি। মানসিক অত্যাচারে মরেছে। আর হলেও ওকে ওই ছেলেই খুন করবে। প্রাইভেট কোম্পানিতে একটা চাকরি করে, বাবার সম্পত্তি তো কম নেই। অথচ বাবা নিজের ছেলেকেও বিশ্বাস করে কোনোদিন কিছু দেয়নি। মরলে তবে পাবে ভেবে বসে থাকতেই হয়তো…। আপনি যদি ভেবে থাকেন ওই দুর্মূল্য কয়েনের জন্য আমি ওকে মেরে দিয়েছি, তাহলে খোঁজ নিয়ে দেখুন ওসব কয়েন ওর বাড়িতেই আছে এখনও। যদি অবশ্য অশৌচ অবস্থায় রাহুল বেচে না দিয়ে থাকে। তাই অফিসার গল্প বোনা বন্ধ করে সঠিক পথে তদন্ত করুন।’
লগ্নজিতা একফোঁটা উত্তেজিত না হয়েই বলল, ‘আপনি দেখি বড় তাড়াতাড়ি রেগে যান। প্রেশারের ওষুধ কি দুবেলাই খান? সেদিন সবাই মিলে গেলেন মৃন্ময়বাবুকে দেখতে, আপনি একা রাগ করে বেরিয়ে এলেন। এত রাগ কিন্তু ভালো নয় বাসুদেববাবু। এ আপনারই ক্ষতি করবে।’
থমকে গেছেন বাসুবাবু। তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘ওহ আমার পিছনে টিকটিকি লাগিয়েছেন? এই জন্যই এই ডিপার্টমেন্টকে আর কেউ বিশ্বাস করে না। আসল খুনি বুক ফুলিয়ে সিমপ্যাথি আদায় করে বেড়াচ্ছে আর আপনারা দুষ্প্রাপ্য কয়েনের সূত্র ধরে সুতোয় গিঁট ফেলতে চাইছেন!’
এবারও লগ্নজিতা একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলল, ‘মৃন্ময়বাবুর বাড়ি থেকে রেগে বেরিয়ে এলেন কেন?’
বাসুবাবু স্থির গলায় বললেন, ‘অযথা মিথ্যে কথা আমার সহ্য হয় না, তাই। মৃন্ময় বলছে, ও নাকি সাড়ে চারটে নাগাদ ব্রজর বাড়িতে গিয়েছিল। অথচ আমি ওকে সাড়ে পাঁচটার সময় ব্রজর বাড়ি থেকে বেরোতে দেখলাম। ও আমার সঙ্গে কথা না বলে হনহন করে পালিয়ে গেল। আমার ওদিন যেতে দেরি হয়েছিল ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছিলাম বলে। ব্রজমোহনরা চলে গেছেই জানতাম। কিন্তু স্পষ্ট দেখলাম ব্রজর বাড়ির গেটের বাইরে মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। এখন মিথ্যে বলছে। তাহলে একঘণ্টা ও ওই বাড়ির মধ্যে করছিল কী? সব মিথ্যুক লোকজন। আমার আবার এত মিথ্যে পোষায় না।’
লগ্নজিতা বলল, ‘তো মৃন্ময়বাবু কী বলছেন এ বিষয়ে?’
বাসুদেববাবু বললেন, ‘মৃন্ময় বলছে আমি নাকি ভুল দেখেছি। ওটা ও ছিল না। ও সাড়ে চারটে নাগাদ ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির পথ ধরেছিল। ওর নাকি শরীরটা খারাপ লাগছিল। তাহলে আমি কাকে দেখলাম? দেখুন মশাই, আমার এখনও ভীমরতি ধরেনি মৃন্ময়ের মতো।’
লগ্নজিতা বলল, ‘শুনলাম শিবনাথবাবু নাকি ব্রজমোহনের কাছে মোটা টাকা ধার নিয়েছিলেন, এখন আর শোধ করতে পারছেন না। এটা কি সত্যি?’
বাসুদেববাবু বললেন, ‘শিবনাথ কবে কার টাকা শোধ দিয়েছে আমায় একটু বলুন দেখি? সবাইকেই তো ‘আজ দেব, কাল দেব’ বলে বিন্দাস চলছে ও। যারা ওকে ধার দেয় তারাও ফেরতের আশা ছেড়ে দিয়েই ধার দেয় বোধহয়। আমিও পাই ওর কাছে হাজার চল্লিশেক মতো। দু-বছর আগে নিয়েছিল ছোট মেয়ের বিয়ে দেবে বলে। এখন সেই মেয়ের বাচ্চা হয়ে গেছে, আমার টাকা পাইনি। এ চত্বরের সবাই জানে সে কথা। ব্রজমোহন জেনেও দিয়েছিল ওকে টাকা ধার এটাই তো অবাক লাগছে। এ খবর অবশ্য আমার কাছে ছিল না। আপনি পেলেন কোথায়?’
লগ্নজিতা বলল, ‘ব্রজমোহনবাবুর ডায়েরি মেইনটেইন করা স্বভাব ছিল। কার কাছে কত ধার, কার কাছে কী পেতেন সব নোট করতেন। সেখানেই দেখলাম উনি মারা যাবার মাত্র দিন দশ আগে শিবনাথবাবুকে প্রায় দু-লাখ টাকা ধার দিয়েছিলেন। কোনো পারপাস লেখা নেই অবশ্য।’
বাসুবাবু বললেন, ‘এই টাকার হদিস আমি জানতাম না। তবে মনে হয় আবার শিবনাথের জামাই টাকা চেয়েছে। কুলাঙ্গার জামাই কী যে ব্যবসা করে কে জানে! রোজই শ্বশুরের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা চায়। শিবনাথ রিটায়ার করার পরে যা জমিয়েছিল, তা সব গেছে এই জামাইয়ের জন্য। বড় মেয়ের জামাই ভালো। কিন্তু ছোটটি একেবারে জিনিস।’
লগ্নজিতা বলল, ‘ব্রজমোহন যেদিন মারা যান, তার আগের দিন সন্ধেবেলায় আপনি কেন গিয়েছিলেন ওঁর বাড়িতে সেটা যদি একটু স্পষ্ট করে বলেন!’
বাসুদেববাবু যে রীতিমতো বিরক্ত হচ্ছেন এসব প্রশ্নে, সেটা উনি বুঝিয়েই দিচ্ছেন শারীরিক অঙ্গভঙ্গিতে। এখনও যেমন চোখ কুঁচকে বললেন, ‘ওই তো খুন করতে গিয়েছিলাম। সন্ধেতে খুন করে এলাম। গোটা বাড়ির লোক ঘুমাচ্ছিল সন্ধে সাতটায়। ভোর অবধি সব ঘুমিয়ে উঠে আবিষ্কার করল ব্রজর মৃতদেহ। চলবে অফিসার এই গল্পটা?’
লগ্নজিতা বুঝল, বাসুবাবুর মুখ থেকে কথা বের করা মুশকিল। ভদ্রলোক বড্ড মুডি। হাইপার হয়ে যান একটুতেই। লগ্নজিতা শান্ত গলায় বলল, ‘আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন। আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাইছি। তাতে আমার তদন্তের সুবিধা হবে।’
ঢকঢক করে এক বোতল জল খেয়ে বাসুবাবু বললেন, ‘আমি নিজে যাইনি ওর বাড়িতে। ওই ফোন করে ডেকেছিল আমায়। বলেছিল, এতদিনের পরিশ্রম সফল হল। সত্যিই গুপ্তধনের সন্ধান পেলাম। এসো পড়ে শোনাবো সবটা, গায়ে কাঁটা দেবে। তুমি এসব বিষয় ভালো বুঝবে। আর তোমার কাছে থাকা প্রাচীন মিশরের রেয়ার ম্যাপটা সঙ্গে নিয়ে এসো। আমি গিয়েছিলাম। এটা ওটা কথার পরে ব্রজমোহন আসল বিষয়টি বলতে শুরু করার আগেই ওর কাছে একটা ফোন এলো। ও উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল— আগামীকাল কেন, আজই আসুন। ব্রজমোহন খুবই উত্তেজিত ছিল। আমি বললাম—কী দেখাবে দেখাও। ব্রজমোহন নির্বিকারভাবে বলল, কিছুই দেখানোর নেই। দুটো কয়েনের দাম জানতে চাইছিলাম। বলে দুটো পুরোনো পয়সা ফেলে দিয়ে বলল, বলো তো কোন রাজার আমলের? অদ্ভুত লেগেছিল ওর ব্যবহার। বুঝতে পেরেছিলাম ও আসল জিনিসটা বলতে চাইছে না আমার কাছে। তাই একটু রেগে গিয়েই বলেছিলাম, ভিখারি পেয়েছ নাকি, যে বাড়িতে ডেকে অপমান করছ? ফিরে এসেছিলাম রাগ করে। এর বেশি আমি কিছু জানি না।’
লগ্নজিতা বলল, ‘আচ্ছা বাসুদেববাবু, এই রেয়ার কয়েন বা মিশরীয় দুষ্প্রাপ্য মূর্তির কথা আপনাদের দলে আর কে কে জানতো?’
বাসুবাবু একটু ভেবে বললেন, ‘জানতো তো সবাই। আমরা যখন ওর বাড়িতে গেছি সকলের সামনেই ও দেখিয়েছে এসব। কিন্তু এসব জিনিস বোঝার জাত এদলের কারোর নেই। শিবনাথ শুধু এর দাম কত হবে বর্তমানে এটুকু জেনেই খুশি থাকত। অমিত তো সেভাবে দেখার প্রয়োজন অনুভব করত না। আর মৃন্ময় বলত, রাহুলকে বুঝিয়ে দিও এসব জিনিসের মর্ম। ও যেন টাকার লোভে বংশের গরিমা বিক্রি করে না দেয়। এসব অমূল্য সম্পদ। স্ফটিকের একটা পানদানি আছে ব্রজর কাছে। আমি ওটা কিনতে চেয়েছিলাম। প্রচুর দামও দিয়েছিলাম, ও দেয়নি। ওর এসব জিনিসের প্রতি ভীষণ টান ছিল। আমাদের দলের কেউ অত বুঝত না। বর্ণালী ম্যাডাম আর মধুমিতা ম্যাডাম তো এসব দেখতেও চাইত না সেভাবে। ব্রজই জোর করে দেখাতে চাইত।’
লগ্নজিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি প্রয়োজনে আপনার হেল্প পাবো নিশ্চয়ই? আপনিও নিশ্চয়ই চান বন্ধুর খুনি ধরা পড়ুক।’
বাসুদেববাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘খুনি ওদের ঘরে আছে ম্যাডাম। নিশ্চয়ই চাই সে ধরা পড়ুক। আমার দিক থেকে সবরকমের হেল্প পাবেন।’
লগ্নজিতা বেরিয়ে এলো। এ পাড়ায় যখন এসেছে, তখন শিবনাথবাবুর বাড়িটা ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধে সাড়ে ছটা বাজে। সন্ধে ছটার পরে কারোর বাড়িতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতেই রাহুলের ফোন। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, মন্টু মার্ডার হয়েছে।’
চমকে উঠেছে লগ্নজিতা। মন্টুকে পাওয়া যাচ্ছে না অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু মার্ডার? রাহুলের গলা আতঙ্কে কাঁপছে। লগ্নজিতা ড্রাইভারকে বলল, ‘ব্রজধাম চলো।’
ব্রজধামের গেটের সামনে ভর সন্ধেবেলা মন্টুর বডিটা পড়ে আছে। রাস্তার ওপর ব্রজধাম। এখানে মন্টুকে খুন করলে সবাই জানতে পারত। তার মানে কেউ মেরে এখানে ফেলে দিয়ে গেছে। লগ্নজিতা থানায় ফোন করল। পোস্টমর্টেমে পাঠাতে হবে বডি। গলায় ফাঁসের দাগ। ব্রজমোহন আর মন্টুর খুনি একজনই হবে। মাথার পিছনে সজোরে আঘাত তারপর গলায় ফাঁস। খুনি মারাত্মক সাবধানী। একবার মাথার পিছনে মারলে যদি মৃত্যু নিশ্চিন্ত না হয় তাই শ্বাসরোধ করেছে। খুনি বিচক্ষণ, সাবধানী, ঠান্ডা মাথার অপরাধী। খুনের পদ্ধতি বলে দিচ্ছে, মন্টু আর ব্রজমোহনবাবুর খুন একই মানুষ করেছে। মন্টুর ছবিতে চেহারাটা বেশ গোলগাল ছিল। মৃতদেহের মুখে চোখে কালসিটে রয়েছে। তার মানে মারধর করা হয়েছিল। মন্টুই ছিল ব্রজমোহন খুনের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। তাই হয়তো মন্টুকে মেরে ফেলতেই হত খুনিকে। লগ্নজিতা দেখল রাহুল ছটফট করছে। গতকালই বোধহয় ওর বাবার শ্রাদ্ধ মিটিয়েছে। আজই মন্টুর মৃত্যু। রাহুলের কাছে এগিয়ে গিয়ে লগ্নজিতা বলল, ‘কখন দেখলেন?’
রাহুল অস্থিরভাবে বলল, ‘অফিস গিয়েছিলাম আজ। অফিস থেকে ফেরার সময় দূর থেকেই দেখতে পেলাম একটা বাইক প্রচণ্ড স্পিডে ছুটে আসছে। আচমকা আমাদের বাড়ির সামনে বস্তাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল। বস্তার মুখ আলগা হয়ে গিয়েছিল, ওখান দিয়েই দুটো পা দেখা গেল। লোকজন জড়ো হল। সবাই মিলে খুলে দেখা গেল মন্টু। এটা আমি ভাবতে পারছি না ম্যাডাম। মন্টুকে কেউ কেন খুন করবে! ছেলেটার তো তিনকুলে কেউ নেই। কারোর কোনো ক্ষতি করেনি কোনোদিন। টাকা-পয়সা বলতে এ বাড়ি থেকে যা মাইনে পেতো সেটাই জমিয়ে দিত বাবা ওর নামে।’
লগ্নজিতা বলল, ‘মন্টুই ছিল আপনার বাবার মৃত্যুর একমাত্র সাক্ষী। তাই ওকে এভাবে সরিয়ে দেওয়া হল।’
রাহুল মাথার দু-পাশটা চেপে ধরে বসে পড়ল। সরলাদেবী বারান্দার এক কোণে চুপ করে বসে আছে। ভাবলেশহীন মুখ। দেখে বোঝার উপায় নেই মনে কী চলছে।
ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের অফিসার এসে গেছে। মন্টুর বডি নিয়ে যাওয়া হবে। হঠাৎই লগ্নজিতা মন্টুর জামার পকেট থেকে কিছু একটা বের করে নিল সবার অলক্ষ্যে।
লগ্নজিতা আরেকটু ভালো করে বডিটা দেখে রাহুলের সঙ্গে ওর বাড়িতে ঢুকেই বলল, ‘আমায় মন্টুর ঘরে নিয়ে চলুন।’
ঘরে অতি সামান্য কিছু জিনিসপত্র। একটা আলমারি রয়েছে ঘরে। আলমারিটা চাবিবিহীন। হয়ত মূল্যবান কিছু নেই চাবি দেওয়ার মতো। লগ্নজিতা আলমারিটা খুলে দেখল বেশ কয়েক সেট পোশাক, সোয়েটার, একটা দামি ঘড়ি আর চক্রবর্তী বাড়ির একটা ফ্যামিলি ছবি। সেখানে সুন্দর পাঞ্জাবি পরে মন্টুও উপস্থিত। ছবিটা ফ্রেমে বাঁধানো। আলমারির মোটামুটি সবই অতি সাধারণ জিনিস, যেগুলো মন্টুর কাছে থাকার মতোই। শুধু বেমানান একটা ঘড়ি। বেশ দামি ব্র্যান্ডের।
ঘড়িটা রাহুলকে দেখিয়ে লগ্নজিতা বলল, ‘এটা কি আপনার বাবা মন্টুকে দিয়েছিল কখনও?’
রাহুল একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, ‘না। এটা মন্টুর নয়। ও ডিজিটাল ঘড়ি পরতো। আমিও ওকে একটা ডিজিটাল ঘড়ি দিয়েছিলাম। ইনফ্যাক্ট, এই ঘড়িটা আমি বাবার হাতেও কখনও দেখিনি। মন্টুর আলমারিতে ঘড়িটা এলো কী করে? তাছাড়া ঘড়ির একটা লক ভেঙে গেছে তো।’
লগ্নজিতা বলল,’এটা আমার কাছে থাকল।’
রাহুল ঘাড় নেড়ে বিধ্বস্ত গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, আপনারা যদি মন্টুর হারিয়ে যাওয়াটা সিরিয়াসলি নিতেন, তাহলে ও খুন হয়ে যেত না হয়তো। এভাবে একটা নিরপরাধ ছেলের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না ম্যাডাম।’
লগ্নজিতা বলল, ‘দেখুন, প্রচুর ট্রেস করার চেষ্টা করা হয়েছে মন্টুকে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
ব্রজধামের বাইরের গেটে আজও আলোটা জ্বলছে। কিন্তু ভিতরটা বেশ অন্ধকার। বারান্দায় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন সরলাদেবী। লগ্নজিতার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন, কান অবধি পৌঁছালো না অবশ্য। হয়তো আবারও বললেন, পুলিশ না ডাকলে এটা হতো না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন