অর্পিতা সরকার
প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে পরবর্তী জীবনের নাম ছিল ‘দ্য ফিল্ড অফ রিডস’ (আরু)। যা পৃথিবীতে বসবাসকারী জীবনের একটি নিখুঁত প্রতিরূপ। মৃত্যুর কারণে একজনের জীবন থেকে যা যা হারিয়ে গেছে বলে ভাবা হয়ে থাকে, তা পরকালে এক আদর্শ রূপ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। সেখানে তার পার্থিব সব জিনিসপত্র মৃতদেহের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করা হয় যাতে, ওই জগতে কোন অসুবিধা না হয়।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে বা সমাধিতে মমি স্থাপনের আগে ‘ওপেনিং দ্য মাউথ’ নামে এক অনুষ্ঠান হতো। এই অনুষ্ঠানটাও দৈহিক শরীরের গুরুত্বকেই বেশি করে পেশ করত। আত্মা যাতে মৃত্যুর পরেও দেহটাকে ব্যবহার করতে পারে তার জন্য মৃতদেহকে পুনর্জীবিত করার আচার পালন করা হতো। একজন পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে এক বিশেষ ধারালো চাকুর মতো ফলা দিয়ে মৃতদেহের মুখ স্পর্শ করতেন। (যাতে মৃতদেহ আবার শ্বাস নিতে পারে, খেতে পারে এবং পান করতে পারে) হাত ও পা স্পর্শ করা হত ওই ফলা দিয়ে, যাতে সমাধিস্থলে চলাফেরা করতে পারে। একবার মৃতদেহকে সামাধির ভিতর শুইয়ে দেওয়া হলে সমাধিস্থল সীলমোহর লাগিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হত। অন্যান্য নানান মন্ত্র পাঠ এবং প্রার্থনা চলত তার সঙ্গে। যেমন ‘দ্য লিটানি অফ ওসাইরিস’ (ফারাওয়ের ক্ষেত্রে, ‘দ্য পিরামিড টেক্সটস’) পাঠ করতে করতে মৃতকে পরলোকে যাত্রা শুরু করার জন্য ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসার পথ ধরত শোকার্ত পরিবার পরিজনেরা।
যেহেতু মমিকরণ পদ্ধতি খুব ব্যয়বহুল ছিল, তাই দরিদ্র মানুষেরা মৃতদেহকে মোড়ানোর জন্য তাদের ব্যবহৃত পোশাক মৃতদেহ সংরক্ষণকারীদের দিত। এর সূত্রেই এক শব্দবন্ধ জন্ম নেয়, ‘দ্য লিনেন অফ ইয়েস্টারডে’।
আমি বিজয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী এই তথ্য লিখছি হায়রোগ্লিফ ভাষায়। আমি চাই আমার এই ডায়েরি পড়ার জন্য ভবিষ্যতে আর কোনো চক্রবর্তীর বংশধর এ ভাষা শিখুক। আমি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে শিখেছিলাম এ ভাষাটা। তাই এ ভাষাতেই লিখলাম আমার জীবনের গল্প। আমারই কোনো বংশধর জানুক আমার জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ের গল্প।
আমার প্রথম সন্তান বিনয়মোহন চক্রবর্তী আজ মারা গেল। বয়েস মাত্র ছয় বছর। আমি রাজকর্মচারী। আমার আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়া সত্ত্বেও যেখানে রাজকর্মচারীদের আত্মীয়দের কবরস্থ করা হয় সেখানে আমার সন্তানের স্থান হল না। রাজবংশের উত্তরাধিকারীর নির্দেশে আমার সন্তানকে কবরস্থ করতে হল অন্যত্র।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলেই হয়তো এ অন্যায়।
আমি আমার সন্তানকে কবর দিলাম ওখানের নিয়ম মেনেই। কিন্তু তার পাশেই কবরস্থ করা হল, দুটো কুকুরকে। একজন মিশরীয় মহিলার দুই আদরের কুকুর।
সারারাত ছটফট করতে থাকি। মনে হয় কুকুর দুটো সারারাত বিনয়কে কামড়ে খাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে কবর খুঁড়ে বের করি কুকুর দুটোকে। কুকুরের সঙ্গে দেওয়া সমস্ত মূল্যবান জিনিসগুলো রেখে দিই নিজের কাছে। কুকুর দুটোকে বাইরে এনে কবরস্থান আগের মতো বন্ধ করে কুকুরগুলোকে ব্যাগে নিয়ে রাতের অন্ধকারে হেঁটে গেলাম আমি। শহর থেকে অনেকটা দূরে।
রাতের নিস্তব্ধতা সময় বলতে নারাজ। শুধু আকাশের তারারা আর ঘন অন্ধকার বুঝিয়ে দিচ্ছে এটা গভীর রাত। একটা খাদে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসি কুকুরগুলোকে।
প্রাচীন মিশরীয় রীতিতে সমাধিতে সীলমোহর লাগানোর কাজ সমাপ্ত করে, শোকার্তরা এক ভোজের আয়োজন করত। যা ছিল মৃত ব্যক্তির জীবনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করা। সাধারণত যেখানে সমাধিস্থ করা হতো তার আশেপাশেই এই ভোজসভার আয়োজন হতো। এটা শেষ হলে বাকিরা নিজেদের তাদের বাড়িতে ফিরে যেত এবং তাদের জীবন শুরু করত। ধরেই নিত বিদেহী আত্মা সমাধির ভিতর জেগে উঠবে। তারপর সে যাত্রা করবে আনুবিসের পথে। এসব মিশরীয়রা বিশ্বাস করত। বহু বইতেও ফারাওদের মমিকরণ পদ্ধতিরও উল্লেখ আমি পেয়েছি।
ওদের নিয়ম অনুযায়ী তো বিনয়েরও যাত্রা করার কথা। কিন্তু বাঙালি ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে পুত্রকে কবর দেওয়ায় আমি অস্বস্তিতে ভুগছিলাম।
পুত্রকে তুলে আনব ভেবেই মধ্যরাতে বের হলাম। একটু গিয়েই দেখলাম, রাতের অন্ধকারে কারা যেন অন্যান্য কবরের মৃতদেহ সরাচ্ছে। পাশাপাশি কবরগুলো খুঁড়ে খুঁড়ে। সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান জিনিস। মিশরীরা তখনও কবরের সঙ্গে মূল্যবান জিনিস দেওয়ায় বিশ্বাসী ছিল। আমার হাতে লণ্ঠন আর লাঠি দেখে ওর ভয় পেল। রাজার পাহারাদারের মতোই হাঁক দিলাম। সব ফেলে তারা পালালো। বহুমূল্যবান সম্পত্তি পথে পড়ে রইল। আমি সেসব কুড়িয়ে আনলাম। লুকিয়ে রাখলাম আমার ঘরের কোণে। ওগুলো নিয়ে ফিরে আসব ভাবলাম নিজের রাজ্যে। কিন্তু শেষপর্যন্ত শুধু প্রাণটুকু নিয়েই ফিরে আসি। কারণ তখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন চলছে মিশরে। রাজকর্মচারীদের জীবনও বিপন্ন। সঙ্গে আনতে পেরেছিলাম অল্প কিছু সম্পদ। মূল্যবান কিছু মূর্তি আর কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য কয়েন। যা রাজকর্মচারী থাকাকালীন পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম এক বৃদ্ধ রাজপুরোহিতের কাছ থেকে। যেটুকু সম্পত্তি রাজকর্মচারী থাকাকালীন সংগ্রহ করেছিলাম সেই নিয়েই ফিরতে হল। মৃতের সম্পত্তি ভোগের অধিকার কারোর নেই সেই ব্যক্তি ব্যতীত। এ কথা মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন। এখন আমিও করি। এ ডায়েরিতে কোনো সম্পত্তির হদিশ নেই। এ ডায়েরি চক্রবর্তী পরিবারের এক ঘরছাড়া ছন্নছাড়া মানুষর গল্প বলবে। তবে ওই কয়েনগুলো আর মূর্তিগুলো দুষ্প্রাপ্য। এ বংশের কেউ যেন বিক্রি করে না দেয়। এগুলো আমার অর্জিত সম্পদ।
শুদ্ধশীল বলল, ‘ম্যাডাম মোটামুটি যা চোখ বোলালাম, প্রাচীন মিশরীয় রাজাদের একেকজনের সময়ে মৃত্যু সম্পর্কে একেক রকমের নিয়ম চালু হয়েছিল। উনি ওখানের বহু বই পড়ে এবং দেখে অনেক বিষয় সম্পর্কে জেনেছিলেন। মৃত্যু, মমি, তার পরবর্তী নিয়মাবলী…সে বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন বিজয়কৃষ্ণ। কিন্তু কোনো গুপ্তধনের সন্ধান তো এখানে নেই। উনি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কীভাবে মিশরে পৌঁছান, কীভাবে ওখানের রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ হন, কেনই বা পালিয়ে আসেন স্ত্রী সন্তান নিয়ে, কোন রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ঘটে তখন মিশরীয় রাজতন্ত্রে এসব নিয়েই লিখেছেন।’
শুদ্ধশীল সাম্মানিক অর্থ নিয়ে রাহুলের হাতে ডায়েরিটা দিয়ে চলে গেল। রাহুল ফিসফিস করে বলল, ‘চন্দ্রা আমি হায়রোগ্লিফ শিখব। এ ডায়েরির প্রতিটা অক্ষর পড়ব আমি। বাবাও তার মানে আবিষ্কার করেছিল কোনো গুপ্তধনের সন্ধান নেই এতে, তাতেও বাবার এটাকে দুর্মূল্য গুপ্তধনই মনে হয়েছিল। কারণ চক্রবর্তী বংশের বিজয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী চেয়েছিলেন শুধু তাঁর বংশেরই কেউ এটা পড়ুক। তিনি বাংলায় বা ইংরেজিতে লেখেননি, কারণ চাননি এখানের যে কেউ এটা পড়ে এর মর্মোদ্ধার করতে পারুক।’ চন্দ্রজা রাহুলের হাতটা ধরে বলল, ‘আঙ্কেল যখন পেরেছিল তুমিও পারবে।’
সরলাদেবীর চোখদুটো অস্বাভাবিক লাল। ধীর পায়ে চন্দ্রার দিকে এগোতে দেখেই মেঘবালা বলল, ‘রিন্তিদি তোর মনে আছে আমাদের বাড়ির কুয়োর পাড়ে আমরা তিন-চার বোন মিলে সিনেমা সিনেমা খেলতাম। তুই সব থেকে ভালো অভিনয় করতি, গান গাইতিস, সেই গানগুলো মনে আছে তোর?’ সরলাদেবী থমকে গেলেন। বাচ্চাদের মতো হেসে গেয়ে উঠলেন, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আহা, হাহা, হা। আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের …’
মেঘবালার হাতটা ধরে টানছিলেন নাচবেন বলে। মেঘবালা শান্ত গলায় বলল, ‘যাবি আমার শান্তিনিকেতনের বাড়িতে। আজ তো ব্রজদা নেই। ব্রজদাকে আমি কেড়ে নেব এমন ভাবনাও তোর নেই। চল আমরা দুজনে থাকি। ব্রজদা ওপর থেকে দেখুক, চক্রবর্তী বংশের সম্পত্তির লোভে আমি তোর চিকিৎসার দায় নিচ্ছি না রিন্তিদি।’ রাহুল বলল, ‘মাসিমণি আমার মা খুনি নয়। আমর মা খুন করেনি কাউকে।’
মৃন্ময়বাবু বললেন, ‘ব্রজদা বলত, সরলা মেরে ফেলব বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেও শেষপর্যন্ত ও খুনটা করতে পারে না মৃন্ময়। তুমি চিন্তা করো না তোমার মেয়েকে নিয়ে। কী করে ব্রজদা এতটা ভরসা করত সরলাকে সেটা অবশ্য আমার অজানা ছিল না। সরলার অদ্ভুত পজেসিভনেস ছিল ব্রজদার প্রতি। নাকি আশ্রয় হারিয়ে ফেলার ভয় জানি না। ব্রজদাকে কোন মহিলার সঙ্গে মিশতে দিত না। এ এক অদ্ভুত চরিত্র। আমাদের নাটকেও এমন চরিত্র বিরল।’
লগ্নজিতা বলল, ‘বাসুদেববাবু মানিক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না। লোকটা কিন্তু ক্রিমিন্যাল। খুব তাড়াতাড়ি আমি ওকে ধরব। তখন আপনারও বিপদ।
আর ওই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা যখন আপনাকে তার রেয়ার কম্পাসটা দেবেন না বলছেন, তখন প্রায়ই আপনি ওনাকে গিয়ে বিরক্ত কেন করছেন? ওটা ওনার স্বামীর জাহাজের ক্যাপ্টেন থাকাকালীন অর্জিত জিনিস। অযথা বিরক্ত করবেন না।’
অমিতবাবু আপনার শালাকে বলুন, ‘তৃষার রেপ কেসটা ওপেন হবে। তার আগেই যেন উনি যাদের আড়াল করেছিলেন তাদের নামগুলো বলে দেন।
বর্ণালীম্যাম আপনার ছেলে নির্দোষ। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি। কিন্তু এই কেস ওপেন হলে ওর হেল্প চাই হয়তো।’ বর্ণালীদেবী ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘সব রকম হেল্প আমরা করব আমাদের দিক থেকে।’
সরলাদেবী তখনও গাইছেন নিজের আনন্দে…
‘কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে—
তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি।
আহা, হাহা, হা’
লগ্নজিতা মাকে কল করে বলল, ‘ক্ষমা করো মা, ব্রজমোহন চক্রবর্তী, মন্টু, ইন্দ্রজিৎ তিন তিনখানা খুনের দায়ে বিমানমামাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হলাম। যাবজ্জীবন হবেই। জেলেই হয়ত মারা যাবে।’
ওদিকে ডুকরে কেঁদে উঠল মা। ‘জিতা তোর মামা নিঃসন্তান। এত সম্পত্তি। হলদিয়ায় বাড়ি, কলকাতার কাজরীদের বাড়িটাও ওই পেয়েছে। শ্বশুরের সব সম্পত্তি বিমান পেয়েছিল, কাজরী একমাত্র সন্তান হবার কারণে। দুজনে শখ করে শান্তিনিকেতনে বাংলো বানিয়েছিল, এরপরেও ওর সম্পত্তির লোভ ছিল! এই বয়েসে এসে এসব কী করল বিমান! কিসের লোভ ওর যে খুন করতে হল ওকে?’
লগ্নজিতা শান্ত গলায় বলল, ‘খুন করার জন্য লোভ দরকার নেই, আচমকা উত্তেজনা দরকার, হঠাৎ রাগের দরকার। বন্ধু বিমানমামাকে ডায়েরিটা দিচ্ছে না এই আক্রোশ থেকেই খুন হয়ে গেল ব্রজমোহন। তোমরা কলকাতায় তো? এলে একবার এসো দেখা করে যাও।’
মা কেঁদে বলল, ‘হাতকড়া পড়া অবস্থায় ওকে দেখতে চাই না জিতা। আমি ওকে রাখী পরাতাম যে। তোর বাবা যাবে বলছে যাক।’
কৌশিক দেখল, লগ্নজিতা বিমানবাবুর দিকে তাকাচ্ছেও না ভুলে। অন্য দুজন কনস্টেবলই ওনাকে পুলিশ ভ্যানে তুলল। বিমানবাবু ইশারায় কৌশিককে ডেকে বলল, ‘লগ্নজিতাকে ছোটবেলায় আমি রাজকুমারী বলে ডাকতাম। তোমরা কখনও শান্তিনিকেতন গেলে বলাকাতে ঘুরে এসো।’ কৌশিক কী বলবে বুঝতেও পারছে না!
পুলিশ ভ্যান চলে গেল। লগ্নজিতা নিজের গাড়িতে উঠল। কৌশিক বলল, ‘বিমানমামা খুন করেছে বুঝেই তুমি বাবা-মাকে হলদিয়া থেকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলে?’
জিতা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘আমার বাবা অথবা মাকে আটকে রাখলে আমি দুর্বল হয়ে যাব, এই সম্ভাবনা অপরাধীর মাথায় আসা স্বাভাবিক ছিল। মামা একবার ডাকলেই বাবা-মা নির্দ্বিধায় চলে যাবে যেকোনো জায়গায়। মৃন্ময় বা চন্দ্রজা বা রাহুল, সরলা কাউকে খুন করে দিলে আরও জটিলতা বাড়বে। সেটাও এই মুহূর্তে মাথায় আসা স্বাভাবিক। কারণ অপরাধী তখন কলকাতাতেই ছিল। তাই ওদের গার্ডের ব্যবস্থা করেছিলাম। আমরা শান্তিনিকেতন থেকে ফিরতে ফিরতে উনি খবর পেয়ে গিয়েছিলেন যে আমরা বেরিয়ে এসেছি। কারণ ওই টোটোওয়ালা গিয়ে ফিরে আসবে, মহাদেবও। উনি ততক্ষণে বুঝে যাবেন আমি ধরে ফেলেছি খুনি কে! আমার সন্দেহ হয়েছিল, বিমানমামার কথাবার্তা শুনে। উনি বলছেন, সেই লাইব্রেরিয়ান থাকার সময় লাস্ট ব্রজমোহনবাবুর সঙ্গে ওনার যোগাযোগ হয়েছিল। অথচ কথার স্রোতে বলে ফেলেছিলেন ওর প্রাতঃভ্রমণের বন্ধুরা কী বলছে? খুনি কে?’
শিবনাথবাবুর সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম ওনারা প্রাতঃভ্রমণ শুরুই করেছেন বছর চারেক। বিমানমামা বোঝাতে চাইল গত দশ বছর উনি ব্রজমোহনের নামই শোনেননি। তাহলে এ তথ্য পাওয়ার কথা নয়। এমন অনেক ছোট ছোট অসংগতিতে আমার একটাই কথা মনে হচ্ছিল, কেন অযথা মিথ্যে বলছে? ঠিক কী কারণে? তারপর আরও অনেক অসংগতি ধরা পড়ল প্রমাণ সমেত।
কৌশিক বলল, ‘আর মেঘবালা? তাকে কী মনে হল?’ লগ্নজিতা বলল, ‘ব্রজমোহনকে ভালোবাসত, ব্রজমোহনও হয়তো দুর্বল ছিল। কিন্তু উনি জানতেন না বিমানমামা খুনি। উনি জানতেন সরলাদেবী খুনি। তাই রাগে, অভিমানে চক্রবর্তী বাড়ির ডায়েরিটা ব্রজমোহনের প্রিয় বন্ধুর হাতে তুলে দেন। কারণ উনি দেখেছিলেন, বিমানমামা আর ব্রজমোহন এইসব ভাষা নিয়ে রাতের পর রাত চর্চা করছে। ব্রজমোহনও হয়তো শেষে ভেবেছিলেন, বিমানমামাকে বলে সোনালী প্রকাশনা থেকে এ ডায়েরিটা বই আকারে প্রকাশ করতে। তাই বলেছিলেন, তুমি প্রকাশক তোমারও লাভ হবে। ব্রজমোহনের কাছে বংশের ইতিহাস গুপ্তধনের চেয়েও মূল্যবান ছিল। কিন্তু বিমানমামা ওই আবিষ্কারকে দুজনের বলে চালাতে চেয়েছিলেন। কারণ প্রচুর মিশরীয় দুষ্প্রাপ্য বই জোগাড় করে দিয়েছিল বিমানমামা। ব্রজমোহনের মৃত্যুর সময় ওনার টেবিলে যে বইটা খোলা আছে তাতেও লেখা, ‘মহৎ কাজের অভিপ্রায়ে বন্ধু ব্রজকে উপহার স্বরূপ বিমান।’
কৌশিক বলল, ‘একটা অল্পবয়সী একতরফা প্রেম ভেঙে যাওয়ায় সরলাদেবীর জীবনটা অদ্ভুত খাতে বইলো।
সরলাদেবীকে ভালোবেসেও না পাওয়ায় ব্রজমোহন শুধু মানিয়েই নিল। মেঘবালাকে ভালোবেসে বন্ধুত্ব হলেও, ওর মুখশ্রীর জন্যই সম্পর্কটা অসমাপ্ত রয়ে গেল। মৃন্ময়বাবু আজীবন মানসিক যন্ত্রণায় কাটিয়ে দিলেন ব্রজমোহনের বিশ্বাস আর সরলার অবিশ্বাসের চাপে পড়ে। চন্দ্রজা আর রাহুল বুঝতেই পারছিল না ওদের সম্পর্কটা পরিণতি পাবে কিনা! বড় জটিল জিতা মানুষের জীবন।’ লগ্নজিতা বলল, ‘বিমানমামা ছোটবেলায় আমায় কোলে নিয়ে চড়কের মেলায় যেত, ওই হাত দিয়ে আমার গালে হাত বুলিয়ে আদর করত। যে হাত দুটোতে আমি আজ হাতকড়া পরালাম।’ কৌশিক হাতটা রাখল লগ্নজিতার হাতে। জিতা কৌশিকের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। গাড়ির সিটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। সেই মামাবাড়ির চিলেকোঠার ঘরটা ভাসছে চোখের সামনে… নিজের মামা ছিল না, দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। বিমানমামাই সে ঘাটতি পূরণ করত। ওই তো সেই চিলেকোঠার ঘরে নীল ফ্রকটা পরে চোর-পুলিশ খেলছে জিতা। সামনের ছাদে রোদে পিঠ দিয়ে বই পড়ছে বিমানমামা।
কৌশিক খেয়াল করল, বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে আছে জিতা আজ। কানের কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল, ‘তোমার প্রিয় চায়ের দোকান পেরিয়ে যাচ্ছে, গাড়িটাকে দাঁড় করাই?’ লগ্নজিতা ঘাড় নেড়ে না বলল।
কৌশিক বলল, ‘তুমিই তো বলো জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে তোমার সামনে। আজও জীবন এই চ্যালেঞ্জটা আনলো তোমার সামনে, ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে স্বাভাবিক থাকতে হবে তোমায়।’
লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক আজ তোমায় ভীষণ দরকার ছিল আমার। ভিতরের ক্ষরণটা বন্ধ হতে একটু সময় লাগবে জানো।’
জিতা তোমার ফোন বাজছে, ‘রিসিভ করো।’
—হ্যালো, লগ্নজিতা ভট্টাচার্য বলছি…কী বললেন? মার্ডার? কোথায় হয়েছে? কৌশিক আমায় একবার যেতে হবে। একটা ব্যাংকের মধ্যে কিছু ঘটেছে।
কৌশিক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘নতুন কেস?’ ঘাড় নেড়ে গাড়ি ঘোরাতে বলল ইন্সপেক্টর লগ্নজিতা ভট্টাচার্য।
কৌশিক হেসে বলল, লগ্নজিতা ভট্টাচার্যের সুস্থ হতে আরেকটা জবরদস্ত কেস চাই বুঝলে জিতা?
সমাপ্ত
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন