রাহুলের সেই ফোনটা

অর্পিতা সরকার

ইউসুফের ফোনটা রিসিভ করতেই ইউসুফ বলল, ‘ম্যাডাম আপনাকে অনেকক্ষণ ধরেই চেষ্টা করছি। একটা খবর আছে। চন্দ্রজা আজ মৃন্ময়কে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। রাহুল ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। এদিকে ওদের এই প্রাতঃভ্রমণের দলের তিনজনও গিয়েছিল দেখতে। ফেরার পথে বলাবলি করছিল, রাহুলের সঙ্গে চন্দ্রজার বিয়েটা কিছুতেই হতে দেবে না সরলাবৌদি। এটা বোধহয় মৃন্ময় আগেই বুঝে গেছিল। তাই সেদিন বলেছিল, ব্রজধামের সম্পত্তিতে অভিশাপ আছে। ও বোধহয় কেউই ভালো করে ভোগ করতে পারে না। আমি চাই না চন্দ্রজা ও বাড়িতে যাক। এসব নিয়ে আলোচনা চলছিল। রাহুল ফোনে বারবার চন্দ্রজার কাছে ক্ষমা চাইছিল। চন্দ্রজা কোনো কথা বলছিল না। শুধু বলল, তোমার মা সঠিক রাহুল। আমি মিথ্যে ছিলাম, আছি, থাকতে চাই।

আর মন্টুর ফোনে একটা আননোন নম্বরের কল আছে যেদিন ও বেপাত্তা হল সেদিন। আর বাকি সরলাদেবী, রাহুল, ব্রজমোহনবাবু, ওর পরিচিত দু-একটা দোকানদারের নম্বর সেভ করাই ছিল। ফোনটা ঘেঁটে ফেলেছি। আর কিছু নেই কল রেকর্ডে। ওই নম্বরটা কার এখনও ট্রেস করতে পারিনি। যতবার কল করছি সুইচড অফ বলছে।’ লগ্নজিতা বলল, ‘সিমটা কোথাকার আর কার নামে নেওয়া খুঁজে পেয়েছ?’ ইউসুফ বলল, ‘ওটা আজ সন্ধেতে জেনে যাব। খুঁজতে বলেছি একজনকে।’

লগ্নজিতা বলল, ‘নম্বরটা আমায় সেন্ড করো তো।’

নম্বরটা ঢুকতেই চমকে গেল লগ্নজিতা। এই অদ্ভুত নম্বরটা কোথায় যেন দেখেছে ও। একটা দশ ডিজিটের নম্বরে ছয়টি ২ দেখা যায় না। একেবারে ছয়খানা দুই দিয়ে রীতিমত জোর সংখ্যা হয়ে বসে আছে যেন নম্বরটা।

কোথায় দেখেছে ভাবছিল লগ্নজিতা। তার মধ্যেই রাহুলের ফোনটা ঢুকল। বেশ উত্তেজিত গলায় রাহুল বলল, ‘ম্যাডাম আমি দুঃখিত। আপনাকে অন্য পথে চালিত করার জন্য মিথ্যে বলে। আপনি আমাকে সে জন্য সব রকমের শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু খুনি এই ব্রজধামেই রয়েছে বহালতবিয়তে। আরও কয়েকটা খুন করার অপেক্ষায়।’ স্বরটা বুজে আসছে রাহুলের। অনেক কষ্টে রাহুল বলল, ‘ম্যাডাম প্লিজ অ্যারেস্ট হার। সরলা চক্রবর্তীই খুন করেছে আমার বাবাকে, মন্টুকে, তারপর খুন করতে চেয়েছিল চন্দ্রজাকে। চন্দ্রাকে আমি কোনোমতে বাঁচাতে পেরেছি। খুনের পদ্ধিতি সেই একই, শ্বাসরোধ করে মৃত্যু।

অফিসার, আমি মাকে আড়াল করার জন্যই সত্যিটা বলতে চাইনি। আমার মা একজন ভয়ঙ্কর মানসিক রোগী। সঙ্গে দুর্দান্ত অভিনেত্রী। মায়ের চোখের নকল জলটাও সকলে আসল ভাবতে বাধ্য।’ রাহুলের গলাটা তিরতির করে কাঁপছে। লগ্নজিতা বলল, ‘আপনি একটা কাজ করুন রাহুল। এ কদিন একটু সরলাদেবীকে চোখে চোখে রাখুন। আমি আগামীকালই কলকাতা ফিরছি। তারপর যাচ্ছি ব্রজধামে।’ রাহুল বলল, ‘ম্যাডাম আপনি শান্তিনিকেতন গেছেন তাই না? মায়ের প্রেসক্রিপশনে মেঘবালাআন্টির নাম দেখে।’ লগ্নজিতা বলল, ‘আপনি ওনাকে চেনেন নাকি? বললেন, আপনাদের কোনো রিলেটিভ বা বাবার বন্ধু হবেন।’ রাহুল একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘চিনি ম্যাডাম। আমি দু-একবার মায়ের জন্য ওষুধ আনতে গিয়েছিলাম। মায়ের কাকুর মেয়ে। যদিও এদের সঙ্গে মায়ের যোগাযোগ ছিল না। মা একেবারেই পছন্দ করে না মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মা বলে, মেঘা তোর বাবাকে কেড়ে নেবে দেখিস। সেটা অবশ্য মায়ের মানসিক সমস্যা। তবে বাবা মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পছন্দ করত বলেই মনে হয়।’

লগ্নজিতা বলল, ‘রাহুল মেঘবালা আপনাকে কিছু জানিয়েছিল, যে ওর কাছে এমন কিছু গচ্ছিত আছে যেটা ও আপনাকে ফেরত দিতে চায়?’ রাহুল একটু ভেবে বলল, ‘না এমন কিছু তো আমায় বলেননি উনি। আমি বাবা মারা যাবার খবরটা দিয়েছিলাম। তখন উনি বলেছিলেন, আমি তো ভেবেছিলাম ব্রজদার ডিপ্রেশনটা কেটে গেছে বোধহয়। সুইসাইড করবে এমন তো কখনও মনে হয়নি ইদানীং কালে। আমি বলেছিলাম, মে বি এটা মার্ডারও হতে পারে। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, রিন্তিদি এখন আর ওষুধ খাচ্ছে না? শেষপর্যন্ত এমন একটা অঘটন ঘটিয়েই ফেলল ও! এর বাইরে আর তো কোনো কথা হয়নি আমার সঙ্গে। মা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করেছিল মাঝে একদিন ফোন করে। আর রাতের দিকে ঘুমের ওষুধ দিতে বলেছিল মাকে হালকা ডোজের। নাহলে নাকি মায়ের মাথায় আরও খুনের নেশা চাপবে। এরপর আর কথা হয়নি ম্যাম ওনার সঙ্গে। আর বাবা যদি ওনাকে বন্ধু ভেবে কিছু দিয়ে যায় সেটা আমি তার সন্তান হিসাবে ফেরত নেবই বা কেন?’

লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘আপনাদের সব এত আত্মসম্মান, কেউ কারোর জিনিস ছুঁয়েও দেখবেন না বলছেন, অথচ মাত্র দিন তিনেক আগেই বাবার আর আপনার জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় লাখ ছয়েক টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করার প্রয়োজন হলো কেন মিস্টার রাহুল? ওটা তো ব্রজমোহন চক্রবর্তী আর রাহুল চক্রবর্তীর জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল। ব্যাংকে আরেকটা অ্যাপ্লিকেশনও জমা পড়েছে, অ্যাকাউন্টটা সরলা চক্রবর্তী আর রাহুল চক্রবর্তীর নামে জয়েন্ট করার জন্য।

এই অবধি ঠিক আছে, কিন্তু যেদিন অ্যাপ্লিকেশন জমা দিলেন তার আগের দিন লাখ ছয়েক টাকা ট্রান্সফার হয়েছে এই অ্যাকাউন্ট থেকে। সেটা ঢুকেছে আপনার স্যালারি অ্যাকাউন্টে নয়, অন্য একটা অ্যাকাউন্টে। এত তাড়াহুড়োয় কিছু ছিল রাহুল?’

রাহুল বেশ ঘাবরেছে। ভাবতেও পারেনি পুলিশ ওদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ওপরে নজর রেখেছে। মায়ের সঙ্গে জয়েন্ট হওয়ার আগেই টাকাটা সরাতে চেয়েছিল ও। কারণ বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী ওপরের ঘরে ওদের বংশের সকলের পোট্রেট দিয়ে সাজাবে। যথেষ্ট খরচ সাধ্য হবে বিষয়টা। মা যদি করতে না দেয় তাই আগেই সরিয়ে নিয়েছে।

রাহুল বলল, ‘ম্যাম এটা তো আমার পার্শনাল ব্যাপার। তাছাড়া বাবার টাকা, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট প্রয়োজনে তুলতে অসুবিধা কোথায়?’ লগ্নজিতা বলল, এটাই বলতে চাইছি, বাবার জিনিস কোথাও গচ্ছিত থাকলে নেবেন না বলে যে প্রতিজ্ঞা করছেন সেটা না করাই ভালো। কারণ শিবনাথবাবুর কাছে আপনার বাবার ধার দেওয়া টাকাটা শোধ করার জন্য ইতিমধ্যেই আপনি বার তিনেক কল করেছিলেন। তাই লোভ, আসক্তি নেই এমন প্রমাণ করার চেষ্টা পুলিশের সামনে করবেন না।

আপনার বাবার খুনের সমাধান করতে নেমেছি মশাই, সরকার আমায় মাইনে দেয়, আপনার কাছ থেকে একপয়সাও দাবি করিনি। শুধু বলেছিলাম, সঠিক তথ্যগুলো অন্তত দেবেন। সেখানেও দেখি সবই লুকিয়ে রেখেছেন। এনিওয়ে, আমি যে কাজটা হাতে নিই তার নিষ্পত্তি করেই ছাড়ি।’

রাহুল চুপ করে রইল। লগ্নজিতা বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিল। পুরো রোমিও ছেলে একেবারে। এতদিন পর্যন্ত বাবার খুন নিয়ে কোনো উদ্বেগ ছিল না। সব তথ্য লুকিয়ে চলেছিলেন। যেমনি প্রেমিকাকে ওনার মা খুন করতে গেলেন, তখন জেগে উঠল প্রেমিক হৃদয়। তার আগে অবধি মৃন্ময়কাকু খুন করল নাকি বলতেও মুখে আটকায়নি। অদ্ভুত সব চরিত্র!

বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল লগ্নজিতার। থানায় যেতে হবে একবার। ইন্দ্রজিতের পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা আজ এসে যাওয়ার কথা। ওটার সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হবে।

একটু অন্যমনস্কভাবেই হাঁটছিল লগ্নজিতা। হঠাৎই দেখল, কৃষ্ণা হন্তদন্ত হয়ে ওদের বাংলোর দিকেই হাঁটছে।

হাতে একটা ঝোলা ব্যাগ। লগ্নজিতা ওকে দেখেই বলল, ‘চললে কোথায় কৃষ্ণা?’ কৃষ্ণা হেসে বলল, ‘ঘরের পথে যাচ্ছি রে।’

বাংলোয় ঢুকে দেখল, কৌশিক চুপচাপ খাবার টেবিলে বসে আছে মুখ হাঁড়ি করে। লগ্নজিতা সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। খিদেও পেয়েছে খুব।

খাবার টেবিলে বসেই লগ্নজিতা বলল, ‘খেয়ে উঠেই কলকাতা রওনা দেব কৌশিক। তাড়াতাড়ি করো।’ কৌশিক অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু কেন? আজ তো আমাদের এখানে থাকার কথা ছিল। আগামীকাল ফেরার কথা ছিল। এখন বিকেলে ফিরব কেন? তোমার হাতে ওই ব্যাগটা কিসের?’

লগ্নজিতা মটন দিয়ে ভাতটা মাখতেই রিং বেজে উঠল।

‘বলো মামা, এই জাস্ট খেতে বসলাম। মাংসটা তো দেখেই মনে হচ্ছে তোমার মহাদেব মারাত্মক রেঁধেছে।’

মামা বলল, ‘আমি সুশীল বলে একটা ছেলেকে ফোন করে দিয়েছি বুঝেছিস। ও এসে বিকেলবেলা তোদের টোটোতে করে নিয়ে যাবে। ওসব গ্রামে গাড়ি ঢোকে না। শান্তিনিকেতনের আসল ফ্লেভার নিয়ে আয়। দেখবি বাউলের আখড়া কেমন হয়। আমি কত রাত কাটিয়ে দিয়েছি এককালে ওখানে। এখন আর একেবারেই যাওয়া হয় না। এত দেরি করে খাচ্ছিস কেন?’ লগ্নজিতা বলল, ‘তোমার ওই ব্রজমোহনের প্রেমিকার প্রেম পর্ব শুনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল বুঝলে?’ বিমানমামা হেসে বলল, ‘প্রেম কি দু তরফেরই ছিল? নাকি মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একতরফা ভালোবাসত ব্রজমোহন, কী বুঝলি? যদি না বুঝে থাকিস, তো আমার বাড়িতে একদিন আয়, আমি ওদের প্রেমপর্বের গল্প শোনাবো তোকে। এত কথা তো ফোনে হয় না। তাছাড়া আমার ভাগ্নি নিজের বুদ্ধিতে কতটা এগোলো দেখি আগে, তারপর তো আমি রইলামই সব রকম হেল্পের জন্য। তোরা তো ছোটবেলায় আমার নাম দিয়েছিলিস সিধু জ্যাঠা। এনিওয়ে, আমাদের জামাইয়ের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো ওখানে? লগ্নজিতা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না কৌশিক বিন্দাস আছে। ও আমার ভাল বন্ধু। তোমার দিদি তোমাকে যাই বোঝাক তুমি বুঝে যেও না।’

নরম মাংসের পিসটা মুখে ঢুকিয়েই লগ্নজিতা বলল, ‘বেশ তোমার বাউলের আখড়া দেখেই তবে ফিরব।’

কৌশিক অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে জিতার দিকে।

ফোনটা রেখেই লগ্নজিতা বলল, ‘আজ প্রথম দেখছ নাকি আমায়? অমন হাঁ করে তাকিয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি খেয়ে প্যাকিং সেরে নাও। আমরা কলকাতা ফিরব আজ রাতেই।’ কৌশিক বলল, ‘তবে যে মামাকে বললে বাউলের আখড়া দেখতে যাবে? তোমার প্রবলেমটা ঠিক কী হচ্ছে একটু কি বুঝিয়ে বলা যায়?’

লগ্নজিতা বলল, ‘রাহুল কল করেছিল কৌশিক। সরলাদেবী আবারও চন্দ্রজাকে গলা টিপে মেরে দিতে চেয়েছিল। রাহুল চায় ওর মাকে আমরা অ্যা রেস্ট করি।

রাহুলের কথা মত ব্রজমোহন আর মন্টুর খুনি সরলাদেবীই।’ কৌশিক বলল, ‘তাহলে ওই পুলিশ অফিসার ইন্দ্রজিৎকে কে খুন করল? সরলাদেবীর ভাড়া করা লোক? নাকি মেঘবালা আর সরলাদেবীর কোনো ঝগড়াই নেই। দুজনেই ব্রজমোহনের সম্পত্তি হাতানোর জন্য এগুলো করল। ইন্দ্রজিৎকে সোনাঝুরিতে লোক দিয়ে খুন করাতে মেঘবালার দশমিনিট লাগবে।’

লগ্নজিতা হাত ধুতে ধুতে বলল, ‘তাহলে তুমি বলতে চাও ডাক্তার মানেই সে সরল হয় না? মনের ডাক্তারের চোখ দেখে একটু আগেই তোমার যে উপলব্ধি হয়েছিল সেটা কি তবে ভুল কৌশিক?’

কৌশিক বলল, ‘তুমি কি পজেসিভ আমায় নিয়ে বাই এনিচান্স? লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘কষ্ট কল্পনা করার একটা লিমিট আছে তো নাকি? উনি তোমার মায়ের বয়সী হবেন।’

কৌশিক বলল, ‘তার মানে বয়েস কম হলে তুমি পজেসিভ হতে বলছো?’ লগ্নজিতা বলল, ‘রেডি হও তাড়াতাড়ি। টাইমের ব্যাপারে আমি কিন্তু মারাত্মক পজেসিভ। দেরি করো না।’ কৌশিক ধুত্তোর বলে ওপরে উঠে গেল প্যাকিং করতে।

লগ্নজিতা গুছিয়ে নিয়েই ড্রাইভারকে ফোন করল। বলল, ‘গাড়ি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াও তুমি। বাংলোর সামনে আসার দরকার নেই।’

গাড়িতে উঠেই লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক সিকিউরিটির কাছে মামার বাংলোর চাবিটা রেখে দিয়ে এলাম। বললাম, মহাদেব ঢুকলেই দিয়ে দিতে।’

কৌশিক বলল, ‘হ্যাঁ মহাদেব তো সন্ধের টিফিন করতে ছটা নাগাদ আসবেই বাংলোতে। তখন চাবিটা নিয়ে নেবে। আমি বেরোনোর আগে বাথরুম থেকে ছাদ সবের লাইট বন্ধ কিনা চেক করে নিয়েছি।’ লগ্নজিতা বলল, ‘আমরা কটা নাগাদ পৌঁছাব গো কলকাতা মোটামুটি?’ কৌশিক বলল, ‘রাস্তায় জ্যাম না থাকলে সাড়ে তিনঘণ্টা। জ্যাম থাকলে জানা নেই।’

ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা পিপপিপ আওয়াজ আসছিল। এতক্ষণ খেয়াল করেনি লগ্নজিতা। কৌশিক বলল, ‘পিপ পিপ আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে?’

লগ্নজিতা নিজের সাইড ব্যাগটার সামনের চেনটা খুলে সুইচ টেপা মোবাইলটা বের করল। বলল, ‘এটার চার্জ শেষ হয়েছে। তাই জানান দিচ্ছে।’ কৌশিক বলল, ‘কিন্তু আমাদের কাছে তো সব সি টাইপ চার্জার। এটার চার্জার পাবো কোথায়?’ হঠাৎই ড্রাইভার ছেলেটি বলল, ‘আমার কাছে ওই ফোন একটা আছে ম্যাডাম। চার্জারও আছে, দেব?’ কৌশিক বলল, ‘নিশ্চয়ই।’

ইদানীং গাড়িতেই একটা সুবিধা হয়েছে। চার্জ দেওয়া হয়ে যায়। চার্জে বসাতে গিয়েই লগ্নজিতা বলল, ‘ইউরেকা! এই নম্বরটাই আমায় সেদিন বলল ইউসুফ। মন্টুর রুম থেকে যে ফোনটা পেয়েছিলাম ওতে এই ছয়টা ২ ওয়ালা নম্বরটা ছিল। আবার ইন্দ্রজিতের ফোনেও একই নম্বর। এটা কার নম্বর এটাই খুঁজতে হবে কৌশিক।’

ইউসুফকে ফোনটা করতেই ওদিকে উত্তেজিত গলায় ইউসুফ বলল, ‘ম্যাডাম ওই নম্বরটা ট্রেস করা গেছে। একজন মহিলার নামে সিমটা। তবে এই নম্বর থেকে রিসেন্ট ফোন গেছে এই দুটো নম্বরের। সিমটা রিচার্জ করা হয়েছে সময়মতো। কিন্তু ইউজ করা হয়নি প্রায় বছর তিনেক।’ লগ্নজিতা বলল, ‘হোয়াটসআপে যার নামে সিম আর কবে কবে কখন কোন নম্বরে ফোন করা হয়েছে তার ডিটেলস পাঠাও।’

ইউসুফের মেসেজটা দেখে একটু থমকে গেল লগ্নজিতা। থানায় ফোন করে বলল, ‘বিকাশ দুজন করে কনস্টেবল পাঠাও ব্রজমোহন চক্রবর্তীর বাড়িতে আর মৃন্ময়বাবুর বাড়িতে পাহারা দেবার জন্য। গেটের ভিতরে আমার পারমিশন ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেবে না।’

কৌশিক উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘হঠাৎ হলটা কী তোমার? আমায় কি বলবে?’ লগ্নজিতা বলল, ‘ওয়েট। এখন সময় নেই প্লিজ।’

পরের ফোনটা করল বাবাকে। ‘বাবা আমি বলছি, তোমরা একটা কাজ করো তো, বাই কার আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো এখুনি।’ বাবা অবাক হয়ে গিয়ে বলল, ‘কেন জিতা? কোনো প্রবলেম? তুই ঠিক আছিস?’

‘আমি একদম ঠিক আছি। তুমি এখুনি বেরিয়ে পড়। কৌশিক তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে আজকেই।’ বাবার গলায় হাসি। ‘বেশ বেশ, আমরা এমনিও রেডি আছি বুঝলি। তোর মা ‘প্রজাপতি’ দেখতে যাবে বলে বায়না ধরেছিল। এই দেখতে যাব বলে রেডি হয়েছি।

বেরিয়ে পড়ছি তাহলে।’

‘হ্যালো, চন্দ্রজা, আমি ইন্সপেক্টর লগ্নজিতা বলছি। আপনি এবং আপনার বাবা বাড়ির বাইরে বেরোবেন না কয়েকঘণ্টা। আমি দুজন গার্ডকে পাঠিয়েছি।’ চন্দ্রজা বলল, ‘কেন অফিসার আপনার বুঝি আমাদেরই খুনি বলে মনে হল শেষপর্যন্ত? তাই নজরবন্দি করতে চাইছেন?’ লগ্নজিতা বলল, ‘ধরুন তাই। এটা পুলিশের নির্দেশ। ভাঙার চেষ্টা না করাই ভালো।’ চন্দ্রজা বলল, ‘আমি অফিসে আছি ম্যাম। আপনার নির্দেশ মত বাড়ি ফিরে যাচ্ছি তবে।’

কৌশিক অপলক তাকিয়ে দেখছে উত্তেজিত লগ্নজিতাকে। ওর কপালের ভাঁজ বলছে ও ভীষণ রকমের দুশ্চিন্তায় আছে।

পরের ফোনটা কাকে করবে ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেল, ‘মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনি ইমিডিয়েট কলকাতায় চলে আসুন। এখন আর মান-অভিমান নয়। নিজে বাঁচতে চাইলে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করুন কাউকে কিছু না বলে।’

চোখটা বন্ধ করে বসেছিল লগ্নজিতা।

সুনীলের কল, ‘ম্যাডাম মৃন্ময়বাবু আর চন্দ্রজা ম্যাডাম দুজনেই বাড়িতে আছে। চন্দ্রজা ম্যাডাম অফিস থেকে ফিরে বাড়ির গেটে তালা লাগিয়ে দিলেন। আমরা গেটের বাইরে ওয়েট করছি।’

রাহুলের কল ঢুকছিল লগ্নজিতার ফোনে।

ম্যাডাম, ‘আপনি আমাদের বাড়ির গেটে পুলিশ বসিয়েছেন কেন? মাকে অ্যারেস্ট করবেন আজকেই? মা পালাবে বলে কি?’

লগ্নজিতা ধীর গলায় বলল, ‘বিকাশের কাছে আপনার বাবার আর মন্টুর দুজনের ঘরেরই চাবি দেওয়া আছে। বিকাশকে আমি বলে দিচ্ছি, দুটো ঘর খুঁজে দেখুন তো কোনো পুরোনো চামড়ার সোনালী লকওয়ালা ডায়েরি দেখতে পান কিনা? পেলে সরিয়ে রাখুন। আমি গিয়ে দেখছি…কোনটা আসল আর কোনটা নকল। বিকাশ সঙ্গে থাকবে, কোনোরকম চালাকি করতে যাবেন না রাহুল। মনে রাখবেন তাহলে কিন্তু বিপদ আপনার।’

কৌশিক বলল, ‘জিতা আমায় বলবে প্লিজ খুনিটা কে?’

ব্রজমোহনের খুনি কি ওর স্ত্রী? নাকি মৃন্ময় আর সরলাদেবীর যৌথ প্রচেষ্টা এটা? নাকি রাহুল আর চন্দ্রজার যৌথ ব্যাপার? প্লিজ বলো না? আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে মৃন্ময় আর সরলাদেবী দুজনে মিলে ব্রজমোহনকে খুন করেছে। তারপর কোনো মনোমালিন্য হওয়ায় দুজনেই দুজনকে খুনি সাজাতে চাইছে। আবার মনে হচ্ছে, রাহুল আর চন্দ্রজার কাজ। ব্রজমোহনের মৃত্যু, খুনি হিসাবে সরলাদেবী অ্যারেস্টেড, ওদের লাইফ সেটেল্ড। কি ভুল বলছি?’ লগ্নজিতা বলল, ‘আমায় একটু সময় দাও প্লিজ। আমি একটা হিসেব মেলাতে চেষ্টা করছি, একেবারে শেষ এসে গিঁটটা খুলছে না। ওটা খুলে ফেললেই ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’ মহাদেবের ফোন ঢুকছে। কৌশিক বলল, ‘তোমায় এই হঠকারিতার জন্য দুদিন ধরে আপ্যায়ন করা লোকগুলোকে এভাবে না বলে, না দেখা করে চলে আসতে হল। ফোনটা রিসিভ করো জিতা। গ্রামের সহজসরল মানুষগুলো অন্যরকম হয়। মহাদেবদা হয়তো ভাবছে ওনার আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রয়ে গেছে। তাই আমরা এভাবে না জানিয়ে চলে এলাম।’ জিতা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘ফোনটা রিসিভ করে বলে দাও আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি হঠাৎ করেই। তাই কলকাতা নিয়ে যাচ্ছ।’

কৌশিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এটাই বলল মহাদেবদাকে। কারণ ও জানে এই ক্রিটিক্যাল সময়ের লগ্নজিতা অন্যরকম মানুষ। এ কারোর কথার উত্তর দেবে না। নিজেই ভাবনার জগতে ডুব দেবে।

কৌশিক ফোনটা রেখে বলল, ‘মামাকে একবার জানিয়ে দিল হত না জিতা? উনি মহাদেবদার কাছ থেকে শুনবেন এটা ঠিক দেখায় না। উনি আমাদের জন্য এত ব্যবস্থা করলেন, আমাদের কমফোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করলেন শান্তিনিকেতনে এসে। এটুকু তো মিনিমাম ভদ্রতা।’

লগ্নজিতা বলল, ‘মানুষ বড় অদ্ভুত হয় কৌশিক। ডক্টর রাজেন চৌধুরীর কথাই ঠিক। খুন করার জন্য একটা আকস্মিক রাগের দরকার। একটা খুন করে ফেলতে পারলে খুনির নেশা চেপে যায়। একটার পর একটা মারতে শুরু করে। ব্রজমোহন খুন হয়েছিলেন নিজের নির্বুদ্ধিতায় অথবা বংশের গর্ব করার লোভ সামলাতে না পেরে। ওনার কাছে যে গুপ্তধনের নকশা আছে এটা যদি উনি না বলে বেড়াতেন তাহলে কিছুতেই উনি এভাবে খুন হতেন না। চা দিতে এসে যদি মন্টু অতি পরিচিত খুনিকে খুন করতে না দেখত তাহলে মন্টু মারা যেত না।

ইন্দ্রজিৎ যদি সামান্য অর্থের লোভে নিজেকে এভাবে বিক্রি না করে দিত তাহলে ও খুন হত না।

ওর স্ত্রী স্বামী হারা আর দু-বছরের শিশু কন্যা বাবা হারা হল। শুধু ওই গুপ্তধনের নকশা আর মিশরীয় দুষ্প্রাপ্য জিনিসের লোভে তিন তিনটে মানুষ শেষ হয়ে গেল। আরও গোটা দুই মানুষের প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা আছে হয়ত, জানি না বাঁচাতে পারব কিনা কৌশিক।

কৌশিক তুমি চূড়ান্ত ব্যর্থ লগ্নজিতাকে ভালোবাসবে আর? রেসপেক্ট করবে আমার প্রফেশনকে? নাকি ভাববে আমার একটা ছোট্ট ভুলে বাকি মানুষগুলোরও প্রাণ গেল!’ কৌশিক লগ্নজিতার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘বি স্টেডি। আমাদের অনেক কাজ এখন। আর একটা প্রাণও যাতে না যায় সেটা দেখতে হবে।’

অদ্ভুত লাগছে কৌশিকের। জিতাকে এতটা ব্যস্ত ও কোনোদিন দেখেনি। ইনফ্যাক্ট আগের কেসে দার্জিলিং সফরে সঙ্গী ছিল ও। তখনও খুনিকে শনাক্ত করার পরেও এমন উত্তেজনা দেখেনি কৌশিক।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন