প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গীরা

অর্পিতা সরকার

—মৃন্ময় আজও এলো না ওয়াকে? শরীর খারাপ হল নাকি?

বাসুদেব রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে বললেন, ‘আসার পথে মৃন্ময়ের বাড়ি ঘুরেই এলাম। শরীর খারাপ নয়, মনখারাপে ভুগছে। আসলে কি জানো শিবনাথ, ব্রজমোহন এভাবে চলে যাবে বুঝতে পারেনি মৃন্ময়। তাই আগেরদিনের ঝগড়াটা নিয়ে বিষণ্ণ হয়ে আছে।’

অমিতবাবু বললেন, ‘ওদের ঝগড়াটা হয়েছিল কী নিয়ে? আমি তো ঠিক বুঝতেও পারলাম না। রিটায়ার করার পরে বোধহয় আমার বোধবুদ্ধি একটু কমে যাচ্ছে। আর এখনও মাথায় ঢুকল না ব্রজমোহন হঠাৎ আচমকা আত্মহত্যা করতে কেন গেল? সরলার সঙ্গে বনিবনা তো ওর কোনোদিনই ছিল বলে মনে হয় না। অন্তত আমরা যে চারবছর দেখছি, তাতে বেশ বোঝা যায় সরলা আর ব্রজমোহনের সম্পর্কটা একটু হলেও প্যাঁচালো টাইপ। তাহলে এই সাতষট্টিতে আবার আত্মহননের পাপ নেওয়া কেন? এমনিতেই তো কে কবে যাব তার প্রতীক্ষায় আছি। ব্লাড সুগার, প্রেশার, কিডনি নিয়ে সবাই জেরবার।’

বর্ণালী আর মধুমিতা আলতো পায়ে ওদের দিকেই আসছিল। বাসুদেব বললেন, ‘অমিত, চুপ করে যাও। বর্ণালী আর মধুমিতা এদিকেই আসছে। শিবনাথের হাঁটার নতুন সঙ্গী।’

শিবনাথ হেসে বললেন, ‘সঙ্গী নয় সঙ্গিনী। দুজনেরই হাঁটার থেকে গল্পে বেশি মন। এক পা হাঁটে তো চারটে গল্প ফাঁদে। তাই আমি ওদের বলেই দিয়েছি—আমরা পার্কের দক্ষিণে বসে গল্পের আসর জমাই হাঁটা শেষ হলে। ওখানেই আসবেন। তবে দুজনেই বড় ভালো মনের।’

অমিত তখনও ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘ব্রজমোহনের ছেলেটা যেন কেমন টাইপের! বাবা মারা গেছে এমন আচমকা, শোক বলে কিছু নেই।’

বাসুদেব হেসে বললেন, ‘ব্রজমোহনের সম্পত্তি তো কিছু কম নেই। সবকিছুর ওয়ারিশ ওই রাহুল। তাই পিতৃশোক একটু কমই হবে ভাই।’

শিবনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ব্রজমোহনের মৃত্যুটা আমাকে বড্ড নাড়িয়ে দিয়ে গেল গো। ব্রজ সবসময় বইপত্রের জগতে ডুবে থাকত। নতুন নতুন ভাষা, নতুন হরফ শেখায় ওর বড্ড নেশা ছিল। ওর জগৎটাকে ও ভীষণ ভালোবাসতো। সেটা ওর কথাবার্তা শুনেই বোঝা যেত। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে একই বাড়িতে থাকলেও ওর ওই বইয়ের ঘরটি ছিল ব্রজর অক্সিজেন। এমন মানুষটা আত্মহত্যা করতে পারে, এ যেন অকল্পনীয়।’

বর্ণালী এইটুকু হাঁটার পরিশ্রমেই রীতিমতো হাঁপাচ্ছেন। বয়সটা নয় নয় করে তেষট্টি হল। ভাবতেই অবাক লাগে মাত্র তিনবছর আগে অবধি রোজ দশটায় স্কুলে গেছেন। হেডমিস্ট্রেসের কাজ সামলেছেন। ইদানীং যেন একটুতেই হাঁপিয়ে যান।

শিবনাথের কথার সুর ধরে বর্ণালী বললেন, ‘কিন্তু শিবনাথদা, আমি তো অন্য কথা শুনলাম। ওদের বাড়ির কাজের মেয়ে মীনাক্ষী বলছিল—পুলিশ সন্দেহ করেছে এটা খুন। ওইজন্যই তো পোস্টমর্টেমে গিয়েছিল বডি।’

বাসুদেব বললেন, ‘ঠিক সেটা নয়। অ্যাবনরম্যাল ডেথ হলেই পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে। খুন কি বলে দিয়েছে পুলিশ?’

বর্ণালী বললেন, ‘না সেটা ঠিক জানি না। তবে তিনটে বাড়ির পরেই তো আমার বাড়ি; আমার কর্তা বলছিল—তোমাদের প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গীর মৃত্যুর কারণে বাড়িতে আবার পুলিশ না আসে। ওই জিজ্ঞাসাবাদ করবে আরকি। আমি বললাম—আমার সঙ্গে ব্রজমোহনদার প্রাতঃভ্রমণে পরিচয় মাত্র বছরখানেক হবে। শিবনাথদা, বাসুদেবদা, অমিতদা, মৃন্ময়দা আর ব্রজমোহনদাকে তো আমরা পঞ্চপাণ্ডব বলতাম। তাই আমার বাড়িতে পুলিশ আসার আগে এদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে। কারণ এরা সবাই ব্রজমোহনদাকে বহুদিন ধরে চেনেন। কি ঠিক বলেছি না মধুমিতা?’

মধুমিতা আর বর্ণালী একই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। মধুমিতা বছরখানেক আগে রিটায়ার করেছে, আর বর্ণালী আরও আগে। তাই দুজনের বন্ধুত্ব বহুদিনের।

মধুমিতা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘একদম বর্ণালীদি। আমরা আর কদিন চিনি ব্রজদাকে? ওই ‘কেমন আছেন?’, ‘ভালো আছেন?’—এর বাইরে সেভাবে কথাই হয়েছে কবে? একই পাড়ায় বাড়ি, প্রতিবেশী এটুকুই।

 অমিত একটু স্ট্রেইটকাট কথা বলতে পছন্দ করেন। বিরক্তির সুরে বললেন, ‘এভাবে বলবেন না বর্ণালী। আমরা গুলিডান্ডার বন্ধু কেউই নই। সবাই রিটায়ার্ড পার্সন। শেষ বয়সে এসে শরীরচর্চা যখন প্রায়োরিটি পায় তখন ওয়াকে এসে পরিচিত হয়েছি একে অপরের সঙ্গে। যে নিজের সম্পর্কে যেটুকু বলেছে সেটুকুই চিনি। সকালের এই ঘণ্টাখানেক পার্কের বেঞ্চে গল্পের মাধ্যমে যেটুকু চেনা যায়। আর বক্তা সবসময় আত্মপক্ষ সমর্থন করেই কথা বলে, তাই একে অপরকে চেনার বিশাল সুযোগ কিছু ছিল না। আপনি ব্রজবাবুকে যতটা চেনেন আমরাও বেশি কিছু চিনি না।’

শিবনাথ সকালের আসরের উত্তপ্ত আবহাওয়াকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ধীর স্বরে বললেন, ‘আপনাদের সকলের কাছেই আমার একটা আর্জি আছে। ব্রজমোহনকে আমরা যত কম বা বেশিই চিনি না কেন, তার মৃত্যুর পাঁচদিন পরে এ আলোচনাটা বোধহয় শোভনীয় নয়। ব্রজ আমাদের সঙ্গী ছিল। তাই ব্রজর মৃত্যু যদি আত্মহত্যা না হয়ে খুন হয়, তাহলে আমরা সকলেই চাইব ব্রজর নির্মম মৃত্যুর বিচার হোক। খুনি ধরা পড়ুক। তাই পুলিশ এলে কেউ কারোর দিকে ঠেলে না দিয়ে যার যতটা সাধ্য পুলিশকে হেল্প করব। তাতে বোধহয় প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গীটির আত্মা শান্তি পাবে। বর্ণালী, ব্রজকে প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী বলতে আপনার নিশ্চয়ই আপত্তি নেই?’

শিবনাথের কথায় বর্ণালী কিছু বলার আগেই শিবনাথ আবারও বলল, ‘সেদিন আপনি ইনহেলার আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। আপনার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল একটু। ব্রজই তখন নিজের ইনহেলার আপনাকে দিয়ে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা করল। সরি! প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গীর পরিচয় দিল। মধুমিতার ক্ষেত্রেও তাই। পায়ের ব্যান্ড-এইড উঠে যাওয়ায় মধুমিতার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। ব্রজই ছুটে গিয়ে টোটো ডেকে সেদিন আপনাকে বাড়ি পাঠিয়েছিল। সুতরাং আমরা তাকে কতটা চিনির থেকে বেশি প্রয়োজন হল;—যদি সত্যিই ব্রজমোহন খুন হয়ে থাকে তাহলে যেন তার খুনি ধরা পড়ে।’

শিবনাথের কথায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি কয়েক মিনিটেই স্তব্ধ হল। প্রত্যেকের চোখেই পুরোনো স্মৃতির আনাগোনা। যেখানে ব্রজমোহন উপস্থিত ছিল।

অমিত বললেন,’ব্রজমোহন আত্মহত্যা করার মানুষ নয়। তৃষার মৃত্যুটা ওইভাবে মেনে নেওয়ার পরেও যে মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে লড়াই করে, সে এই বয়েসে এসে আত্মহত্যা করবে না।’

বাসুদেব ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সহমত। তাছাড়া আগেরদিনও আমরা ব্রজর সঙ্গে হেঁটেছি, গল্প করেছি, বিশুর দোকানে লিকার খেয়েছি। ওর মুখে কোথাও বিষাদের চিহ্ন ছিল না। বরং শিবনাথকে নিয়ে মজা করল, শিবনাথের জন্মদিনে কেক স্পনসর করবে ব্রজ নিজে—এমনও বলল। তাই আমি অন্তত বিশ্বাস করি না ব্রজমোহন আত্মহত্যা করেছে।’

বর্ণালী আর মধুমিতা একটু হলেও লজ্জিত স্বরে বললেন, ‘সরলাবৌদির সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বা রাহুলের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে এমন তো শুনলাম না পাড়ায়। দেখা যাক আসল সত্যি কী! তবে সত্যিই আমরা একটা ভালো মানুষকে হারালাম।’

শিবনাথ বললেন, ‘শুধু ভালোমানুষ নয়, একজন বিদ্যান,পরোপকারী মানুষকে হারালাম।’

টুকটুক পায়ে যে যার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

অমিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সত্যি! জীবিত আর মৃতের মধ্যে সময়ের ব্যবধানটা বড্ড আকস্মিক।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন