সাদা-কালো অ্যালবামটা

অর্পিতা সরকার

‘কী ব্যাপার, আজ হঠাৎ জরুরি তলব কেন? ইনফ্যাক্ট আমার গুপ্তচর খবর দিলো যে তুমি তিন দিন আগে কলকাতা ফিরেছ, তারপরও আমার সঙ্গে দেখা করার সময়ই বের করতে পারলে না জিতা?’

লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘তোমার গুপ্তচর মানে তো আমার রাঁধুনি রেখা। তো সে এটা তোমায় জানায়নি যে আমি দিনরাত ব্যস্ত আছি?’

কৌশিক বলল, ‘এতদিন অবধি জানতাম ডাক্তাররা বেশি ব্যস্ত থাকে। তোমার সঙ্গে পরিচয় হবার পরে বুঝলাম, পুলিশরাও ব্যস্ত থাকে। এর আগে পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল…এনিওয়ে, তোমার হাতটা কেমন আছে দাও দেখি একবার।’

লগ্নজিতা বলল, ‘ভালো আছে। তোমার কাছে আমি চেকআপে আসিনি। অন্য একটা দরকারে এসেছি।’

কৌশিক বলল, ‘মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্কটা বড্ড একতরফা। মানে আমার একারই মনখারাপ করে, একারই তোমায় দেখতে ইচ্ছে করে। আর তোমার তো মাঝে মাঝে এই অধমকে মনেই থাকে না। বুঝলে জিতা? আমার মনে হয় এ জীবনে আমার আর সংসারী হওয়া হল না।’

লগ্নজিতা ফাইলটা টেবিলে রেখে দুটো কফির অর্ডার দিয়ে বলল, ‘কেন হবে না কেন? বলতো আমি ভালো একটা সংসারী মেয়ে দেখে দিই তোমার জন্য? এটুকু আমি করতে পারব।’

কৌশিক বিরক্ত মুখে বলল, ‘সত্যি বলতে কি তোমার এই উপকারী মনটাকে বাঁচিয়ে রেখো। আমি যেদিন এই কলকাতা ছেড়ে হিমালয়ে চলে যাব সেদিন তুমি সঙ্গে একটা ঝোলা দিয়ে দিও। শোনো জিতা, পুলিশ, ডাক্তার এরাও কিন্তু বিয়ে করে। আজীবন আইবুড়ো হয়ে ঘুরছে এমন একখানা পুলিশ দেখাও আমায়।’

 লগ্নজিতা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এই জন্যই ডাক্তারদের আমি একটুও সুযোগ দিতে চাই না। সুযোগ পেল তো ভাইরাল ফিভারকে ডেঙ্গি বুঝিয়ে ছাড়বে। তোমার প্রেম নিবেদন কমপ্লিট হলে বলো, আমার একটা দরকারি কথা আছে।’

কৌশিক কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘না। সেসবের আর সময় কোথায়? সারাদিন রোগী দেখা, নয়তো ওটিতে অপারেশন—এই তো চলছে। তার মধ্যে ম্যাডামের মুড বুঝে একটু কথা বলতে গেলেও ধমক। বললাম তো আমায় তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নাও। তোমার জিপে করে ঘুরব, চব্বিশঘণ্টা তোমায় দেখতে পাব, ব্যস। তোমার কাজে বিশ্বস্ত একজন সহযোগী হব। সেও তো নিলে না। বাধ্য হয়ে ডাক্তারিটা করতেই হবে। কিন্তু জিতা, একটা কথা বলো তো। কতটা ভাগ্য খারাপ হলে মানুষ এমন গোমড়া মুখো পুলিশ অফিসারের প্রেমে পড়ে!’

লগ্নজিতা কফির কাপটা টেবিলে রেখে বলল, ‘আজ তাহলে উঠি কৌশিক। তুমি যে মুডে আছো, তাতে কাজের কথা হবে বলে তো মনে হচ্ছে না।’

কৌশিক বাঁ হাতটা লগ্নজিতার হাতের ওপরে রেখে বলল, ‘প্লিজ। আচ্ছা বলো, কাজটা কী?’

আমায় তোমার মাসিমণির বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে একবার। পূরবী বোসের বাড়িতে।

লগ্নজিতা না সরালেও কৌশিক নিজের হাতটা সরিয়ে নিল লগ্নজিতার হাতের উপর থেকে। থমকে গিয়ে বলল, ‘কেন জিতা? হঠাৎ মাসিমণি এলো কোথা থেকে? হলদিয়া থেকে আমাদের পুরোনো অ্যালবামের ছবি চেয়ে পাঠালে। মাসিমণিকে তুমি চিনলে কী করে? আমার কাছে একটু ক্লিয়ার করো প্লিজ।’

লগ্নজিতা ব্রজমোহন খুনের ঘটনাটা বলার পরেই বলল, ‘সরলাদেবীকে দেখার পর থেকেই মাথার দু-একটা নার্ভ অসম্ভব সচল হয়ে উঠল। বারংবার মনে হতে শুরু করল ভদ্রমহিলাকে আমি দেখেছি। ওই ঠোঁটের নীচে তিলটা টানছিল বেশি। আর একটা জিনিস আছে জানো? ভদ্রমহিলার বয়েস বাড়লেও মুখের সেভাবে পরিবর্তন হয়নি। তাই ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে গেল এনাকে আমি দেখেছি তোমাদের বাড়ির পুরোনো অ্যালবামে। কনফার্ম হবার জন্য ছবি পাঠাতে বলেছিলাম পূরবী বোসের। বুঝলাম, স্মৃতি আমাকে বিট্রে করেনি। আমি ঠিকই চিনেছি সরলাদেবীকে। কিন্তু ওনার সম্পর্কে আমায় আরও জানতে হবে কৌশিক। আসলে উনি যাকে খুনি বলে চিহ্নিত করেছেন, তাকে খুনি মেনে নিলে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তাই সরলাদেবী সম্পর্কে আমার আরেকটু তথ্য চাই।’

কৌশিক শান্ত গলায় বলল, ‘আসলে জিতা, ঠিক বুঝতে পারছি না মাসিমণির সামনে কীভাবে গিয়ে দাঁড়াব। মায়ের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকবার মাসিমণির বাড়িতে। মামা, দাদু কেউ সম্পর্ক রাখেনি মাসিমণির সঙ্গে। এমনকি বাবাও শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে যেতে চায়নি কোনোদিন। তাই মাসিমণি আজ অবধি কোনোদিন আসেনি আমাদের বাড়িতে। কিন্তু মা বায়না করত মাঝে মাঝে। আমিই মাকে নিয়ে যেতাম তখন। মা অসুস্থ থাকাকালীন মাসিমণি একদিন আমাদের বাড়িতে দেখতে এসেছিল, কিন্তু ঘটনাক্রমে সেদিন মামা এসেছিল আমাদের বাড়িতে। তাই মাসিমণিকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। মা মারা যাবার পরে আমার হয়তো যাওয়া উচিত ছিল। আমি যাইনি। কেন যাইনি প্রশ্ন করো না। হয়তো সংকোচে বা বাবার ইচ্ছে নেই বলেই যাইনি। তুমি যে পুরোনো অ্যালবাম দেখেছিলে আমাদের বাড়িতে—ওগুলো সব মায়ের সম্পদ। মা নিজেদের ছোটবেলাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ওইভাবে সাদা-কালো রঙের মধ্যে। ছবিগুলো যাতে নষ্ট না হয়ে যায় তাই প্রায় অ্যালবাম চেঞ্জ করত মা। মা মাসিমণির অভাব দেখে অনেকবার টাকা দিতে গেছে কিন্তু চূড়ান্ত আত্মসম্মান থাকায় মাসিমণি সে টাকা ফেরত দিয়েছে। মা বলত—পূরবীর জেদ তো আমি জানি; লড়াই করবে, তবু মাথা নীচু করবে না।

মায়ের মৃত্যুর পর আর যাইনি। এখন যাওয়াটা কি আদৌ ঠিক হবে জিতা? তার থেকে আমি তোমায় ঠিকানা দিচ্ছি তুমি গিয়ে কথা বলো।

 লগ্নজিতা বলল,’সেটা আমি করতেই পারি, কৌশিক। কিন্তু আমি চাই তোমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হোক। একটি মেয়ে শুধু বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল বলে তাকে অস্পৃশ্য করে রাখাটা বোধহয় এই বাইশ সালে এসে মেনে নেওয়া যায় না। আর সব থেকে বড় কথা তার বয়েসও তো কম হল না। আর কেউ না থাকুক তুমি অন্তত তার পাশে থাকো কৌশিক।’

 কৌশিক শান্তভাবে বলল, ‘বেশ তুমি যখন বলছো, যাব তাহলে। কবে যেতে হবে বলো।’

লগ্নজিতা বিল মিটিয়ে বলল, ‘কবে মানে কী? আজই এখনই চলো। তোমার তো সেকেন্ড হাফে ছুটি আজ।’

কৌশিক বিরক্ত মুখে বলল, ‘ধুর। ভাবলাম একটা সেকেন্ড হাফ ছুটি, তুমি আর আমি একটু ঘুরব। তুমি এত আনরোমান্টিক কেন জিতা?’

লগ্নজিতা কৌশিকের হাত ধরে টেনে বলল,’ডাক্তার নই বলে। চলো এবারে।’

পূরবীদেবীর মুখের সঙ্গে কৌশিকের মায়ের মুখের বেশ মিল আছে। দুই বোন দেখেই বোঝা যায়। কৌশিককে জড়িয়ে ধরলেন মহিলা। কোনো কথা বললেন না। দু-চোখ জলে ভর্তি। ফিসফিস করে বললেন, ‘দিদি চলে গেল, আমায় কেউ দেখতে দিল না রে।’

একটু পরেই নিজেকে সামলে নিয়ে লগ্নজিতাকে খেয়াল করে বললেন, ‘ইনি কে?’

কৌশিক বলল, ‘মাসিমণি ইনি ইন্সপেক্টর লগ্নজিতা ভট্টাচার্য। একটা কেসের বিষয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।’

পূরবীদেবী ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘থানা-পুলিশ থেকে আমি দূরে থাকি। আমার সঙ্গে ঠিক কী কথা?’

লগ্নজিতা তাড়াতাড়ি বলল, ‘না আপনার বিষয়ে কিছু নয়ই। আমি আপনার এক পুরোনো বন্ধুর বিষয়ে একটু জানতে চাইছি।’

 পূরবীদেবী বললেন, ‘পুরোনো কোনো বন্ধুর সঙ্গেই আমার সেভাবে কোনো যোগাযোগ নেই। রমেশের সঙ্গে বিয়ের পর পুরোনো বন্ধু, নিজের আত্মীয়স্বজন সকলেই পর করে দিয়েছিল। থিয়েটারের ছেলেকে বিয়ে করাটা কেউ মেনে নেয়নি। আসলে চালচুলোহীন ছেলে, স্বপ্ন ছাড়া যার চোখে কিছুই নেই—তার সঙ্গে মিশে কেউই নিজের স্ট্যান্ডার্ড নীচু করতে চায়নি।’

লগ্নজিতা বেশ বুঝতে পারল এত বছর পরেও বুকের ক্ষতটা বেশ টাটকা আছে পূরবীদেবীর। খোঁচা লাগলেই রক্ত ঝরবে। কৌশিক বলেছিল, মাসিমণিরা নিঃসন্তান। তবে মেসোমসাই ভীষণ ভালো মানুষ, মাসিমণিকে আগলে রাখেন। তাই অভাব হলেও ওরা ভালো আছে।

লগ্নজিতা পূরবীদেবীকে সামলে নিতে সামান্য সময় দিয়েই বলল, ‘আমি আপনার বন্ধু সরলা সম্পর্কে জানতে এসেছি।’

পূরবীদেবী বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘সরলা? সেটা আবার কে? এই নামে কারোর কথা তো মনে পড়ছে না।’

কৌশিক মোবাইলটা সামনে ধরে বলল, ‘মাসিমণি, এই যে ইনি।’

সরলাদেবীর ছবিটা দেখে ফিক করে হেসে বললেন, ‘এ তো রিন্তি। তাই বল। ওহ মনে পড়েছে, ওর ভালো নাম ছিল সরলা। আমারা মজা করে বলতাম, সরু। ও প্রচণ্ড রোগা ছিল তখন। তাই পোশাকি নামটা বেমালুম ভুলেই গেছি। আর আজকের কথা তো নয় এসব। মনে হচ্ছে যেন গতজন্মের কথা। তখন আমরা সদ্য ইলেভেন পাশ করেছি। আমাদের কমলাসুন্দরীর ভূগোলের শিক্ষক সমীরভূষণবাবু টিফিনের পরের পিরিয়ডে এসে বললেন, স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে একটা নাটক করতে চান। কারা নাম দিতে ইচ্ছুক যেন দিয়ে দিই। দেখলাম গোটা ক্লাস নিস্তব্ধ। একটা হাতও ওঠেনি। সবাই ফিসফিস করছে—বাবারে! তারপর যদি পার্ট ভুলে যাই স্টেজে উঠে? তখন তো গোটা স্কুল হাসবে। স্যার গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন,—তাহলে ইলেভেন আর্টস থেকে একটা হাতও উঠল না?’

হঠাৎই গোটা ক্লাসকে চমকে দিয়ে ক্লাসের সম্মানরক্ষার্থে দুজনের হাত উঠেছিল। একটা হাত আমার, আরেকটা রিন্তির। সেই শুরু আমাদের বন্ধুত্বের। ক্লাসে যে তেমন বন্ধু ছিলাম তা নয়। কিন্তু সমীরভূষণ চট্টোপাধ্যায় আমাদের নাটকের সুতোয় বেঁধে দিলেন। স্কুলের নাটক ছেড়ে আমরা তখন গিরিশ মঞ্চে পৌঁছে গেছি। দুজনের বাড়ির লোকেরই অমত। কিন্তু স্যার পাশে ছিলেন বলে আমরা অনুমতি পেয়েছিলাম। তখনই মৃন্ময় আর রিন্তির প্রেম হয়। একটু ভুল বললাম, রিন্তি ভালোবাসত মৃন্ময়কে। মৃন্ময় সেভাবে সাড়া দেয়নি। আর আমি প্রেমে পড়ি আমাদের নাটকের লিড রোল করত যে , সেই রমেশের। কৌশিকের মেসোমশাইয়ের সঙ্গেই বাড়ি ছাড়ি।’

চমকে উঠেছে লগ্নজিতা। মৃন্ময়? সরলাদেবীর সঙ্গে মৃন্ময়বাবুর প্রেম ছিল! খুনের তদন্ত করতে এসে প্রতি মুহূর্তে একটা করে গোপন পাতার উন্মোচন হচ্ছে লগ্নজিতার সামনে। লগ্নজিতা বলল, ‘মাসিমণি, আমায় একটা কথা বলুন, রিন্তি মানে সরলাদেবীর সঙ্গে মৃন্ময়ের বিয়ে হয়নি কেন?’

পূরবীদেবী বললেন, ‘সে বেশ বড় একটা গল্প আছে। আসলে মৃন্ময়দা একটু রাশভারী মানুষ ছিল। এমনিতে হাসিখুশি হলেও খুব বেশি মিশুকে ছিল না। রিন্তি মনে মনে মৃন্ময়দার প্রেমে পড়েছিল। সমীরভূষণবাবুর সেবারের নাটক ছিল—ঘরে বাইরে। বিমলা হয়েছিল রিন্তি। আর মৃন্ময়দা নিখিলেশ। সেই থেকেই দুর্বলতা জন্মেছিল। মৃন্ময়দা সম্ভ্রান্ত বাড়ির ছেলে ছিল। দেখতেও সুন্দর। রিন্তির প্রেমে পড়তে দেরি হয়নি। কিন্তু মৃন্ময়দা রিন্তিকে প্রেমিকা ভাবতো না। বরং স্নেহের চোখে দেখত। রিন্তির সমস্যা শুরু হয় ওখান থেকেই। কারণ ও তখন মৃন্ময়দা বলতে পাগল। মাঝে মৃন্ময়দা ওকে একটু অপমানজনক কথা বলেছিল বলে ও সুইসাইড করতেও গিয়েছিল। তারপর তো মৃন্ময়দা নাটকের দল ছেড়ে চলে যায়। তখন থেকেই রিন্তির মানসিক সমস্যা শুরু হয়। ওষুধ খেতে হত ওকে। নাহলে ভায়োলেন্ট হয়ে যেত। অথচ নাটকের সময় পার্ট ভুলে যেত না কখনও। তখন একেবারে বাধ্য ছাত্রী। রমেশ বলত—রিন্তি নাটককে ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি। তাই নাটক ওকে মানসিক আশ্রয় দেয়। রমেশ ওকে খুব স্নেহ করত। রমেশের কথা মেনেও চলত রিন্তি। কিন্তু মৃন্ময়দা দল ছেড়ে চলে যাবার পর থেকেই ওর মানসিক সমস্যা শুরু। কল্পনার জগতে বাস করত। একবার আমি গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে ডাক্তারের কাছে। ওই বলেছিল, চল দুজনেই যাই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর রাজেন চৌধুরীর চেম্বারে বসেই ও বলতে শুরু করেছিল, জানিস রাজেন চৌধুরী আমায় প্রপোজ করেছেন? আমি রাজি হইনি। কিন্তু ডক্টরকে দেখে বুঝেছিলাম, এগুলো ওর মনগড়া কথা।’

লগ্নজিতা বলল, ‘কিন্তু ওনার রোগের সিম্পটমগুলো কী আপনার জানা আছে?’

পূরবীদেবী ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না তো। ঠিক কারণগুলো জানি না। ভেবেছিলাম ট্রমা কাটাতে নার্ভের ওষুধ খায় ও।’

কৌশিক লগ্নজিতাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘ডোন্ট ওরি! রাজেন স্যারের সঙ্গে বাবার আলাপ আছে। আমি তোমায় নিয়ে যাব ডিটেলস ইনফর্মেশন পাওয়ার জন্য।’

লগ্নজিতার মাঝেমাঝে মনে হয়, কৌশিক শুধু ওকে ভালোবাসে না, ওর কাজটাকেও ভীষণ সম্মান করে। তাই হয়ত ভালোবাসা নামক জিনিস থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েও কৌশিককে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় ওর। সবসময় যেভাবে ওর পাশে থাকার চেষ্টা করে নিজের ব্যস্ততার মধ্যেও এটাকে অবশ্যই নির্ভেজাল বন্ধুত্ব বলাই যায়। যদিও শুধু বন্ধুত্বের আখ্যা দিলে কৌশিক মুখ গোমড়া করে। এইটুকুতে মোটেই সন্তুষ্ট নয় সে।

লগ্নজিতা বলল, ‘তারপর? সুস্থ হলেন কবে উনি?’

পূরবীদেবী মুখটা করুণ করে বললেন,’হলো আর কই! সেই ছটফটে প্রাণবন্ত রিন্তিকে আমরা আর ফেরত পাইনি। মৃন্ময়দা দল ছেড়ে দেওয়ার পর থেকেই অদ্ভুত একটা বিহেভ করত সকলের সঙ্গে। বেশি কথা বলত না। শুধু নাটকের সংলাপগুলো মন থেকে বলত। তারপরেই আচমকা ডিসিশন নিলো বিয়ে করবে। তাও কাকে? ওর থেকে বেশ খানিকটা বড় কলেজের প্রফেসরকে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়—বিয়ে করার কারণটা। ব্রজমোহনবাবুর বাড়ি নাকি মৃন্ময়দের পাড়ায়। ব্রজমোহনবাবুর কাছে টিউশন নিতে গিয়েছিল কদিন রিন্তি। তারপরেই শুনলাম বিয়ে। বিয়ের পরে আর যোগাযোগ রাখেনি আমার সঙ্গে। অবশ্য একতরফা ওর দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমিও রাখিনি। রমেশকে বিয়ে করে পুরোনো সবকিছুর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম।’

লগ্নজিতা বলল, ‘আচ্ছা মৃন্ময়বাবু কেমন মানুষ ছিলেন?’

পূরবীদেবী একটু অন্যমনস্ক স্বরে বললেন, ‘মানুষটা একটু একলা থাকতে ভালোবাসতেন। একটু গম্ভীর, নীরবে সরে যাওয়া মানুষ। কিন্তু কাউকে বন্ধু ভাবলে বা আপনজন ভাবলে তার জন্য নিজের জীবন দিতে পারতেন। রমেশের নাট্য দলের জন্য বহুবার সাহায্য করেছেন। আসলে মৃন্ময়দার গভীরতা মাপার মতো বোধ তখন আমাদের ছিল না। রমেশের কাছে শুনেছিলাম, মৃন্ময়দা একজনকে ভালোবাসতো কলেজলাইফ থেকে। তাকেই নাকি বিয়ে করেছে। তারপর ধীরে ধীরে সকলে ব্যস্ত হয়ে গেল নিজের জগতে।’

—’কী হলো? মাসিমণির বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকেই লক্ষ করছি একদম চুপচাপ হয়ে গেছো জিতা। ঠিক কী চলছে তোমার মনের মধ্যে বলবে প্লিজ?’ কৌশিক অধৈর্য হয়েই বলল।

লগ্নজিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘গত দুদিনের সব হিসেব গুলিয়ে গেল কৌশিক। মৃন্ময়বাবু খুনি এটা মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সরলাদেবী। আমরাও তদন্তের মুখটা কিছুটা হলেও সেদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। আজ গোপনে মৃন্ময়ের অফিস, ওর পাড়ায় রেপুটেশন এসব খোঁজ নিতে পাঠিয়েছি। এমনকি ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট জোগাড় করার চেষ্টাও চালাচ্ছিলাম। এখন বুঝলাম, সরলাদেবী কেন রাহুল আর চন্দ্রজার সম্পর্ক মেনে নিতে চাইছেন না। কেন ব্রজমোহনের বাকি বন্ধুদের ‘বাবু’ সম্বোধন করলেও মৃন্ময়কে মৃন্ময়দা ডাকেন।

আসলে অভিমানটা সেই সময় থেকেই পুষে রেখেছেন। তাই স্বামীর খুনি হিসাবে মৃন্ময়কে দাগিয়ে দিতে চাইছেন। কৌশিক, ভালোবাসা এত হিংস্র হয়! পূরবীদেবীর কথা মতো সরলা ভালোবাসত মৃন্ময়কে। কিন্তু মৃন্ময় বাসেনি। তাই ওদের বিয়েটা হয়নি। তাই বলে সেই আক্রোশ এই বয়েসে পুষে রেখে মৃন্ময়কে খুনের আসামি বানাতে চাইছেন মহিলা? অদ্ভুত না, মানুষের মন?’

কৌশিক বলল, ‘এর থেকে প্রমাণিত সরলাদেবী কতটা ভালোবাসতেন মৃন্ময়কে। নাহলে এত বছর পরে সন্তানের বিয়ের সময়ে দাঁড়িয়েও প্রথম প্রেমে প্রত্যাখ্যান মনে রাখতেন না। এটা কলেজপ্রেম ছিল না, এর গভীরতা আরও বেশি ছিল। আসলে জিতা, সবার মন একই দিকে একই গতিতে ধাবিত হয় না বলেই মানুষের অভিব্যক্তিগুলো আলাদা।’

লগ্নজিতা হঠাৎই বলল, ‘কৌশিক, আমায় ফিরতে হবে। একটা কাজ মনে পড়েছে।’

 কৌশিক লগ্নজিতার এমন আচমকা সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরিচিত। এর আগেও দেখেছে, হঠাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে ছুটেছে ও। এখন আর কোনো কথা বলা নেহাতই বৃথা। কারণ লগ্নজিতার মাথায় এই মুহূর্তে কোনো ক্লু এসেছে। যেটার নিষ্পত্তি না করে ও দ্বিতীয় কিছু ভাববে না।

যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘সরলাদেবীর আগের ডক্টরের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখো প্লিজ।

আর শোনো তোমার চোখের নীচে কালি পড়ছে, রাত জাগছো নাকি? শরীরের খেয়াল রেখো প্লিজ।’

লগ্নজিতা চলে গেল, কৌশিকের ঠোঁটে হাসির রেখা। যাক ম্যাডামের এটুকু তো চোখে পড়েছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন