রবিঠাকুরের ডাকে

অর্পিতা সরকার

—হ্যালো বিমানমামা, আমায় একটা হেল্প করতে হবে।

বিমানমামা দরাজ গলায় বলল, ‘বলুন ইন্সপেক্টর সাহেবা, কী উপকার করতে হবে আপনার? আমি বেকার মানুষ, উপকারে সিদ্ধহস্ত।’

লগ্নজিতা জানে গল্প করতে শুরু করলে বিমানমামা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারে।

লগ্নজিতা গলায় ব্যস্ততার ভাঙ্গিমা এনে বলল, ‘ব্রজমোহন খুনের তদন্তের ব্যাপারে।’

 মামার গলাটা একটু গম্ভীর হল। বলল, ‘তুই এখনও সেই নিয়ে পড়ে আছিস। আমি তো পুরোনো বন্ধুদের কাছ থেকে খবর নিয়ে জানলাম এটা আত্মহত্যা। খুনই নয়। সরলাদেবীর সঙ্গে মনোমালিন্যর জন্যই ব্রজমোহনবাবু এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’

লগ্নজিতা বলল, ‘মামা, ওটা তদন্ত সাপেক্ষ। আমায় তুমি বলো, তোমার শান্তিনিকেতনে একটা ডুপ্লেক্স ছিল না? ওই বাংলো প্যাটার্ন বাড়ি। বাবা গিয়েছিল বলছিল।’

বিমানমামা বলল, ‘ছিল নয় রে, আছে। তোর মামীর শখের ‘বলাকা’। বাড়িটার নাম বলাকা। সাদা ধবধবে বলাকা। কিন্তু আজ যাইনি প্রায় বছর দুয়েক হল। একজন আছে পরিষ্কার করে রাখে সপ্তাহে একদিন করে। কেন বলতো?’

লগ্নজিতা বলল, ‘আমার ওটা লাগবে তিনদিনের জন্য। আমি হোটেলে উঠতে চাইছি না। ওখানে থাকা যাবে?’

বিমানমামা উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘আলবাৎ যাবে। আমি আজই মহাদেবকে বলে দিচ্ছি আমার ইন্সপেক্টর ভাগ্নি যাবে, যেন সব টিপটপ করে রাখে। শোন হঠাৎ সোনাঝুরিতে কেন? খুনের কোনো তথ্য পেলি নাকি?’

লগ্নজিতা বলল, ‘মামা, তুমি কলকাতায় এলে সবটা বলবো। এখনও ধোঁয়াশায় ঘুরে মরছি। খুনের মোটিভ খুঁজে পাচ্ছি না। খুনি তো কোন ছাড়।’

 বিমানমামা হেসে বলল, ‘মাথার চুলগুলো আমার পেকেছে অভিজ্ঞতায়। এটা খুনই নয়। আত্মহত্যাকে পুলিশ খুন বললে, খুনি পাবে কোথায়? যাইহোক, খোঁজখবর করতে থাক। আপডেট দিস আমায়। বুড়ো বয়েসের এন্টারটেইনমেন্ট। মহাদেবের নম্বরটা লিখে নে। ওকে ফোন করে চলে যাস যে কোনোদিন।’

লগ্নজিতা দেখল, ইন্দ্রজিৎ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার অপেক্ষায়। ইন্দ্রজিৎকে ডাকতেই ও একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ম্যাডাম, রাহুল চক্রবর্তী, মানে ব্রজমোহনবাবুর ছেলে এসেছে থানায়। মন্টুর মিসিং ডায়েরি নিতে হবে বলে তর্ক করছেন। নিজেরাই তাড়িয়ে দিয়ে এখন থানায় এসে হম্বিতম্বি করছে ভদ্রলোক।’

 লগ্নজিতা বলল, ‘অবশ্যই মিসিং ডায়েরি নিতে বলো। কাজ হয়ে গেলে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও ওকে।’

ইন্দ্রজিৎ বলল, ‘কিন্তু ম্যাডাম…’

 লগ্নজিতা আর কথা না বাড়িয়ে ফোন থেকে কৌশিককে টেক্সট করল—আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট কনফার্ম তো সরলাদেবীর ডক্টরের সঙ্গে?

কৌশিক কল করে বলল, ‘ইয়েস ম্যাডাম। আপনার আদেশ এই অর্বাচীন ডাক্তার ফেলে কী করে! কিন্তু মাসিমণি যে ডক্টরের নাম বলল, এ তো সে নয় মনে হচ্ছে। তিনি তো পুরুষ ছিলেন।’

 লগ্নজিতা বলল, ‘হ্যাঁ। উনি যার কথা বলেছিলেন, তিনি আর চেম্বার করেন না। যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। সরলাদেবীকে প্রায় বছর পনেরো ধরে অন্য একজন দেখছেন। আমার ধারণা যদি ভুল না হয়, তাহলে ইনি আরও কিছু জট ছাড়াতে পারবেন।’

কৌশিক বলল, ‘আশা করি তুমি ডেটটা শনি-রবি রেখেছো। তাহলে আমিও যেতে পারি সোনাঝুরি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে।’

লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই ডক্টরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট শনিবারেই করেছো?’

কৌশিক একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি কি আমায় নিয়ে যেতে চাও না?’

 লগ্নজিতা বুঝল, গলায় অভিমান ভরা। তাই হেসে বলল, ‘আরে না না, অবশ্যই তুমি যাচ্ছ। আমি শান্তিনিকেতন যাচ্ছি এটা থানার কেউই জানে না। তাই কোনো অফিসারকেই সঙ্গে নেব না। এবারের কাজে তুমিই থাকবে।’

কৌশিক নরম গলায় বলল, ‘আচ্ছা তাহলে হোটেল বুক করতে হবে তো?’

লগ্নজিতা বলল, ‘ওসব কমপ্লিট। তুমি শুধু তোমার ব্যাগ নিয়ে রেডি থেকো। আমি তোমায় পিকআপ করে নেব।’

কৌশিক বেশ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘জিতা, আমার এই পানসে ডাক্তারি জীবনে ওষুধের গন্ধের মধ্যে ভাগ্যিস তুমি এলে। তাই বুঝতে পারলাম, জীবন প্রতিমুহূর্তে রোমাঞ্চকর। রোগী, ওষুধ, ওটিকে ভালোবেসে দিনগুলো বড্ড একঘেয়ে ভাবে কেটে যাচ্ছিল। যবে থেকে লগ্নজিতা ভট্টাচার্য আমার জীবনে এলো, তবে থেকে সবকিছুর মধ্যেই আমি রহস্যের গন্ধ পাই।’

লগ্নজিতা আলতো করে বলল, ‘এটা প্রশংসা হিসাবে নেব নাকি তোমায় নানা ভাবে বিপদে জড়িয়ে দিয়েছি, তাই নিন্দে হিসাবে নেব?’

কৌশিক হেসে বলল, ‘খুব ফারাক হবে কি তাতে তোমার আচরণের? তাহলে আর হিসেবনিকেশ করে লাভ কী? চললাম, আউটডোর আছে।’ ফোনটা রেখে দিল কৌশিক।

 লগ্নজিতা নিজের মনেই হেসে নিল। মাঝে মাঝে কৌশিক এমন ছেলেমানুষি অভিমান করে। তবে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না কাজের চাপে। দরজায় নক করছে লগ্নজিতার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটি। সঙ্গে রাহুল দাঁড়িয়ে আছে। অশৌচের কারণেই দাড়ি কাটেনি। কাছা পরিহিত অবস্থাতেই দেখে এসেছিল লগ্নজিতা ওকে সেদিন বাড়িতে। আজ দেখল, একটা সাদা পাজামা পরে এসেছে। বেশ উস্কোখুস্কো লাগছে। চোখ দুটো উত্তেজনায় অথবা নির্ঘুম রাত কাটানোর জন্য বেশ লালচে হয়েছে। লগ্নজিতা ইশারা করতেই সামনের চেয়ারে এসে বসল রাহুল। তারপরেই উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘ম্যাডাম, মন্টু আজ তিনদিন বাড়ি ছাড়া। আমি থানায় মিসিং ডায়েরি লেখাতে এসেছি। আপনার ওই অফিসার ইন্দ্রজিৎবাবু কিছুতেই মিসিং ডায়েরি নিতে চাইছেন না। বলছেন, আমরাই নাকি মন্টুকে সরিয়ে দিয়ে এসব নাটক করছি। আপনিই বলুন ম্যাডাম, এভাবে প্রেশার দেওয়া কি ঠিক? এত বছর মন্টু এ বাড়ির মেম্বারের মতো আছে, হঠাৎ বাবা মারা যেতে যখন এ বাড়ির তাকে আরও বেশি করে প্রয়োজন তখন তাড়িয়ে দেব? মাইনে মন্টু নেয় না। সবই বাবা ওর অ্যাকাউন্টে জমা করত। আমাদের সে অবস্থা হয়নি যে মন্টুকে তাড়িয়ে দিতে হবে ওই সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য। তাছাড়া ওর অ্যাকাউন্টয়ের সব আমার কাছেই থাকে বরাবর। প্লিজ ম্যাম, ওকে খুঁজে বের করুন। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে ওর বড় বিপদ হয়েছে।’

লগ্নজিতা বলল, ‘আপনারা বাড়িটাকে ভালো করে খুঁজে দেখুন। আপনাদের বাড়িতে তো প্রচুর দুর্মূল্য জিনিসপত্র ছড়ানো রয়েছে, সেসব চুরি যায়নি তো?’

রাহুলের ভ্রুতে ভাঁজ। বিরক্তির সুরে বলল, ‘ম্যাডাম, এসব জিনিস তো গতকাল আসেনি বাড়িতে। এতদিন কেন নিয়ে পালায়নি? তাছাড়া জিনিসপত্রে কোনো লোভ ওর কোনদিনই ছিল না। ওর একটাই নেশা ছিল—বাগানে ফুল ফোটানো। গাছের ফুল কেউ তুললেই ও অগ্নিমূর্তি ধারণ করত। বাদবাকি কোনো কিছুতে ওর কোনো মোহ ছিল না।’

লগ্নজিতা চিন্তিতভাবে বলল, ‘রাহুল, দিনরাত খবরে পড়ছেন না, তেরো বছরের বিশ্বস্ত পরিচারক খুন করে দেয় তার মালিককে? তাই মন্টু যে সম্পূর্ণ নির্দোষ এতটা বিশ্বাস কেন করছেন? এমনও তো হতে পারে মন্টুই খুনি। কদিন চুপ করে থেকে শোকের নাটক করেছে, এখন পুলিশি তল্লাশি চলছে দেখে পালিয়ে গেল।’

রাহুল বলল, ‘ম্যাডাম! বাবা বলত, বাবা নাকি এত বছর ধরে ছাত্র তৈরি করেছে, তাই বাবা মানুষ চেনে। সেই বাবা বলত—মন্টুর মধ্যে যে সততা আমি দেখেছি, তা এ বাড়ির কারোর মধ্যে নেই। তাহলে তো বলতে হয়, বাবার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ভুল। মানে মন্টু যদি বাবার খুনি হয় ম্যাডাম, তাহলে সন্তান তার মায়ের কোলকে নিরাপদ ভাববে না। বাবার আর মন্টুর সম্পর্কটা তেমনই ছিল। আমি বিশ্বাস করি না মন্টু বাবাকে খুন করেছে।’

লগ্নজিতা বলল, ‘সে আপনার বিশ্বাস নিয়ে তো লাভ নেই। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফুট প্রিন্ট এসেছে। ওগুলো মেলাবো আগে। মিসিং ডায়েরি করে, মন্টুর ছবি দিয়ে যান। আরেকটা কথা—অযথা নিজের পারিবারিক কেচ্ছা বা দুর্বলতা ঢাকতে যাবেন না। তাতে তদন্তের অসুবিধা হয়। যেটুকু জানেন সেটা সঠিকভাবে বলবেন।’

রাহুল মাথা নীচু করে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার মায়ের মানসিক সমস্যা ছিল, আছে। মা হঠাৎ যা কল্পনা করে সেটাকেই সত্যি বলে প্রতিস্থাপন করতে চায়। আপনি সেদিন মায়ের ঘর থেকে প্রেসক্রিপশনটা ছবি তুলে এনেছেন সম্ভবত। টেবিলে ছিল ওটা। হয়তো দেখেছেন মা দুটো রোগের শিকার। প্যারানয়ড ডিলিউশন আর স্কিৎসোফ্রেনিয়া। মা হঠাৎ হঠাৎ এমন কিছু কথা বলে যা কখনও ঘটেইনি। কিন্তু মা অত্যন্ত বিশ্বাসের সঙ্গে এগুলো বলে এবং লোকজনকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। আসলে মা যা কল্পনা করে, সেগুলোকেই বাস্তবে ভাবে। আগে আচমকা ভায়োলেন্ট হয়ে যেত। এখন ওষুধ খেয়ে শান্ত থাকে। কিন্তু আজগুবি ধারণা, সন্দেহবাতিক মনোভাবটা যায়নি। আর কোনো কিছুতেই সন্তুষ্টি নেই মনে। আমার হয়তো আপনাকে বলা উচিত ছিল, কিন্তু মায়ের সম্পর্কে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। আসলে মা আমার খুব সফট কর্ণার। আমি জানি মা এগুলো স্বেচ্ছায় করছে না। এগুলো রোগে করছে।’

রাহুল বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘মন্টুকে খোঁজার ব্যবস্থা করুন ম্যাডাম। কিডন্যাপারের ফোন এলে টাকা চাইত, তাহলেও আমি টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতাম। কিন্তু তেমন কোনো ফোনও আসেনি।’

লগ্নজিতা ভাবছিল, এখনও কিছু কথা রাহুল বলল না। আড়ালেই রেখে দিল। না বলার হয়তো কারণ আছে। তবুও রাহুল আরেকটু সাহায্য করলে লগ্নজিতার উপকার হত। কিন্তু রাহুলকে এখন প্রেশার দিয়ে বিশেষ লাভ হবে না। বরং ওর সাহায্য দরকার লগ্নজিতার।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন