মৃন্ময়বাবু কি খুনি

অর্পিতা সরকার

মৃন্ময়বাবু কি খুনি

—হ্যালো রাহুল! তুমি আমার ফোন কেন রিসিভ করছ না? এত টেক্সট করছি,—সেগুলো ‘সিন’ হচ্ছে, একটারও উত্তর দিচ্ছ না। আঙ্কেল মারা গেছেন খবরটা আমি বাবার কাছ থেকে পেলাম। তারপর থেকে যোগাযোগ করার কত চেষ্টা করছি, ফোন কেটে দিচ্ছ কেন? এই রাহুল প্লিজ কথা বলো। আমি বুঝতে পারছি তুমি আপসেট আছো। আঙ্কেলের এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছো না, কিন্তু আমিও পাঁচদিন ধরে তোমার সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারছি না। প্লিজ কথা বলো।’

রাহুল একটু গম্ভীর গলায় বলল, ‘চন্দ্রজা, তুমি মৃন্ময়কাকুকে কাইন্ডলি একটু জিজ্ঞাসা করবে, কেন উনি বাবার মৃত্যুর দিনে ভোর চারটে পনেরোর সময় আমাদের বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তার কিছুক্ষণ পরে আমি বাবার ঘরে ঢুকেই দেখেছিলাম, বাবা মৃত। মৃন্ময়কাকুকে মা নিজের চোখে আমাদের বাগান দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। আমি মানলাম তোমার বাবার আমায় পছন্দ নয়। আমাদের বিয়েটা হোক কাকু চান না। তাই বলে এভাবে বাবাকে মেরে ফেলবেন উনি?’

চন্দ্রজা প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠল, ‘কী বলছো তুমি রাহুল? আর তুমি বোধহয় জানো না আমার বাবার তোমায় অপছন্দ নয়। অপছন্দ তোমার মাকে। আমি মাকে হারিয়েছি উচ্চমাধ্যমিকের পরেই। তখন থেকেই আমার মা-বাবা সবই আমার বাবা। একা হাতে আমায় মানুষ করেছে। আজ আমি বড় চাকরি করছি, প্রতিষ্ঠিত হয়েছি—সবই বাবার জন্য। বাবা ভেবেছিল বিয়ের পর আমি আবার নতুন করে মায়ের আদর পাব। কিন্তু তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে বাবা বুঝতে পেরেছে, আমার সে সৌভাগ্য কোনোদিন হবে না। তাই বাবার এ বিয়েতে অমত। তোমাকে অপছন্দ নয় মোটেই। আর ব্রজআঙ্কেল তো বাবার কাছের বন্ধু। তাকে অপছন্দের কোনো জায়গাই নেই রাহুল। কিন্তু তুমি আর তোমার মা অযথা আমার বাবার মাথায় যে দোষটা চাপিয়ে দিতে চাইছো, তার থেকে পরিষ্কার বলে দিলেই পারতে আমাদের সম্পর্কটা তুমি ভেঙে দিতে চাইছো। রাহুল, চারবছরের সম্পর্ক ভেঙে দেবার জন্য এতটা নীচে না নামলেও পারতে। শুধু একবার বলতে—চন্দ্রজা লিভ মি। এক কথায় চলে আসতাম। তাই বলে…’

চন্দ্রজার কথাটা শেষ হবার আগেই রাহুল বলল,’ তাহলে তো আমার মায়ের চোখকে অবিশ্বাস করতে হয় চন্দ্রা, তাই না? আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম, মৃন্ময়কাকু বাবার মৃত্যুর পরের দিন থেকে আর ওয়াকে যাননি। কোথায় আছেন উনি?’

চন্দ্রজা কান্না চেপে বলল, ‘বাবার জ্বর এসেছে। আঙ্কেলের খবরটা শুনে ভেঙেও পড়েছে খুব। বন্ধুত্বটা তো কমদিনের নয় তাই। তুমি ইচ্ছে হলে বাড়িতে এসে দেখে যেতে পারো। বাবা শহর ছেড়ে গা ঢাকা দেয়নি। এ বাড়িতে তো তোমার অবারিত দ্বার ছিলই। চক্রবর্তী বাড়ির দরজা অবশ্য আমার জন্য খুলতে রাজি ছিলেন না তোমার মা। আজকের পর চন্দ্রজা নামটাও ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় যাওয়ার চেষ্টা করবে না কখনও।’

রাহুল বলল, ‘চন্দ্রা, তুমি একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়ছ। দেখো, মৃন্ময়কাকু যে সেদিন ওই সময়ে এসেছিলেন—এটা তো ঠিক। আমার মাথায় তো এটাই ঢুকছে না, অত ভোরে বাবার কাছে কেন এসেছিলেন উনি। ওনারা তো রোজ পার্কে মিট করেন। চন্দ্রা, তুমি বরং অঙ্কেলকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখো, সঠিক উত্তর পাও কিনা। ইনফ্যাক্ট আমি সেদিন ইন্সপেক্টর লগ্নজিৎ ভট্টাচার্যের সামনে মৃন্ময়কাকুর নামটাকে আসতে দিইনি। মা জেরার মুখে বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি আটকে দিয়েছি। সেটা তোমাকে ভালোবাসি বলেই। তাই বলে সন্দেহের তিরটা তো মৃন্ময়কাকুর দিকেই ঘুরে যাচ্ছে। বিশেষ করে পোস্টমর্টেমে মার্ডারের টাইম দেখে। বাবা খুন হয়েছে ওই চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যেই। এরপরেও মৃন্ময়কাকুকে তুমি আড়াল করার চেষ্টা করবে চন্দ্রজা?’

চন্দ্রজা দৃঢ় গলায় বলল, ‘তুমি আটকিও না। পুলিশকে তাদের ডিউটি করতে দাও। পাঠিয়ে দিও কাল আমাদের বাড়িতে পুলিশ। কিন্তু আজকের পর থেকে চন্দ্রজাও মৃত তোমার চোখে। আরেকটা কথা শুনে নাও রাহুল, আমার কাছে যদি পুলিশ আসে, আমিও কিন্তু সরলাদেবী সম্পর্কে যা জানি সব বলব। রাহুল চক্রবর্তীর মা বলে আলাদা রেসপেক্ট করব না।’

রাহুল চেঁচিয়ে বলল, ‘চন্দ্রা, প্লিজ না।’

চন্দ্রজা ফোনটা কেটে দিল নিঃশব্দে।

চন্দ্রজার দু-চোখ ছাপিয়ে নোনতা জল কখন যে ওর চিবুক ছুঁয়েছে সেটা ও নিজেও বুঝতে পারেনি। এই চারদিন ধরে ভাবছিল, ব্রজআঙ্কেলের সাডেন ডেথে রাহুল আপসেট। তাই ওর ফোন রিসিভ করছে না বা মেসেজ সিন করেও উত্তর দিচ্ছে না। এটা খুব নরম্যাল। বাবা চলে গেলে মনের অবস্থা ঠিক কী হতে পারে—সেটা আন্দাজ করেই শিউরে উঠেছিল চন্দ্রজা। তাই রাহুলের মনের অবস্থা ভেবেই ক্রমাগত ছটফট করছে। বারবার মনে হয়েছে ছুটে যেতে রাহুলের কাছে। ওর হাতটা ধরে বলতে, আমি আছি তোমার পাশে, তোমার সমস্ত প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। কিন্তু রাহুলের মা সরলাআন্টি চন্দ্রজাকে তেমন পছন্দ করেন না। অপছন্দের কারণটা অবশ্য জানতে বাকি নেই চন্দ্রজার। তবে রাহুলের মা বলেই কখনও অসম্মান করেনি ওনাকে। গত চার-পাঁচদিনের ছটফটে অস্থির কষ্টটা যে রাহুলের সঙ্গে কথা বলে ঘৃণাতে পরিণত হতে পারে দশ মিনিট আগেও ভাবতে পারেনি চন্দ্রজা। রাহুল চন্দ্রজার বাবাকে এতদিন চেনার পর এমন মিথ্যে অপবাদ দিয়ে দিল এক নিমেষে! কল্পনা করতে কষ্ট হচ্ছে চন্দ্রজার। অথচ এটা সত্যি। রাহুল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোঝাতে চাইল ব্রজমোহনআঙ্কেলের মৃত্যুর জন্য বাবা দায়ী! চন্দ্রজার বাবা মৃন্ময় মণ্ডল—যে রান্নাঘরে বেড়াল ঢুকলে লাঠি দিয়ে না তাড়িয়ে, গায়ে জল ছিটিয়ে তাড়ায়, সে নাকি খুনি! তাও কাকে খুন করেছে! এতদিনের প্রাণের বন্ধুকে! ছি! ছি! রাহুল এটা ভাবল কী করে! রাহুলের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাওয়ার আওয়াজটা শুনতে না পেলেও তীব্রভাবে অনুভব করছে চন্দ্রজা। এই মুহূর্তে চোখের অবাধ্য জলকে নিষেধ করতে যাওয়া বোকামি ভেবেই ডুকরে কেঁদে উঠল ও। বাবা এসে কখন পিছনে দাঁড়িয়েছে।

ওর কান্নার দমক সামলানো পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলল,—’রাহুলের মন মেজাজ ঠিক নেই হয়তো। এখন ওর সঙ্গে ঝগড়া করিস না চন্দ্রা। দুদিন যেতে দে সব ঠিক হয়ে যাবে। চল, কালকে ওদের বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসি। ব্রজদা ছাড়া ওই বাড়িতে ঢুকব কি করে কে জানে! তবুও যাওয়া তো কর্তব্য। সেদিন যেতে চেয়েও যেতে পারিনি। ব্রজদাকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখতে পারব না বলেই যাইনি। কিন্তু একবার আমাদের যাওয়া দরকার।’

চন্দ্রা বলতে পারল না, ‘বাবা, রাহুল তোমাকে ওর বাবার খুনি ভাবছে।’ তাই আচমকা চিৎকার করে বলল,’ না। আমরা এখন ওই বাড়িতে যাব না। তুমিও যাবে না বাবা। ব্রজআঙ্কেল তো নেই, কার কাছে যাবে?’

বাবা করুণ স্বরে বলল, ‘পাগলী। রাহুলের ওপরে রাগ করিস না এসময়।’

চন্দ্রা হঠাৎই গালের জলটা মুছে বলে বসল, ‘বাবা, তুমি শুক্রবার দিন ভোরে আঙ্কেলদের বাড়ি কেন গিয়েছিলে? চারটে পাঁচ-দশে কেন গিয়েছিলে?’

মৃন্ময় মাথা নীচু করে বলল, ‘ব্রজদার সামনে যাওয়া হয়নি। ওদের বাগান থেকেই ব্যাক করেছিলাম। কেন বলতো? তোকে কে বলল?’

‘জেঠু, একজন মহিলা পুলিশ অফিসার এসেছেন। আপনাকে ডাকছেন।’,পারুল বলল।

পারুল এ বাড়িতেই থাকে। পরিচারিকা নয়, ঠিক যেন এ বাড়ির মেম্বার। পারুলের নিজের পরিবার নেই। চন্দ্রজা আর মৃন্ময়ই ওর দিদি আর জেঠু। খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল পারুলের। তারপর শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে লোকের বাড়িতে কাজে লেগেছিল। তখন থেকেই রয়ে গেছে ওদের ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে। পুলিশ দেখে পারুল যে ভয় পেয়েছে, সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

মৃন্ময় একটু অবাক আর বিচলিত গলায় বলল, ‘হ্যাঁরে চন্দ্রা পুলিশ কেন?’

চন্দ্রজা বুঝল, সরলাদেবী সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশের কাছে বাবার নাম বলে দিয়েছে। তাই পুলিশ তদন্তে নেমেই সোজা ওদের বাড়িতেই এসেছে। বাবাকে একা যেতে দেওয়া ঠিক হবে না বুঝেই, নাইটির ওপরে ঝট করে হাউজকোটটা গলিয়ে নিয়ে চন্দ্রজা বলল, ‘চলো বাবা।’

—ইন্সপেক্টর লগ্নজিতা ভট্টাচার্য। আপনিই মৃন্ময়বাবু? মৃত ব্রজমোহন চক্রবর্তীর বন্ধু? বসুন মৃন্ময়বাবু। ইন্দ্রজিৎ, প্লিজ নোট করো ওনার কথা। আপনি নির্ভয়ে বলুন। সরলাদেবী জানিয়েছেন ওদিন ভোর চারটে পাঁচ-দশ নাগাদ আপনাকে ওনাদের বাগান দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন। এটা কি সত্যি মৃন্ময়বাবু?’

মৃন্ময় ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘বাগান অবধিই গিয়েছিলাম। তারপর ব্যাক করেছি। ব্রজর ঘরে যাওয়া হয়নি। বাইরে অপেক্ষা করছিলাম কিছুক্ষণ। ব্রজ বেরোলো না দেখে চলে এলাম ফিরে।’

লগ্নজিতা বলল, ‘ফিরে কোথায় গেলেন? যুবসংঘের মাঠে নিশ্চয়ই। ওখানেই তো আপনারা মর্নিংওয়াক সারেন।’

মৃন্ময় মাথাটা নীচু করে বললেন, ‘না ফিরিনি। ব্রজদা বেরোলো না দেখে মিনিট পনেরো পরে বাড়ি ফিরে এলাম। শরীরটা ঠিক লাগছিল না। পরে বুঝলাম জ্বর এসেছে।’

লগ্নজিতা একটু দৃঢ় স্বরে বলল, ‘কিন্তু মৃন্ময়বাবু, আপনার এমন গল্পকথা তো আমার কেসে টিকবে না। ব্রজমোহনবাবুর মৃত্যুর টাইম চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তাই বলছে। সরলাদেবী আপনাকে বেরোতে দেখেছে ওই সময়েই। আপনিও স্বীকার করলেন গিয়েছিলেন। এবারে বলুন তো, বন্ধুকে খুনটা কেন করলেন? কিসের আক্রোশ থেকে?’

চন্দ্রজা বলে উঠল, ‘অফিসার, আমার বাবার কিন্তু হাই ব্লাড প্রেশার আছে।’

লগ্নজিতা ধীর গলায় বলল, ‘বয়স্ক মানুষ বলেই আমি নিজে এসেছি। নাহলে থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে জেরা করতাম। বলুন মৃন্ময়বাবু, খুনটা কেন করলেন? এই বয়েসে এসে এমন কী ঘটল যে এতদিনের পুরোনো বন্ধুকে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হল?’

মৃন্ময় অবাক হয়ে বলল, ‘খুন? কে খুন হয়েছে? ব্রজমোহন আত্মহত্যা করেছে আমি শুনলাম। আমায় শিবনাথ ফোনে সেটাই বলেছিল। এখন খুন এলো কোথা থেকে? তাছাড়া ব্রজদাকে খুন কে করবে? ব্রজদার মানসিক কষ্ট তো আজকের নয়। চেপে থাকে সেটা ঠিকই। কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা ওর বহুদিনের। তবে ব্রজদার এই আচমকা সুইসাইড আমি মানতে পারিনি। ঠিক বিশ্বাস করিনি।’

লগ্নজিতা মৃন্ময়ের কথার সুর ধরে বলল, ‘ঠিক বলেছেন। সবাই মৃত্যুটাকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চাইলেও আমি জানি এটা খুন। বলতে পারেন ঠান্ডা মাথায় খুন। প্রশ্নটা হল খুনটা আপনি কেন করলেন?’

মৃন্ময় চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘অদ্ভুত প্রশ্ন করছেন তো আপনি! ব্রজকে খুন করব আমি? মাথাটা খারাপ নাকি আপনার? মন্টুকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন আমি সেদিন বাড়িতে ওদের বারান্দায় উঠেছিলাম, নাকি বাগান থেকেই ফেরত এসেছি। আর তাছাড়া আমি ব্রজদাকে খুন কেন করব? খুনের মোটিভ কী? সেদিন থেকেই জ্বরে বেহুঁশ হয়ে ছিলাম বলে মৃত্যু সংবাদ পেয়েও ব্রজদার বাড়িতে যেতে পারিনি। আজকেই চন্দ্রাকে বলছিলাম—চল ঘুরে আসি। ব্রজবিহীন ব্রজধামে যাব কী করে সেটাই ভাবছিলাম। আর আপনি বলেন কিনা আমি খুন করেছি?’

লগ্নজিতা জানে অপরাধী নিজেকে গার্ড করার জন্য সমস্ত রকমের চেষ্টা করে। সেটাই স্বাভাবিক। মনস্তত্ত্ব বলছে, সব খুনের মোটিভ থাকে না। কখনও শুধু হিংসা বা রাগের কারণেও মানুষ খুন করে দেয়। মৃন্ময়ের বাড়ি বা স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং—দেখেই বোঝা যাচ্ছে অর্থনৈতিক ভাবে বেশ স্বচ্ছল। টাকার প্রয়োজনে খুন হয়তো করেনি মৃন্ময়, কিন্তু উনি যে কিছু একটা করেছেন সেটা ওনার ঘনঘন চোখের পলক ফেলা থেকেই বুঝতে পেরেছে লগ্নজিতা। সাইকোলজি বলছে, কোনো মানুষ যখন মিথ্যে বলে, তখন সে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে ঘনঘন আর চোখের পাতাও ফেলে দ্রুত। মৃন্ময়বাবুও এই মুহূর্তে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাইছেন। লগ্নজিতা স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। চন্দ্রজার মুখেও কিছু একটা লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।

লগ্নজিতা বলল, ‘বেশ। মেনে নিলাম আপনি খুন করেননি। তাহলে অত ভোরে আপনি ঠিক কী করতে ওই বাড়িতে ঢুকেছিলেন?’

মৃন্ময় অধৈর্য গলায় বললেন, ‘ব্রজদার সঙ্গে পার্সোনাল একটু প্রয়োজন ছিল। পরে সিদ্ধান্ত নিই, দুদিন যাক তারপরেই বলব।’

লগ্নজিতা বলল, ‘সেই বিশেষ পার্সোনাল কথাগুলো যে আপনাকে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে মৃন্ময়বাবু। নাহলে আমার সন্দেহের তালিকায় আপনি এক নম্বরে উঠে আসবেন।’

চন্দ্রজা বিরক্তির সুরে বলল, ‘যতক্ষণ না আপনি সলিড এভিডেন্স দিতে পারছেন যে আমার বাবা খুন করেছে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি বোধহয় এভাবে ট্রিটমেন্ট করতে পারেন না মিস ভট্টাচার্য।’

লগ্নজিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আইনটা আপনি বেশ ভালোই জানেন দেখছি। তাই এটুকুও মনে হয় জানেন যে সাসপেক্টেডকে বারংবার জেরা করার অধিকার আমার আছে যেহেতু কেসটার ইনভেস্টিং অফিসার আমি। এনিওয়ে, আমি আবার আসব। মৃন্ময়বাবু, আপনার ডান হাতের কনুইয়ের নীচে থেকে লম্বা কাটা দাগটা বড্ড টাটকা লাগছে। ব্রজবাবুর বাগানের গোলাপ গাছের কাঁটাগুলো ভীষণ রকমের তীক্ষ্ন দেখছি। ওষুধপত্র লাগিয়ে দেবেন মিস চন্দ্রজা বাবার হাতে। ডোন্ট ওরি, সেরে যাবে। তাড়াহুড়োয় বেরোতে গিয়ে ছিঁড়ে গেছে নিশ্চয়ই। যাইহোক, ততদিনে আপনি বন্ধুকে হারানোর কষ্টটা একটু স্টেবল করে ফেলুন। আর আমার সন্দেহের তালিকা থেকে নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করুন মৃন্ময়বাবু।’

লগ্নজিতা ইন্দ্রজিৎকে ইশারা করতেই ও উঠে পড়ল।

দুজনে বেরিয়ে এসে গাড়িতে ওঠার আগেই লক্ষ করল, মৃন্ময়বাবু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মুহ্যমানভাবে। চন্দ্রজা হাত নেড়ে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। মৃন্ময় সে কথার উত্তর না দিয়ে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

লগ্নজিতা গাড়িতে উঠেই বলল, ‘বুঝলে ইন্দ্রজিৎ? মৃন্ময়বাবু কথা গোপন করছেন। খুন করেছেন কিনা জানি না, তবে বহু কথা গোপন করলেন উনি ও ওনার মেয়ে।’

 ইন্দ্রজিৎ বলল, ‘ম্যাডাম, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে মৃন্ময়ই খুনি। রেগুলার মর্নিংওয়াকের জন্য বন্ধুকে ডাকতে যান না উনি। তাহলে সেদিন কেন গেলেন? গেলেনই যদি তাহলে দেখা না করে ফিরে এলেন কেন? সরলাদেবীর কথা মতো, ওনাকে ডেকেওছিলেন সরলাদেবী। তারপরেও উনি না দাঁড়িয়ে হনহন করে পালিয়ে কেন এসেছিলেন? এতগুলো প্রশ্নের উত্তর কিন্তু নেই ওনার কাছে। এরপর ম্যাডাম, আর তো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আমি বলছি শুনুন, অ্যারেস্ট হিম। বয়েসের দোহাই দিয়ে পালাতে চাইলেই তো হবে না, ইনিই খুনি।’

লগ্নজিতা বলল, ‘আমার ইনভেস্টিগেশন তো আজ সবে শুরু ইন্দ্রজিৎ। এতেই এত উত্তেজিত হলে হয়?’

ইন্দ্রজিৎ লজ্জিত স্বরে বলল, ‘ম্যাডাম, এই কেসটায় আমি আপনাকে সম্পূর্ণ হেল্প করতে চাই। মানে আপনার সঙ্গে থাকতে চাই।’

লগ্নজিতা ড্রাইভারকে বলল, ‘ ব্রজধাম চলুন। দেখি ব্রজমোহন চক্রবর্তীর বাড়ির বর্তমান অবস্থাটা কেমন। মন্টুকে কথা বলানো দরকার।’

ইন্দ্রজিৎ আফসোসের সুরে বলল, ‘হ্যাঁ, দেখুন চেষ্টা করে। তবে আমি শিওর খুনি এই মৃন্ময়।’

বাড়ির বাইরে সাদা শ্বেতপাথরের ফলকের ওপরে লেখা— ‘ব্রজধাম’ -১৩৬৬। নিজের নাম দিয়েই বাড়ির নাম রেখেছিলেন ব্রজবাবু। নাকি এ বাড়ি তার পিতৃপুরুষের? বাড়ির বয়েস দেখে তো মনে হয় ব্রজমোহনের দাদু তার নাতির নামে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন।

সাজানো বাগান পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল লগ্নজিতা।

সরলাদেবী একাই ড্রয়িংরুমে বসেছিলেন। মীনাক্ষীই বেলের আওয়াজে দরজা খুলে দিয়েছিল। লগ্নজিতা মীনাক্ষীকে সামনে পেয়েই অতর্কিতে আক্রমণ করল। আচমকা বলল, ‘তারপর মন্টুবাবু আজ কী বলল তোমায়? বলেনি বাগানে ঘাস হয়েছে পরিষ্কার করা দরকার?’

মীনাক্ষী একটু হকচকিয়েই বলল, ‘মন্টু তো কথাই বলছে না কদিন ধরে। চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। জেঠুর শখের বাগান পরিষ্কার করছে, জেঠুর পড়ার ঘরে যেহেতু আপনারা তালা দিয়ে গেছেন—তাই দরজাটার সামনে ধূপ জ্বালিয়ে রাখছে সন্ধেবেলা। কিন্তু কথা তো কারোর সঙ্গেই বলছে না। রাহুলদাদা কতবার বলছে—মন্টু কথা বল…কিন্তু সে যেন মুখে কুলুপ এঁটেছে।’

লগ্নজিতা বুঝল, মীনাক্ষী হয় সত্যি বলছে নাহলে পুরোটাই এ বাড়ির প্ল্যান মতো চলছে মেয়েটা। একটাই হিসেব মিলছে না। যদি এবাড়ির সবাই খুনটাকে চেপে রাখতে চাইতো, তাহলে সুনীল আর বিকাশ যখন আত্মহত্যা বলে দায় সেরেছিল তখন রাহুল কেন হাঁপাতে হাঁপাতে থানায় গিয়েছিল? বড় রকমের একটা গরমিল আছে। সেটা ঠিক কী কিছুতেই বুঝতে পারছে না লগ্নজিতা।

 সরলাদেবী ড্রয়িংয়ে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। লগ্নজিতাকে দেখেই বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘আবার এসেছেন আপনারা?’

ইন্দ্রজিৎকে ইশারায় লগ্নজিতা বাইরে দাঁড়াতে বলল।

লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘পূরবী বোসকে আপনার মনে আছে ম্যাডাম? আপনারা এক সঙ্গে নাটক করতেন। একই স্টেজে পারফর্ম করেছিলেন বহুবার।’

সরলাদেবী একটু চমকে বললেন, ‘আপনি কী করে জানলেন? পূরবীকে চেনেন নাকি? সেসব তো বহুকাল আগের কথা। পূরবীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই বহুকাল। আমাদের নাট্যসংস্থারই রমেশদাকে বিয়ে করেছিল। তারপর বহুদিন দুজনে নাটক করতও।’

 লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘আপনাকে কিন্তু লাডলী বেগমের চরিত্রে অসাধারণ মানিয়েছিল।’

সরলাদেবী একটু চমকে বললেন,’ আপনি কোথায় দেখলেন?’

লগ্নজিতা বলল, ‘এক বন্ধুর ফ্যামিলি অ্যালবামে দেখলাম আপনার বেশ কিছু ছবি। ওই কলেজ লাইফের। যদিও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে চেহারায়, তবে নীচের ঠোঁটের পাশের তিলটা ছাড়া। আপনি তো ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন দেখলাম। অবশ্য এখনও আছেন।’

 লগ্নজিতা খেয়াল করছে, সরলাদেবীর মুখের কঠিন শিরাগুলো অল্প হলেও কাঠিন্য হারাচ্ছে। কথায় বরফ গলবে বুঝেই বলতে শুরু করল ও। ‘আসলে আমার ওই ডাক্তার বন্ধুর বাড়িতে প্রচুর পুরোনো অ্যালবাম আছে। একদিন আমি সেগুলো দেখছিলাম। তখনই ও বলেছিল পূরবী বোস ওর মাসিমণি হয়। বাড়ির অমতে বিয়ে করায় মামার বাড়ির কেউই নাকি সম্পর্ক রাখেনি মাসির সঙ্গে। পূরবী বোসের পাশে জ্বলজ্বল করছিলেন আপনি। যে কারোর চোখে পড়বেই।’

সরলাদেবী বললেন, ‘ওহ! আপনার বন্ধু তার মানে পৌষালীদির ছেলে। পূরবীর দিদি। ওরা দুই বোন, এক ভাই ছিল। তখন ওদের বাড়িতে খুব গেছি। পৌষালীদি খুব ভালো ছিল পড়াশোনায়। এসব নাটকে তার ইন্টারেস্ট ছিল না। তাই আমাদেরও বারণ করত এসব নাটক-থিয়েটার করতে। কিন্তু আমরা তখন মঞ্চের নেশায় পাগল। পৌষালীদির অ্যালবাম দেখেছেন আপনি। দিদিই সব ছবি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখত। এক রিল করে ছবি তোলা হত পূরবীর বাবার ক্যামেরায়।’

লগ্নজিতা বলল, ‘হ্যাঁ, পৌষালীদেবীই আমার বন্ধুর মা। যদিও উনি আর জীবিত নেই। মারা গেছেন বেশ কয়েকবছর আগেই।’

আনমনে স্মৃতির পাতা উল্টে উল্টে সেই কলেজ লাইফে নাটকের দিনগুলোতে চলে গিয়েছিলেন সরলাদেবী। আচমকা পৌষালীদির মৃত্যু সংবাদ শুনে বললেন, ‘সেকি! ডাক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল শুনেছিলাম।’

লগ্নজিতা বলল, ‘হ্যাঁ ঠিকই শুনেছিলেন। কার্ডিওলজিস্টের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তবুও রোগ ভোগ করে মারা গেছেন।’

সরলাদেবী আনমনে বললেন, ‘পূরবীই বোধহয় ঠিক করেছিল রমেশদাকে বিয়ে করে। সচ্ছলতা না থাকুক, ইচ্ছেটার মূল্য তো দিত রমেশদা। এই তো পৌষালীদির অত বড়লোক বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল, জীবন তো তবুও হারিয়ে দিয়ে গেল।’

বেশ আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন সরলাদেবী। মনের নরম জানালাগুলোর খোঁজ পেয়ে গেছে লগ্নজিতা।

‘সেটা অবশ্য আপনি ঠিকই বলেছেন ম্যাডাম। এই যে ব্রজমোহনবাবুর মতো প্রফেসরের স্ত্রী হয়ে সমাজে হয়তো আপনার মান বেড়েছিল, কিন্তু আপনার প্রতিভার মৃত্যু হয়েছিল।’

সরলাদেবী একটু ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ‘ব্রজ কবে কার কথা ভেবেছে? নিজের কলেজ, নিজের রিসার্চ, নিজের নেশা নিয়েই তো আজীবন ব্যস্ত ছিল। আমি তো গরিব ঘরের মেয়ে। ওর শিক্ষার আলোর নীচে চাপা পড়ে ছিলাম আজীবন। আমিও যে গান গাইতাম, আমিও যে কবিতা বলতাম, নাটক করতাম, গ্র্যাজুয়েশন করেছিলাম—সেসব ও কোনোদিন মনে রেখেছে নাকি?’

লগ্নজিতার খারাপ লাগছিল ভদ্রমহিলার দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিতে, কিন্তু তদন্তের খাতিরে এটা ওকে করতেই হবে। লগ্নজিতা বলল, ‘আসলে জ্ঞানী মানুষরা একটু স্বার্থপর হন বলেই শুনেছি। নির্বিবাদীও হন অবশ্য। তবুও দেখুন—এমন জ্ঞানী, নির্বিবাদী মানুষকেও কেউ খুন করে দিয়ে গেল বাড়িতে ঢুকে! অদ্ভুত। তাই না মিসেস চক্রবর্তী?’

সরলাদেবী বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘অদ্ভুতের তো কিছু নেই। ওকে খুন করেছে প্রাণের বন্ধু মৃন্ময়। কারণ ওই চন্দ্রজার সঙ্গে আমি রাহুলের বিয়ে দেব না এটা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম। সেটাই ব্রজ ওকে আগেরদিন মর্নিংওয়াকে গিয়ে বলেছিল বোধহয়। তাই আক্রোশ থেকেই বাড়িতে ঢুকে খুন করে দিয়ে গেল। আমি তো বিয়ে দেব না বলিনি। আমি বলেছিলাম চন্দ্রজার বিয়ের পরে চাকরি করা চলবে না। এই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে হবে। চন্দ্রজা তাতে রাজি নয়। মৃন্ময়দাও আমায় চার কথা শুনিয়ে গেছে ওই কারণেই। আমার নিজের ছেলে রাহুলকে পর করে দিতে চায় ওই মেয়ে। এ বিয়ে আমি বেঁচে থাকতে দেব না। মৃন্ময়দা যদি মনে করে থাকেন ব্রজ মারা গেছে বলে আমরা অসহায় হয়ে ওদের পাশে চাইব—তাহলে ভুল।’

লগ্নজিতা বলল, ‘রাহুলের সঙ্গে চন্দ্রজার বিয়ের কথা কে বলেছিল?’

সরলাদেবী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কেউ বলেনি। ওই মেয়ের সঙ্গে রাহুলের নাকি সম্পর্ক আছে, এমনই দাবি করে মৃন্ময়দা। এবারে আমিও দেখি রাহুল বাবার খুনির মেয়েকে বিয়ে করে কিনা!’ সরলাদেবীর চোখ দুটো আচমকাই একটু জ্বলে উঠল যেন। প্রতিশোধস্পৃহা নাকি ওইটুকু একটা মেয়ের বিরুদ্ধে! নাকি নিজের অনেক কিছু না পাওয়া জমে জমে এমন হয়েছে সেই তথাকথিত শাশুড়ি বৌমার সমস্যার মতো!

লগ্নজিতা বলল, ‘ওনাদের মর্নিংওয়াকের সকলকে আপনি চেনেন?’

সরলাদেবী বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘জানবো না কেন? এই দলটা তো প্রায়ই বাড়িতে এসে চায়ের আসর বসায়। শিবনাথবাবু, অমিতবাবু, বাসুদেববাবু আর মৃন্ময়দা ছিল আগে। কিন্তু পুরুষমানুষের তো বয়েস হলেও স্বভাব যায় না, তাই এই পাড়ারই দুজন রিটায়ার্ড শিক্ষিকা জুটেছে ইদানীং। বর্ণালী আর মধুমিতা। পুরো দলটা হাঁটে কম, গল্প করে বেশি। আমার কর্তার মুখে তো আবার বর্ণালীদেবীর গানের বেশ প্রশংসাও শুনেছি।’

লগ্নজিতা বলল, ‘এদের মধ্যে কাউকে আপনার সন্দেহ হয় নাকি?’

সরলাদেবী ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে বললেন, ‘এতে সন্দেহের তো আর অবকাশ নেই অফিসার। খুনটা মৃন্ময়দাই করেছেন।’

ওদের কথার মাঝেই রাহুল এসে বলল, ‘অফিসার, প্লিজ আপনি মায়ের কথা শুনে তদন্ত বন্ধ করবেন না। আপনি আপনার পদ্ধতিতে তদন্ত করুন প্লিজ। মৃন্ময়কাকুকে খুনি ভেবে নেবেন না আগেই। এটা আমার রিকোয়েস্ট। আসুন অফিসার, আপনি যেগুলো চেয়েছিলেন সেগুলো সব আমি রেডি করে রেখেছি। দেখে নিন প্লিজ।’

লগ্নজিতা রাহুলের ঘরে ঢুকেই বলল, ‘চন্দ্রজার সঙ্গে আলাপ হল। মেয়েটাকে কেমন মনে হয় আপনার?’

 রাহুল নরম গলায় বলল, ‘মিশুকে মেয়ে। মৃন্ময়কাকু বাবার বন্ধু। সেই হিসাবেই পরিচয় আছে ম্যাডাম।’

লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘আমার তো মনে হচ্ছে আপনি বেশ কেয়ারিং লাভার। আপনার বাবার এই খুনের বিষয়টার মধ্যে কোনোভাবেই যাতে চন্দ্রজার নামটা না আসে তার জন্য চার বছরের প্রেমকে রীতিমতো স্বল্প পরিচিত বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।’

 রাহুল মাথা নামিয়ে বলল, ‘আমি জানি না আপনাকে মা ঠিক কী বলেছে, তবে এই মৃত্যুর জন্য চন্দ্রজা কোনোভাবেই দায়ী নয়। সত্যি বলতে কি, ও এবাড়িতে আসাই পছন্দ করত না মায়ের কারণে। মা চন্দ্রজাকে দেখলেই রেগে যায়। কারণ অবশ্য আমারও অজানা। আমার সঙ্গে সম্পর্ক আছে জেনেও অন্যত্র আমার বিয়ে দেবে বলে উঠে পড়ে লেগে যায়। সত্যি বলছি অফিসার, এই কারণ আমার কাছে অজানা। বাবাও বোধহয় জানত না। এমনিতেই বাবার এ সংসার সম্পর্কে আগ্রহ একটু কমই ছিল। বাবা নিজের কলেজ আর নিত্য নতুন বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তবুও এই একটা বিষয় বাবার নজর এড়ায়নি। বাবাও একদিন বলেছিল—’রাহুল, তোর মা চন্দ্রার সঙ্গে এত মিসবিহেভ কেন করছে? আমি প্রশ্ন করলেই তো বলবে, বেশ করেছি। তার থেকে বরং তুই ডিরেক্ট কথা বলে দেখ মায়ের সঙ্গে।’ আসলে মাকে কোনো বিষয়ে আঘাত দিতে আমার ইচ্ছে হয় না। তাই কখনও প্রশ্নটা করা হয়ে ওঠেনি। আসলে মা সব কথাতেই একটু বেশি রিঅ্যাক্ট করে ফেলে।’

 লগ্নজিতা বলল, ‘এগুলো তাহলে আপনার বাবার দলিল বা ব্যাংকের পাসবুক, তাই তো?’

রাহুল বলল, ‘হ্যাঁ ম্যাডাম। বাবা কোনোদিন বিষয়ী ছিল না। কিন্তু এসব টাকা-পয়সার বিষয়ে বাড়ির কাউকে কিছু কোনোদিন বলত না। এই গত বছর আমায় বলল—’আলমারির ওই লকারে সব রাখা থাকল। আমি যদি গবেষণার কাজে বাইরে যাই তাহলে তুই সব বুঝে নিস।’ আমি ক্যাজুয়ালি বলেছিলাম—এই বয়েসে আর বিদেশ গিয়ে কাজ নেই, এ দেশেই গবেষণা করো। হেসে বলেছিল—’কিন্তু এদেশের রেফারেন্স বইপত্র ঘেঁটেও তো এর সমাধান করতে পারলাম না। তাই ইজিপ্ট যাব ভাবছি। বুঝলি রাহুল? আমাদের পূর্বপুরুষরা খুব জ্ঞানী মানুষ ছিল। তোর দাদুর ট্রাঙ্ক ঘেঁটে এমন সব জিনিস পেলাম, যে ইজিপ্ট আমায় যেতেই হবে একবার।’ এসব ছিল বাবার এলোমেলো কথা।’

সেভিংস সার্টিফিকেটগুলো দেখতে দেখতেই লগ্নজিতা বলল, ‘একটা দশ লাখের সেভিংসের নমিনি দেখছি মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি কে? চেনেন?’

রাহুল ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না চিনি না। হয়তো বাবার কোনো আত্মীয় হবেন।’

ব্রজমোহনের বেশিরভাগ সম্পত্তির নমিনি সরলাদেবী। এই মুহূর্তে উনি কয়েক লাখ টাকার মালিক। আর বাড়িটার মালিক করা হয়েছে শুধু রাহুলকেই। এই হিসেবে চললে তো, সরলাদেবী আর রাহুলকে খুনি ধরে নিতে হয়। কিন্তু ওরা তো উত্তরাধিকার সূত্রে এমনিতেই পেত এসব সম্পত্তি।

লগ্নজিতা বলল, ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী আপনার বাবার মাথায় কেউ ভোঁতা কিছু দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করে দেয় প্রথমে, তারপর শ্বাস রোধ করা হয়।’

রাহুল বলল, ‘কিন্তু গলায় ফাঁসের দাগটা কিসের?’

লগ্নজিতা বলল, ‘খুনি শ্বাসরোধ করেছে এইভাবেই। আত্মহত্যা দেখানোর জন্য। কিন্তু এটা ঠান্ডা মাথায় মার্ডার। আপনার মা তো কনফার্ম ভাবে বলছেন, মৃন্ময়বাবুই খুনি। তাহলে এখন আপনার বক্তব্য কী?’

রাহুল অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘আপনি তদন্ত করুন ম্যাডাম। তারপর নাহয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে যদি সত্যিই মৃন্ময়কাকু খুনি হন, তাহলে আপনি তাকে শাস্তি দিন। সেক্ষেত্রে চন্দ্রজা আর আমার সম্পর্কটা যদি নাও থাকে, তবুও বাবার খুনির শাস্তি আমি চাই। ম্যাডাম, এ ব্যাপারে তদন্ত করতে যদি কিছু খরচ হয়, আমি দিতে পারি।’

লগ্নজিতা বলল, ‘সরকার মাইনে দেয় আমায়। আর এটা আমার ডিউটি।’

রাহুল একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘অফিসার, একটাই অনুরোধ। মায়ের কথার ভিত্তিতে মৃন্ময়কাকুকে অযথা বিব্রত না করাই ভালো। আসলে কাকুর শরীরটা খারাপ যাচ্ছে, চন্দ্রা একা তো!’

লগ্নজিতা বলল, ‘কিন্তু মিস্টার রাহুল, আপনার হবু শ্বশুর যদি আপনার বাবার খুনি হয় তাহলে আমি নিরুপায়। সেক্ষেত্রে উনি যত অসুস্থই হোন আমায় অ্যারেস্ট করতে হবে। আর যদি চন্দ্রজাও যুক্ত থাকে এই চক্রান্তে, তাহলে তাকেও গ্রেফতার করতে বাধ্য হবো। আমি এই ঘরটা একটু একা ভালো করে দেখতে চাই রাহুল।’

লগ্নজিতা লাইব্রেরির আনাচ-কানাচ ভালো করে দেখে নিল। তারপর বলল, ‘অযথা চন্দ্রজাদের গার্ড করবেন না। সত্যিটা আপনিও নিশ্চয়ই জানতে চান।’

রাহুল মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বলল, ‘চলুন মন্টুর সঙ্গে কথা বলবেন। যদিও সেদিনের পর থেকে একটাও কথা বলছে না ও। আসলে বাবাকে বড্ড ভালোবাসত। বাবা ওকে নিজের ছেলের মতো দেখত। বাবা চলে যেতে হয়তো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যদিও আমি বলেছি, ও সারাজীবন এ বাড়িতেই থাকবে, তবুও ট্রমা কাটাতে পারছে না কিছুতেই। শুধু দিনের একটা টাইমে এসে বাবার ঘরটার সামনে দাঁড়াচ্ছে। আপনারা যেহেতু সিজ করে তালা ঝুলিয়ে রেখেছেন তাই ঢুকতে পারছে না। জানালা দিয়ে ভিতরটা দেখছে। আর বাবার বাগানটা সুন্দর করে পরিষ্কার করে জল, সার দিচ্ছে। খাওয়াও কমে গেছে। নামমাত্র অল্প খাচ্ছে। দেখুন যদি কথা বলাতে পারেন।’

লগ্নজিতা বেশ বুঝতে পারল, ‘ব্রজমোহন নয়, এ বাড়ির সকলেরই বেশ টান আছে মন্টুর প্রতি। দীর্ঘদিন এ বাড়িতে আছে বলে হয়ত।’

ইন্দ্রজিৎ বলল, ‘ম্যাডাম, চলুন মন্টুর সঙ্গে কথা বলে আসি। ওই যে পাশের ঘরটা ওর ঘর।’

রাহুল নিয়ে যাচ্ছিল লগ্নজিতাকে। ঘরে ঢুকেই চমকে গেছে রাহুল নিজে। অবাক হয়ে বলল, ‘এই ঘরটা এমন এলোমেলো হল কখন? মন্টু…এই…মন্টু…’

মীনাক্ষী রাহুলের ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে বলল, ‘মন্টুদা তো বাগানে ছিল এতক্ষণ। এখন আর দেখতে পাচ্ছি না।’

রাহুল এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘ওই তো টেবিলে ওর সাইকেলের চাবি রয়েছে। তার মানে ও বাড়িতেই আছে কোথাও। বাইরে বেরোলে তো সাইকেল ছাড়া কোনোদিন বেরোয় না। মীনাক্ষীদি তুমি গোটা বাড়ি খুঁজে দেখো। সম্ভবত পুলিশ এসেছে জানতে পেরেই কোথাও লুকিয়েছে। ওকে গিয়ে বলো, ভয়ের কিছু নেই। ম্যাডাম দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করেই ছেড়ে দেবেন।’

মীনাক্ষী মিনিট দশেক পরে এসে খবর দিলো, মন্টুকে বাড়িতে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে পরা চপ্পল জোড়া থাকলেও বাইরে যাবার চপ্পল জোড়া বাড়িতে নেই।

রাহুল বিস্মিত হয়ে বলল, ‘মন্টু তো কথাই বলেনি কদিন ধরে। আজ হঠাৎ বাইরে গেল কেন? সাইকেল ছাড়া তো কোনোদিন বেরোতে দেখিনি।’

সরলাদেবীকে রাহুল জিজ্ঞাসা করে জানলো, উনিও তাকে বাজারে পাঠাননি। তাহলে গেল কোথায় ছেলেটা?

ইন্দ্রজিৎ ফিসফিস করে বলল, ‘ম্যাডাম, এসব এই রাহুলের চক্রান্ত। মৃন্ময়বাবুকে বাঁচানোর চেষ্টা। সরলাদেবীর সঙ্গে মন্টুও মৃন্ময়বাবুকে দেখেছিল খুন করতে, তাই রাহুল ওকে সরিয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে।’

ইন্দ্রজিতের কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। মন্টু বাড়ি থেকে উধাও কেন হল?

সরলাদেবী বেশ উচ্চস্বরেই বললেন, ‘একে তাকে না খুঁজে মৃন্ময়দাকে অ্যারেস্ট করুন। তৃষার বেলাতেও পুলিশ আমার কথা শোনেনি। তাই আজও অপরাধীরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃন্ময়দা তার মেয়েকে নিয়ে সোনাঝুরি পালাবে।’

কথাগুলো ঘরে বসেই বেশ জোরে জোরে বলছিলেন উনি। রাহুল অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, মন্টু ফিরলেই আমি আপনাকে কল করছি।’

লগ্নজিতা গাড়িতে উঠে বলল, ‘কী মনে হয় ইন্দ্রজিৎ?’ খুনের মোটিভ কী? আমার কাছে তো মারাত্মক ধোঁয়াশা লাগছে সবকিছু। যুক্তিগুলো বড্ড দুর্বল।’

ইন্দ্রজিৎ ফিসফিস করে বলল ম্যাডাম, ‘সব সকালের রোদের মতো পরিষ্কার। সরলাদেবীর চন্দ্রজাকে পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও রাহুল ওকে ভালোবাসত। ব্রজমোহনবাবু রাহুল আর চন্দ্রজার সম্পর্কটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সরলাদেবীর অমতে যেতে হবে, গৃহশান্তি নষ্ট হবে ভেবেই বন্ধু মৃন্ময়কে জানিয়েছিলেন এ বিয়ে সম্ভব নয়। তখনই মৃন্ময়ের রাগ হয়। এত দিনের সম্পর্ক, পাড়া প্রতিবেশীর কাছে সম্মান সব চলে যাচ্ছে দেখে আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেননি। আর চন্দ্রজা তো বলল, মৃন্ময়বাবুর হাই প্রেশার আছে। আর সেই কারণেই রাগের মাথায় ব্রজমোহনকে খুন করে দিল। এখন এ বাড়ির মালিক রাহুল। তার ইচ্ছেই শেষ কথা। সরলাদেবীর পক্ষে এই বয়েসে রাহুলকে বাধা দেবার ক্ষমতা নেই। তাই মৃন্ময়ের রাস্তা পরিষ্কার। মাঝে মুশকিল হয়ে গেল সরলাদেবী আর মন্টু মৃন্ময়কে দেখে ফেলল বলে। নাহলে প্রমাণ হত ব্রজমোহন আত্মহত্যা করেছে বউয়ের সঙ্গে অশান্তির জেরে। ম্যাম, আমাদের ইমিডিয়েট মৃন্ময়বাবুকে অ্যারেস্ট করা উচিত।’

লগ্নজিতা বলল, ‘বুঝলাম। কিন্তু তাহলে মৃন্ময়বাবু কেন সরলাদেবীকে খুন করলেন না? ব্রজমোহনকে খুন করা তো সহজ নয়। অত লম্বা-চওড়া একটা মানুষ। তুলনামূলক অনেক সহজ সরলাদেবীকে মেরে দেওয়া। ওনারই তো বেশি আপত্তি এই বিয়েতে। না ইন্দ্রজিৎ, গোঁজামিল দিয়ে অন্তর্বৃত্ত উপপাদ্যটা মেলানোর চেষ্টা করেছিলাম ক্লাস টেনে। শুভজিৎস্যার ধমকে বলেছিলেন, যতক্ষণ না মেলে চেষ্টা কর, নাহলে ওই সামান্য ফাঁকটুকুর জন্যও ভুল হয়ে যাবে। মিলছে না ইন্দ্রজিৎ, ঠিক মিলছে না। মৃন্ময়বাবু সরলাদেবীকে খুন না করে ব্রজমোহনকে কেন? রাহুল সব জেনেও খুনিকে খুঁজতে চাইছে কেন? অনেকগুলো ‘কেন’ ঢুকে পড়ছে ওই ফাঁকফোকর দিয়ে। এনিওয়ে ইন্দ্রজিৎ, তুমি থানায় ফিরে যাও। আমি একটা অন্য কাজে যাব।’

 ইন্দ্রজিৎ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ ম্যাডাম।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন