শান্তিনিকেতনে লগ্নজিতা

অর্পিতা সরকার

হ্যালো, ‘তুমি রেডি কৌশিক? আমি তোমার বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’

‘তোমার গাড়ির বাঁ দিকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো।’ লগ্নজিতা দেখলো কৌশিক অলরেডি গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে দুটো হলুদ চন্দ্রমল্লিকা। লগ্নজিতার হাতে দিয়ে বলল, ‘আমি আনতে চাইনি, একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেরোচ্ছি ফুল কী হবে সেখানে? কিন্তু আসার সময় বাগানের এই ফুল দুটো নাছোড়বান্দা হয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরে বলল, আমাদের নিয়ে চল প্লিজ। অগত্যা আনতে বাধ্য হলাম। তাও ওদের অনেক বোঝালাম, আমি একজন দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসারের সঙ্গে যাচ্ছি। যার নিজস্ব ডিকশনারিতে রোম্যান্স শব্দের কোনো অস্তিত্বই নেই, কিন্তু ফুল দুটো বড় অবাধ্য জিতা। এই নাও এদের শাসন করে দাও একটু।’

লগ্নজিতা ফুল দুটো হাতে নিয়ে বলল, ‘তোমার উকিল হওয়া উচিত ছিল। সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলতে তুমি বেশ পারদর্শী।’ কৌশিক বলল, ‘অন্য কেউ হলে বলত, তুমি কবি হতে পারতে। কিন্তু এটাই লগ্নজিতার স্পেশালিটি, আর এই কারণেই হয়তো ফুল দুটো তোমার হাতে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল।’ লগ্নজিতা বলল, ‘তোমায় যে কাজটা দিয়েছিলাম সেটা কি আদৌ করেছো? নাকি কবিতা লিখতেই ব্যস্ত ছিলে?’

কৌশিক বলল, ‘দেখো অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে আমি নেহাত মন্দ নই। সরলাদেবীর রিসেন্ট যে ডক্টরের মেডিসিন খাচ্ছিলেন তার সঙ্গে কথা হল বুঝলে। তিনি ওনাকে নিয়ে আপসেট। বললেন, ওষুধ নাকি ঠিকমতো খান না। মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উনি কথাও বলেছিলেন। তাতেও বুঝেছেন, ওনার এই সমস্যা সারার নয়। সরলাদেবীর মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা মারাত্মক। এনার কাছেও নাকি গিয়ে ব্রজমোহনকে কোন ওষুধে মেরে ফেলা যায় সেসব চেয়েছিলেন। এবং সেটা ব্রজমোহনের সামনেই। ডক্টর উনি যে ওষুধগুলো খান তার লিস্ট দিলেন। এই নাও।’ লগ্নজিতা ওষুধগুলোর নাম পড়ে বলল, ‘কৌশিক এই ওষুধের ফাইলটা আমি পেয়েছি সরলাদেবীর ঘর থেকে। এটা কিসের ওষুধ একটু দেখো তো।’ কৌশিক চমকে উঠে বলল, ‘তুমি শিওর এটা সরলাদেবীর ঘরেই ছিল?’ লগ্নজিতা ঘাড় নাড়তে কৌশিক বলল, ‘এটা আসলে এ্যানাবোলিক স্টেরয়েড টাইপের মেডিসিন। এটার রেগুলার ব্যবহারে পুরুষের শুক্রাণুর সংখ্যা কমে গিয়ে বন্ধ্যাত্ব আসে। কিন্তু সরলাদেবী এটা নিয়ে কী করছেন? ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট তো ২২ দেখছি। তার মানে রিসেন্ট কিনেছেন। কাকে খাওয়ান উনি এই ওষুধ? ব্রজবাবুর যা বয়েস তাতে এই ওষুধ ওনাকে খাওয়াতেন না হয়তো। তবে কি ওনার ছেলে রাহুলের জন্য এই ওষুধ? ভদ্রমহিলার কিন্তু পাগল নন জিতা। মারাত্মক শয়তান। তুমি ভাবতে পারছো জিতা, এই মহিলা নিজের সন্তানের বন্ধ্যাত্ব ডেকে আনতে চাইছে! নাকি স্বামীকেই অবিশ্বাস করে মনের তৃপ্তির জন্য খাওয়াতেন কে জানে!’

লগ্নজিতা বলল, ‘উনি নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসেন না সেটা আমি বুঝেছি। মারাত্মক ডার্ক একটা ক্যারেক্টার।

প্রচুর শেড আছে। সকলের কথা শুনে তো মনে হচ্ছে উনিই ব্রজমোহনকে খুন করেছেন। তারপর মন্টু সেটা দেখে ফেলেছে বলেই ওকেও মেরে দেন। ব্রজমোহনের খুনটা নিজে হাতে করলেও মন্টুর খুনটা হয়ত লোক লাগিয়ে করেছিলো। যদিও খুনের পদ্ধতি একেবারে এক। আমরা যেদিন ওদের বাড়িতে যাই, মন্টুকে জেরা করব বলে ওর ঘরে গিয়ে দেখি ও বেপাত্তা। আমার দৃঢ় ধারণা সরলাদেবীই ওকে সেদিন বাড়ির বাইরে পাঠিয়েছিলেন। রাহুলের কথা মতো, মন্টু ব্রজমোহনকে অসম্ভব ভালোবাসত। আর সরলাদেবীকে ভয় পেত। সরলাদেবী যা বলতো মন্টু ভয়ে ভয়ে সেটা পালন করত। পুলিশের জেরার মুখে হয়তো মন্টু বলে দিতো কে ব্রজমোহনকে খুন করেছে, তাহলে ওর মুখোশ খুলে যেত তাই এই নৃশংসভাবে মন্টুকেও সরিয়ে দিলেন মহিলা।’

কৌশিক বলল, ‘আচ্ছা জিতা মা আর ছেলে দুজনেই যুক্ত নয় তো এই খুনের ব্যাপারে?’ লগ্নজিতা বলল, ‘রাহুল কেন থানায় গিয়েছিল? আত্মহত্যা বলে তো চালাতেই পারতো। এই প্রশ্নটার জন্যই আমি রাহুলকে এর বাইরে রাখছি।’

কৌশিক বলল, ‘বাবার মৃত্যুতে হয়ত ওর হাত ছিল না। ও সত্যিই জানত না বাবাকে কে মেরেছে। পরে যখন বুঝতে পেরেছিল মন্টু খুনিকে দেখেছে তখন মাকে বাঁচাতে মন্টুকে খুন করতেও পারে রাহুল।’ লগ্নজিতা বলল, ‘তোমার কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছি না কৌশিক। এই ব্রজধাম অদ্ভুত জায়গা। সব ঘরে ঘরে দুর্মূল্য জিনিসের পশরা। দুষ্প্রাপ্য সব বইয়ের সম্ভার। ব্রজমোহন একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। অর্থের অভাব নেই, তারপরেও বাড়িটাতে কেমন যেন অপ্রাপ্তির লক্ষণ। লাইব্রেরি রুমে মাঝরাত পর্যন্ত বই পড়ে দোতলার অন্য একটি ঘরে ঘুমাতে যেতেন। স্ত্রীর সঙ্গে থাকতেন না। কারণ ওপরের একটি ঘরের বিছানায় বালিশের পাশে আমি অনেকগুলো বইপত্র দেখলাম। ওখানেই ব্রজমোহনের জামা-প্যান্ট, টুপি সব ছিল।’

কৌশিক বলল, ‘আমার অসম্ভব খিদে পেয়েছে জিতা।’

লগ্নজিতা বলল, ‘পাঁচ মিনিট ওয়েট করো, তোমায় হিন্দুস্থান ধাবায় নিয়ে গিয়ে আলুপরোটা আর চানামশলা খাওয়াচ্ছি।’ হিন্দুস্থান ধাবায় ঢুকেই লগ্নজিতা খেয়াল করল, ওর পাশের টেবিলের পাঞ্জাবি ভদ্রলোক ওদের দিকে নজর রাখছে। ভদ্রলোকের মুখটা বেশ পরিচিত। মাথায় পাগড়ি বা দাড়ি-গোঁফ লাগালেও চেহারাটা চেনা লাগছে। একটু মুচকি হেসে লগ্নজিতা খাওয়ায় মন দিল। কৌশিক ফিসফিস করে বলল, ‘হাসছো কেন?’ লগ্নজিতা বলল, ‘দুটো টেবিল পরে ওই পাক্কা পাঞ্জাবি লোকটার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বেসিনে গিয়ে হাতটা ধুয়ে এসো যাও।’ কৌশিক বলল, ‘মানেটা কী? অযথা লোককে ধাক্কা দিলে মার খাবো তো? তাছাড়া উনি পাঞ্জাবি গায়ে প্রচুর জোর, দেবেন পটকে।’

লগ্নজিতা বলল, ‘যেটা বললাম করো তো।’ কৌশিক বলল, ‘তুমি একদিন আমায় নির্ঘাত মার খাওয়াবে জিতা।’

কৌশিক বেসিনে হাত ধুতে যাবার নাম করে বসে থাকা পাঞ্জাবি লোকটার হাতে বেশ জোরেই ধাক্কা মারল। লোকটার হাতের মাটির ভাঁড়ের চা-টা ছলকে পড়ে গেল কিছুটা। লোকটা রাগত স্বরে বলল, ‘অন্ধ নাকি রে শুয়োরের বাচ্চা। বসে থাকা লোককে এসে ধাক্কা মারছিস?’ কৌশিক সরি বলতে ব্যস্ত। লগ্নজিতা গলার স্বরটা কনফার্ম করে নিয়ে নিজের মনেই হাসলো। ওর পিছনে হঠাৎ ফলো করার দরকার কেন পড়ল? মানুষটাকে চিনতে পেরে অবশ্য বেশি চমকেছে লগ্নজিতা। একটু আধটু সন্দেহ হলেও এতটা অবিশ্বাস করতে মন চায়নি।

বিশ্বাসের আর জায়গা নেই। কিন্তু কার নির্দেশে এটা করতে নেমেছে ও সেটাই জানতে হবে লগ্নজিতাকে।

কৌশিক টেবিলে বসে বলল, ‘লোকটা পাঞ্জাবি নয়। পাতি কলকাতার বাঙালি। এরা রেগে গেলে যেকোনো লোককে তুই তোকারি করে। আর বাংলা উচ্চারণও ভীষণ পরিষ্কার। সম্ভবত ছদ্মবেশে আছে।’ লগ্নজিতা বলল, ‘তোমার আলুপরোটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মিস্টার ভাস্কো-দাগামা। আপনার এই আবিষ্কার গোটা বিশ্ব মনে রাখবে। এখন খেয়ে নিন।’ কৌশিক মুখে পরোটা ভরে বলল, ‘ব্যঙ্গ করার কী আছে? আমি জানি তুমি ওটা বুঝতে পেরেই আমায় পাঠিয়েছিলে, তবুও মাঝে মাঝে কলার তুলতে সকলেরই ভালো লাগে। এটা হিউম্যান সাইকোলজি।’

লগ্নজিতা বলল, ‘এ লোকটা কিন্তু শান্তিনিকেতনে আমাদের শান্তিতে রোম্যান্স করতে দেবে না কৌশিক। তাই খুব সাবধান। একে চোখে চোখে রাখতে হবে।’

কৌশিক বলল, ‘তুমি চেনো তার মানে? তো গিয়ে মুখোশটা খুলে দিলেই হয়।’ লগ্নজিতা বলল, ‘আমি চুনোপুঁটি নিয়ে মাথা ঘামাই না। ও কার হয়ে কাজ করছে সেটা জানা জরুরি আমার কাছে। তবে আমি লাটাই সমেত ঘুড়িটাতে টান দিতে পারব।’

ওরা গাড়িতে উঠতেই খেয়াল করল লোকটিও উঠে পড়ল ধাবা থেকে।

গাড়িতে উঠতেই ইউসুফের ফোন—’ম্যাডাম সরলাদেবী কোনো এক তান্ত্রিকের কাছে এসেছিল। কালো জাদু করবে বলে। যার নামে করবে তার নাম বলল চন্দ্রজা। মৃন্ময়ের মেয়ে। কি সব কালো ছাই টাই নিয়ে গেল। মৃন্ময়ের বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে দেবে বলে। যাতে চন্দ্রজা রাহুলের ধারে কাছেও না ঘেঁষে তাই।’

লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘এই মহিলা দেখছি সদা ব্যস্ত থাকেন। আর রাহুলের খবর কী?’

‘ওর ফোন ট্যাপ করা গেছে শেষ পর্যন্ত। আজ এক পুলিশ অফিসারকে ফোন করে বলল, যত টাকা লাগে লাগুক। আমি সুব্রত বসুর শেষ দেখতে চাই। যতদিন না ওকে শাস্তি দিতে পারছি ততদিন পর্যন্ত দিদিভাই শান্তি পাবে না।’

চন্দ্রজাকেও কল করেছিল। আপনাকে রেকর্ডিং পাঠালাম। লগ্নজিতা শুনছিল রেকর্ডিংগুলো। রাহুল বলছে—’মন্টুর মৃত্যুটা মেনে নেওয়া যেন বেশি কষ্টকর।’ চন্দ্রজা কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘আর তোমার মাকে মেনে নেওয়া বোধহয় বেশ সহজ তাই না রাহুল? তুমি জানো রাহুল এদের দুজনকেই কে খুন করেছে, তাহলে পুলিশের কাছে সত্যিটা বলতে বাধা কোথায়? নিজের মা বলে এত বড় একটা অন্যায় মেনে নেবে তুমি?’ রাহুল বলল, ‘তুমি বললে না তো চন্দ্রা, মৃন্ময়কাকু ওদিন আমাদের বাড়িতে অত ভোরে কী করতে এসেছিল? আর এলোই যদি বাবার সঙ্গে দেখা না করে বাগান থেকে ফিরেই বা গেল কেন? আমার মাকে যদি সন্দেহের তালিকায় রাখা হয় তাহলে তো তোমার বাবাকেও রাখা উচিত।’ চন্দ্রজা বলল, ‘তোমার মায়ের মতো সকলের সামনে গলা টিপে তো আর কেউ ধরতে পারবে না রাহুল। এনিওয়ে আমায় ফোন করো না অযথা।’

রাহুল বলল, ‘মন্টু চলে যাবার পরে বাড়িটা বড্ড ফাঁকা লাগছে। বাবার ঘরটা পুলিশ সিল করে রেখেছিল। এবারে মন্টুর ঘরটাও করল। চন্দ্রা এসময় এত তর্ক না করে তোমায় একটু পাশে পাব আশা করেছিলাম।’ চন্দ্রজা বলল, ‘নিজের বাবার খুনির মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে তোমার ভালো লাগবে রাহুল?’ রাহুল বলল, ‘রাখছি। তুমি ভালো থেকো।’

কৌশিক শুনে বলল, ‘অদ্ভুতভাবে একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবার পথে তাই না জিতা? অথচ এদের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে এখনও দুজন দুজনকে ভালোবাসে।’ কৌশিকের কথা শেষ হবার আগেই একটা বড় সাইজের ইট এসে লাগল লগ্নজিতার গাড়ির কাচে। ড্রাইভার চট করে মাথাটা সরিয়েছিল তাই কিছু হল না। কৌশিক বলল, ‘জিতা কেউ তোমাকে টার্গেট করেছে। কী করবে?’

লগ্নজিতা বলল, ‘সামনে কোথাও গ্যারেজ থাকলে দাঁড় করিয়ে গাড়িটা সারিয়ে নাও। আমরা যাবার অন্য ব্যবস্থা করছি।’ শেষপর্যন্ত একটা বাসকে দাঁড় করিয়ে শান্তিনিকেতন পৌঁছালো ওরা। তারপর অটো বুক করে প্রান্তিক। বিমানমামার বাংলোর নাম ”বলাকা”। ভারী সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ। ওরা যেতেই মহাদেব ওদের আপ্যায়ন করল। বাইরে বেগনভেলিয়া বা কাগজ ফুলে রঙিন হয়ে আছে। কৌশিকের চোখে এখনও গাড়ির কাচ ভেঙে যাওয়াটা আতঙ্কটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। লগ্নজিতা সোফায় আরাম করে বসে বলল, ‘মহাদেবদা দু-কাপ গরম চা করে ফেলো দেখি।’ কৌশিক ওর পাশে বসে বলল, ‘জায়গাটা নিরাপদ তো?’ লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘সঙ্গে ইন্সপেক্টর নিয়ে ঘুরতে এসেছো এত টেনশন কেন? চলো তুমি ওপরে যাও আমি নীচে স্নানটা সেরে নিই চা খেয়ে।’ দোতলায় একটা ঘর, বাথরুম, ছোট্ট ডাইনিং আর বড় ব্যালকনি। নীচে কিচেন, দুটো রুম, বাথরুম আর ড্রয়িং। বেশ খোলামেলা বাংলোটা। কৌশিক বলল, ‘এই জিতা ভবিষ্যতে রবি ঠাকুরের আপন দেশে আমাদেরও একখানা এমন বাংলো কিনলে কিন্তু মন্দ হয় না? বলো তো এবারই খোঁজ খবর নিই।’ লগ্নজিতা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘বুড়ো বয়েসে এখানে এসে চেম্বার খুলবে এমন ভাবনা থাকলে কিনতেই পারো।’ কৌশিক বলল, ‘আমি আমাদের কথাটা ব্যবহার করেছি কিন্তু।’ লগ্নজিতা নিজের ব্যাগ নিয়ে রুমে যেতে যেতে বলল, ‘আপাতত খুব খিদে পেয়েছে। মহাদেবদা বনমুরগির ঝোল রেঁধেছে। ঝট করে স্নান সেরে এসো।’

কৌশিক বিরক্তির সুরে বলল, ‘ধুর পুলিশকে কেউ কখনও ভালোবাসে? এর থেকে তো রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে ঘর করা ভালো। বাঘের পেট ভর্তি থাকলে তবুও দুটো ভালো কথা বলবে।’ কৌশিক উঠে গেছে ওপরে। ঘরে চেঞ্জ করতে করতে লগ্নজিতা ভাবছিল, হঠাৎ পাঞ্জাবির পোশাক পরে ওকে ফলো করার দরকার কেন পড়ল? কে লাগিয়েছে ওকে? বাথরুমে ঢুকে একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল লগ্নজিতার, চমকে উঠল ও। মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। সব হিসেব গুলিয়ে যেতে শুরু করল। টেবিলে বসতেই মহাদেবদা বলল, ‘আমার বোন এসে বাসন ধুয়ে দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওর আজকে কল পাড়ে পড়ে গিয়ে কোমরে লেগেছে। তাই আমি এক আদিবাসী মহিলাকে বলেছি সে এসে সব ঘষে মেজে দিয়ে যাবে। আপনারা খেয়ে রেস্ট নিন। আমি আবার সন্ধেতে এসে রাতের খাবার, সন্ধের টিফিন সব করে দেব।’ মামা বলেছিল, ‘মহাদেবের রান্নার হাতটা দারুণ।’ সত্যিই মুরগির ঝোল খেয়ে প্রাণ ভরে গেল। কৌশিক বলল, ‘দুর্দান্ত খেলাম কিন্তু জিতা। এবারে একটু পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে ওই সোনাঝুরিতে যাব।’

লগ্নজিতা দেখল ইউসুফ আরও কয়েকটা কল রেকর্ডিং পাঠিয়েছে। রাহুল আর অমিতবাবুর কথোপকথনও আছে। অমিতবাবু নিজের শালার ব্যাপারে রাহুলকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। রাহুল বলছে, ‘আপনি বাবার বন্ধু। আমি আপনাকে সম্মান করি। কিন্তু আপনার শালা যেটা করেছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য। আমার দিদির কেসটা ও টাকা নিয়ে ধামাচাপা দিয়েছে। ওকে আমি ছাড়বো না। বাবা নেই তো কী হয়েছে, এটা আমিই হ্যান্ডেল করে নিতে পারব। ওর যেখানেই ট্রান্সফার হোক খুঁজে যখন বের করেছি তখন এর শেষ দেখবো।’ অমিতবাবু হিসহিসে গলায় বললেন, ‘এই অবুঝ জেদের জন্যই ব্রজদা প্রাণটা হারালো। তোমরাও কি এরকম ইচ্ছে আছে নাকি?’ রাহুল বলল, ‘থ্রেট দিচ্ছেন নাকি?’

অমিতবাবু গলা নামিয়ে বললেন, ‘থ্রেট নয় ভদ্র ভাষায় বোঝাচ্ছি। দেখো তোমার দিদির সঙ্গে বর্ণালীম্যাডামের ছেলের মাখামাখি জানতে আর পাড়ার কারোর বাদ ছিল না। দুজনে একসঙ্গে পড়তে যেত, রেস্টুরেন্টে খেতে যেত। তোমরা তো সব একসঙ্গে বেড়াতেও নাকি গিয়েছিলে। তাই বলছি, ওটা আদৌ রেপ ছিল নাকি তৃষার সম্মতিতে ….যাইহোক যেটা বললাম শুনলে ভালো। অযথা যে ফিরে আসবে না তার জন্য সুব্রতকে যদি অযথা জড়াও তাহলে কিন্তু ভালো হবে না।’

বাসুদেববাবুও রাহুলকে ফোন করেছিলেন। তার রেকর্ডিংও শোনা হল। মিশরীয় কয়েকটা মূর্তি আর কয়েন বিক্রি করবে কিনা এটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চাইলেন। তারপর বললেন, ‘সরলাবৌদি একা হয়ে গেলেন, আমি শিঞ্জিনীকে নাহয় পাঠিয়ে দেব তোমাদের বাড়িতে। একটু গল্প করে আসবে। তাছাড়া তোমার মা আবার শিঞ্জিনীকে বেশ ভালোবাসেন।’ বাসুদেববাবু আর রাহুলের কথার মাঝেই সরলাদেবীর গলা পাওয়া গেল। ‘মন্টুকে আজকে বাজারে দেখলাম জানিস রাহুল। তুই যে বললি মন্টু মরে গেছে? দিব্য ঘুরে বেড়াচ্ছে ও।’

লগ্নজিতা ভাবছিল—ওই বডিটা মন্টুরই ছিল তো? রাহুল তো তাই শনাক্ত করেছিল। নাকি যার পোস্টমর্টেম হল সে আদৌ মন্টু নয়! সরলাদেবী তাহলে বাজারে কাকে দেখলেন? মন্টুকে চিনতে ওনার ভুল হবার কথা নয়।

নাকি ডক্টর রাজেন চৌধুরীর কথাই ঠিক, সরলাদেবী যেটা কল্পনা করেন, সেটাকেই দেখেছেন বলে দাবি করেন। অথবা উনি কাল্পনিকভাবে এসব দেখতে পান যেগুলো উনি দেখতে চাইছেন। সেই কারণেই হয়তো রাহুলের গলায় কোনো পরিবর্তন ঘটল না মন্টুকে দেখার খবর শুনেও।

ইন্দ্রজিৎ কল করছে দেখে ফোনটা রিসিভ করল লগ্নজিতা। ইন্দ্রজিৎ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘ম্যাডাম মৃন্ময়বাবু আর ওর মেয়ে আজকে বাড়িতে তালা লাগিয়ে কোথায় যেন গেছে সেই সকালবেলা। পালিয়ে গেল না তো? সঙ্গে একটা বড় ব্যাগ ছিল কিন্তু।’

লগ্নজিতা শান্ত গলায় বলল, ‘না পালায়নি। ডোন্ট ওরি। আমি যে বলেছিলাম, মৃন্ময়বাবুর বাড়ির সামনে পাহারা বসানোর দরকার নেই। তবুও…’

ইন্দ্রজিৎ বলল, ‘সরি ম্যাডাম। আপনি খুবই ব্যস্ত খুনিকে খুঁজে পেতে। আর আমি চোখের সামনে খুনিকে দেখেও পাহারা দিতে পারব না এটা খুবই সমস্যাজনক কথা। তাই মৃন্ময় আর চন্দ্রজাকে চোখে চোখে রাখাটা এই কেসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ লগ্নজিতা বলল, ‘বেশ মৃন্ময়বাবুরা ফিরলে খবর দিও।’ ফোনটা রেখে চোখ বন্ধ করল লগ্নজিতা। চোখের সামনে ব্রজমোহনের ঘরটা ভাসছে। ঘরের প্রতিটা কোণ মনে করার চেষ্টা করছে ও। বেলটা বাজল। লগ্নজিতা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই খোঁপায় চন্দ্রমল্লিকা গুঁজে একটা বছর ছাব্বিশের মেয়ে পালিশ করা কালো রঙে বেশ গর্বিত গলায় বলল, ‘তুরা কখন এলি? ওই জেঠাবাবু আসেনি এবারে? আমার ছবি দুটো পাঠালো নাকি তুকে দিয়ে?’

লগ্নজিতা বলল, তোমার নাম কী? মেয়েটা মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘আমার নাম কৃষ্ণা হাঁসদা। ওই সরপুকুরডাঙ্গায় বাড়ি। মহাদেব বলল, তুরা আসবি শহর থেকে। বাসন ধুয়ে রাখতে।’ লগ্নজিতা ওকে সামনের টুলে বসে গল্প করতে শুরু করল। কৃষ্ণা এ পাড়ার মেয়ে এবং বউ। তাই এখানের খুঁটিনাটি সব জানে।

কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প করতে করতেই কৌশিক নেমে এলো ওপর থেকে। কৃষ্ণা সরল গলায় বলল, ‘তোর সুয়ামী বুঝি? দেখতে ভালো, তোদের মানাইছে।’ লগ্নজিতার গালে আচমকা বেগনভেলিয়ার লাল রঙের ভিড়। আর কৌশিকের চোখে দুষ্টুমির মাখামাখি। কৌশিক বলল, ‘এত দিনে একজনকে খুঁজে পেলাম, যে বলল আমাদের ভালো মানিয়েছে। কৃষ্ণা তোমায় আমি একটা উপহার দিতে চাই, তুমি কী নেবে বলো?’

কৃষ্ণা বিষয়টা না বুঝে বলল, ‘কিসের উপহার?’

লগ্নজিতা বলল, ‘দাদার তোমায় খুব ভালো লেগেছে। তাই তোমায় কিছু উপহার দিতে চায়।’ কৃষ্ণা এক মুখ হেসে বলল, ‘তাহলে একটা শাড়ি দিস কেনে।’

লগ্নজিতা বলল, ‘চলো তোমাদের সোনাঝুরির হাট দেখিয়ে আনবে চলো।’

বাড়ির গেটে তালা দিয়ে সিকিউরিটির কাছে চাবিটা দিয়ে ওরা চলল হাটের দিকে। হঠাৎই কৌশিক লগ্নজিতার হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘পিছনে তাকিও না। কিন্তু সেই পাঞ্জাবি পিছু নিয়েছে জিতা।’ লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘ডোন্ট ওয়ারি। আমি দেখে নিয়েছি অলরেডি।’ কৃষ্ণা সব দেখাতে দেখাতে যাচ্ছিল। বিমানমামার ফোনটা এলো লগ্নজিতা আর কৌশিক তখন কোপাইয়ের ধারে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিল। ‘বল রে পাগলী, সোনাঝুরি কেমন লাগছে? কোপাই কেমন লাগছে বল, তুই বোধহয় এই প্রথম গেলি তাই না? দুপুরের খাবার ঠিক ছিল তো? কৌশিকের কেমন লাগছে?’

লগ্নজিতা বলল, ‘মামা চিন্তা করো না। দারুণ লাগছে। মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আছে। সন্ধেতে ওখানে যাব। সরলাদেবী সম্পর্কে আরেকটু জানা দরকার। তুমি বোধহয় ঠিকই বলছো, খুনটা সরলাদেবীই করেছে। আর কয়েকটা প্রমাণ দরকার আমার।’

বিমানমামা হালকা হেসে বলল, ‘আমার মাথার চুলগুলো পেকেছে শুধু বয়েসে নয় রে, অভিজ্ঞতায়। সরলাবৌদির মধ্যে একটা অদ্ভুত হিংস্র মানসিকতা লুকিয়ে আছে। ব্রজমোহনকে জীবনে শান্তি দেয়নি মহিলা। আর এই বয়েসে এসে ওর পক্ষেও আর সম্ভব হচ্ছিল না। হয় ও আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে ব্রজমোহনকে নয়তো নিজেই মেরে দিয়েছে সরলা।’

লগ্নজিতা বলল, ‘হ্যাঁ মামা মোটামুটি সব প্রমাণই পেয়ে যাচ্ছি ওনার বিরুদ্ধে। তবুও আরেকটু দরকার। পেলেই অ্যারেস্ট করব ওনাকে। এখানে কী কী হয় জানাচ্ছি তোমায়। বাই দ্য ওয়ে তোমার মহাদেব কিন্তু ভীষণ কাজের। একে কলকাতা নিয়ে গেলে বেশ হয়।’

সেই ছোটবেলার মতোই প্রাণখোলা হাসলো মামা। কৌশিক বলল, ‘এই আমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করল নাকি তোমার মামা?’ লগ্নজিতা বলল, ‘বিমানমামা চিরকালের ভীষণ শিক্ষিত আর রুচিসম্পন্ন মানুষ। কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো পছন্দ করেন না।’

ওরা সোনাঝুরির হাটে গেল পায়ে পায়ে। কৃষ্ণার উৎসাহ বেশি। কৌশিক দুটো শাড়ি কিনে দিল কৃষ্ণাকে। বেশ কয়েকটা ছবিও তুলে দিল। মেয়েটার ছবি তোলার প্রতি খুব আগ্রহ।

কৃষ্ণা ওদের সোনাঝুরির একেবারে শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছিল পায়ে পায়ে। এদিকটাতে লোক নেই তেমন। সূর্যাস্ত হয়ে যেতেই সোনাঝুরির হাট ভাঙতে শুরু করেছে। কৌশিক বলল, ‘এরা কি শুধু দিনের আলোতে ব্যবসা করে জিতা? মানে সূর্যদেবের ভরসায়? বেশ একটা আদিম ব্যাপার আছে এই চূড়ান্ত আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার মাঝেও।’ জিতা বলল, ‘সবই আমাদের রবি ঠাকুরের কৃপায়। ভাগ্যিস কলকাতা থেকে এত দূরে এসে এমন একটা জায়গা বেছেছিলেন যেখানের আকাশে বাতাসে আজও ওনার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। যদিও রাজনীতির ভয়ঙ্করতায় আগের মতো আর নেই শান্তিনিকেতন। তবুও উনি ছিলেন বলেই আজও আছে।’

কৃষ্ণা ওদের একটু আগে আগে হাঁটছিল। ওর হাঁটার ছন্দটার মধ্যেও মাদকতা আছে। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লগ্নজিতা। কত সরল ওদের জীবনটা।

আচমকা বেশ চিৎকার করে উঠল কৃষ্ণা। সোনাঝুরির ফাঁকা মাঠে সেটা যেন আর্তনাদ করে উঠল।

কৌশিক বলল, ‘সাপ নাকি গো?’

দুজনেই ছুটল ওর দিকে। লালচে মাটিতে মাটি মেখে পড়ে আছে একটা শরীর। লগ্নজিতা কিছু বলার আগেই কৌশিক বলল, ‘এ তো সেই ধাবার পাঞ্জাবিটা।’ হাতটা ধরে পালস চেক করল কৌশিক। বলল, ‘মারা গেছে হয়ত কিন্তু শরীর এখনও গরম। খুব বেশি আগে মারা যায়নি। হসপিটালে নিয়ে যাবে নাকি? লগ্নজিতা বলল, দাঁড়াও এখানের পুলিশের সঙ্গে একটা যোগাযোগ করি আগে। আমার ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু ইন্দ্রজিৎকে এত তাড়াতাড়ি মেরে দেবে বুঝতে পারিনি আমি। অঙ্কটা ঘেঁটে ফেলেছিলাম একটু হলেও।’

কৌশিক বলল, ‘ইন্দ্রজিৎ? ইনি কে জিতা?’

লগ্নজিতা বলল, ‘আমার থানার সাব ইন্সপেক্টর। নতুন এসেছে। আমার সঙ্গে এই কেসটা অ্যাসিস্ট করতে চেয়েছিল। দুদিন নিয়েও গিয়েছিলাম সঙ্গে। তারপর সিক্সথ সেন্স বলছিল ও আমায় ভুল পথে পরিচালিত করতে চাইছে। তাই কথা না বলে সরিয়ে দিলাম।’ কৌশিক বলল, ‘তাহলে ওকে খুন করল কে?’

লগ্নজিতা বলল, ‘যে ওকে নিয়োগ করেছিল আমায় চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার জন্য। যার কাছে টাকার বিনিময়ে ও নিজের মেরুদণ্ডটা বিক্রি করে দিয়েছিল সেই মেরে দিল।’ কৌশিক বিস্মৃত হয়ে বলল, ‘কিন্তু কেন? নজর রাখার প্রয়োজনীয়তা কি চলে গেল?’

লগ্নজিতা বলল, ‘হয়তো আমার কাছে ইন্দ্রজিৎ ধরা পড়ে যাবে আর সব বলে দেবে ভেবেই আর ঝুঁকি নিল না খুনি।’

লগ্নজিতা বোলপুর পুলিশে ফোন করতে করতেই বলল, ‘দেখো তো ইন্দ্রজিতের ফোনটা আছে কিনা সঙ্গে।’ কৌশিক বলল, ‘না নেই। তার মানে সব প্রমাণ গেল। এই লোকটাকে কে নিয়োগ করেছে বোঝার উপায় শেষ।’ লগ্নজিতা বলল, ‘ওর হাতের রিস্ট ওয়াচটা খুলে নাও। খুনের পদ্ধতি বাকি দুটো খুনের মতোই হবে এটা নিয়ে দ্বিমত নেই আমার।’ কৌশিক বলল, ‘জিতা একটা ছোট্ট মোবাইল আছে প্যান্টের হিডেন পকেটে।’ ফোনটা নিয়ে নিজের কাছেই রাখল লগ্নজিতা তদন্তের খাতিরে। বোলপুর থানায় জমা দেওয়া হয়তো উচিত, কিন্তু নিজের ওপরেই ওর বিশ্বাস একটু বেশি। তাই সামান্য এভিডেন্সও আর হাতছাড়া করতে চাইল না ও। কৃষ্ণা মাটিতে বসে কাঁপছে। লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক ওকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আমাদের ড্রাইভারকে বলো ওকে যেন পৌঁছে দেয়। ভয় নেই কৃষ্ণা।’ মেয়েটার হাসি মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। সোনাঝুরিতে যেমন সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই রংবেরঙের পশরা মিলিয়ে গিয়ে ধু ধু করছে লালচে মাটির মাঠ, তেমনই কৃষ্ণার মুখটাও ধূসর হয়ে গেছে। কৌশিক ড্রাইভারকে ফোন করে বলল, ‘ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।’ লগ্নজিতা বলল, ‘কৃষ্ণা কালকে এসো বাংলোতে। কোনো ভয় নেই।’ ওর কথা শেষ হবার আগেই বোলপুর পুলিশ এসে হাজির। বডি নিয়ে চলে গেল। লগ্নজিতা আর কৌশিক থানায় পৌঁছাল। ইন্দ্রজিৎ এস আই শুনে বেশ কিছু মিডিয়াও হাজির হয়েছে। লগ্নজিতা বলল, ‘আমার ফোন নম্বর রাখুন। প্রয়োজনে কল করবেন।’

কৌশিক আর লগ্নজিতা একটু অন্যমনস্কভাবেই হাঁটছিল। কৌশিক বলল, ‘জিতা তোমাদের প্রফেশনে এত প্রলোভন নিজেকে ঠিক রাখাই তো মুশকিল।’ লগ্নজিতা বলল, ‘না কৌশিক পুলিশের নামে দোষ হয় ঠিকই, তবে ঘুষ এখন সব ক্ষেত্রেই লোকজন নিচ্ছে। শুধু সুযোগটা পাওয়ার অপেক্ষা। আমি কলকাতায় ফিরে ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে কমপ্লেন লিখতাম অবশ্যই ডিসি অফিসে। কিন্তু তার আগেই কৃতকর্মের ফল পেল বিশ্রীভাবে। মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেম্বারে ঢুকতে হবে। অলরেডি আমরা পনেরো মিনিট লেট কৌশিক।’ কৌশিক বলল, ‘জিতা তুমি আদৌ বুঝতে পেরেছো ব্রজমোহনের খুনের মোটিভ? নাকি এলোমেলোভাবে সন্দেহের বশে ঘোরাফেরা করছো এখনও।’ লগ্নজিতা বলল, ‘সকলের বলা মিথ্যে বা অসামঞ্জস্যগুলোকে ধরতে পেরেছি। সেগুলোকেই সাজাচ্ছি। এই মিথ্যের পিছনের কারণগুলো মিলিয়ে ফেলতে পারলেই সব হাতের মুঠোয় পেয়ে যাব কৌশিক।’

কৌশিক বলল, ‘তুমি গাড়িতে একটা বই পড়ছিলে দেখলাম ব্রজমোহন চক্রবর্তীর লেখা। ইনি কি লেখক ছিলেন নাকি?’ লগ্নজিতা বলল, ‘ঠিক প্রফেশনাল লেখক বলা চলে না। এই একটি মাত্র বইই দুই মলাটে বন্দি হয়েছিল।’ ইতিহাসের আনাচে কানাচে’—’সোনালী প্রকাশন’ থেকে বেরিয়েছিল। আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে। বিমানমামার প্রকাশন ওটা। সেই সূত্রেই মামার সঙ্গেও পরিচয় ছিল ভদ্রলোকের। বইটা পড়তে গিয়ে একটা অদ্ভুত অধ্যায় পড়লাম বুঝলে। ব্রজমোহন চক্রবর্তীর কোনো এক পূর্বপুরুষ বিজয়কৃষ্ণ চক্রবর্তীর গল্প। চক্রবর্তীদের তখনকার পেশা ছিল টোলে পড়ানো। তখন ব্রিটিশরা এসে গেছে ভারতে। কিন্তু ভারতীয় রাজারা তাদের সঙ্গে সন্ধি করেও নিজেদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর। বলতে পারো ব্রিটিশদের বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া পরাধীন রাজার আমল। বিজয়কৃষ্ণর বাবা ছিলেন টোলের পণ্ডিত। কোনো এক বিশালাক্ষী রাজ্যের টোলে তখন পড়াশোনা চলছিল। হঠাৎই সেখানের রাজা টোল পরিদর্শনে আসেন। বিজয়কৃষ্ণ তখন বছর বারোর যুবক। বাবার টোলে পড়াশোনা করছিলেন। মহারাজা এসে বিজয়কৃষ্ণর বাবা বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন—’বিশালাক্ষীর সম্পদ কোথায় সঞ্চিত আছে বলে আপনি মনে করেন?’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলেন, ‘মহারাজার অন্তরে।’ রাজা এবং রাজার পরিষদরা খুশি হয়ে হাততালি দেন।

ছোট বিজয়কৃষ্ণ উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রতিবাদ করেন। এবং বলেন— ‘বিশালাক্ষীর সমস্ত সম্পদ গচ্ছিত আছে এখানের মাটিতে। এখানের কৃষকরা দিনরাত পরিশ্রম করে সেই সম্পদ তুলে দিচ্ছে রাজার হাতে। রাজা তা রাজকোষে সঞ্চয় করছে। আর কৃষকরা মরছে খালি পেটে।’

ওই কথা শোনার পর বিজয়কৃষ্ণর মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেন রাজা। কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা করেন আকুতিমিনতি করে। তখন রাজা বিজয়কৃষ্ণকে এ রাজ্যে থেকে বিতাড়িত করে দেন।

বিজয়কৃষ্ণ বহু জায়গা ঘুরতে ঘুরতে কীভাবে যেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে একটা কাজ পান। বিজয়কৃষ্ণ নিজের বাবার টোলে শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে না পারলেও, বিদ্যাচর্চা তার বন্ধ ছিল না। বিভিন্ন পণ্ডিতের সান্নিধ্যে এসে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি।

এছাড়াও তিনি কোনো এক কুস্তিবিদের সঙ্গে থেকে শারীরিক কসরৎ করতে শেখেন। মোট কথা নিজেকে তৈরি করেন। কিন্তু তিনি যে সেনাবাহিনীতে সৈন্য হিসাবে যোগ দেন এমন নয়। ছিলেন একজন কেরানি। ১৮৮২ সাল। মাত্র পঁচিশ বছর আগে সিপাহি বিদ্রোহের তেজ সামলে উঠেছে ব্রিটিশরা। সেসব যেতে না যেতেই আরও একটা দুর্যোগ। এবার ভারতে নয়, মিশরে। সেইজন্যই বম্বের বন্দরে এসে ভিড়েছে যুদ্ধজাহাজ। শয়ে শয়ে ব্রিটিশদের সৈন্য এসে হাজির হল জাহাজে।

ইতিমধ্যেই ১৮৬৯ সালের নভেম্বর মাসে খুলে গেল সুয়েজ খাল। এশিয়া আর ইউরোপের বাণিজ্যিক রাস্তাটা আরও সহজ হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই সেই দিকে নজর পড়ল ব্রিটিশদের। এশিয়ার এত বড় উপনিবেশ হাতছাড়া করা যায় নাকি! বরং সুয়েজ ব্যবহার করে বাণিজ্যটাকে আরও শক্তপোক্ত করতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে ব্রিটিশ রাজপতাকা। সেইসঙ্গে মিশরের ওপরও একটু ছড়ি ঘোরানো যাবে। শুধু ব্রিটিশ সৈন্য নয়, ভারতীয়দেরও নিয়োগ করা হল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে। সেই কারণেই হয়ত ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনী নাম।

বিজয়কৃষ্ণ চক্রবর্তীও এই সৈন্যদলের সঙ্গে কেরানি হয়েই পৌঁছে যান মিশরে। কিন্তু ব্রিটিশদের অধীনে কাজ করায় তার ছিল তীব্র অনীহা। কারণ ভারত তখনও পরাধীন। তাই আক্রোশ জমে ছিল মনে। সেই কারণেই ব্রিটিশ পাহারাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান তিনি।

 বুদ্ধিমান বিজয়কৃষ্ণ যা দেখেন তাই শিখে নেন। ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণও তার কিছু কম ছিল না। সঙ্গে অল্প বয়সেই অভিজ্ঞতা তাকে পরিণত করেছে।

মিশরে গিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে কোনোভাবে রাজ পরিবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এক রাজ কর্মচারীর হুবহু ছবি এঁকে দেন। রাজকর্মচারী বিস্মিত হয়ে বিজয়কৃষ্ণকে নিয়ে যান মিশরীয় রাজ দরবারে। তিনি নাকি মিশরীয় রাজার ছবিও এঁকেছিলেন হুবহু একবার মাত্র দেখেই। সেই থেকে ওই রাজপরিবারের বিশ্বস্ত কর্মচারী হয়ে রয়ে গিয়েছিলেন অনেকগুলো বছর। ততদিনে তিনি মিশরীয় ভাষায় পারদর্শী হয়েও ওঠেন। শুধু সেই সময়ের মিশরীয় ভাষা নয়, প্রাচীন মিশর নিয়েও ছিল তার প্রবল আগ্রহ। সেই কারণেই এক বৃদ্ধ রাজ পণ্ডিতের সাহায্যে ভীষণ নিষ্ঠার সঙ্গে শেখেন হায়রোগ্লিফ। কারণ প্রাচীন মিশরীয় বইপত্র ছিল হায়রোগ্লিফ ভাষায়। সেগুলোর মর্মোদ্ধার করার জন্যই উনি শিখেছিলেন সম্ভবত। ফারাওদের নিয়ে, ইজিপ্ট নিয়ে বিজয়কৃষ্ণের আগ্রহের অন্ত ছিল না। প্রাচীন মিশরীয় রীতিনীতি জানার আগ্রহ থেকেই তার এই ভাষা শেখার ইচ্ছে জন্মায়। নিজের প্রবল ইচ্ছেতেই ওই ভাষা শিখে ফেলেন অল্প সময়ে।

ওখানেরই এক মিশরীয় মেয়েকে বিবাহও করেন। বলতে গেলে পুরোদস্তুর ইজিপশিয়ান হয়ে যান। তারপরেই আসল টুইস্ট। নিজের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন সব খুইয়েছিলেন বিজয়কৃষ্ণ। শুধু প্রখর বুদ্ধি আর পরিশ্রমের দ্বারাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। অন্য অনেকের থেকে বাস্তববুদ্ধি ছিল অনেক বেশি। তার গোটা জীবনটা একটা ঘটনা প্রবাহ। নাহলে কোন সুদূর বাংলা থেকে মিশরে গিয়েও রাজপরিবারের বিশ্বস্ত কর্মচারী হয়ে থাকতে পারেন? মিশরীয় রাজপরিবার থেকে কিছু সম্পদের মালিকও হয়েছিলেন উনি। ওদিকে অ্যাংলো-ইজিপশিয়ান যুদ্ধের মাধ্যমে মিশর ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসে। শুরু হয় নানা রাজনৈতিক সংকট।

ওই মিশরীয় রাজবংশটিও তখন বিপদের মুখে পড়ে। সকল রাজকর্মচারীকে অস্ত্র ধরতে হবে এমনই নির্দেশ আসে। তাই তিনি স্ত্রী, ছোট পুত্রকে নিয়ে চলে আসেন জন্মস্থানে। সঙ্গে বেশ কিছু সম্পত্তিও নিয়ে আসেন। স্ত্রী বেশিদিন বাঁচেনি। এদেশে আসার পরে বছরখানেকের মধ্যে কোনো একটা দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যায়। বিজয়কৃষ্ণ ছেলেকে মানুষ করেন বাঙালি চক্রবর্তী পরিবারের নিয়ম মেনে। বল্লভচন্দ্র চক্রবর্তীও বাবার মতোই বুদ্ধিমান হয়েছিল। বিশালাক্ষীতে গিয়ে বিজয়কৃষ্ণ বুঝেছিল এখানে চক্রবর্তীদের আর তেমন সম্মান নেই। তাই তিনি যান ধনেখালিতে। পরবর্তীতে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। এই বল্লভচন্দ্রই হলেন ব্রজমোহনের দাদু। এভাবেই বংশপরম্পরায় ওইসব মিশরীয় রাজধন এসে পৌঁছায় ব্রজমোহনের হাতে। সঙ্গে একটা চামড়ার ডায়েরি। যেটা বিজয়কৃষ্ণ লিখতে শুরু করেছিলেন মিশরে বসে। সেটাও ব্রজমোহনের দাদু রেখেছিল ব্রজধামের লাইব্রেরিতে। সেই ডায়েরি সম্পর্কে এই বইয়ের একটা অধ্যায়ে একটু বর্ণনা আছে। সে ডায়েরি বাংলা বা সংস্কৃতে লেখা নয়। খাঁটি চক্রবর্তী হয়েও বিজয়কৃষ্ণ সে ডায়েরি লিখেছিলেন হায়রোগ্লিফে। তাই সেই ডায়েরির পাতায় ঠিক কী লেখা আছে তার হদিস চক্রবর্তী বংশের কেউই পায়নি। সে ডায়েরি হয়তো বাজে জিনিসের সঙ্গে হারিয়েই যেত কিন্তু ডায়েরির চাবি-তালাটা বড্ড আকর্ষণ করেছে চক্রবর্তীদের। তাদের ধারণা এতে কোনো গুপ্তধনের কথা লেখা আছে। ব্রজমোহনের দাদুও এ ডায়েরি সম্পর্কে লিখেছিলেন। আবার ব্রজমোহনের বাবাও চেষ্টা করেছিলেন এই ডায়েরির ভাষা উদ্ধারের। তারপর এর অধিকার পায় স্বয়ং ব্রজমোহন। ইতিহাসের প্রফেসর প্রায় পনেরো বছর কাটিয়ে ফেলেছিলেন এর পিছনে। আদৌ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন কিনা সেটা নিয়ে কিছু লেখা নেই এই বইয়ে। বরং লেখা আছে ব্রজমোহনের দাদু বল্লভচন্দ্র বাংলায় ওই ডায়েরির অল্প একটু অংশ লিখেছিলেন। সেটাই বোধহয় ব্রজমোহন এই ‘ইতিহাসের আনাচে-কানাচে’ বইয়ে ব্যবহার করেছেন।

এমন বহু ছোট ছোট গল্প আছে বুঝলে তো। হরপ্পার আমলের লিপি নিয়েও একটা গল্প লিখেছেন। তবে এটা চক্রবর্তীদের বংশের ইতিহাস বলে আমি এটাই পড়লাম আগে। কৌশিক বলল, ‘জিতা এই যুগে এসে তো প্রচুর ট্রান্সলেট করার মানুষ পেয়ে যেতেন ব্রজমোহন। বা গুগলবাবাজীবন তো আছেই।’

লগ্নজিতা বলল, ‘রাহুল বলছিল ওর বাবা নাকি স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার ব্যবহার করতেন না। ভদ্রলোক এসবে বিশ্বাসই করতেন না। বইপত্র ঘেঁটে সবটুকু নিজে করতেন। আসলে গুপ্তধনের সন্ধান আছে বলেই হয়তো বাইরের কোনো লোকের হাতে চক্রবর্তীরা এই ডায়েরিটা দেয়নি।’

জিতা, ‘তুমি ওই ডায়েরিটা দেখেছো?’ লগ্নজিতা বলল, ‘না, রাহুল হয়তো জানে কোথায় আছে। আমার দেখা হয়নি এখনও। এই বইটা পড়তে গিয়েই এত সব তথ্য জানলাম। আর ওনার প্রাতঃভ্রমণের বন্ধুরা বলছিল, ব্রজমোহন নাকি গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। বাসুদেবকে নাকি ডেকেওছিল দেখাবে বলে, তারপর আর দেখায়নি বলে বাসুদেবের রাগ।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন