অর্পিতা সরকার
‘কী হল এত অন্যমনস্ক কেন? সামথিং হ্যাপেন্ড? আমাকে বলতে পারিস নির্দ্বিধায়।’
হলদিয়ার বাড়িতে এলেই লগ্নজিতার পুরোনো অনেক কথা মনে পড়ে। স্কুলিংয়ের দিনগুলোতে ওদের চার বন্ধুর দস্যিপনা ছিল নজরকাড়া। বাড়ির ছাদে উঠলেই শোলাট গার্লস স্কুলের সবুজ মাঠটা দেখা যায়। তখন জীবন ছিল ভীষণ সরল। ঠিক জ্যামিতিতে আঁকা সরলরেখার মতো। তখন অবশ্য লগ্নজিতা স্বপ্ন দেখত পাইলট হবে। পুলিশ হবে একথা কল্পনাতেও ছিল না। তারপর কীভাবে যেন স্বপ্নটা পরিবর্তিত হয়ে গেল। সেই সরল জীবনটাকে আজকাল হলদিয়ার অলিগলিতে খুঁজলেও খুঁজে পায় না লগ্নজিতা। আজকের লগ্নজিতা বালিশের নীচে সার্ভিস রিভলভার নিয়ে শোয়। জীবন আর মৃত্যুর দড়ি টানাটানি খেলায় কে যে কখন পরাজিত হবে সেটা এক সেকেন্ড আগেও আন্দাজ করতে পারে না ও।
দিন চারেকের ছুটি নিয়ে কলকাতা থেকে নিজের বাড়ি হলদিয়ায় এসেছে লগ্নজিতা। মা-বাবা মেয়েকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। ওরা বোধহয় এই চারদিনে ওর মধ্যে থেকে ইন্সপেক্টর লগ্নজিতার সমস্ত সত্তা মুছে দিতে চাইছে। চাইছে সেই আগের উচ্ছ্বল মেয়েটাকে। যে অল্পেই হেসে উঠতো, একটুতেই কেঁদে ভাসাতো। অভিমানে ঠোঁট ফোলাতো। সিনেমায় বা গল্পের বইয়ে মৃত্যুর দৃশ্য থাকলে চোখের কোণে বর্ষার মেঘের মতো জল টলমল করত—সেই মেয়েটাকে হয়তো সর্বদা চায় বাবা-মা। কিন্তু বদলে গেছে লগ্নজিতা। প্রফেশনের কারণেই ধীরে ধীরে জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিশীল তারগুলো কর্কশ সুরে বেজে উঠেছে।
আজকাল শুধু ব্যর্থতাতেই কষ্ট পায় ও। এখনও চোখের সামনে ভাসছে, শিয়ালদা স্টেশনে ছুটছিল লগ্নজিতা মানিক চৌধুরীকে চেজ করে। সেই মানিক চৌধুরী যে কলকাতার এক নামী স্কুলের প্রায় পঁচিশ জন ছাত্রকে ড্রাগের নেশা ধরিয়েছে দায়িত্ব নিয়ে। হাতের সামনে পেয়েও পরাজিত হল লগ্নজিতা। আচমকা ছুরি দিয়ে ওর ডান হাতে সজোরে আঘাত দিয়েই ভিড়ে মিশে গেল। হাতের যন্ত্রণায় কাতর লগ্নজিতা হেরে গেল এক ক্রিমিনালের কাছে। হাতটাকে দিন পাঁচেক রেস্ট না দিলে ভোগাবে বুঝতে পারছিল ও। সেই কারণেই রেস্ট নিতে আসতে হয়েছে বাড়িতে। মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে ছুটি তো পেয়েছে বেশ কয়েকদিন। কিন্তু এভাবে হলদিয়ায় বসে থাকলে চলবে না। ফিরতে হবে কলকাতায়। মানিককে ধরতে হবে। ব্রজমোহনবাবুর খুনিকে ধরতে হবে।
বাবা আবারও জিজ্ঞাসা করল, ‘কি রে জিতা কিছু ভাবছিস? এত অন্যমনস্ক কেন তুই?’
লগ্নজিতা এই বয়স্ক মানুষ দুটোকে আর দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায় না। তাই হেসে বলল, ‘নাথিং সিরিয়াস বাবা। ওই একটা অদ্ভুত কেস এসেছে আমাদের থানায়। সেটা নিয়েই একটু ভাবছি আর কি।’
মা ক্যাপসিকাম পকৌরা আর চায়ের ট্রে নিয়ে উঠে এলো ছাদে। এসেই বলল, ‘বাপ-বেটি গল্প পেলে তো আর খাওয়ার কথা মনে থাকে না।’
লগ্নজিতা বলল, ‘সবকিছু মনে রাখার দায় বুঝি আমার! চা চা করছিল মনটা। জানি আমার মা ঠিক আমার মনটা বুঝতে পারবে।’
মা ছদ্ম অভিমানে বলল, ‘হয়েছে হয়েছে। এসে থেকেই দেখছি অন্যমনস্ক হয়ে আছিস। কিছু হয়েছে?’ আর আমাদের সত্যিটা বলতে এত দ্বিধা কিসের? দেখ জিতা, মেয়েকে যখন পুলিশে পাঠিয়েছিলাম তখনই জানি বেশ কিছু বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে তোকে পড়তে হবে। তারপর তুই তো আবার পুলিশের কাজের সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা হয়ে গেলি। সুতরাং বিপদের আশঙ্কা আরও বাড়ল। তাই সত্যিগুলো বল আমাদের। হাতের ওই আঘাতটা গাড়ি থেকে নামার সময় পড়ে গিয়ে হয়েছে—এটা আমি কেন, তোর বাবাও বিশ্বাস করেনি।’
চায়ে চুমুক দিয়ে লগ্নজিতা বলল, ‘দুষ্কৃতীদের জেলে চালান করার সময় তাদের হাতেও ছোটখাটো যন্ত্র থাকে। সেসব দিয়ে তারাও আমাদের একটু আধটু আদর করে বুঝলে মা! ওসব বাদ দাও। তুমি আমায় একটা কথা বলতো—তোমার খুড়তুতো ভাই—মানে আমাদের বিমানমামা এখনও কি হলদিয়ার সেই বাড়িটাতেই আছেন? নাকি ঠিকানা বদলেছেন?’
মা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘বিমান ওই বাড়িতেই আছে রে। কাজরী মারা যাবার পরে ট্যুরে যায় না আর। বাড়ির ওই লাইব্রেরিটাতেই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠেরো ঘণ্টা কাটায়। আমি আর তোর বাবা একদিন দেখা করতে গিয়েছিলাম। অনেক গল্প করল। বলল, ‘মাঝে মাঝে এসো দিদি। একাই তো থাকি। নিঃসন্তান মানুষের স্বপ্নই বা কী এই বয়েসে!’
লগ্নজিতা বলল, ‘তাহলে আমি আগামীকাল যাব বিমানমামার বাড়িতে। অনেক দিন গল্প হয় না। গল্প করে আসব।’
কৌশিক ফোন করছে। রিসিভ করতেই বলল, ‘শরীর কেমন? কলকাতা কবে ফিরেছ? তোমার সব ইনফর্মেশন কালেক্ট করা হয়ে গেছে। যেগুলো তুমি চেয়েছিলে। এবারে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নাও জিতা।’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘তাহলে তোমার আউটডোর, ওটি—ওগুলোর কী হবে? আর তোমার পেশেন্ট যারা বলে—ডাক্তারবাবু আপনি ভগবান, তাদের কী হবে? তারা যদি এসে আমার থানা ঘেরাও করে তখন কী করব?’
কৌশিক বলল, ‘কোনটা বেশি আপন লাগছে জিতা? হলদিয়ার আকাশ নাকি কলকাতার? কাউকে মিস করছো?’
লগ্নজিতা একটু সময় নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ মিস করছি। আমার পেন্ডিং কাজগুলোকে। এনিওয়ে, আমি আর তিনদিন পরেই কলকাতা ফিরছি। ফিরেই তোমার সঙ্গে মিট করছি কৌশিক।’
কৌশিক বুঝল, আপাতত লগ্নজিতা ভীষণ রকম অন্যমনস্ক। তাছাড়া এখনও হয়তো ওর ভালোবাসায় সাড়া দিতে নারাজ। তাই দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে বলল, ‘টেক কেয়ার। ফিরে এসো তাড়াতাড়ি। কলকাতার ধূসর আকাশ তোমার অপেক্ষায়।’
ফোনটা রেখে আকাশের দিকে তাকালো লগ্নজিতা। আকাশ কি আলাদা হয় নাকি? মিলেমিশে তো একাকার। ছোটবেলায় বাবা তারা চেনাতো। লগ্নজিতাও খুব আগ্রহ নিয়ে দেখত। অরুন্ধতী, নীহারিকারা আজ হয়তো ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে গেছে। ফিরতে হবে। ছটফট করে উঠল লগ্নজিতা। ব্রজমোহনবাবুর মৃত্যু রহস্যটা উৎঘাটন করতেই হবে। ক্রমশ লগ্নজিতার মাথায় দৃঢ় ধারণা জন্মেছে ওটা আত্মহত্যা নয় মার্ডার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন