অর্পিতা সরকার
—ম্যাডাম, আমি এই কেসটাতে আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আসলে আপনার কেস সলভ করার পদ্ধতিটাই আলাদা। অনেক কিছু শিখতে পারি।
ইন্দ্রজিতের প্রশংসায় একটুও উত্তেজিত না হয়ে লগ্নজিতা বলল, ‘সে থাকতেই পার। তবে দুটো কাজ করতে হবে সেক্ষেত্রে। কী, কেন, কোথায় —এসব প্রশ্ন করা চলবে না। কারণ আমি উত্তর দেব না। আমি যখন তথ্য সংগ্রহ করি, তখন ঠিক কোন কারণে করছি সেটা আমি বলা পছন্দ করি না।’
ইন্দ্রজিৎ সাগ্রহে বলল, ‘প্রয়োজন নেই ম্যাডাম। আমি সঙ্গে থাকতে চাই।’
লগ্নজিতা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ওকে, চলো।’
গাড়িটা ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। রামপুরহাটের ছেলে ও। কলকাতায় চাকরিসূত্রে এলেও রাস্তাঘাট তেমন নখদর্পণে নয়। তাই গাড়িটা কোথায় যাচ্ছে ঠিক বুঝতেও পারছে না। লগ্নজিতা ড্রাইভারকে বলল, ‘ডানদিকে দাঁড় করাও।’
এতক্ষণে ইন্দ্রজিৎ বুঝতে পারল এটা সন্তোষপুর ঢোকার আগে। এখানে এই কেসের সঙ্গে যুক্ত কেউ আছে বলে তো ওর কাছে কোনো ইনফরমেশন নেই।
লগ্নজিতা বলল, ‘ ইন্দ্রজিৎ , তুমি বাইরে ওয়েট করো। আমি একজনের সঙ্গে কথা বলে আসছি।’
ইন্দ্রজিৎ উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি আসি? কৌতূহল হচ্ছে খুব।’
লগ্নজিতা হালকা হেসে বলল, ‘প্রশাসনের কাজে যুক্ত থাকলে অহেতুক কৌতূহলকে দমন করতে শিখতে হয়।’
আর না দাঁড়িয়ে লগ্নজিতা ঢুকে গেল।
ইন্দ্রজিৎ কাউকে একটা ফোন করে বলল, ‘স্যার, আমায় ভিতরে নিয়ে গেলেন না ম্যাডাম। এটা সন্তোষপুরের আশপাশে। আপনি তো বলেননি এখানে কেউ থাকে বলে।’
ওদিকের ভরাট গলা বলল, ‘শুধু ওয়াচ করতে বলেছি। কথায় কথায় ফোন করবে না।’
ইন্দ্রজিৎ ফোনটা রেখে দিয়ে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে গলিটার দিকে তাকালো। ম্যাডামের দেখা নেই।
—আসতে পারি ডক্টর? আমি লগ্নজিতা ভট্টাচার্য। কৃষ্ণেন্দুআঙ্কেল বলেছিলেন আপনার সঙ্গে আজকে দেখা করতে।
মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা। ওনার সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে যেন। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। বয়েস আন্দাজ চুয়াত্তর হবে। চুলের ভাঁজে একটাও কাঁচা চুল না দেখে লগ্নজিতা বুঝতে পারল, হোয়াইট কালার করিয়েছেন ভদ্রলোক। কৌশিকের বাবা কৃষ্ণেন্দুআঙ্কেল বলেছিলেন —রাজেনদা এখন আর প্র্যাকটিস করে না।
লগ্নজিতাকে সোফায় বসিয়ে বললেন, ‘বলুন ম্যাডাম, আমার কাছে কেন? হ্যাঁ, কৃষ্ণেন্দু আমায় আপনার বিষয়ে বলেছে, কিন্তু হঠাৎ ইন্সপেক্টরের আগমন কেন হবে আমার গৃহে তা তো বলেনি।’
লগ্নজিতা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘রাজেনবাবু, আমি আপনার একজন পেশেন্ট সম্পর্কে একটু জানতে চাই।’
ডক্টর রাজেন চৌধুরী অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে একটু মেপে নিলেন লগ্নজিতাকে। তারপর বললেন, ‘কেস হিস্ট্রি দিন। যদি মনে করতে পারি। কম রোগী তো দেখলাম না জীবনে। তাই ওভাবে তো মনে রাখা সম্ভব নয়।’
ডাক্তারবাবুর গলায় একটু সতর্কতা লক্ষ করল লগ্নজিতা। কিছু করার নেই, ওদের পেশাটাই এমন—কেউ প্রাণখুলে কথা বলবে না। তার মধ্যে থেকেই প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে। লগ্নজিতা সরলাদেবীর কেস হিস্ট্রির ফাইলটা বের করে বলল, ‘দেখুন।’
রাহুলকে রীতিমতো প্রেশার দিয়েই এই ফাইলটা বের করেছে লগ্নজিতা। রাহুল তো মায়ের কোনো মানসিক সমস্যা আছে সেটাই স্বীকার করতে চাইছিল না, কারণটা যদিও অজানা। ওর মা মানসিকভাবে অসুস্থ এটা লুকিয়ে রাখার কারণ কী? ডাক্তারবাবু ফাইলটা ঘেঁটে চলেছেন।
লগ্নজিতা কৌশিকের মায়ের পুরোনো অ্যালবাম খুলে বলল, ‘দেখুন তো মুখটা দেখলে চিনতে পারেন কিনা!’
রাজেন চৌধুরী অ্যালবাম দেখার আগেই বললেন, ‘হ্যাঁ, সরলাকে বহুদিন ধরে চিনি। ও যখন ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট,তখন থেকে। তখন ওর বয়েস কত? উনিশ-কুড়ি হবে। যাকে বলে অসাধারণ সুন্দরী। চোখ ফেরানো দায়। একদিন আমার চেম্বারে ঢুকেই বলেছিল,—’ডাক্তারবাবু ভালোবাসা কি অপরাধ?’
আমি বলেছিলাম—’ভালোবাসা অপরাধ কেন হবে? ওই একটা অনুভূতি আরও কত কত অনুভূতির সৃষ্টিকর্তা। ভালোবাসা থেকেই বিশ্বাস, বিশ্বাসভঙ্গ, বিরহ, অভিমান, অনুযোগ, ভরসা, অধিকারবোধ—কতকিছুর জন্ম হয়।’ তখন ও বলেছিল,—’আমার একটাই অনুভূতির জন্ম দিয়েছে ভালোবাসা। সেটা হল আক্রোশ। অপমান, অবহেলার আক্রোশ। ডাক্তারবাবু আমি একজনকে খুন করতে চাই।’ ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলাম—ওর ওই সরল মুখের আড়ালে, আরেকটা মুখ আছে। যেটা প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারে না কিছুতেই। কেউ প্রত্যাখ্যান করলে, ও তাকে শেষ করে দেবে—এমনই মনোভাব ছিল। ওষুধ শুরু হল, শুরু হল কাউন্সিলিং। একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছিল সরলা। কিন্তু হঠাৎই আবার ওর মাথায় ভর করল, মৃন্ময়ের প্রত্যাখ্যানের আক্রোশ। দুর্দান্ত নাটক করত, গান গাইতো ভালো, কবিতা বলতো শোনার মতো। কিন্তু ওই এক সমস্যা মৃন্ময়কে না পাওয়া। শেষে মৃন্ময়ের সঙ্গে আমি কথাও বললাম, খুবই ভদ্র ছেলে। কিন্তু সে একটি মেয়েকে ভালোবাসত। আর সরলাকে স্নেহ করলেও, প্রেম নয়। মৃন্ময় নাটকের দল ছেড়ে দিল সরলার কারণেই। তখন শুরু হল মৃন্ময়কে রোজ দেখতে না পাওয়ায় আক্রোশ। তারপরে ব্রজমোহনের মতো বয়েসে বড় প্রফেসরকে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল।
পরে বুঝেছিলাম, মৃন্ময়ের পাড়াতেই বিশাল বাড়ি ব্রজমোহনের। সত্যি বলতে কী সরলা আমার ডাক্তারি জীবনে দেখা সবচেয়ে জটিল কেস। সাতদিন সুস্থ থাকতো তো দশ দিন অসুস্থ। অসুস্থ মানে শারীরিকভাবে নয়। মানসিকভাবে, যেটা সাধারণ মানুষ সাদা চোখে বুঝতে পারে না।’
লগ্নজিতা বলল, ‘স্যার, একটা প্রশ্ন করব? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড?’
রাজেন চৌধুরী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘করুন।’
‘আপনি সরলাদেবীকে প্রোপোজ করেছিলেন?’
একটু থমকে গিয়ে ডক্টর বললেন, ‘আপনাকে এই খবরটা কে দিয়েছে? সরলা?’
লগ্নজিতা অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘না, মানে জানি—উনি মিথ্যে বলেছিলেন। সরি।’
রাজেনবাবু হেসে বললেন, ‘সরলা মিথ্যে বলেনি। আমি ওকে প্রোপজ করেছিলাম। জানতাম ও রিফিউজ করবে। আমি তখন মধ্যবয়স্ক, বিবাহিত ডাক্তার। আর ও সদ্য কলেজের তরুণী। কিন্তু এটা আমার চিকিৎসার অঙ্গ ছিল। ও আমায় প্রত্যাখ্যান করেছিল। আমি ওকে বুঝিয়েছিলাম, প্রত্যাক্ষিত হয়েও আমি ওকে খুন করব না। বুঝেছিল কিছুদিন। কিন্তু ওই যে অদ্ভুত মানসিক গঠনের জন্য কিছুতেই সুস্থ করা যায়নি ওকে। বিয়ের পর সুস্থ ছিল কিছু বছর। ব্রজমোহন মানুষটি রাশভারী, বিদ্যান মানুষ। তাই হয়তো নতুন পরিবেশে গিয়ে চেষ্টা করেছিল নতুনভাবে গুছিয়ে নেবার। কিন্তু তৃষার আকস্মিক মৃত্যুর পর আবারও পুরোনো রোগটা তীব্রতর হয়ে ওঠে। ব্রজমোহন আমার কাছে নিয়ে আসে সরলাকে। যেহেতু আমি ওর অগ্রপশ্চাৎ জানি, তাই বুঝতে পেরেছিলাম—আবারও সেই পুরোনো সরলা ফিরে আসছে ওর মধ্যে।’
লগ্নজিতা বলল, ‘তৃষা কে? কীভাবে মারা গিয়েছিল?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজেনবাবু বললেন, ‘তৃষা সরলার প্রথম সন্তান। রাহুল তারপর। তৃষার বিএসসি এক্সামের পরে ওরা বেড়াতে গিয়েছিল। ওখানেই বোধহয় একটা ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তৃষার। সেখান থেকেই প্রেম। প্রেমের বয়স কত ছিল আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে ওর সেই প্রেমিক আর তার সঙ্গী সাথীরা একদিন গ্যাং রেপ করেছিল তৃষাকে। মেয়েটা মাত্র একুশেই মারা যায়। বহুদিন পুলিশ কেস চলেছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে রেপিস্টদের কিছু হয়নি। তারপর থেকেই গোটা পুরুষজাতির প্রতি, প্রেম, সম্পর্কের প্রতি তীব্র বিরক্তি দেখা দিয়েছিল সরলার। ব্রজমোহনকে সহ্য করতে পারতো না। ওকে আলাদা ঘরে থাকতে হত। ব্রজমোহনকে বেশ কয়েকবার মেরে ফেলতেও চেয়েছে সরলা। আমার দেওয়া ওষুধ খেত না। পুরুষ বলে আমায় সহ্য করতে পারত না। ব্রজমোহনের মতো সজ্জন ব্যক্তি সরলার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। মেয়ে হারানোর শোকের থেকেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক ছিল সরলার মানসিক অত্যাচার। ব্রজমোহন নিজের কাউন্সিলিংয়ের জন্য এসেছিল আমার কাছে। অমন ধীরস্থির মানুষটাও উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল কথায় কথায়। আসলে সরলার মতো রোগী যাদের বাড়িতে আছে তাদের নিত্যদিনের জীবন দুর্বিষহ হতে বাধ্য। ব্রজমোহন দিন দিন নিজের কাজ আর পড়াশোনার মধ্যে আরও বেশি করে নিমজ্জিত হয়ে গেল। সরলা তখন একাকিত্বে ভুগছে। রাহুল বোধহয় উচ্চমাধ্যমিক পড়ে তখন। পুরুষ বলে নিজের ছেলেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছিল সরলা। রাহুলের খাওয়া দাওয়ার প্রয়োজনে কোনো মেইডকে বাড়িতে রাখলেও, তিনদিনে সরলা তাকে তাড়িয়ে দিত দুর্নাম দিয়ে। সে এক অসহনীয় অবস্থা। ব্রজমোহন অনেক চেষ্টা করেও আমার কাছে ওকে আনতে ব্যর্থ হয়েছিল। আমিই তখন ওকে আমারই কৃতিছাত্রী মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। মেঘবালা মানুষের মনের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। রোগী ওকে ভীষণ আপন ভাবে। সরলাও বশ হয়েছিল মেঘবালার কাছে। যা আমি পারিনি মেঘবালা করে দেখিয়েছে। সরলাকে প্রায় সুস্থ করে তুলেছিল। তৃষাকে ধীরে ধীরে ভুলেছিল। তবে পুলিশের ওপর ওর খুব রাগ। যেহেতু তৃষার কেসটা জাস্টিস পায়নি, তাই পুলিশের ইউনিফর্ম দেখলেই সরলা রেগে যায়।’
লগ্নজিতা বলল, ‘এবারে আপনাকে আসল কারণটা বলি ডক্টর। ব্রজমোহনবাবু খুন হয়েছেন। লোকে আত্মহত্যা বললেও, বিষয়টা আসলে খুন। তার সব প্রমাণ আমি পেয়েছি।’
ডক্টর রাজেন চৌধুরী বলে উঠলেন, ‘ও মাই গড! বহু বছর আর খোঁজ পাইনি আমি ওদের। মেঘবালা মাঝে জানিয়েছিল ওরা ভালো আছে। ইনফ্যাক্ট ব্রজমোহনও সুস্থ আছে।’
লগ্নজিতার ভ্রু কুঁচকে গেছে ইতিমধ্যেই,—’ব্রজমোহনবাবু অসুস্থ ছিলেন নাকি?’
রাজেনবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। তবে মেঘবালার ট্রিটমেন্টে সুস্থ হয়ে ওঠেন।’
ডক্টর রাজেন চৌধুরী এবারে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘অফিসার, আমার আর কিছু জানা নেই এ সম্পর্কে। দয়া করে আর প্রশ্ন করবেন না।’
লগ্নজিতা বলল, ‘স্যার, আপনি অভিজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট। এটুকু বলুন, সরলাদেবীর মধ্যে খুন করার সাহস ছিল?’
রাজেনবাবু হেসে বললেন, ‘এটা আপনাকে কে বলল ম্যাডাম যে খুন করার জন্য সাহসের প্রয়োজন হয়? খুনের জন্য সাময়িক উত্তেজনার প্রয়োজন। যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে নিজের সংযম হারিয়ে ফেলতে পারে। মানসিক সংযম হারিয়ে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে যে কেউ খুন করতে পারে। তাই সাহস নয়, সাময়িক উত্তেজনার প্রয়োজন—যাতে সে বেসামাল হয়ে পড়ে। সুতরাং সরলার মধ্যে সাহস ছিল কি নেই সেটা আলোচ্য বিষয় নয়। বিষয়টা হল, কেন সরলা এত বছর পরে খুন করবে ব্রজমোহনকে? আপনি আগে মোটিভ খুঁজে বের করুন অফিসার।’
লগ্নজিতার কাজকে কেউ প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখে ফেলে দিলে ভিতরে ভিতরে অসন্তুষ্ট হয় ও। তবুও সামলে নিয়ে বলল, ‘সেই জন্যই তো আপনাদের কাছে আসা। সব সুতোগুলোকে এক জায়গায় বাঁধতে না পারলে এ রহস্যের সমাধান খুব মুশকিল। স্যার, প্রয়োজনে ফোন করতে পারি। আশা করি সাহায্য পাবো।’
রাজেনবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘রাত দশটার আগে করবেন। দশটার পরে আমি আর কল রিসিভ করি না। আর একটা কথা—মেঘবালার সঙ্গে যখন কথা বলবেন, আমার রেফারেন্স টেনে কথা বলবেন না। ওকে ওর পেশেন্টদের বিষয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করবেন। তাতেই আপনার বেশি উপকার হবে। প্রতিটা ডাক্তারের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। মেঘবালার দৃষ্টিতে ব্রজমোহন বা সরলাকে চিনতে সুবিধা হবে আপনার।’ একটা পায়ের ওপরে তুলে রাখা আরেকটা পাকে বন্ধন মুক্ত করে মাটিতে নামিয়ে রেখে রাজেনবাবু পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন, ‘আজ আসুন।’
ভঙ্গিমাটা লগ্নজিতার চেনা। ইনফ্যাক্ট পুলিশদের চেনা। আর সময় ব্যয় না করে ওনার ইঙ্গিতকে শিরোধার্য করে উঠে দাঁড়ালো লগ্নজিতা। গাড়িতে উঠতেই ইন্দ্রজিতের বেশ কিছু প্রশ্ন একসঙ্গে ধেয়ে এলো।
—ম্যাডাম, এখানে কার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন? কোনো ক্লু পাওয়া গেল?
লগ্নজিতা তখন ভাবনার জগতে বিচরণ করছে। ব্রজমোহন ডিপ্রেশনের ওষুধ খেত? এ কথা রাহুল কেন স্বীকার করল না? মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রজমোহন আর সরলার সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়া সত্ত্বেও রাহুল কেন তাকে চিনতে অস্বীকার করল? নিজের লেখা বই ব্রজমোহন তার ডাক্তারকে উৎসর্গ করতেই পারে, কিন্তু ব্রজমোহনের একটা সেভিংসের নমিনি কেন মেঘবালা? মেঘবালার কি অর্থসংকট আছে? মেঘবালা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন রাহুল ‘হয়তো কোনো আত্মীয়’ বলে এড়িয়ে গেল?
প্রেসক্রিপশনের ফাইলটা আরেকবার ঘেঁটে ফেললো লগ্নজিতা। মেঘবালা ছাড়াও আরেকজনের নাম পাচ্ছে এখানে। ডক্টর সুবিমল মিশ্র। এনার একটাই প্রেসক্রিপশন রয়েছে এখানে। তাও বছরখানেক আগের। তাহলে কি একবারই দেখানো হয়েছিল সরলাদেবীকে এনার কাছে?
রাহুলের এত গোপনীয়তা বড্ড সন্দেহজনক।
লগ্নজিতার চিন্তার মধ্যেই ইন্দ্রজিৎ বলল, ‘ম্যাডাম, আজ একটা খবর পেলাম। রাহুল চন্দ্রজার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। না, বাড়িতে যায়নি। রাস্তার মোড়ে দেখা করেছে। হাতে একটা ছোট্ট কিছু দিয়েওছে। তারপর ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে, কারণটা জানা নেই ম্যাম। দুজনেই ফিরে গেছে বাড়ি।’
লগ্নজিতার অবশ্য মনে পড়ল না ইন্দ্রজিৎকে কখন নির্দেশ দিয়েছিল রাহুলকে ফলো করার জন্য। তবুও বলল, ‘কাকে ফলো করছিলে? রাহুলকে না চন্দ্রজাকে?’
ইন্দ্রজিৎ বলল, ‘এদের ফলো করিনি ম্যাডাম। মৃন্ময়বাবুর বাড়ির বাইরে একজনকে রেখেছি। সেই চন্দ্রজাকে বেরোতে দেখে ফলো করেছিল। আসলে কেন জানি না মনে হচ্ছে ব্রজমোহনকে খুনের পিছনে একজনের মোটিভ সব থেকে ক্লিয়ার—সেটা মৃন্ময়বাবু। ওনার মেয়ের সঙ্গে রাহুলের বিয়েতে সরলাদেবী রাজি ছিলেন না। ব্রজমোহন প্রথমে রাজি থাকলেও পরে আপত্তি জানিয়েছিল স্ত্রীর কথা ভেবে। এদিকে মৃন্ময়বাবুর বাড়িতে রাহুলের যাতায়াত ছিল। গোটা পাড়া, আত্মীয়স্বজন—সবাই জানে ওদের বিয়ে হবে। এই অবস্থায় চক্রবর্তী বাড়ির সবাই বিয়েতে আপত্তি জানালে, মৃন্ময়বাবু মাথা গরম করে উত্তেজিত হয়ে ব্রজমোহনকে খুন করে বসে। খুন হয়তো করতে চায়নি, সাময়িক উত্তেজনার বশে করে দিয়েছে। মন্টু ওকেই খুন করতে দেখেছিল, তাই অবাক হয়ে গিয়ে চুপ করে ছিল। সরলাদেবী ওনাকে বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরোতে দেখেন। মন্টু যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী, তাই ওকে খুন করে দিল মৃন্ময়বাবু। হিসেবটা খুব সহজ ম্যাডাম। আপনি যত দিকেই অভিমুখ ঘোরানোর চেষ্টা করুন না কেন, মৃন্ময়বাবুর দিকেই সন্দেহের তীর আটকে আছে। খুনটা যে প্রফেশনাল খুনি করেনি সেটা তো পোস্টমর্টেম করে বলেই দিয়েছে ডক্টর। মাথার পিছনের সজোরে আঘাত। তারপর অজ্ঞান অবস্থায় শ্বাস রোধ করে মারা হয়েছে। মানে কোনো অস্ত্র দিয়ে মারা হয়নি। ছা-পোষা মানুষ আচমকা উত্তেজিত হয়ে যে খুনগুলো করে ফেলে সেগুলোই আরকি।’
একটু আগেই রাজেনবাবুর বলা কথাটা লগ্নজিতার মাথায় ঘুরপাক খেলো, ‘খুন মানুষ সাময়িক উত্তেজনার বশে করে, সবাইকে পেশাদার খুনি হতে হয় না।’
লগ্নজিতা বলল ‘তারপর? মৃন্ময়বাবুর ঠিক কী গতিবিধি দেখতে পেলে তুমি? রাহুল-চন্দ্রজার প্রেম-বিরহের কাহিনী বাদ দিয়ে নতুন কোনো তথ্য?’
ইন্দ্রজিৎ বলল, ‘আছে ম্যাডাম। গতকাল বিকেলে মর্নিংওয়াক বাহিনী মৃন্ময়বাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। কারণটা হল, ব্রজমোহন মারা যাবার পরে মৃন্ময়বাবু আর প্রাতঃভ্রমণে যাচ্ছেন না। কিন্তু আসার দশ মিনিটের মধ্যে রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন বাসুদেববাবু। বাইরে বেরিয়েই ফোন করলেন কাউকে একটা। বলতে লাগলেন—মৃন্ময় ডাহা মিথ্যে বলছে ব্রজমোহনের বাড়িতে যাওয়া নিয়ে। প্রায় আধঘণ্টা থেকে পুরো দলটা বেরিয়ে এলো। চন্দ্রজা বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওর দুই ম্যাডামের সঙ্গে খুব নীচু গলায় কিছু একটা আলোচনা করছিল। সেটা আমার ইনফরমার শুনতে পায়নি।’
ইন্দ্রজিতের মুখে বেশ একটা গর্বের হাসি দেখেই লগ্নজিতা বলল, ‘তুমিই তো তাহলে কনক্লুশন টেনে দিলে, ব্রজমোহন হত্যা রহস্য তো সমাধান করেই দিলে তুমি।’
ইন্দ্রজিৎ একটু গর্বের সঙ্গে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে থেকে এটুকু বুদ্ধি খুলেছে মাত্র।’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘তোমার ইনফর্মারকে বলো মৃন্ময়বাবুর বাড়ির সামনে থেকে চলে আসতে। বরং ব্রজধামের সামনে একজনকে বসানোর ব্যবস্থা করো।’
লগ্নজিতা থানায় ঢুকে গেল।
ফোনটা রিসিভ করে ইন্দ্রজিৎ বলল, ‘স্যার, মৃন্ময়বাবুই খুনি এটা কিছুতেই মানতে চাইছেন না ম্যাডাম। ওনার বাড়ির সামনে থেকে ইনফর্মারকে সরিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। কী ভাবছেন সেটাও তো ওনার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না। ইয়েস স্যার, আমি নজর রেখে যাচ্ছি। তবে ম্যাডাম সর্বত্র আমায় নিয়ে যেতে চাইছেন না।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন